1 of 2

শনিবারের মড়া

শনিবারের মড়া

নারায়ণী গোয়েন্দানীর এই তেরোতলার অফিসঘর থেকে পাতালরেলের খোঁড়াখুঁড়ি দেখা যায়। এ ঘরের পুরো পশ্চিমের দেওয়ালটা অদ্ভুত পুরু কাঁচ দিয়ে তৈরি। পশ্চিমে যখন সূর্য অস্ত যায় গঙ্গার ওদিকে, কালচে কাঁচ পড়ন্ত রোদ্দুরকে ফিলটার করে ঘরে ঢোকায়। পুরো ঘরখানায় তখন গোধূলির রহস্য ভাসতে থাকে। দিনের বেলায় এ ঘরে নকল আলোর দরকার হয় না। সূর্য তার আলো পাঠান কালচে কাঁচের মধ্যে দিয়ে। মোটা পরদা দিয়ে ইচ্ছে করে খানিকটা কাঁচ ঢেকে রেখে দেয় নারায়ণী গোয়েন্দানী–যাতে বেশি আলো চোখের মধ্যে দিয়ে ঢুকে মাথা গরম না করে দেয়।

নারায়ণী গোয়েন্দানীর চোখ দুটো অবশ্য বেশ বড়ই–জগতের আলো আর অন্ধকার দুটোই একটু বেশি করে ঢুকে পড়ে–চোখের সুড়ঙ্গ দিয়ে পৌঁছয় মগজে। সমাজের ওপরমহল আর নিচের মহল–দুটো মহলের খবর রাখে। রাঘববোয়াল আর চুনোপুঁটি–সব্বাই তাই তাকে যমের মতো ভয় পায়।

কারণ, নারায়ণী গোয়েন্দানী রহস্যের কিনারা করে দেয় বটে কিন্তু সোজাপথে করে না। এক পয়সা দক্ষিণাও নেয় না। আইন-টাইন কিছু মানে না। উঁচবুদ্ধি, গণ্ডারের গোঁ, সিংহের সাহস, আর হাতির শক্তি নিয়ে ও বদমাশ ঘায়েল করে, ষড়যন্ত্র ছিন্নভিন্ন করে, ছদ্মবেশীর মুখোশ ছিঁড়ে উড়িয়ে দেয়–গরিবকে বাঁচায়, অত্যাচারের অবসান ঘটায়।

হ্যাঁ, এতগুলো গুণের সঙ্গে আরও একটা উপাদান ও মিশিয়ে দেয় কাজ উদ্ধারের সময়ে। ওর রূপ। শান্তশিষ্ট অবস্থায় মা লক্ষ্মী বলে মনে হয় বটে, কিন্তু রণক্ষেত্রে যখন নামে, তখন ওর বড়-বড় চোখ দুটো দিয়ে ধকধক করে আগুন ছিটকোয়, তখন ওর দশবাই চণ্ডীরূপ দেখে মূৰ্ছা যেতে পারলে বেঁচে যায় কুটিলকরাল কুচক্রীরা।

মানুষ গড়ার কারিগর নারায়ণী গোয়েন্দানীকে বানিয়েছিলেন আরও অনেক বিচিত্র উপকরণ দিয়ে। সেসব একটু-একটু করে প্রকাশ পাবে। হাতির মতো বিরাট দেহ তো ওর নয়–ছিপছিপে হিলহিলে যেন এক নাগিনী। কিন্তু ক্যারাটে ফ্যারাটে শিখে একাই দশজনের মহড়া নিতে পারে। অবিশ্বাস্য বেগে ঘুরতে থাকে তখন ওর মা লক্ষ্মীর মতো বডিখানা–শত্রুদের হাড়গোড় ভেঙে পঙ্গু করে দেয় চক্ষের নিমেষে।

কলকাতা এখন একটা আজব জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা দেশটাই তাই হয়েছে– কলকাতার আর দোষ কি। এ দেশে এখন যে যত কুকর্ম করতে পারবে–সে তত শিরোপা পাবে। কুকাজের অবসান ঘটানোর জন্যে অলিতে-গলিতে এখন ডিটেকটিভরা দোকান খুলে বসেছে। কেউ বলছে আমি গোমেশ গোয়েন্দা। এরা যে-যার পাড়ার রহস্যসন্ধানের ব্যবসায় নেমেছে।

নারায়ণী গোয়েন্দানী কিন্তু ব্যবসা-ট্যবসা বোঝে না। ও স্রেফ ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। যেহেতু গোঁফ দেখলেই ও শিকারি বেড়াল চিনতে পারে–তাই ওর হাতে রক্ষে নেই দুর্জনের।

আজব শহর কলকাতায় ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটাতেই আবির্ভূত হয়েছে গোয়েন্দানী নারায়ণী। অপকর্ম দিয়ে অপকর্মের অবসান ঘটাতে তার তিলমাত্র অরুচি নেই। এইসব কারণেই তার কীর্তিকাহিনি লিখতে চাইনি এতদিন। হয়তো অপকর্মকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়ে যাবে। কিন্তু উদ্দেশ্য যখন সাধু হয়, তখন…

নারায়ণীর মতো রূপসী মেয়ে সচরাচর চোখে পড়ে না। কিন্তু বিখ্যাত সেই প্রবাদের মতো তার রূপ নয়। প্রবাদটা যাঁদের এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, তাঁদের অবগতির জন্যে জানাই ।

ইষ্টকালয়, শ্যামা নারী, বটচ্ছায়া, কৃপাবারি।

এইসব কে না চায়? ইটের বাড়ি, কালো মেয়ে, বটের ছায়া আর দয়ার দান।

নারায়ণী কিন্তু এই ফরমুলায় পড়ে না। সে মোটেই কালো নয়, অথচ তাকে দেখলেই সব পুরুষই ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে। তার গায়ের রঙটা কীরকম জানেন? এরকম গাত্রবর্ণ শুনেছি নাকি শুধু রূপকথার রাজকন্যেদেরই থাকে। প্রথম পরিচয়ের সময়ে আমি কিন্তু নারায়ণীর গায়ের রং দেখে ফস করে বলে ফেলেছিলাম, এক বাটি দুধে একটু আলতা মিশিয়ে দিয়ে গায়ে মেখেছেন নাকি?

নারায়ণী তখন ওর দাঁতের ঝিলিক দেখিয়ে বলেছিল (দাঁত তো নয়, কোথায় লাগে সিংহলী মুক্তো), গালটা একটু চেটে দেখবেন?…

শুধু আমিই লজ্জায় লাল, মানে বেগুনি হয়ে গেছিলাম। (কারণ আমি কালো মহাদেশের মানুষদের মতোই তিমির বর্ণের অধিকারী)।

যাক সেই প্রথম পরিচয়ের কথা। নারায়ণী গোয়েন্দানীর অভিনব কীর্তিকলাপ আমাকে এমনই অভিভূত করেছে যে, তার সর্বশেষ কীর্তিটি সবিস্তারে আপনাদের সমীপে উপস্থিত করার অনুমতি প্রার্থনা করছি।

আবেদন মঞ্জুর? তাহলে শুনুন!

.

নারায়ণীর কথা লিখতে গেলে আমার কথাও একটু বলতে হবে। আমি লোকটা একেবারেই ছাপোষা। আমার এমন কিছু এলেম নেই যে পাঁচজনের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি। অথচ চেষ্টার কসুর করিনি। আমার মা-বাবা পটকে গেছে কোনকালে; ভাইবোন আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। আমি থাকি মুচিপাড়ার নেবুতলা পার্কের কোণের মেসবাড়িতে। আমি চেষ্টা করেছিলাম ফিল্ম ডিরেক্টর হতে, সাংবাদিক হতে এবং লেখক হতে–যেগুলো হতে গেলে মগজের পুঁজি বেশি দরকার হয় না–পকেটে টাকা না থাকলে হওয়া যায় (এর ব্যতিক্রম আছে নিশ্চয়–আমি সে দলে পড়ি না)। এত ঘাটে জল খাওয়ার ফলে আমার যোগাযোগ অনেক সাদা বাংলায়, আমার আড্ডাখানার শেষ নেই। ছেলেদের সঙ্গে যেমন রকবাজি করি, ঠিক তেমনি মেয়েদের সঙ্গেও গুলতানি চালাই। সবাই আমাকে পছন্দ করে। ফিল্ম লাইন আর লেখাজোখার লাইনে একটা ম্যাজিক আছে। এ লাইন যে ছুঁয়ে থাকে, তাকেই সবাই ম্যাজিশিয়ান মনে করে।

আমাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে মেয়েরা। আমাকে দেখলেই দাঁত বের করে হেসে গায়ে ঢলে পড়ে কতরকম রগড়ই না করে। কারণ কী জানেন? আমি নির্বিষ। আমি কুৎসিত। গরিলা আর মানুষের মধ্যে আমি একটা মিসিং লিঙ্ক। আমার হাইট সাড়ে চার ফুট। গুহামানবদের কপাল যেরকম কার্নিশের মতো সামনে ঝুঁকে থাকত, আমার বিরাট কপাল ঠিক সেইভাবে অনেকখানি এগিয়ে এসে দুটো চোখের ওপর ঝুলে থাকে। কার্নিশ থেকে লম্বা-লম্বা ভুরুর নোম যখন ঝুলে পড়ে, তখন চোখে ঢুকে গিয়ে চোখের মধ্যে কড়কড়ানি শুরু করে দেয়। সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা। আমার গালের হনু দুটোও ছোট টিলার মতো উঁচিয়ে থাকে। এমনকী আমার চোয়াল বেধড়ক বড় হওয়ায় ওপরের দাঁতের পাটিকে পেছনে রেখে এগিয়ে থাকে সামনে আধইঞ্চির মতো। আমার ঘাড় আছে কিন্তু গর্দান নেই। তাই বিশাল চিবুক ঠেকে থাকে লোমশ বুকে। কাঁধ দুটো ষাঁড়ের কাঁধের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। ধড়টা যে অনুপাতে নিরেট আর বিরাট–পা দুটো সেই অনুপাত মেনে চলেনি; দুটো পা-ই বেঁটে আর বাঁকা। আমি অষ্টপ্রহর পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে থাকি গরিলা আকৃতিটাকে কিঞ্চিৎ সভ্যভব্য করে তোলার জন্যে।

এ রকম চেহারার ব্যাটাছেলেকে কোনও মেয়েছেলেই ভালোবাসতে পারে না মানে, প্রেমের পুরুষ করে তুলতে পারে না কিন্তু তাকে নিয়ে অনায়াসে রঙ্গপরিহাস করা চলে। আমিও আমার গজালের মতো দাঁত বের করে হাসি। তাই আমি সবার প্রিয়।

কলেজ স্ট্রিটে আমার একটা ডেরা আছে। এক প্রকাশকের খাস কামরায়। এখানে জলপথের বিহার করতে অনেক কেষ্টবিষ্টু আসেন। জলপথে মানে বুঝলেন না? বড় ব্যাকডেটেড আপনি। কলেজ স্ট্রিটে লক্ষ্মী, সরস্বতী আর গণেশের উপাসকরা দুটো পথে পরিভ্রমণ করেন। একটা বিদ্যাসাগরীয় পথ–সেটা স্থলপথ; রঙিন জলের স্কোপ এ পথে নেই। আর একটা মধুসুদনীয় পথ–এটা জলপথ; এখানে রঙিন জলের ফোয়ারা ছোটে। রঙিন জলের ব্যাখ্যা নিশ্চয় করতে হবে না। সিরাজি এখন কালচারের ওপিঠ।

আমি এই আড্ডায় প্রায় যেতাম অফুরন্ত সময়ের কিছুটা কাটানোর জন্যে। প্রকাশক ছোটখাট কাজ দিতেন আর লাল-হলুদ-সাদা জল খাওয়াতেন। এই আড্ডাতেই একদিন জমে গেলাম নারায়ণীর সঙ্গে।

নারায়ণীর যে রূপ পরে দেখেছিলাম, প্রথম পরিচয়ে কিন্তু তার ছিটেফোঁটাও চোখে পড়েনি। ভারি ভদ্র, ভারি মিষ্টি, নিপাট সুন্দরী মেয়ে। চোখ-মুখ-দাঁত-নাক-চিবুক সবই যেন সাদা পাথর কেটে বানিয়েছে এক ভাস্কর যিনি কামিনীকে দামিনী করার গুপ্ত কৌশল রপ্ত করে ফেলেছেন। এই দামিনীর ঝলক মাঝে-মাঝে টের পেতাম নারায়ণীর বড়-বড় চোখের মধ্যে। কণ্ঠ তখন রণরণিয়ে উঠত– এর বেশি কিছু না। এই মেয়েই যে পরে তার ভয়ঙ্করী রূপ দেখিয়ে থ করে দেবে দুর্জনদের তা কল্পনাও করতে পারিনি।

আমার সঙ্গে বিলকুল জমে গেছিল নারায়ণী। বিউটি অ্যান্ড দ্য বীস্ট উপন্যাসটা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা আমাদের মুখোমুখি ছবিটা আন্দাজ করে নিতে পারবেন। আমাদের প্রকাশক বন্ধুটি বিলক্ষণ রসিক পুরুষ এবং জলপথে দীর্ঘকাল ভ্রমণ করছেন। তাঁর আপ্যায়নকে আমরা অপমান করতে পারতাম না। আমি আর নারায়ণী দুজনেই জলপথের পথিক হয়ে যেতাম। সেই সময়ে খুলে যেত ওর মনের আগল। হুড়হুড় করে বলে যেত নিজের কথা। দিদি মরে যাওয়ার পর জামাইবাবুর আশ্রয় থেকে চলে এসেছে। দিদির শেষ ইচ্ছে ছিল যেন জামাইবাবুর হাতে সিঁথিতে সিঁদুর পরে নেয়। কিন্তু নারায়ণী তো অন্য ধাতু দিয়ে তৈরি হয়েছিল। অত্যাচারী এই সমাজটার ওপর সীমাহীন আক্রোশ বুকের মধ্যে নিয়ে ও ঘরছাড়া হয়েছিল। থাকত একটা মেয়েদের হস্টেলে–ভবানীপুরে। খরচপত্র জুটিয়ে নিত টিউশনি আর প্রুফ দেখে। এরই মধ্যে পড়াশোনা চালিয়েছে আর গড়েছে নিজেকে। আজকাল মার্শাল আর্ট অনেক রকম বেরিয়েছে। নারায়ণী সেই বিদ্যে দিয়ে ওর নরম তুলতুলে শরীরটাকে প্রয়োজনের মুহূর্তে শতঘ্নী অস্ত্র বানিয়ে তুলতে পারে–একই সময়ে একশো লোককে নাকি ঘায়েল করতে পারে। ওর হাত আর পা তখন চারখানা গদা হয়ে যায় হাতের মুঠো দুটো হয়ে যায় দুটো লোহার বল।

জলপথে ভ্ৰমণবীরদের মুখে এরকম আস্ফালন ঢের-ঢের শুনেছি–আর এ তো বীরাঙ্গনা। কাজেই বিশ্বাস করতাম না একবর্ণও। তবে অবাক হয়ে যেতাম অকপট কথাবার্তা শুনে। মনের মধ্যে কোনও কপাট তো রাখেইনি লজ্জা-ফজ্জারও ধার ধারত না। সিগারেট টানতে টানতে কামসূত্র নিয়েও দিব্যি আড্ডা চালিয়ে গেছে। বাৎস্যায়ন মুনি কত রকম আসনের বর্ণনা দিয়ে গেছেন এবং কোনটা কোনদিক দিয়ে উৎকৃষ্ট, তার নিপুণ ব্যাখ্যা দিয়ে তাক লাগিয়ে দিত আমাদের। আমি আমার গরিলা-চোয়াল ঝুলিয়ে ফেলে তাজ্জব গলায় বলতাম, তুই তো বিয়েই করিসনি– এত খবর জানলি কী করে?

অমনি প্রাণখোলা হাসি হেসে নারায়ণী বলত, তুই কী করেছিস?

এই হল নারায়ণী। দেখলে মনে হয় মা লক্ষ্মীবাংলার বধু, মুখে তার মধু, নয়নে নীরব ভাষা। কিন্তু জমে গেলেই ঠেলা বুঝবেন। তখন সে জীবন্ত শতঘ্নী। মা দুর্গার রূপটা দেখেছিলাম পরে। ক্রমে-ক্রমে আসছি সে প্রসঙ্গে।

সে ব্যাপারে হোতা ছিলাম কিন্তু আমিই। গুচ্ছের বিলিতি বই পড়তাম। কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে জলের দামে লোমহর্ষক রহস্য উপন্যাস কিনতাম। একদিন পড়লাম সাইমন টেম্পলারের কাহিনি। সেন্ট অর্থাৎ সন্ত নামে যে দুর্জনদের কাছে একটা বিভীষিকা। সমাজের দুগ্রহদের সে টাইট দিত আইন-ছাড়া পথে–রেখে যেত একটা স্কেচ।–সেন্ট-এর নিজের হাতে একটানে আঁকা দেহরেখা।

নারায়ণী বইটা আমার কাছ ছেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছিল। দুদিন বাদে ফেরত দিল। সেই সঙ্গে দেখাল পেনসিলে আঁকা একটা স্কেচ।

স্কেচ দেখেই বুঝেছিলাম সেন্ট-এর প্রভাব ওর ওপর পড়েছে। নিজেও তাই বললে, নরহরি, এই হল আমার প্রতীক। সমাজের আঁচিলদের শায়েস্তা করব এই প্রতীক পাঠানোর পর।

আমার নামটাই এতক্ষণ বলা হয়নি। নরহরি সরকার। জাতে কায়স্থ। কিন্তু গরুর মাংসও খেয়েছি। শুওর আরও ভালো লাগে। ভালো লাগে নারায়ণীকেও। নারায়ণীও আমাকে দারুণ পছন্দ করে। কিন্তু তাই বলে যেন কেউ ভাববেন না আমরা প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। ওসব ছেনালিপনা আমাদের মধ্যে নেই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও একটা আড়াল থাকে সব কথা বলা যায় না; ভাইবোন আর বন্ধুবান্ধবীদের মধ্যেও রেখে ঢেকে কথা বলতে হয়। কিন্তু নরহরি আর নারায়ণীর মধ্যে কোনও কথাই আটকায় না। দুজনেই দুজনের কাছে দুটো তেপান্তরের মাঠ। তাই তো আমাদের জলপথের পথিক প্রকাশক বন্ধুটি আমাদের নাম দিয়েছেন নর-নারায়ণী।

.

আমি আগেই নিজের গাওনা গেয়ে নিচ্ছি এই কারণে, যে এর পর থেকে শুধু নারায়ণী স্তোত্রপাঠই করতে হবে। নারায়ণীর গায়ের রঙের সঙ্গে আমার গায়ের রঙের আশমান-জমিন ফারাক আছে, সে কথা আগেই লিখেছি। কালার কমপিটিশনে আমি দাঁড়কাককেও হারিয়ে দিতে পারি। উপরন্তু এই গরিলা-ফিগার। কাজের মধ্যে ভ্যারান্ডা ভাজা। ট্যাঙস-ট্যাঙস করে কলকাতায় চক্কর না মারলে আমার বেঁটে আর বাঁকা পা কটকট করে। পাঁচজনের চোখে আমি একটা পয়মাল। কিন্তু নিশ্চয় নারায়ণীর কাছে নয়। তাই সে একদিন আমাকে বলেছিল, নরহরি, আমি হব কলকাতায় প্রথম মেয়ে ডিটেকটিভ। আমি বলেছিলাম, তোকে কেটে ফেলবে, খুবলে-খুবলে খাবে, ধর্ষণ পর্যন্ত করে ফেলতে পারে। কলকাতায় দোগলাবাজদের তুই চিনিস না। নারায়ণী হেসে গড়িয়ে পড়ে বলেছিল, তুই সত্যিই আর জন্মে গরিলা ছিলিস। মানুষ মেয়েদের এখনও চিনতে পারিসনি। মেয়েদের বুদ্ধি, মেয়েদের হিসেব, মেয়েদের সাহস তোদের চেয়ে বেশি। ঘাটতি ছিল শুধু গায়ের জোরে। মার্শাল আর্ট শিখে সেদিকেও মেরে দিয়েছি। মেয়েদের সবচেয়ে বড় গুণটা কী বলতো? আমি বলেছিলাম, চোখ মারা। ভদ্রভাষায় কটাক্ষ। ও বলেছিল, তুই একটা গাধা। মেয়েদের মোক্ষম মারণাস্ত্র হল তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। ইনটিউশন। এর সঙ্গে আমি আরও দু-চারটে বিদ্যে শিখে নিয়েছি। এক নম্বর হল বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। যে-কোনও মানুষের হাত-পা-চোখ-মুখের ভঙ্গিমা দেখেই আঁচ করতে পারি তার মনের চেহারা এর জন্যে টেলিপ্যাথি জানার দরকার হয় না। এই সঙ্গে জানি আর একটা বিদ্যে। পৃথিবীর যে কোনও ভাষা একবার শুনেই উলটোদিক থেকে বলে যেতে পারি–বলার শব্দটাকেই শুধু নকল করি। এটা আমার কোড ল্যাঙ্গুয়েজ। নারায়ণী গোয়েন্দানীর সাংকেতিক ভাষা।

আমি বলেছিলাম, নারায়ণী গোয়েন্দানী। এটা একটা নাম হল?

ও বললে, মাই ডিয়ার হাফ-গরিলা, আমার এই অভিযানে তোকে মাঝে-মাঝে শাগরেদি করতে হবে। কেননা, তোর মতো ভিজে বেড়াল চট করে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার কোড ল্যাঙ্গুয়েজটা তোকে শিখে নিতে হবে। শত্রুদের সামনেই হয়তো এই ভাষায় কথা বলব–লোকে ভাববে ভয়ের চোটে আবোলতাবোল বকচি। ট্রেনিং এখুনি শুরু করছি নায়ন তাকিচ নিরীহ লাঞ্চ। কী বুঝলি?

আমার কানের মধ্যে ঝমঝমাঝম করে যেন একটা অজানা গানের পশলাবৃষ্টি হয়ে গেল। কিছু না বুঝে গজাল দাঁত বের করে হেসে ফেললাম। রেগে নিয়ে নারায়ণী বললে, তুই একটা আস্ত মর্কট। নায়ন তাকিচা নিরীহ লাঞ্চচ। শুধু শব্দ শুনে উলটোদিক বুঝতে পারছিস না? চঞ্চলা হরিণী চকিতা-নয়না। হল?

নারায়ণী কিন্তু এই ভাষা আমাকে শিখিয়ে ছেড়েছিল।

এর পর থেকেই নারায়ণীর সঙ্গে কলেজ স্ট্রিটের জলপথ জাহাজঘাটায় তেমন আর দেখাসাক্ষাৎ হত না। বেশ কিছুদিন যেন উবেই গেছিল। তারপর পরপর দুটো পিলেচমকানো ঘটনা ঘটিয়ে ছেড়েছিল এই কলকাতায় আর আশেপাশে। আক্কেল গুড়ুম করে ছেড়েছিল পুলিশমহল আর মুখোশধারী শয়তানদের। সে দুটো ব্যাপারে আমার কোনও হেল্প নেয়নি। বলেছিল, এখন হাত পাকাচ্ছি। ইনকাম ভালোই হচ্ছে। সমাজের বুকে বসে যারা গরিবদের রক্ত শুষে খাচ্ছে পুলিশ প্রোটেকশন নিয়ে তাদের রক্তমোক্ষণ করিয়ে দেওয়ার মধ্যে একটা চার্ম আছে। সেই রক্ত মানে বস্তাপচা কালো টাকা দিয়ে সর্বহারাদের উপকার করে যাচ্ছি। আমার একটু কমিশন রেখে দিচ্ছি অবশ্য। নইলে এসটাব্লিশমেন্ট চালাব কী করে।

এসব কথা বলেছিল ওর তেরোতলার অফিসঘরে বসে। এইরকম খানদানি এলাকায় এরকম একটা ঘর ম্যানেজ করল কী করে, ভেবে অবাক হয়ে গেছিলাম। লিফট থেকে নেমেই বাঁ-হাতি দরজা। কালো কাঁচের পাল্লা। ভেনেসিয়ান ব্লাইন্ড দিয়ে ঢাকা। ওপরে কাঁচের ওপর সোনালি সুতো দিয়ে আঁকা ওর সেই নারায়ণী স্কেচ। তলায় কিছু লেখা নেই। আমি ইতিউতি তাকাচ্ছিলাম কলিংবেল এর বোতাম টিপব বলে, এমন সময় প্রায় কানের কাছে শুনলাম নারায়ণীর হাসি আর বিদ্রূপবচন, ওরে-ওরে মর্কট, চলে আয় ভেতরে, দরজা খোলাই আছে, হেলেদুলে আয় রে!

নারায়ণীর এরকম ফচকেমি আমার গা-সওয়া। তাই কিছু মনে করলাম না। পাল্লা ঠেলোম। খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে ছেড়ে দিলাম, আপনিই বন্ধ হয়ে গেল। দেখলাম খাঁটি কাশ্মিরী কার্পেটে মোড়া একটা দারুণ ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। এ ঘরের মেঝেতে কাপের্ট, দেওয়ালে কার্পেট, কড়িকাঠে কার্পেট। প্রকৃতই কার্পেটকক্ষ। নেই শুধু নারায়ণী। কেউই নেই।

শুনলাম আবার সেই খিলখিল হাসি আর বিচ্ছিরি ইয়ারকি, ওরে আয়, ওরে আয়, ওরে আয়দরজা ঠেলে চলে আয়!

তাকিয়ে দেখি, সামনে দরজার মতো কী একটা রয়েছে বটে, আমি তো ভেবেছিলাম পারস্যের কার্পেট। সোনালি হাতল চোখে পড়তেই সেটা আঁকড়ে ধরলাম। অমনি গোটা পাল্লাটা সাঁৎ করে বাঁ-দিকের দেওয়ালে ঢুকে গেল!

চমকে উঠেছিলাম। দরজার এরকম ব্যবহার আমি আশা করিনি।

তারপরেই দেখেছিলাম এই কাহিনির নায়িকা গোয়েন্দানী নারায়ণীকে (আমাকে নায়ক যদি মনে করে থাকেন, তাহলে মস্ত ভুল করলেন–আমি যে কী তাই আমি জানি না)।

নারায়ণী ওর ভুবন-ভোলানো হাসি হেসে আমার দিকে তাকিয়েছিল। এতদিন পরে দেখে আমার তাক লেগে গিয়েছিল। মেয়েদের একটু মেজে-ঘষে দিলে দেখতে আরও ভালো হয়। নারায়ণী কী দিয়ে মেজেছে নিজেকে? এরকম অপ্সরার মতো লাগছে কেন? কাঁচের ঘরের জেল্লার জন্যেও চেহারা হয়তো আরও খুলে গেছে। পাজামা পাঞ্জাবি পরা এই হাফ-গরিলা যে নিতান্তই বেমানান এখানে!

নারায়ণী বললে, নরহরি, তোর বাঁকা পা আরও বেঁকে গেছে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলছে, তুই ঘাবড়ে গেছিস–মুখ যদিও নির্বিকার। বোস। এ ঘর আমি ম্যানেজ করেছি খোদ পুলিশ কমিশনারের কৃপায়–তাঁর একটা ছোট্ট উপকার করে দিয়েছিলাম। উনিই দরজার বাইরে টিভি ক্যামেরা বসিয়ে রেখেছেন–এই দ্যাখ স্ক্রিন–এখানে বসেই আমি দেখতে পাই এল কোন মক্কেল। কোড ল্যাঙ্গুয়েজটা ভুলে যাসনি দেখে আই অ্যাম গ্ল্যাড।

মেসবাড়ি থেকে টেলিফোনে ডেকে পাঠিয়েছিল নারায়ণী। তিনতলা বাড়িতে ফোন একটাই। ওর ফোন যখন গেছিল, আমি তখন আমার মাসিক ২৬২ টাকার তক্তপোশে শুয়ে দৈনিক গল্প পত্রিকা পড়ছিলাম। বেড়ে গল্প লেখে প্রতিদিন মনে হয় যেন টাটকা খবর। এমন সময়ে শুনলাম কে একটা মেয়েছেলে আমাকে ডাকছে।

মেসের চাকর এসেই দিয়ে গেল খবরটা। মেয়েছেলেদের পাতে পড়বার যোগ্য আমি নই, তা সে জানে। তাই মুচকি হাসল না।

লুঙ্গি সামলে নিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলে নিয়ে যেই বলেছি হ্যালো, অমনি নারায়ণীর কোড ল্যাঙ্গুয়েজে কলকলিয়ে উঠেছিল খোদ নারায়ণীর কণ্ঠস্বর

রকারদ ইকেমাতো
সয়ে লেচ রেক টচ
রকারস রিহরন
রেমাতো ছিনেচি ছিনেচি।

একবার শুনেই শিহরণ বয়ে গেছিল শিরদাঁড়া দিয়ে। এ যে মদ্দানি নারায়ণীর পেটেন্ট ভাষা। বলেছিলাম, আর একবার হোক, আর একবার।

তখন নারায়ণী টেলিফোনের তারের মধ্যে দিয়ে যে হাসিখানা পাঠিয়েছিল, তা শুনলে (আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। যে-কোনও মুনি-ঋষির শরীরে উত্তেজনা ঘটে যেত। আমি কিন্তু রইলাম নির্বিকার (জিনিসই আলাদা) এবং শুনলাম আজব ভাষার পুনরাবৃত্তি। মানেও করে নিলাম তক্ষুনি। নারায়ণী ছড়া কাটছে এইভাবে?

চিনেছি চিনেছি তোমারে
নরহরি সরকার
চট করে চলে এস
তোমাকেই দরকার।

ঠিকানা নিলাম। চলে এলাম এই তেরোতলার মুকুরমহলে।

.

আমি চেয়ার টেনে নিয়ে বসতেই নারায়ণী টেবিলের তলা দিয়ে নিজের পা দুখানা ছড়িয়ে দিল সামনে। শিরদাঁড়াটাকেও হড়কে নামিয়ে নিল পিঠ-উঁচু গদি চেয়ারের ওপর দিয়ে। কাঁধের হলুদ শাড়ির আঁচল খসে পড়ল হেঁচড়ানির ফলে। ওর তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই।

আমি বললাম, আমাকে কি নাগর পেয়েছিস? ওইভাবে বুকের আঁচল খসালি কেন? খোলা বুক উঁচিয়ে বসাটা বেহায়া মেয়েদের সাজে।

ও বললে, তোকে আমি ছেলে বলেই মনে করি না। তাই তো এত ভালোবাসি।

আমিও বললাম, তোকেও আমি মেয়ে বলে মনে করি না, তাই তো এত কাছে আসি।

ও বললে, এটা আচ্ছায় জায়গা নয় কাজের জায়গা।

আমি বললাম, কী কাজ?

ও বললে, মন্টেগু জন ডুইট খুব সম্ভব কলকাতায় পুনর্জন্ম নিয়েছে। চিনিস মন্টেগুকে? গুড। স্কটল্যান্ডের সন্দেহ, এই ছোঁড়াই জ্যাক দ্য রিপার নাম নিয়ে লন্ডনের ইস্ট এন্ডে পরপর ছজন বেশ্যাকে খুন করে কেটে ছিঁড়ে ফালাফালা করেছিল। মাংস কেটে নিয়ে নিয়ে ছবি ঝোলানোর পেরেকে টাঙিয়ে রেখেছিল, নাড়িভুড়ি চেঁচে বের করে নিয়েছিল, হার্ট, কিডনি, ব্রেস্ট কেটে নিয়ে টেবিলের ওপর পাশাপাশি সাজিয়ে রেখেছিল, মুখ চিরে ফালাফালা করেছিল, নাক আর কান কেটে রেখেছিল, গলা কেটে দু-টুকরো করেছিল। কসাই-এর অধম হলেও ছিল তার কবিত্ববোধ। তার লেখা একটা কবিতা আজও রেখে দিয়েছে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড।

আমি বললাম, সে কবিতাটা এই :

Im not a butcher,
Im not a yid,
Nor yet a foreign skipper,
But Im your own light-hearted friend,
Yours truly, Jack the Ripper.

নারায়ণী বললে, তোর গরিলা ব্রেনের শার্পনেস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। নরহরি, জ্যাক দ্য রিপার আত্মহত্যা করেছিল আজ থেকেঠিক একশো চার বছর আগে। মেয়েখুনের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সে নিশ্চয় ফের জন্ম নিয়েছে ধরাধামে–এবার এই কলকাতায়।

আমি গালে হাত দিয়ে বললাম, একদিক দিয়ে ভালোই করেছে। বড্ড এডস রোগ ছড়াচ্ছে। বেশ্যারা।

বেশ্যা নয়, ধরেছে বাড়ির বউদের।

সত্যিই আঁতকে উঠলাম–কটা খুন হয়েছে? কোথায়? কাগজে বেরোয়নি কেন?

হয়েছে আপাতত একটা। কাল রাতে। কাগজওয়ালারা এখনও খবর পায়নি। কাল ছিল শনিবার। কথায় আছে, শনিবারের মড়া দোসর চায়, তাই আরও মৃত্যু আসন্ন বলেই আমার বিশ্বাস। অবলা মেয়েদের এইভাবে যে খুন করে, আমিও তাকে খুন করব। তোকে শুধু একটা কাজ করতে হবে।

আমি বললাম, হয় তুই বেশি হুশিয়ার, না হয় বাতিকে ভুগছিস। আইবুড়ো থাকলে ও রোগ হয়। ধরে নিয়েছিস, জ্যাক দ্য রিপার নতুন জন্ম নিয়ে মেয়ে খুন শুরু করেছে। যেহেতু শনিবারে মড়া পড়েছে অতএব আরও খুন হবে। কিন্তু তোকে তো খুন করবে না। তুই বয়ে একার, শয়ে য-ফলা আকার নস, তুই কারও বউও নস, তোর ভয় কী?

নারায়ণী বললে, ব্যাপারটা আগে শোন। তারপর ফুট কাটিস। এই যে বাড়িটায় বসে আছিস, এটা ইংরেজি E অক্ষরের প্যাটার্নে তৈরি। এই কমপ্লেক্সে মোট ফ্ল্যাটের সংখ্যা ২৯৩। এত বড় ফ্ল্যাটবাড়ি গোটা ওয়েস্ট বেঙ্গলে আর নেই। এখানে ব্যবসা চলছে, ফ্যামিলি নিয়ে থাকাও হচ্ছে। এক ফ্ল্যাট থেকে আর এক ফ্ল্যাট দেখা যায়। ইচ্ছে করেই তা করা হয়েছে যাতে ২৯৩টা ফ্ল্যাট মালিকদের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই বিল্ডিংয়েরই ১২৩ নম্বর ফ্ল্যাটে মিসেস সাহানা সিকদারকে কাল রাতে জন্মান্তরিত জ্যাক দ্য রিপার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ক্ষুর চালিয়ে সরু-সরু করে ফালি করে রেখে গেছে। গলাও দু-টুকরো করেছে। শুধু রেপ করেনি। রক্তমাখা ক্ষুরখানা রেখে গেছে। কাঠের বাঁটে তার বুড়ো আঙুলের ছাপও পাওয়া গেছে।

সাহানা সিকদারের স্বামী তখন কোথায় ছিলেন? ছেলেমেয়ে?

স্বামী রয়েছেন ব্যাঙ্গালোরে–অফিস থেকে পাঠিয়েছে সেখানকার হেড-অফিসে–ফেরার কথা পনেরো দিন পর–কিন্তু খবর চলে গেছে। আজকের ফ্লাইটেই ফিরছেন। ওঁদের কোনও ছেলেমেয়ে নেই। সাহানার বয়স ছাব্বিশ। স্বামী সুজন সিকদার মাত্র দু-বছরের বড়। সাহানাকে আমি দেখেছি। খুব একটা আহামরি রূপসি নয়। হিংসে করে বলছি, ভাবিসনি যেন, সাহানার রং মাঝারি, অতিরিক্ত স্মোকিং-এর ফলে দাঁতে ছোপ পড়েছে, হাসলে চোখের কোণ আর ঠোঁটের কোণে চামড়া ইকড়িমিকড়িভাবে ভাঁজ খেয়ে যায়। স্বামীকে মাসের মধ্যে দিন পনেরো কলকাতার বাইরে থাকতেই হয়। তখন সাহানা একপাল পরপুরুষ নিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরোয় মানে বেরোত। বাড়িতেও অনেক রাত পর্যন্ত হুল্লোড় চলত।

তুই জানলি কী করে?

হাসল নারায়ণী, হাজার হোক মেয়ে হয়ে জন্মেছি, কেচ্ছা জানবার কৌতূহল তো আছেই। এই ঘর থেকেই দেখা যায় ১২৩ নম্বর ফ্ল্যাট। আয় দেখাচ্ছি।

গদিচেয়ার ছেড়ে ওঠবার আগে বেঁকে গিয়ে, টেবিলের ড্রয়ার টেনে একটা বাইনোকুলার বের করল নারায়ণী। তারপর গেল পশ্চিম দিকের দেওয়ালের কাছে। এখানে কাঁচ নেই। ইটের দেওয়ালে সারি-সারি তাকে বিস্তর বই। সবই ক্রাইমের বই। খাড়াইভাবে রাখা বইয়ের ভিড়ের ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে ফ্রেডরিক ফোরসাইথ-এর লেখা দ্য নিগোসিয়েটর বইখানা। এই বইয়ের প্লট নকল করেই খুন করা হয়েছে রাজীব গান্ধীকে। বুঝলাম নারায়ণী বইটা ফের পড়ছিল।

আমি যখন বই দেখছি, নারায়ণী তখন তাক-ভর্তি দেওয়াল ধরে টানছে। কাঠের পাল্লার ওপর বই রাখায় দরজা দেখা যাচ্ছিল না। এখন তা খুলে গেল। এসে দাঁড়ালাম ব্যালকনিতে। চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে ফোকাস করে নিল নারায়ণী। তারপর আমার হাতে তুলে দিয়ে বললে, দ্যাখ।

১২৩ নম্বর ফ্ল্যাটের দরজা-জানলা সব বন্ধ।

নারায়ণী বললে, জানলা যখন ভোলা থাকত, তখন তো আমি দেখেছি ওদের কীর্তি। চারজনকে নিয়ে ফুর্তি করত সাহানা। পুলিশ তাদের খবর পাবে না। কারণ সাহানা আর নেই। প্রতিবেশীরা মুখ খুলবে বলে মনে হয় না–মার্ডার কেসে আন্দাজে মার্ডারারের নাম কেউ বলতে চায় না। সুজন সিকদারও জানে না, এই চারজন কে-কে। কিন্তু আমি চিনি এই চারজনের একজনকে।

এই বলে নারায়ণী আমাকে ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে এল–তাকভর্তি পাল্লা বন্ধ করতে করতে বললে, ওই ফ্ল্যাটের ঠিক ওপরকার ফ্ল্যাটে সে থাকে।

তার নাম?

বিনয় মালাকার। ছবি আঁকতে জানে। কিন্তু রোজগার তেমন নেই। আমার নারায়ণী স্কেচ দেখে নিজে এসে আলাপ করে গেছিল–তাই আমি এই সময়ে লোকটার কাছে ঘেঁষতে চাই না। লম্বায় সে ছফুটের কাছাকাছি। আগের জন্মের জ্যাক দ্য রিপার ছিল বেশ ছিপছিপে সুশ্রী ছোকরা। বেশ্যাপ্রিয় পুরুষ। আর এই লোকটা মানুষ-দানব। চোখের তারা দেখলেই বুঝবি মেয়ে-পটানো চাহনিটা কি মারাত্মক। আমাকেও হিপনোটাইজ করতে চেয়েছিল। ওরকম চেহারা দেখলে সব মেয়েই ঢলে পড়ে। সাহানার দোষ কী। মাসের পনেরো দিন স্বামীছাড়া থাকা একটু কষ্টকর ব্যাপার বইকি। বিনয় ওই ফ্ল্যাটে প্রায় যেত। এক বিছানায় শুতেও দেখেছি।

খুব খারাপ কাজ করেছিস, বললাম আমি–নিষিদ্ধ দৃশ্য দেখা অত্যন্ত কুরুচি। তোকে মানায় না। যাক, দেখেই যখন ফেলেছিস, তখন আমাকে জড়াচ্ছিস কেন?

পৈতে পুড়িয়ে ব্রহ্মচারি হতে যাসনি, নরহরি। দোব হাটে হাঁড়ি ভেঙে। বিনয় মালাকার খুনি কিনা সেটা প্রমাণ করতে হবে। তুই ওর ঘরে যাবি জার্নালিস্ট সেজে। টিপিক্যাল জার্নালিস্টদের মতোই তুই কদাকার, পোশাকও সেই রকম, জার্নালিজম-ও করিস কিন্তু কল্কে পাসনি, তবে ইন্টারভিউ নিতে হয় কী করে তা জানিস। এই নে আমার ক্যামেরা। এক গেলাস জল এনে দিতে বলবি বিনয়কে–সেই গেলাস হাতসাফাই করে কাঁধের ঝোলায় ফেলবি ফিংগারপ্রিন্টের ফটো নিয়ে মিলিয়ে দেখব ক্ষুরের ফিংগার-প্রিন্টের সঙ্গে মিলে যায় কিনা। ক্ষুরের ফিংগারপ্রিন্ট কাল সকালেই পেয়ে যাব–সে লাইন করে রেখেছি। এলোমেলো খানকয়েক ফটো তুলবি। আর জেনে নিবি, সাহানার সঙ্গে আর যে তিনজন ছোকরা ঘুরঘুর করত, তাদের নাম কী? ধাম কোথায়?

আমি বললাম, বিনয় মালাকার সাহানাকে খুন করতে যাবে কেন? মোটিভ কী?

জেলাসি। এক মেয়ে চার নাগর–নিশ্চয় বিনয়কে কাট করতে চেয়েছিল সাহানা। তুই যা–এখন বিনয় একা আছে।

ফ্ল্যাটে আর কেউ থাকে নাকি?

ওর বউ থাকে। বাঁজা মেয়েছেলে। হস্তিনী বললেই চলে। কিন্তু রোজগার করে ভালো। নইলে এ ফ্ল্যাট কিনতে পারত না। অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। নাম তার হাসি। দেখে হেসে ফেলিসনি যেন। যদিও এখন নেই। যা, যা।

প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়েই আমাকে বের করে দিল নারায়ণী।

.

হাসি কিন্তু ফ্ল্যাটেই ছিল। আমার ধারণা ছিল, সৃষ্টিকর্তা শুধু আমাকেই অমাবস্যার অন্ধকার দিয়ে গড়েছেন। এখন তো দেখছি হাসি মেয়েটাও কম যায় না। আমি তো মশাই হাঁ করে চেয়েছিলাম দরজা খোলার পরেই। বেল টিপতেই ইলেকট্রনিক মিউজিক শুরু হয়েছিল। শুনছিলাম আর তৈরি হচ্ছিলাম মানব-দানব বিনয় মালাকারের সঙ্গে মোলাকাতের জন্যে। তার বদলে দরজা খুলে দিল হাসি মালাকার স্বয়ং। রক্ষেকালীর বাচ্চা বললেই চলে। দাঁত ছরকুটে রয়েছে। মোটা-মোটা কাফ্রী ঠোঁট ফেটেফুটে রয়েছে। নাক থ্যাবড়া–প্লাস্টিক সার্জারি করে একটু উঁচু করা হয়েছে কিনা ঈশ্বর জানেন। উটকপালী নাম্বার ওয়ান। অনায়াসে ফুটবল খেলা যায় যেন সেই কপালে। চুল এতই পাতলা যে নেই বললেই চলে। চোখ গোল-গোল। মুখও গোল। কালো হাঁড়ি বলা চলে। পুরো বডিখানাও বোধহয় গোল। তাই গলা থেকে পা পর্যন্ত ম্যাক্সি দিয়ে ঢেকে রেখে দিয়েছে। গোটা অবয়ব থেকে এমনই একটা বিশ্রী ব্যাপার বিচ্ছুরিত হচ্ছে যে আমি হাসতে ভুলে গিয়ে হাঁ করে চেয়ে রইলাম। হাসিও আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। সে-ও তো আমার মতো কদাকার পুরুষ কখনও দেখেনি।

দুজনেই যখন হাঁ, তখন পেছনে এসে দাঁড়াল মানব-দানব বিনয় মালাকার। দানবদেহী হলেও মানব তো বটে। চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি পরকীয়া প্রেমের পাত্রীটি নৃশংসভাবে নরকে প্রস্থান করেছে। তার প্রতিক্রিয়া চোখেমুখে ফুটে উঠেছে। উদ্বেগে কালো, উৎকণ্ঠায় টানটান।

আটঘাটের জল-খাওয়া ঘোড়েল মাল আমি। নিমেষে ম্যানেজ করে নিলাম নিজেকে। জার্নালিস্টের জয় যে সর্বত্র, তার আর একদফা প্রমাণ হাতেনাতে জুটিয়ে নিলাম। আমি যে কাগজের লোক এবং বিশেষ তদন্তে বেরিয়েছি–একথা জানামাত্র দুজনেরই মুখ আরও শুকিয়ে গেল। হাসিদেবী এমনিতেই কান্নাকান্না মুখ করেছিল। এখন তা শুকনো আমড়া হয়ে গেল। সাহানাকে ক্ষুর দিয়ে চেরা হয়েছে শুনে ইস্তক ভয়ে আধমরা হয়ে রয়েছে হাসিরাশি দেবী। (পুরো নামটা তাই রাশি রাশি হাসি-কে উলটে নিলেই হাসিরাশি!) ভীষণ টেনশন চলছে। মানব-দানব স্বামী তাকে অনেক বুঝিয়ে গেল আমার সামনেই। বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করলে কী হয়? সব কাজ চলুক। সবসময়ে ব্যালকনি থেকে ১২৩ নম্বর ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে থাকলে টেনশন তো বেড়েই চলবে। মডার্ন জ্যাক দ্য রিপার অন্তত এ ফ্ল্যাটে ঢুকবে না–শিরদাঁড়া টেনে ছিঁড়ে দেবে বিনয় মালাকার।

কিন্তু তাতেও স্বস্তি পাচ্ছে না হাসিরাশি দেবী। আরও শুনলাম, এই ফ্ল্যাটবাড়ির ঘরে-ঘরে আতঙ্ক ঢুকে গেছে। প্রত্যেকেই ম্যাজিক আই দিয়ে আগে দেখছে, কে বেল টিপছে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকেও ম্যাজিক আই দিয়ে দেখে নিয়েছে হাসিরাশি। চিনেছে বলেই তো দরজা খুলেছে। একটু আগেই আমি নিচের ফ্ল্যাটে ঢুকেছিলাম তো? নিচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখছিলাম ১২৩ নম্বর ফ্ল্যাট। রূপসি মেয়েটার সঙ্গে যখন আমার এতই ভাব, তখন আমাকে দরজা খুলে দিতে ডর লাগেনি।

অথচ ভয়ডর কাকে বলে, এতদিন তা জানত না হাসিরাশি। ছেলেবেলা থেকেই ডানপিটে। বড়লোকের মেয়ে। কনভেন্টে পড়া মেয়ে। ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ভাষা জানা মেয়ে। কাজ করে বিভিন্ন এমব্যাসিতে। ফরেনার এলে কলকাতা ঘুরিয়ে দেখায়। বাড়ি ফেরার সময়ের ঠিক নেই। কখনও মাঝরাতে, কখনও রাতভোরে। বাপ-মার অমতে বিনয়কে মালা পরিয়েছে বলে ত্যাজ্যকন্যা হয়েছে। তাতে ওর বয়ে গেল। রোজগারের টাকায় ফ্ল্যাট তো কিনেইছে। টাকাও জমিয়েছে। কাল সকালেই লাখ টাকার ইনসিওর করেছে নিজের নামে, রাতেই ফাঁই হল সাহানা। এর পর কে হবে? ভাবতে ভাবতেই একরাতেই খানকয়েক চুল পাকিয়ে ফেলেছে হাসিরাশি দেবী।

আমি বকবকানি শুনছি আর টুকটাক প্রশ্ন চালিয়ে যাচ্ছি। হাসি যেই রান্নাঘরে আমার তেষ্টা মেটাতে গেলাসভর্তি কোল্ড ড্রিঙ্ক আনতে গেল, অমনি আমি জিজ্ঞেস করে নিলাম বিনয় মালাকারকে, সাহানা দেবীর বাকি তিনজন পরপুরুষ বন্ধুর নামধাম কি বলবেন? বিনয় চমকে উঠেছিল। আমি গজাল দাঁতের হাসি হেসে দেখিয়ে বলেছিলাম, সবাই সব জানে মশাই। আপনারই কোনও রাইভ্যাল তো এ কাজ করতে পারে? বিনয় যেন কীরকম হয়ে গেল। গলার কণ্ঠা ওঠানামা করছে দেখে হাসিরাশি দেবীকে বললাম আর এক গ্লাস ঠান্ডা পানি তাকে এনে দিতে এবং তা আনতে চোঁ-চোঁ করে শেষ করে দিল মানব-দানব। মুখ তার ফ্যাকাশে। আমি বললাম, আপনার এত ভয় কীসের? আমি তো আছি। কাগজের লোককে মশাই পুলিশেও ভয় পায়খুন যে করেছে, সে আর এ তল্লাটে ভিড়বে না–আপনি শুধু আমাকে হেল্প করুন।

আমি ধানাই-পানাই করে যাচ্ছি আর ভাবছি কোন ফাঁকতালে বিনয়ের আঙুলের ছাপ লাগা গেলাসটা সরানো যায়। দেবা আর দেবী দুজনেই যে উপস্থিত, আগে তো জানতাম না। আমাকে এই সংকট থেকে মুক্তি দিল স্বয়ং নারায়ণী।

ইলেকট্রনিক মিউজিক বেজে উঠল দরজার পাশে। মানব-দানব উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভুবনমোহন হাসি হেসে ঘরে ঢুকল নারায়ণী–এ হাসি যে হাসতে পারে দুনিয়ায় তার অপ্রাপ্য কিছু থাকে না। কাঁধে ঝুলছে জরিদার কাঁচ-চুমকি-পুঁতি বসানো রাজস্থানী ঝোলা। ঘরভরতি বিষাদ-মেঘকে চকিতে উড়িয়ে দিল প্রাণবন্ত কথাবার্তায়। প্রতিবেশিনী হিসেবে তার দায়িত্ব রয়েছে এই ফ্ল্যাটবাড়ির সব মেয়ের দেখভাল করার। কথা বলতে বলতে উঠে গেল ব্যালকনিতে। ঝোলা থেকে বাইনোকুলার বের করে দেবা আর দেবীর হাতে গছিয়ে দিয়ে ফিরে এল ঘরে। শরবতের গেলাস তিনটে (একটা গেলাসে হাসিও শরবত খেয়েছিল) তুলে নিয়ে গিয়ে রেখে দিল রান্নাঘরে। ফিরে গেল ব্যালকনিতে। আরও কিছুক্ষণ বকরবকর করে আমাকে নিয়ে চলে এল নিচের তলায় নিজের ফ্ল্যাটে। ঝোলা থেকে গেলাস তিনটে বের করে রাখল টেবিলে।

বললে, চুরি করে আনলাম। শরবতের গেলাস সবসময়ে দরকার হয় না। চুরি গেছে জানতে পারার আগেই কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে।

আমি বললাম, তুই নিজেই যদি যাবি তো আমাকে পাঠালি কেন?

কারণ আছে, কারণ আছে, বলতে-বলতে ফোনের রিসিভার তুলে নিল নারায়ণী। ডেকে পাঠাল পুলিশেরই এক ফিংগার প্রিন্ট এক্সপার্টকে।

সন্ধের সময়ে বিনয় বেরিয়ে গেছিল গঙ্গার হাওয়া খেতে। তখন ঘড়িতে বাজে ছটা। আধঘণ্টা পরেই ইলেকট্রনিক মিউজিক শুনে ম্যাজিক আই দিয়ে তাকিয়ে হাসি দেখল বিনয় ফিরে এসেছে। দরজা খুলে দিল। বিনয় ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসল। মুখ পাথরের মতো শক্ত। হাসিও বসল ওর গা-ঘেঁষে। মুখের পরতে-পরতে অশান্ত স্নায়ুর নৃত্য চলছে। বিনয় উঠে গেল টয়লেটে। ফিরে এসে দাঁড়াল সোফায় পেছনে হাসির ঠিক পেছনে। বাঁ হাতে বউয়ের থুতনি চেপে ধরে পেছনে হেলিয়ে চুমু দিল কপালে। ডান হাতে পকেট থেকে বের করে আনল ক্ষুর। আঙুলের কায়দায় খুলে গেল ফলা। এর পর একটানে দু-টুকরো হবে হাসির গলা।

কিন্তু তা হয়নি। পর্দার আড়ালে আমি আর নারায়ণী দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। বিনয় বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে দুজনে ঢুকেছিলাম ফ্ল্যাটে। হাসিকে বলেছিলাম–খোদ পতিদেবতাও যদি ফিরে আসে আমাদের অস্তিত্ব যেন না জানায়। জানান দেব আমরা নিজেরাই।

ক্ষুর যখন খেলে গেল বাতাসে, নারায়ণীর হিলহিলে বডিও খেলে গেল বাতাসে। পর্দার আড়াল থেকে বিনয় পর্যন্ত দূরত্বটা যেন বিদ্যুতের পিঠে চেপে পৌঁছে গেল ক্যারাট মারে উড়িয়ে দিল ক্ষুর।

তারপরেই পরের পর মার। তছনছ হয়ে গেল লিভিংরুম, ঠিকরে গেল হাতির দাঁতের স্ট্যান্ড ল্যাম্প। দানবদেহী বিনয় মালাকারকে নিয়ে কিছুক্ষণ যেন লোফালুফি খেলে গেল নারায়ণী। তারপর তার হাত-পা পাঁজরা ভাঙা শরীটাকে এক লাথি মেরে ঘরের কোণে গড়িয়ে দিয়ে তুলে নিল ফোনের রিসিভার। ডেকে পাঠাল পুলিশের লোকদের।

তারা এল। গদগদ গলায় নারায়ণীকে বললে, সাধু! সাধু! এত সহজে সাহানার হত্যাকারী ধরা পড়বে ভাবতেই পারিনি।

চোখ পাকিয়ে গলা রণরণিয়ে নারায়ণী বললে, এইজন্যেই রসাতলে যাচ্ছে কলকাতার পুলিশ। আপনারা যাকে ধরলেন, সে তার নিজের বউয়ের গলায় ক্ষুর চালাতে যাচ্ছিল বউয়ের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স আর ইনসিওরেন্সের টাকার জন্য। আপনারা ভাবতেন সাহানার হত্যাকারী হাসিরাশি দেবীকেও খুন করে গেছে। কোনওদিনও জানতে পারতেন না কে খুন করেছে সাহানাকে।

চোখ ছানাবড়া করে (নারায়ণীর দশবাই চণ্ডীরূপের জন্যেও বটে) পুলিশ অফিসার বলেছিল, আপনিও জানেন মনে হচ্ছে?

না জানলে কি ন্যাকামি করছি?

নামটা জানতে পারি?

হাসিরাশি মালাকার। আপনার সামনেই বসে রয়েছে।

হাসি তক্ষুনি চোখ উলটে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। নারায়ণী ফাঁস করে দিয়েছিল হাসির কুকীর্তি। লম্পট স্বামীর জন্যে সর্বস্ব ত্যাগ করেছে। অথচ লাম্পট্য চলছে অবাধে। চোখের সামনে। ১২৩ নম্বর ফ্ল্যাটে। স্বামীকে রোখা দরকার। ব্যাভিচারিণীকে মারা দরকার। তাই ক্ষুর চালিয়েছিল কাল রাতে। তাই এত ভয়।

প্রমাণ? ক্ষুরের বাঁটে আঙুলের যে ছাপ পাওয়া গেছে, সেই একই ছাপ রয়েছে শরবতের গেলাসে–হাসি শরবত খেয়েছিল যে গেলাসে।

সন্দেহটা নারায়ণীর মাথায় আসতেই দৌড়ে উঠে এসেছিল ফ্ল্যাটে আমি থাকতে থাকতেই। ক্ল একটাই।

সাহানাকে রেপ করা হয়নি।

নারায়ণী-নৃত্য নেচে এসে গোয়েন্দানী মহারাণী শরীর চাঙা করার জন্যে সিরাজির পেয়ালা বের করেছিল (যদিও একটুও হাঁপায়নি, শাড়িও হাঁটু ছাড়িয়ে ওপরে ওঠেনি)।

আমি বাধা দিইনি। দিলেই তো বলবে, দেবতারা সোমরস খেলে দোষ হয় না, মানুষের হবে কেন?

খাক, খেয়েই তো শরীটাকে অমন টসটসে আঙুর করে রেখেছে। তাই শুধু একটাই প্রশ্ন করেছিলাম, তুই বুঝলি কী করে, আজ রাতেই বিনয় ক্ষুর চালাবে?

নারায়ণীর চোখ তখন টুলটুলু হয়ে এসেছে। আমার চোখেও রং ধরেছে। তাই একজোড়া নারায়ণী দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল, রূপ যেন আরও বেড়ে গেছে। গেছো মেয়েরা একটু বেশি রূপসিই হয়, এটা তো ঠিক। আঁটা হাতে মারকুটে হলে তো সোনায় সোহাগা।

মদির চোখে তাকিয়ে নারায়ণী বলেছিল, প্রথমে খটকা লেগেছিল বিনয়ের বডি ল্যাংগুয়েজ দেখে। যে মিথ্যে বলে, তার অঙ্গভঙ্গি দেখে তা ধরা যায়। মনের মধ্যে ফন্দির তোড়জোড় চললে, চাহনি দেখে তা আঁচ করা যায়। এ বিদ্যে অনেক কষ্টে শিখতে হয়েছে আমাকে। সেইসঙ্গে কাজ করেছে আমার ইনটিউশন–যে জিনিসটা অন্য মেয়েদের চেয়ে আমার একটু বেশিই আছে বলে আমি জানি। এটা একটা সাইকিক ফোর্সও বলতে পারিস। তখন খাটালাম আমরা যুক্তি। এখন হাওয়া গরম। আরও মেয়ে চেরাই হবে–এই আতঙ্ক জেগেছে ঘরে-ঘরে। গরমে-গরমে নিজের ঘরের বউটাকে একই কায়দায় কেটে ফেললেই তো একঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যায়। পুলিশ জানবে, জন্মান্তরিত জ্যাক দ্য রিপার-ই খুন করে গেল হস্তিনী হাসিকে। মরা হাসির আঙুলের ছাপও কেউ নেবে নাসাহানার খুনি কে, তা অজানাই থেকে যাবে। ফঁকতালে হাসির ফ্ল্যাট, বীমার টাকা, ব্যাঙ্কের টাকা সব পেয়ে যাবে। এন্তার মেয়ে ভোগ করা যাবে। আরও একটা মোটিভ তো নিজের কানেই শুনলি। কী বলছিল বিনয় ধোলাই খাওয়ার সময়ে?

সাহানাকে মেরেছে ক্ষুর চালিয়ে–আমিও মারব ক্ষুর চালিয়ে!

অর্থাৎ প্রতিহিংসা। হাসির অস্বাভাবিক আতঙ্ক দেখে সন্দেহ হয়েছিল বিনয়ের। খটকা লেগেছিল আমার আবির্ভাবে–তাই আর সময় নষ্ট করতে চায়নি। গোয়েন্দানী যখন চর পাঠায়, তখন তার সন্দেহটাকে ঝটপট ঘুরিয়ে দেওয়া দরকার।

প্ল্যান এঁটেই তাহলে তুই আগে আমাকে পাঠিয়ে পরে নিজে গেছিলি?

আজ্ঞে। আমার না গেলেও চলত, কিন্তু মূল সূত্রটা মাথায় ঝলক দিতেই আর দেরি করিনি– দরকার ছিল হাসির ফিংগার প্রিন্ট।

এ তো দেখছি আড়াই প্যাঁচ।

নারায়ণীর আড়াই প্যাঁচ। ছেলে গোয়েন্দাদের মাথায় এসব কুচুটে প্ল্যান গজাবে? নে, ওঠ, আর গিলিসনি!

* নবকল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত। (শারদীয় সংখ্যা, ৩৩শ বর্ষ)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *