1 of 2

সবুজ মানুষ

সবুজ মানুষ

একমনে নিজের সঙ্গে গলফ খেলা প্র্যাকটিশ করে চলেছে এক যুবক সমুদ্রের ধারে বালুকা সৈকতের ওপর। গোধূলির ধূসর রঙের ছোঁয়া লেগেছে সমুদ্রে। কোনও স্ট্রোকের মধ্যেই হেলাফেলা নেই, আছে একাগ্র নিষ্ঠা, আণুবীক্ষণিক প্রচণ্ডতা। যেন নিখুঁত খুদে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে এক-একটা স্ট্রোক মারার সঙ্গে-সঙ্গে। চটপট অনেক খেলাই সে রপ্ত করেছে এই জীবনে; কিন্তু চটপট খেলা রপ্ত করে নেওয়ার প্রবণতা আছে বলেই যেসব খেলা চটপট শেখা যায় না, সেসবও রপ্ত করেছে খুবই তাড়াতাড়ি। অ্যাডভেঞ্চার জিনিসটাকে সে ভালোবাসে, অ্যাডভেঞ্চার-ঠাসা পরিবেশে থাকতে পারলে আর কিছুই চায় না। বর্তমানে সে স্যার প্রদ্যুম্ন মল্লিকের প্রাইভেট সেক্রেটারি। বালুকা-সৈকতের ঠিক পাশেই এই যে বিরাট উদ্যান, তার ঠিক পেছনেই স্যার প্রদ্যুম্নর বিশাল ইমারত। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। বলেই অনন্তকাল কারো প্রাইভেট সেক্রেটারি হয়ে থাকার অভিপ্রায় নেই যুবকটির। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানও আছে সেই সঙ্গে; তাই সে যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বুঝেছে সেক্রেটারি জীবনটায় ছেদ টেনে দেওয়ার শ্রেষ্ঠ পন্থা হল, নিষ্ঠার সঙ্গে সেক্রেটারিগিরি করে উত্তম সেক্রেটারিরূপে স্বীকৃতি পাওয়া। কার্যত সে তাই বটে। অতি উত্তম সেক্রেটারি। গলফ বলটিকে যেরকম ক্ষিপ্রতা সহকারে নিয়ে ফেলছে একদিক থেকে আর একদিকে, হুবহু সেই ক্ষিপ্রতা দিয়ে একাই জবাব দিয়ে যাচ্ছে স্যার প্রদ্যুম্নর নিত্য জমে যাওয়া চিঠির তাড়ার। চিঠির জবাব নিজের মর্জিমাফিক একাই দিয়ে যেতে হচ্ছে বর্তমানে। বলতে গেলে, একাই লড়ে যাচ্ছে পত্রবাহিনীর সঙ্গে। কারণ স্যার প্রদ্যুম্ন তাঁর বিলাস-তরণী নিয়ে জলে ভেসেছেন ছমাস আগে। ফেরার সময় হয়েছে–ফিরেও আসছেন–কিন্তু বেশ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে সম্ভাবনা নেই। কয়েক ঘণ্টা কেন, কয়েক দিনও কেটে যেতে পারে। তারপর হয়ত ফিরবেন।

যুবকটির নাম বিপুল ব্যানার্জি। খেলোয়াড়ি পদক্ষেপে বালুকা সৈকতের গা-ঘেঁষে ঘাসজমিটুকু পেরিয়ে এসে দৃষ্টিচালনা করল সমুদ্রের দিকে। দেখল একটা অদ্ভুত দৃশ্য। সুস্পষ্ট দেখতে পেল না অবশ্য। ঝোড়ো মেঘের আড়ালে গোধূলির আলো মিলিয়ে যাচ্ছে একটু-একটু করে–ঘনীভূত হচ্ছে। তমিস্রা। কিন্তু পলকের জন্যে মনে হল যেন ইতিহাস-আশ্রিত একটি নাটক, অথবা একটা ভৌতিক নাটক স্বপ্নকারে অভিনীত হয়ে চলেছে অদূরে–মুহূর্তের মরীচিৎকার মতো যেন বহু যুগের ওপার থেকে ভেসে এসেছে একটা দৃশ্য।

সূর্যাস্তের শেষ রশ্মি তাম্রবর্ণ এবং সুবর্ণবর্ণ সুদীর্ঘ রেখাপাত করেছে কালচে সমুদ্রের ওপর। নীল সমুদ্র আর নীল নেই কৃষ্ণবর্ণ হয়ে এসেছে এর মধ্যেই অন্ধকারের এই পটভূমিকায় দেখা যাচ্ছে আরও অন্ধকারময় দুটি মূর্তিকে। যেন ঐতিহাসিক নাটকের দুটি চরিত্র। যেন মূকাভিনয় চলছে ঘনিয়ে আসা আঁধারের বুকে। একজনের মাথায় উষ্ণীষ–আরেকজনের কোমরে তরবারি। যাত্রাদলের দুটি চরিত্র যেন সহসা নেমে এসেছে ছায়াময় দেহ নিয়ে দারুময় কোনও জাহাজের মধ্যে থেকে।

মরীচিকা দর্শনের প্রবণতা নেই বিপুল ব্যানার্জির। ছায়াদৃশ্যও মরীচিকাসম নয় মোটেই। যুক্তিবুদ্ধি বৈজ্ঞানিক নিষ্ঠা নিয়ে যে-কোনও পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করে নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। অতীত অথবা ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে যে-কোনও দৃশ্যই ভেলকির মতো সহসা আবির্ভূত হলে মন দিয়ে যাচাই করে নিতে সে পারে। তাই বিচিত্র এই মূকাভিনয় দেখে মুহূর্তের মধ্যে উপনীত হল যে সিদ্ধান্তে উঁদে ভবিষ্যদ্বক্তাও অত তাড়াতাড়ি সে সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছতে পারত কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে বিলক্ষণ।

চক্ষুভ্রম কেটে যায় মুহূর্তের মধ্যে। পরমুহূর্তেই চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বিপুল ব্যানার্জি যা দেখল তা অস্বাভাবিক হতে পারে, অবিশ্বাস্য নয় মোটেই। একটি মূর্তি রয়েছে আরেকটি মূর্তির পেছনে–প্রায় পনেরো গজ পেছনে। দুজনকেই দেখে মনে হচ্ছে যেন–রাজবেশ আর সেনাপতির বেশ পরে নেমে এসেছে দুটি মানুষ সমুদ্র অভিযান সাঙ্গ করে। ঝলমলে পোশাকের জরি আর ঝালর, উষ্ণীষের মণি আর তরবারির সুদৃশ্য কোষ দূর থেকেও আর ততটা অস্পষ্ট মনে হচ্ছে না। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এহেন বেশ পরে যাত্রাদলে অভিনয় চলে, মঞ্চে বীরদর্পে হাঁটা যায়, নিরালা সমুদ্রতীরে কেউ এভাবে হাওয়া খেতে আসে না। সামনের মূর্তিটি হনহন করে হাঁটছে, আপনমনে, খেয়ালই নেই যে পেছনে আসছে আর একজন। প্রথম ব্যক্তির খাড়া নাক আর ছুঁচলো দাড়ি দেখেই কিন্তু চিনতে পেরেছে বিপুল ব্যানার্জি। স্যার প্রদ্যুম্ন মল্লিক–তার মনিব। পেছন-পেছন যে আসছে, তাকে সে চেনে না। কিন্তু যাত্রাপার্টির অভিনেতাদের মতো এই যে কুচকাওয়াজ, এর অর্থ অস্পষ্ট নয় তার কাছে। স্যার প্রদ্যুম্ন যাত্রা-পাগল মানুষ। বছরের বেশির ভাগ সময় নিজস্ব বজরায় যাত্রার সরঞ্জাম আর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যাত্রা দেখিয়ে বেড়ান এমন-এমন জায়গায়, যেখানে শহরের কোনও যাত্রাপার্টির পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় কোনওমতেই। যাত্ৰাই তার প্রাণ, যাত্ৰাই তার জীবন। শখের পার্টি নিয়ে জলবেষ্টিত বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে গিয়ে প্রমোদ বিতরণ করে যতটা আনন্দ দেন, তার শতগুণ আনন্দ পান নিজে। সেই বজরা যে ফেরার পথে, এ খবর রাখে বিপুল ব্যানার্জি। ছ-মাস পরে বাড়ি ফিরছেন স্যার প্রদ্যুম্ন। বজরা রেখে এসেছেন নিশ্চয় কাছাকাছি কোথাও। পরনে তাই যাত্রার রাজবেশ। কিন্তু বজরা থেকে রাজবেশ পরে তিনি নেমে এলেন কেন, এই রহস্যটা রহস্যই রয়ে গেল বিপুল ব্যানার্জির মস্তিষ্কে। মিনিট পাঁচেক তো লাগত ধড়াচূড়া পালটাতে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলেই পারতেন। রহস্যটা তাই জটিল ধাঁধার আবর্ত রচনা করে গেল সেক্রেটারি মশায়ের মগজের কোষে-কোষে। স্যার প্রদ্যুম্নর অভ্যেস সে জানে। কোথায় কী ধরনের পোশাক পরতে হয়, কখন কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়–স্যার অন্তত তা ভালো করেই জানেন। রহস্যটা তাই বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে জবর রহস্য থেকে গেছিল রহস্যময় এই ব্যাপারের সবচেয়ে বড় রহস্যের আকারে। ধূসর গোধূলি, ঘনায়মান আঁধার আর চলমান ওই দুটি নিঃশব্দ মূর্তি যেন যাত্রাপার্টিরই একটি নাটকের অংশবিশেষ।

প্রথম ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি অসাধারণ দ্বিতীয় ব্যক্তি। পরনে যদিও সেনাপতির পরিচ্ছদ–কিন্তু চেহারা অতি অসাধারণ, তার চেয়েও অসাধারণ তার আচরণ। হাঁটছে অদ্ভুতরকম এলোমেলোভাবে–অস্বস্তি যেন ঠিকরে-ঠিকরে পড়ছে প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি অঙ্গসঞ্চালনে। কখনও হাঁটছে দ্রুতচরণে, কখনও মন্থর গতিতে। স্যার প্রদ্যুম্নর নাগাল ধরে ফেলা উচিত হবে কিনা, যেন ভেবে ঠিক করে উঠতে পারছে না কিছুতেই। স্যার প্রদ্যুম্ন কানে কম শোনেন বলেই বোধ হয় পেছনে বালির ওপর পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না। যদি শুনতে পেতেন এবং যদি ডিটেকটিভগিরি জানতেন, তাহলে শুধু পদশব্দ শ্রবণ করেই আঁচ করে নিতে পারতেন পায়ের মালিক কখনও খুঁড়োচ্ছে, কখনও নাচছে, এবং এই দুইয়ের মাঝখানে আরও প্রায় বিশ রকমের ভঙ্গিমায় পেছন-পেছন আসছে। লোকটার মুখ আঁধারে ভালো করে দেখা না গেলেও চকিত চাহনির ঝলক দেখতে পাচ্ছে বিপুল ব্যানার্জি নিরতিশয় উত্তেজনা যেন অদৃশ্য রশ্মি আকারে বিচ্ছুরিত হচ্ছে মুহুর্মুহু চঞ্চল দুই অক্ষিতারকা থেকে। একবার সে পাইপই করে দৌড়তে গিয়েও সামলে নিল পরক্ষণেই মন্থরচরণে পা ফেলে গেল অন্যমনস্কভাবে। তারপরেই যে কাণ্ডটি করে বসল, তা কোনও যাত্রাদলের অভিনেতার কাছে অন্তত আশা করেনি বিপুল ব্যানার্জি বিশেষ করে নিরালা এই সমুদ্রসৈকতে।

লোকটা খাপ থেকে টেনে বার করল তরবারি।

নাটকের এই নাটকীয় মুহূর্তে ক্লাইম্যাক্স যখন ফেটে পড়তে চলেছে, ঠিক তখনি চলমান মূর্তিদুটি অন্তর্হিত হল সৈকতভূমির একটা টিলার আড়ালে। ক্ষণেকের জন্যে বিস্ফারিত চক্ষু সেক্রেটারি শুধু দেখলে অবহেলাভরে বেগে তরবারি চালনা করে একটা সামুদ্রিক উদ্ভিদের শিরচ্ছেদ করল বিচিত্ৰবেশী আগন্তুক। ভাবসাব দেখে মনে হল যেন প্রথম ব্যক্তিটিকে কচুকাটা করতে পারার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় বিষম আক্রোশে ঝাল ঝাড়ল নিরীহ উদ্ভিদটার ওপরেই।

কিন্তু ভয়ানক চিন্তাকুটিল হয়ে উঠল মিস্টার বিপুল ব্যানার্জির বদনমণ্ডল। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সৈকতভূমিতে ঘনায়মান চিন্তার মেঘে আচ্ছন্ন দুই চোখ মেলে।

তারপর গম্ভীরবদনে মন্থরচরণে অগ্রসর হল রাস্তার দিকে। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে রাস্তা বেঁকে গেছে অনেক দূর পর্যন্ত–স্যার প্রদ্যুম্নর বিশাল প্রাসাদের পাশ দিয়ে গেছে এই সড়ক আরও কিছু দুরে।

সমুদ্রতীর থেকে প্রাসাদে পৌঁছতে গেলে স্যার প্রদ্যুম্নকে আসতে হবে এইপথ ধরেই। দূর থেকে সেক্রেটারি তার হাঁটার ধরন দেখে আন্দাজে তাই রওনা হল সেইদিকেই। নিশ্চয় বাড়ির দিকেই চলেছেন স্যার প্রদ্যুম্ন। অচিরে আবির্ভূত হবেন বাঁকা সড়কে। পথটির প্রথম অংশ বালিতে ঢাকা– যেহেতু সৈকত বরাবর গিয়েছে। তারপর বালি শক্ত হয়েছে আরও কিছুদূর এগিয়ে–অনতিদূরে দেখা যাচ্ছে মল্লিকভবন। প্রথমে মন্থরচরণে, তারপর দ্রুত পদক্ষেপে, অবশেষে নক্ষত্রবেগে নিরেট বালি দিয়ে তৈরি এই পথের দিকেই ধেয়ে গেল বিপুল ব্যানার্জি। গড়িমসি করা তার ধাতে নেই, সবকিছুই করে তড়িঘড়ি–সফল জীবনের মন্ত্রগুপ্তি তো সেইটাই।

কিন্তু একী! বাড়ি ফেরার পথ ধরে স্যার প্রদ্যুম্নকে তো বাড়ি ফিরতে দেখা গেল না। কোথায় গেলেন তিনি?

তার চাইতেও আশ্চর্য ব্যাপারটা দেখা গেল কিন্তু এর পরেই।

বাড়ি অভিমুখে রওনা হল না বিপুল ব্যানার্জিও।

গেল কোথায়, তা জানে শুধু বিপুল ব্যানার্জিই। বাড়ি ফিরেছিল ঠিকই–বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে। বিপুল রহস্য এবং ভয়ানক উত্তেজনার সঞ্চার ঘটিয়ে বসিয়েছিল মল্লিকভবনের প্রতিটি প্রাণীর অন্তরে দীর্ঘ অনুপস্থিতির দরুন।

বিরাট বিরাট থাম আর পামবৃক্ষ সুশোভিত প্রাসাদে অধীর হয়ে উঠেছিল প্রত্যেকেই। এত দেরি হচ্ছে কেন? সাগ্রহ প্রতীক্ষার পরিশেষে উপস্থিত হল নিদারুণ অস্বস্তি। সবচেয়ে বেশি ছটফট করতে দেখা গেল খাসভৃত্য কদমচাঁদকে। বিপুলকায় এই জীবটি স্বভাবে অতিশয় শান্ত, অস্থিরতা বস্তুটা ধাতে নেই মোটেই। কথা বলে খুব কম–অস্বাভাবিক নীরবতাই তার চরিত্রের বৃহত্তম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এহেন শান্তশিষ্ট নির্মূপ প্রকৃতির জীবটিই মুহুর্মুহু গবাক্ষপথে দৃষ্টিচালনা করতে থাকে সমুদ্রসৈকতের ওপর দীর্ঘ বাঁকা সাদা পথটির দিকে সবেগে পদচারণা করতে থাকে সামনের বড় হলঘরটিতে।

স্যার প্রদ্যুম্নর প্রাণপ্রিয় ভগ্নী প্রমীলার চিত্তও চঞ্চল হয়েছে বিলক্ষণ। খেয়ালি ভাই যাত্রা নিয়ে ব্যস্ত থাকে বারোমাস। এত বড় বাড়ি আর সংসারের যাবতীয় ঝঞ্জাট পোহাতে হয় তাকেই। নামটা তার প্রমীলা-আকৃতিতেও রাবণপুত্র মেঘনাদের পত্নী প্রমীলার মতোই। বিবাহ নামক শুভকার্যটি ললাটে লেখা ছিল না সেই কারণেই। ভাইয়ের মতই তার নাসিকা প্রত্যঙ্গটি অবিকল খাঁড়ার মতোই শাণিত এবং কোপ মারার ভঙ্গিমায় উদ্যত। শুধু এই খাঁড়া নাকের মহিমাতেই জবরদস্ত এই মহিলাটিকে ভয় পায় এ তল্লাটের কাক-চিল পর্যন্ত। এই পৃথিবীর সব্বাই জানে, মেয়েরা জিহ্বা চালনায় এবং অবিরল কথা বলে যাওয়ায় টেক্কা মারতে পারে যে-কোনও বচনবাগীশ পুরুষকে। প্রমীলা হার মানিয়ে দেয় দুনিয়ার সব মেয়েছেলেকে। মুখে কথার তুবড়ি ফোটে অনর্গল বিরাম নেই এক মুহূর্তের জন্যেও। ঘ্যানোর-ঘ্যানোর করা নয় কিন্তু। কানের পোকা বার করে দেওয়ার মতো আতীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর মাঝে-মধ্যে যখন কাকাতুয়ার তীব্র ডাকের মতো প্রচণ্ড হয়ে ওঠে, তখন কাক-চিল পর্যন্ত উড়ে পালায় মল্লিকবাড়ির ত্রিসীমানা ছেড়ে।

স্যার প্রদ্যুম্নর প্রাণাধিকা কন্যা অলিম্পিয়া কিন্তু একেবারেই বিপরীত প্রকৃতির। পিসির মতো ডাকসাইটে তো নয়ই, আকৃতিতেও মেঘনাদ-পত্নীর মতো নয়। রঙটা একটু ময়লা বটে, কিন্তু আয়ত দুই চোখে অষ্টপ্রহর স্বপ্ন যেন লেগেই আছে। চেঁচিয়েমেচিয়ে পিসি বাড়ি মাতিয়ে রাখে বলেই বোধ হয় তার আর চেঁচানো তো দূরের কথা, টু শব্দটিও করার দরকার হয় না। চোখেমুখে মাখানো অদ্ভুত বিষাদ। কেন, তা জানা নেই এই কাহিনিকারের। এহেন ভাইঝির সঙ্গে তাই একাই তড়বড় করে কথা বলে যেতে হয় খান্ডারনি পিসিকে এবং বিন্দুমাত্র অনিচ্ছা প্রকাশ পায় না অনর্গল কথা বলার সময়ে। কানে তো আর তুলো গুঁজে রাখা যায় না, তাই চুপচাপ সব শুনে যায় অলিম্পিয়া। মাঝে-মাঝে কিন্তু এমন প্রাণখোলা হাসি হেসে ওঠে, যা শুনলে এবং দেখলে থমকে যায় উড়ন্ত কাক-চিলও। হাসিটি বড় মিষ্টি, বড় সুরেলা, বড় ঝঙ্কারময়। অলিম্পিয়ার ভেতরটা যে সঙ্গীতময় এবং প্রাণময়তার প্রকাশ ঘটে চকিতের জন্যে অপূর্ব ওই হাস্যধ্বনির মধ্যে।

আড়িপাতা যাক এবার পিসি-ভাইঝির কথোপকথনে।

পিসি বলছে, এতক্ষণে তো এসে যাওয়া উচিত ছিল দুজনের।

ভাইঝি উদাস চোখে তাকিয়ে রইল সমুদ্রের দিকে।

খরখরে চোখে সেদিকে (মানে যুগপৎ ভাইঝি এবং সমুদ্রের দিকে) তাকিয়ে নিয়ে পিসি বললে, চিঠি দিতে এসে পিয়ন কিন্তু দিব্যি গেলে বললে, দাদাকে আসতে দেখেছে সমুদ্রের তীর বেয়ে। পেছনে ছিল সেই ভয়ানক জীবটা।

ভয়ানক জীব? চোখ না ফিরিয়েই বলে অলিম্পিয়া।

পীতাম্বর! পীতাম্বর! কেন যে সবাই ওকে সেনাপতি পীতাম্বর বলে, ভেবে পাই না।

ক্ষণেকের জন্যে অলিম্পিয়ার বিষাদ-কালো দুই চোখে কৌতুকের বিদ্যুৎ খেলে যায়, সেনাপতি বলেই বোধ হয় সেনাপতি বলে। রাজাকে রক্ষে করাই যার কাজ, তার নামই হয় সেনাপতি।

ওরকম বিতিকিচ্ছিরি লোককে ল্যাজে বেঁধে কোথাও নিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয়? চাকরি খেয়ে দিলেই ল্যাটা চুকে যায়।

দাদাকে বিষম ভালোবাসে প্রমীলা। কিন্তু লোক চেনার ব্যাপারে দাদার ওপর তিলমাত্র আস্থা তার নেই। এই একটি বিষয়ে সে সর্বেসর্বাই থাকতে চায়। কিন্তু দাদাটা যেন কী! যত্তো সব আপদদের জুটিয়েছে চারপাশে।

পীতাম্বর মুখচোরা বলেই গায়ে পড়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারে না–বিশেষ করে মহিলাদের সঙ্গে। শেষ কথাটা বলার সময়ে অলিম্পিয়া আয়ত নেত্রপাত করলে প্রমীলা পিসির দিকে, কিন্তু তার মানেই এই নয় যে সে লোক খারাপ, সেনাপতি হওয়ার অযোগ্য এবং ঘাড়ধাক্কা দেওয়ার পক্ষে যোগ্যতম পুরুষ।

প্রমীলার কণ্ঠে এবার জাগ্রত হল সেই বিখ্যাত কাকাতুয়ানিনাদ, সেনাপতি! সেনাপতি কাকে বলে জানিস? আমি জানি। অ্যাত্তটুকু বয়স থেকে কত সেনাপতি দেখেছি, সবই অবশ্য যাত্রার সেনাপতি! সেনাপতিদের সবসময়ে লম্পঝম্প করতে হয়, চেঁচিয়ে আকাশ ফাটাতে হয়, চেঁচিয়ে আকাশ ফাটাতে হয়–

অলিম্পিয়া মৃদুস্বরে শুধু বললে, পীতাম্বর যাঁর সেনাপতি, তিনি নিজেও লম্পঝম্প করতে জানেন না, চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করতে জানেন না।

ওটা কথার কথা। ঝটিতি বললে প্রমীলা পিসি, যা বলতে চাই, তা হল…তা হল–পীতাম্বর ঝলমলে চকচকে নয় মোটেই

ছাতলা-পড়া সোনা কি ঝকমকে চকমকে হয়?

টগবগে খলবলও যদি হত—

সে তো পাগলা ঘোড়ারাই হয়।

তুই থাম। কিছুতেই বলতে দিচ্ছিস না যা বলতে চাই।

তুমি তো পীতাম্বরের কথাই বলছ।

একদম না। বললেই হল? আমি ওই বিপুল ব্যানার্জির কথা বলছি। খাসা ছোকরা। টগবগে তেজি ঘোড়া, ঝকঝকে হিরের টুকরো।

পরমুহূর্তেই অলিম্পিয়ার সেই আশ্চর্য হাসি সপ্তসুরে জাগ্রত হল কণ্ঠে। এ সুরের তুলনা হয় না–এ হাসি হাসতে পারে, এমন মানুষ দুনিয়ায় আর দুটি নেই। চোখের তারায়, মুখের প্রতিটি পেশিতে হাসি বন্যার মতো ধেয়ে গেল চক্ষের নিমেষে।

ঘোড়ার মতো লাফ দেওয়া আর হিরের মতো চকচক করার গুপ্তবিদ্যেটা বিপুলবাবু অন্যসব বিষয়ের মতোই শিখে নিতে পারেন পলকের মধ্যে। কৌশল রপ্ত করতে তার জুড়ি নেই।

পিসির মুখের রং পালটে যাচ্ছে দেখে আশ্চর্য হাসিটাকে পত্রপাঠ মনের কন্দরে নিক্ষেপ করে সহজ হয়ে গেল অলিম্পিয়া।

বললে উদাস-উদাস গলায়, সত্যিই তো, বিপুলবাবু এখনও এসে পৌঁছলেন না কেন?

গোল্লায় যাক বিপুলবাবু। বলে গাত্রোত্থান করল প্রমীলা পিসি–জানলা দিয়ে চেয়ে রইল বাইরে।

গোধূলির ধূসর রং আর ধূসর নেই। চাঁদের আলোয় ধরার ধূসর রং এখন প্রায় সাদাটে বললেই চলে। সমুদ্রের ধার বরাবর যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকেই এই আশ্চর্য রহস্য-থমথমে আলো ছড়িয়ে পড়ছে একটু-একটু করে। বহুদূরে দেখা যাচ্ছে তীরের ভেতর দিকে একটা পুকুরপুকুর ঘিরে তেড়াবাঁকা গাছের জটলা। তারও ওপাশে সৈকতভূমিতে প্রায় গা ঘেঁষে একটা শ্রীহীন দীনহীন চেহারার টিনের চালাঘর। এ অঞ্চলের চা-পানের একমাত্র আড্ডাখানা। নামটা বিচিত্র। সবুজ মানুষ।

হ্যাঁ। চায়ের দোকানের নাম সবুজ মানুষ। কেন যে দোকানের এহেন নামকরণ করেছে কৃষ্ণকায় দোকানদার হরিহর–তা শুধু হরিহরই জানে। গায়ের রং তার কালো জামরুলের মতোই ঘোর কালো। কিন্তু সবুজ রঙের ওপর তার অহেতুক প্রীতি-রহস্য সমাধান করার জন্যে যখন এ কাহিনির অবতারণা করা হয়নি, তখন বিচিত্র নাম নিয়ে অযথা গবেষণা করার আর দরকার নেই।

সাদাটে চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে সবুজ মানুষ চায়ের দোকান পর্যন্ত। জীবন্ত কোনও প্রাণী নেই কোথাও। একটু আগেই গোধূলির আলোয় এই অঞ্চলেই কিন্তু হেঁটে গেছিল নতমুখ স্যার প্রদ্যুম্ন আর নৃত্যপর পীতাম্বর। কিন্তু কেউ তাদের দেখেনি। দেখেছিল শুধু একজন। বিপুল ব্যানার্জি। তাকেও কেউ দেখেনি।

রাত গম্ভীর হল। মাঝরাত পার করে দিয়ে আবির্ভূত হল বিপুল ব্যানার্জি। অতিশয় বিপুল বেগে এবং বিষম চেঁচিয়ে ঘুম-ঘর থেকে টেনে আনল বাড়ির প্রত্যেককে। প্রেতের মতো ফ্যাকাশে মুখ বিপুল ব্যানার্জির। আরও ফ্যাকাশে লাগছে পুলিশ ইনসপেক্টরের ভাবলেশহীন নিরেট মুখ এবং অবয়বের পাশাপাশি থাকায়। কিন্তু ভাবলেশহীন থাকার বহু চেষ্টা সত্ত্বেও ভাবলেশহীন থাকতে পারেনি আরক্ষাবাহিনীর এই অফিসারটি। মনে হয়েছিল যেন নির্বিকার একটা মুখোশ পরে প্রাণপণে চেপে রাখতে চাইছে ভেতরকার আবেগকে। প্রমীলা পিসি আর অলিম্পিয়ার সামনে যথাসম্ভব রেখে-ঢেকে খবরটা হাজির করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তা চক্ষের নিমেষে যেন হাওয়ায় ভর করে ছড়িয়ে গিয়েছিল বাড়িময়।

বড় ভয়ঙ্কর সংবাদ বহন করে এনেছে নিশীথ রাতের এই দুটি পুরুষ। অনেক চেষ্টার পর অবশেষে পাওয়া গেছে স্যার প্রদ্যুম্নর দেহ। শুধু দেহ। প্রাণহীন দেহ। গাছ-ঘেরা পুকুরে জাল ফেলে পচা পাঁক আর কাদার মধ্যে টেনে তোলা হয়েছে সেই দেহ।

জলে ডুবে মারা গেছেন স্যার প্রদ্যুম্ন মল্লিক।

.

বিপুল ব্যানার্জিকে যারা চেনে এবং জানে, তারা নিশ্চয় আঁচ করে নিয়েছে মহা তৎপর এই মানুষটি রাতের উদ্বেগ উত্তেজনা বেমালুম ঝেড়ে ফেলবে সকাল হতে-না-হতেই। কার্যক্ষেত্রেও দেখা গেল তাই। গতরাতের উদভ্রান্ত বিপুল ব্যানার্জি এখন রীতিমতো প্র্যাকটিক্যাল। তড়িঘড়ি হাজির হয়েছে ইনসপেক্টর রাজীবলোচনের কাছে। গতরাতে এই রাজীবলোচনের সঙ্গেই পথে দেখা হয়ে গিয়েছিল বিপুল ব্যানার্জির। সবুজ মানুষ চায়ের দোকানের ঠিক পাশটিতে। সকাল হতেই ইনসপেক্টরকে নিরালা একটা ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে প্রশ্নে-প্রশ্নে নাস্তানাবুদ করে তুলল বিপুল ব্যানার্জি–যেন জেরা করার অধিকারটা আছে শুধু তারই রাজীবলোচনের নয়।

রাজীবলোচন লোকটিও বড় কম যায় না। শুধু বাইরেটা নয়, ভেতরটাও যেন আস্ত গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরি। একেবারে নিরেট। হয় নিরেট বোকা, না হয় দারুণ ধূর্ত। তাই এইসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা গরম করবার পাত্র নয় মোটেই।

অচিরেই দেখা গেল, রাজীবলোচনের চেহারা আর চাউনি যতই বোকা-বোকা হোক না কেন, ভেতরে-ভেতরে সে নিদারুণ সেয়ানা। বিপুল ব্যানার্জিকে সব প্রশ্নেরই জবাব দিয়ে গেল বেশ ওজন করে করে। খামতি বা ঝুঁকতি নেই কোনও জবাবেই।

প্রশ্নগুলো এল ঝড়ের বেগে, কিন্তু জবাবগুলো গেল গদাই লস্করি চালে রীতিমত যুক্তিতে ঠাসা অবস্থায়।

বিপুল ব্যানার্জির মাথায় তখন ঘুরঘুর করছে সদ্য-পড়া একটা বইয়ের বিষয়বস্তু। বইয়ের নাম, কী করে দশদিনে ডিটেকটিভ হওয়া যায়। তাই শেষমেষ বললে, ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে তাহলে এই অ্যাক্সিডেন্ট, সুইসাইড অথবা মার্ডার।

চেয়ে রইল রাজীবলোচন।

ঝটিতি বললে বিপুল ব্যানার্জি, ত্রিভুজ রহস্য–চিরকাল যা ঘটে এসেছে, ঘটে চলবে।

রাজীবলোচন বললে, অ্যাক্সিডেন্ট? কক্ষনও না।

কেন না?

অ্যাক্সিডেন্ট মানে বলতে চাইছেন, অন্ধকারে দেখতে পাননি–জলে পড়ে গেছেন স্যার প্রদ্যুম্ন, কেমন?

নিশ্চয়, নিশ্চয়।

কিন্তু ঘটনাটা যখন ঘটে, তখন তো অন্ধকার তেমন গাঢ় হয়নি। তা ছাড়া, রাস্তা থেকে পুকুরটা কম করেও পঞ্চাশ গজ দূরে। রাস্তাও অচেনা নয়–চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলেও পৌঁছে যেতেন নিজের বাড়ি। পঞ্চাশ গজ দূরে পুকুরের দিকে যাবেন কেন? না, একে অ্যাক্সিডেন্ট বলা যায় না। কোনওমতেই না। জেনেশুনে গিয়ে ধীরে-সুস্থে নিশ্চয় শুয়ে পড়েননি পুকুরের জলে।

সুইসাইড করার ইচ্ছে থাকলে–

সুইসাইডও নয়। মানুষ সুইসাইড করে কেন? জীবনে বিতৃষ্ণা এসে, মনে প্রচণ্ড আঘাত পেলে, অথবা দারিদ্র্যের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারলে–

বটেই তো! বটেই তো!

স্যার প্রদ্যুম্নর ক্ষেত্রে এর কোনওটাই খাটে না। জীবনে তাঁর তৃষ্ণা না থাকুক, বিতৃষ্ণা নেই। যাত্রাটাত্রা নিয়ে ছিলেন মনের সুখে। মনে আঘাত পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কেননা, তাঁর পারিবারিক জীবন অত্যন্ত সুখের। টাকা-পয়সার অভাব কাকে বলে, তা তিনি জন্মাবধি জানেননি–কোটিপতি বলা যায় এক কথায়। নইলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত যাত্রাপার্টির পেছনে দু হাতে টাকা ওড়াতে যেতেন না। সুখে ছিলেন, বড় সুখে ছিলেন–সুইসাইড করতে যাবেন কোন দুঃখে?

রহস্যনিবিড় চাপা স্বরে বললে বিপুল ব্যানার্জি, তাহলেই দেখুন এসে যাচ্ছে তৃতীয় সম্ভাবনাটা।

তৃতীয় সম্ভাবনাটা নিয়ে এই মুহূর্তে এত তাড়াহুড়ো করার কোনও প্রয়োজন দেখছি না, থেমে-থেমে নিরুত্তেজ গলায় বললেন রাজীবলোচন।

শুনে বিলক্ষণ বিরক্ত হল বিপুল ব্যানার্জি। তার আবার তাড়াহুড়ো করা স্বভাব সব ব্যাপারেই। তড়বড় করে মন্তব্য প্রকাশও করতে যাচ্ছিল, কিন্তু রাজীবলোচন সে সুযোগ দিলে না। বললে, শেষ সম্ভাবনাটা আদৌ সম্ভব কিনা জানবার আগে দু-একটা বিষয় জানা দরকার। স্যার প্রদ্যুম্নর সেক্রেটারি আপনি। এই দু-একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করতে পারবেন শুধু আপনিই।

বিষয়গুলো কী যদি জানতে পারি–

ওঁর প্রপার্টি।

প্রপার্টি?

হ্যাঁ। ওঁর বিরাট সম্পত্তিটা দিয়ে যাচ্ছেন কাকে কাকে? সম্পত্তির পরিমাণটা কত? উইল নিশ্চয় একটা আছে। কী লেখা আছে, সেক্রেটারির জানা থাকতে পারে। জানেন কী?

যে ধরনের প্রাইভেট সেক্রেটারি হলে এই বিষয়টা অন্তত জানা যায়, সেই ধরনের প্রাইভেট সেক্রেটারি আমি নই।

বটে।

কিন্তু যাদের জানা আছে, তাদের নামটা জানি।

তারা কারা?

মেসার্স লাহিড়ী, মুখার্জি অ্যান্ড ব্যানার্জি কোম্পানি। গুরু নিবাস রোডে এঁদের অফিস। স্যার প্রদ্যুম্নর ইনকাম ট্যাক্স থেকে আরম্ভ করে বিষয়-সম্পত্তির দেখাশুনা করা সমস্ত করেন এঁরা।

সলিসিটর কোম্পানি?

হ্যাঁ। উইলের খবর এঁরাই জানেন নিশ্চয়।

ঠিক বলেছেন। উইল বাড়িতে রাখা সমীচীন নয়। সলিসিটরদের জিম্মাতেই থাকে। তাহলে ওঁদের ওখানে টু মারা যাক!

এখুনি। বিপুল ব্যানার্জির আর তর সইছে না।

কিন্তু রাজীবলোচন লোকটা যেন কী! উইলের পেছনে সঙ্গে-সঙ্গে দৌড়নোর কোনও অভিপ্রায় আছে বলে মনেই হল না। নিরেট বপু আর নির্ভাষ চাহনি নিয়ে বসে রইল চুপচাপ।

বিপুল ব্যানার্জি কিন্তু আর সামলাতে পারছে না নিজেকে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠল চেয়ার ছেড়ে। সবেগে দু-পাক ঘুরে এল ঘরময়। উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। যেন একটা চাপা আগ্নেয়গিরি। ফেটে পড়ল বলে।

এবং ফেটেও গেল পুরো দুটো মিনিট যেতে না যেতেই।

প্রশ্নটা ঠিকরে বেরিয়ে এল লাভা উদগীরণের মতোই, রাজীবলোচনবাবু, স্যার প্রদ্যুম্নর ডেডবডিটা এখন কোথায়?

ডক্টর তলাপাত্র তলিয়ে দেখছেন।

মানে?

মানে, এগজামিন করছেন। মৃত্যুর কারণ খুঁজছেন।

কোথায় দেখছেন? মানে, বডিটা এখন কোথায়?

স্রেফ পাথরের মূর্তির মতোই চেয়ে থেকে রাজীবলোচন বললে, থানায়।

রিপোর্ট রেডি হতে কত দেরি?

ঘণ্টাখানেক তো লাগবেই।

অসম্ভব।

কী অসম্ভব?

এত তাড়াতাড়ি এ ধরনের রিপোর্ট লেখা যায় না। হাপিত্যেশ করে বসে না থেকে চলুন সলিসিটর কোম্পানিতে যাওয়া যাক। বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে।

রাজীবলোচনের পাথর-চাহনি দেখে পরমুহূর্তেই কিন্তু থিতিয়ে গেল বিপুল ব্যানার্জি। সুর পালটে নিল চক্ষের নিমেষে। ইনসপেক্টরের ধীর-স্থির ভাবভঙ্গি তাকে যে বিলক্ষণ অপ্রস্তুত করেছে, তা প্রকট হল চোখে-মুখে।

বিপুল ব্যানার্জি যতখানি অস্থির উইল-বৃত্তান্ত জানতে, ঠিক সেই পরিমাণে প্রশান্ত রাজীবলোচন উইলের বৃত্তান্ত না জানতে। অথবা বলা যায়, জানতে সে চায় ঠিকই কিন্তু যথাসময়ে–এত হুটোপাটি করতে রাজি নয়।

তাই সুর বদলাতে হল বিপুল ব্যানার্জিকে। রাজীবলোচনের নিরেট বদনের দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে বললে ওভার-স্মার্ট বিপুল ব্যানার্জি, ব্যাপারটা..মানে, ঠিক বোঝাতে পারছি না– ইয়ে..স্যার প্রদ্যুম্নর মেয়ের কথা বলছি…তার কথাটাও একটু ভাবা দরকার…এত বড় একটা শক..বুঝতেই পারছেন…

পারছি। অমায়িক বচন রাজীবলোচনের।

আরও ঘাবড়ে গেল বিপুল ব্যানার্জি। ফলে স্পিড বেড়ে গেল কথার, মানে, সে বেচারি হয়তো অনেক হাবিজাবি কথাই ভেবে মরছে…দুশ্চিন্তা তো হবেই…ঠিক কিনা বলুন?

এক্কেবারে ঠিক।

ফালতু চিন্তা থেকে ওকে মুক্তি দেওয়া দরকার।

তা তো বটেই।

খামোকা ভেবে মরছে। এর মধ্যেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুটন্ধুর সঙ্গে কনসাল্ট করবে ঠিক করে ফেলেছে। একজন তো এই মুহূর্তে এই টাউনেই রয়েছে।

কে বলুন তো?

নামটা তার যেমন বিদঘুঁটে, পেশাটাও তেমনি বিদঘুঁটে। ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে যারা তাদের আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি না।

ধর্মের ব্যবসাদারদের অনেক সময়ে দুচোখ দিয়ে দেখাও যায় না।

মানে? মানে?

মনের চোখ দরকার।

এবার বিলক্ষণ চটিতং হল বিপুল ব্যানার্জি, আরে মশায়, এ লোকটা পয়লা নম্বর বুজরুক। ঈশ্বর নিয়ে কারবার করে, অথচ পাইপ খায় যখন-তখন।

খাক না। সাধু-সন্ন্যাসীরা গাঁজাও খায়।

যাচ্চলে! শিব গাঁজা খায় বলেই সন্ন্যাসীরা গাঁজা খায়। কিন্তু যীশু কি কোনওদিন পাইপ খেত?

কার কথা বলছেন? এবার যেন আগ্রহের রোশনাই দেখা যায় রাজীবলোচনের পাথর চোখে।

যার ভাঙা ছাতা, ন্যাতার মতো আলখাল্লার আর কুমড়োর মতো চেহারা দেখলে আপনি হেসে গড়িয়ে পড়বেন।

নামটা?

ফাদার ঘনশ্যাম।

ঘনশ্যাম পাদরি!

চেনেন নাকি?

আপনার চাইতে বেশি চিনি।

আ-আমার চাইতে! মা-মানেটা কী হল?

মানে হল এই যে, ফাদার ঘনশ্যামকে আমি যতটা চিনি, আপনি তার দশ ভাগের এক ভাগও চেনেন না। আইসবার্গের ওপরটুকুই কেবল আপনি দেখেছেন–চোখের আড়ালে যা আছে, তা দেখেননি।

আইসবার্গ! মা-মা–

মানে, হিমবাহ। ফাদার ঘনশ্যাম একটা মানুষ-হিমবাহ। তার বাইরেটা হাস্যকর। কিন্তু ভেতরটা যে কত ভেতরে গেছে, তা তলিয়ে দেখার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। বলে বিপুল ব্যানার্জির দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থেকে রাজীবলোচন বুঝিয়ে দিলে সাধারণ মানুষটা বর্তমান ক্ষেত্রে কে– অদ্ভুত একটা জুয়েল কেসে তার যে ভেল্কি দেখেছি, তাতেই বুঝেছি, ফাদার ঘনশ্যাম পাদরি না হয়ে পুলিশ হলে পারতেন।

অতঃপর ঘরের মধ্যে থাকা আর সমীচীন বোধ করেনি বিপুল ব্যানার্জি। বিপুল বেগে ঘর থেকে উধাও হয়ে যেতে-যেতে শুধু বলে গেছে, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তাহলে সলিসিটর কোম্পানিতে ফাদার ঘনশ্যামও আসুক। ডাক্তারও আসুক। এক জায়গাতেই সবকথা হয়ে যাক।

ব্যবস্থা হল সেইভাবেই। সমুদ্রসৈকত থেকে খুব দূরে নয় টাউন। ইনসপেক্টর রাজীবলোচনকে নিয়ে হুড়মুড় করে সলিসিটর কোম্পানির অফিসে ঢুকল বিপুল ব্যানার্জি। ফাদার ঘনশ্যাম পৌঁছে গেছে তাদের আগেই। কোলের ওপর বিরাট (এবং ভাঙা) ছাতাটা রেখে বসে আছে চেয়ারে। দুহাত রয়েছে তালিমারা নোংরা ছাতার ওপর। জমিয়ে গল্প করছে কোম্পানির সেকেন্ড পার্টনার সলিল মুখার্জির সঙ্গে। ডক্টর তলাপাত্রও হাজির অফিসরুমে। নিশ্চয় এইমাত্র এসেছেন। সুদৃশ্য ছাতাটা ঘরের কোণে রাখছেন। এখুনি এসেছেন বলেই নিশ্চয় স্যার প্রদ্যুম্নর মৃত্যুসংবাদ এখনও দেননি ফাদার ঘনশ্যাম এবং সলিল মুখার্জিকে। দুজনেরই মুখে তাই কৌতুক ঝলমল করছে। হাসির কথাই বলছে বোধ হয় ফাদার ঘনশ্যাম। চাঁদের মতো মুখ আর চশমার আড়ালে কুকুতে চোখে রসবোধ যেন উপচে উঠছে। সলিল মুখার্জি শুধু শুনে যাচ্ছে আর শব্দহীন হাসি হেসে চলেছে। ভদ্রলোকের মাথার চুলে পাক ধরেছে। বিলক্ষণ আমুদে বলেই দুই চোখ নাচিয়ে-নাচিয়ে ঘনশ্যাম পাদরির কথা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। চকচকে কাগজকাটা ছুরির পাশে পড়ে থাকা ধুলোয় ময়লা কলমটা নাড়তে নাড়তে নিমগ্ন হয়ে রয়েছে রসালাপে।

রাজীবলোচন আর বিপুল ব্যানার্জি সবেগে আবির্ভূত হতেই গোল চশমার ফাঁক দিয়ে চাইল ফাদার ঘনশ্যাম। বললে, ফাইন মর্নিং। ঝড় পালিয়েছে, সকালটাও যেন হাসছে।

রাজীবলোচন বললে, আপনার হাসিও তাই খুলেছে।

পুরোপুরি খোলেনি, বললে ফাদার ঘনশ্যাম, এখানে সেখানে এখনও কিছু কালো মেঘ জমে রয়েছে। তবে বৃষ্টি আর পড়েনি।

হ্যাঁ, এখনও কিছু কালো মেঘ জমে রয়েছে। বললে রাজীবলোচন।

কিন্তু এক ফোঁটা বৃষ্টিও আর পড়েনি। ফাদার ঘনশ্যামের সুরে সুর মিলিয়ে বললে সলিসিটর সলিল মুখার্জি, ও মেঘে আর বৃষ্টি হবে না। ছুটির মেজাজ আসে এমন দিনেই।

অথবা ছুটির মেজাজ উবে যায় এমন দিনেই। বললে রাজীবলোচন।

বিপুল ব্যানার্জি এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। তাই এবার তার দিকে অ্যাপায়নের সুরে বললে সলিল মুখার্জি, আছেন কেমন ব্যানার্জি সাহেব? স্যার প্রদ্যুম্ন নাকি ফিরে আসছেন?

আসছিলেন, কিন্তু আর আসবেন না। কঁকা গলায় বললে বিপুল ব্যানার্জি।

কলম নামিয়ে রাখল সলিল মুখার্জি, কেন আসবেন না?

জলে ডুবে মারা গেছেন বলে।

মুহূর্তের মধ্যে পালটে গেল অফিসরুমের হালকা পরিবেশ। কিন্তু চেয়ারে আসীন মূর্তি দুটির সকৌতুক মুখচ্ছবি কৌতুক ঝলমলেই রইল আগের মতো। যেন এইমাত্র একটা মস্করা করে বসল বিপুল ব্যানার্জি-তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করে গেল সলিল মুখার্জি এবং ফাদার ঘনশ্যাম। ঠোঁটগুলো রইল কেবল নিস্পন্দ নিস্পন্দ রইল অবয়বও।

তারপর দুজনেই মৃদুকণ্ঠে পুনরাবৃত্তি করলে একই কথাটা, জলে ডুবে মারা গেছেন!

বলে, ফাদার ঘনশ্যাম তাকালেন সলিল মুখার্জির মুখের দিকে। সলিল মুখার্জিও তাকাল ফাদার ঘনশ্যামের মুখের পানে।

দৃষ্টি বিনিময় সাঙ্গ করে দুজনেই দৃষ্টিশর নিক্ষেপ করল বার্তাবহ বিপুল ব্যানার্জির পানে। কয়েক সেকেন্ড সব চুপচাপ।

পরমুহূর্তেই শুরু হয়ে গেল প্রশ্নের-পর-প্রশ্ন।

পাদরির প্রশ্ন, কখন?

সলিল মুখার্জির প্রশ্ন, কোথায়?

জবাবটা দিল ইনসপেক্টর, সবুজ মানুষ চায়ের দোকানের কাছেই যে পুকুরটা আছে– সেইখানে। সবুজ পাঁক আর সবুজ শ্যাওলায় মাখামাখি লাশটা টেনে তোলবার পর চিনতে কষ্ট হয়েছে। ডক্টর তলাপাত্র তারপর আরে! আরে! ফাদার ঘনশ্যাম! আপনার কী হল? শরীর খারাপ নাকি?

শিউরে উঠে বললে ফাদার ঘনশ্যাম, সবুজ মানুষ! সবুজ মানুষ!

লাশটাকে সবুজ মানুষের মতোই লাগছিল বটে—

সরি, ইনসপেক্টর! মাথাটা হঠাৎ কীরকম ঘুরে যাওয়ায়–বলুন, বলুন, আপনি বলে যান।

রাজীবলোচন চোখ দুটো একটু ছোট করে ফাদার ঘনশ্যামের দিকে চেয়ে রইল সেকেন্ড কয়েক। তারপরে বললে, মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল কেন?

কাষ্ঠহাসি হাসল ফাদার ঘনশ্যাম। বললে আমতা-আমতা করে–ডেডবডিটা সবুজ পাঁক আর সবুজ শ্যাওলায় মাখামাখি হয়েছিল শুনেই–

কী মুস্কিল! তাতে মাথা ঘুরে যাবে কেন?

আমি ভেবেছিলাম, সমুদ্রের সবুজ উদ্ভিদের জন্যে সবুজ মানুষ হয়ে গেছেন স্যার প্রদ্যুম্ন। সেইটা হলেই বরং ছিল ভালো–পাঁক আর শ্যাওলাটা বড় বিচ্ছিরি জিনিস।

ঘরসুদ্ধ সবাই নিমেষহীন চোখে তাকিয়ে থাকে ঘনশ্যাম পাদরির দিকে। পাগল নিশ্চয়। মাথায় ছিট আছে। ঘর নিস্তব্ধ।

নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করলেন ডাক্তার তলাপাত্র।

ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে অসাধারণ পুরুষ। অন্তত বাহ্য-আকৃতির দিক দিয়ে। মাথায় তালঢ্যাঙা। রোগা ডিগডিগে। চর্বি-টর্বির বালাই নেই। তাই বলে অস্থিচর্মসার মোটেই নন। পোশাক-আশাকেও রীতিমত পারিপাট্য। যে ধরনের কোট-প্যান্ট পরলে ডাক্তার বলে মনে মনে সম্ভ্রম জাগে–পরেছেন ঠিক সেই ধরনের কোট-প্যান্ট-টাই। তবে যা একটু সেকেলে। কোট-প্যান্টের কাট-ছাঁট অথবা নেকটাইয়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আধুনিক ফ্যাশন অনুযায়ী অচল। বয়স কিন্তু তেমন কিছু নয়। চল্লিশও ছাড়িয়েছে কিনা সন্দেহ। ধড়াচূড়ায় সেকেলে, কিন্তু দাড়ি রাখার ব্যাপারে আধুনিক। মাইকেল মধুসূদন টাইপের দাড়ি রেখে আঁতেল হতে চায় এ যুগের অনেকেই। ডাক্তার তলাপাত্রও সযত্নে মাইকেল দাড়ির চাষ করেছেন দুই গালে। বরং একটু বাড়িয়েই রেখেছেন। রাবীন্দ্রিক স্টাইলে বুক পর্যন্ত লুটিয়ে দিয়েছেন। দুই চোখে কিন্তু রাবীন্দ্রিক বা মাইকেলি চাহনির ছিটেফোঁটাও নেই। অন্তর্ভেদী রুক্ষ চাহনি। মুখভাব তা সত্ত্বেও সুন্দর। কিন্তু এই মুহূর্তে কেন জানি বড় ফ্যাকাশে মনে হচ্ছে। সরু ছুরির মতো চোখজোড়া বড় চঞ্চল। কোনওদিকে বা কারও দিকেই স্থির থাকছে না, অথচ স্থির রাখার চেষ্টা চলছে অবিরাম।

ঘরের প্রত্যেকেই লক্ষ করল এইসব কিছুই। কেউ কিছু বলার আগেই মুখ খুললেন ডাক্তার। কণ্ঠস্বরে জাগ্রত হল কর্তৃত্ব, প্রখর ব্যক্তিত্ব। নায়ক যেন তিনি এখন নিজে। আশ্চর্য এই কর্তৃত্বব্যঞ্জক কণ্ঠস্বরকে ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। বুঝে নিতে হবে।

যা বললেন তিনি, তা এই : স্যার প্রদ্যুম্নর লাশ জলের মধ্যে পাওয়া গেছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যেও রয়েছে একটা রহস্য।

থামলেন। সবাইকে দেখলেন। তারপর বললেন, জলে ডুবে উনি মারা যাননি।

তড়িৎস্পর্শে যেন সচকিত ইনসপেক্টর রাজীবলোচন। এবং সেই প্রথম তীব্র কণ্ঠে প্রশ্ন করতে শোনা গেল তাকে, এক্সপ্লেন।

ডেডবডি এগজামিন করে এলাম এইমাত্র। স্যার প্রদ্যুম্নর মৃত্যু হয়েছে হৃৎপিণ্ডের মধ্যে একটা সরু তীক্ষ্ণ বস্তু ঢুকে যাওয়ার ফলে। ছোট ছোরাজাতীয় কিছু।

রাজীবলোচন চেয়ে আছে। চোখের পাতা পড়ছে না। গোল চশমার আড়ালে চোখের পাতা বন্ধ করে যেন মনের চোখে দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করছে ঘনশ্যাম পাদরি।

বললেন ডাক্তার, মৃত্যুর বেশ কিছুক্ষণ পর ডেডবডি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল পুকুরের জলে।

এইবার দুই চোখ খুলে গেল ফাদার ঘনশ্যামের। নিষ্প্রভ মণিকা দুটো এখন আশ্চর্য উজ্জ্বল। যেন প্রাণশক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে তারারন্ধ্র থেকে। একদৃষ্টে চেয়ে আছে ডাক্তারের পানে। ফাদার ঘনশ্যামকে যারা দীর্ঘদিন ধরে চেনে, তারা অন্তত জানে, কদাচিৎ এভাবে কারও দিকে তাকিয়ে থাকে বিচিত্র এই পাদরি।

অফিসরুম থেকে একে-একে সবাই বেরিয়ে আসে রাস্তায়। ফাদার ঘনশ্যাম কিন্তু আঠার মতো লেগে আছে ডাক্তারের পেছনে। হঠাৎ গায়ে পড়ে আলাপ শুরু করে দেয় অত্যন্ত অমায়িক ভঙ্গিমায়।

ঘর ছেড়ে বেরোনোর আগেই অবশ্য আসল প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনা সেরে নিয়েছে বিষম কৌতূহলী বিপুল ব্যানার্জি।

প্রসঙ্গটা স্যার প্রদ্যুম্নর উইল সংক্রান্ত।

সলিল মুখার্জি প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ আইনবিদ। উইলের ব্যাপারে চট করে মুখ খুলতে চায় কোনও আইনজীবীই। বিপুল ব্যানার্জির অস্থিরতা তাকে একটু বিরক্তই করেছে বলা চলে। চুলচেরা চোখে লক্ষও করেছে, উইলের বৃত্তান্ত না জানা পর্যন্ত যেন স্বস্তি পাচ্ছে না সেক্রেটারি।

রাজীবলোচনও দেখেছে বিপুল ব্যানার্জির অধীর কৌতূহল। পুলিশি কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে সলিল মুখার্জির মুখ বন্ধ রাখতেও পারত সেই মুহূর্তে। কিন্তু যে ব্যাপারে কোনও রহস্য নেই, অযথা সেই ব্যাপারটাকে রহস্যময় করে তুলতে চায়নি ফাদার ঘনশ্যাম। বলতে গেলে তারই অনুরোধে অবশেষে মনের আগল খুলেছে সলিল মুখার্জি।

মৃদু হেসে বলেছে পাদরিকে, ফাদার, স্যার প্রদ্যুম্নর উইলে ঘোরপ্যাঁচ কিচ্ছু নেই। সবাই যা করে, উনিও তাই করেছেন। স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তি দিয়ে গেছেন একমাত্র সন্তান অলিম্পিয়াকে।

এরপরেই রাস্তায় নেমে এসেছে সবাই। রওনা হয়েছে মল্লিকভবনের দিকে। হন্তদন্ত হয়ে সবার আগে-আগে চলেছে বিপুল ব্যানার্জি। গন্তব্যস্থানে আগেভাগে না পৌঁছলেই যেন নয়।

কিন্তু সেরকম কোনও তাড়াহুড়োই দেখা যাচ্ছে না পেছনের দুটি মূর্তির ক্ষেত্রে। ধীরেসুস্থে যেন হাওয়া খেতে-খেতে চলেছে দীর্ঘকায় ডাক্তার আর হ্রস্ববপু পাদরি। গন্তব্যস্থানে তড়িঘড়ি পৌঁছনোর চাইতে অনেক বেশি আগ্রহ দেখা যাছে সাতপাঁচ কথাবার্তায়।

জীবন্ত প্রহেলিকা বলা যায় ডাক্তার তলাপাত্রকে। হাঁটছেন মুখ বুজে। পাদরি ঘনশ্যামের হযবরল কথাবার্তা যেন এ কান দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে যাচ্ছে ও কান দিয়ে।

প্রশ্নটা করলেন হঠাৎ।

ফাদার, একটা কথা জিগ্যেস করব?

কুৎকুতে চোখ ফিরিয়ে তাকায় ফাদার, কী বলুন তো?

ব্যাপারটা আপনার লাগছে কীরকম?

সেকেন্ড কয়েক অনিমেষে ডাক্তারের পানে চেয়ে রইল ফাদার। তারপর বললে, কীরকম মানে?

মানে, সব তো শুনলেন, এখন কী মনে হচ্ছে আপনার?

দু-একটা ধাঁধা ঘুরঘুর করছে মাথার মধ্যে।

ধাঁধা!

স্যার প্রদ্যুম্নকে তেমনি ঘনিষ্ঠভাবে জানতাম না বলেই একটু গোলমাল লাগছে?

গোলমালটা কোথায়?

স্যার প্রদ্যুম্নকে তেমন না জানলেও, ওঁর মেয়ে অলিম্পিয়াকে জানি বেশ ভালো করেই। ডাক্তারের সরাসরি প্রশ্নটাকে পাশ কাটিয়ে যায় ফাদার।

অজাতশত্রু ছিলেন স্যার প্রদ্যুম্ন। সুন্দর মুখখানাকে উৎকট গম্ভীর করে বলল ডাক্তার।

আছে, কিছু আছে। নিরীহ স্বরে বললে পাদরি ঘনশ্যাম।

কিছু আছে! কোথায়? কী?

আপনার কথার মধ্যেই। যা আপনি খুলে বলতে চান না।

দেখুন মশায়, স্বর রুক্ষ হয়ে ওঠে ডাক্তারের, আমার এই নাকটা দেখেছেন?

সুন্দর নাক।

এই নাকের আত্মসম্মান বোধটা একটু প্রখর। যেখানে সেখানে নাক-গলানো আমার ধাতে নেই। বুঝেছেন?

বুঝলাম।

স্যার প্রদ্যুম্ন খুন হয়েছেন তো আমার কী? ভদ্রলোকের মেজাজের একটু নমুনা পেয়েছি। কাজেই তার মৃত্যুরহস্য নিয়ে কোনও মাথাব্যথাই নেই আমার।

কীরকম নমুনা শুনতে পারি?

আরে মশাই, সামান্য একটা ব্যাপার। অপারেশন করতে গেলে ওরকম একটু-আধটু ভুল সব ডাক্তারই করে। কিন্তু তিলকে তাল করে তুললেন উনি। কোর্টে পর্যন্ত যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।

শেষপর্যন্ত আর যাননি?

সুবুদ্ধিটা শেষকালে এসেছিল বলেই যাননি। ওঁর নিচের থাকের মানুষদের পোকামাকড়ের মতো দেখতেন। ব্লু ব্লাড থাকলে যা হয় আর কী।

জবাব দিল না ফাদার ঘনশ্যাম। চেয়ে রইল একদৃষ্টে সেক্রেটারির দিকে। হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা এগিয়ে গেছে বিপুল ব্যানার্জি। হন্তদন্ত হয়ে হাঁটার কারণটাও আবিষ্কার করে ফেলল ফাদার ঘনশ্যাম।

অলিম্পিয়া। স্যার প্রদ্যুম্নর কন্যা। এখনও পঞ্চাশ গজ এগিয়ে রয়েছে বিপুল ব্যানার্জির সামনে। চলেছে মল্লিকভবনের দিকেই।

পঞ্চাশ গজ পথ হনহনিয়ে পেরিয়ে গিয়ে অলিম্পিয়ার নাগাল ধরে ফেলল সেক্রেটারি। দূর হতে মিলিয়ে গেল পাশাপাশি দুটি মূর্তি। অপলকে মূকাভিনয় দেখে গেল ফাদার ঘনশ্যাম পেছন থেকে। খুবই উত্তেজিত মনে হল সেক্রেটারিকে। কারণটা ফাদার ঘনশ্যাম আঁচ করতে পারলেও মুখে প্রকাশ করল না। ডাক্তারের সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে পৌঁছল মোড়ের মাথায়–অদূরে মল্লিকভবন।

আচমকা প্রশ্নটা করল ঠিক তখন।

ডাক্তার, আপনার আর কিছু বলার আছে বলে মনে হচ্ছে না।

কেন থাকবে শুনি? সঙ্গে-সঙ্গে মুখের ওপর জবাবটা ছুঁড়ে দিয়েই এমনভাবে লম্বা-লম্বা পা ফেলে উধাও হলেন ডাক্তার যেন জবাব নয়, প্রশ্নই করে গেলেন–বলার যদি কিছু থাকেও, বলতে যাবেন কেন? আদৌ কিছু বলার আছে কিনা, সেটাও অনিশ্চিত রয়ে গেল অদ্ভুত ভঙ্গিমায় নিক্ষিপ্ত শব্দ তিনটের মধ্যে। জবাব না জিজ্ঞাসা–কিছুই আঁচ করা না গেলেও ফাদার ঘনশ্যামের মস্ত মাথার মধ্যে শব্দ তিনটে কিন্তু ঘুরপাক খেয়েই গেল। একা-একা হেঁটে গেল বিপুল ব্যানার্জি আর অলিম্পিয়ার পেছন-পেছন।

কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে গেল মল্লিকভবনের ঝাউবীথির সামনেই।

আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়েছে অলিম্পিয়া। দ্রুত চরণে এগিয়ে আসছে ফাদারের দিকেই। মুখভাব অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে। জুলজুল করছে কিন্তু দুই চোখ। যেন টাটকা অথচ নামহীন আবেগে আপ্লুত হয়েছে অন্তরপ্রদেশ।

কাছে এসেই বললে চাপা গলায়, ফাদার, জরুরি কথা আছে। এখুনি শুনতে হবে। কী করব ভেবে পাচ্ছি না।

নিশ্চয়, নিশ্চয়। এখুনি শুনব। কিন্তু কোথায় বসে শুনব?

ঝাউবীথির দুপাশে বিরাট বাগান। ফাদার ঘনশ্যামকে এই বাগানের মধ্যেই নিয়ে গেল অলিম্পিয়া। বসল ঝরাপাতায় ঢাকা ঘাসজমির ওপর। মুখ খুলল সঙ্গে-সঙ্গে। যেন পেট থেকে কথা বার করে না দেওয়া পর্যন্ত আবেগকে আর ধরে রাখতে পারছে না–অজ্ঞান হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়।

কথাটা এই, বিপুল ব্যানার্জি এইমাত্র বড় ভয়ঙ্কর-ভয়ঙ্কর কথা বলে গেল।

নীরবে মস্ত মাথা নেড়ে সায় দিলে ফাদার ঘনশ্যাম। কথাগুলো যে খুবই ভয়ঙ্কর, তা পেছন থেকে বিপুল ব্যানার্জির ভয়ঙ্কর উত্তেজনা দেখেই আঁচ করা গেছিল।

অলিম্পিয়া বললে, কথাটা পীতাম্বরকে নিয়ে। চেনেন পীতাম্বরকে?

চিনি…মানে–

সে চেনা নয়, অধীর কণ্ঠে বলে অলিম্পিয়া, জানেন তার নাড়ীনক্ষত্র? তার চরিত্র? তার স্বভাবপ্রকৃতি?

অত কি আর জানি। যেটুকু শুনেছি, তা একটু গোলমেলে বইকী।

কী রকম? কী রকম?

পীতাম্বরকে যাত্রা-পার্টির সবাই পীতাম্বরানন্দ বলে ডাকে। অথচ সে আনন্দে ভরপুর নয় কখনওই। তাকে দেখলেই মনে হয় যেন একটা জীবন্ত বিষের বোতল কঙ্কালের করোটির ওপর যেন আড়াআড়িভাবে রাখা দুটো মড়ার হাড়।

কী ভয়ঙ্কর! কী ভয়ঙ্কর!

ভয়ঙ্কর তো বটেই। ওরকম চেহারা যার–

পীতাম্বরকে মোটেই ওরকম দেখতে নয়। কিন্তু…

কিন্তু বলতে-বলতে খাদে নেমে আসে অলিম্পিয়ার কণ্ঠস্বর, অদ্ভুত কিছু একটা ঘটেছে ওর মধ্যে। এইটুকু বয়স থেকে ওকে আমি চিনি– হাড়ে-হাড়ে চিনি–মড়ার হাড় ওর মুখের ওপর কখনও কল্পনাও করতে পারি না–ভেতরে তো নয়ই। কত খেলা খেলেছি দুজনে সমুদ্রের ধারে বালির ওপর। ঝিনুক কুড়িয়েছি, কাড়াকাড়ি করেছি, বালির কেল্লা গড়েছি, ভেঙে তছনছ করে দিয়েছি। ওর কথাগুলো একটু ঝাঁঝালো। বড় চোখাচোখা। মনের ভেতর পর্যন্ত কুপিয়ে কাটে। যারা ওকে চেনে না, জানে না, বোঝে না তাদের কাছে তাই ও বিষের বোতল, কঙ্কালের করোটি আর মড়ার হাড় হতে পারে–আমার কাছে নয়। কেননা, আমি জানি ওর ছুরির মত ধারালো কথাবার্তার মধ্যে আছে কবিতার সুর আর ছন্দ, ফুলের মতো ওর মনের গন্ধ আর রং। সেই সময়ে আমিও ওকে পীতাম্বরানন্দ বলে খেপাতাম। আনন্দ দিতে জুড়ি ছিল না। আনন্দ বিতরণ করতে ভালোবাসত বলেই যাত্রাপার্টিতে ঢুকেছিল পাঁচজনকে আনন্দ দেবে বলে। কিন্তু…কিন্তু

তারপর? অসহিষ্ণু কণ্ঠে শুধু বললে ফাদার ঘনশ্যাম।

ইদানীং যে যাত্রাপার্টিতে আনন্দের খোরাক আর পাচ্ছে না, আমার কাছে তা বলেছিল। আমার কাছেই শুধু বলেছিল–আর কাউকে নয়। কিন্তু ভেতরে যার আনন্দ নেই, সে তো নিরানন্দ থাকবে বাইরেও। কাঠের মতো শক্ত হয়ে মুখখানাকে পেঁচার মতো করে না-না, কঙ্কালের করোটির মত কক্ষনও নয়–পেঁচার মতো করে দিনগত পাপক্ষয়ই কেবল করে গেছে। মড়ার মতো হেঁটে যাওয়া বলতে পারেন–আড়ষ্ট, প্রাণহীন। প্রাণে ফুর্তি থাকলে তো বাইরে বেরোয় ফুর্তির ফোয়ারা– কেন, আমি জানি না! এড়িয়ে চলে আমাকে। তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমার জন্যে ওর ভেতরটা গুঁড়িয়ে গেছে, আমার তা মনে হয় না। খুব বড় রকমের একটা দুঃখ শুকিয়ে দিয়েছে ওর ফুর্তির ফোয়ারা। এখন যা শুনলাম বিপুল ব্যানার্জির মুখে, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে বলব, ওর এই দুঃখটা এসেছে পাগলামি থেকে। অথবা

অথবা?

ওর ঘাড়ে ভূত চেপেছে।

বিপুল ব্যানার্জির কাছে কী শুনেছ, অলিম্পিয়া? তা এতই ভয়ঙ্কর যে বলতেও মুখে আটকাচ্ছে।

আটকাক। তবুও বলো।

বিপুল ব্যানার্জি নিজের চোখে দেখেছে, বাবার পেছন-পেছন পা টিপে টিপে আসছিল পীতাম্বর। কিছুতেই যেন মনস্থির করে উঠতে পারছিল না। তারপর খাপ থেকে টেনে বার করেছিল তলোয়ার…।

তারপর?

ডাক্তার তো বলছেন, ইস্পাতের সরু ফলা দিয়ে বুক ফুটো করা হয়েছে বাবার।

বলেছেন বটে।

ফাদার, আপনার কী মনে হয়—

তোমার কী মনে হয় অলিম্পিয়া, আগে তা বলো।

আমার কী মনে হয়? আমার কী মনে হয়, তা কি আপনি আঁচ করতে পারেননি ফাদার? পীতাম্বর ইদানীং মুষড়ে থাকত। বাবার মেজাজ তো জানি–মেজাজ সপ্তমে উঠতে দেরি লাগে না। পীতাম্বরের সঙ্গে খিটিমিটি লেগে থাকতই। তবু বলব, বিপুল ব্যানার্জি নিজের চোখে যাই দেখুক না কেন, পীতাম্বরের পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয় কোনওমতেই।

কিন্তু বিপুল ব্যানার্জি তো ভুল দেখেনি।

আমিও আমার পুরোনো বন্ধুর হয়ে ওকালতি করতে বসিনি। তা ছাড়া, পীতাম্বর তো এখন আমার বন্ধু নয়–ছিল এককালে–অনেক-অনেক বছর আগে। এখন আমার ছায়া মাড়ানো দূরে থাক দূর থেকেই ছায়া দেখলে সরে যায়। বন্ধু সে আর নয়, শত্রুও নয়। সুতরাং পীতাম্বরের পক্ষে যা অসম্ভব, তা হাজারবার বলতে দ্বিধা নেই আমার। অথচ প্রায় হাজারবার ওই একটা কথাই বলে গেল বিপুল ব্যানার্জি–

একই কথা হাজারবার বলাটা বিপুল ব্যানার্জির মুদ্রাদোষ।

মুদ্রাদোষ!

বলেই থেমে গেল অলিম্পিয়া। গুম হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ।

তারপরেই মুখ তুলে বললে এক্কেবারে অন্য সুরে, মুদ্রাদোষটা আমার ক্ষেত্রে না দেখালেই ভালো হত না? বিশেষ করে এই সময়ে?

তোমার ক্ষেত্রে? জুলজুল করে তাকায় ফাদার ঘনশ্যাম।

হাজারবার বলে গেল একটাই কথা বিয়ে করতে চায় আমাকে।

সুসংবাদ।

সুসংবাদ?

অভিনন্দনটা কাকে জানাব, সেটাই শুধু ঠিক করে উঠতে পারছি না। তোমাকে, না বিপুল ব্যানার্জিকে?

ফাদার!

অলিম্পিয়া, উত্তেজনা কোনও সমস্যারই সমাধান করতে পারে না, বরং আরও জট পাকিয়ে দেয়।

উত্তেজিত এখন হয়েছি–তখন হইনি।

আমিও তা দেখেছি। খুবই উত্তেজিত হয়েছিল বিপুল ব্যানার্জি। বিয়ের প্রস্তাবটা শোনবার পর কী বললে তুমি?

বললাম, এখন ওসব কথা থাক।

চমৎকার বলেছ। বিপুল ব্যানার্জি কী বলল?

কথা কানেই তুলতে চায় না। একই কথা বলে গেল হাজার বার। বলতে বলতে অলিম্পিয়ার কথায় জাগল সেই আমুদে সুর–যা ওর অন্তর-প্রকৃতির মধ্যে সুপ্ত থাকে বাইরে থেকে দেখে মোটেই বোঝা যায় না, কত কথাই না বলে গেল। জীবনে বড় হতে চায়, অনেক উচ্চাশাকে সফল করতে চায়। এক সময়ে নাকি আমেরিকাতে ছিল–অথচ আমেরিকার ডলার ছাড়া আর কোনও আমেরিকাব বিষয় নিয়ে ওকে কথা বলতে এর আগে শুনিনি। উচ্চাশাগুলো যে কত উচ্চে পৌঁছেছে, তাও জানবার সৌভাগ্য কখনও হয়নি–জানলাম এই প্রথম। বিয়ে করে নিয়ে যেতে চায় আমাকে আমেরিকার স্বর্গরাজ্যে ।

সেটা সৌভাগ্য, না দুর্ভাগ্য?

আমার ভাগ্যে যা আছে, তা কি আমিই জানি? ফাদার, প্রশ্নটা বিপুল ব্যানার্জির উচ্চাশা সফল করার ব্যাপারে নয়।

জানি। নরম গলায় বললে ফাদার ঘনশ্যাম, বিপুল ব্যানার্জি কোনও প্রবলেমই নয় এই মুহূর্তে। প্রবলেম হল–

পীতাম্বর।

হ্যাঁ, পীতাম্বর। বিপুল ব্যানার্জি ওর সম্বন্ধে যা-যা বলে গেল, তা কি সত্যি? তোমার তো মনে হয় সত্যি নয়।

শক্ত কাঠ হয়ে গেল অলিম্পিয়া। অদ্ভুত চোখে চেয়ে রইল ফাদার ঘনশ্যামের চশমার আড়ালে কুকুতে চোখজোড়ার দিকে। সে চোখে শ্যেনদৃষ্টি নেই, তবুও অলিম্পিয়ার মনে হয় যেন তার ভেতর

পর্যন্ত দুরবীণ দিয়ে দেখে নিচ্ছে অদ্ভুত নিস্তেজ ওই চোখজোড়া।

ভুরু কুঁচকে মুচকি হেসে বললে, অনেক কিছুই জানেন দেখছি।

ফাদার ঘনশ্যাম কিন্তু হাসির ধার দিয়েও গেল না। কণ্ঠস্বরেও অটুট রইল গাম্ভীর্য। বললে থেমে-থেমে, অলিম্পিয়া, জানি আমি অনেক কিছুই। কিন্তু এই ব্যাপারে জানি খুব সামান্যই। কিন্তু একটা ব্যাপারে জানি খুব ভালো করেই। আমি জানি, কে খুন করেছে তোমার বাবাকে।

ভীষণ চমকে উঠল অলিম্পিয়া। বসে থাকতেও পারল না। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে হেঁট হয়ে চেয়ে রইল ফাদারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে। মুখ সাদা হয়ে গেছে। ফ্যাকাশে।

ফাদার ঘনশ্যাম কিন্তু নির্বিকার। বললে শুষ্ক কণ্ঠে, আমি একটা গাধা। নিরেট বোকা। বোঝা উচিত ছিল তখনই।

কখন?

যখন জিগ্যেস করা হচ্ছিল, কোথায় পাওয়া গেছে তোমার বাবাকে। সবুজ পাঁকে মাখামাখি অবস্থায়। ঠিক যেন সবুজ মানুষ।

বলে উঠে দাঁড়াল ঘনশ্যাম পাদরি। বিশাল ছাতাটা বাগিয়ে ধরল এমনভাবে যেন হঠাৎ নতুন। একটা সঙ্কল্প কঠিন করে তুলেছে অন্তরপ্রদেশকে।

কথার মধ্যেও প্রকট হল নতুন গাম্ভীর্য। বললে, তোমার বাবার মৃত্যুকে ঘিরে যে হেঁয়ালি গড়ে উঠেছে, তার সমাধান-সূত্রটিও আমি জেনে ফেলেছি।

আ-আপনি জানেন?

কিন্তু এখুনি তোমাকে বলব না। খবরটা শুভ নয়, এইটুকুই শুধু জেনে রাখো। তবে যে অশুভ পরিস্থিতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছ, তার চাইতে বেশি অশুভ নয়। বলতে-বলতে কোটের বোতাম এঁটে নিল ফাদার। ঘুরে দাঁড়াল ফটকের দিকে, চললাম।

কোথায়?

পীতাম্বরের সঙ্গে দেখা করতে।

জানেন, কোথায় থাকে পীতাম্বর?

জানি। সমুদ্রের ধারে টালির ঘরটায়। বিপুল ব্যানার্জি সেখানেই তো দেখেছে ওকে পায়চারি করতে।

বেগে সমুদ্র-সৈকতের দিকে উধাও হয়ে গেল ফাদার ঘনশ্যাম মণ্ডল।

অলিম্পিয়া কল্পনার জগতে বাস করতে ভালোবাসে। কল্পনার আকাশপাতাল রচনা করে। তাই এই মুহূর্তে বয়স্ক এই বন্ধুটি যে ভয়াবহ ইঙ্গিতটি নিক্ষেপ করে অন্তর্হিত হয়ে গেল, সেই কল্পনা মনে নিয়ে একা-একা দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ মনে করল না। অথচ স্থানত্যাগ করে যেতেও পারল না। আচমকা অমন একটা ভয়াবহ ইঙ্গিত দিয়ে ঝড়ের মতো কেন যে উধাও হয়ে গেল ফাদার ঘনশ্যাম, আকাশপাতাল ভেবেও তার কুলকিনারা পেল না। ফাদার নাকি জানে কে খুন করেছে তার বাবাকে। কী করে জানল, সেটা একটা রহস্য। তার চাইতেও বড় রহস্য পুকুরের সবুজ পাঁকে সবুজ হয়ে যাওয়া মৃতদেহটাকে সবুজ মানুষ নামকরণ করা। সবুজ মানুষ! কীসের প্রতীক? এত হেঁয়ালি করে কথা বলে গেল কেন ফাদার? হেঁয়ালির মধ্যে হেঁয়ালি রচনা না করলেই কি চলত না? মনের চোখে যেন দেখতে পেল ভূতের মতো সবুজ মানুষ চক্কর দিচ্ছে পুকুরের পাড়ে–তাঁদের আলোয়। দিনের আলোয় এ ধরনের গা-ছমছমে কল্পনা মনের মধ্যে কেন যে হঠাৎ ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, বুঝে উঠল না অলিম্পিয়া। দিনের আলোটাকেই বরং আরও বেশি রহস্যময় মনে হল চঁদনি রাতের চেয়ে।

পুকুর। পাঁক। সবুজ মানুষ।

গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অলিম্পিয়া।

সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই অনেক দূরে দেখা গেল দ্রুত আগুয়ান একটা মূর্তিকে। আসছে তার দিকেই। দেখেই বুকের রক্ত চঞ্চল হল অলিম্পিয়ার। দুনিয়াটা মনে হল যেন হঠাৎ উলটে গেছে। যা কল্পনা করা যায় না, চোখের সামনে তাই দেখছে।

হনহন করে যে মূর্তি এগিয়ে আসছে তার দিকে সমুদ্রের ধার থেকে, তাকে চেনে অলিম্পিয়া। খুব ভালো করেই চেনে। কিন্তু তার হাঁটার ধরন আজ এরকম কেন? এরকম উচ্ছল ভঙ্গিমায় তো সে অনেকদিন হাঁটেনি?

আরও কাছে এগিয়ে এসেছে সে। না, ভুল হয়নি। পীতাম্বর আসছে। পড়ন্ত আলোয় ক্রমশ সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার মুখচ্ছবি। আনন্দের রোশনাইতে ঝলমল করছে সারা মুখখানা।

বিমূঢ় হয়ে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল অলিম্পিয়া।

হাসতে হাসতে উল্লাসে ফেটে পড়ল পীতাম্বর তার সামনে এসে। এতদিন যার ছায়া দেখলেই সরে গেছে দূর থেকে, এসে দাঁড়াল এক্কেবারে তার সামনে। দু-হাত রাখল তার দুকাঁধে। বললে সহর্ষে, মুখ তুলে চেয়েছেন ভগবান। এখন থেকে তোমার ভার আমার।

অলিম্পিয়া হতভম্ব। কিছুক্ষণ শুধু চেয়েই রইল ফ্যালফ্যাল করে পীতাম্বরের আনন্দনিবিড় চোখের তারা দুটোর দিকে। তারপর বলেছিল স্বগতোক্তির সুরে, এত আনন্দ কীসের? হঠাৎ এমনভাবে পালটে গেলে কেন পীতাম্বর?

কারণ, এইমাত্র শুনলাম অশুভ সংবাদটা। অলিম্পিয়া, আজ আমি সুখী, সত্যিই বড় সুখী!

.

মল্লিকভবনের সামনের বাগানে জড়ো হয়েছে সকলেই। বিচিত্র এই রহস্য উপাখ্যানে যাদের কিছু ভূমিকা আছে, তারা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে তারাও যাদের কোনও ভূমিকাই নেই। সবাই দাঁড়িয়ে আছে দু-পাশে ঝাউবীথি শোভিত পথের ওপর। উদ্দেশ্য একটাই। আইনবিদ মহাশয় এখুনি আনুষ্ঠানিকভাবে করবেন তার কর্তব্যটি। অর্থাৎ পড়ে শোনাবেন স্যার প্রদ্যুম্ন মল্লিকের শেষ ইষ্টিপত্র। সেইসঙ্গে জ্ঞানদানও করবেন। সেটাও তার কর্তব্য। এহেন সঙ্কটাবস্থায় যা-যা করণীয়, আইনজ্ঞ হিসেবে তা তাকে বলতেই হবে। ফলে, কী ঘটবে আর কী না ঘটবে, জানবার আগ্রহ প্রত্যেকেরই মনে।

দলিল-দস্তাবেজের ফাইল বগলে দাঁড়িয়ে আছেন সলিসিটর সলিল মুখার্জি। পাশেই দাঁড়িয়ে ইনসপেক্টর রাজীবলোচন। আইনের হাতিয়ার চালিয়ে হত্যাকারীকে কুপোকাত করার জন্যেই উইলের বয়ান শুনতে বড়ই ব্যগ্র সে। পীতাম্বর মহাপ্রভু কিন্তু নির্লজ্জভাবে ব্যস্ত অলিম্পিয়াকে নিয়ে। ভ্রূক্ষেপ নেই কোনওদিকেই। দীর্ঘদেহী ডাক্তারকে দেখে বিস্মিত অনেকেই, তার চাইতেও বেশি অবাক হচ্ছে কুমড়োর মতো বপু যার–সেই ঘনশ্যাম পাদরিকে দেখে। ধর্ম নিয়ে যার কারবার, অধর্মের ব্যাপারে তার আগ্রহটা যেন কেমনতর।

ছোট্ট দলটাকে দেখেই বাড়ির দিক থেকে উল্কার মতো বেগে ধেয়ে এল বিপুল ব্যানার্জি। মানুষ-উল্কাই বটে। খাতির করে সবাইকেই নিয়ে গেল মল্লিকভবনের সামনের সবুজ ঘাসজমিতে। পরমুহূর্তেই পুনরায় উল্কাবেগে অন্তর্হিত হল বাড়ির মধ্যে–অভ্যর্থনার আয়োজন করতে। যাওয়ার সময়ে বলে গেল দ্রুত কণ্ঠে, আসছি এখুনি।

লোকটার সচল ইঞ্জিনের মতো এনার্জি দেখে তাজ্জব হয়েছে প্রত্যেকেই। সেক্রেটারি বটে একখানা। প্রাণশক্তিতে ভরপুর। কোনও কাজে ত্রুটি নেই।

প্রথম মন্তব্যটা শোনা গেল পীতাম্বরের কণ্ঠে, ক্রিকেটের রান তুলছে মনে হচ্ছে!

দ্বিতীয় মন্তব্যটা করলেন সলিল মুখার্জি, ছোকরা খাপ্পা হয়েছে আইনের মন্থরগতি দেখে। আইন কেন ওর মতো স্পিডে ছুটছে না–অতএব ছুটে মরছে নিজেই। মিস মল্লিক অবশ্য বোঝেন, এহেন পরিস্থিতিতে আইনবিদরা কখনওই ক্রিকেট রানারের মতো পাই-পাঁই করে দৌড়োতে পারে না। এসব ব্যাপারে আইনগত অসুবিধে আছে–তার জন্যে সময় যা লাগবার, তা লাগবেই। আমার ঢিমেতালে কাজ করায় মিস মল্লিক অন্তত অখুশি নন।

তৃতীয় মন্তব্যটা আচমকা নিক্ষেপ করলেন ডাক্তার, বিপুল ব্যানার্জির ছুটোছুটি এখন কিন্তু আমার ভালোই লাগছে। যা করতেই হবে, তা ঝটপট সেরে ফেলাই ভালো।

ভুরু কুঁচকে বললে পীতাম্বর, কথাটার অর্থ? বিপুল ব্যানার্জির তাড়াহুড়োটা এখন আপনার ভালো লাগছে কেন?

বিপুল ব্যানার্জির বৈশিষ্ট্য তো ওইখানেই। হেঁয়ালির সুরে বললেন ডাক্তার, কখনও তাড়াহুড়ো করে মরে, কখনও ঢিমেতালে চলে।

এটা আবার কীরকম কথা হল?

তাড়াহুড়ো করলে যখন আরও মানাতো, তখন কিন্তু ঢিমেতালেই চলেছিল সেক্রেটারি সাহেব।

কখন বলুন তো?

পুকুরপাড়ে আধখানা রাত ঘুরঘুর না করে কাটালেই পারত। সবুজ-মানুষকে পুকুর থেকে তোলার ব্যবস্থাটা তাড়াহুড়ো করে সারলেই পারত। ইনসপেক্টরের সঙ্গে হঠাৎ দেখা না হয়ে গেলে বাকি রাতটাও বোধ হয় কেটে যেত পুকুরের পাড়েই। তাই বলছিলাম, বিপুল ব্যানার্জি কখনও কাজ করে স্লো স্পিডে, কখনও হাই স্পিডে। ইন্টারেস্টিং।

পীতাম্বর বললে, তাহলে কী বলতে চান, বিপুল ব্যানার্জি যা বলেছে, তার মধ্যে মিথ্যের ভেজাল আছে?

ব্যস, আর কথাটি নেই ডাক্তারের মুখে। গুঢ় কৌতুকের হাসি হাসল কেবল সলিসিটর সলিল মুখার্জি। বলল তরল স্বরে, ছোকরার বিরুদ্ধে কিন্তু আমি কিছু বলব না। তবে

অধীর হল পীতাম্বর, তবে আবার কী?

আমার কাজ আমি ভালো বুঝি, সে ব্যাপারে আমাকে জ্ঞানদান করার চেষ্টাটা না করলেই ভালো করত।

তাই নাকি? আইন শেখাতে গেছিল আপনাকে?

খুব প্রশংসনীয় ভাবেই শেখাতে গেছিল এবং তিলমাত্র দেরি না করে। মানে বুঝেছেন? উইলটা পড়ে শোনানো হোক ঝটপট–দেরি করছি কেন?

এতক্ষণে মুখ খুলল ইনসপেক্টর রাজীবলোচন, সে চেষ্টা আমার ওপরেও হয়েছে। আমার চরকায় কীভাবে তেল দিতে হয়, সেটা আমার চাইতে বিপুল ব্যানার্জির বেশি জানা উচিত নয়। মরুকগে, তাতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ডাক্তার সাহেব কি সন্দেহ করেন বিপুল ব্যানার্জিকে? সেক্ষেত্রে কিন্তু ছোকরাকে এখুনি জেরা করা দরকার।

ওই তো আসছে বিপুল ব্যানার্জি। বললে পীতাম্বর।

দোরগোড়ায় আবার বায়ুবেগে আবির্ভূত হতে দেখা গেল সেক্রেটারিকে।

ঠিক এই সময়ে প্রত্যেককেই অবাক করে ছাড়ল ফাদার ঘনশ্যাম। এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল সবার পেছনে। নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেনি একেবারেই। আচমকা হনহনিয়ে এল সবার সামনে। বোঁ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দুহাত শূন্যে তুলে দাঁড়িয়ে গেল এমন ভাবে, যেন আগুয়ান সৈন্যবাহিনীকে আর এক ইঞ্চিও না এগোনোর নির্দেশ দিচ্ছে সেনাপতি।

কুমড়োপটাশ মন্থরগতি ফাদার ঘনশ্যামের পক্ষে এবম্বিধ আচরণ অতীব বিস্ময়কর। বিশেষ করে যারা তাকে চেনে এবং জানে, তাদের চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম হল স্থূলকায় পাদরির নাটকীয় কাণ্ড দেখে।

দাঁড়ান! আর এগোবেন না!

রীতিমত ধমক দিচ্ছে যে পাদরি! ব্যাপারটা কী?

ফাদার–পীতাম্বর মুখ খুলেছিল বটে–কিন্তু দাবড়ানি দিয়ে থামিয়ে দেয় ঘনশ্যাম পাদরি :

আগে আমাকে যেতে দিন। বিপুল ব্যানার্জির সঙ্গে আমাকে আগে কথা বলতে দিন। আমি যা জানি, আমার মুখেই আগে ওকে শুনতে দিন। প্লিজ, আপনারা কেউ যা জানেন না এখনও পর্যন্ত, আমি তা জানি। আপনাদের বলার আগে ওকে তা বলা দরকার। কেন জানেন? একটা মস্ত ভুল বোঝাবুঝির হাত থেকে বেঁচে যাবে অন্তত একজন।

কী বলতে চান বলুন তো? সলিল মুখার্জির ঝাঁঝালো প্রশ্ন।

অশুভ সংবাদটা শুনিয়ে দিতে চাই। বললে ফাদার ঘনশ্যাম।

তেড়ে উঠল রাজীবলোচন, দেখুন ফাদার–, পরমুহূর্তেই সামলে নিল নিজেকে ঘনশ্যাম পাদরির কুতকুতে চোখজোড়ার দিকে চেয়ে। এ দৃষ্টি সে আগেও দেখেছে অনেক অদ্ভুত ঘটনার ঠিক আগের মুহূর্তে। সুর পালটে নিয়ে বললে সঙ্গে-সঙ্গে, আপনি না হয়ে আর কেউ হলে কিন্তু আমাকে রুখতে পারত না–

কিন্তু যার উদ্দেশে এ কথা বলা, সেই ফাদার ঘনশ্যাম ততক্ষণে বাঁই-বাই করে দৌড়ে পৌঁছে গেছে গাড়িবারান্দায় হাত-মুখ নেড়ে কথা আরম্ভ করে দিয়েছে বিপুল ব্যানার্জির সঙ্গে। জায়গাটা অন্ধকার বলেই দেখা গেল না নাটকের বাকি অংশটুকু। মিনিট বারো পরে একলাই বেরিয়ে এল ফাদার ঘনশ্যাম।

এবং আর-এক দফা তাজ্জব করে দিল প্রত্যেককেই।

কারণ, বাড়ির মধ্যে ঢোকবার কোনও সদিচ্ছাই দেখাল না ফাদার। ঝুপ করে বসে পড়ল নড়বড়ে বেঞ্চিতে, পকেট থেকে বার করল পাইপ আর তামাক, দেশলাই জ্বেলে অগ্নিসংযোগ করে ফুকফুক করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল তন্ময় চোখে গাছের পাতার দিকে চেয়ে–দুকান ভরে যেন শুনছে পাখিদের কাকলি। জগতে এর চাইতে মধুর, এর চাইতে প্রিয় যেন আর কিছুই নেই।

বিমূঢ় দলটা অগত্যা ফাদারকে ওই অবস্থায় রেখেই প্রবেশ করল বাড়ির মধ্যে।

.

কিছুক্ষণ পর।

দড়াম করে খুলে গেল সদরদরজা। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসতে দেখা গেল তিনটি মূর্তিকে। সবার আগে অলিম্পিয়া আর পীতাম্বর। ভারী দেহ নিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ায় পিছিয়ে পড়েছে রাজীবলোচন।

ফাদার কিন্তু তখন ধূম্রজালে আচ্ছন্ন। দুই চোখে স্বপ্নিল চাহনি।

মত্তহস্তীর মতোই বাগান কাঁপয়ে অবশেষে সামনে এসে দাঁড়াল রাজীবলোচন। ক্রোধে আরক্ত মুখ।

রেগেছে অলিম্পিয়াও, ফাদার! ব্যাপার কী বলুন তো? বিপুল ব্যানার্জি কোথায়?

বোমার মতো ফেটে পড়ল পীতাম্বর, পালিয়েছে! সুটকেশ গুছিয়ে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পাঁচিল টপকে পালিয়েছে! ফাদার, কী বলেছিলেন ওকে?

কী আবার বলবেন? বললে অলিম্পিয়া, শয়তানিটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন–মিথ্যের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন।

হুঙ্কার ছাড়ল রাজীবলোচন, একী করলেন ফাদার? এভাবে কেন ল্যাং মারলেন আমাকে?

কী করলাম তাই তো বুঝতে পারছি না। নিরীহ স্বরে বললে ঘনশ্যাম পাদরি।

পারছেন না? আর কত ন্যাকা সেজে থাকবেন? খুনিকে পালিয়ে যেতে দিয়েছেন আপনি…হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি! নিরেট গাধা আমি–তাই খুনিকে হুঁশিয়ার করার সুযোগটা আমিই দিয়েছি আপনাকে, সারা বাগান থরথর করে কাঁপতে লাগল রাজীবলোচনের বজ্ৰনাদে, হেল্প করেছেন–মার্ডারারকে হেল্প করেছেন পালিয়ে যেতে–সেইসঙ্গে বসিয়ে গেছেন আমাকে! আর কি ওকে ধরা যাবে? এতক্ষণে রাস্কেলটা–

বেশ কয়েক মাইল দূরে–আপনার নাগালের বাইরে। রুষ্ঠ কণ্ঠে বললে পীতাম্বর।

হৃষ্টকণ্ঠে বললে ফাদার ঘনশ্যাম, খামোকা চেঁচাচ্ছেন। অতীতে অনেক খুনিকে আমি সাহায্য করেছি ঠিকই কিন্তু খুন করতে সাহায্য করিনি কোনও খুনিকেই।

যাই বলুন আর তাই বলুন, গোড়া থেকেই আপনি জানতেন খুনি বিপুল ব্যানার্জি। অলিম্পিয়াকে এ মূর্তিতে কখনও দেখা যায়নি। রাগে মুখ থমথম করছে। আতীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে গাছের পাতাগুলো পর্যন্ত যেন শিউরে উঠছে, ডেডবডি কোথায় পাওয়া গেছে, এই নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই তাই আপনি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি। ডাক্তার ঠিকই বলেছেন। পুকুরপাড়ে অত রাত পর্যন্ত ঘুরঘুর করছিল ওই কারণেই।

খটকা আমারও লেগেছিল। তখনি যদি রাস্কেলটাকে পাকড়াও করতাম– রাজীবলোচন

প্রায় নৃত্য করতে থাকে প্রচণ্ড আফশোসে।

রাস্কেল বলে রাস্কেল! রণচণ্ডিনী মূর্তি অলিম্পিয়ার, এখন তো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেল বাবাকে খুন করেছে–

সলিসিটর সলিল মুখার্জি। ভারি শান্ত গলায় বললে ফাদার ঘনশ্যাম।

কে? যেন হেঁচকি তুলল রাজীবলোচন। থ হয়ে গেল অলিম্পিয়া। চক্ষু ছানাবড়া করে চেয়ে রইল পীতাম্বর। অকস্মাৎ যেন শ্মশান নৈঃশব্দ্য নেমে এল ঠিক ওইটুকু জায়গায় আশপাশে অব্যাহত রইল বিহঙ্গ কুজন।

সলিসিটর সলিল মুখার্জি! থেমে-থেমে আবার বললে ফাদার ঘনশ্যাম। এমন সুস্পষ্ট উচ্চারণে বললে যেন বাচ্চাদের ক্লাশ নিচ্ছেনতুন শব্দ শেখাচ্ছে–বোঝার সুবিধের জন্যে ধীরে সুস্থে পরিষ্কার উচ্চারণ করতে হচ্ছে। ওই যে ভদ্রলোক, চুল যার কঁচাপাকা, উইল বগলে এসেছেন পড়ে শোনানোর জন্যে।

বলে, পাইপের ছাই ফেলে দিয়ে ফের তামাক ঠাসতে লাগল ফাদার ঘনশ্যাম নিশ্চিন্ত মনে, তিন-তিনটে মূর্তি অবিকল কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল সামনে। তিনজনেরই চোখ গোল গোল, বিষম বিস্ময়ে তিনজনেরই চোয়াল ঝুলে পড়েছে, কথা গেছে আটকে।

বেশ বারকয়েক ঢোক গিলে অবশেষে স্বরযন্ত্রকে সরব করল রাজীবলোচন, কিন্তু কেন?

ঠিক কথা। কেন? কেন সলিল মুখার্জি খুন করতে গেল স্যার প্রদ্যুম্ন মল্লিককে। পাইপে তামাক ঠাসা হয়ে গেছিল ফাদার ঘনশ্যামের। এখন তা ধরিয়ে নিয়ে ফুকফুক করে বার কয়েক টেনে নিয়ে বললে, কারণটা বলার সময় এখন হয়েছে। খুবই অন্যায়, বিরাট অপরাধ করেছেন সলিল মুখার্জিজঘন্য এই ব্যাপারটার মূলে রয়েছে জঘন্যতম সেই অপরাধ এবং একটু থেমে, বারকয়েক পাইপ টেনে, স্যার প্রদ্যুম্ন মল্লিককে খুন করার চাইতেও কদর্য সেই অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই।

মুখ থেকে পাইপ নামাল পাদরি। সটান চাইল অলিম্পিয়ার মুখের দিকে। মুখভাব সিরিয়াস– কণ্ঠস্বরও তাই।

অলিম্পিয়া, কথাটা এখনই শোনা দরকার তোমার। আমি জানি, ধাক্কা তুমি সইতে পারবে। সে মনের জোর তোমার আছে বলেই বলছিনইলে বলতাম না। তুমি প্রায় পথে বসেছ বললেই চলে।

পথে? ছুঁচের ডগার মতো সুর হল অলিম্পিয়ার নয়নতারকা।

হ্যাঁ। মানে, পীতাম্বরের সঙ্গে তোমার আর বিশেষ তফাত নেই। রাজ-ঐশ্বর্য আর তোমার নেই। ফুকে উড়িয়ে দিয়েছে সলিসিটর সলিল মুখার্জি হাজাররকম বিজনেস অ্যাডভেঞ্চারে। পয়লা নম্বর জোচ্চোর, এক নম্বরের প্রতারক সলিল মুখার্জি। টাকার পাহাড় থেকে তোমাকে যে নামিয়ে আনা হয়েছে মাটির ওপর–এই তথ্যটাই কিন্তু এতগুলো রহস্যকে বুঝে ওঠার একমাত্র সূত্র। এই যে ভ্যাবা গঙ্গারামের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে পীতাম্বর, ওকে গিয়ে আমি শুধু সেই খবরটাই দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, রুপোর চামচ মুখে দিয়ে জন্মেও এখন তুমি প্রায় পথের ভিখিরি। শুনেই বাঁই-বাই করে দৌড়ে এসেছিল তোমার পাশে দাঁড়াতে, বুক দিয়ে তোমাকে সাহায্য করতে, প্রাণ দিয়ে তোমার প্রাণে আশার আলো জ্বালাতে। অসাধারণ মানুষ এই পীতাম্বর।

দূর মশায়! কী ফালতু বকছেন! রেগেমেগে বললে পীতাম্বর।

প্রশান্ত স্বরে বললে ফাদার ঘনশ্যাম, অথবা বলা যায় পীতাম্বর লোকটা প্রাগৈতিহাসিক দৈত্য–প্লেসিওসরাস অথবা ওই জাতীয় দানব। গুহামানবদের হৃদয়ও বোধ হয় এত নির্লিপ্ত, এত নির্দয় এবং এত উদাসীন ছিল না। টাকার পাহাড়ে অসীন স্ত্রীর সঙ্গে ঘর করতে সে চায়নি। বউয়ের টাকায় দুবেলা খেয়ে-পরে থাকতে চায়নি। দু-বেলা বউয়ের মুখনাড়া খেয়ে শ্বশুরের ভিটেয় বসে ঘরজামাই হয়ে থাকতে চায়নি। গুহামানবেরও অধম। জঘন্য। বিচিত্র। তাই একেবারেই নির্লিপ্ত, উদাসীন হয়ে গেছিল তোমার ব্যাপারে। তাই অমন কিম্ভুতকিমাকার হয়ে থেকেছিল এতগুলো বছর। তাই তোমার ছায়া দেখলেও দূর থেকে সটকান দিত, পাছে টাকার ছায়ায় গায়ে ফোস্কা পড়ে যায়। কিন্তু যেই আমার মুখে শুনল পথে বসেছ তুমি, তোমার গা থেকে সরে গেছে টাকার ছায়া–অমনি প্রাণবন্ত হল চক্ষের নিমেষে–এতদিন ছিল জ্যান্ত মড়া–হঠাৎ হল জ্যান্ত প্রেমিক–পাই-পাই করে দৌড়ে এল গতর খাঁটিয়ে ভাবীবউকে সাহায্য করার আশ্বাসবাণী শোনাতে–সে যে চায় বউ খাবে তারই টাকায় বউয়ের টাকায় সে খাবে না কোনওদিনই। এমন অদ্ভুত লোককে প্রাগৈতিহাসিক জীব ছাড়া আর কিছু বলা চলে কি? গুহামানবরাও এমন আহাম্মক ছিল কি? জঘন্য! অতি জঘন্য লোক এই পীতাম্বর।

ফুক…ফুক…ফুক! তাল-তাল ধোঁয়া উড়ে গেল ফাদারের পাইপের গর্ত থেকে। নির্নিমেষে তার নির্বোধ আকৃতির দিকে চেয়ে রয়েছে তিন-তিনটে মূর্তি। নাক সিঁটকে রয়েছে কেবল পীতাম্বর। প্রাগৈতিহাসিক জীব অথবা গুহামানবের চাইতেও অধম বিশেষণ দুটো বোধহয় মনঃপূত হয়নি।

ফিসফিস করে বললে অলিম্পিয়া, ফাদার, পীতাম্বরের চাইতেও জঘন্য তোক আপনি।

কেন? কেন? কেন? যেন বিষম আহত হয়ে পাইপ নামিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে চেয়ে রইল ঘনশ্যাম পাদরি।

বিপুল ব্যানার্জি পালিয়ে গেল কেন, তা তো বললেন না।

পালিয়ে গেল তুমি পথে বসেছ শোনামাত্র। মুখ থেকে কথাটা খসতে-না-খসতেই বেশ কিছুক্ষণ ডাঙায় ওঠা মাছের মতো খাবি খেয়েছিল অবশ্য। বড্ড বেশি স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল কিনা– রাজা হবে রাজকন্যেকে বিয়ে করে, টাকার আণ্ডিল নিয়ে পৃথিবীটাকে চক্কর দিয়ে বেড়াবে কত কী প্ল্যানই ঘুরঘুর করছিল মাথার মধ্যে। আকাশ থেকে মাটিতে পড়ায় ঘিলুঢিলু দারুণ আঁকুনি খাওয়ায় কিছুক্ষণ কিং…কিং–কী যেন কথাটা?

কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বললে অলিম্পিয়া।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারপরেই চটপটে ব্রেন চালিয়ে চকিতে কর্তব্য স্থির করে নিলে। এমতাবস্থায় কপর্দকহীন ভাবী বউকে ফেলেই চম্পট দেওয়া বিধেয়। যার টাকা নেই, সেরকম মেয়েকে বিয়ে করার মতো গোমূর্খ অন্তত নয় বিপুল ব্যানার্জি। ভয়ানক স্পিডে তাই ছুটে গেল বাড়ির মধ্যে–তারপর–

ভয়ানক স্পিডে পাঁচিল টপকে পালাল এমন জায়গায়, আমার নামও যেখানে পৌঁছবে না। ভারি মিষ্টি গলায় বললে এবার অলিম্পিয়া, কিন্তু বাবাকে খবরটা কে দিয়েছিল শুনি? আপনি?

পাগল নাকি! কিন্তু এসব কথা হাওয়ার আগে ছোটে। কপর্দকহীন হয়েছেন, এ খবরটা পেয়েই ফিরে এসেছিলেন স্যার প্রদ্যুম্ন। ভারি রাগী মানুষ তো। রাগে ফুঁসতে-ফুঁসতে যাত্রার পোশাক পরেই চলেছিলেন সলিল মুখার্জির দফারফা করবেন বলে–পোশাক পালটানোর মতো মেজাজও ছিল না।  হাবভাব দেখেই পীতাম্বর আঁচ করেছিল, নিশ্চয় বিরাট একটা গন্ডগোল হয়েছে। রাশভারী মনিবকে জিগ্যেস করার সাহসও নেই–অথচ গন্ডগোলটা জান দিয়েও মিটিয়ে ফেলার জন্যে আকুলিবিকুলি করছে বুকের ভেতরটা। কী করা উচিত ভেবে না পেয়ে দোনামোনা মনে ছুটছিল স্যার প্রদ্যুম্নর পেছন-পেছন। দেখে খটকা লেগেছিল বিপুল ব্যানার্জির। দ্বিধাটা কেন, তা আঁচ করতে পারেনি। মনে-মনে হিরো হওয়ার বাসনা থাকে সব মানুষেরই পীতাম্বরও হিরো হতে চেয়েছিল। সমুদ্রের ধারে ভেবেছিল একলাই রয়েছে –কেউ দেখতে পাবে না। তলোয়ার বার করে বাচ্চাছেলের মতো আস্ফালন জুড়েছিল তোমার বাবার পেছনে দূর থেকে দেখে বিপুল ব্যানার্জি ভেবেছে, মনিবকেই কচুকাটা করতে চলেছে পীতাম্বর পাগলা–

খবরদার! পাগলা বলবেন না! খ্যাক করে ওঠে পীতাম্বর।

মুচকি হাসে অলিম্পিয়া, চোপরাও! গুহামানবেরও অধম কোথাকার!–ফাদার, তারপর কী হল?

তোমার বাবা থানায় খবর পাঠিয়েছিলেন আগেই। তাই হনহন করে সবুজ মানুষ চায়ের দোকানের দিকে আসছিলেন ইনসপেক্টর রাজীবলোচন–তাই তো?

হ্যাঁ। বললে রাজীবলোচন।

পীতাম্বর শেষমেশ আস্ফালনই করে গেছে, অগ্নিশর্মা মনিবের পেছন-পেছন আর যায়নি– গেলে খুনটা আটকানো যেত। গুহামানবদের অধম যারা–

তাদের বুদ্ধিও থাকে কম। পাদপূরণ করল অলিম্পিয়া। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে খুন করেছে সলিল মুখার্জি?

গোড়াতেই একটা বেস কথা বলে ফেলেছিল বলে। রাজীবলোচনবাবু এসে খবর দিলেন, জলে ডুবে মারা গেছেন স্যার প্রদ্যুম্ন মল্লিক। আমরা কিন্তু তখন জানি, উনি বাড়ি ফিরে আসছেন জলপথ যাত্রা স্থগিত রেখে। জলে ডুবে গেছেন–এই কথাটা শোনার সঙ্গে-সঙ্গে যে মৃত্যু-দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তা হল সমুদ্রের জলে ডুবে মৃত্যু। সেই দৃশ্য মনের মধ্যে নিয়েই আমি জিগ্যেস করেছিলাম কখন? কিন্তু সলিল মুখার্জির মনের মধ্যে ভাসছিল অন্য মৃত্যু-দৃশ্য। উনি ফস করে জিগ্যেস করলেন, কোথায়? অবান্তর প্রশ্নটা শুনেই বোঁ করে মাথাটা ঘুরে গেল আমার। সমুদ্র থেকে ফেরার পথে যে মারা যায়–সে তো সমুদ্রেই ডুবেছে ধরে নিতে হবে। তা সত্ত্বেও উনি প্রশ্ন করলেন, মৃত্যুটা ঘটেছে কোথায়। তার মানে, উনি জানেন মৃত্যুর জায়গাটা–মানে, মৃতদেহটাকে যেখানে রেখে এসেছেন–সেই পুকুরটা–যার দূরত্ব সমুদ্র থেকে বেশি দূরে নয়। একটা জঘন্য খুনির পাশে বসে আছি জেনেই তৎক্ষণাৎ বমি-বমি পাচ্ছিল বলেই অমন ফ্যাকাশে মেরে গিয়েছিলাম। মৃতদেহটাকে সবুজ মানুষ বলে বসেছিলাম। সবুজ শ্যাওলায় সবুজ মৃতদেহটা সমুদ্রের সবুজ শ্যাওলায় সবুজ হয়ে গেলেই বরং ভালো ছিল–এই রকম একটা ইঙ্গিত করেছিলাম। সেই মুহূর্তে জেনে ফেলেছিলাম, স্যার প্রদ্যুম্নর ডেডবডি সবুজ পাঁকের মধ্যেই ঢুকিয়ে দিয়ে এসে ন্যাকা সাজছেন সলিল মুখার্জি। খুন করেছেন যে অস্ত্রটা দিয়ে, জ্ঞানপাপী বলে হাতও দিচ্ছেন না তাতে—

.

কোন অস্ত্রটা বলুন তো? সবিস্ময়ে জিগ্যেস করে রাজীবলোচন।

যাচ্চলে। তাও দেখেননি? টেবিলে পাশাপাশি ছিল কালি-মাখা ধুলো-মাখা কলম আর চকচকে পরিষ্কার কাগজ কাটা ছুরি–যা সরু ছোরার মতোই বুকের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে চেপে বসিয়ে দিলেই। সলিল মুখার্জি কলমবাজ মানুষ কথা বেচে আর কলম চালিয়ে রোজগার করেন–ছুরি চালনা নিশ্চয় তাকে মানায় না। কিন্তু কাজের ফাঁকে-ফাঁকে অন্যমনস্ক থাকলে, চকচকে কাগজকাটা ছুরি নিয়ে নাড়াচাড়া করে না, এমন কাউকে দেখাতে পারেন? সলিল মুখার্জি কিন্তু সদ্য পরিষ্কার করা ছুরিটাতে আঙুল না ছুঁইয়ে ধুলো আর কালি-মাখা কলম দিয়েই নাড়াচাড়া করে যাচ্ছিলেন সমানে। ছুরি থেকে রক্তের দাগ ধুয়ে ফেললেও মন থেকে তো ধুতে পারেননি, কাজেই–

সলিল মুখার্জি সেই দিনই নিজের ব্রেন উড়িয়ে দিয়েছিল রিভলভারের গুলিতে রাজীবলোচন হাতকড়া হাজির করার আগেই।

ঠিক সেই মুহূর্তেই পুরোনো দিনের মতোই সমুদ্রসৈকতে ছেলেখেলা করতে দেখা গিয়েছিল দুটি মূর্তিকে।

পীতাম্বর আর অলিম্পিয়া।

বিদেশি ছায়ায় * রোমাঞ্চ পত্রিকায় প্রকাশিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *