স্যার আর্থার কোনান ডয়ালের গল্প নিয়ে গোয়েন্দা ধাঁধা
পাঁকে পড়েছে পটের বিবি। শার্লক হোমস
মেয়েটার নাম ভায়োলেট হান্টার।
ভায়োলেট হান্টার বাড়ি গিয়ে ছেলেপুলে মানুষ করার চাকরি করত। কিন্তু কিছুদিন হাতে কাজ নেই।
এমন সময়ে একটা অদ্ভুত চাকরি এল হাতে। মাইনে তিনগুণ। কিন্তু কাজটা যেন কেমন কেমন। বাচ্ছা মানুষ করতে হবে ঠিকই। দু-বছরের বাঁদুরে বাচ্চা। চটি দিয়ে চটাস-চটাস করে আরশুলা মারতে ওস্তাদ। কিন্তু মাস্টারনিকে মাথার চুল কাটতে হবে কেন? কেন মনিবের মেয়ের জামা পরে এখানে-সেখানে বসে থাকতে হবে?
ঝাড় মারি অমন চাকরিতে বলে পালিয়ে এল ভায়োলেট। চাকরি আগে না চুল আগে? কিন্তু বাড়ি এসে ভড়ার খালি দেখে মন বলল চাকরি আগে। এল শার্লক হোমসের কাছে। চাকরি নেওয়াটা কি ঠিক হবে?
আইবুড়ো হোমস বললে–মোটেই না।
আমতা আমতা করে ভায়োলেট বললে কিন্তু আমার যে অভাবের সংসার। বরং বেগতিক দেখলে ডেকে পাঠাব। আসবেন তো?
রাজি হল হোমস।
.
পনেরো দিন পরে ডাক এল। অমুকদিন এগারোটায় ব্ল্যাক সোয়ান সরাইখানায় আসা চাই।
যথাসময়ে দুই বন্ধু এসে পৌঁছল সরাইখানায়। ভায়োলেট সত্যি-সত্যিই মাথার চুল কেটে ফেলেছে। দিন দুয়েক ভালোই কেটেছিল। মনিব ভদ্রলোক চোয়াড়ে হলেও খারাপ ব্যবহার করেননি। মনিবানি তার দ্বিতীয় পক্ষের তরুণী ভার্যা। প্রথম পক্ষের মেয়ে আমেরিকা চলে গিয়েছে নতুন মায়ের সঙ্গে বনিবনা হয়নি বলে। বিরাট বাড়ি। নাম কপারবিচেস। একটা রাক্ষুসে ডালকুত্তা বাড়ি পাহারা দেয় সারারাত। কুকুর দেখবার ভার যার ওপর নাম তার টলার। ভীষণ মদ খায়।
মনিবের নাম রুক্যালস। মিসেস কিন্তু অষ্টপ্রহর বিষাদ সিন্ধুতে ডুবে রয়েছেন। মাঝে-মাঝে চোখের জলও ফেলেন।
দিন দুই পরে মিসেস মিস্টারের কানে কানে কী যেন বললেন। অমনি রুক্যালস বললেন– নাও উঠে পড়ো। নীল পোশাকটা পরে এসো। দেখি কেমন মানায়।
হুকুম তামিল করল ভায়োলেট। নিশ্চয় রুক্যালসের প্রথম পক্ষের মেয়ের পোশাক। এসে বসল জানলার দিকে পিঠ করে একটা চেয়ারে। সামনে দাঁড়িয়ে অনেক মজার মজার কথা বলে ভায়োলেটের পেটের খিল খুলে ছেড়ে দিলেন রুক্যালস।
তারপরের দিনও একই কাণ্ড ঘটল। নীল পোশাক পরে জানলার দিকে পিঠ করে বসে রইল ভায়োলেট। মনিবের হুকুমে এবার বই থেকে কিছু কিছু পড়ে শোনাতে হল। কিন্তু বেশ মনে হল পেছনে কিছু একটা ঘটছে–যা শুধু মনিব আর মনিবানিই দেখতে পাচ্ছেন।
কুচুটে বুদ্ধিতে ভায়োলেটও কম যায় না। তৃতীয় দিন একটা ভাঙা আয়না রুমালের মধ্যে নিয়ে বসে রইল চেয়ারে। হাসির ফাঁকে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে আয়নার মধ্যে দিয়ে দেখে নিল পেছনের রাস্তায় ছাই রঙের পোশাক পরা একটা ছোট্ট মানুষ একদৃষ্টে তাকে দেখছে।
মিসেস রুকলস তার চালাকি ধরে ফেলেছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন কর্তাকে–দেখে তো কে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্যাট-প্যাট করে দেখছে মিস হান্টারকে।
তাই নাকি? ভায়োলেট ওকে হাত নেড়ে বলল চলে যেতে।
হাত নাড়ল ভায়োলেট। মিসেস সঙ্গে-সঙ্গে পরদা টেনে দিলে জানালায়।
রহস্য আরও জট পাকিয়ে উঠল এরপর। বাড়ির একটা অংশে সবসময়ে তালাচাবি লাগানো থাকত। সেই অংশেরই পেছন দিকের জানলাগুলোর একটা জানলার খড়খড়ি তোলা দেখে খটকা লাগল ভায়োলেটের মনে। বাইরে তালা ঝুলছে কেন? তারপরেই একদিন দেখা গেল নিষিদ্ধ অংশে চুপিসারে ঢুকলেন রুক্যালস–বেরিয়ে এলেন পা টিপে টিপে কিছুক্ষণ পরেই।
অতশত না ভেবে মনিবকে জিগ্যেস করেছিল ভায়োলট–জানলার খড়খড়ি কে তুলে রেখেছে? শুনেই চমকে উঠলেন চোয়াড়ে মনিব। ভুরু কুঁচকে ব্যঙ্গের স্বরে বললেন–তাই নাকি? সবদিকেই নজর আছে দেখছি। ওটা আমার ডার্করুম। বুঝেছ।
রুক্যালসের মেয়ে আগে যে ঘরে থাকত সেই ঘরেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল ভায়োলেটের। দৈবাৎ একটা দেরাজ খুলে ফেলেছিল নিজের চাবির গোছা দিয়ে। ভেতর থেকে বেরোল একগোছা ভারী সুন্দর মাথার চুল। তারই মাথার চুল।
নিজের মাথার চুল কেটে ফেলেও দ্বন্দ্ব মিটোনোর জন্যে তোরঙ্গ খুলে দেখল। তোরঙ্গে চুল তুলে রেখেছিল ভায়োলেট। যেখানকার চুল সেখানেই আছে। দেরাজের মধ্যে অবিকল একরকম চুলের গোছাটা তাহলে কার?
এ তো ভারী সমস্যার ব্যাপার। ভায়োলেটের বুকের মধ্যে গুড়গুড়ানি আরম্ভ হল সেই থেকে। এমন সময়ে একদিন দেখা গেল নিষিদ্ধ অংশের দরজায় চাবি ঝুলছে। ভুল করে ঝুলিয়ে গেছেন রুক্যালস। বাচ্চাটাও রয়েছে স্বামী-স্ত্রীর কাছে।
এই তো সুযোগ। টুক করে ভেতরে ঢুকল ভায়োলেট। লম্বা গলি শেষ হয়েছে একটা বন্ধ দরজার সামনে। পাল্লা দুটো বাইরে থেকে হুড়কো দিয়ে পাকাঁপোক্তভাবে বন্ধ করা। অথচ ফঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে অন্ধকারের মধ্যে একটা ছায়ামূর্তির নড়াচড়া।
দেখেই ভয়ে প্রাণ উড়ে গেল ভায়োলেটের। দুপদাপ করে বেরিয়ে এসে পড়বি তো পড় রুক্যালসের দু-বাহুর মধ্যেই। ভদ্রলোক দাঁত কিড়মিড় করে শুধু একটা কথাই বললেন–ফের যদি চৌকাঠ মাড়াতে দেখি তো ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়াব বুঝেছ?
খুব বুঝেছিল ভায়োলেট। এ বাড়িতে পা দেওয়ার পরেই রুক্যালস খুব মিষ্টি করে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন বাছুরের মতো প্রকাণ্ড ডালকুত্তাটা দেখিয়ে। রাত্রে বেরোলে আর নিস্তার নেই।
তাই আজ দিনের বেলায় হোমসকে ডেকে এনেছে ভায়োলেট। কর্তাকে মিথ্যে বলে এসেছে। ফিরতে হবে তিনটের মধ্যে। সন্ধ্যায় কর্তা-গিন্নি অবিশ্যি বাড়ি থাকবেন না। টলার মদ খেয়ে বেহুশ। কুকুরটা ঘরে বন্ধ।
লাফিয়ে উঠল হোমস–তাই তো চাই। আপনি বাড়ি গিয়ে টলারের বউকে ঘরে পুরে শেকল তুলে দেবেন। সাতটার সময়ে আমরা আসছি।
ঠিক সাতটার এল দুই বন্ধু। রহস্যে ঘেরা অন্ধকার পুরিতে প্রবেশ করে গায়ের জোরে সেই বিশেষ দরজাটা ভেঙে কী দেখল?
পাখি উড়েছে। স্কাইলাইট খোলা–একটা মই নেমে গেছে বাইরে।
আচমকা বজ্রনাদ করে আবিভূর্ত হলেন রুক্যালস। বাইরের লোকজন আর ভাঙা দরজা দেখেই দৌড়ে গিয়ে খুলে দিলে ডালকুত্তাকে।
ফলটা হল সাংঘাতিক। দু-দিনের উপোসী ডালকুত্তা খাক করে কামড়ে ধরল মনিবের টুটি। ওয়াটসন গুলি করে মারল ডালকুত্তাকে। মিসেস রুক্যালস ছুটলেন ডাক্তার ডাকতে।
শেকল খুলতেই বেরিয়ে এল টলারের তালগাছ বউ। বিরক্ত হয়ে বললে–এত কাণ্ডর দরকার ছিল না। আমাকে বললেই তো হত।
জানি, বললে হোমস। আপনিই আজকের নাটকের জোগাড়যন্ত্রর করেছেন। স্বামীকে মদ খাইয়ে বেহুশ রেখেছেন। স্কাইলাইটের সামনে মই রেখে ওদের পালাতে সুযোগ দিয়েছেন।
কাদের?
.
গোয়েন্দা ধাঁধার সমাধান
রুক্যালসের প্রথম পক্ষের মেয়ে আর তার হবু বরকে। বিয়ে করলে মেয়ের ভাগের সম্পত্তি পাছে হাতছাড়া হয়ে যায়, তাই একটা দলিল সই করিয়ে নিতে চেয়েছিল রুক্যালস। চূড়ান্ত অত্যাচার করেছে–মেয়ে রাজি হয়নি। এদিকে তার হবু বরকেও ঠান্ডা রাখা দরকার। তাই ভায়োলেটকে দিয়ে মেয়ের পার্ট করিয়েছে ছোকরাকে ভুলিয়ে রাখবার জন্যে। কিন্তু টলারের বউ যে তলায়-তলায় হবু বরের টাকা খেয়ে কাজ এগিয়ে রেখেছে তা কে জানত?
*সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় প্রকাশিত। ১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮২।