1 of 2

সুন্দরী তুমি শুকতারা

সুন্দরী তুমি শুকতারা

গৌরচন্দ্রিকা

ফুটন্ত লোহা গজায়, কিন্তু বানিয়ে দেয় ইস্পাত। ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির লেলিহান অগ্নিশিখায় মানুষও কখনও কখনও পালটে যায়–অসহ্য কষ্ট তাকে প্রায় অমানুষ করে দেয়। বিদ্রোহী

বর্মন-এর ক্ষেত্রে হয়েছিল ঠিক তাই। সুন্দরী স্ত্রীকে হারানোর পর সে হয়ে গেল নিছক একটা মেশিন, প্রতিহিংসা নেওয়ার মেশিন।

আমরা জানি সে এখন কী হয়েছে ও বরফ আর ইস্পাতে গড়া মূর্তি, এই দুইয়ের চাইতেও বেশি নিষ্করুণ; অতি ভয়ানক প্রায় নৈব্যক্তিক এক শক্তি, যার মড়ার মতন সাদা মুখ মুখোশের মতন ঢেকে রেখে দেয় হিমশীতল প্রায় অলৌকিক নির্মম প্রতিভাকে সমাজশত্রু হননের পূর্বমুহূর্তেই কেবল নারকীয় আগুন দেখা যায় কালো চোখের মণিকায়–

এ কাহিনি সেই বিদ্রোহী বর্মনের–
সঙ্গে আছে গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ রুদ্র।

.

অর্ধাঙ্গিনীর অন্তর্ধান

ফাগুনের আগুন লেগেছে বনে-বনে।

দমদম এয়ারপোর্টের দুরে-দূরে দেখা যাচ্ছে এহেন আগুনের সমারোহ।

এয়ারপোর্ট কিন্তু নিস্তরঙ্গ পুষ্করিণীর মতনই স্থির। পুকুরের শোভা যেমন পদ্ম ফুল, এয়ারপোর্টেও তেমনি ঝকঝক করছে খানকয়েক এরোপ্লেন।

শান্ত এয়ারপোর্টে ঝিকমিকিয়ে চলেছে ফাগুনের আনন্দময় রোদ। এই দৃশ্যই নয়নভরে দেখছে বিদ্রোহী বর্মন। তখন কি কল্পনাও করতে পেরেছিল যে এমন সুন্দর জায়গাটাই তার জীবন সাহারার সূচনাকেন্দ্র হয়ে দাঁড়াবে? ভাবতেও কি পেরেছিল অপরিসীম আতঙ্কঘন ফ্যানট্যাসটিক ঘটনার পর ঘটনা তার গোটা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে?

না, পারেনি।

আতঙ্কের জীবাণু প্রশান্ত পরিবেশে লীলা দেখাতে পারে না–এ হেন জায়গায় তার সৃষ্টির সম্ভাবনাও থাকে না।

অথচ রৌদ্রবিধৌত অপরূপ এই দমদম বিমান বন্দরেই আতঙ্ক হল অঙ্কুরিত। বিদ্রোহী বর্মন সর্বজনের কাছে পরিচিত ছিল হাসিখুশির অফুরন্ত আধার হিসাবে–কৌতুকবোধ অপসৃত হল তার চরিত্র থেকে।

ট্র্যাজেডির বীজ বপন হয়ে গেল শান্তিময় এই ক্ষেত্রেই–পালটে গেল বিদ্রোহী বর্মনের জীবনের ছন্দ।

.

ডগলাস বিমানে দশজন প্যাসেঞ্জার বসতে পারে। প্রাইভেট এয়ারলাইন্স-এর বিমান। দুটো আছে। এখুনি একটা আকাশে উড়বে। তাই যেন দম নিচ্ছে। রানওয়ের ওপর খাড়া। শেষ লাগেজটা এইমাত্র প্রবেশ করেছে তার উদরে। জানলায় বসে সেই দৃশ্য দেখল বিদ্রোহী।

বলল এজেন্টকে, আমাকে যে যেতেই হবে পোর্টব্লেয়ার–এখুনি।

সসম্ভ্রমে বিদ্রোহীর দিকে চেয়ে রইল এজেন্ট। সম্ভ্রম সে ছিনিয়ে নেয় সবার কাছ থেকেই। তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে। তার চাবুক চেহারা দিয়ে। কণ্ঠস্বরের মাদল বাজনা দিয়ে। তার কুচকুচে চুলের ঝিকিমিকি, তার কৃষ্ণতর চোখের কালো দীপ্তি পুরুষ অথবা নারী–সবাইকেই মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারে প্রথম দর্শনেই।

এত সমীহবোধ সত্ত্বেও ঘাড় নাড়ল এজেন্ট। নিতান্তই নারাজ।

বললে মৃদু স্বরে, কলকাতায় হেড অফিসে খোঁজ নিয়ে আসেননি? একদম জায়গা নেই। সব সিট ফুল।

বিদ্রোহীর কালো মণিকা দুটোয় শুধু কালো স্ফুলিঙ্গ দেখা দিল–ক্ষণেকের জন্য। পিয়ানোর ইস্পাত তারে টঙ্কার দিলে যেরকম শিরশির আওয়াজ বেরয়, সেই আওয়াজ ধ্বনিত হল তার কণ্ঠস্বরে–খুব নীচু খাদে।

বললে, আমাকে যে যেতেই হবে। আমি আর আমার স্ত্রী। স্ত্রীর আত্মীয়া খুবই অসুস্থ। মুমূর্ষ।

হাত রাখল শুকতারার হাতে। বিদ্রোহীর হাতের পাঞ্জা দেখলে বোঝা কঠিন প্রতিটি আঙুল যেন হাড় আর ইস্পাত দিয়ে গড়া–চামড়া দিয়ে ঢাকা; সে তুলনায় শুকতারার বাহু পেলব কোমল, মসৃণ চামড়া মখমল কোমল, উজ্জ্বল গৌরবর্ণের সঙ্গে দুধ আর আলতার সংমিশ্রমের আভাস আছে। শুকতারা তাই শুধু সুন্দরী নয়–অপরূপ রূপসি। তার নাক মুখ চিবুক ইউরোপীয় মর্মর মূর্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তার দীঘল আঁখি আর মখমল পেলবতা পলিমাটির স্নিগ্ধতা মনে এনে দেয়। তার দুই চোখের তারার সমাহিত চাহনি মন-সমুদ্রের অতলতাকে বাঙময় করে তোলে। পরনে তার ফিকে গোলাপি রঙের অর্গান্ডি শাড়ি ফরসা রঙকে আগুনের মতোই প্রোজ্জ্বল করে তুলেছে। বিদ্রোহীর করস্পর্শে সাদা দাঁতের সারির আভাস, সে সামান্য হাসল। বরকে যেন সংযত হতে বলছে।

এজেন্ট কিন্তু নিরুপায়। ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়েই চলেছে। সমবেদনা জানাচ্ছে, একই সঙ্গে অক্ষমতাও প্রকাশ করে চলেছে।

কিছুই করা যাবে না। মাঝরাতে একটা প্লেন ছাড়বে–

অতক্ষণ ওয়েট করা যাবে না, ঝটিতি বললে বিদ্রোহী। ওর মুখের পরতে-পরতে সঙ্কল্প প্রস্তরকঠিন রূপ নিয়েছে। অতীতেও এরকম মুখাবয়ব দেখা দিয়েছে বিশেষ ক্ষেত্রে–যখনি সাধারণ মানুষ সমস্যা সমাধানে অপারগ হয়েছে বিদ্রোহী বর্মনের অ্যাডভেঞ্চারাস সত্তা সেই সমস্যা লুফে নিয়েছে। সমাধান হাতে তুলে দিয়েছে।

বললে, চাটার প্লেন নেব। যত বড়ই হোক না কেন–

চার্টার করার মতন প্লেন এখন ফিল্ডে নেই। সরি, কান্ট হেল্প।

ঠিক এই সময়ে এয়ারপোর্ট অফিসের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল বিদ্রোহী বর্মন। দেখেছিল চাকা গড়গড়িয়ে রানওয়ের দিকে চলেছে ডগলাস।

এজেন্টের সঙ্গে আর কথা বলেনি বিদ্রোহী। দ্রুতপদে ধাবিত হয়েছিল দরজার দিকে। পেছনে এসেছে সুন্দরী শুকতারা।

শুধিয়েছিল, কী করতে চাও?

সুন্দরী শুকতারার কণ্ঠস্বরে বীণার ঝঙ্কার–স্বামীর সঙ্গে কথা বলার সময় মূর্ত হয়ে ওঠে গভীর আস্থা–সে জানে, ধূসর অগ্নিশিখা সম স্বামী প্রবরের ডিক্সনারিতে অসম্ভব শব্দটা ঠাঁই পায় না।

বিদ্রোহী বললে, পোর্টব্লেয়ারে যাব–এখুনি।

ধেয়ে চলেছে সে এয়ারলাইনারের দিকে।

বিদ্রোহী যখন নিশ্চল, তখন সে সম্ভ্রম ছিনিয়ে নেয়। যখন সে চলমান, তখন তাকে স্বচ্ছন্দ গতিতে শিকারি চিতার মতন ধাবমান বলেই মনে হয়। বহু যুগে এমন শরীরী বিদ্যুৎ দেখবার সৌভাগ্য হয় মানুষের। প্রাণশক্তির তীব্রতা স্ফুরিত হয় হাতে-পায়ে সর্ব অঙ্গে। অথচ সে আয়তনে বিপুলকায় নয়। হাইটে মাত্র পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। ওজন মোট একশ ষাট পাউন্ড।

স্বামী স্ত্রী একই গতিবেগে চলে এসেছে প্লেনের কাছে। ডবল মেটাল ডোর এখনও খোলা রয়েছে। ধাতুর সোপান এখনও যথাস্থানে রয়েছে। প্লেন ঘুরে একজন অ্যাটেনড্যান্ট এসে দাঁড়াল বিদ্রোহীর সামনে।

বললে, এ প্লেনের দুটো খালি সিট কি আপনাদের জন্যে?

লোকটা বেজায় লম্বা। হাড়সবর্ষ। আঙুলের গাঁট বেশ মোটা। চামড়া লালচে আর কর্কশ। বিদ্রোহীর কালো চোখের ওপর কালো ভুরু জোড়া নারকেল দড়ির মতন শক্ত হয়ে ওঠে লোকটার দিকে তাকিয়েই।

দুই চোখে জয়োল্লাস ভাসল তৎক্ষণাৎ।

সিট তাহলে আছে। অথচ বলল নেই। ঘোর চক্রান্ত।

আপনাদের টিকিট যদি না থাকে–

পোর্টব্লেয়ারে নেমে মিটিয়ে দেব। ফরম্যালিটি যদি কিছু থাকে সেরে নিন–এসো সুন্দরী।

শুকতারাকে শুধু সুন্দরী বলেই ডাকে বিদ্রোহী। চিরকাল। বিয়ের আগে থেকে। শুনে যারা চোখ কপায়, তাদের দিকে কালো চোখের হিরে জ্বালিয়ে রাখে–থেমে যায় চোখের কাঁপন।

টুকটুক করে সিঁড়ি বেয়ে প্লেনের ভেতরে গিয়ে ঢোকে দুই মূর্তি। একজন পুরোদস্তুর হি ম্যান, আর একজন অণু পরমাণুতেও শী-ম্যান। প্রপেলারের গর্জন চলছে, ধাম করে বন্ধ হচ্ছে মেটাল ডোর, লক করেও দেওয়া হল সে দরজা। চলতে শুরু করেছে প্লেন। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। বিদ্রোহী। ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছে। কিন্তু অন্যান্য আরোহীদের চিনতে পারছে না।

ওরা স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও আটজন প্যাসেঞ্জার রয়েছে প্লেনে। সাতজন পুরুষ। একজন নারী। মহিলাটির শ্রী অঙ্গে আকর্ষণ আছে বিলক্ষণ। কিন্তু মুখ শক্ত, চোয়াল শক্ত, নাক শক্ত। এগুলি না থাকলে তাকে পারফেক্ট বিউটি বলা যেত। ছয় পুরুষের একজন বিশালকায় এবং স্থূলকায় বাড়তি চর্বি জমেছে শরীরের সব জায়গায়। দ্বিতীয়জনও বিশাল, তবে চর্বির পাহাড় নয়–এর হাতে রয়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ কালো চুল। তৃতীয়জন খর্বকায়, সলিড বপু–দাঁতের ফাঁকে মোটা চুরুট। বাকি চারজন ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতন মামুলি চেহারার অধিকারী। পর্যবেক্ষণ সমাপ্ত করে সুন্দরীর পানে তাকায় বিদ্রোহী–খুশি তো?

নিজের সিটে বসে ঈষৎ ঝুঁকেও পড়ে। ইস্পাত-পাঞ্জা রাখে সুন্দরীর কাঁধে। যেন হরগৌরী। নিবিড় সম্পর্কটা বিজ্ঞাপিত ওই একটি আচরণেই।

ফাইন। মিষ্টি হেসে বললে সুন্দরী।

রিল্যাক্সড হয়ে যায় বিদ্রোহী। প্লেনের মৃদু আন্দোলনে আন্দোলিত হয় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি বডি। সূর্য ডুবছে দিগন্তে–গোধূলি অবগুণ্ঠন মেলে ধরছে ধীরে ধীরে।

সুন্দরীর মা মৃত্যুশয্যায়। যদি কিছু হয়ে যায়, বিশাল সম্পত্তির ওয়ারিশ হতে চলেছে সুন্দরী। নির্বিকার থাকার চেষ্টা করে বিদ্রোহী।

প্লেনের গর্জন এখন কানে সয়ে গেছে। কালো ইস্পাতের পাতের মতন বঙ্গোপসাগর পড়ে রয়েছে নীচে। আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে না সাগরের জলও তাই কালো। বেঁটে সলিড লোকটা জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে–তার দৃষ্টি নেই আর কোনও দিকে।

বছর বিশেক বয়সের স্টুয়ার্ডেস এগিয়ে এল সুন্দরী শুকতারার দিকে। সুন্দরীরা সুন্দরীদের দিকে বেশি তাকায়–পুরুষদের দিকে ততটা তাকায় না। শুকতারা দেখে নিল স্টুয়ার্ডেসকে। স্লিম

অ্যান্ড অ্যাট্রাকটিভ।

হাসল স্টুয়ার্ডেস। কিছু প্রয়োজন কি শুকতারার?

না, শুকতারা ভালোই আছে। তবে উঠে দাঁড়াল বিদ্রোহী। হাত দুটো তার চটচট করছে। ধোয়া দরকার। এগোল ল্যাভেটরির দিকে।

চলন ভঙ্গিমায় আবার ঠিকরে গেল সেই মসৃণ পিচ্ছিলতা–শক্তি ঠাসা পেশিপুঞ্জ থেকে যার আবির্ভাব ঘটে। প্রতিটি পদক্ষেপে চিতাবাঘের রাজকীয়তা–অঙ্গ ঘিরে বিদ্যুৎ-বহ্নির অদৃশ্য বিচ্ছুরণ। শুধু চলন ভঙ্গিমাই নয়। মাঝারি মাপের ফ্রেমে বিরল শক্তির কাহিনি যেন কথা কয়ে উঠবে ওর শরীরটার দিকে তাকালে। দক্ষ লড়াকুর পূর্ণ বয়েসের সমস্ত অভিজ্ঞতাই সঞ্চিত হয়েছে। বিদ্রোহীর শক্তিঠাসা শরীরটার সব জায়গায়। একই সঙ্গে যৌবনের আগুন আর সহনশীলতাও বিধৃত রয়েছে প্রতিটি অণুপরমাণুতে। বিদ্রোহী এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটিয়ে এমনই তড়িৎ, শক্তি অর্জন করেছে যা চোখে পড়ে কদাচিৎ।

শুকতারা এহেন বিরল পুরুষের দিকে তাকিয়ে হাসল ছোট্ট আর মিষ্টি হাসি। হাসি ফিরিয়ে দিল বিদ্রোহী কালো চোখের তারা নাচিয়ে। তারপর দরজা খুলে ঢুকল টয়লেট রুমে।

হাতে ময়লা না থাকলেও হাত ধোওয়ার বাতিক আছে বিদ্রোহীর। জঙ্গলে অথবা মেরু প্রান্তরে, শহরে অথবা পর্বতে লক্ষ কোটি টাকার অ্যাডভেঞ্চারে গেছে বিদ্রোহী হাত ধোওয়ার বাতিক ছাড়েনি। এক বিন্দু জলের দাম যেখানে সোনা দিয়ে ধার্য করা যায়–সেই মরু অঞ্চলেও দু-হাতের কল্পিত ক্লেদ সাফ করতে জল অপচয় করেছে নির্বিকার ভাবে।

ধীরে সুস্থে নিতান্তই অলস ভঙ্গিমায় দুহাত পরিষ্কার করে নিল বিদ্রোহী–ফিরে এল প্লেনের মধ্যে।

দেখল, ওর পাশের সিট শূন্য।

যেখানে বসেছিল সুন্দরী শুকতারা একটু আগেই।

নির্নিমেষে শুন্য সিটটার দিকে চেয়ে রইল বিদ্রোহী। শিরশির করে উঠল ব্রহ্মতালুর চামড়া।

কিন্তু শিউরে ওঠবার মতন কিছুই তো ঘটেনি। লেডিজ ল্যাভেটরি পেছনে–শুকতারা গেছে। সেখানে।

বেঁটে সলিড লোকটা এখনও চুরুট কামড়ে চলেছে–অগ্নিসংযোগ এখনও ঘটেনি। বিদ্রোহীর দিকে পূর্ণ চোখে ক্ষণেক তাকিয়ে চাহনি ফিরিয়ে নিল জানলার দিকে। বাকি ছয় পুরুষ আর এক নারী দৃকপাতই করল না ওর দিকে। পেছন থেকে এগিয়ে এল বিমানসুন্দরী। হাতছানি দিয়ে তাকে কাছে ডাকল বিদ্রোহী।

আমার স্ত্রীর শরীর সুস্থ তো? ল্যাভেটরিতে গেল নাকি?

আপনার স্ত্রী? ললাটে ঈষৎ কুঞ্চন জাগিয়ে বললে বিমান-অপ্সরা।

হ্যাঁ। সিক হয়ে গেল নাকি প্লেন মোশান-এর জন্য?

বুঝলাম না। রূপসীর চোখে এখন জাগ্রত হচ্ছে অদ্ভুত চাহনি।

নিমেষে প্রদীপ্ত হল বিদ্রোহীর কয়লা কালো চোখ, কালো স্ফুলিঙ্গ যেন বিমান রূপসীর সুন্দর তনুর মর্মস্থল ভেদ করে গেল চকিতে। একই সঙ্গে শিরশির করে উঠল শিরদাঁড়ার শীর্ষদেশ।

বললে স্পষ্টতর উচ্চারণে, আমি বলছি আমার স্ত্রীর কথা। একটু আগেই বসেছিল আমার পাশে–ওই সিটে।

ও সিট তো খালিই ছিল।

চকচক করে ওঠে বিদ্রোহীর কপাল। আবির্ভাব ঘটেছে স্বেদবিন্দুর। ইস্পাতের দীপ্তি দেখা যায় কালো চোখে।

বিমান তিলোত্তমার কথা কিন্তু থামেনি, কী বলেছেন বুঝতে পারছি না। প্লেনে উঠেছেন একা–কেউ তো সঙ্গে ছিল না।

মনে হচ্ছে আপনার মাথা খারাপ হয়েছে, ডম্বরু কণ্ঠে শব্দগুলো নিক্ষেপ করেই ঘুরে গেল বিদ্রোহী। চর্বির পাহাড় বসে আছে ওর সব চাইতে কাছে। বললে তাকেই, আপনি তো দেখেছেন আমার স্ত্রীকে। বলে দিন এই স্টুপিড স্টুয়ার্ডেসকে।

খুব আস্তে মাথা নাড়ে চর্বির পাহাড়।

ঠিকই বলেছেন স্টুয়ার্ডেস। দমদম এয়ারপোর্টে আপনি একাই উঠেছেন প্লেনে–কেউ ছিল সঙ্গে।

জীবনমৃত্যুর লড়াইয়ে বহুবার নিজের শ্রবণেন্দ্রিয়র ওপর নির্ভর করতে হয়েছে বিদ্রোহীকে। কখনই দুর্বলতা দেখায়নি শ্রবণশক্তি। সুতরাং এখনও ভুল শুনছে কানে–তা ভাবতে পারল না। ঘুরে দাঁড়াল অন্যান্যদের দিকে।

আপনারা তো দেখেছেন আমার স্ত্রীকে?

পর্যায়ক্রমে প্রত্যেকের মুখ নিরীক্ষণ করে যায় বিদ্রোহী। সব মুখেই ভাসছে অবাক চাহনি। বিমূর্ত বিস্ময়–যেন একযোগে সবাই প্রত্যক্ষ করছে এক বদ্ধ উন্মাদকে। ভয়ের ভাবও মিশে রয়েছে। চাহনিগুলোর মধ্যে।

প্রায় লাফিয়ে প্লেনের পেছনে চলে যায় বিদ্রোহী। দড়াম করে খোলে লেডিজ ল্যাভেটরির দরজা। কেউ নেই ছোট্ট খুপরিতে। দৃষ্টি নিক্ষেপ করে টেল কম্পার্টমেন্টে৷ শুধু লাগেজই রয়েছে সেখানে–আর মেল ব্যাগ। দৌড়ে চলে আসে প্লেনের সামনের দিকে ঝটকান দিয়ে খোলে পাইলটের কম্পার্টমেন্টের দরজা। ক্রুদ্ধ চোখে ওর দিকে তাকায় পাইলট আর কোপাইলট। তারপরেই ঘাবড়ে যায় বিদ্রোহীর চোখে ঘনায়মান ক্ষিপ্ততা দেখে।

ওর মাথায় তখন চর্বিপাক দিচ্ছে একটাই অসম্ভব সত্য।

সুন্দরী শুকতারা নেই এই প্লেনে।

কঠিন ধাতুর রড বুঝি মট করে ভেঙে গেল বিদ্রোহীর কণ্ঠস্বরে, ড্যাম ইউ অল। হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান? হোয়্যার ইজ মাই ওয়াইফ? ছিটকে যায় দরজার সামনে। লক করা রয়েছে। এ দরজা এখন ভোলা প্রায় অসম্ভব–উড়ন্ত প্লেনে বাইরের এয়ার প্রেসার ঠেলে দরজা খোলা এত সহজ নয়। লাটুর মতন অবয়বটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে তাকায় আরোহীদের দিকে।

চর্বির পাহাড় আর বেঁটে সলিড লোকটা পায়ে-পায়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে।

অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে বিমান-রূপসী, মাথা বিগড়েছে। ধরুন।

তাহলেই মরবেন। বিদ্রোহীর কণ্ঠস্বর বিদ্রোহীই এখন চিনতে পারছে না।

আগুয়ান দুজনেই পিছিয়ে যায় এক পা। উঠে দাঁড়িয়েছে অন্য পাঁচ পুরুষ। এখন ওরা সাতজন।

বিদ্রোহীর হাত চলে যায় হিপ পকেটে। খুদে রিভলভার ওর নিত্য সঙ্গী।

কণ্ঠে মিনতি জাগায় বিমান-সুন্দরী–প্লিজ। কেন বুঝছেন না? আপনি তো একাই উঠেছেন। একাই বসেছিলেন। কেউ তো আপনার সঙ্গে ছিল না। ইউ আর হ্যাঁভিং ডিলিউশন।

যেন অবোধ বালকের মতিভ্রম ঘোচাতে চাইছে স্টুয়ার্ডেস।

স্ত্রী আমার সঙ্গেই ছিল না–এটাই তো বলতে চান? বলতে বলতে শুন্য সিটটার দিকে এগিয়ে যায় বিদ্রোহী–কুশন এখনও গরম বডির গরমে। দেখুন–

কুশন কিন্তু ঠান্ডা। কেউ সেখানে বসেছে বলে তো মনে হচ্ছে না। আস্তে আস্তে হাত তুলে নেয় বিদ্রোহী।

স্ত্রী নেই প্লেনে। একসময় যে ছিল, তারও কোনও প্রমাণ নেই। প্যাসেঞ্জার আর কর্মীরাও বলছে, শুকতারা ওঠেনি প্লেনে। প্লেন থেকে তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ারও কোনও পথ নেই।

পেছন দিকে পাইলটের দরজা ফাঁক হচ্ছে একটু-একটু করে। তন্ময় হয়ে থাকায় ওদিকে খেয়াল ছিল না বিদ্রোহীর। নিঃশব্দে বেরিয়ে এল কোপাইলট। দু-হাতে উঁচু করে ধরল আগুন নেভানোর সিলিন্ডার। সবেগে নিক্ষিপ্ত হল মানুষটার মাথার ওপর। যে মানুষটার দিকে সভয়ে তাকিয়ে রয়েছে সকলেই।

লুটিয়ে পড়ে বিদ্রোহী।

.

ট্র্যাজেডির পরের ঘটনা

পোর্ট ব্লেয়ার এয়ারপোর্ট।

চারজন পুলিশ আর তিনজন ফিল্ড অ্যাটেনড্যান্ট–প্রত্যেকেই লোহায় পেটা ভীম বললেই চলেদাঁড়িয়ে রয়েছে বিদ্রোহী বর্মনের গা-ঘেঁষে। এত কাছে থাকার কারণ, দু-দুবার বিদ্রোহীর কালো চোখে উন্মাদ অগ্নির নৃত্য দেখা গেছে। মাসল গুটিয়ে ইস্পাতের বল হয়ে গেছে–প্রতিবারেই তাকে চেপে ধরেছে সাতজন একসঙ্গে। বিদ্রোহীর মুখাবয়ব খড়ির মতন সাদা।

সে বলছে, ফোন করুন দমদমে। কতবার বলব?

করা হয়েছে, নরম গলায় জবাব দিল এয়ারপোর্ট ম্যানেজার। আপনার প্যাসেজের কোনও রেকর্ড সেখানে নেই।

বললাম তো, লাস্ট মিনিটে জোর করে উঠেছিলাম প্লেনে আমি আর আমার স্ত্রী। রেকর্ড থাকবে কী করে? কিন্তু ফিল্ডের লোকজন–

তারাও বলছে একই কথা। প্লেনে উঠেছেন একা। সঙ্গে স্ত্রী ছিল না।

দৃষ্টি বিনিময় ঘটে চার পুলিশের চোখে–তাৎপর্যপূর্ণ চাহনি।

তবে গেল কোথায় আমার ওয়াইফ? কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারছি না কেন?

সাতজোড়া অবিশ্বাসভরা চোখ চেয়ে রইল বিদ্রোহীর দিকে। সাতজোড়া হাতও এগিয়ে এল বেগতিক দেখলেই আঁকড়ে ধরার জন্য। বিদ্রোহীর চোখে জ্বলছে মশাল। মনের ভেতর প্রোজ্জ্বল হয়ে রয়েছে শুকতারার দুটি চোখ। টলটলে একজোড়া দীঘি–নিস্তরঙ্গ শান্ত চাহনি–নিমেষহীন নয়নে শুধু দেখছে বিদ্রোহীকে–যেভাবে জ্যোৎস্না রাতে অরণ্য অঞ্চলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে– ঠিক সেইভাবে বিদ্রোহী বলেছিল–কী মুশকিল। পূর্ণিমার রাতে এত কষ্ট করে জঙ্গলে নিয়ে এলাম–আর তুমি দেখছ উঁদ? আমি কি জিরো হয়ে গেলাম? নরম চাহনি বিদ্রোহীর পানে ফিরিয়ে শুভ্র দাঁতে চাঁদের আলোর ঝিলিক তুলে শুকতারা বলেছিল, হে আর্যপুত্র, তুমিই যে আমার চাঁদ। অবাক হয়ে তখন ভাবছিলাম, আমার চাঁদ আকাশে গেল কী করে?

বুকের ভেতর কনকন করে ওঠে বিদ্রোহীর। ও যেন শুনতে পায় মনের আয়নায় শুকতারার চোখ বলছে, আমার চাঁদ আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে না কেন?

ইচ্ছে হয়েছিল সেই মুহূর্তে চিৎকার করে বলে, শুকতারা তুমি কোথায়? বন্দিনী কার কাছে? কীভাবে?

নিশ্চয় দুই চক্ষু তখন অগ্নিময় হয়ে উঠেছিল, স্ফুলিঙ্গ বর্ষণও করেছিল। আর সেই উন্মাদ চাহনি দেখেই সাত জোয়ান সাতরকম ভাবে ওকে চেপে ধরেছিল–নড়বার উপায় ছিল না বিদ্রোহীর।

আর ঠিক তখনি যেন ঝঙ করে একটা আওয়াজ হল ব্রেনের মধ্যে। যেন পিয়ানোর তার ছিঁড়ে গেল।

এল অ্যাম্বুলেন্স। নিয়ে গেল মামুলি হাসপাতালে নয় স্যানিটারিয়ামে।

নার্স—

.

ভাঙা কর্কশ কণ্ঠস্বর। কাহিল। নিজের কণ্ঠস্বর? চিনতে অসুবিধে হয় বিদ্রোহীর। সাদা জানলার সামনে দাঁড়িয়েছিল শুভ্রবেশ পরা একটি মেয়ে। এ ঘরের দেওয়ালও সাদা। কিন্তু জানলার লোহার মোটা গরাদ। এত মজবুত গরাদ তো গেরস্থ বাড়িতে থাকে না। পায়ের কাছে দরজাটাও স্টিলের পাত দিয়ে তৈরি। এখন রয়েছে বন্ধ।

সাদা পোশাক পরা মেয়েটি এল বিদ্রোহীর শয্যার পাশে–কী বলছেন?

কটা বাজে এখন?

বিকেল সাড়ে চারটে। নার্সের চোখে পেশাদারি হাসি–সেই হাসি ভেদ করে বিদ্রোহী দেখল–মনে মনে মেয়েটা কিন্তু হাসছে না–যেন সুদূরের পানে চেয়ে আছে।

বিদ্রোহীর সুদূর অতীতের দিকে কি?

সাড়ে চারটে? তার মানে অজ্ঞান ছিলাম আঠারো থেকে কুড়ি ঘণ্টা।

অজ্ঞান ছিলেন তিন সপ্তাহ। ব্রেন ফিভার হয়েছিল আপনার।

তিন সপ্তাহ!

ঝটিতে খাটে উঠে বসে বিদ্রোহী, আর দেরি নয়। যেতে হবে এখুনি।

আস্তে ঠেলে বিদ্রোহীকে শুইয়ে দেয় নার্স। বাধা দেওয়ার শক্তি নেই বিদ্রোহীর। বড় দুর্বল। শুয়ে পড়ে অসহায়ভাবে। মুখে কথা নেই। নীরবে চেয়ে আছে নার্সের দিকে।

বলে অবশেষে, ওভাবে চেয়ে আছেন কেন? কী দেখছেন? মাথার ভেতরটা অসাড় হয়ে থাকায় এর বেশি কথা বলতেও পারে না। এই অসাড়তার মধ্যে রয়েছে নিবিড় শান্তি-অস্থির উদ্দামতার লেশমাত্র নেই। এখানে আসবার আগে কী ঘটেছিল, তা মনে পড়ছে না। বাতাসে মিলিয়ে গেল নাকি শুকতারা? প্লেনের দরজা কি খুলেছিল?

নার্স বললে নরম গলায়, কেন তাকাচ্ছি? আপনি যে অনেক পালটে গেছেন, এখানে আসবার পর।

বলে, একটা আয়না ধরল বিদ্রোহীর মুখের সামনে।

ও দেখল নিজেকে। নিজের মুখকে। কিন্তু এ মুখ তো তার মুখ নয়।

তার চুল ছিল কয়লা কুচকুচে। আয়নায় যার মুখ দেখা যাচ্ছে তার চুল যে ধবধবে সাদা– তুষার শুভ্র। এ মুখের চামড়া সাদা কাপড়ের মতন–অথচ ওর ফরসা মুখ ছিল রোদ ঝলসানো। প্রাণশক্তিতে রাঙানো। এ মুখে কোনও ভাব-বিকাশ নেই–যেন একটা মোমের মুখোশ।

আর এই ভাবহীনতার মধ্যেই প্রচ্ছন্ন রয়েছে ভয়ানক কিছু। যাকে স্বাভাবিক বলা যায় না। মড়ার মুখ–জীবিত মানুষের মুখ এমন হয় না। এক্কেবারে অনড় মুখাবয়ব। দেখলে ভয় হয়। স্বাভাবিক মোটেই নয়। প্রাণময় প্রাণীর মুখ কি এমন হয়? না। স্পন্দনহীন সেই মুখ দেখলেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।

দম আটকে আসে বিদ্রোহীর। দলা পাকিয়ে ওঠে গলার কাছে। হাসবার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না।

ঠোঁট, ভুরু, মুখের সমস্ত মাংস একেবারে স্থির।

চেষ্টা করে কপাল কুঁচকানোর–ব্যর্থ হয়। পারে না ভেংচি কাটতেও।

কোমল কণ্ঠে বললে নার্স, মুখের পেশি প্যারালাইজড হয়ে গেছে। না, না, পারমানেন্ট প্যারালিসিস নাও হতে পারে। কণ্ঠস্বরেই প্রকাশ পায় সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা–চিরকাল এমন থাকবে না।

হল কী করে? বিদ্রোহীর কণ্ঠস্বর বিলক্ষণ আড়ষ্ট।

সঠিক বলা যাচ্ছে না। দুটো কারণ অনুমান করা হয়েছে।

কী কী?

প্লেনে আপনার মাথায় মেরেছিল কোপাইলট। ব্রেনে চোট লাগার দরুন হতে পারে।

আর?

নার্ভ শক–ডিলিউশনের জন্যে।

ডিলিউশন? আমার?

হ্যাঁ।

নিজের অনড় মুখের দিকে চেয়ে থাকে বিদ্রোহী। সাদা কাপড়ের মতন মুখ। কয়লা কালো চোখ দুটো শুধু ধকধক করছে তার মাঝে।

জানলার দিকে এগিয়ে যায় নার্স। বন্ধ করে পাল্লা।

আঙুল দিয়ে মুখে চাপ দেয় বিদ্রোহী। আঙুল ঠেকেছে গালে, অথচ তা টের পায় না। চামড়ায় নেই অনুভূতিবোধ।

ঘুরে দাঁড়িয়েছে নার্স। আর্ত চিৎকার করে ওঠে পরক্ষণেই।

চোখ তুলেছিল বিদ্রোহী। নার্সের আতঙ্ক আঁকা মুখচ্ছবি দেখেই ফের চোখ নামিয়েছিল দর্পণের ওপর।

শিউরে উঠেছিল নিজেই।

আঙুলের ডগা দিয়ে মুখের চামড়ায় চাপ দিয়েছিল বিদ্রোহী। যেখানে চাপ দিয়েছে, সেখানকার মাংস ঠেলে উঠে গেছে হনুর ওপর।

তরঙ্গায়িত মাংস বিকটাকার করে তুলেছে মুখণ্ডলকে। অবর্ণনীয় সেই আকৃতি কাপড়ের মতন ফ্যাকাশে চামড়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় প্রকৃতই লোমহর্ষক।

আঙুল দিয়ে টিপে টিপে মাংসর দলা নীচে নামিয়ে আনে বিদ্রোহী। তারপর হাতের চেটো দিয়ে তোলে আর নামায় দুই হনুর ওপরকার মাংস। তারপর আঙুল দিয়ে।

কাজ হচ্ছে আঙুলেই। চেটোর দরকার হচ্ছে না। যখন খুশি মুখের মাংস নড়িয়ে সরিয়ে দিয়ে মুখের চেহারা পালটে দিতে পারে বিদ্রোহী। মাংস যেখানে ঠেলে দিচ্ছে থেকে যাচ্ছে সেখানেই। ফিরে আসছে না আগের জায়গায়।

ঠিক এই সময়ে ঘরে ঢুকলেন স্টাফ ডক্টর।

বাঃ। জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন? কী রকম লাগছে?

বিদ্রোহীর মন এখন ওর শরীরের মতনই ছুটছে তুরঙ্গ গতিতে। মাত্র মিনিট কয়েক আগে জ্ঞান ফিরে পেয়েই জেনেছে ব্রেনের চোট কী কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছে মুখের ওপর।

একই সঙ্গে বুঝে নিয়েছে দুটো সার সত্য।

শক্তি সঞ্চয় করতে হবে খুব দ্রুত–এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে।

বেরনোর পথ প্রশস্ত করার জন্যে প্রকাশ করা চলবে না শুকতারা বিহনের অন্তর যন্ত্রণা ভান করে যেতে হবে যেন শুকতারা নেই–কোনওকালেই ছিল না তার অস্তিত্ব।

বললে সুস্পষ্ট গলায়, খুব ভালো লাগছে।

ফাইন। এবার বলুন আপনার স্ত্রীর কথা।

স্ত্রী? আমার? আমি তো ব্যাচেলর।

উজ্জ্বল হয় ডাক্তারের মুখ, ভেরি ফাইন। জানতাম আপনার বিভ্রম একদিন কাটবেই। এবার আপনাকে ডিসচার্জ করা যায়।

থ্যাংকিউ, ডক্টর। চোখে চোখ রেখে বলে গেল বিদ্রোহী–চোখের মধ্যে দিয়ে মনের কথাও পড়ে নিল। ডাক্তারের অভিপ্রায় ছিল মতিভ্রমের ভিত্তিতে মারদাঙ্গা রোগীদের ওয়ার্ডে তাকে চালান করা, যেখানে আছে, দেওয়ালে প্যাড লাগানো খুপরি ঘর–ঘরে ঘরে উন্মত্ত নৃত্য আর গজরানি।

অল্পের জন্য ভয়ানক এই পরিণতি এড়িয়ে গেল বিদ্রোহী।

শক্তি সঞ্চয় করে গেল পরের কয়েকটা দিন। ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাদ্য আর বিশ্রাম। দিনে দিনে বৃদ্ধি পেল শক্তির ভাণ্ডার। অবসর সময়ে শুধু ভাবল একজনের কথা। শুকতারার কথা।

গেল কোথায় মেয়েটা? প্লেন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ তো ছিল না। তা সত্ত্বেও অন্তর্ধান ঘটিয়েছে কতিপয় দুবৃত্ত।

কেন?

বারংবার এই একটি প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে মনের মধ্যে। মাঝে-মাঝে ভয় হয়েছে, ভাবতে ভাবতেই না পাগল হয়ে যায়।

কীভাবে?

অজান্তে এ কোন চক্রান্তজালে জড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহী তার সুন্দরী শুকতারাকে নিয়ে? নারকীয় কর্মকাণ্ডের মূলে নিশ্চয় আছে অতীব নিষ্ঠুর আর অতিশয় শক্তিশালী একটা গোষ্ঠী। বিদ্রোহী একাই নয়–হয়তো আরও অনেকে শিকার হয়েছে হৃদয়হীন এই দলটির।

স্যানিটারিয়াম থেকে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট পেয়ে গেল বিদ্রোহী। ঢুকেছিল একটা মানুষ বেরিয়ে গেল একটা মেশিন।

বরফ আর ধীরগতি আগুন দিয়ে গড়া একটা মেশিন।

এ মেশিনের পাওয়ারফুল ইঞ্জিন শুধু একটা গিয়ারেই বেঁধে রেখেছে নিজেকে…

যে গিয়ারের লক্ষ শুধু দুটি কাজ—

স্ত্রী উদ্ধার। এবং… ।

যে ফোর্স এইরকম ফ্যানট্যাসটিক পন্থায় তার জীবনে বিপর্যয় আবাহন করতে পারে সেই ফোর্সকে সমূলে ধ্বংস করা।

বিদ্রোহীকে দেখলেও এখন আর মানুষ বলে মনে হবে না। যেন স্টিল দিয়ে গড়া।

চুল তার তুষার শুভ্র, ক্রোমিয়ামের মতন। ভাবলেশহীন অতীব ভয়ঙ্কর মুখ ইস্পাতের মতন সাদা। এই মুখে গাঁথা কালো চোখ দুটো এমনই নিতল যে ক্ষণেক দৃষ্টিপাতেই মনে হবে যেন কুয়াশা আর বরফ দিয়ে ঠাসা এক তুহিনশীতল জগতের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। এমনকী পরনের স্যুটটাও বহন করছে এই অভিব্যক্তি–এ স্যুটের রং ইস্পাত-ধূসর।

পোর্টব্লেয়ার এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে বুকটা ধক করে উঠেছিল রানওয়ের ওপর অলস ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা মস্ত প্লেন দেখে। একই সঙ্গে সাদা মুখের পটভূমিকায় চোখের মশাল জ্বলে ওঠে ধিকিধিকি। বিদ্রোহী জানে, এ প্লেনের দিকে ফিরে তাকানো মানেই বুকের খাঁচায় মহা ভয়ঙ্কর সেই আঘাতটাকে ফিরিয়ে আনা। এটাও জানে, প্রতিহিংসার অনলে বৈরী শক্তিপুঞ্জকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে গেলে এই দুটোই তার দরকার।

ধকধকে চোখ দেখেই কিন্তু এক পা পেছিয়ে গেছে এজেন্ট। বলে আমতা-আমতা করে, ইয়েস স্যার, দমদমের প্লেনে খালি রয়েছে একটা সিট।

থ্যাংকিউ, ঠোঁট নড়ে না বিদ্রোহীর–শব্দটা বেরিয়ে এল অতল কূপ থেকে–যেখানে অনির্বাণ রয়েছে প্রতিহিংসার আগুন।

প্লেনে উঠে বসে বিদ্রোহী। তাকিয়ে থাকে অ্যাটেনড্যান্টরা। সেদিকে চোখ নেই ওর। ও এখন একা, একেবারে একা।

প্লেন ছুটে যায় রানওয়ের ওপর দিয়ে।

.

প্রথম সূত্র

জীবনে অনেক পেয়েছে বিদ্রোহী বর্মন। সব পাওয়াকে ছাড়িয়ে গেছে একা শুকতারা।

শেষ অভিযান চলেছিল অস্ট্রেলিয়ায়। তিরিশ লাখ উপার্জনের পর বউকে নিয়ে ঘুরেছিল অর্ধেক পৃথিবী। বামুড়া, হাওয়াই, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, আলাস্কা–এখানকার অনেক মানুষ আজও মনে রেখেছে এই দুজনকে। বিদ্রোহীর মতন শুকতারাও ছিল ভাইটাল এনার্জির সজীব বোমা। যেখানে গেছে, সেখানেই প্রাণশক্তির বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। শুকতারার সরু কোমর আর বড় চোখ, পাতলা ঠোঁট আর ঠেলে বেরিয়ে আসা চিবুক নারী পুরুষ সবার মনেই দাগ কেটে গেছে। ওর উছল হাসির মধ্যে ঝরনার সঙ্গীত কেউ ভুলবে না। যেন একটা চৌম্বক শক্তি দিয়ে আকর্ষণ করত সবাইকে এবং জয় করত মনের শক্তি দিয়ে।

মন। শুকতারার এই আশ্চর্য মনের ক্ষমতার হদিশ পায়নি বিদ্রোহী নিজেও। চোখে চোখ রেখে যেমন বিদ্রোহীর মনের কথা হুবহু বলে দিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে চোখে চোখ রেখে শুকতারার মনের কথার প্রতিধ্বনিও বিদ্রোহীর মাথার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে। কীভাবে এটা হয়, তা বুঝতে পারেনি বিদ্রোহী। শুকতারাও বোঝাতে পারেনি। জিগ্যেস করলে শুধু হেসেছে। খুব চেপে ধরলে বলেছে, জানি না কেন এমন হয়। মাঝে-মাঝে মনে হয়, আমার ব্রেনের রেডিও তোমার ব্রেনের রেডিওর সঙ্গে এক টিউনিং-এ বাঁধা।

রেডিও? অবাক হয়েছে বিদ্রোহী।

তাছাড়া আর কী বলব বলো? তুমি আর আমি একই বৃন্তে দুটি ফুল। একই যন্ত্র দুটো খাঁচায় ঠাসা। আমি শুকতারা তুমি বিদ্রোহী;

শুনেছি মাথায় চোট পেলে অদ্ভুত ক্ষমতা অনেকের মধ্যে এসে যায়। পিটার হারকোস ছিলেন রঙের মিস্ত্রি। দোতলার ভাড়া থেকে পড়ে যান। মাথায় চোট লাগার পর অর্জন করেছিলেন ই এস পি।

সেটা কী?

এক্সট্রা সেনসরি পারসেপশন। অতীন্দ্রিয় অতি-অনুভূতি বোধ। শুকতারা, তোমার মাথায় কি কখনও চোট লেগেছিল?

সে তো তুমি দিয়েছিলে।

আমি!

সেই যে গো, কোলে তুলে নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লুফে নিচ্ছিলে-খটাং করে মাথা লাগল সিলিং-এ।

ধ্যেৎ। তার আগে থেকেই তোমার মনের এই শক্তি দেখে আসছি। বিশেষ করে চাঁদনি রাতে তোমার এই ক্ষমতা যেন বেড়ে যায়। পূর্ণিমার চাঁদ যখন গোল রূপোর থালার মতন–

পূর্ণিমা সবাইকেই অল্পবিস্তর পাগল করে দেয়। আমি তো হবই।

না, শুকতারা, না–পূর্ণিমায় তুমি ভয়ানক পাওয়ারফুল।

হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে-দেখতে এইসব কথাই ভাবছিল বিদ্রোহী।

একা। আশপাশের ঝুলবারান্দায় জনপ্রাণী নেই। আর ঠিক এই সময়ে…

শুকতারা কথা কয়ে উঠল ওর মাথার মধ্যে।

শুনছ? বলি ও আর্যপুত্র, শুকতারা সুন্দরীর কথা কি শুনতে পাচ্ছ?

থ হয়ে যায় বিদ্রোহী।

পাগল হয়ে গেল নাকি?

পরক্ষণেই চোখ ঘুরে যায় চাঁদের দিকে।

আজ পূর্ণিমা।

আজই তো মনের শক্তির তুঙ্গে যেত তার চাঁদবদনি ধনি–সুন্দরী শুকতারা।

শুকতারা কি তবে বেঁচে আছে?

শুকতারা কি তার মনের কথা ধরতে পারছে?

আকুলভাবে মনের সব শক্তি জড়ো করে মনে-মনে আউড়ে যায় বিদ্রোহী, শুকতারা। শুকতারা। তুমি কোথায়?

জবাব তো এল না। একই কথা আবার ধ্বনিত হয়ে চলেছে মাথার মধ্যে, বলি ও আর্যপুত্র, তোমার শুকতারা যে বড় একা, বড় একা, কথা শুনতে পাচ্ছ?

দুহাতে মাথা চেপে বারান্দাতেই বসে পড়ে বিদ্রোহী। রগের শিরা ফুলে উঠেছে দড়ির মতন। পুঞ্জীভূত শক্তি দিয়ে বৃথাই মনে মনে বলে যাচ্ছে, শুকতারা। শুকতারা। কোথায় তুমি? তুমি কি জীবিত না মৃত? তুমি ইহলোকে না পরলোকে? এ কার কথা শুনছি? প্রেতিনী শুকতারার না দেহিনী শুকতারার?

জবাব নেই। একই কথা ঘুরে-ঘুরে আছড়ে পড়ছে বিদ্রোহীর মাথার কন্দরে, শুনছ? শুনতে পাচ্ছ? কথা বলছ না কেন?

ফ্ল্যাস খেলে যায় বিদ্রোহীর মগজে।

মাথায় চোট। কোপাইলট তার মাথায় মারার পর মুখের পেশির ওপর কন্ট্রোল হারিয়েছে বিদ্রোহী।

অঘটন ঘটেছে আর এক ক্ষেত্রেও।

শুকতারার কথাই যদি ঠিক হয় তাহলে বিদ্রোহীর ব্রেনের রেডিওটা বিকল হয়ে গেছে– অথবা, টিউনিং নষ্ট হয়ে গেছে।

নয়তো…

যা একেবারেই অবিশ্বাস্য তাই ঘটছে।

শুকতারা এখন বিদেহিনী।

না। আর সময় নষ্ট করা সমীচীন নয়।

এই মুহূর্তে পুলিশের কাছে যাওয়াও অসমীচীন। পুলিশ তার কথার একটা অক্ষরও বিশ্বাস করবে না।

এমন একজনের কাছে যেতে হবে যাকে পুলিশ মানে, জানে, চেনে।

কিন্তু সেরকম মানুষকে তো চেনে না বিদ্রোহী। ভবঘুরে জীবন যাপন করেছে বউকে নিয়ে মাসের পর মাস। বড়লোক ভ্যাগাবন্ড ছাড়া সে কিছুই নয় এই শহরের কলকাতায়। উঠেছে দামি হোটেলে শুধু পয়সার জোরে। তখন শুকতারা ছিল সঙ্গে।

এখনও উঠেছে সেই হোটেলে–এখন শুকতারা নেই সঙ্গে।

ম্যানেজারকে জিগ্যেস করবে?

ভুল হবে। ভয়ানক ভুল। যে শক্তিচক্রের সঙ্গে মোকাবিলা করতে নেমেছে তার চরচক্র কি হোটেলেও নেই? শুকতারাকে নিয়ে সে তো এই হোটেল থেকেই রওনা হয়েছিল দমদম এয়ারপোর্ট অভিমুখে। এই ম্যানেজারই ট্যাক্সি বুথ থেকে ডাকিয়ে এনেছিল ট্যাক্সি।

তাহলে উপায়?

বুদ্ধিটা মাথায় এসে যায় হঠাৎ।

ইয়োলো পেজ। সব বড় শহরেই চালু হয়ে গেছে এই সিসটেম। বিজনেস ডাইরেক্টরি। অনেক শহরে থাকে টেলিফোন গাইডের সঙ্গে।

ঘরে ফিরে আসে বিদ্রোহী। টেলিফোনের পাশেই রয়েছে পুরোনো টেলিফোন গাইড। তুলে নিয়ে পাতা ওলটাতেই চোখে পড়ে ইয়োলো পেজ সেকশান।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ হেডিং-এর নীচে চোখ বুলিয়ে যায়। মড়ার মুখে এখন জ্বলছে কালো অঙ্গার। চোখ আটকে যায় সবচেয়ে বড় নামটায় যার শাখা অফিস ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরে।

প্রেমচাঁদ প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি। নামটা আগেও শুনেছে বিদ্রোহী। ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকার সময়ে।

.

অলস নয়নে মুখর টেলিফোনটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ। তারপর তুলে নিল রিসিভার, ইন্দ্রনাথ রুদ্র বলছি।

আমি বিদ্রোহী বর্মন বলছি।

চিনতে পারলাম না।

স্বাভাবিক, আমি এই শহরের লোক নই। তবে প্রেমচাঁদ মালহোত্র আমাকে চেনে।

প্রেমচাঁদ প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি? বারণ করেছিলাম আমার ফোন নাম্বার যেন…

কাউকে না দেয়। আমাকে তা বলেও ছেন মিঃ মালহোত্র। তবে সিডনিতে আমি ওর একটা উপকার করেছিলাম। খুব ছোট্ট উপকার। ওঁর প্রাণটাকে একটিমাত্র বুলেটের খপ্পর থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম। তারই প্রতিদানে–।

মনে হচ্ছে আপনি অত্যন্ত ডেয়ারডেভিল?

এবং রাগলে চণ্ডাল।

এই মুহূর্তে রেগেছেন?

হ্যাঁ।

কার ওপর?

যারা আমার বউকে ফ্লাইং প্লেন থেকে হাওয়া করে দিয়েছে।

কৌতূহল জাগিয়েছেন কিন্তু।

নিরসন করা টেলিফোনে সম্ভব নয়। আমার পক্ষেও আপনার কাছে যাওয়া সঙ্গত নয়।

অতএব আমিও আসছি। প্রেমচাঁদ কখনও ছ্যাচড়া কেস আমাকে দেয় না।

আসুন। কিন্তু হোটেলে কেউ যেন জানতে না পারে আপনি এসেছেন আমার কাছে।

আই সি। আর ইউ আন্ডার অবজারভেশন?

আই থিঙ্ক সো।

ডোন্ট ওরি। আই নো মেনি টেকনিকস্।

দুজনে এখন মুখোমুখি বসে। ইন্দ্রনাথ রুদ্র আর বিদ্রোহী বর্মন।

ইন্দ্রনাথ বললে, আপনার প্রাণ যে-কোনও মুহূর্তে যেতে পারে, সেইসঙ্গে আমার।

বিদ্রোহী–ভয় দেখিয়েছে মনে হচ্ছে?

ইন্দ্রনাথ–আপনার টেলিফোন রাখবার সঙ্গে-সঙ্গে। ছোট্ট উপদেশ–আমি যেন নাকে তেল দিয়ে ঘুমোই। নইলে খতম কহানি শুরু হয়ে যাবে।

বিদ্রোহীর মড়ার মতন মুখে কোনও ভাববিকৃতি দেখা গেল না–শুধু প্রদীপ্ত হল চোখের অঙ্গার। বলে গেল ইন্দ্রনাথ, ঘরে আলো জ্বলছে, স্টার টিভি চলছে, চলবে। আমারও সিক্রেট প্যাসেজ আছে, আপনাকে বলা যাবে না।

গুড, এখানে ঢুকলেন কীভাবে?

খোলাখুলি।

মানে?

সবার নাকের ডগা দিয়ে, বলে আর কথা না বলে এক টুকরো কাগজ বিদ্রোহীর চোখের সামনে মেলে ধরল। তাতে লেখা আছে?

এদেরকে ধরতে হলে অথবা এই রহস্যের মীমাংসা সূত্র বের করতে হলে সম্মুখযুদ্ধ অনিবার্য। কোনও কথা না। এ ঘরে লুকোনো মাইক্রোফোন আর চোরা টিভি ক্যামেরা থাকতে পারে। এখুনি উঠুন। আমার সঙ্গে বেরোন। ট্যাক্সি ধরব। তারপর দেখি কী হয়।

পড়া সাঙ্গ করে ইন্দ্রনাথের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিল বিদ্রোহী। অপূর্ব সুন্দর মানুষ। যেন টুসকি দিলে রক্ত ফেটে পড়বে গালে। মর্মর মূর্তি সহসা সজীব হয়ে গেলে বুঝি চোখমুখ চিবুকের গড়ন এমন নিখুঁত হয়। সবচেয়ে সুন্দর দুটি চোখ। ভাবালু। স্বপ্নিল। কবি অথবা দার্শনিক বলা সঙ্গ ত। মানুষটার পরনেও মুগার পাঞ্জাবি আর চুনোট করা ধুতি। গা ঘিরে ভুরভুর করছে দক্ষিণ ফ্রান্সের ল্যাভেন্ডারের খোশবাই।

এমন মানুষটা মানুষ-খুনেদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চায়? দ্বিধা জাগে বিদ্রোহী বর্মনের চোখেমুখে।

নীচে নেমে আসে দুই মূর্তি। সটান ঢুকে পড়ে ম্যানেজারের চেম্বারে। সে ভদ্রলোক আকার আয়তনে ক্ষুদ্র জলহস্তী বিশেষ। পরনে ব্লু সাফারি স্যুট। কেশবিরল মাথাটা প্রকাণ্ড। মুণ্ডটাও বিরাট। নিষ্প্রভ চক্ষুযুগল জানিয়ে দিচ্ছে, বিপুল কলেবরের এই জীবনটির যকৃৎ সুস্থ নয়। অতিরিক্ত মদিরা

সেবন নিশ্চয় হেতু, তাই দু-চোখের নীচে দুটো থলি ঝুলছে। চিবুকের নীচেও তিনথাক মাংস গরুর গলকম্বলের মতন ঝুলছে। দুই চিবুকের দুই কোণে যেন দুটি গলগণ্ড ফুলে রয়েছে। মিশকালো মানুষটা পান খাওয়া দাঁত দেখিয়ে কাষ্ঠ হেসে বললে, বলুন স্যার?

বিদ্রোহী বললে, আমার স্ত্রী কোথায়?

মড়া গাছের মতন চোখ বড় করে ম্যানেজার বললে, আপনি তো একা এলেন স্যার।

গতবার আমার সঙ্গে ছিল। মনে পড়ছে?

অফকোর্স..রিয়াল বিউটি।

তিনি কোথায়?

আপনি তো সঙ্গে নিয়ে দমদম এয়ারপোর্টে চলে গেলেন।

তারপর?

চলে গেলেন পোর্টব্লেয়ার–না, না, উনি যাননি।

আমার স্ত্রী যায়নি? মুখোশ মুখে অঙ্গার চক্ষু জ্বালিয়ে বললে বিদ্রোহী।

চিঠি পড়ে তাই তো জেনেছি।

চিঠি। কার চিঠি?

বেল টিপল ক্ষুদ্র জলহস্তী। ক্লার্ক ঢুকল ঘরে, এঁকে চেনো? মিস্টার বর্মন। গতবার এখান থেকে এয়ারপোর্ট গেছিলেন উইথ ওয়াইফ। তারপর একটা চিঠি আসেমিসেস বর্মনের। মনে আছে? কী লেখা ছিল চিঠিতে? উনি পোর্টব্লেয়ার যাচ্ছেন না। দিল্লির এডিকং হোটেলে যাচ্ছেন, এখানে চিঠিপত্র এলে যেন রিডাইরেক্ট করে দেওয়া হয়। ঠিক বলেছি? যাও।

বিদ্রোহীর দিকে তাকিয়ে শেষ করল ম্যানেজার, গেস্টদের খবরাখবর রাখতে হয় স্যার।

আই সি। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ইন্দ্রনাথের দিকে তাকায় বিদ্রোহী। ভেতরে পাওয়ারফুল ইঞ্জিনটা চালু হয়ে গেছে। ক্ষুদ্র জলহস্তীর মুণ্ডুটা মুচড়ে ছিঁড়ে আনতে ইচ্ছে করছে।

স্মিত মুখে বললে ইন্দ্রনাথ, ট্যাক্সি বুথ থেকে ট্যাক্সি ডাকিয়ে এনেছিলেন আপনি?

খুবই সংযত স্বর ইন্দ্রনাথের। অথচ যেন পেতলের ঘণ্টা বাজছে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে। হুঁশিয়ার হয়ে যায় জলহস্তী। ম্যানেজার–ও ইয়েস।

কত নম্বর ট্যাক্সি, সে রেকর্ডও নিশ্চয় আছে। ভি আই পি গেস্টদের সিকিউরিটির ভার তো আপনার হাতে। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ডাকান।

.

তোমার ট্যাক্সিতেই ইনি গেছিলেন এয়ারপোর্টঃ সঙ্গে ছিলেন ম্যাডাম?

আগে গেছিলেন এয়ারলাইন্সের সিটি অফিসে। নিরক্ত মুখে বলে গেল শুটকে ট্যাক্সি ড্রাইভার। বিদ্রোহীর মুখ আর চোখ দেখে তার হৃৎপিণ্ড চঞ্চল হয়েছে। তাই জোর করে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ইন্দ্রনাথের দিকে।

ইন্দ্রনাথের চোখে জ্বলছে নরম আলো–বিখ্যাত সেই প্রদীপ শিখা–যা শ্রোতার মনের কন্দরে আস্থা জাগিয়ে তোলে মনকে নির্ভয় করে তোলে।

বললে, সিটি অফিস থেকে?

দমদম এয়ারপোর্ট।

দুজনে?

আজ্ঞে না।

তা হলে?

উনি তো একা গেলেন। বিদ্রোহীকে তর্জনী সঙ্কেতে দেখায় ট্যাক্সি ড্রইভার ম্যাডাম যাননি।

বিদ্রোহীর সাঁড়াশি আঙুল নিশপিশিয়ে উঠেছে লক্ষ করেই তার কাঁধে হাত রেখে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে মন্ত্রমন্থর কণ্ঠে বললে ইন্দ্রনাথ, ঠিক আছে। আসতে পারো।

.

লোকটাকে ছেড়ে দিলেন আপনি–আমি কিন্তু মার্ক করে রাখলাম। ইস্পাত গলায় বললে বিদ্রোহী বর্মন ছুটন্ত ট্যাক্সির মধ্যে।

ট্যাক্সি উড়ে যাচ্ছে দমদম এয়ারপোর্টের দিকে।

ইন্দ্রনাথ নীরব। স্বপ্নিল চাহনিতে সুদূরের প্ল্যান।

অ্যাকশন শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই।

দু-জনের কেউই খেয়াল করেনি সবুজ ফিয়াটটাকে। আসছে ট্যাক্সির পেছন পেছন–অনেক দূরে থেকে ফলো করে চলেছে। ফিয়াটের মধ্যে তিন জোড়া চোখ নিবদ্ধ সামনের ধাবমান ট্যাক্সির দিকে।

দমদম এয়ারপোর্ট।

অভিজাত আকৃতির ধুতি পাঞ্জাবি পরা অতীব সুদর্শন বাঙালিবাবুকে এগিয়ে আসতে দেখে টলেনি এজেন্ট। কিন্তু মুখের পেশি কেঁপে উঠল নাতিদীর্ঘ মানুষটাকে ঠিক পাশেই যন্ত্রদানবের মতন হেঁটে আসতে দেখে। ধাতু দিয়ে গড়া নাকি? মুখভাব অতীব ভয়াল। গনগনে চোখে চেয়ে আছে। এজেন্টের দিকে।

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে শুনে গেল বাঙালিবাবুর প্রথম প্রশ্ন, চেয়ে রইল কিন্তু জাগুয়ার আকৃতির মানুষটার দিকে। দুলছে ডাইনে-বাঁয়ে। লাফিয়ে পড়ার আগের মুভমেন্ট।

বিদ্রোহীকে দেখিয়েই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিল ইন্দ্রনাথ, এঁকে চিনতে পারছেন?

ঢোঁক গিলে বললে এজেন্ট, ইয়েস স্যার।

একমাস আগে এসেছিলেন এখানে। সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী। যাচ্ছিলেন পোর্টব্লেয়ার। প্লেনে সিট চেয়েছিলেন দুটো।

ম্যালেরিয়া রুগির জ্বর প্রকল্প শুরু হয়ে গেছে এজেন্টের সারা শরীরে। অতি কষ্টে অকম্পিত রাখল কণ্ঠস্বর, উনি তো একা এসেছিলেন।

স্ত্রী ছিলেন না সঙ্গে?

না। পোর্টব্লেয়ার থেকে ওয়ারলেসে জানতে চেয়েছিলেন একই কথা, যা তখন বলেছি, এখনও তাই বলছি।

একাই এসেছিলেন?

সাদা হয়ে গেল এজেন্টের মুখ। গলার স্বর এবার কাঁপছে, আজ্ঞে হ্যাঁ।

পলকহীন চোখে শুধু চেয়ে রইল বিদ্রোহী। ভয়ানক একটা চক্রান্তের গন্ধ আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। এজেন্টের চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। শুধু বিদ্রোহী নয়, শুকতারাকেও সে দেখেছে। অথচ ভীষণ ভয়ে তা স্বীকার করতে সাহস পাচ্ছে না। এই ভয় গ্রাস করেছিল ট্যাক্সি ড্রাইভারকেও। সত্যি স্বীকার করতে পারেনি।

এরা দুজনেই জানে খলনায়কদের।

কিন্তু ইন্দ্রনাথ কথা বলতে দিচ্ছে না বিদ্রোহীকে। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল এয়ারফিল্ডে। নিরক্ত মুখে ওদের দিকে চেয়ে রইল এজেন্ট।

সবুজ ফিয়াট থেকে তিন ষণ্ডামার্কা ওদের পেছন নিয়ে ঢুকেছিল ভেতরে। ওরা এগিয়ে যেতেই এজেন্টের খুপরিতে গিয়ে ঢুকল তিনজনে।

শোচনীয় হয়ে ওঠে এজেন্টের মুখচ্ছবি।

তিন মূর্তির একজন বললে, মুখ খুললে কী ঘটবে মনে আছে?

গলা ভেঙে গেল এজেন্টের–আ-আমি তো মুখ খুলিনি। সাফ বলে দিয়েছি একা এসেছিলেন, কেউ ছিল না সঙ্গে।

দ্বিতীয় ব্যক্তির রিভলভারের চোঙাটা চেপে বসে এজেন্টের তলপেটে, কাকে ভয় বেশি? একে না ওই দু-জনকে?

শিউরে উঠে বললে এজেন্ট, ধুতি পাঞ্জাবিকে তো ভয় পাইনি, পাশের লোকটার মুখটা ওরকম কেন? রাইফেলের চাইতেও ভয়ঙ্কর।

.

সবচেয়ে কাছের হ্যাঁঙারে পৌঁছে গেছে ইন্দ্রনাথ আর বিদ্রোহী। ওদের এগিয়ে আসতে দেখেছে একদল পুরুষ। কৌতূহলী চোখে চেয়ে আছে বিদ্রোহীর মরা মুখের পানে–অস্বস্তি বোধ করছে মশাল চক্ষু দেখে।

প্রশ্নবাণ নিক্ষিপ্ত হল, বিদ্রোহীর অনড় অধরোষ্ঠের ফাঁক দিয়ে। অধর নড়ছে না, ওষ্ঠ নড়ছে না–শব্দগুলো শুধু বেরিয়ে আসছে মুখবিবর থেকে।

ভয়াবহ সেই মুখচ্ছবি দেখে কম্পিত কলেবর প্রত্যেকেই।

শুধোয় বিদ্রোহী, ঠিক একমাস আগের ঘটনা। প্লেনে উঠেছিলাম পোর্টব্লেয়ার যাব বলে। সঙ্গে ছিল আমার স্ত্রী। কেউ কি মনে করতে পারছেন?

ধীরে-ধীরে মাথা নাড়ে প্রত্যেকেই। মনে করতে অক্ষম প্রত্যেকেই।

যেন কুয়াশার সঙ্গে লড়ছে বিদ্রোহী। আঘাতে-আঘাতে পর্যদস্ত করেও টলানো যাচ্ছে না কাউকে। এক্ষেত্রে এরা অবশ্য অসত্য বলছে বলে মনে হচ্ছে না। অশুভ সেইদিনে এদের কাউকে দেখেনি বিদ্রোহী।

হ্যাঙার ছেড়ে সরে আসে ইন্দ্রনাথ। টেনে নিয়ে আসে পরাজিত বিদ্রোহীকে। লম্বকর্ণ এক পুরুষকে দেখেই ইন্দ্রনাথ কৌতূহলী হয়েছে। লোকটা দূরে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। অন্যদিকে পাশ ফিরে থাকলেও তার নজর যে ওদের দুজনের দিকেই, তা চোখের কোণ দিয়ে বুঝেছে ইন্দ্রনাথ।

লোকটার কান দুটো অদ্ভুত লম্বা। নৌকোর পালের মতন যেন পতপত করে উড়ছে দুপাশে। বেজায় পুরু গদান। ষাঁড়ের গানের সঙ্গে তুলনীয়। ইন্দ্রনাথ যে চোখের কোণ দিয়ে তাকে লক্ষ করছে, সে নিজেও যেন তা বুঝেছে। হঠাৎ তাই পায়ে-পায়ে সরে গেল তফাতে।

ইঙ্গিতটা সুস্পষ্ট। যেন পেছন ধরতে বলছে।

বিদ্রোহী এতক্ষণে তাকে নজরে এনেছে। স্মৃতির বিদ্যুৎ ঝলসে দিয়ে গেল মনের গগনকে। লোকটাকে চেনে সে। দেখেছে এই এয়ারফিল্ডেই।

লম্বকর্ণ হাঁটছিল ধীরপদে। ওরা দুজন হনহনিয়ে নাগাল ধরে ফেলতেই ঘাড় না ফিরিয়ে, সামনে চোখ রেখে, সে বললে, পেছনে আসছেন কেন জানি। কিন্তু এখানে কোনও প্রশ্ন নয়। হ্যাঁঙার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি এই কারণেই। এখানে ধুলোরও কান আছে। কোন হোটেলে উঠেছেন?

ঠোঁটের কোণ দিয়ে কথাগুলো বলে গেল লম্বকর্ণ–পা না থামিয়ে।

দূরত্ব বজায় রেখে রুদ্ধশ্বাসে বললে বিদ্রোহী, তোমাকে…

পেটে অনেক কথা জমা আছে। বলতে চাই। এখান থেকে বেরোলেই।

হোটেল রেডরোজ। ডাইনিং রুম। চাপা গলায় বলে গেল বিদ্রোহী। যে হোটেলে উঠেছে এটা সে হোটেল নয়। ইন্দ্রনাথ ওকে হাত ধরে টানছে বাইরের দিকে। উত্তেজনায় দুজনের কেউই লক্ষ করল না তিন মূর্তিকে।

অনুসরণ করছে বেশ তফাতে থেকে। তিনজনের একজন বগলের নীচে ঝোলানো রিভলভারে হাত দিয়েছিল। অপর দুজন অলস নয়নে বিমান ক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ঘাড় নাড়ল নীরবে। গুলি বর্ষণের জায়গা এটা নয়।

.

ট্যাক্সি ছুটছে হোটেলের দিকে। জানলা দিয়ে উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে ইন্দ্রনাথ। বিদ্রোহীর ধমনীতে উত্তাল হয়েছে রুধির। এই বোধহয় শেষ সুযোগ। লম্বকর্ণের আচরণে প্রতিভাত হয়েছে। সততা। শুকতারার সন্ধান সে জানে।

ট্যাক্সির ডানপাশ দিয়ে বেগে বেরিয়ে গেল একটা সবুজ ফিয়াট। ব্রেক টিপে ধরেছে ট্যাক্সি ড্রাইভার। ঘূণ্যৰ্মান চাকার আচমকা গতিরোধের আর্তনাদ সচকিত করেছে ইন্দ্রনাথকে।

দেখল, ট্যাক্সি এসে পড়েছে জনবিরল রাস্তায়। দুপাশে ঝোঁপ আর জঙ্গল। দূরে-দূরে ফ্যাক্টরির শেড।

গ্রীন ফিয়াট ড্যাশ করেছে সামনে দিয়ে ট্যাক্সিকে এনে ফেলেছে রাস্তার পাশে। রিফ্লেক্স অ্যাকশন চনমনে করে তুলেছে বিদ্রোহীকে। হাত চলে গেছে লুকোনো রিভলভারের সন্ধানে।

কিন্তু রিভলভার নেই সেখানে। পোর্টব্লেয়ার স্যানিটারিয়ামে বের করে নেওয়া হয়েছে। ইন্দ্রনাথ নিজেও নিরস্ত্র।

তাই শুধু বললে চাপা গর্জনে, মারো ধাক্কা।

আসন্ন সংঘাত বিমূঢ় করে তুলেছিল ট্যাক্সি ড্রাইভারকে। তাই বোধহয় শুনতে পায়নি ইন্দ্রনাথের আদেশ। আরও মন্থরগতি হয় ট্যাক্সি।

পাঞ্জাবি পরা নবনীত কোমল মানুষটার ডান হাত ধেয়ে যায়, ইস্পাত কঠিন আঙুল দিয়ে খামচে ধরে ড্রাইভারের কণ্ঠদেশ। ঝটকান দিয়ে মুণ্ডু সুদ্ধ ঘাড় বেঁকিয়ে আনে পেছন দিকে।

ব্রেক থেকে পা পিছলে যায় ড্রাইভারের। লাফিয়ে উঠে ট্যাক্সি ধেয়ে যায় সামনে।

গ্রিন ফিয়াটের তিন আরোহীর হাতে উঠে এসেছে রিভলভার। দুই গাড়ির মধ্যে ব্যবধান দ্রুত কমছে দেখেই ট্যাক্সি ড্রাইভার স্টিয়ারিং কাটিয়েছে–ডাইনে সংঘাত এড়ানোর শেষ চেষ্টা। রুখে দেওয়ার চেষ্টায় ঘুরেছে গ্রিন ফিয়াটও। কঁকুনিতে লক্ষ ঠিক রাখতে পারল না দুই বন্দুকবাজ। শূন্যে ঠিকরে গেল দুটো বুলেট।

সবুজ ফিয়াটের ওপর আছড়ে পড়ল ট্যাক্সি।

কলিশনের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ট্যাক্সির দুদিকের দরজা খুলে ছিটকে গেছিল ইন্দ্রনাথ আর বিদ্রোহী। লাফিয়ে এগিয়ে গেছিল সবুজ ফিয়াটের দিকে। প্রথমজনের চোখ এখন হীরক-উজ্জ্বল। দ্বিতীয় জনের চোখ তুহিন শীতল–প্রতিহিংসা স্পৃহায় নির্মম। শুকতারা অন্তর্ধানের সূত্র এখন প্রায় হাতের মুঠোর মধ্যে। ঠোঁটের কোণে ভাসছে বরফকঠিন হাসি।

ধাক্কা খেয়ে ট্যাক্সি থেকে দূরে ছিটকে গিয়ে সবুজ ফিয়াট ডানদিকের দুই চাকার ওপর প্রায় উলটে যাচ্ছিল। মুহূর্তের মধ্যে সিধে হয়ে গেল চার চাকার ওপর। ভেতরের প্রাণী তিনজন ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার আগেই গাড়ির দুপাশে আবির্ভূত হল ইন্দ্রনাথ আর বিদ্রোহী।

প্ৰথমজন যেন ননী দিয়ে গড়া দ্বিতীয় জনের উচ্চতা মোটে পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। কিন্তু নিরীহদর্শন এই দুটি কলেবরের মধ্যে যে এত শক্তি লুকিয়ে আছে, তা কি জানত ফিয়াটের আরোহী তিনজন?

জানত কি পরিমাণে স্বল্প হলেও কিছু কিছু পেশিতে সঞ্চিত থাকে রুদ্রশক্তি? বিজ্ঞান তার ব্যাখ্যা জোগাতে অক্ষম। পেশির এই প্রচ্ছন্ন ভয়াল শক্তি অবিশ্বাস্য প্রলয় ঘটিয়ে দিতে পারে সময় এলেই।

এখনও তাই ঘটল। মাত্র দশ সেকেন্ডের মধ্যে।

বাঁ-হাতে সবুজ ফিয়াটের দরজা খুলে ধরে রেখে ডানহাতটাকে বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে দিল বিদ্রোহী। মাত্র দশ ইঞ্চি দূরে ছিল একজনের চোয়াল। বর্শার ডগায় লাগানো যেন লোহার বল আছড়ে পড়ল সেখানে। গুলিবিদ্ধ মানুষের মতনই লোকটা ঠিকরে গেল পাশের সঙ্গীর ওপর।

ড্রাইভার ততক্ষণে রিভলভার তাগ করেছে বিদ্রোহীর দিকে। কিন্তু খেয়াল করেনি খুলে গেছে পাশের দরজা। কবজি খামচে ধরেছে ইন্দ্রনাথ। শুধু খামচে ধরেছে। আর একটু মোচড় মেরেছে। কাতরে উঠেও ট্রিগার টিপেছিল ড্রাইভার। কিন্তু গুলি বেরিয়ে গেল ফিয়াটের ছাদ ফুটো করে। একহাতেই আরও মোচড় দিচ্ছে ইন্দ্রনাথ। বিকট চেঁচিয়ে উঠে সিটে লুটিয়ে পড়েছে ড্রাইভার।

পেছনের সিটে সঙ্গীর দেহভার কাটিয়ে সবে ধাতস্থ হয়েছে তৃতীয় মূর্তি। গুলিবর্ষণ অসম্ভব বুঝেই কাত হয়ে থেকেও লাথি ছুঁড়েছিল বিদ্রোহীর দিকে।

ভুল করেছিল সেইখানেই।

খপ করে ডান হাতে তার পায়ের ডিম চেপে ধরল বিদ্রোহী। তারপর মোচড় আর মোচড়। আতীব্র যন্ত্রণা উঠে গেল স্নায়ুকেন্দ্রে। রক্ত জল করা চিৎকার শুনেও মোচড়ানি অব্যাহত রাখল বিদ্রোহী, যতক্ষণ না জ্ঞান লোপ পায়।

দশ সেকেন্ডের মধ্যে সব স্তদ্ধ। পাংশুমুখে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ট্যাক্সি ড্রাইভার। ভয়ার্ত চোখে তাকাচ্ছে ইন্দ্রনাথ আর বিদ্রোহীর দিকে। দুজনেরই শ্বাসপ্রশ্বাসে ছন্দপতন ঘটেনি।

স্বাভাবিক গলায় বললে প্রথম জন, চলো থানায়।

.

লকআপে তিনজনকে ঢুকিয়ে দিয়ে রেডরোজ হোটেলের ডাইনিং রুমে এল ইন্দ্রনাথ, বিদ্রোহীকে নিয়ে। টেলিফোন এল প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে।

তিন আততায়ীকেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে থানা থেকে, খুবই উঁচু মহলের নির্দেশে–সে মহলের নাম বলা যাবে না।

এই তিনজনকেও যে আর সশরীরে দেখা যাবে না তাও নিমেষে বুঝল ইন্দ্রনাথ। লম্বকর্ণ উৎকর্ণ হয়ে বসেছিল কোণের টেবিলে।

.

নয়া স্যাঙাৎ

নাম তার চম্পক সাহা। ছফুট ঢ্যাঙা। মাথায় চাপ-চাপ চুল। নিগ্রোদের চুলের মতন ঘন আর কোঁচকানো। চোখ দুটো ঈষৎ খয়েরি। দু-হাতের মুঠো মুগুরের সঙ্গে তুলনীয়। পায়ের পাতা বিরাট, চার্লি চ্যাপলিন বেঁচে থাকলে অবাক হতেন। এমনকী তার হাঁটার ঢঙও চার্লির মতন। এটা অবশ্য বিমানক্ষেত্রেই লক্ষ করেছিল ইন্দ্রনাথ আর বিদ্রোহী।

টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। বিদ্রোহীর মুখ শিহরণ জাগায় সব মানুষেরই চোখে। গত কদিন ধরে তা লক্ষ করে আসছে বিদ্রোহী। কিন্তু এই লোকটা শিহরতি হয়নি। বিলক্ষণ নির্বিকার, ভয় বস্তুটা যেন তার ধাতে নেই। ব্রণ কলঙ্কিত মুখ আর রেখাজটিল ললাট অবিকৃত, খয়েরি চোখ পাথরের চোখ বলে মনে হচ্ছে। দুর্জয়, মানুষ, নিঃসন্দেহে।

শুষ্ক কণ্ঠে বললে বিদ্রোহী, স্ত্রীকে নিয়ে প্লেনে উঠতে আমাকে দেখেছিলে?

দেখেছিলাম।

ইন্দ্রনাথ চেয়েছিল চম্পক সাহার ডানহাতের আঙুলের গাঁটের দিকে। চামড়া উঠে গেছে সেখান থেকে। কপালেও কালসিটের দাগ।

সদ্য মারপিটের চিহ্ন মনে হচ্ছে? প্রশ্নটা ইন্দ্রনাথের।

আজ্ঞে হ্যাঁ। এয়ারপোর্টে আপনাদের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তখন তা লক্ষ করা হয়েছিল। বেরোতেই দুজন ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুজনকেই ফেলে এসেছি রাস্তায়।

ধক করে ওঠে বিদ্রোহীর চোখ। কিন্তু মজা নাচছে ইন্দ্রনাথের চোখে। বললে, টাকার হরির লুঠ চলছে দেখছি। টাকা দিয়ে বলানো হচ্ছে, প্লেনে ওঠেনি বিদ্রোহীর স্ত্রী।

ঠিক, কঠোর কণ্ঠে বললে চম্পক।

রাস্তায় শুইয়ে না দিয়ে দুজনকে পুলিশের হাতে দিলে না কেন?

পুলিশের সঙ্গে খেলা শেষ করে এসেছি বলে।

জেল খেটেছিলে?

না। কিন্তু পুলিশের চরিত্র জেনে গেছি।

কীভাবে?

এয়ারপোর্টে আমি লেবারার, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু এক সময় চাঁদনিচকে ছিল আমার ওষুধের দোকান। ঘরে ছিল বউ আর দুই ছেলে। ভালোই ছিলাম। একদিন ওরা এল। মাসে চারশো টাকা চাইল। ওদের দলের মেম্বারশিপ ফী। নইলে বোমা মেরে দোকান উড়িয়ে দেবে। আমি তাদের মেরে তাড়ালাম।

চোখ জ্বলছে চম্পকের। খয়েরি মশাল। কথা আটকে গেছে।

নরম গলায় ইন্দ্রনাথ বললে, তারপর?

দোকানের পিছনেই থাকতাম বউ বেটা নিয়ে। ভোর ছটায় বোমা ফাটল। দোকান উড়ে গেল। বউ আর বেটা দুটো কড়িকাঠ চাপা পড়ল। সেই থেকে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। খেটে খাই। মস্তান দেখলেই ঠ্যাঙাই। পুলিশের হাতে দিয়ে কী করব?

বিদ্রোহী নির্বাক। এতদিনে পেয়েছে মনের মতন দোসর। পুলিশের কাছে যেতে চায় না চম্পক, চায় না বিদ্রোহী।

অনড় রইল অধর আর ওষ্ঠ, কথাগুলো বেরিয়ে এল দাঁতের ফাঁক দিয়ে, মনে হয় আমরা তোমার কাজে লাগব। তুমিও আমাদের কাজে লাগবে। রাজি?

হ্যাঁ।

ইন্দ্রনাথ বললে, তাহলে বলো, ম্যাডাম উধাও হল কেন? কার পাকা ধানে মই দিয়েছিল। আমার এই বন্ধুটি? কী সেই চক্রান্ত? জোর করে প্লেনে উঠেছিল স্বামী-স্ত্রী। স্ত্রীকে লোপাট করা হল কেন? এত লোককে টাকা খাইয়ে মিথ্যে বলাচ্ছে কারা? এয়ারপোর্টে কাদের লোক অ্যাটাক করেছিল তোমাকে? এখানে আসবার সময় তিনজন অ্যাটাক করেছিল আমাদেরও। এরাই বা কাদের লোক?

নি*গ্রো চুলে আঙুল চালনা করে চম্পক বললে, জানলে বলতাম।

কিছুই জানো না?

অন্য ব্যাপার জানি। গত তিনটে সপ্তাহে একটাই দল বিশেষ ওই প্লেনটায় চেপে পোর্টব্লেয়ার গেছে। প্রতিবার প্লেনের সব সিট বুক করেছে, কিন্তু দুটো-তিনটে সিট খালি রেখেছে। ট্রাঙ্ক নিয়ে সচরাচর কেউ প্লেনে ওঠে না, কিন্তু এই দলটার কাছে থাকে একটা ট্রাঙ্ক।

এতক্ষণ কথা হচ্ছিল বসে। চম্পকের কথা শেষ হতেই শুধু উঠে দাঁড়াল বিদ্রোহী। পেশি ফুলে উঠেছে বাঘের পেশির মতন। হাত নাড়াতেই কিলবিল করে উঠল কাঁধের দলা পাকানো মাসল। সাদা মড়ার মুখে দুটো গর্তে জ্বলছে কালো আগুন।

ট্রাঙ্ক। টেল কম্পার্টমেন্টে আমিও দেখেছি। শুকতারাকে সেই ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে পোর্টব্লেয়ার নিয়ে যায়নি তো?

বলেই বসে পড়ল আস্তে-আস্তে। ডালা খুলে উলটানো ছিল–সুতরাং বউকে তার মধ্যে পুরে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা টিকছে না।

আদৌ বেঁচে আছে কি শুকতারা?

গলার স্বর বুজে আসে কথা বলতে গিয়ে, হয়তো মেরেই ফেলেছে। তাই যদি হয় এদের কারও রক্ষে নেই।

তিনজনের পক্ষে তা কি সম্ভব? খয়েরি চোখ শক্ত করে বলে গেল চম্পক, ওদের দল ভারী, অনেক টাকা, অনেক উঁচু মহল হাতের মুঠোয়।

দেখা যাক।

লড়বেন কীসের জোরে?

টাকার জোরে। অভাব নেই আমার। সঙ্গে আছেন ইনি ইন্দ্রনাথকে দেখিয়ে বলে, আর তুমি। পারব না?

আরও জোর দরকার।

চম্পক, মড়ার মুখোশের মতন অচঞ্চল মুখে প্রত্যেকটা শব্দের মধ্যে বুঝি বোমা ফাটিয়ে গেল বিদ্রোহী, আমি টাকা রোজগার করেছি ইন্ডিয়ার বাইরে। এমন সব জায়গা যেখানে সভ্যদেশের কানুন খাটে না। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষেছি দিনেরাতে সমানে। যাদের সঙ্গে টক্কর দিয়েছি তাদের কাছে বড় বড় শহরের বড় বড় মস্তানরা নিতান্তই শিশু। বরফের দেশ মেরু অঞ্চলে খনি আবিষ্কার করেছি, ব্রেজিল থেকে পান্না নিয়ে এসেছি, মালয়ের জঙ্গল থেকে জাহাজ ভরতি জানোয়ার এনে চড়া দামে ক্লিভল্যান্ড চিড়িয়াখানায় বেচেছি, তেইশ দিন ধরে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর নৌ-বিদ্রোহ ঠেকিয়েছি। বেশি কথার মানুষ আমি নই। কাজে দেখাই আমি কী করতে পারি। এই এঁর মতন। ইন্দ্রনাথকে দেখিয়ে–একে দেখে যেমন বোঝা যায় না দরকার হলে উনি চিতাবাঘ হতে পারেন, আমার পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি হাইট দেখেও তোমার ছফুট বডি ধারণাও করতে পারবে না কী রয়েছে। আমার মধ্যে।

নীরব হল বিদ্রোহী। সামান্য হাঁফাচ্ছে। উত্তেজনায়।

শান্ত স্বরে ইন্দ্রনাথ বললে, কাজের কথা হোক।

বাধা দিয়ে বললে বিদ্রোহী, আরও একটা মোক্ষম অস্ত্র হাতে এসেছে আমার। ব্রেনে চোট মেরেছিল এরা। মুখের মাসল কন্ট্রোলের নার্ভ আর কাজ করছে না। দেখুন।

বলতে-বলতে টেবিলের ওপর থেকে তুললে ছোট্ট আয়না। স্ট্যান্ডের ওপর রেখে ঘুরিয়ে দিল নিজের দিকে। আঙুল দিয়ে টিপে ঠোঁটের দুপাশ ঝুলিয়ে দিল নীচের দিকে। চোখের তলদেশ তুলে দিল ওপর দিকে। নরুনচেরা চোখে সে এখন চাইনিজ ম্যান।

থ হয়ে চেয়ে রইল চম্পক।

তোফা। বললে ইন্দ্রনাথ, এমনটা কখনও দেখিনি।

আঙুল চালিয়ে মুখের আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনল বিদ্রোহী। বললে ইন্দ্রনাথকে, এবার শুরু করতে পারেন কাজের কথা।

ইন্দ্রনাথ বললে, চম্পক, এই যে প্লেনটা থেকে বিদ্রোহীর বউ উবে গেল, এই প্লেন সম্বন্ধে বিশেষ কোনও খবর তোমার জানা আছে? ফ্লাইংপ্লেনে কোথাও কোনও চোরা দরজা আছে কি? যে দরজা খুলে মিসেস বর্মনকে ঠেলে ফেলে দেওয়া যায় বাইরে?

সশব্দে নিশ্বাস নিয়ে চুপ করে রইল বিদ্রোহী। সম্ভাবনাটা তার মাথায় আসেনি। ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। যদি চোরা দরজা থাকে, শুকতারা তাহলে বেঁচে নেই।

সোজা সামনের দিকে সেকেন্ড কয়েক চেয়ে থেকে যেন দম নিল চম্পক সাহা। বলে গেল থেমে থেমে, এই প্লেনের মালিক হচ্ছে বে অফ বেঙ্গল এয়ারলাইন্স। এদের সব প্লেনই সেকেন্ড হ্যান্ড। এই প্লেনটাকে কিনেছিল ইউনাইটেড স্টেটস কোস্ট সারভিস থেকে। ম্যাপ তৈরির কাজে লাগত প্লেনটা। বে অফ বেঙ্গল এয়ারলাইন্স এই প্লেনেই গত বছর ফুড ড্রপ করেছিল বন্যার সময়। গভর্নমেন্ট ভাড়া নিয়েছিল।

সিধে হয়ে বসল ইন্দ্রনাথ। ম্যাপ আঁকার প্লেন ফুড ড্রপ করা হয়েছে। তাহলে তো মেঝেতে চোরা দরজা আছে।

সূত্র নম্বর ওয়ান, বিড়বিড় করে বলে গেল বিদ্রোহী, তদন্ত হল শুরু। তার আগে আমার দুটো জিনিস দরকার। ওয়াইল্ড কান্ট্রিতে কাজে লেগেছিল, কুবের হওয়ার পর আর অ্যাডভেঞ্চারের দরকার হবে না বলে রাখিনি। ইন্দ্রনাথ রুদ্র, জোগাড় করে দেবেন জিনিস দুটো?

কী জিনিস? বললে ইন্দ্রনাথ।

নাম বলে গেল বিদ্রোহী।

.

ট্যাপডোর প্লেন

চম্পক ভার নিল চোরা দরজা দেখে আসার। এয়ারফিল্ডে তার যাতায়াত কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না।

কিন্তু কর্মস্থলে পা দিয়েই শুনল, তার চাকরি নেই।

কথা বাড়াল চম্পক। যাদের ঠেঙিয়েছে, তাদের লোক তাকেও এয়ারফিল্ডে ঢুকতে দিতে চায় না। সেটা যখন বোঝাই গেল, তখন এবার ঘুরপথে কাজ শুরু করা যাক।

চম্পক সাহা জানে, কীভাবে চেহারা পালটাতে হয়।

দমদম এয়ারপোর্টের এজেন্ট দুই চোখে বিপুল কৌতূহল জাগিয়ে চেয়ে রইল আগন্তুকের দিকে, লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছে, এমনি একটা আবছা ধারণা মনের মধ্যে জাগছে বটে, কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না। সে কে হতে পারে।

আগন্তুক কমসেকম ছফুট লম্বা। কঁধ দুটো ভয়ানক চওড়া। কলেবরও বিপুল। পরনে স্যুট, মাথায় চওড়া কিনারা টুপি, চোখে হালকা নীল কাঁচের চশমা। দেখে তো মনে হচ্ছে ফরেন ট্যুরিস্ট, হিপিটিপিও হতে পারে।

লম্বা-লম্বা পা ফেলে লোকটা যখন সামনে দিয়ে হেঁটে গেল তখনই চক্ষু বিস্ফারিত হয়েছে। এজেন্টের।

এতবড় পায়ের পাতা আছে শুধু একজনের হাঁটার ধরনও সিনেমার চার্লি চ্যাপলিনের মতন।

আস্তে-আস্তে খুপরি ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছে, এমন সময় মুগার পাঞ্জাবি আর চুনোট করা ধুতি পরা সেই ফুলবাবুটি এসে দাঁড়াল সামনে। মুখে ভাসছে দ্যাখন হাসি। বললে মধুক্ষরা গলায়, আরে বসুন, বসুন। আপনার সঙ্গে কথা আছে।

কী কথা? তাড়াতাড়ি বলুন।

বলছি, বলছি। একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দেয় ফুলবাবুটি, যেখানকার যা দস্তুর… বুঝলেন কিনা…পান খাওয়ার জন্য রাখুন…পোর্টব্লেয়ার যেতে চাই…গোটা একটা প্লেন নিয়ে…কীরকম প্লেন জানেন?…যার মেঝেতে ট্র্যাপোর আছে।

ট্রাপডোর?

আরে ওই হল গিয়ে…চোরা দরজা…চোরা দরজা..বুঝলেন কিনা? আন্দামানে একটা দ্বীপে আগ্নেয়গিরি আছে না? ওখানকার ছবি তুলব আকাশ থেকে…আজ্ঞে…আমি প্রোডিউসারও বটে, ডিরেক্টরও বটে…ডকুমেন্টারি তুলছি..ইন্ডিয়ার ওই তো সবেধন নীলমণি একটাই আগ্নেয়গিরি…খাসা হবে ডকুমেন্টারিটা।

এরকম প্লেন, এরকম প্লেন, দ্বিধায় পড়ে এজেন্ট, আছে বলে তো আমার জানা নেই।

নেই? তাহলে আর জ্বালাব না..না-না, ও নোটটা আপনার…আমার তো নয়…আচ্ছা আসি।

তালঢ্যাঙা বৃষস্কন্ধ লোকটা চার্লি চ্যাপলিনের মতন হেঁটে বেরিয়ে গেল সামনে দিয়ে। ফুলবাবু মিটিমিটি হেসে গেল পেছন পেছন।

দেখেশুনে একটু ভাবল এজেন্ট। চাইল হাতের নোটখানার দিকে। বসে পড়ল আস্তে আস্তে। ক্ষেত্র বিশেষে মুখে চাবি দিয়ে থাকাই সঙ্গত।

.

বাইরে দাঁড়ানো ট্যাক্সিতে একদিক দিয়ে উঠল বৃষস্কন্ধ, আর একদিক দিয়ে ফুলবাবু। প্রথম জন মাথার হ্যাট খুলতেই বেরিয়ে পড়ল বিটকেল দুটো কান আর চাপ-চাপ নিগ্রো চুল। কাঁধের স্প্রিং-এ চাপ দিতেই সোঁ-সোঁ করে হাওয়া বেরিয়ে গেল যেন বেলুন থেকে। চুপসে ছোট্ট হয়ে গেল কঁধ। মেকি কঁধ। হাওয়া দিয়ে ফোলানো থাকে। চশমা খুলতেই বেরিয়ে এল খয়েরি চোখ।

শক্ত মুখে বললে ফুলবাবুকে, ভাগ্যিস এজেন্টকে আটকে রেখেছিলেন, নইলে হ্যাঁঙারেই ঢুকতে পারতাম না।

ফুলবাবু, মানে ইন্দ্রনাথ রুদ্র বললে, ঢুকেছিলে? ট্র্যাপোের দেখে এলে?

আছে। কার্পেট ঢাকা। এককোণ ধরে টানলেই উঠে আসে। তবে ওরা প্লেনের নাম্বার পালটেছে। ছিল S-402 এখন হয়েছে S-404।

ট্যাক্সি ড্রাইভার এতক্ষণ ছিল বাইরে, এগিয়ে আসছে ট্যাক্সির দিকে। তাড়াতাড়ি বললে ইন্দ্রনাথ, তোমাকে ঢুকতে দেখেছে হ্যাঁঙারে?

দুজন আটকাতে এসেছিল–শুইয়ে এসেছি।

কেষ্টপুরের প্রায় গ্রাম্য অঞ্চলের একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ট্যাক্সি। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে সোজা ছাদে উঠে গেল দুজনে। সেখানে ডেক চেয়ারে বসে বিদ্রোহী বর্মন চেয়ে আছে চাঁদের দিকে। আবিষ্ট চাহনি।

ইন্দ্রনাথ বললে, মেসেজ আসছে শুকতারার কাছ থেকে?

আস্তে বললে বিদ্রোহী, মাঝে-মাঝে–তেমন জোরাল নয়…ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক..শুধু জিগ্যেস করে যাচ্ছে…আমার জবাব শুনতে পাচ্ছে না..বেঁচে আছে…নিশ্চয় বেঁচে আছে…

বিদ্রোহী, নরম কিন্তু দৃঢ় স্বরে বললে ইন্দ্রনাথ, এবার কাজের কথা হোক।

চোখ নামিয়ে বিদ্রোহী বললে, হোক।

প্লেনে ট্র্যাপডোর আছে।

গুড।

আমরা যখন নতুন তৈরি এই বাড়িতে পালিয়ে লুকিয়ে আছি, আমাদের খোঁজ ওরা পাবে না। কিন্তু ওদের খোঁজ আমি নেবই, কাল সকালে।

নিন। কিন্তু শুকতারাকে ওরা ট্র্যাপডোর দিয়ে ফেলে দিল কেন?

শুকতারা কিছু দেখে ফেলেছিল বলে।

কী দেখেছিল?

অনুমান করে বলতে পারি।

বলুন।

অতবড় ট্রাঙ্কে মানুষের বডি পুরে নিয়ে যাওয়া যায়। সেই রকমই কারও বডি নিয়ে গিয়ে যখন ফেলা হচ্ছে, শুকতারা তা দেখে ফেলেছিল, ট্র্যাপোর ছিল ওর পেছনে, কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়েছিল নিশ্চয়।

বটে।

শুকতারাকেও তখন ট্র্যাপডোর দিয়ে বেরিয়ে যেতে হয়, নিশ্চয় প্যারাসুট দিয়েছিল, নইলে বেঁচে থাকবে কেন, নিশ্চয় নীচে বঙ্গোপসাগরের জল থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়েছিল, কিন্তু কেন? সুন্দরী বলে?

কয়লাচক্ষু জ্বলে উঠল বিদ্রোহীর। পরক্ষণেই দু-রগ টিপে মাথা কেঁকাল সামনে। এখন সে নিঝুম।

ইন্দ্রনাথ আর চম্পক দাঁড়িয়ে দুপাশে। শুধু চেয়ে আছে।

আস্তে আস্তে রগ থেকে হাত নামাল বিদ্রোহী। বললে, মেসেজ আসছে। একতরফা, কিন্তু আপনার প্রশ্নের জবাব এর মধ্যে রয়েছে।

নির্নিমেষে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।

বলে গেল বিদ্রোহী, মুক্তিপণ চাইছে…শুকতারা বলেছিল, আমি সুন্দরী। কিন্তু আমার ধর্ম নষ্ট করো না…করলে তোমরা কেউ পার পাবে না…বরং মুক্তিপণ চাও…আমার স্বামীর অনেক টাকা… একথা হয়েছিল প্লেনে…তাই আমাকে জলে ফেলে দেয়নি…নানাভাবে কবজায় আনবার চেষ্টা করছে।

শুকতারা কোথায় আছে, তা কি বলছে?

না, শুধু কাঁদছে। বলছে, যেখানেই থাকো, ওদের টাকা দাও, ছাড়িয়ে নিয়ে যাও দ্বীপ থেকে। দ্বীপ?

আন্দামান নিকোবরের অসংখ্য দ্বীপেই ওদের ঘাঁটি। সে হদিশ আমি বের করে নেব। তার আগে জানতে চাই, ট্রাঙ্কে করে পাচার করছে কাদের?

কালকেই জানবেন।

হ্যাঁ। এ শহর থেকে গত তিন সপ্তাহে অন্তত তিনজন নামী-দামি লোক নিরুদ্দেশ হয়েছে, তাদের নামধাম জানা কি খুব কঠিন?

ডাঙাতেই অনেক জায়গা আছে, পাঁকের তলায় বডি পুঁতে দিলেই তো হত। এত খরচ করে, প্লেন ভাড়া করে সমুদ্রে ফেলছে কেন?

জ্যান্ত কয়েদ করে রাখবে বলে।

প্যারাসুট দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে? যেমন দিয়েছে শুকতারাকে?

নিশ্চয়। জিল থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে মোটরবোট?

আমারও তাই বিশ্বাস।

পোর্টব্লেয়ারে নেমে ট্রাঙ্ক পাচার করছে না কেন?

ছোট জায়গা। অনেকেরই চোখে পড়তে পারে। তার চেয়ে বড় কারণ যেখানে সমুদ্রে ফেলছে, সেখান থেকে দ্বীপের ঘাঁটি নিশ্চয় খুব কাছে। পোর্টব্লেয়ার থেকে দূরে। অসংখ্য দ্বীপ ও অঞ্চলে। সব দ্বীপে সভ্য মানুষ আজও নামতে চায় না। কে আসছে?

চাঁদনি রাতে দূরের গাছপালার ঝাপসা অন্ধকার থেকে ভটভট করে বেরিয়ে এল একটা থ্রি পয়েন্ট ফাইভ বুলেট মোটর সাইকেল। সরু মেঠোপথটা সাদা ফিতের মতন ঝকমক করছে। লাল মোটর বাইকের নিকেল করা বনেটও ঝকঝক করছে। চালকের মাথার রূপোলি স্পেস হেলমেটও ঝকঝক করছে।

প্রেমচাঁদ মালহোত্র আসছে। ইন্দ্রনাথের হিরে চোখ ঝকমকিয়ে উঠল চাঁদের আলোয়।

ঠিক এই সময় শুকতারা গুনগুন করে উঠল বিদ্রোহীর ব্রেনের মধ্যে–আন্দামান…আন্দামান…শুধু এইটুকু শুনলাম…দ্বীপের নামটা বলতে চাইছে না। ওরা তোমাকে জ্যান্ত ধরতে চায়…গুলি করে মেরে ফেলার নাটক করে গেছে…সত্যিই তোমাকে গুলি করতে চায় না…কিন্তু তুমি কথা বলছ না কেন? বিদ্রোহী..ও বিদ্রোহী…আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছ না?…বৃথাই কি বকে যাচ্ছি আমি?

.

ইনসুলিন রহস্য

পাঞ্জাব-তনয় প্রেমৰ্চাদের পেল্লায় সিলভার হেলমেট এখন ছাদের ওপর পাতা সতরঞ্চিতে ঝকমক করছে। চারজনে বসে মুখোমুখি। প্রেমাদের মাথা উঠে রয়েছে সবার ওপরে। কতখানি ঢ্যাঙা, তা বোঝা যাচ্ছে।

বিরাগ মুখে ইন্দ্রনাথ বললে, প্রেম, তোর এখানে আসা উচিত হয়নি।

ইন্দ্র, বললে প্রেমচাঁদ, খবর আছে। টেলিফোন নেই বলে চলে এলাম।

কী খবর?

শেয়ার মার্কেট নিয়ে কি কাণ্ড চলছে গোটা ইন্ডিয়ার, তা তুই জানিস?

জানবার চেষ্টা করি না। তবুও চোখে পড়ে, কাগজে।

গত তিন সপ্তাহে তিনজন শেয়ার জায়ান্ট নিখোঁজ হয়েছে।

মাই গড! সোজা হয়ে গেল ইন্দ্রনাথের মেরুদণ্ড, এইরকমই একটা খবর বের করার জন্য কাল সকালেই যাচ্ছিলাম তোর কাছে।

তাহলেই দ্যাখ, প্রাইভেট ডিটেকটিভদের চেয়ে প্রফেশন্যাল ডিটেকটিভরা কত ফাস্ট ইন অ্যাকশন।

সেটা জানা আছে বলেই তোকে এ লাইনে এনেছি। লেগওয়ার্ক করা প্রাইভেট ব্রেনে সম্ভব নয়, তারা করবে ব্রেনওয়ার্ক।

বিদ্রোহী নীরস গলায় বললে, ঝগড়া পরে হবে। মিঃ মালহোত্র, খবরটা পেলেন কী করে?

বিলবার আগে আপনার জিনিস দুটো নিন, ইন্দ্রনাথ অর্ডার দিয়েছিল আপনার ফরমাস মাফিক। ঠিক আছে?

সতরঞ্চির ওপর দুটো চামড়ার খাপ রাখল প্রেমচাঁদ। লম্বাটে খাপ। কুচকুচে কালো চামড়া দিয়ে তৈরি।

দুটো খাপেরই একদিকে সূচ্যগ্র, আর একদিক খোলা। খোলা দিকে বেরিয়ে রয়েছে একটা করে আংটা।

প্রেমচাঁদের চোখে চোখ রেখে বিদ্রোহী বললে, জোগাড় করলেন কোত্থেকে?

মুচকি হেসে প্রেমচাঁদ বললে, ওটা আমার ট্রেড সিক্রেট। তবে আপনাকে বলতে বাধা নেই। তার আগে একটা প্রশ্ন, এ দুটোর ব্যবহার শিখেছিলেন কোথায়?

টোকিওতে। আমার গুরুর নাম মিৎসুবিসি।

আমিও তাই আঁচ করেছিলাম। এই শহরেই আছেন জাপানিজ সিক্রেট এজেন্ট। দুটো জিনিসই পেয়েছি তার কাছ থেকে।

দাম?

নেয়নি। তিনিও যে মিৎসুবিসির শিষ্য। তাই একটা অনুরোধ করেছেন। এ জিনিস যেন যত্রতত্র ব্যবহার করা না হয়। আর যদি নিতান্তই প্রয়োজন হয় তাকে তলব করলে তিনি আপনার পাশে এসে দাঁড়াবেন।

নাম কী তার?

প্রেমচাঁদ তক্ষুনি কোনও জবাব দিল না। দূরে চাঁদের আলোয় ধোওয়া গাছপালার দিকে তাকিয়ে রইল। অর্থব্যঞ্জক চাহনি।

চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললে, তাঁকে দেখতে চান?

মুখে দু-আঙুল পুরে শিস দিয়েছিল প্রেমচাঁদ। কোকিলের কুহু কুহু রব ভেসে গেছিল গাছপালার ওপর দিয়ে নাচতে নাচতে দূরে বহুদূরে। সেই আওয়াজ মিলোতে-না-মিলোতেই কুহু কুহু রব জেগেছিল জঙ্গলের মধ্যে। তারপরেই দেখা গেল তাঁকে।

খর্বকায় শ্বেতবসন এক মূর্তি এগিয়ে আসছে সরু ফিতের মতন পথের ওপর দিয়ে।

নাম তার কাকোই। বয়স চল্লিশ। কিন্তু তিরিশের বেশি মনে হয় না। কদমছাট চুল নিতান্তই শ্রীহীন। হলদে পার্চমেন্টের মতন মুখের চামড়া। ছোট-ছোট দু-চোখ, কিন্তু কৌতুকময়। হাসিতেও কৌতুক। এ জগৎটা যেন বড়ই রঙ্গময় তার কাছে।

তিনি ছাদে উঠে এসে সতরঞ্চির ওপর পাতলেন একটা কাঠের পাটাতন। যা দিয়ে বাড়ি তৈরি চলছে। আর একটা পাটাতন খাড়া করে রাখলেন চিলেকোঠার গায়ে। খাপ থেকে আংটায় টান দিয়ে বের করলেন দুটি জিনিস, দুটোতেই চাঁদের আলো লেগে ঠিকরে গেল।

প্রথমটি একটি ছোরা। দ্বিতীয়টি একটি রিভলভার।

দুটোই অতিশয় অদ্ভুত ধরনের।

এ ছোরার বাঁট নেই। পুরোটাই ফলা। মাঝে মোটা, দু প্রান্তে সরু। দুদিকেই ধার। একপ্রান্তে ছোট্ট একটা আংটা এক বর্গ ইঞ্চি ধাতুর ফলকে আটকানো। হাতল বলা চলে এই ফলকটাকেই। খুব জোর দু-আঙুলে ধরা যায়।

বিদ্রোহী তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে ধরল ছোরার ছুঁচোলো দিকটা। ঝোলাল শূন্য সতরঞ্চিতে পাতা কাঠের তক্তার তিনফুট উঁচুতে। আংটা লাগানো ধাতুর ফলকটা রইল নীচের দিকে। বললে, এখন ছোরা ছেড়ে দিলে কী হওয়া উচিত। আংটার দিকটা একটু ভারী বলে ওই দিকটাই তক্তায় পড়বে তাই তো? দেখুন কী হয়।

তর্জনী আর বুড়ো আঙুল শিথিল করতেই খসে পড়ল আজব ছোরা। কিন্তু ওই তিন ফুটের মধ্যেই পরিষ্কার একটা ডিগবাজি খেয়ে ছুঁচোলো দিকটা নামিয়ে আনল নিচে, ঘাত করে গেঁথে গেল কাঠের তক্তায়।

শুকনো গলায় বিদ্রোহী বললে, আবিষ্কারটা গুরু মিৎসুবিসির। ছোরার সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি এমন জায়গায় রাখা হয়েছে যে ছুঁচোলো দিকটা শূন্যে ঘুরে গিয়ে সবসময় থাকবে সামনের দিকে। দেখুন।

ফলকের দিকটা দু-আঙুলে ধরে কাঠ থেকে টেনে তুলে নিয়েই দূরের চিলেকোঠার খাড়া করা কাঠের তক্তার দিকে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিল বিদ্রোহী। চাঁদের আলোয় ঝিলিক তুলে ছোরা ধেয়ে গেল সামনে, ছুঁচোলো দিকটা গেঁথে গেল তক্তায়। যদিও মরা আলোয় তক্তা দেখা যাচ্ছিল না ভালোভাবে।

নীরবে দ্বিতীয় বস্তুটা তুলে নিল বিদ্রোহী। লম্বাটে চোঙা বললেই চলে। মাঝখানটা স্ফীত। এইখানে আঙুল রেখে বিদ্রোহী বললে, চারটে বুলেট আছে এখানে। সামনে রয়েছে সাইলেন্সার। হাতল বেঁকিয়ে রাখার দরকার হয় না। কারণ, এটা বাঁধা থাকে এখানে। বলে ডান পায়ের প্যান্টের তলা গুটিয়ে নিয়ে পায়ের ডিমের ঠিক তলার খাঁজে চামড়ার খাপটা সেঁটে দিল স্ট্র্যাপ টেনে। চোঙা রিভলভার গুঁজে রাখল তার মধ্যে। বললে, হাতলের পেছনের এই বোতামে বাঁ-পায়ের চাপ দিলে গুলি ছুটে যাবে নিঃশব্দে। দুহাত ব্যবহারের দরকার হবে না। বলতে-বলতে উঠে গিয়ে তক্তা থেকে ছোরা টেনে নিয়ে ফিরে এর সতরঞ্চির ওপর। খাপে ঢুকিয়ে বেঁধে নিল বাঁ-পায়ের ডিমের খাঁজে। বললে অবিচলিত কণ্ঠে, মিঃ মালহোত্র, গত তিন সপ্তাহে তিনজন শেয়ার জায়ান্ট নিখোঁজ হয়েছে বলছিলেন। খবরটা পেলেন কী করে, সে প্রশ্নের উত্তরটা এখনও দেননি। এখন দেবেন?

প্রেমচাঁদ তাকাল কাকোই-এর দিকে। কাকোই বলে গেল পরিষ্কার কথ্য বাংলায়।

ইন্ডো-নিপ্পন কোম্পানির শেয়ার চড়া দামেই বিকিকিনি হচ্ছিল খোলা বাজারে। তা সত্ত্বেও খবর এল আমার কাছে, খুব গোপনে শেয়ার কেনা হচ্ছে কোম্পানি অফিসেই।

এ কোম্পানির তিন ডিরেক্টরের মধ্যে একজন জাপানের এক শিল্পপতি হিতোহিশো। বাকি দুজনের একজন সুজন দেশাই। তৃতীয় জন রাম ঘোষ।

হিতোহিশোর ইন্টারেস্ট দেখার জন্য আমাকে অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছে জাপান থেকে। কারণ, এ কোম্পানির ক্যাশ রিজার্ভে আছে এক হাজার কোটি টাকা।

অবাক হচ্ছেন? হবেন না, জাপান যখন কোনও দেশে টাকা লগ্নী করতে চায়, সেই দেশে বাণিজ্যের ফসল ফলাতে চায়, তখন টাকা ঢালে আর জমায় এইভাবে।

ক্যাশ রিজার্ভের কথা অ্যানুয়াল রিপোর্টে খুব কায়দা করে সংক্ষেপে লেখা আছে। এমনিতেই এ কোম্পানির সুনাম যথেষ্ট। বাজারে শেয়ার পড়তে পায় না। অথচ গোপনে কোম্পানির অফিসেই শেয়ার কিনে নেওয়া হচ্ছে শুনে আমার টনক নড়েছিল।

আমি লোক পাঠিয়েছিলাম। অফিস ক্লার্ক জানিয়েছিল, কোম্পানি উঠে যাওয়ার আপাতত কোনও সম্ভাবনা নেই। তবে অঘটন ঘটে যেতে পারে, এরকম একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাই কোম্পানি গুটিয়ে নিচ্ছে কাকপক্ষীকে না জানিয়ে, যেন পাবলিকের ক্ষতি না হয়।

ঠিক এর পরেই পরপর তিনজন ডিরেক্টরই নিরুদ্দেশ হয়েছেন। প্রথম জন রাম ঘোষ। পরের সপ্তাহে সুজন দেশাই টেলিফোন করেন হিতাহিশোকে। বাড়িতে আসতে বলেন। খুব জরুরি কথা আছে। আর ফিরে আসেননি। মিসেস হিতোহিশো আমাকে খবর দেন। আমি যাই সুজন দেশাইয়ের জোকার ভিলায়। গিয়ে দেখি বাড়ি খাঁ-খাঁ করছে। জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড। উনি একা থাকতেন ভিলায়। ফ্যামিলি থাকে বম্বেতে। এ বাড়ির সব দেখাশুনা করে যে লোকটা, তাকে অর্ধমৃত অবস্থায় দেখতে পাই গ্যারেজে। গাড়ির মধ্যে হাত-পা বাঁধা অবস্থায়।

তার কাছেই শুনলাম, হিতেহিশো যাননি ও বাড়িতে। চারজন ষণ্ডা প্রকৃতি লোক সুজন দেশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে তার আগের দিন। চৌকাঠ পেরিয়েই প্রথমেই গৃহরক্ষীকে নাকে ক্লোরোফর্ম ভিজানো রুমাল চেপে ধরে অজ্ঞান করতে যায়। বাগে আনতে না পেরে চলে মারপিট। তারপর আর কিছু মনে নেই তার।

সুজন দেশাই বাড়িতে নেই শুনে হতভম্ব হয়ে যায় সে।

বুঝলাম, কিডন্যাপ করা হয়েছে তাকে।

চলে আসার আগে গোটা বাড়ি সার্চ করেছিলাম। বাইরের ঘরে একটা কাগজ পেলাম। এই ঘরেই তুমুল হাতাহাতি হয়েছিল চার গুন্ডার সঙ্গে ভিলা রক্ষকের।

কাগজে লেখা ছিল শুধু দুটি শব্দ–SEND INSULIN।

.

বন্দির জন্য দরদ?

চাঁদের দিকে তাকিয়ে কাকোই-এর কথা শুনছিল বিদ্রোহী। শেষ শব্দ দুটো শোনবার সঙ্গে-সঙ্গে দুহাতে রগ টিপে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল চাঁদের দিকেই। ওর ওই কালো শক্ত চোখে এরকম বিমূঢ় চাহনি এর আগে দেখেনি ইন্দ্রনাথ। ইশারায় চম্পক, কাকোই আর প্রেমচাঁদকে মুখ বন্ধ রাখতে বলে চেয়ে রইল বিদ্রোহীর চোখের দিকে।

যেন দম আটকে বসে রইল বিদ্রোহী। মিনিট কয়েক, তারপর পাঁজর খালি করা নিশ্বাস ফেলে চাইল ইন্দ্রনাথের দিকে। ফিরে আসছে চোখের স্বাভাবিক চাহনি।

মৃদুকণ্ঠে বললে ইন্দ্রনাথ, শুকতারার মেসেজ?

হ্যাঁ। ততোধিক মৃদু কণ্ঠে জবাব দিল বিদ্রোহী।

কী বলছে?

কথা কও, কথা কও। হে বিদ্রোহী, কথা নেই কেন তোমার কণ্ঠেঃ তুমি কি বোবা? তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না? তোমার কাছে মুক্তিপণের দাবি নিয়ে কেউ কি যায়নি? বিশ লক্ষ টাকা দিতে তুমি পেছপা নও আমি জানি। কিন্তু সাড়া দিচ্ছ না কেন? নাকি বীরত্ব ফলাতে যাচ্ছ? বউ আগে না বীরত্ব আগে? ওরা এখনও আমার সতীত্ব বজায় রেখেছে। তবে ওদের একজনের চোখে আমি লোভের আগুন দেখেছি। হাজার হোক, তোমার শুকতারা তো সুন্দরী? বিশ্বসুন্দরী না হলেও সুন্দরী। সুন্দরীদের জীবন সুন্দর হয় না। যদি না স্বামী পাশে থাকে। আমার জীবনও বোধহয় অসুন্দর হতে চলেছে। লাবণ্যবৃদ্ধির কসমেটিক্স তো অনেক কিনে দিয়েছিলে, কাল হয়েছিল সেইটাই। লোকটা এখুনি এসেছিল, দরজা খোলার আগে কাকে যেন বলল–ফোনে বলে দাও, ইনসুলিন পাঠাক নেক্সট প্লেনে। তারপরেই ঘরে ঢুকে শুধু বলে গেল বেশি সময় আর দেওয়া যাবে না। বিদ্রোহী, ইনসুলিন কি জিনিস? ড্রাগ? আমার আত্মরক্ষার শক্তি কেড়ে নেওয়ার ওষুধ? বিদ্রোহী…বিদ্রোহী..আমার ভয় করছে…বড় ভয় করছে…

ছাদের কেউ আর এখন কথা বলছে না। গোটা পৃথিবীটা যেন মরে গেছে। জীবন্ত শুধু বুঝি ওই চাঁদ। যার অতিপ্রাকৃত প্রভাবে সাগরপার থেকে ভেসে আসছে শুকতারার হাহাকার।

থমথমে নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করল প্রেমচাঁদ।

বললে নিবিড় ভরাট গলায়, আরও একটা খবর এনেছি।

জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় সবাই।

কাল আবার প্লেনটা যাচ্ছে পোর্টব্লেয়ার।

যেন একটা হ্যাঁচকা টান লাগল বিদ্রোহীর শিরদাঁড়ায়। চাঁদের কিরণ দ্বিগুণ তেজে প্রতিফলিত হল চোখের কালো অঙ্গার থেকে।

বলে গেল প্রেমচাঁদ, যথারীতি আটজন প্যাসেঞ্জার যাচ্ছে।

সাতজন পুরুষ, একজন মহিলা? মেশিনের মতো বলে গেল বিদ্রোহী।

হ্যাঁ। দুটো সিট খালি আছে।

একটায় যাব আমি, খুব আস্তে বললে ইন্দ্রনাথ। চম্পক, ডগলাস প্লেনের আন্ডারক্যারেজের স্কেচ এঁকে দেখাতে পারবে?

চাঁদের আলোয় ম্যাপ দেখা সম্ভব হল না। নেমে আসতে হল একতলার ঘরে। ম্যাপ বিছিয়ে বসল প্রেমচাঁদ। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অগুন্তি দ্বীপগুলোর কোনটি আকাশ পথে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে সবচেয়ে কাছে, জলপথে পোর্টব্লেয়ার থেকেও কাছে এমন একটি দ্বীপ আগে থেকেই চিহ্নিত করে রেখেছিল প্রেম। এখন সেখানে আঙুল রেখে বলল, এই সেই দ্বীপ, যার কাছাকাছি আকাশ থেকে প্যারাসুটে করে কাউকে ফেলে দিলে, পোর্টব্লেয়ার থেকে স্পিড বোট নিয়ে তাকে উদ্ধার করে এই দ্বীপে তোলা যায়।

চম্পক বলল, আকাশ থেকে ড্রপ করে ঝক্কি বাড়ানোর দরকারটা কি? পোর্টব্লেয়ারে নেমে মোটর বোটে করে পাঠিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। অনেক সহজ হয়।

হয় না। বললে প্রেমচাঁদ, পোর্টব্লেয়ার ছোট জায়গা। প্রতি সপ্তাহে সেখানে একটা ট্রাঙ্ক প্লেন থেকে নেমে যদি মোটর বোটে উঠে বিশেষ একটা দ্বীপের দিকে যায়, কাস্টমস-এর চোখে পড়বেই। তার চেয়ে অনেক নিরাপদ আকাশ থেকে ট্রাঙ্কের লোকটাকে ফেলে দেওয়া, জল থেকে তুলে নিয়ে তাকে দ্বীপে পৌঁছে দেওয়া। পোর্টব্লেয়ারে মোটরবোট যখন ফিরে যাবে, দেখা যাবে, বেরুনোর সময়ও ট্রাঙ্ক ছিল না ফিরে আসার পরেও নেই।

তাহলে বিশেষ একটা মোটরবোট পোর্টব্লেয়ার থেকে রাতে বেরিয়ে আবার রাতেই ফিরে আসছে, বললে ইন্দ্রনাথ।

হ্যাঁ। সায় দিল প্রেমচাঁদ।

অতএব আরও একটু লেগ ওয়ার্ক করো বন্ধু।

বান্দা তৈরি। দোস্ত, তুমি যা বলতে চাও তা বোঝা হয়ে গেছে। ওয়্যারলেসে খবর পাঠাচ্ছি পোর্টব্লেয়ার অফিসে। ওখানকার অজস্র মোটরবোটের কোন মোটরবোটটি গত তিন সপ্তাহের বিশেষ এক রাত্রে বিশেষ একটা সময়ে বেরিয়েছে এবং ফিরে এসেছে–এই তো?

কাল সকালেই খবর চাই–বেরুনোর আগে।

কোথায় বেরুবি? এই যে বললি, আট দুশমনের সঙ্গে একই প্লেনে ট্র্যাভেল করবি?

সে তো আমি করব। বিদ্রোহী, চম্পক আর কাকোই যাবে আমার আগেই। চার্টার প্লেনে। তিনজনের কাজ হবে তিন রকম। বলছি, কান পেতে শোন।

ভোরের দিকে ধাতুর পাখিটা উড়ে গেল পোর্টব্লেয়ারের দিকে। যথাসময়ে নেমে পড়ল সেখানে। তালঢ্যাঙা লম্বকর্ণ এক ব্যক্তি তুষোমুখে নেমে এসে চার্লি চ্যাপলিন কায়দায় হেঁটে গিয়ে উঠে পড়ল ট্যাক্সিতে। তার একটু পরে নামল জীবন্ত যন্ত্রের মতন এক পুরুষ। হাইট মোটে পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। মুখখানা অবিকল চিনে ম্যানের মতন। চামড়া তো নয় যেন সাদা পার্চমেন্ট কাগজ। চোখ দুটোতেই কেবল প্রাণ আছে বলে মনে হয়। বুঝি নরকাগ্নি জ্বলছে সে চোখে। সভয়ে এ হেন পুরুষের দিকে চেয়ে রইল বিমানক্ষেত্রের কর্মীরা। ধীর চরণে গিয়ে সে উঠল অন্য একটা ট্যাক্সিতে। মিনিট খানেক পরেই হন্তদন্ত হয়ে প্লেন থেকে নেমে এল খর্বকায় এক জাপানি। ভাবখানা যেন, ট্রেন ফেল হয়ে যেতে পারে আর একটু আস্তে পা চালালেই। চোখে আর ঠোঁটে কৌতুকের ঝরনাধারা ছুটিয়ে দিয়ে, হাত নেড়ে বিমানক্ষেত্রের কর্মীদের অভিবাদন জানিয়ে, সে একরকম ছুটেই বেরিয়ে গিয়ে উঠে পড়ল তৃতীয় একটা ট্যাক্সিতে। আগের দুটো ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। এবার তিনটে ট্যাক্সিই যাত্রা শুরু করল একযোগে। ঘুরেফিরে গিয়ে দাঁড়াল একটাই হোটেলের সামনে।

তিনমূর্তি তিনটে ট্যাক্সি থেকে নেমে এসে ঢুকল হোটেলে। উঠল একটাই কামরায়। সেখানে ইজিচেয়ারে জানলার ধারে বসে পাইপ টানছিলেন পক্ককেশ এক বৃদ্ধ। তাঁর নাক চোখা, চিবুক ঠেলে বের করা, সাদা চুল টেনে আঁচড়ানো। পরনের সাদা স্যুটে লাল নেকটাই মানিয়েছে ভালো।

তিনমূর্তি কুচকাওয়াজ করে ঘরে ঢুকতেই মুখের পাইপ নামিয়ে বাঁধানো সাদা দাঁত বের করে প্রায় দাঁত খিঁচিয়েই হাসলেন বৃদ্ধ। বললেন, ক্যাপ্টেন ডিক্সিট স্পিকিং। আপনাদের জন্য একটা মোটরবোট রেডি অ্যাট জেটি। গায়ে লেখা আছে দেখবেন মোহান্ত। এতে কে যাবেন?

বিদ্রোহীর বীভৎস মুখাবয়বের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করেছিলেন তিনি। তার মানে, তিনি জানতেন প্রায় অমানুষ আকৃতি এই মানুষটাই যাবে এহেন অসম্ভব অভিযানে।

বিদ্রোহী দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, আমি যাব।

তাহলে চলে যান। মোহান্তর পাইলটের নাম আসগর। তাকে আমার এই ভিজিটিং কার্ড দেবেন। সে আপনার জন্য জান দেবে। ও কে।

বিদ্রোহী আর বসলই না। বেরিয়ে গেল।

কৌতুক নাচানো চোখে বিদ্রোহীর অপসৃয়মান মেশিন বডির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল কাকোই। বসল খাটের ওপর। টেনে বসাল চম্পককে।

বললে ক্যাপ্টেন ডিক্সিটকে, আমাদের হিল্লে কী করলেন?

বেশ বাংলা বলেন তো আপনি? পাইপে ফের কামড় দিয়ে বললেন ক্যাপ্টেন ডিক্সিট, আমি অবশ্য ছটা ল্যাংগুয়েজে চোস্ত। বেঙ্গলি ইজ সুইটেস্ট অফ অল। শুনুন মশাইরা, ডলফিন নামে একটা মোটর বোটের গতিবিধি আমার চোখে ভালো ঠেকেনি। গত তিন সপ্তাহে রোজই গভীর জলে পাড়ি দিয়েছে মাছ ধরার জন্য। ভোররাতে বেরোয়, মাঝদুপুরে ফেরে। তখন থাকে মাঝিমাল্লা। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে একটি দিন বোটের মালিক ছুটি নেয়। সেদিন আর ভোররাতে বেরোয় না। গভীর রাতে যায় গভীর জলে। যায় দুজনে, ফিরেও আসে দুজনে। অতএব মাই ডিয়ার জেন্টেলমেন, আপনারা দুজনেই ডলফিনে উঠে লুকিয়ে থাকুন মাছ রাখবার পেটিতে। জেটিতে ভাসছে, মালিকের নাম হাফিজজি। মাথার চুল সব সাদা। কিন্তু গা-গতরে বেশ জোয়ান। সামলেসুমলে চলবেন। এগোেন। বেগতিক দেখলে ফিরে আসবেন। এই ঘরটাই আমাদের ঘাঁটি। আপনারা ফিরে না আসা পর্যন্ত। আর ওই যে অদ্ভুত লোকটা, কী যেন ওর নাম? বিদ্রোহী বর্মন। মনে হয় না উনি দ্বীপে ঢুকে একলা ফিরতে পারবেন, যদি ফেরেন, নিয়ে আসবেন এখানে। আর কিছু জানার আছে? নেই? তাহলে নমস্কার।

আসগর লোকটাকে রামগড়ুরের ছানা বললেই চলে। রোদেজলে ঝামা চেহারা। শুকনো প্যাকটি। তবে হাত-পা-কাঁধের দড়ি দড়ি মাসল দেখলে সম্ভ্রম হয়। এ লোক প্রয়োজনে হাতি টেনে রাখতে পারে। বয়স তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হবে। গোড়ালি থেকে জিনস-এর প্যান্ট গুটিয়ে খালি গায়ে দাঁড়িয়েছিল মোহান্তর সামনে। বিদ্রোহী এগিয়ে আসতেই তার সঙ্গে কথা না বলে তক্তা বেয়ে উঠে গেল ডেকে। পেছন-পেছন উঠে গেল বিদ্রোহী। দুজনেই ঢুকল কেবিন রুমে। সেখানে একটা চার্ট পাতা ছিল। একটা দ্বীপের ওপর আঙুল রেখে বললে আসগর, এই একটা দ্বীপের একটা দিক জল থেকে সোজা ওপরে উঠে গেছে। পাথরের দেওয়াল, খাঁজ কাটা। কাছে যাইনি, দূর থেকে দেখেছি। এদিক দিয়ে দ্বীপে ওঠা যাবে না। আমাদের যেতে হবে অনেক ঘুরে। এখন বেরোনো দরকার।

বিদ্রোহী ঠোঁট আর অধর না কাঁপয়ে বললে, তাই চলো।

চিনেম্যান মেকআপ এখনও পালটায়নি বিদ্রোহী। চিনেম্যানের মুখে এত পরিষ্কার বাংলা আশা করেনি আসগর। তাই চেয়ে রইল সাদা চুল, সাদা মুখ আর কালো চোখের দিকে।

দুই চোখের অমানবিক শীতলতা শিহরিত করল আসগরের মতন আসুরিক শক্তির মানুষকেও।

মোহান্ত বেরিয়ে গেল বঙ্গোপসাগরের বুকে।

.

ইনসুলিন, বললে ইন্দ্রনাথ কলকাতায় প্রেমাদের অফিসে বসে, দরকার হয় হাই ডাইবিটিজ পেসেন্টের জন্য। সেন্ড ইনসুলিন লেখা কাগজটা পাওয়া গিয়েছিল সুজন দেশাইয়ের বাড়িতে। কেমন?

প্রেমচাঁদ বললে, শুনছি।

নিশ্চয় ধস্তাধস্তির সময় চার গুন্ডার পকেট থেকে পড়ে গেছিল? সুজন দেশাইয়ের গৃহরক্ষী কিন্তু ইনসুলিন কি জিনিস, তা জানে না। তার বস সুজন দেশাইয়েরও ডায়াবিটিজ নেই। হাউস ফিজিসিয়ানের কাছে খবর নিয়েছি।

বলে যা।

শুকতারা টেলিপ্যাথিক মেসেজ পাঠায় বিদ্রোহীকে। ব্যাপারটা বিজ্ঞানসম্মত নয়, কিন্তু ঘটছে। বিজ্ঞান যার ব্যাখ্যা করতে পারে না, এমন অনেক জ্ঞানই আমাদের গিলতে হচ্ছে। স্রেফ ঘটে যাচ্ছে বলে। শুকতারার অসাধারণ ক্ষমতাকেও তাই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি।

বেশ।

শেষ বার্তায় শুকতারা জানিয়েছিল, ফোনে হুকুম দেওয়া হবে–নেক্সট প্লেনে ইনসুলিন পাঠানোর জন্য। নেক্সট প্লেন যাচ্ছে আজকে। যার মধ্যে যাচ্ছি আমি, স্রেফ গায়ের জোরে।

জানি।

ইনসুলিনও যাচ্ছে এই প্লেনে। কার জন্য?

যার ডায়াবিটিজ আছে তার জন্য?

মাই ডিয়ার প্রেমচাঁদ, এই হেঁয়ালিটার সমাধান করেছি স্রেফ ব্রেন ওয়ার্ক করে। তুই কি কিঞ্চিৎ লেগ ওয়ার্ক করে আমার সিদ্ধান্তটার সমর্থন এনে দিবি?

সিওর, উজ্জ্বল চোখে বললে প্রেমচাঁদ, যাদের কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাদের কি কারুর জন্যে দরদ উথলে উঠল কিডন্যাপারদের–এইটাই তো জানতে চাস?

রাইট ইউ আর, মাইডিয়ার মাথামোটা প্রেমচাঁদ।

.

কুঁজোর হঠকারিতা

ট্রান্সপোর্ট প্লেনে রাতের জার্নি খুব সুখকর হয় না। বিমান ভ্রমণের উত্তেজনা এতে নেই। গতিবেগ হয় মন্থর, জানলা দিয়ে বাইরে কিছু দেখাও যায় না। মোটরের চাপা একঘেয়ে গজরানিতে ঘুম এসে যায়। প্যাসেঞ্জাররা ঢুলতে পারলে বেঁচে যায়।

অথচ রাতের মালবাহী বিমানেই উঠেছে এতগুলি মানুষ।

প্রথমে এসেছিল চারজন। ট্যাক্সিতে। চার পুরুষ। একজন বিশালকায় এবং স্থূলকায়। বাড়তি চর্বি জমেছে শরীরের সব জায়গায়। দ্বিতীয় জন বিশাল, তবে চর্বির পাহাড় নয়, এর হাতে রয়েছে। গুচ্ছ-গুচ্ছ কালো চুল। তৃতীয় জন খর্বকায়, সলিড বপু, দাঁতের ফাঁকে-ফাঁকে মোটা চুরুট। চতুর্থ জন ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতন মামুলি চেহারার অধিকারী।

এরা চারজনেই ছিল সেই রাতে–যে রাতে শুকতারা নিখোঁজ হয়েছিল উড়ন্ত প্লেন থেকে।

ট্যাক্সি থেকে নামবার আগে চুরুট প্রিয় খর্বকায় ব্যক্তি যেন বলেছিল নিজের মনেই, ট্রাঙ্কটা কার কাছে?

রিনির কাছে। জবাব দিল চর্বির পাহাড়।

ট্যাক্সি থেকে নেমে চার মূর্তিমান স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিমায় ঢুকে গেল ভেতরে। চারজনেরই হাতে ছোট ব্রিফকেস–যেমন থাকে প্যাসেঞ্জারদের হাতে। বিবিধ বিধি নিষেধের গণ্ডি টপকিয়ে চারজনেই এগিয়ে গেল ডগলাস বিমানের দিকে। কিন্তু তাড়াহুড়ো নেই।

ঝড়ের বেগে আর একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল গাড়ির লাইনে। গাড়ি থেকে নামল চারজন। তিনজন মামুলি চেহারার পুরুষ, চতুর্থজন এক মহিলা। আকর্ষণীয়া। কিন্তু চোখ শক্ত, নাক শক্ত। চোয়াল শক্ত। এগুলির জন্যই তাকে পুরোপুরি বিউটি কুইন বলা যাচ্ছে না।

তিন পুরুষ আরোহীর একজন বললে দ্রুত কণ্ঠে রিনি ট্রাঙ্কটা। বাগড়া পড়বে না তো ভেতরে ঢোকাতে?

কঠোর হেসে রিনি বললে, এই বডি দেখিয়ে সব পথই চিচিং ফাঁক করে রেখেছি। এর আগের দুবার কী অসুবিধে হয়েছে?

টিকটিকি লেগেছে যে পেছনে।

টাকাও ছড়াচ্ছি আমি, প্লাস মাই বডি। ডোন্ট ওরি। গো অ্যাহেড। ট্রাঙ্ক নিয়ে তিনজনে পেছনে। বিধি নিষেধের গণ্ডিগুলো ভোজবাজির মতন মিলিয়ে যাচ্ছে রিনির খটখটাখট জুতোর হিলের আওয়াজ শোনার সঙ্গে-সঙ্গে। খোদ প্রাইম মিনিস্টার গেলেও এভাবে শশব্যস্তে কেউ পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ায় না।

ধীরপদে হাঁটছিল যে চারজন, ট্রাঙ্কবাহী দলটা তাদের নাগাল ধরে ফেলতেই ট্রাঙ্কের ওজন নিয়ে আর কারও মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। আট যাত্রী, এক ট্রাঙ্ক। অসুবিধাটা কোথায়?

আগে ট্রাঙ্ক উঠে গেল বিমানে, যাত্রীরা উঠল তার পরে। এবার রওনা হওয়ার পালা।

উল্কাবেগে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল বাইরে। ছিটকে বেরিয়ে এল বিদঘুঁটে এক মূর্তি। লম্বা সে বিলক্ষণ সন্দেহ নেই, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না কুঁজো হয়ে থাকায়। উটের কুঁজের মতনই বিশাল বক্রপিঠ বেচারিকে ঝুঁকিয়ে রেখেছে সামনে। কিন্তু সে হাঁটছে অবিশ্বাস্য গতিবেগে। দৌড়চ্ছে বললেই চলে। তার কাঁধ খুব চওড়া, পায়ে চর্কি লাগায় এই কঁধ দুলছে সমান তালে। মুখ তার থসথসে চবির্তে ঠাসা। পুরু নাক, লোমশ ভুরু। ঠোঁটের দু-কষ বেয়ে পানের রস গড়াচ্ছে। পরনের ঢোল প্যান্ট আর ঢোলা বুশ শার্ট বালিশের খোলের সঙ্গে তুলনীয়।

কী আশ্চর্য! এমন একটা কিম্ভুতকিমাকার মূর্তি কিন্তু ছুটতে ছুটতেই পেরিয়ে গেল গেটের পর গেট, কেউ ফিরেও তাকাল না।

টাকার কার্পেট পেতে রেখেছে নাকি লোকটা? নাকি ওপর মহলের নির্দেশ?

ডগলাস বিমান তখন ওড়বার জন্য তৈরি হচ্ছে, লোকটাও ভাঙা গলায় চেঁচাচ্ছে, আটকাও, আটকাও। প্লেনটাকে ধরো। পোর্টব্লেয়ার যেতে হবে আমাকে, এখুনি।

বিমানের ভেতরে চুরুটধারী পুরুষ সবেগে ছিটকে গেল পাইলটের কম্পার্টমেন্টে, চালাও। আবার এসেছে একটা গাধা।

চিৎকার করে ওঠে পাইলট, চালাব কী করে? চাকার তলা থেকে কাঠ না সরালে চাকা ঘুরবে কী করে? বলতে বলতে উদ্দামভাবে হাতের ইশারা করতে থাকে নীচের লোকজনদের, কাঠের ব্লক সরিয়ে নেওয়ার জন্য।

প্লেনের দরজা পর্যন্ত লাগানো সিঁড়ি তখনও সরানো হয়নি। কুঁজো এসে দাঁড়িয়েছে সিঁড়ির গোড়ায়। হাত-পা ছুঁড়ে তর্ক জুড়েছে ফিল্ড অ্যাটেনড্যান্টের সঙ্গে।

প্লেন হাউসফুল তো আমার কি? যেতে আমাকে হবেই। প্লেনের ল্যাজে বসে থাকব। এতবড় একটা প্লেন বাড়তি একজনকে নিয়ে যেতে পারবে না বললেই হল? আরও হাফটন ওজন নিয়ে শুন্যে উড়ে যেতে পারে এ প্লেন। কী ভেবেছ আমাকে? গাড়ল?

তা সত্ত্বেও পথ রুখে দাঁড়িয়েছিল অ্যাটেনডেন্ট। ঠিক এই সময় একটা লাল জিপ এসে দাঁড়াল পাশে। ভেতরে থেকে শোনা গেল কড়া গলা, ঝামেলা কীসের? যেতে চাচ্ছে যাক।

জোঁকের মুখ নুন পড়ল যেন। সরে গেল অ্যাটেনড্যান্ট। সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বিড়বিড় করে বললে কুঁজো, সাবাস প্রেমচাঁদ। তোর হাত এত লম্বা?

গলাটা ইন্দ্রনাথ রুদ্রর।

প্লেনের দরজা তখন বন্ধ হচ্ছে। ভেতর থেকে তিনজন বন্ধ করতে চাইছে। বাইরে থেকে কুঁজো একাই দরজা খুলে রাখছে। ঢুকেও গেল ঝটকানি মেরে। তিনজনকে এক হাতে রুখে দেওয়া তার কাছে নেহাতই ছেলেখেলা।

ঢুকেই অবশ্য পানরঞ্জিত বিচ্ছিরি দাঁত বের করে বলে উঠল, সরি ফর ডিসটার্বান্স, বাট আই হ্যাভ টু গো।

চুরুটধারী তখনও রয়েছে পাইলটের কম্পার্টমেন্টে। পাইলট শুনেছে কুঁজো ঢুকে পড়েছে ভেতরে।

বললে খাটো গলায়, একটু দাঁড়িয়ে যাব? ঠেলে ফেলে দেবেন?

না। জিপের অফিসার আমাদের ঘুষের লিস্টে নেই। কুঁজোর ব্যবস্থা করছি–ওঠাও প্লেন।

দমাস করে বন্ধ হল দরজা। রানওয়ের ওপর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিমায় গগনবিহারী হল ডগলাস প্লেন।

শূন্য একটা সিটে ততক্ষণে পরম আরামে বসে পড়েছে কুঁজো।

আমোদ ঝলমল করছে গোটা বদন জুড়ে। যেন ভীষণ একটা মজা হয়ে গেল, এমনিভাবে তাকাচ্ছে আট আরোহীর দিকে।

চুরুটধারীকে শুধু একটাই প্রশ্ন করল, পাইলট কোথায়?

প্রথমটাকে ফেলবার ঠিক আগে–দূরে আলোর সিগন্যাল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। আগের মেয়েটাকে প্যারাসুট দিয়েছিলাম। এটাকে তাও দেব না। তার হাজব্যান্ডকে পোর্টব্লেয়ার পৌঁছে দিয়েছিলাম, এটাকে জলে ফেলে দেব। টাকার মালিক বলে তো মনে হয় না–জঘন্য।

দাঁত বের করে আমুদে হাসি হাসতে-হাসতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল জঘন্য কুঁজো।

আর, সাধারণ প্যাসেঞ্জারদের মতনই ঝিমোতে শুরু করে দিল প্লেনের আটজন আরোহী। নিদারুণ একঘেয়েমির ভাব মুখচ্ছবিতেই সুস্পষ্ট। লোমশহস্ত বিশালবপু লোকটা মাঝেমধ্যে সামনে ঝুঁকছে, কী যেন বলছে সামনে সলিডবপু খর্বকায় চুরুটধারীকে। দ্বিতীয় ব্যক্তি ঠোঁট বেঁকিয়ে মৃদু মৃদু হেসেই চলেছে, হাসিহীন কিন্তু মুখাবয়বের বাদবাকি অংশ। এই হাসিটুকুই একমাত্র প্রাণস্পন্দন হয়ে রয়েছে আট আরোহীর মধ্যে। বাকি সবাই যেন নিষ্প্রাণ।

ভয়ানক উত্তেজনার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কেবল বৃষস্কন্ধ কুজ ব্যক্তিটির সর্বাঙ্গে। এমনভাবে ইতিউতি তাকাচ্ছে যেন জীবনে এই প্রথম বিমানে চেপেছে। জানলার ওপর দিয়ে তাকাচ্ছে, নীচ দিয়ে তাকাচ্ছে, অন্ধকারে কত কিছু দেখবার চেষ্টা করছে দু-চোখ কুঁচকে। তারপরেই বত্রিশপাটি দাঁত বের করে তাকাচ্ছে সহযাত্রীদের দিকে। যেন একটা বৃহদাকার বালক। নিরবচ্ছিন্ন শব্দহীন হাসিতে ঠাসা লোকটা কিন্তু এই ভড়কিতে ভোলেনি।

চর্বির পাহাড় বসেছিল ঠিক তার সামনেই। ঈষৎ ঝুঁকে বললে নিম্নকণ্ঠে, এবার চিনেছি বাছাধনকে। সেই টিকটিকিটা ইন্দ্রনাথ রুদ্র। ওই চোখ কি ভোলো যায়?

সত্যি, তাড়াহুড়োয় ওই একটা ভুল করেছিল ইন্দ্রনাথ। কনট্যাক্ট লেন্স ছদ্মবেশ বাক্সে তো ছিলই।

তবে মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়।

নিঃশব্দে শিস দিয়ে ওঠে চর্বির পাহাড়, আশ্চর্য। কুঁজ দেখে ভুলেছি সবাই।

বিদ্রোহীর লোক। টাকার লোভে রাস্কেলটাকে ছেড়ে দেওয়াটা ভুল হয়েছে। কী করা যায়?

বাড়াবাড়ি করলে ট্র্যাপডোর তো রয়েছেই।

ভয়ানক জোর গায়ে–দরজাটা একহাতে খুলল কী করে দেখলেন তো?

টিট করার পথ আমি জানি। সুটকেশে আছে তো জিনিসটা?

নিশ্চয়।

তাহলে ওঠা যাক।

দ্যাখন হাসি, লোকটা দাঁড়িয়ে উঠে গেল প্লেনের পেছন দিকে। ফুরফুরে চেহারার বিমান সেবিকা এগিয়ে এল একইরকম সেঁতো হাসি হেসে–পোর্টব্লেয়ারের এই সফরে প্রতিবারেই এই ললনাকেই দেখা যায় এই প্লেনে। এগিয়ে দিল দ্যাখন হাসির ব্রিফকেস। নিরীহ দর্শন একটা রুমাল বের করে সশব্দে তাতে নাক ঝেড়ে নিল দ্যাখন হাসি। কিন্তু ব্রিফকেস বন্ধ করার সময় যখন রুমাল গুঁজল পকেটে, তখনই বর্ণহীন তরল পদার্থ ভরতি ছোট্ট একটা শিশি চালান হয়ে গেল রুমালের ফাঁকে।

স্বস্থানে ফিরে এসে পাশের জানলা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইল দ্যাখন হাসি। তারপর উঠে এসে বসল কুঁজোর পাশের খালি সিটে। জানলা দিয়ে চেয়ে রইল বাইরে। যেন অদৃশ্য কোনও বস্তু নিরীক্ষণের আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।

কুঁজে ঠেস দিয়ে আরও আরামে বসল ইন্দ্রনাথ এবং রইল প্রতীক্ষায়।

ক্রিমিনালদের হেডকোয়ার্টার আবিষ্কারের বিপদসঙ্কুল এই পরিকল্পনাটা তার নিজস্ব। বলেছিল প্রেমচাঁদকে, যাব একই প্লেনে, একই জায়গায়। দেখি তোর মুরোদ, পারবি না পথ পরিষ্কার করে দিতে?

প্রেমচাঁদ তার খেল দেখিয়েছে।

এবার এসেছে ইন্দ্রনাথের খেলা দেখানোর সময়।

বসেছে বিদ্রোহী যেখানে বসেছিল একমাস আগে, ঠিক সেই জায়গায়। বুদ্ধির ভেলকিতে যদি হারাতে পারে প্রতিপক্ষকে, প্রাণে বাঁচবে, নইলে…

দুঃসাহসের প্রথম পর্বটা সহজেই পেরিয়ে আসা গেছে। এবার বাকি দ্বিতীয় পর্ব, সবচেয়ে কঠিন পর্ব। আন্দামান বেশি দূর নেই।

লক্ষ করে যাচ্ছে আট আরোহীর প্রত্যেকের প্রতিটি মুভমেন্ট।

বেশি নজর কিন্তু পাশে বসা লোকটার দিকে। বিপদের সম্ভাবনা এই তরফেই। একটু আগেই প্লেনের পেছনে গিয়ে রুমাল বের করেছে ব্রিফকেস থেকে।

পাশের দিকে বড় বেশি নজর দিয়েছিল বলেই একটু শৈথিল্য দিয়েছিল পেছনের দিকে। কানজোড়াকে ততটা সজাগ রাখেনি। তাই বুঝতেও পারল না, একদম পেছনের সিট থেকে অতিশয় মামুলি চেহারার একটা লোক সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। বেড়ালের মতন নিঃশব্দে এসে গেছে পেছনে, বগল থেকে একটা রিভলভার বের করে আচমকা ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে।

খরনজরে পাশের লোককে দেখতে-দেখতে হঠাই টের পেল ইন্দ্রনাথ, হিমশীতল একটা বস্তু ঠেকেছে কানের পেছনে। এখন একটু নড়লেই উড়ে যাবে মগজ। সুতরাং সে একদম অনড় হয়ে রইল।

নড়ল না কেউই। কথাও বলল না। ডিটেকটিভ ধরা পড়েছে। আর কি?

খুব আস্তে, নিরন্তর নিঃশব্দ হাসি-আঁটা মুখটা ঘুরে গেল ইন্দ্রর দিকে। হাসতে হাসতেই সে রুমাল বের করেছে পকেট থেকে। শক্ত চোয়াল, শক্ত নাক, শক্ত চোখওয়ালা মেয়েটা বিষম ভয়ের ভান করছে। আর সবাই দাঁত খিঁচিয়ে হাসছে।

হাসি মুখ লোকটা একহাতের শিশি উপুড় করে ধরেছে আর এক হাতের রুমালের ওপর। ক্লোরোফর্মের উৎকট গন্ধে ভরে গেল কেবিন।

পাইলট। বিকট গলায় হেঁকে উঠল ইন্দ্রনাথ। এর বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। নলচে ঠেকে রয়েছে কানের পেছনে।

ক্লোরোফর্ম ভিজোনো রুমাল চেপে বসল তার নাকে আর মুখে। ধস্তাধস্তি করেছিল ইন্দ্রনাথ। প্রথমে জোরে, তারপর ক্ষীণভাবে। শেষে নিস্তেজ হয়ে গেল সর্বাঙ্গ। রুমাল আরও চেপে বসল নাকে মুখে।

সিটে এলিয়ে পড়ল কুঁজো।

দুজন গিয়ে ট্র্যাপডোর খুলছে। ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে ভেতরে। আয়তাকার গর্তের দিকে শিথিল দেহটাকে ঠেলে এগিয়ে দেয় বেশ কয়েকজন।

দু-হাজার ফুট নীচে বঙ্গোপসাগরের আবলুষ কালো জল ফুটপাথের মতনই কঠিন, এত উঁচু থেকে যে আছড়ে পড়বে, সে পড়বে যেন গ্রানাইটের ওপর।

ঢালু পথে গড়িয়ে দেওয়া হল ইন্দ্রনাথকে। ঢাল নেমে গেছে প্লেনের পেছন দিকে। আর তাকে দেখা গেল না। গর্জন অব্যাহত রেখে এগিয়ে গেল বায়ুযান।

.

ইন্দ্রনাথ কোথায়?

বিমানের মধ্যে তখন চলছে বিপুল তৎপরতা। চলছে দু-হাজার ফুট নীচের জলেও। অনেক দূরে পিনের ডগার মতন একটা আলোক বিন্দু দেখা গেছে জলের ওপর। দেখেছে নিরবচ্ছিন্ন হাস্যমুখর চুরুটধারী।

কুচক্রীদের গোপন বিবরের নিশানা এই আলোর কণা।

প্লেনের পেছন থেকে হিড়হিড় করে টেনে আনা হল কালো ট্রাঙ্ক। ডালা খুলে ধরাধরি করে বের করা হল একটা মনুষ্যদেহ। বৃদ্ধ অথচ তার হাত মুখ পা কষে বাঁধা। জ্ঞানহীন এই বৃদ্ধ সুজন দেশাই।

কর্কলাইট বেল্ট এঁটে দেওয়া হল বৃদ্ধের কাঁধে।

সামনের কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে পাইলট। হাঁক দিচ্ছে সেখান থেকেই, তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি।

দ্রুত হাত চালিয়ে একটা প্যারাসুট বেঁধে দেওয়া হল সুজন দেশাইয়ের শরীরে। বয়ে নিয়ে যাওয়া হল খোলা ট্র্যাপডোরের পাশে।

আলোকবিন্দু এখন প্লেনের ঠিক নীচে। হেঁকে ওঠে পাইলট, ফেলুন।

ঢালু দরজার ঢালে পিছলে নামিয়ে দেওয়া হল দেহটাকে।

প্যারাসুটটা খুললে হয়। অস্বস্তির সুরে বললে একজন।

এর আগেও যখন খুলেছে, এবারও খুলবে, জবাব দিল আর একজন।

বলতে-বলতেই দেখা গেল প্যারাসুট খুলে গেছে। বঙ্গোপসাগরের জলের দিকে হেলেদুলে নেমে যাচ্ছে সুজন দেশাইয়ের অচেতন দেহ।

সাদা ব্যাঙের ছাতার মতন এই প্যারাসুটের অদুরে খুলে গেল আর একটা ব্যাঙের ছাতা, এটা কুচকুচে কালো রঙের।

প্লেন থেকে পতনের ঝুঁকিটা অকারণে নেয়নি ইন্দ্রনাথ।

মাথা খাঁটিয়েছে আগেই। ডগলাস প্লেনের আন্ডারক্যারেজের নকশা আঁকিয়ে নিয়েছিল চম্পককে দিয়ে।

এ প্লেন ল্যান্ডিং করে ট্রাইসাইকেল কায়দায়। পেছনের চাকাজোড়াকে জুড়ে রেখেছে যে ডান্ডাটা সেটা থাকে ট্র্যাপডোরের পেছন প্রান্তে। হাত বাড়ালে নাগাল পেলেও পাওয়া যেতে পারে।

নাকেমুখে ক্লোরোফর্ম দেওয়ার সময় দমবন্ধ রেখেছিল ইন্দ্রনাথ। তা সত্ত্বেও শেষের দিকে যৎকিঞ্চিৎ নাকে ঢুকেছিল, তাতেই কুয়াশা জমেছিল ব্রেনে। লোপ পেয়েছিল জ্ঞান।

ট্র্যাপডোরের মারাত্মক ঢালু পথে পিছলে নামবার সময় ঠান্ডা হাওয়ার ঝাঁপটায় পরিষ্কার হয়ে গেছিল মগজ। পা নীচের দিকে করে পাশ ফিরে হড়কে নেমে যাচ্ছে, বুঝতে পেরেছিল। দরজার ঢাল থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গে মোচড় দিল শরীরে।

সেকেন্ডে দুশো ফুট গতিবেগে এরোপ্লেনটা মাথার ওপর থেকে সরে যেতেই বাতাসের ধাক্কায় একটু কমেছিল ওর পতনের বেগ। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই হাত বাড়িয়ে আঙুলের ডগা দিয়ে ধরে নিয়েছিল পেছনের চাকা জোড়ার মাঝের ডান্ডা। বাতাসের ধাক্কায় সঙ্গে-সঙ্গে উড়ন্ত প্লেনের সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে গেল শরীর, আঙুলের আঁকশি কিন্তু শিথিল হয়নি। বরং আরও জবর মুঠোয় চেপে ধরেছে ডান্ডা।

এইভাবেই তেড়চা হয়ে কিছুক্ষণ ঝুলে রইল ইন্দ্রনাথ। টনটনিয়ে উঠল মাসল। কিন্তু কেটে গেল গা-পাক দেওয়া ভাবটা। ঘরে বসে প্ল্যান করা এক জিনিস, আর তার রূপায়ণ আর এক জিনিস। দুটোতেই দরকার ঠান্ডা মাথার। ইন্দ্রনাথের তা আছে।

এবার একহাতে শরীর ঝুলিয়ে রেখে আর এক হাতে খুলে ফেলল গায়ের কোট, টেনে ছিঁড়ে আনল পিঠের প্যাড। হাত বদল করে শরীর ঝুলিয়ে রেখে অপর হাত দিয়ে কোট গলিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল নীচে।

এখন তার পিঠে দেখা যাচ্ছে একটা কমপ্যাক্ট প্যারাসুট। প্যাড সেঁটে এই জিনিসটাকেই কুঁজের আকার দেওয়া হয়েছিল। কুঁজ ছিল তার ছদ্মবেশ।

ট্র্যাপরে ফের খোলা হচ্ছে দেখেই প্লেনের তলপেটে নিজেকে সাঁটিয়ে নিয়েছিল ইন্দ্রনাথ। ওই পজিশনে থাকলে প্লেনের ভেতর থেকে তাকে দেখা যাবে না। ও কিন্তু দেখতে পাবে আবার কি গড়িয়ে নামছে প্লেন থেকে।

অচিরেই দেখা গেল তাকে।

হাত-পা বাঁধা একটা নরদেহ।

নীচে ঠিকরে গেল দেহটা। সাদা মেঘের মতন খুলে গেল প্যারাসুট, হ্রাস পেল পতনবেগ। নিমেষে শূন্যে ঝাঁপ দিল ইন্দ্রনাথ–সাদা মেঘের পেছনে।

বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছিল কপালে। মৃত্যু সামনে কিছু করার নেই।

খুলে গেছে প্যারাসুট। কালো রঙের। দুলছে ইন্দ্রনাথ। কালো রং মিশে গেছে আকাশের কালো রঙের সঙ্গে। ভাগ্যিস এখনও চঁদ ওঠেনি। আকাশে মেঘ থাকায় তারা দেখাও যাচ্ছে না। দেখা দিলে বিপদ বাড়ত। নীচের লোক দেখত বেশ কিছু তারা ঢাকা পড়ে গেছে একটা ধ্যাবড়া কালো জিনিসে।

প্যারাসুট বাতাসে ভেসে নামে বটে, কিন্তু নামে খুব জোরেই। একটু পরেই সাদা প্যারাসুট আছড়ে পড়ল জলে। কাঁধের কর্ক লাইফ বেল্ট ভাসিয়ে রাখল বৃদ্ধকে।

পা নীচের দিকে নামিয়ে সেকেন্ড কয়েক পরেই জলে আছড়ে পড়ল ইন্দ্রনাথ। শরীরটাকে দুমড়ে মুচড়ে বের করে আনল প্যারাসুটের দড়িদড়ার জঙ্গল থেকে।

শোনা যাচ্ছে মোটরবোটের ভটভট আওয়াজ। দ্রুত এগিয়ে আসছে এই দিকেই।

ওই তো প্যারাসুট, সাদা জায়গাটা–বোট থেকে ধ্বনিত হল, পুরুষ কণ্ঠস্বর, ঝটপট…জ্যান্ত তুলতে হবে জল থেকে।

আবলুষ কালো জলে নিঃশব্দে সাঁতরে গেল ইন্দ্রনাথ। বোটের ইঞ্জিনের আওয়াজ লক্ষ করে। ওর ঠিক সামনেই ভাসছে অচেতন বৃদ্ধ। এক লাইনেই উলটো দিক থেকে এগিয়ে আসছে মোটরবোট। আলো নেই বোটে। কালো আকাশ আর কালো জলের পটভূমিকায় দেখা যাচ্ছে শুধু কালো জমাট আঁধার। বোটের বিশাল খোল। রিভার্স গিয়ারে ঘড়ঘড় আওয়াজ হল, স্পিড কমছে বোটের, স্থির হয়ে গেল ভাসমান শরীরটার পাশে এসে।

তোলো।

বোটের উঁচু দিক থেকে নেমে এল একটা বোটহুক। লাইফবেল্টের স্ট্র্যাপে গেঁথে গেল হুক। টেনে তোলা হল শরীরটাকে।

ঠান্ডা মেরে গেছে, তবে বেঁচে আছে, বোটের ডেকে ধ্বনিত হল পুরুষ কণ্ঠস্বর।

আলো না জ্বালিয়েই আন্দামান-নিকোবর দ্বীপের গোলক ধাঁধার দিকে ভটভটিয়ে এগিয়ে গেল মোটরবোট। ততক্ষণে বোটে উঠে পড়েছে আরও এক আরোহী–বোটের মালিক তাকে চেনে না।

বোট যখন দাঁড়িয়ে ছিল, ঠিক তখন দুটো হাত উঠে এসেছিল কালো জল ছেড়ে। নোঙর আঁকড়ে অক্লেশে টেনে তুলেছিল নিজের ব্যায়ামপুষ্ট বডিটাকে। বোট যখন ছুটেছে ঘণ্টায় তিরিশ মাইল গতিবেগে, সে তখন গলুইয়ের তমিস্রায় নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছে।

মাকড়সা ওৎ পেতে বসে থাকে জটিল জালের ঠিক সেন্টারে। ইন্দ্রনাথ রুদ্র চলেছে রহস্যময় সেই কেন্দ্র অভিমুখে।

.

আদর করে দ্বীপটার ডাকনাম হয়েছিল রাজার দ্বীপ। শুনলে মনে হতে পারে রাজা-বাদশাদের আনাগোনা ছিল অতীতকালে। অথবা বাদশাহী কাণ্ডকারখানা চলছে সেখানে এখনও।

কিন্তু এ দ্বীপে রাজকীয় কাজকারবার নেই একেবারেই।

ছোট্ট দ্বীপ। খান কয়েক কাঠের গুঁড়ির কেবিন। দ্বীপে দিন গুজরানের অভিলাষ যাদের, তাদের জন্য একটা মুদির দোকান।

মোহান্তর ডেকে দাঁড়িয়ে নিমেষহীন চোখে এই দ্বীপটার দিকেই তাকিয়েছিল বিদ্রোহী।

পাশে দাঁড়িয়ে আসগর বললে, আপনার প্ল্যানটা কী?

দ্বীপে হানা দেওয়া।

পণ্ডশ্রম হবে। প্রাণটাও যেতে পারে। এখানকার খুদে-খুদে দ্বীপে অনেক ব্যাপার চলে, পুলিশ আসতেও সাহস পায় না। দ্বীপে নামতেই পারবেন না। বুলেট ছুটে আসবে।

ভয় পেয়েছ?

আপনার হঠকারিতা বন্ধ করার চেষ্টা করছি। আপনার স্ত্রী ছাড়াও আরও অনেককে যারা ওখানে আটকে রেখেছে, তারা নিশ্চয় বাইরের লোককে দ্বীপের ধারেকাছে আসতে দেবে না। নামবার জায়গা খোঁজার জন্য আমাকে টহল দিতেই হবে। খবর চলে যাবে।

যাক।

আপনি যা করতে চাইছেন, সেটা তো হবে না।

তোমার প্ল্যান কী?

রাজার দ্বীপে নেমে পড়ুন। মুদির দোকানে খোঁজ নিন। আশপাশের ছোটখাটো দ্বীপের মানুষ কেনাকাটার জন্য পোর্টব্লেয়ার যায় না। খোঁজ পেয়ে যাবেন।

আসগরের বুদ্ধির তারিফ করতেই হল বিদ্রোহীকে। একটু চুপ করে থেকে বললে, তার চাইতে ভালো হয়, যদি তুমি নামো।

নেমে?

আমার মুখ দেখলে সবাই ভয় পায়। তোমাকে দেখলে ঠিক তার বিপরীত হবে। প্রাণ খুলে কথা বলবে।

ঠিক আছে।

বাঁশের তৈরি জেটিতে মোহান্তকে বেঁধে রেখে আসগর নেমে গেল। ফিরে এল ঘণ্টাখানেক পরে।

ছোট্ট কেবিনে নিশূপ দেহে বসেছিল বিদ্রোহী। যেন পাথরের চিনেম্যান। আসগর বললে, আপনাকে আঘাটায় নামিয়ে দিচ্ছি।

তারপর?

খাবার এনেছি দোকান থেকে, চিড়ে গুড়। খেয়ে নিন। এই নিন জলের বোতল। জঙ্গলে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। সন্ধের পর ডলফিন আসবে এখানে।

ডলফিন?

একটা মোটরবোট। গত তিন সপ্তাহে তিনবার গভীর রাতে গভীর জলে গেছে।

গত তিন সপ্তাহে তিনবার–গভীর রাতে?

মাছ ধরতে নয়, তাহলে মাঝিমাল্লা থাকত। ডেকে থাকে শুধু দুজন। মালিক আর একজন। যাওয়ার আগে এখান থেকে মদের মোতল নিয়ে যায়, দামে সস্তা বলে। কোথায় যায় অত রাতে

তা কখনও বলেনি হাফিজজি।

হাফিজজি কে?

বোটের মালিক। লোকটার কথাবার্তা আর চোখ দেখে খটকা লেগেছিল মুদির দোকানির, কিন্তু বেশি জানতে চায়নি। প্রাণের ভয় তো আছে। করেকন্মে খাচ্ছে খাক। আমার মনে হয়, হাফিজজির বোট ওইখানেই যায়, যে দ্বীপে আপনি যেতে চাইছেন।

আন্দাজি কথা।

আমি যে দ্বীপটাতে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, গভীর রাতে ওই দ্বীপের দিক থেকেই হাফিজজির মোটর বোটকে ফিরতে দেখা গেছে। দূর দিয়েই পোর্টব্লেয়ার চলে গেছে। তবে আওয়াজ শুনে মুদির দোকানি ঠিক চিনতে পেরেছে। এখান থেকে যাওয়ার সময় গভীর সমুদ্রের দিকে যায়, ফেরে ওই দ্বীপ হয়ে। কেন, সেটা একটা রহস্য।

তোমার প্ল্যানটা কী?

জঙ্গলে লুকিয়ে থাকুন। ডলফিন যখন আসবে, সাঁতরে পেছন দিয়ে উঠে পড়বেন। মাছ। রাখার অনেক খালি পেটি থাকে। একটায় লুকিয়ে থাকবেন। যেখানে যেতে চান, পৌঁছে যাবেন। তারপর যদি আয়ু থাকে, ওই বোটেই ফিরে যাবেন পোর্টব্লেয়ার।

আমার আয়ু? হাসল বিদ্রোহী। অধর আর ওষ্ঠ নড়ল না।

ভেতর পর্যন্ত কেঁপে উঠল আসগরের। এ যে জীবন্ত বিভীষিকা।

.

বিদ্রোহীর রণমূর্তি

গুটিসুটি মেরে খুবই অল্প জায়গায় নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছিল ইন্দ্রনাথ। কালো আকাশ, কালো জল, ডেকের অন্ধকার, পরনের শার্ট প্যান্টও ডিপ ব্লু। সুতরাং আঁধার তাকে গ্রাস করেছে।

বোটটা লম্বায় তিরিশ ফুট। সামনের উঁচু ডেক জুড়ে রয়েছে আট ফুট। সরু কেবিনটা নিয়েছে পনেরো ফুট জায়গা। তারপরেই পেছন দিক, ভোলা ককপিট।

কেবিনের দু-ফুট নীচে রয়েছে সামনের ডেক। কেবিনের জানলা রয়েছে এইদিকেই। ককপিটে দাঁড়িয়ে যে দুজন মোটরবোট চালাচ্ছে, তাদের দেখতে হচ্ছে কেবিনের কাঁচের জানলা দিয়ে। যেখানে ঘাপটি মেরে রয়েছে ইন্দ্রনাথ সেখান থেকে জায়গাটা খুব কাছে। ককপিটের কেউ যদি বিড়ি ধরায় আলোর আভায় দেখা যাবে ইন্দ্রনাথকে। তবে বিড়ি ধরানোর চেষ্টা কেউ করছে না। মুখে চাবি দিয়ে বোটটাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঘণ্টায় তিরিশ মাইল বেগে। গন্তব্যস্থান বেশি দুর আর নেই।

রেলিং এর ধারে বসে ইন্দ্রনাথ দেখল, অন্ধকার ডাঙা দেখা যাচ্ছে সামনে। রহস্যাবৃত সেই দ্বীপ এসে গেছে। প্লেন থেকে যেখানে প্যারাসুট নামানো হয়েছে, সেখান থেকে বেশি দূরে নয়, আধ মাইলের মধ্যেই। সময়জ্ঞান খুব প্রখর বটে প্লেন চালকের।

মোটর-গজন কমে গেছে। গতি মন্থর হচ্ছে। সামনে খাড়াই পাথর ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। দ্বীপের এদিকটা যেন ছুরি দিয়ে কেক কাটার মতন কাটা হয়েছে।

বোট আস্তে-আস্তে যাছে খাড়াই দেওয়ালের পাশ দিয়ে। ফঁক ফোকর তো কোথাও নেই। তবুও যাচ্ছে। গোপন গহ্বরের সন্ধানে নাকি?

আচমকা চোখ ধাঁধানো আলো জ্বলে উঠল খাড়াই পাথরের শীর্ষদেশে। সার্চলাইট। সোজা এসে পড়েছে মোটরবোটের ডেকে।

সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার ভেসে আসে ওপর থেকে, ডেকে ও কে?

চকিতে ডিগবাজি খেয়ে রেলিং টপকে টুপ করে জলে পড়েই তলিয়ে গেল ইন্দ্রনাথ। কিন্তু পার পেল না।

ককপিট থেকে দু-জনেই লাফ দিয়ে নেমে এসেছিল ওপর থেকে হুঙ্কারের সঙ্গে-সঙ্গে। দু জনেই তুলে নিয়েছিল দুটো বোটহুক। লম্বা লগার মাথায় লাগানো। ইন্দ্রনাথ জলে পড়তেই একটা বোটহুক ওর পেছন-পেছন এসে গেছিল জলের মধ্যে।

জল এখানে মাত্র ফুট পাঁচেক গভীর। ঘোলাটে। ডুব সাঁতার কাটা সম্ভব নয়। সে সময়ও পায়নি ইন্দ্রনাথ।

একটা বোটহুক আঁকড়ে ধরল কোমরের বেল্ট। টেনে তুলল জল থেকে বাইরে। আর একটা বোটহুক পাশ থেকে ঘা মারল মাথায়।

মাথা ঘুরে গেল ইন্দ্রনাথের। কিন্তু পুরো সম্বিৎ হারাল না। অবশ হয়ে রইল গোটা দেহ। ওই অবস্থাতেই শুনল ওপরের আর নীচের কথোপকথন।

বোটে উঠল কী করে?

তাই তো ভাবছি।

প্যারাসুট পড়বার সময় আশেপাশে মোটরবোট ছিল?

একেবারেই না।

তবে কি আকাশ থেকে খসে পড়ল?

কী করে জানব?

চোপরাও। বস যখন শুনবে, কাউকে আস্ত রাখবে না। ঠিক এই সময় জল ফুঁড়ে উঠে বসল তোমার বোটে?

চোখ রাঙাবেন না। প্যারাসুটের লোকটাকে নামিয়ে নিন, আমার কাজ শেষ।

খুব যে গরম দেখছি। একাই উঠেছে না আরও কেউ?

খুঁজে দেখতে হবে। ইনসুলিন এনেছ?

সেটা কী?

যে বডিটা জল থেকে তুলেছ, তার গায়ে একটা প্যাকেট বাঁধা আছে?

পেটের কাছে প্লাস্টিক মোড়া একটা প্যাকেট আছে।

ওইটাই ইনসুলিন। বডি আমরা নামাচ্ছি। তোমরা বোট খুঁজে দেখো, আর কেউ আছে কিনা।

ওপরের আর নীচের কথোপকথনের শুরুতেই মোটর বোটের পেছনের ডেকে রাখা দুটো পিপের ওপর থেকে সরতে শুরু করেছিল আলগা কাঠের ঢাকনা দুটো। ফঁক দিয়ে উঁকি মেরেছিল একজোড়া করে চোখ। সার্চলাইটের আলো আর মোটরবোটের ওপর পড়ছে না দেখে আস্তে-আস্তে আরও ওপরে উঠল ঢাকনা দুটো। মার্জার লম্ফনে বেরিয়ে এল দুটি ছায়ামূর্তি। সাপের মতন বুকে হেঁটে গেল ডেকের ওপর দিয়ে। রেলিং টপকে পা ঝুলিয়ে নেমে গেল জলে।

একইসঙ্গে নড়ে উঠল একটা প্যাকিং কেস। বিরাট সাইজ। পাঁচ ফুট বাই তিনফুট। ডেকের পাটাতন ছেড়ে উঠল সামান্য। বাক্সের অন্ধকারে যেন দু-টুকরো আগুন জ্বলছে। আশেপাশে কেউ নেই দেখে মাথার ওপর তুলে ফেলল গোটা প্যাকিং কেসটা। রাখল পাশের আরও প্যাকিং কেসের গাদায়।

ঠিক এই সময় পায়ের শব্দ শোনা গেল। কেবিনের দুপাশ দিয়ে দুজন এগিয়ে আসছে পেছনের ডেকে।

জ্বলন্ত-চক্ষু মানুষটা নিমেষমধ্যে হিসেব করে নিল, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে রেলিং কতদূর।

রেলিং পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে জলে ঠিকরে যাওয়ার আগেই পদশব্দের অধিকারী দুজন বেরিয়ে আসবে কেবিনের দু-পাশ থেকে। অতএব…

চোখের পলক ফেলবার আগেই ডেকের ওপর বসে পড়ে, দু-পা সামনে ছড়িয়ে দিয়ে, দুই পায়ের প্যান্টের পা টেনে তুলে, দুটো খাপ থেকে বের করল দুটি মারণাস্ত্র।

হাতলবিহীন ছোরা আর সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার। বাঁ-হাতের রিভলভার সমেত হাতটা সটান বাড়িয়ে ধরল সামনে। ডান হাতটা কনুইয়ের কাছে বেঁকিয়ে ছোরাটাকে রাখল কানের কাছে। কেবিনের দুপাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে পদশব্দের দুই মালিক। এদের একজন কুখ্যাত হাফিজজি, অপরজন তার স্যাঙাৎ। ধরাধামে তাদের আয়ু ছিল ওই পর্যন্তই।

বাঁ-হাতের রিভলভারে আওয়াজ হল খট, ডান হাতের কনুই হয়ে গেল সোজা–ছোরা আর নেই দু-আঙুলের ফাঁকে।

বিঁধেছে হাফিজজির বুকে।

বুলেট উড়িয়ে দিয়েছে তার স্যাঙাতের খুলি।

নিঃশব্দে দুটি মূর্তি আস্তে-আস্তে লুটিয়ে পড়ল ডেকের ওপর।

উঠে গেল বিদ্রোহী বর্মন। ছোরাটা বুক থেকে টেনে নিয়ে জল চামড়ার খাপে। রিভলভার গেল যথাস্থানে। এখনও তিনটে বুলেট রয়েছে সেখানে। কাজ এখনও বাকি।

যেন পিছলে গেল ডেকের ওপর দিয়ে। রেলিং টপকে জলে পড়তেই দু-পাশ থেকে দুটো হাত পড়ল তার কাঁধে।

.

ছুঁচ

জল এখানে মোটে পাঁচফুট গভীর। আপনার হাইট পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। অতএব দাঁড়িয়ে থাকুন।

কথাগুলো বলা হল কানের কাছে। বক্তার গলা চেনা। চম্পক সাহা।

দাঁড়িয়েই আছি। জবাব দিল বিদ্রোহী, এ পাশে নিশ্চয় কাকোই?

হ্যাঁ জবাবটা কাকোই-এর, আমার হাইট মোটে পাঁচ ফুট। আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। আকাশের দিকে মুখ করে আছি। কষ্ট হচ্ছে। ইন্দ্রনাথ রুদ্র ধরা পড়ল মনে হচ্ছে?

উনি ছাড়া গভীর জলে বোটে উঠবে কে? আকাশ থেকে উনিই তো ঝাঁপ দিয়েছিলেন। বাহাদুর বটে। আন্ডারক্যারেজের নকশা আঁকিয়েছিলেন আমাকে দিয়ে। কেন জানি না। গলাটা চম্পক সাহার।

আস্তে। সামনে তাকান। বিদ্রোহীর গলায় চাপা রণদামামা।

বোটের পাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছিল অন্ধকারে ঢাকা পাথুরে দেওয়াল। আচমকা সেখানে একটা বাতি দেখা গেল। পাথরের গায়ে একটা ফোকর আবিভূর্ত হয়েছে। কপাট সাইজের খানিকটা পাথর সরে গেছে। সেখান দিয়ে আলো পড়েছে জলে।

একটা লম্বা তক্তা বেরিয়ে এল ফোকর দিয়ে। পড়ল বোটের ডেকে। একটা শিথিল দেহ মানুষকে ধরাধরি করে নামিয়ে নেওয়া হল তক্তার ওপর দিয়ে। ফিরে এল একজন। মোটর বোটের ডেকে উঠে এল পাটাতন বেয়ে। হেঁকে বলল, হাফিজজি।

আবার ক্ষিপ্রগতির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে দিল বিদ্রোহী বর্মন। বিদ্যুৎ গতিতে দু-পাশের দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে গোটা শরীরটাকে তুলে নিল জল থেকে। দাঁড়িয়ে পড়ল দু-জনের কাঁধে পা রেখে। নোঙর ঝুলছিল মাথার ওপর। দু-হাতে সেটা খামচে ধরে শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে রেলিং টপকে গিয়ে পড়ল ডেকের ওপর।

হেঁট হয়েই পায়ের চামড়ার খাপ থেকে টেনে নিল মারাত্মক হাতিয়ার–দু-দিক ধারাল হাতলবিহীন ছুরিকা।

হাফিজজি সাড়া না দেওয়ায় পদশব্দ যখন এগিয়ে আসছে কেবিনের দিকে, চিতাবাঘের মতন পা টিপে টিপে তখন পদশব্দ লক্ষ করেই এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ-বাঘ বিদ্রোহী বর্মন। অপরিসীম নিষ্ঠুরতায় তুহিন কঠিন হয়ে উঠেছে দুই চক্ষু। শীতল বরফের মধ্যে ধকধকে আগুন যদি কেউ কল্পনাও না করতে পারে, তাহলে সে এখন দেখে নিতে পারে সেই দৃশ্য–বিদ্রোহীর দুই চোখ।

কেবিনের পাশ দিয়ে পায়ের আওয়াজ এগিয়ে এসেই থমকে গেল, পায়ের কাছে লুণ্ঠিত মৃতদেহ নিশ্চয় দেখেছে।

দেখেছে বিদ্রোহীকেও। মুখোমুখি। কিন্তু আর সময় পেল না বাকযন্ত্রকে চালু করার।

তার আগেই হাতটা সটান বাড়িয়ে দিয়ে তার টুটি কেটে দু-টুকরো করে দিল বিদ্রোহী।

আর ঠিক এই মুহূর্তে আকাশের চাঁদের জন্যও আর অপেক্ষা করল না শুকতারার কণ্ঠস্বর। ধ্বনিত হল বিদ্রোহীর ব্রেনের মধ্যে, বিদ্রোহী…বিদ্রোহী…তুমি কোথায়?

নিমেষে স্থাণু হয়ে গেল শ্রোতা।

সামনের ডেকে নড়ে উঠল লুণ্ঠিত মানুষটা। ইন্দ্রনাথ রুদ্র। আচমকা আঘাতে আচ্ছন্ন ব্রেন এতক্ষণে ক্লিয়ার হয়ে এসেছে। হাফিজজিকে ডাকা সে শুনেছে, পায়ের আওয়াজকে এগিয়ে যেতেও শুনেছে, ধপ করে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজও শুনেছে।

তারপর থমথমে নৈঃশব্দ্য।

অতএব সঞ্চরমান হল তার দেহসর্পিল ভঙ্গিমায়। কেবিনের পাশে গিয়ে দেখল পরপর দুটো মৃতদেহ। ওপাশে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে একটা ছায়া মূর্তি। অন্ধকারে আদল দেখেও বোঝা যাচ্ছে সে কে।

নরম গলায় বললে ইন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী, কী বলছে শুকতারা?

পাথুরে দেওয়ালের খুপরিতে ফিরে আসছে পায়ের আওয়াজ। এবার অনেকে। নিমেষে বিদ্রোহীকে ঝাঁকুনি দিয়ে ঘোর কাটিয়ে দিল ইন্দ্রনাথ। পলক ফেলবার আগেই বিদ্রোহীর দু-হাতে উঠে এল দুই মারণাস্ত্র। ইন্দ্রনাথের হাতে তার প্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র।

আর মার্ডার নয়, কড়া গলায় ফিসফিসিয়ে গেল ইন্দ্রনাথ, চম্পক আর কাকোই কোথায়?

এসে গেছি। পেছনে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বললে কাকোই, নাউ অ্যাকশন, টুগেদার।

কেরামতি দেখিয়েছে বটে চম্পক সাহা। খর্বকায় কাকোই-এর কষ্ট দেখে তাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল নিজের তালঢ্যাঙা শরীরের মাথার ওপর। নোঙর আঁকড়ে কাকোই যখন ঝুলছে, তখন তার পা ধরে উঠে এসে নোঙর ধরেছে চম্পকও।

পায়ের মালিকেরা এখন অনেকে। মোট পাঁচজন।

তক্তা বেয়ে উঠতে-উঠতে একজন বললে, বুড়োর জ্ঞান ফিরেছে। এবার টিকটিকিটাকে চাবকাব। এল কী করে এখানে?

দ্বিতীয় জন তক্তায় পা দিয়ে বললে, কিন্তু বোটের লোকেরা গেল কোথায়?

তৃতীয় জন বলে উঠল, জনসাহেব কিন্তু একটু আগেই এসেছেন। কোথায় উনি?

চতুর্থ জন বললে, দাঁড়াও?

আর দাঁড়াও। পাঁচজনকে পাঁচ রকমভাবে টার্গেটের মধ্যে পেয়ে আর কি রোখা যায় কাকোই-কে?

ইন্দ্রনাথের অগোচরে অদ্ভুত একটা যন্ত্র এনে ফেলেছিল হাতের মুঠোয়। স্প্রিং পিস্তল।

পরপর পাঁচজনকে তাগ করে চাপ দিয়ে গেল স্প্রিং-এ। নিঃশব্দে ধেয়ে গেল পাঁচটা ছুঁচ। তিনজন রইল পাথুরে দেওয়ালের সামনে, পাথুরে আলসেতে।

শক্ত গলায় বললে ইন্দ্রনাথ, ফের খুন?

নইলে এরা আমাদেরই খুন করত। নিরুত্তাপ গলায় জবাব দিল কাকোই।

জিনিসটা কী? এই প্রথম অবাক হতে দেখা গেল বিদ্রোহীকে।

সারিন, বললে কাকোই, পটাসিয়াম সায়ানাইডের চাইতে বিশগুণ পাওয়ারফুল। জাপানে নিরীহ লোক মারা হয়েছে এই দিয়ে। আমি ট্রায়াল নিলাম কুলোকের ওপর। সাকসেসফুল।

সারিন বিষে ডোবানো ছুঁচের এত শক্তি? ইন্দ্রনাথ যখন ওর বিস্ময় নিয়ে ব্যস্ত, বিদ্রোহী তখন ছিটকে গেছে তক্তার দিকে।

.

মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত

আলোকিত আলসেতে দাঁড়াতেই দেখা গেছিল পাথরের সিঁড়িটা। পাহাড়ের গায়ে গুহার পাথর কেটে তৈরি সিঁড়ি। একটু উঠেই একটা চাতাল। এখান থেকে দুদিকে উঠেছে সিঁড়ি।

কোনদিকে যাওয়া যায়?

দুভাগ হয়ে গেল চারজনের দল। ইন্দ্রনাথ আর চম্পক একদিকে। কাকোই আর বিদ্রোহী আর একদিকে।

প্রথম দল পনেরো ধাপ ভেঙেই পেল আর একটা চাতাল। চাতালের একদিকে তালা দেওয়া লোহার ফটক। তার ওপাশে কয়েদ ঘরে আলো জ্বলছে। অনেক উঁচুতে গরাদ দেওয়া একটাই জানলা। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেতে বসে রয়েছে বিধ্বস্ত চেহারার তিন পুরুষ। একজন বৃদ্ধ। তার পোশাক জলে ভিজে গায়ে লেপটে রয়েছে। দ্বিতীয়জন প্রৌঢ়। মুখ মঙ্গোলীয় ধাঁচের। তৃতীয় বয়স্ক ব্যক্তি নিঃসন্দেহে বাঙালি–পরনে ধুতি আর পাঞ্জাবি।

তৃতীয় ব্যক্তির দিকে চেয়ে লোহার ফটকের এদিক থেকে বললে ইন্দ্রনাথ, আপনি রাম ঘোষ। আপনার পাশে নিশ্চয় হিতোহিশো। ভিজে পোশাকে এখুনি অসুস্থ হবেন সুজন দেশাই। ইনসুলিন এসে গেছে–দরকার কার?

সটান হয়ে বসেছিলেন তিনজনই। মঙ্গোলীয় মুখের অধিকারী হিতোহিশো বললেন, আমার ব্লাডসুগার নরম্যাল। ইনসুলিন নিয়ে কী করব?

জড়িত গলায় ভিজে পোশাকে সুজন দেশাই বললেন, এটা কি রসিকতার সময়। রাম ঘোষ কিছু বললেন না।

ইন্দ্রনাথ তাঁর দিকে চেয়ে শুধু হাসল। পাশ ফিরে বললে চম্পককে, হাঁ করে দেখছ কী? সিঁড়ি তো উঠে গেছে আরও ওপরে, যাও ওঠ।

গিয়ে? কাঠকাঠ গলায় বললে চম্পক।

তালা ঝুলছে, চাবি আনতে হবে না? খবরদার খুন-টুন আর নয়।

খুন। কয়েদ ঘরের ভেতর থেকে বলে উঠলেন রাম ঘোষ ভরাট গম্ভীর গলায়, কে খুন হল?

আপনি চেনেন নাকি সবাইকে? ইন্দ্রনাথের প্রশ্ন।

আমি জানতে চাইছি কে খুন হল?

বলুন কজন খুন হল।

হোয়াট?

মোট আটজন। তার মধ্যে দুজন মোটরবোট চালিয়ে এনেছিল।

বাকি ছজন তো এখানকার লোক।

ছজনের গ্যাং?

ও ইয়েস।

যাচ্ছলে। চাবি কোথায় আছে কে বলবে? আপনাদের বের করব কী করে?

চাবি থাকে জনসাহেবের কাছে। কোমরের বেল্টে৷

মুশকিলে ফেললেন। দুজন তো পড়েছে জলে, এদের মধ্যে জনসাহেব যদি থাকে…

নেই, সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে-আসতে বললে বিদ্রোহী। তার পার্চমেন্ট মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু কালো চোখে ভাসছে হাসি।

সেই চোখে চোখ রেখে বললে ইন্দ্রনাথ, আসা হচ্ছে কোথা থেকে?

শুকতারার ঘর থেকে।

হয়েছে প্রেমালাপ?

মাঝে গরাদ থাকলে ওটা কি হয়?

বটে, বটে। কিন্তু চাবি তো জনসাহেবের কাছে। সে ভদ্রলোক তো পরলোকে। বডিটা কোথায়?

জনসাহেব? বোটে উঠেছিল প্রথমে? তা হলে বোটেই আছে।

চম্পকের দিকে মুখ ফেরাতেই সে হনহন করে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে।

চাবি নিয়ে একসঙ্গে তিনটে ধাপ টপকে ফিরে এল একটু পরেই। বললে, আগে খুলব কোন দরজা?

জবাব দিল বিদ্রোহী, আগে এই দরজা?

সেকি। আগে তো বউ, মিটিমিটি হেসে বললে ইন্দ্রনাথ।

আগে রহস্যের সমাধান।

সেটা কি এই ঘরের মধ্যে।

আমার তাই মনে হয়। আপনি কি অন্তর্যামী?

আমি নয়-শুকতারা।

তিনি জানেন, রহস্যের সমাধান রয়েছে এই ঘরে?

হ্যাঁ।

কী করে জানলেন?

আপনার মন পড়ে।

আ-আমার মন পড়ে? জীবনে বুঝি এই প্রথম তোতলা হয়ে যায় ইন্দ্রনাথ।

আপনার চিন্তার তীব্রতা যে বড় বেশি, ইন্দ্রনাথবাবু। রয়েছেনও শুকতারার খুব কাছে। তাই আমাকে বললে, তুমি যাঁদের সঙ্গে এসেছ, তাদের একজন খালি একটা নাম মনে-মনে জপে যাচ্ছেন। তিনি নাকি পালের গোদার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।

পালের গোদাই বটে। ইন্ডো-নিপ্পন কোম্পানির শেয়ার যাঁদের কাছে সবচেয়ে বেশি, তাঁদের সবার কাছ থেকেই কোম্পানি শেয়ার কিনে নিচ্ছে। কিন্তু এই তিন ডিরেক্টরের শেয়ার সংখ্যা জুড়লে সবচেয়ে বেশি হয়। তাই এই তিন ডিরেক্টরকে আনা হয়েছে এখানে জোর করে সই করিয়ে নেওয়ার জন্য। ঠিক কিনা?

শেষ দুটো শব্দের প্রশ্ন নিক্ষিপ্ত হল গরাদের ওদিকে ঘরের ভেতর। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন হিতোহিশো, নেভার। আই উইল নট সাইন।

সুজন দেশাই অদ্ভুত চোখে শুধু তাকিয়ে রইলেন। তার গলা দিয়ে এখন ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরচ্ছে, ঠান্ডায় জমে যাবেন মনে হচ্ছে।

কসাই, দাঁতে দাঁত পিষে বললে ইন্দ্রনাথ, কে বলুন তো? এবারের প্রশ্ন রাম ঘোষের দিকে। তিনি কোনও জবাব দিলেন না।

বিদ্রোহী বললে, এঁর নাম কী?

যে নামটা আপনার সুন্দরী বউয়ের মুখে শুনে এসেছেন। ইন্দ্রনাথের জবাব।

এবার আর কথা বলল না বিদ্রোহী। শুধু বেরিয়ে পড়ল দাঁতের সারি। নড়ল না ঠোঁট অধর। পার্চমেন্ট মুখের একটা পেশিও কাঁপল না। দুই অঙ্গার চক্ষুতে শুধু জাগ্রত হল পাশবিক চাহনি।

মধুক্ষরা হাসি হেসে ইন্দ্রনাথ বললে, নো, বিদ্রোহী নো, নো মোর মার্ডার। রাম ঘোষকে জ্যান্ত দরকার ইন্ডিয়ার সেকেন্ড গ্রেটেস্ট শেয়ার কেলেঙ্কারি ফাঁস করার জন্য। প্রথমটার নাম আবাল বৃদ্ধ-বনিতা জানে। সেই ঘটনাই প্রেরণা জুগিয়েছে শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত রাম ঘোষকে। চমৎকার পরিকল্পনা। একটাই ভুল করে ফেলেছিল ওঁর সাগরেদরা। টাকার লোভে শুকতারাকে এখানে এনে, আর তার স্বামীকে পোর্টব্লেয়ারে জ্যান্ত পৌঁছে দিয়ে। এটা ঘটেছে ওঁর পারমিশান না নিয়ে, নইলে ফুলপ্রুফ ছিল ওঁর প্ল্যান। নিজের শেয়ার বিক্রি করতেন না। সব শেয়ার নিজেই কিনে নিতেন, এক হাজার কোটি টাকার ক্যাশ রিজার্ভ এসে যেত নিজের কন্ট্রোলে। দুই ডিরেক্টরের যাতে সন্দেহ না হয়, তাই আগেই কিডন্যাপ হয়েছিলেন নিজে। সাজানো কিডন্যাপিং। তারপরেই সত্যিকারের কিডন্যাপিং হল পরপর দুবার। বলে একটু থামল ইন্দ্রনাথ। বললে স্বগতোক্তির সুরে, পরপর দুবার। পরক্ষণেই রাম ঘোষকে উদ্দেশ করে, সেগুলো তো ঘটেছে পরপর দুটো সপ্তাহে। কিন্তু তার আগের সপ্তাহে ডগলাস প্লেন একই প্যাসেঞ্জার নিয়ে কেন রওনা হয়েছিল পোর্টব্লেয়ারের দিকে? ও হো-হো, উকিলকে সামনে না রেখে আপনি কথাই বলবেন না ঠিক করেছেন। তাহলে আমি বলে দিচ্ছি– ট্রায়াল দিচ্ছিলেন। ব্যস, আর কথা নয়। চম্পক, কাকোই, চাবি ভোলা হোক এই দরজার। কিন্তু শ্রীল শ্রীযুক্ত পরম পূজনীয় রাম ঘোষ নজর ছাড়া না হন। চলুন মশায় বিদ্রোহী বর্মন। আপনার সুন্দরী শুকতারাকে আশীর্বাদ করে আসি। আশীর্বাদই তো করব? আপনি তো আমার হাঁটুর বয়সি। সেইসঙ্গে দেখব, তার মনের কথা আমি পড়তে পারি কিনা।

মোল্লার দৌড় যেমন মসজিদ পর্যন্ত, ইন্দ্রনাথের দৌড়ও যে তার বেশি নয়, তা সেই রাত্রেই প্রমাণিত হয়ে গেছিল। অবলা মেয়েদের মনের কথা জানতে পারা কি চাট্টিখানি কথা?

* স্বস্তিকা পত্রিকায় প্রকাশিত। পূজাসংখ্যা, ১৪০২।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *