মেয়ে খুনে কাউন্ট সারভিয়াত্তি
যখনই নতুন কোনও খুনের তদন্তে তলব পড়ে আমার ডিপার্টমেন্টের, তখনই আপনা হতেই আমার ভাবনার পটে ভেসে ওঠে এ শতাব্দীর সবচেয়ে কুখ্যাত খুনে–কাউন্ট সিজারে সারভিয়াত্তির উপাখ্যান। আর বাস্তবিকই, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
অপরাধ-তদন্ত নিয়ে যারা দিনরাত মাথা ঘামায়, তাদেরকে হামেশাই যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তার প্রতিটাই ছিল কাউন্ট সারভিয়াত্তির কেসে। কিন্তু মাদকদ্রব্যর বেআইনী আমদানির নতুন নতুন ঝামেলায় অথবা অতিদুত্থাপ্য ডাকটিকিটের অতি-চমৎকার জালিয়াতির খবর পেয়ে অনামী কারিগরকে বার করার কাজে আমাকে যতখানি বেগ পেতে হয়, কাউন্টের কেস হাতে অবশ্য তার চেয়ে বেশি মাথা ঘামাতে হয়নি।
সারভিয়াত্তির শিকার ছিল মেয়েরা। কৌশলে মুঠোর মধ্যে এনে মেয়েগুলোকে খুন করত ও। এবং করত শুধু টাকার জন্যে। তারপর লাশগুলো এমনভাবে টুকরো টুকরো করে কাটত যেন পাকা কশাই সে। আর বাস্তবিকই সে তাই ছিল। ওর কপাল মন্দ। তাই কলঙ্কিত রক্ত নিয়েই ওর জন্ম। ওর বাবা ছিলেন ইটালিয়ান আর্মির ক্যাপ্টেন। পয়লা নম্বরের উচ্চুঙ্খল। বুদ্ধিজীবী মহলে তাঁর আত্মম্ভরিতারও সীমা-পরিসীমা ছিল না। ভদ্রলোক যখন ওপারের পথে রওনা হলেন সিজারের বয়স তখন মাত্র চোদ্দো। বাবার কাছে সে উত্তরাধিকারসূত্রে পেল ছোটখাটো একটা ঐশ্বর্য, শিল্পকলার প্রতি প্রীতি আর একটা অতি-দুষ্ট দর্শন-বাদ।
এক বছর আগে ছেলেকে গণিকালয়ে নিয়ে গিয়ে তত্ত্বকথা শুনিয়েছিলেন ভদ্রলোক–মেয়েদের অস্তিত্ব শুধু আমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্যে। তোমার সুখ-সুবিধার জন্যেই ওরা এসেছে এই দুনিয়ায় এবং এটুকু বাদ দিলে নিরেট মাথা শুয়োর ছাড়া আর কিছুই নয়।
দুর্ভাগ্যক্রমে, যে ধরনের মহিলারা এই জঘন্য উপদেশ যে নিতান্তই অসার, তা প্রমাণ করে ছেলের স্নেহ-ভালোবাসা অর্জন করার চেষ্টা করতেন–ওর মা ঠিক এই ধরনের মহিলা ছিলেন না। অতি সাধারণ শ্রেণির জীব ছিলেন এই ভদ্রমহিলা। ঘন ঘন সুরাপান ছিল তাঁর প্রিয় নেশা। উৎকৃষ্ট আসবাব আর দুষ্প্রাপ্য সুরা ছাড়া অন্যকিছুর ভক্ত ছিলেন না তিনি। আরথ্রাইটিসে ভোগার ফলে মেজাজটা হয়ে গিয়েছিল বেজায় খিটখিটে। অহোরাত্র সুরাপাত্র কানায় কানায় টলটলে মদিরায় ভরিয়ে রাখার জন্য পতিদেবতার অতি কষ্টে সংগৃহীত মূল্যবান সম্পদগুলো একে একে বিক্রি করে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না তিনি। তারপর তিনিও যখন ইহলোকের ধুলো ঝেড়ে পরলোকে গেলেন, তখন সিজারের বয়স মাত্র আঠারো। মায়ের সঙ্গে থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ও।
কয়েক বছরের মধ্যেই সম্পত্তির বাকিটুকু ঠুকে শেষ করে ফেললে সিজারে। কোনও কাজের শিক্ষা সে কোনওদিন পায়নি। পেশার কথা উঠতেই পারে না। কাজেই একটা মেয়েলোকের বাঁধা প্রেমিক হিসেবে শুরু হল তার নতুন জীবন। লা স্পেজিয়াতে মেয়েদের টুপি, জরি, পোশাকের বিরাট দোকান ছিল স্ত্রীলোকটার। নাম তার রোজ। সারভিয়াত্তির চাইতে বয়সে বছর দশেকের বড় সে। প্রথম কটা দিন ভালোই কাটল কপোত কপোতীর। তারপর শুরু হল ঝগড়াঝাটির পালা। সম্ভবত রোজ যত টাকা দিতে প্রস্তুত ছিল তার চাইতেও বেশি টাকার দাবি জানাত সিজারে–ঝগড়ার সূত্রপাত এইখান থেকেই। দোকানের কোনও কাজই হত না সিজারেকে দিয়ে ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি হওয়া তো দূরের কথা। ফলে, যতই দিন যেতে থাকে, ততই চোখমুখের চেহারার সজীবতা চনমনে খুশি-খুশি ভাব হারিয়ে ফেলতে থাকে রোজ।
এই কাহিনির উপসংহার ঘটল সেই দিনই যেদিন রোজ তার প্রেমাস্পদকে জানাল যে সে মা হতে চলেছে। কথাটা শুনে এমনিই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল সারভিয়াত্তি যে তখুনি আগুনের চুল্লী থেকে আগুন খোঁচাবার লোহার ডান্ডাটা তুলে নিয়ে উন্মাদের মতো রোজকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। বাড়ির পেছনকার বাগানে লাশটা পুঁতে ফেলে কবরস্থানের ওপর সযত্নে পাথর-বাঁধানো একটা রাস্তা বানিয়ে রাখল।
একটা মুহূর্তের জন্যও উদ্বেগের ছায়ামাত্র দেখা যায়নি সারভিয়াত্তির মনে। রোজের প্রতিবেশীদের আর মক্কেলদের সে জানিয়ে দিলে যে রোমের শৌখিন মহলে একটা নতুন ব্যবসা ফেঁদেছে সিগনোরা। সিজারেকে এখানে রেখে গেছে সম্পত্তি উপযুক্ত দামে বেচে ফেলার জন্যে। লা স্পেজিয়ার এই কাজটুকু শেষ করেই সে রোজের কাছে চলে যাবে রোমে। মালপত্রসমেত দোকানটা জলের দামে বেচে দিল সে এবং বিক্রি করার অধিকার তার বাস্তবিকই আছে কিনা, এ প্রশ্নও কেউ তাকে জিগ্যেস করল না।
অতি সহজে লোক ঠকিয়ে নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখার এই ক্ষমতাই সারভিয়াত্তিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে এক খুন থেকে আরেক খুনের দৃশ্যে। শেষকালে তার মুখোশ খুলে পড়ল মরণের সওদাগর হিসেবে। তার সমস্ত তৎপরতাকে সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলে একটা খবরের কাগজ মাত্র কয়েকটা শব্দের মধ্যে। ফ্যালো কড়ি মাখো তেল-এর পদ্ধতিতে খুন–মেয়েরা এনেছে অর্থ আর কাউন্ট সরিয়ে দিয়েছে তাদের দেহগুলো।–এই ছিল খবরে কাগজের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। তার কবলে পড়ে কত মেয়ে যে প্রাণ হারিয়েছে, তার সঠিক হিসেব জানা যায়নি। শুধু এইটুকুই বলা চলে যে সারভিয়াত্তির সঙ্গে মোলাকাত হওয়ার পর বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেছে–এরকম মেয়ের সংখ্যা বড় কম নয়। সারভিয়াত্তি কিন্তু চিরকুমার থেকেছে সমস্ত জীবন–যেন দিনের পর দিন খুঁজে বেরিয়েছে তার উপযুক্ত গৃহিণীকে–এই রকম একটা ভাব দেখিয়েছে সে।
পর পর দুটি দিন বিভিন্ন ট্রেনে মালপত্রের সঙ্গে খণ্ড-বিখণ্ড লাশ আবিষ্কার হওয়ার পরেই সেই প্রথম পুলিশ জানতে পারে সমাজের মধ্যে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা নররাক্ষস। ১৯৩২ সালের ১৬ই নভেম্বর টুরিন থেকে মর্নিং এক্সপ্রেস সবে এসে দাঁড়িয়েছে নেপলস্-এর বিশাল খিলেনওয়ালা স্টেশনে। দুজন রেলওয়ে পুলিশ (ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের অনতিকাল পরেই একটা বাহিনী সৃষ্টি করেছিলেন মুসোলিনী) করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা সেকেন্ড ক্লাস কমপার্টমেন্টে দুটো বড় বড় সুটকেস দেখতে পেল। আঁশের তৈরি পেল্লায় সুটকে দুটো কে বা কারা ফেলে গিয়েছিল কামরার মধ্যে। সদ্যকেনা না হলেও খুব পুরোনো বলে মনে হল না সুটকেস দুটো। ওজনেও দারুণ ভারী। পুলিশ অফিসার দুজন সুটকেস দুটো নামিয়ে নিয়ে গিয়ে জমা দিয়ে দিলেন হারানো প্রাপ্তি অফিসে। একটা সুটকেসকে তাকের ওপর তুলে রাখার সময়ে খুট করে খুলে গেল তালাটা এবং সঙ্গে সঙ্গে ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ল একটা মুন্ডু–মেয়েমানুষের মুন্ডু। পুরু বাদামি কাগজের লাইনিং দিয়ে মোড়া ছিল সুটকেসটা। গাঢ় লালচে রঙের কাঠের কুচো দিয়ে প্যাক করা ছিল ভেতরকার বস্তু। একজন অফিসার নিঃশব্দে তুলে ধরলে মুন্ডুটা। অপরজন চাড় দিয়ে দড়াম করে খুলে ফেলল দ্বিতীয় সুটকেস। ভেতর থেকে পাওয়া গেল–হতভাগিনীর হাত আর পা।
হাত-পা মুন্ডুবিহীন ধড়টা এসে পৌঁছোল পরের দিন ট্রেনে। লাস্পেজিয়া থেকে রোমে এসে পৌঁছোল যে ট্রেনটি, সেই ট্রেনেই এল এই ধড়টি। প্রথমবার যেভাবে পাওয়া গিয়েছিল সুটকেস দুটি, দ্বিতীয় আবিষ্কারটিও ঘটল ঠিক এ ভাবেই। সেকেন্ড ক্লাস কমপার্টমেন্টে একটা বড় সুটকেস খোলার পর ভেতর থেকে পাওয়া গেল উলঙ্গ ধড়টা। অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো যে একই দেহের, তা প্রমাণ করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না ডাক্তারদের। হতভাগিনীর চেহারার মোটামুটি এবং বিশ্বাসযোগ্য একটা বিবরণও দিলেন তারা। বয়স তার তিরিশ। উচ্চতা মাঝামাঝি। লালচে বাদামি চেস্টনাট রঙের চুল আর চোখ। বাঁ-পা-টা সামান্য বেঁকা। অনেকরকম পুরোনো ক্ষতচিহ্নও ছিল সারা দেহে।
পেছন থেকে ছুরি মারা হয়েছিল মেয়েটিকে। ছুরি মারার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়নি বেচারি এবং যখন প্রমাণ পাওয়া গেল জীবন্ত অবস্থাতেই মেয়েটিকে টুকরো টুকরো করে কাটতে শুরু করেছিল খুনে জানোয়ারটা তখন এই বিভীষিকা উপাখ্যানের ওপর চড়ল আর এক পোঁচ বিভীষিকার রং।
অপরাধ সম্পর্কীয় যে-কোনও তদন্তে পুলিশি তৎপরতা যদি সর্বত্র ছড়িয়ে থাকত তাহলে অবিশ্বাস্যরকমের মসৃণগতিতে অব্যাহত থাকত, চালু থাকত পুলিশ মেশিনের অপরাধসমাধান পর্ব। কিন্তু তা যখন নয়, ব্যাপক, সুষ্ঠু আর নিখুঁত পুলিশি তৎপরতার যেখানে অভাব সে ক্ষেত্রে বুঝে নিতে হবে যে গোয়েন্দাদের সাফল্যের পরিমাপ সাধারণত এই কটি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হয়? অসীম সহিষ্ণুতা আর হাল ছেড়ে না দিয়ে অহোরাত্র সজাগ থাকা সম্ভাবনা ও দশভাগের সাত ভাগ, সহজজ্ঞান অথবা দিব্যচক্ষেদর্শন–সম্ভাবনা : দশভাগের দু-ভাগ, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়া–সম্ভাবনা? দশ ভাগের এক ভাগ! ধীশক্তির তথাকথিত চমক লাগানো নিদর্শন চেয়ারে বসা গোয়েন্দা আর রহস্য উপন্যাস লিখিয়েদের জন্যে বাস্তব জীবনে আমাদের ক্ষেত্রে তার কোনও স্থান নেই।
স্কোয়াড্রা মোবাইল (নরহত্যা স্কোয়াড) হতভাগিনী মেয়েটার সনাক্ত করার প্রচেষ্টা শুরু করল। টুকরো টুকরো অংশে আবিষ্কৃত হয়েছিল তার দেহ। তাই বিভিন্ন সময়ে দেশের নানাস্থান থেকে যে কয়েকশো মেয়ে বেমালুম উবে গিয়েছিল, তাদের নামের তালিকা নিয়ে বসলেন তারা কোনও হদিশ পাওয়ার আশায়। কিন্তু বৃথাই, কোনও সূত্রই পাওয়া গেল না! রাশি রাশি টেলিগ্রাম টেলিপ্রিন্টার বার্তা ঘোষণা, বিজ্ঞপ্তি ইটালির পুলিশ স্টেশনগুলোয় পর পর এসে পৌঁছোতে লাগল–কিন্তু রহস্যের তিমিরে এতটুকু আলোকের সন্ধান পাওয়া গেল না।
এ ধরনের দৈহিক বর্ণনার মানুষ খোঁজার ব্যাপারে সুফল লাভ কেউই ঠেকিয়ে রাখতে পারে যদি জনসাধারণের সক্রিয় সহযোগিতা পাওয়া যায়। কিন্তু এই বিশেষ তদন্তটিতে স্কোয়াড্রা মোবাইলের এই জাতীয় সাহায্যের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে আদেশটি তা স্বয়ং মুসোলিনীর। তার নিষেধাজ্ঞা বেরিয়ে গিয়েছিল কোনও খবরের কাগজ এ-কেসের খুঁটিনাটি ছাপতে পারবে না। তদন্তের মোটামুটি যে বিবরণ পুলিশের তরফ থেকে ছাড়া হত কাগজে প্রকাশের জন্য তার দৈর্ঘ্য তিরিশ লাইনের ওদিকে যেত না। এ আদেশের কারণও দেখিয়ে ছিলেন মুসোলিনী। বলেছিলেন, ফ্যাসিস্ট ইটালিতে এরকম পিশাচের মতো খুন-খারাপি করাটাই নাকি একদম অসম্ভব। আর যদিও বা কেউ করে থাকে তবে তা নিয়ে যত অল্প কথা বলা যায় ততই মঙ্গল।
যাই হোক শেষ পর্যন্ত তদন্ত যখন ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থায় এসে দাঁড়াল, তখন দৈনিকগুলো একযোগে ইল দুচের নিষেধ-বিজ্ঞপ্তিতে আর কোনও গুরুত্ব না দিয়ে খুঁটিনাটি জনসাধারণে প্রকাশ করে দেওয়াই সঙ্গত মনে করলে। প্রথম পাতা জুড়ে ছবি বেরুল খণ্ডবিখণ্ড মেয়েটার।
আর ঠিক তখন থেকেই সত্যি সত্যিই রহস্যের তিমিরাবগুণ্ঠন উঠে যেতে লাগল আস্তে আস্তে। প্রথম ট্রেনের দুজন যাত্রী খবর দিল যে হৃষ্টপুষ্ট চেহারার মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক তাদের কম্পার্টমেন্টে ঢুকেছিল। ভদ্রলোকের গোঁফের ডগা বেশ পাকানো এবং ছুঁচোলো। লাগেজ র্যাকে দুটো আঁশের তৈরি সুটকেস রেখে এক কোণে বসেছিল ভদ্রলোক। একচোট ঘুম দিয়ে উঠে দুজনে দেখলেন নেপলস্ যাওয়ার পথে রোমের মধ্যে ঢুকছে তাদের ট্রেন, ভদ্রলোক অদৃশ্য হয়েছে কামরার ভেতর থেকে, কিন্তু মালপত্র দুটি ফেলে গেছে তাকের ওপর।
সুটকেসের মালিকের এহেন দৈহিক বর্ণনা পাওয়া যাবার পর স্কোয়াড্রা মোবাইল ভদ্রলোকের খোঁজ পেল না স্পেজিয়াতে। এইখান থেকেই রোম আর নেপলস্ যাওয়ার এক্সপ্রেস ধরেছিল ভদ্রলোক। পিসা পর্যন্ত ট্রেনভ্রমণ করেছিল। রওনা হবার পর প্রথম স্টপ ওইখানেই পিসাতে ট্রেন থেকে নেমে ফিরতি ট্রেন ধরে সে ফিরে আসে লা স্পেজিয়াতে।
এই তথ্য জানার পরেই খুনটা এসে পড়ল আমারই অফিসের আওতায়। তার কারণ, ওই সময় লা স্পেজিয়া নরহত্যা স্কোয়াডের চিফ ছিলাম আমি। লা স্পেজিয়া একটা সদাব্যস্ত বন্দর। টাইরেনিয়ান উপকূলে তার অবস্থান। এতক্ষণ পর্যন্ত সমস্যাময় জটিল কেসটা আমাদের সবার আলোচনার খোরাক জোগালেও মূল রহস্যভেদের সবটুকু দায়িত্বই ছিল রোমের পুলিশের। কিন্তু এই নতুন আবিষ্কারের বৃত্তান্ত শুনলেই খুবই সম্ভব যে অনুমানটি সবার আগে মাথায় আসে তা হল এই যে খুনি এই লা স্পেজিয়া শহরে আমাদেরই মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে–সেক্ষেত্রে তার সমুচিত দণ্ডবিধানের দায়িত্ব তো আমাদেরই। আমার ডিপার্টমেন্টে এমন লোক একটিও ছিল না যে ওই নররাক্ষসটার মণিবন্ধে লোহার গয়না পরিয়ে দেওয়ার আগ্রহকে ক্ষুরের মতো শাণিত করে রাখেনি। নির্দিষ্ট সময়ের চাইতেও আরও অনেক বেশি ঘণ্টা আমরা ব্যয় করতে লাগলাম হোটেলে হোটেলে এবং প্রতিটি বোর্ডিং হাউসের মালিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে। একমাত্র আশা, হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনও তথ্য পাওয়া যাবে তাদের কাছ থেকে। বন্দর-অঞ্চলে আমাদের টিকটিকিরা অগুন্তি গণিকালয় আর পানাগারে তল্লাসি চালাল। কিন্তু কোথাও এতটুকু কানাঘুসোও শুনলাম না রাক্ষসটার সম্বন্ধে।
তার পরেই আচম্বিতে একদিন নীলাকাশ থেকে বাজ নেমে আসার মতো বিপুল সৌভাগ্য খসে পড়ল আমাদের তদন্ত-পর্বে। কি করে বরাত খুলল, সেই কথাই বলি এবার। তন্ন তন্ন করে তল্লাসি চালানোর পর যখন কোনওদিনই কোনও আলোর সন্ধান পেলাম না, তার দুদিন পর অফিসে বসে স্থানীয় খবরের কাগজটার পাতা ওলটাচ্ছি, এমন সময়ে নজরে পড়ল ছোট্ট একটা পরিচ্ছেদ। রেলওয়ে স্টেশনের কাছে রাবিশের স্তূপের ওপর একটা বড় সাইজের ছুরি পড়ে থাকতে দেখেছিল একটি অল্পবয়সি ছেলে। এ জাতীয় ছুরি রান্নাঘরের কাজেই লাগে। ছেলেটির মনে কোনও অসাধুতা ছিল না। তাই ছুরিটা পাওয়ামাত্রই সে জমা দিয়ে দেয় হারানো-প্রাপ্তি অফিসে।
ছুরিটা সম্পর্কেই ভাবছিলাম। ভাবছিলাম কী কী কাজে দরকার হতে পারে ছুরিটার। আর তার পরেই আচমকা ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম আমি। তারস্বরে হুকুম দিয়ে ডাকিয়ে আনলাম আমার এক সহকারীকে এবং দুজনে মিলে তৎক্ষণাৎ গাড়ি হাঁকালাম হারানো প্রাপ্তি অফিসের দিকে। ছুরিটাকে নিয়ে রাখলাম আমাদের জিম্মায়। পুলিশ ল্যাবরেটরির রিপোর্ট থেকে জানা গেল ফলার ওপর যে দাগগুলো পাওয়া গেছে, আসলে তা মানুষের রক্ত ছাড়া আর কিছু নয়। অর্থাৎ পায়ের কাজ আরও কিছুটা বাড়লো। শহরে যে-কটা জিনিসপত্রের, কাঁচের বাসনপত্রের আর স্টেশনারি দোকান ছিল, সবকটার মালিক আর কর্মচারীদের প্রশ্নে প্রশ্নে বিপর্যস্ত করে ফেললাম। শেষকালে যে প্রমাণের জন্যে এত পরিশ্রম, তা পাওয়া গেল। একজন সেলসম্যানের মনে পড়ল ওই রকম আকারের একটা ছুরি একদিন সে বিক্রি করেছিল হৃষ্টপুষ্ট চেহারার মাঝবয়সি ছুঁচালো গোঁফওয়ালা এক ভদ্রলোকের কাছে। রোম এক্সপ্রেসে লোকটার যেরকম বর্ণনা পাওয়া গিয়েছিল, সেলসম্যানের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে গেল । আবিষ্কার শুধু এই একটাই নয়। কেননা কয়েকটা বাড়ি পরেই আরও একটা দোকান দেখলাম আমরা। এই দোকান থেকেই আমাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গোঁফওয়ালা বন্ধুটি কিনেছিলেন তিন-তিনটে আঁশের তৈরি সুটকেস।
খুনে বদমাশটাকে যে এই লা স্পেজিয়াতেই পাওয়া যাবে, এ বিষয়ে আর তিলমাত্র সন্দেহ রইল না আমাদের মনে। এ কাজে যে ধরনের গোয়েন্দাদের দরকার, তাদের প্রতিজনকে পাঠিয়ে দিলাম আমি বাড়ি বাড়ি তল্লাসির হুকুম দিয়ে। একটা বাড়িও বাদ গেল না। তারপর শুধু একটা বিশেষ অঞ্চলে সঙ্কীর্ণ করে আনলাম এই চিরুনি দিয়ে আঁচড়ানো তদন্ত-পর্ব। এবং শেষ পর্যন্ত তা সীমিত হয়ে এল একটি মাত্র বিশেষ রাস্তায়।
খুনটা আবিষ্কার হওয়ার ঠিক একমাস পরে ১৯৩২ সালের ১৫ই ডিসেম্বর আমি নিশ্চিন্ত হলাম। নিশ্চিন্ত হলাম এবার ঠিক কোন কোন জায়গাটিতে অভিযান চালাতে হবে, সে সম্পর্কে। জানলাম, লা স্পেজিয়ার দরিদ্রতম অঞ্চলের পাথর দিয়ে বাঁধানো এবড়োখেবড়ো সঙ্গীর্ণ রাস্তা ভায়া ডেনোভার একটা শ্রীহীন বাড়ির পাঁচ তলায় উঠে এবার তৎপর হতে হবে আমাদের। সেইদিনই দুজন গোয়েন্দাকে নজর রাখতে বলেছিলাম বাড়িটার ওপর। তারা খবর পাঠালে, সারাদিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে কেউ বাইরে আসেনি। স্থির করলাম, আর নয়, এবার ঢুকে পড়া যাক।
পিস্তল বাগিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে কাঁচকেঁচে সিঁড়ি বেরিয়ে ওপরে ওঠার সময়ে দারুণ উত্তেজনায় কি প্রচণ্ড শব্দে ধ করেছিল হৃদযন্ত্রটা, তা আজও আমার মনে আছে। শুধু এই মুহূর্তটির জন্যে কি প্রচণ্ড খাটুনিটাই না গেছে ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকের। এসেছে সেই মুহূর্ত–পরিশ্রমের ফল হাতের মুঠোর মধ্যে এসে গেল প্রায়। পাঁচতলায় পৌঁছনোর পর আমার পিছু পিছু এল একজন গোয়েন্দা। দেখলাম, করিডরের দুটো দরজার মধ্যে একটা সামান্য খোলা রয়েছে। পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকে দেখলাম ঘরটাকে রান্নাঘরই বলা উচিত। ঘরে ঢোকামাত্র যে জিনিসটা সবার আগে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল, তা হচ্ছে একটি বালতি। দেওয়ালের পাশেই বসানো ছিল বালতিটা। বালতিটার কিনারা পর্যন্ত উঁচু হয়েছিল কাঠের কুচো–যে ধরনের কুচো দিয়ে প্যাক করা হয়েছিল লাশটার মুন্ডুটা–হুঁবহু সেই রকমই।
রান্নাঘরের ভেতরের দরজা দিয়ে যাওয়া যায় আর একটি ঘরে। দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলাম আমি। ঘরটা পুরোনো কিন্তু জমকালো আসবাবপত্রে একদম ঠাসা। দুজন পুরুষ আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল। বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়িয়েই আমার হাতে পিস্তল দেখামাত্র নিমেষের মধ্যে তারা হাত বাড়িয়ে দিলে নিজের নিজের পকেটের দিকে।
হুঁশিয়ার করে দিই আমি–নড়বেন না। নড়লেই গুলি চালাব।
মাথার ওপর হাত তুলে দেয় দুজনে। একজন বললেন–আমাদের পরিচয়টা দেওয়া দরকার। আমি হলাম রোম ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের কমিশনার এরিকো। আর ইনি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট, সিগনর মুস্কো।
পরিচয় শোনার পর আমার রসনায় আর কোনও কথাই ফুটল না। মাথার মধ্যে রাগ, অপমান, হতাশার তুমুল দাপাদাপির চাইতেও হতভম্ব হয়েছিলাম সবচাইতে বেশি। তার কারণও ছিল যথেষ্ট। বুদ্ধিকৌশল দক্ষতার প্রতিযোগিতায় আমারই এক্তিয়ার শহরে বসে টেক্কা মারা হল আমার ওপর। শুধু তাই নয়। যে দুই আইন রক্ষক অফিসার এইভাবে আমার গালে চুনকালি লেপে দিলেন, সমস্ত তদন্তপর্বটা তারা পরিচালনা করেছেন ২৫০ মাইল দূরে বসে। তারপর লা স্পেজিয়াতে এসেছেন তাঁদের পরিকল্পনার এতটুকু আভাস কাউকে না জানিয়ে।
কাউন্ট সিজারে সারভিয়াত্তি কোথায়? এ বাড়িতে যার বাস এবং যাকে গ্রেপ্তার করার জন্যেই আমাদের আগমন, তাকে রেখেছেন কোথায়?–শুধোলাম আমি।
খরখরে চোখে আমার দিকে তাকালেন কমিশনার এরিকো। জবাব দিলেন–আপনি লা স্পেজিয়ার ডোসি। আমার বোঝা উচিত ছিল।
এবার হতভম্ব হয়ে তাকানোর পালা তার। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে তারপর উত্তর দিলেন আমার প্রশ্নের–টুকরো টুকরো করে কাটা মেয়েটার হত্যাকারী হিসাবে আমরাও তাকে সনাক্ত করেছিলাম। গতকাল সারভিয়াত্তিকে গ্রেপ্তার করেছি আমরা। এখন সে রয়েছে রোমের রেজিনা কোয়েলি জেলখানায়।
বটে, তাহলে এই ব্যাপার। মাস কয়েক মুহূর্ত আগেও আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, কুখ্যাত খুনেটার কোমরে বেড়ি পরানোর সম্মান এবার লা স্পেজিয়ার পুলিশ-মহলই পাবে। কিন্তু রোম তা ছিনিয়ে নিয়ে গেল একদিন আগে এসে।
কেসটা নিয়ে আলোচনা হল কমিশনার এরিকো আর আমার মধ্যে। শুনলাম খুনেটার হদিশ বার করার জন্যে তারা নাকি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একেবারে নিজস্ব একটা পদ্ধতিমাফিক তল্লাসি পর্ব চালিয়েছিলেন। তদন্ত পর্বের প্রথম দিকেই একজন রোম গোয়েন্দা বলেছিলেন পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপন থেকে হয়তো সূত্র পাওয়া যেতে পারে। তৎক্ষণাৎ বিভিন্ন দৈনিকের ফাইল ঘাঁটা শুরু হল। অনেক পরিশ্রমের পর সম্ভাবনাময় কয়েকটা পয়েন্টও পাওয়া গেল।
এরপর গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে উঠল কয়েকটা লোককে নিয়ে। এরা প্রত্যেকেই মনোমত গিন্নি লাভের আশায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল কাগজে। এদের প্রত্যেকের গতিবিধি আর চরিত্র নিয়ে জোর গবেষণা চলল কিছুদিন। কিন্তু বৃথাই। এমন একটি লোককেও পাওয়া গেল না যার ওপর টেনেটুনে এতটুকু সন্দেহের ছায়া ফেলা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন নাছোড়বান্দা টিকটিকির নজরে পড়ল বহু পুরোনো একটা বিজ্ঞাপন। লা স্পেজিয়া শহরের এক অজ্ঞাতনামা পুরুষ বিবাহের আমন্ত্রণ জানিয়েছে বিজ্ঞাপনে। বিজ্ঞাপন-বার্তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু শহরের নামটি। খবরটা এইরকম ।
সম্ভ্রান্ত পুরুষ, বিত্তবান, যুবাপুরুষ নয়, কিন্তু উদার এবং কোমল স্বভাব, পারিবারিক বন্ধনবিহীন তরুণী, কন্যার সঙ্গে বিবাহের জন্যে পত্রালাপ করতে ইচ্ছুক।
রোম-পুলিশ এই বিজ্ঞাপনের সঙ্গে একটি উধাও-হওয়া মেয়ের যোগসূত্র বার করে ফেললে। মেয়েটির বয়স বছর তিরিশ। একটা বাড়ির সাংসারিক কাজকর্ম দেখাশুনো করত সে। নভেম্বরের গোড়ার দিকে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যায় সে। অন্নদাতাদের কাছে অবশ্য সে খোলাখুলি বলে গিয়েছিল তার গন্তব্য শহরের নামটা। সে নাকি পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপনের উত্তর দিয়েছিল এবং তার ভবিষ্যৎ স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বন্দোবস্ত হয়েছে লা স্পেজিয়া শহরে। এরপর থেকে তার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশ আরও জানাল, মেয়েটির বাঁ-পা খোঁড়া ছিল, পা টেনে টেনে চলতে হত তাকে। আর ঠিক এই শারীরিক বিকৃতিটুকুই নিহত মেয়েটির লাশ পরীক্ষা করতে গিয়ে ডাক্তারদের নজরে পড়েছিল।
লা স্পেজিয়া শহরে উদার এবং কোমলস্বভাব সম্ভ্রান্ত পুরুষটির হদিশ বার করা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। তৎক্ষণাৎ রোম থেকে গোয়েন্দাদের পাঠানো হল এ শহরে–লীলাখেলা যে সাঙ্গ হয়েছে এ খবর জানার আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা দরকার। কমিশনার এরিকো যখন তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসে পৌঁছোলেন, তখন সবেমাত্র রোম অভিমুখে রওনা হয়েছে কাউন্ট সিজারে সারভিয়াত্তি। রোমের একটা হোটেলে পাওয়া গেল তাকে। ভদ্রলোককে হাজতে পুরে তারা ফিরে এলেন লা স্পেজিয়াতে। এলেন সেই ঘরটিতে যে ঘরটি সারভিয়াত্তি ভাড়া নিয়েছিল বিজ্ঞাপনের টোপ গিলে আসা হতভাগিনী মেয়েগুলোকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে।
আগেই বলেছি, খুনে বদমাশটার বদলে কমিশনারকে গ্রেপ্তার করতে উদ্যত হয়েছিলাম–এ তথ্য জানার পর রীতিমতো খিঁচড়ে গিয়েছিল আমার মনমেজাজ। কিন্তু তবুও একদিক দিয়ে আমার ওই তিক্ত মেজাজে সন্তোষের বারি সিঞ্চন হয়েছিল। বেশির ভাগ সাক্ষ্য প্রমাণ জুগিয়েছিলাম আমিই এবং এই সাক্ষ্য-প্রমাণের বলেই চরম দণ্ড নেমে এসেছিল সারভিয়াত্তির শিরে। আমি আরও প্রমাণ করে দিয়েছিলাম যে পাওলিনা গোরিয়াত্তিই হচ্ছে সারভিয়াত্তির সর্বশেষ শিকার। রোমের যে মেয়েটি সংসারের কাজকর্ম দেখাশুনো করার কাজ ছেড়ে একদিন নিপাত্তা হয়ে গিয়েছিল, পাওলিনা গোরিয়াত্তি তারই নাম। বিবাহের প্রতিশ্রুতির প্রলোভন দিয়ে আসার পর যে-কটি মেয়েকে যমালয়ে পাঠানো হয়েছে, এ হচ্ছে তাদের সর্বশেষ। প্রতিটি মেয়ে আসবার সময়ে সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ নিয়ে এসেছে এবং তাকে খুন করা হয়েছে এই কাঞ্চন লোভেই। তারপর দেহটাকে কেটে টুকরো করে পাচার করা হয়েছে নানাদিকে।
কাহিনির উপসংহারে এসে বিলক্ষণ বিরাগ সত্ত্বেও আর একটি নাম মনে পড়ছে। বেল গিনেস একটি অসুন্দর আমেরিকান মহিলার নাম। বিয়ের লোভ দেখিয়ে টাকাকড়িসমেত পুরুষদের ভুলিয়ে আনত সে নিজের খামার বাড়িতে। তারপর যথাসময়ে তাদের খুন করে দেহগুলি থোড়কুচি করত। এবং এই থোড়াকুচি পর্বটি যে কাঠের ব্লকটির ওপর হতো, তার ওপরেই জবাই করা শুয়োর কেটে কুচিকুচি করত বেল গিনেস। এই একই নারকীয় ব্যবসায় হাত পাকিয়েছিল কাউন্ট সারভিয়াত্তি। একটা অপরিচ্ছন্ন হোটেল মালিক ছিল ভদ্রলোক। সেখানে হানা দিতেই আরও দুই হতভাগিনীর দেহাবশেষ পেয়েছিলাম আমি।
তাদের একজনের নাম বিসে মারগারুচ্চি। স্থানীয় দাঁতের ডাক্তার তার দাঁতের চিকিৎসা করেছিলেন একবার এবং তারও রেকর্ডও রেখেছিলেন তিনি। তাই মেয়েটির দাঁত দেখেই তাকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল ডাক্তারের পক্ষে।
ইটালিতে আজকাল আর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না বটে, কিন্তু যে সময়ের কাহিনি লিখলাম সে সময়ে মুসোলিনী কয়েকটি অপরাধের শাস্তি এইভাবেই দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কাউন্ট সারভিয়াত্তিও রেহাই পেল না এই হুকুমনামা থেকে।
গ্রেপ্তার এবং অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার কয়েক মাস পরে একদিন খুব ভোরে তাকে হিড়হিড় করে টেনে আনা হল ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে। ককিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অনুনয় বিনয় করতে লাগল সে। তার পরেই একসঙ্গে গর্জে উঠল রাইফেলগুলো এবং চিরকালের মতো নির্বাক হয়ে গেল এযুগের সবচেয়ে কুখ্যাত মেয়ে-খুনে কাউন্ট সিজারে সারভিয়াত্তি।
* কম্যান্ডাটোর যুসেপেপদোসা (রোম ইতালি) রচিত কাহিনি অবলম্বনে।