আগাথা ক্রিস্টির গল্প নিয়ে গোয়েন্দা ধাঁধা
ভাঙা দেউলের খুনি প্রতিমা। মিস্ মাপল
ক্লাবের নাম টুইসডে নাইট ক্লাব। উদ্দেশ্য–রহস্য গল্প বলা এবং তার সমাধান করা। সেদিন গল্প বলেছেন পাদ্রী পেনডার।
ডার্টমুর জায়গাটা রহস্যময়, ভয়ঙ্কর অথচ সত্যিই দর্শনীয়। ডার্টমুরের প্রান্তে বেশ খানিকটা জায়গা জমি কিনলেন স্যার রিচার্ড হেডন। প্রাসাদের পাশেই প্রস্তর যুগের সারি-সারি গুহা, দিগন্তবিস্তৃত জলাভূমি এবং জঙ্গলাকীর্ণ পর্বতশ্রেণি।
এই বাড়িতেই একদিন একটা পার্টি দিলেন স্যার রিচার্ড। অনেকেই এলেন সেখানে– অভ্যাগতদের মধ্যে রইল মিস ডায়না–ডাকসাইটে সুন্দরী।
সবাইকে নিয়ে স্যার রিচার্ড গেলেন প্রস্তরযুগের গুহা অঞ্চলে। নিওলিথিক কুঁড়ে দেখিয়ে বললেন–এ জায়গার নাম সাইলেন্ট গ্রোভ।
সাইলেন্টই বটে। থমথম করছে চারিদিক। নির্জন, নিস্তব্ধ। এবড়োখেবড়ো পাহাড় ন্যাড়া ন্যাংটা। আর কিছু নেই।
অদূরে অনেকগুলো গাছ মাথা ঠোকাঠুকি করে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকদিনের মরা গাছ– নতুন করে পুঁতে রাখা হয়েছে শুধু মাঝের দেউলটাকে ঘিরে রাখার জন্যে।
ভাঙা দেউল। ফোনিসিয়ানদের ডাকিনী মন্দির। মন্দিরে পাথরের প্রতিমা। মনে হয় যেন জীবন্ত। মাথায় জোড়া শিং।
গা শিরশির করে উঠল অভ্যাগতদের। মেয়েরা ভয় পেল। পুরুষরাও স্বীকার করলে– জায়গাটা অভিশপ্ত। যেন একটা অশুভ শক্তি প্রচ্ছন্ন রয়েছে এখানকার বাতাসে। পরিবেশ মোটেই সুবিধের নয়।
মিস ডায়না কিন্তু লাফিয়ে উঠে বললে–তাই কি হয়? আসুন আজ চঁদনী রাতে সবাই মিলে নাচগান করি–দেবীপ্রতিমার সামনে।
রোমাঞ্চিত হল সবাই। রাজিও হল।
প্রাসাদের হলঘরে খাওয়ার টেবিলে সব শেষে হাজির হল মিস ডায়না। এসে দেখলে তার মন জোগাতে প্রত্যেকেই অদ্ভুত সাজে সেজে এসেছে। স্যার রিচার্ড প্রস্তরযুগের গুহাবাসী সেজেছেন– তার খুড়তুতো ভাই জংলি সর্দারের ছদ্মবেশ নিয়েছেন। লেডি ম্যানারিং সেজেছেন হাসপাতালের নার্স তার মেয়ে হয়েছেন হারেমের বাঁদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফুর্তিতে নেচে উঠে মিস ডায়না বললে–চলুন বেড়িয়ে আসা যাক।
বাইরে চাঁদের আলো। মায়াময় পরিবেশ। অভ্যাগতরা সকলেই ফুর্তি উচ্ছল। হঠাৎ দেখা গেল মিস ডায়না নেই।
শুতে গেল নাকি? বললেন স্যার রিচার্ড।
না-না। মন্দিরের দিকে যেতে দেখেছি, বললেন ভায়োলট ম্যানারিং।
এত রাতে মন্দিরের দিকে? ভুরু কুঁচকোলেন স্যার রিচার্ড। মতলবটা বোঝা যাচ্ছে না তো। ডাইনি সাজবে নাকি?
মন্দিরের দিকে রওনা হলেন সবাই। দূর থেকেই দেখা গেল ভয়াবহ সেই দৃশ্য।
মন্দিরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে অপার্থিব একটি মূর্তি। সারা দেহ চকচকে বস্তুতে আচ্ছাদিত। মাথায় একজোড়া সিং।
প্রতিমা কি জাগ্রত হয়েছে?
ডায়না! ডায়না! তীক্ষ্ণস্বরে বললেন ভায়োলেট।
মেয়েদের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। ভায়োলেট ঠিকই চিনেছেন। ডায়নাই বটে।
ভীষণা দেবীর মতোই চন্দ্রকিরণে দাঁড়িয়ে অকম্পিত দেহে—
ডায়না! চমকে উঠলেন স্যার রিচার্ড! অন্যরকম মনে হচ্ছে না?
দাওয়ায় দাঁড়িয়ে এক হাত শূন্যে তুলল ভয়ংকরী!
বলল–আমি এ মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কাছে এসো না। আমার হাতে মৃত্যু।
সর্বনাশ! হেসে উঠে বললেন স্যার রিচার্ড। কী ছেলেখেলা জুড়েছ, ডায়না। বলেই পা বাড়ালেন সামনে।
এগিয়ো না, এগোলেই মরবে।
হাঃহাঃহাঃ। খুব ভয় দেখাচ্ছ দেখছি।
বারণ করছি আর এগিয়ো না। আমার হাতে মৃত্যু।
ছুটে গেলেন স্যার রিচার্ড।
সহসা শূন্যে উত্থিত হাতটা নামিয়ে আনল মিস ডায়না–সঙ্গে-সঙ্গে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন স্যার রিচার্ড। আর নড়লেন না।
দৌড়ে গেল তার খুড়তুতো ভাই ইলিয়ট হডন। হাঁটু গেড়ে বসে চিৎ করে শোয়াল দাদাকে।
পরক্ষণেই দাঁড়িয়ে উঠে বললে–ডাক্তার ডাকুন। দাদা মারা গেছেন।
স্যার রিচার্ডের বুকে ছুরি মারার চিহ্ন।…রক্ত…কিন্তু ছুরি নেই কোথাও।
পুলিশ এল। মাথা নেড়ে বললে অসম্ভব! অশুভ প্রেতাত্মা এসে ছুরি মেরে গেল।
তাই কি হয়?
সমস্ত রাত কারও ঘুম হয় না। স্যার রিচার্ডকে সত্যি সত্যিই মরতে দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল ডায়না। ডাক্তার তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে পুলিশ তাকে জেরা না করা পর্যন্ত কোনও কথা বলতে রাজি নয়।
সবচেয়ে আশ্চর্য! ছুরিটা কোথায়? অভ্যাগতদের মধ্যে কেউ বললে, ডায়নার হাতে সত্যিই যেন কী চকচক করে উঠেছিল। কেউ বললে, চোখের ভুল। সত্যিই ডায়নার হাতে কিছু দেখা যায়নি। ক্ষতস্থানেও নয়।
ছুরিটা খুঁজে বের করার জন্যেই ইলিয়ট হেডন ফের গিয়েছিল মন্দিরচত্বরে। ভোররাতেও তাকে ফিরতে না দেখে টনক নড়ল প্রত্যেকের। পাদ্রী সাহেবের ওপর ভার পড়ল তাকে খুঁজে আনার।
একজন সঙ্গী নিয়ে পাদ্রী গেলেন অকুস্থলে। স্যার রিচার্ডের লাশ আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঠিক সেই জায়গায় মুখ থুবড়ে পড়ে আরও একটা দেহ।
ইলিয়ট হেডন। তখনও নিসে পড়ছে। কাঁধে বিঁধে আছে একটা ছুরি।
জ্ঞান ফেরার পর ইলিয়ট যা বলল তা সত্যিই রোমাঞ্চকর। মন্দিরের সামনে পৌঁছনোর পর থেকেই কেন জানি তার মনে হচ্ছিল কে যেন তাকে প্যাট-প্যাট করে দেখছে গাছের আড়াল থেকে।
আচমকা কীসের আঘাত লাগল রগের ওপর। মাথা টলে পড়ে যাওয়ার সময়ে একটা ছুরি উড়ে এসে গেঁথে গেল কাঁধে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
গল্প শেষ হল। ক্লাবের কেউ বললে ডায়নাই খুনি। অপরজন বললে–দূর! ডায়না স্যার রিচার্ডের কাছেই আসেনি। দূর থেকে ছুঁড়ে মেরেছে? বেশ বেশ ছুরিটা কি হাওয়ায় গলে মিলিয়ে গেল? অন্য এক সদস্য বললে–গাছের আড়ালেই কেউ লুকিয়ে ছিল। ইলিয়ট নিজেও তা টের পেয়েছে। বুকে ছুরি নিয়ে পড়ে যাওয়ার সময়ে হাতের টানে ছুরি টেনে নিয়ে নিশ্চয় দূরে ফেলে দিয়েছিলেন স্যার রিচার্ড। সেই ছুরি দিয়েই হত্যাকারী খতম করতে চেয়েছে তার খুড়তুতো ভাইকে।
মিস মার্পল বললেন–তোমাদের মাথা আর মুণ্ডু।
আর কী বললেন বলুন তো?
.
গোয়েন্দা ধাঁধার সমাধান
মিস মার্পল বললেন–তোমাদের মাথা আর মুণ্ডু। মেয়েছেলে দেখলেই সব ব্যাটাছেলেই কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে ছোটে। স্যার রিচার্ডও রূপে পাগল হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন সামনে নিশ্চয় হোঁচট খেয়েছিলেন গাছের শেকড়ে। মাথা ঠুকে বেহুঁশ হয়ে যেতেই সবার আগে একজনই গিয়েছিল তার কাছে খুড়তুতো ভাই ইলিয়ট। তার পরনে জংলি সর্দারের পোশাক। তার মানে কোমরে গোটা চার পাঁচ ছুরি থাকা আশ্চর্য নয়। বেঁকের মাথায় চট করে খুন করে ফেলে দাদাকে সম্পত্তির লোভে, উপাধির লোভে, ডায়নার লোভে। বুকে ছুরি বিধিয়েই লুকিয়ে ফেলে বেল্টের মধ্যে। পরে নিজের কাঁধেই ছুরি মেরে সাধু সাজতে চেয়েছিল। প্রেমের আগুনে পুরুষ-পোকারা পুড়ে মরে এইভাবেই।
* সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় প্রকাশিত। ১৪ চৈত্র, ১৩৮১।