1 of 2

নিরুদ্দেশ নীলকান্তমণি

নিরুদ্দেশ নীলকান্তমণি

ইন্দ্রনাথের একটা বদখেয়াল আছে। হাতে যখন কোনও কাজ না থাকে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তাতে ওর মন প্রসন্ন থাকে।

এইভাবেই একদিন বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে। তখন সকাল সাতটা। চলে এল বেলেঘাটা মেন রোডে। চলল শিয়ালদার দিকে।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই খেয়াল হল, ওর হাত দশেক দূরে সামনে হাঁটছে লুঙ্গিপরা আধবুড়ো একটা লোক। গায়ে হলুদ হাতকাটা গেঞ্জি। তার হাতে একটা সাদা কাপড়ের থলি। মাঝে-মাঝে সে থমকে দাঁড়াচ্ছে, হেঁট হচ্ছে, থলি থেকে রাধাচূড়া ফুল বের করে ফুটপাতে ফেলছে, ফের সিধে হয়ে হাঁটছে।

পাগল নাকি? কিন্তু আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার যে দেখা যাচ্ছে উলটোদিকের ফুটপাতে। সেখানে হনহন করে হাঁটছে হাফপ্যান্ট পরা একটি ছেলে। বছর বারো বয়স। গা খালি। আশপাশের বস্তির ছেলে নিশ্চয়। এ-ফুটপাতের আধবুড়ো যেই হেঁট হয়ে ফুল ফেলছে, ও ফুটপাতের ছেলেটা তক্ষুনি খড়ি দিয়ে পাশের বাড়ির দেওয়ালে গোল কেটে মাঝখানে ক্রুশ চিহ্ন দিচ্ছে।

এ তো ভারি মজার খেলা। নাকি বদমায়েশির যোগসাজস?

এইভাবে মোট উনিশবার ফুল ফেলা হল, উনিশবার দেওয়াল লিখন হল–তারপরেই আধবুড়ো লোকটা রাস্তা পেরিয়ে চলে গেল ছেলেটার কাছে। প্যান্টের পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে ছেলেটা দিল আধবুড়োর হাতে। দুজনে মিলে দরজা খুলে ঢুকে গেল একটা বাড়ির মধ্যে।

বাড়িটা তিনতলা। নিচে দোকানপাট। ওপরের জানলাগুলো বন্ধ।

সদর দরজা খোলাই রয়েছে। ইন্দ্রনাথও ঢুকে গেল ভেতরে। সিমেন্ট বাঁধাই পুরোনো সিঁড়ি ওপরে উঠেছে দরজার ডানপাশ থেকে। দোতলায় চাতালে দাঁড়িয়ে দেখল, লম্বা গলিপথ অন্ধকার। সব ঘর বন্ধ। এমন সময় কানে এল দুমদাম শব্দ তিনতলা থেকে। জিনিসপত্র ভাঙচুর চলছে।

এক-এক লাফে চারটে করে ধাপ টপকে তিনতলার চাতালে পৌঁছে গেল ইন্দ্র। লম্বা গলিপথে আলো এসে পড়েছে একটা খোলা দরজা দিয়ে। ঝড়ের বেগে পৌঁছল দরজার সামনে, দেখল সেই আধবুড়ো আর ছেলেটা দুখানা চেয়ার মাথার ওপর তুলে মেঝেতে আছড়ে-আছড়ে ভাঙছে।

হুঙ্কার ছেড়ে চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল ইন্দ্রনাথ। সঙ্গে-সঙ্গে পেছনে শোনা গেল কৌতুক-তরল কণ্ঠস্বর–সুপ্রভাত, ইন্দ্রনাথ রুদ্র।

সবেগে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ইন্দ্র। দেখেছিল, কালো চশমাপরা, কালো দাড়িওলা, ঘি রঙের সাফারি সুট গায়ে এক সুদর্শন পুরুষ দাঁত বের করে হাসছে।

কড়া গলায় বলল ইন্দ্র, কে আপনি? এ সব কী হচ্ছে?

পকেট থেকে একখানা একশো টাকার নোট বের করে আধবুড়ো আর ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল সুদর্শন পুরুষ, তোমাদের কাজ শেষ। একশো টাকায় রফা হয়েছিল–দিয়ে দিলাম। যাও।

কান এঁটো-করা হাসি হেসে দুই মূর্তিমান বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অক্ষত একটা চেয়ার টেনে নিয়ে টেবিলের পাশে বসল সুন্দরদেহী পুরুষ। বললে, বসুন ওই চেয়ারটায়। আস্ত আছে। চিনতে পারলেন না আমাকে?

চোয়াল শক্ত করে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ। বুঝল, বিরাট একটা রঙ্গ হচ্ছে তাকে নিয়ে।

সুদর্শন পুরুষ কালো চশমাটা খুলে বললে, এবার?

পৈশাচিক ওই বেড়াল-চোখ কি ভোলা যায়? দাঁতে দাঁত পিষে ইন্দ্রনাথ বললে, চন্দ্রকান্ত মল্লিক?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার ভাষায় আমি নাকি পাঁকাল মাছ। ধরেও ধরা যায় না। অবশ্য আমার মতোন সমাজবিরোধীর সঙ্গে টক্কর দিয়ে আপনি বেজায় খুশি হন–ঠিক কিনা?

ইন্দ্রনাথ বললে, ইয়ার্কি হচ্ছে?

চন্দ্রকান্ত বললে, জীবনটাই বিষ হয়ে গেল আমার। আপনার সঙ্গে ইয়ার্কি? ছিঃ! ছিঃ! আমি ডাকলে কি আপনি আসতেন? আসতেন না। তাই খেলিয়ে আনতে হল। রাস্তায় যদি না বেরোতেন– ওই দুজন অন্য খেলা দেখাত।

দরকারটা কী?

আপনাকে একটা মাথার খোরাক উপহার দিতে চাই–যা পেলে আপনি আনন্দ পান।

ইন্দ্রনাথের এক চোখে বিরক্তি, আর এক চোখে কৌতূহল দেখা গেল।

চন্দ্রকান্ত কালো চশমাটা পরে নিয়ে বললে, কাল রাত এগারোটা নাগাদ বিদ্যাসাগর সেতুর তলা দিয়ে একটা লঞ্চ যাচ্ছিল। সেতুর ওপর থেকে একটা কাগজের প্যাকেট ফেলা হয় গঙ্গার দিকে কিন্তু সেটা পড়ে লঞ্চের ওপর। এই সেই প্যাকেট।

নীল নাইলন দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা কাগজের প্যাকেট টেবিলের ওপর রাখল চন্দ্রকান্ত মল্লিক। ইন্দ্রনাথ তাতে হাত দিল না। মুচকি হাসল চন্দ্রকান্ত। খুলল নাইলন দড়ির গিঁট। দুহাতে কাগজটাকে চেপে-চেপে মেলে ধরল টেবিলের ওপর। জিনিসগুলোকে সাজিয়ে রাখল কাগজের পাশে।

একটা ছোট ছোরা–ফলাতে লেগে শুকনো রক্ত। একটা পেতলের মোমবাতি স্ট্যান্ড বেশ ভারি। একটা লাল সিল্কের স্কার্ফের আধখানা–তাতেও জায়গায়-জায়গায় লেগে শুকনো রক্ত। আর, একটা কঁচি।

কেউ আর কথা বলছে না। ইন্দ্রনাথ চেয়ে আছে জিনিসগুলোর দিকে–চন্দ্রকান্ত চেয়ে আছে ইন্দ্রনাথের দিকে–তার মুখে দুজ্ঞেয় হাসি।

ইন্দ্রনাথের চোখ কিন্তু শক্ত হয়ে উঠেছে।

খুব আস্তে সে বললে, খুন হয়েছে একটি মেয়ে। পোশাকে শৌখিন। বলে, কাগজটা উলটেপালটে দেখল, খুনি রেস খেলে। রেসের মরশুমে সন্ধের দিকে এই কাগজ বেরোয়। কিছু বাড়িতে কুরিয়ার ডেলিভারি দেয়। ব্রাউন র‍্যাপারের একটা কোণ আঠা লেগে সেঁটে রয়েছে কাগজে এই ব্যাপারে লেখা ছিল ঠিকানা। কাগজ রেখে তুলে নিল আধখানা স্কার্ফ। চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে রৌদ্রালোকিত জানলার কাঁচে চেপে ধরতেই দেখা গেল হাতের ছাপটা। রক্তমাখা হাতে স্কার্ফ খামচে ধরার ফলে পাঞ্জার ছাপ উঠেছে অসমানভাবে–কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, ছাপটা ডানহাতের।

ইন্দ্র বললে, খুনি ছোরা মারার পর ডানহাতে স্কার্ফ খামচে ধরে বাঁ-হাতে কঁচি দিয়ে কেটেছিল–এই সেই কাঁচি। খুনি ল্যাটা।

তন্ময় হয়ে শুনছে চন্দ্রকান্ত। মুখের হাসি অম্লান, তারপর?

ইন্দ্রনাথ তখন দেখছে, স্কার্ফের প্রান্তের লাল ঝুমকো। সন্তর্পণে প্রতিটি লাল সুতো ফাঁক করে দেখবার পর খসে পড়ল একটা ছোট্ট জিনিস–খুট করে পড়ল মেঝেতে।

সঙ্গে-সঙ্গে চিতাবাঘের মতোন চেয়ার থেকে ছিটকে এসে ছোঁ মারতে গেছিল চন্দ্রকান্ত– তার আগেই বস্তুটা বাঁ-হাতে তুলে নিয়ে ডানহাত সামনে বাড়িয়ে ধরে বললে ইন্দ্রনাথ, তিষ্ঠ। আর এগোলেই বিপদ।

বক্তা যে মিথ্যে বলছে না, তা বুঝল শ্রোতা। দাঁড়িয়ে গেল ওইখানেই। এখন কালো চশমার আড়ালে তার চোখ ধকধক করে জ্বলছে।

ইন্দ্র বললে, বুদ্ধি আছে তাহলে। বলেই, দু-হাতে বস্তুটা ধরল চোখের সামনে। লাল সুতো দিয়ে ঘন প্যাটার্ন বুনে মোড়া হয়েছে জিনিসটাকে। নখ দিয়ে খুঁচিয়ে সুতো সরিয়ে দেখে নিল ইন্দ্র। দেখাল চন্দ্রকান্তকে।

বললে, লকেট। ওপরে লেখা রয়েছে মাউন্ট মেরি। বম্বের কাছে এই চার্চে এরকম লকেট পাওয়া যায়। গলায় পরে থাকলে কপাল খুলে যায়–চন্দ্রকান্ত মল্লিক, মুখ দেখেই বুঝেছি, আপনি লকেট নয়–অন্য কিছু আশা করেছিলেন। তাই এত কষ্ট করে জিনিসগুলো বয়ে এনেছেন। খুনিকে আপনি চেনেন?

চিনি। নাম বলব না।

তার কাছেই জেনেছেন, মেয়েটাকে খুন করলে পাওয়া যাবে অত্যন্ত দামি একটা জিনিস। সাইজে ছোট হলেও খুব দামি।–রত্ন?

নীলকান্তমণি। দারুণ লাকি স্টোন। কিন্তু মেয়েটার নাম-ঠিকানা বলেনি পাছে আমি নীলকান্ত হাতিয়ে নিই। খুনির ঠিকানা? মাপ করবেন, আমরা নিচের তলার মানুষ, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা কখনও করি না। গঙ্গার ধারে কাছেই থাকে। খুঁজে নিন। এখন বাজে আটটা। পুলিশ লাশ নিয়ে নিশ্চয় মাথা ঘামাচ্ছে। যান, দেখুন যদি পান নীলকান্তমণি।

খুনি পায়নি?

না। মেয়েটার ঘরেই আছে। ভালো কথা, প্যাকেটের মধ্যে পেতলের মোমবাতি স্ট্যান্ড কেন ছিল, সেটা কিন্তু বলেননি।

প্যাকেট ভারি করবার জন্যে–যাতে জলে পড়েই ডুবে যায়।

কিন্তু পড়ল লঞ্চের ওপর। কার লঞ্চ? সরি, সিক্রেট আউট করা যাবে না। প্যাকেটের নাইলন দড়ির ব্যাখ্যাটা আমার মুখেই শুনে নিন। খুনি ওই দড়ি গলায় পেঁচিয়ে ঘাড় পর্যন্ত ভেঙে দেয়–ওস্তাদ কারিগর। দড়িটা সঙ্গে এনেছিল সেই কারণেই। চললাম।

বলে, মিঠে হেসে, লম্বা-লম্বা পা ফেলে, ঘর থেকে বেরিয়ে গেল চন্দ্রকান্ত মল্লিক।

পুলিশের দপ্তর থেকে খবর নিয়ে নটা নাগাদ অকুস্থলে পৌঁছে গেল ইন্দ্রনাথ। রেসকোর্সের ধারে, ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলার লণ্ডভণ্ড ঘর, শুয়ে আছে মেয়েটা। বয়স তিরিশের মধ্যে। ফরসা, সুন্দরী, সুসজ্জিতা। প্রসাধনের পুরু প্রলেপ ভেদ করে ফুটে বেরুচ্ছে ভয়াবহ আতঙ্ক। পরপর দুবার ছোরা মারা হয়েছে বুকে। গোলাপী সালোয়ার কামিজ রক্তে ভিজে গায়ে লেপটে রয়েছে। ওড়নার বদলে লাল সিল্কের স্কার্ফ ব্যবহার করে মেয়েটি। কঁচি দিয়ে কাটা আধখানা স্কার্ফ চেপে রয়েছে শক্ত মুঠোর মধ্যে।

গলায় কিন্তু নাইলন দড়ির ফঁস লাগানো হয়নি। সাদা কোনও দাগ নেই, পুলিশ ডাক্তার বললেন, স্কার্ফ পেঁচিয়ে আগে দমবন্ধ করা হয়েছে–ছোরা মারা হয়েছে তার পরে।

তদন্তকারী অফিসার বীরেন শাসমলকে ইন্দ্রনাথ বললে, খুনিকে ধরে দেব আজ রাতেই। কিন্তু আমার একটা কথা রাখতে হবে।

বলুন?

কাগজের এই প্যাকেটটা ততক্ষণ কাছে রাখব। ফেরত দেব খুনির সামনে।

ধূর্ত চোখে সন্দেহ বিছিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাজি হলেন আই. ও.।

তখন বাজে এগারোটা। বারোটা নাগাদ গঙ্গার ধারে এক নামী কুরিয়ার-এর অফিসে দেখা গেল ইন্দ্রনাথকে। ম্যানেজারের চেম্বারে বসে বললে, রেসের এই সান্ধ-দৈনিক কোন কোম্পানি পৌঁছে দেয় বাড়ি-বাড়ি?

ম্যানেজার খুব চৌকস ছোকরা। নামেই মাদ্রাজি–বাংলা বলে যে-কোনও বাঙালির চাইতে ভালো। প্যাকেটের কাগজ দেখেই বললে, আপনাকে বেশি ঘুরতে হবে না। একাগজ আমরাই ঘরে ঘরে পৌঁছে দিই–আমাদের এলাকায়।

গত সন্ধ্যায় যাদের ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাদের নাম-ঠিকানা দেবেন?

নিশ্চয়।

আটজনের নাম-ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে গেল ইন্দ্রনাথ। সবই আলিপুর, খিদিরপুর, রেসকোর্স অঞ্চলে। ট্যাক্সি নিয়ে চতুর্থ ঠিকানায় পৌঁছে দেখল, সেটাও ফ্ল্যাটবাড়ি। খিদিরপুর অঞ্চলে। কেয়ারটেকার বললে, আশু দাস? কাল রাত আটটায় কাগজ ডেলিভারি হয়েছে নটায় আমার কাছ থেকে নিয়ে বেরিয়ে গেছিলেন, ফিরেছেন রাত বারোটা নাগাদ।

ফ্ল্যাটে আছেন এখন?

খেতে বেরিয়েছেন। একা মানুষ তো–ব্যাচেলর। ফিরবেন এখুনি।

তাহলে বসে যাই, বলে কেয়ারটেকারের টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে পড়ল ইন্দ্রনাথ।

আধঘণ্টাও গেল না। বটলগ্রীন কালারের একটা মারুতি ঢুকল উঠোনে। গাড়ি থেকে নামল ব্লু-জিনস্-এর প্যান্ট আর ইট রঙের ডবল-পকেট শার্ট পরা এক কৃশকায় পুরুষ। টকটকে ফরসা, হিলহিলে শরীর এবং বিলক্ষণ সুদর্শন। যদিও বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। সরু গোঁফের দু-চারটে সাদা চুলে তার আভাস রয়েছে।

একহাতে একটা ছড়ি নিয়ে সে দরজার সামনে এগিয়ে আসতেই কেয়ারটেকার বললে, আসছেন।

ভেতরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা হিরো-হিরো চেহারার এক মানুষ তারই দিকে চেয়ে আছে দেখে প্রথমে থমকে দাঁড়াল আশু দাস। চোখে হিম চাহনি।

পরের মুহূর্তেই ঝট করে সরে গিয়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল পাশের দরজায়। ডানহাতে ছড়িটা সামনে বাড়িয়ে ধরে বাঁ-হাত চালান করলে পেছনে–খুঁজছে দরজার হাতল।

ইন্দ্রনাথ প্রথমে তাই ভেবেছিল। দরজার হাতল ঘুরিয়ে ভেতরে সটকান দেওয়ার ধান্দায় আছে আশু দাস। তাই ছড়ির ভয় না করে দু-পা সামনে এগোতেই মনে পড়ে গেল নিজেরই কথা সকালেই বলেছিল চন্দ্রনাথকে।

খুনি ল্যাটা।

নিমেষে একপাশে ছিটকে গেছিল বলেই পর-পর দুটো বুলেটের কোনওটাই গায়ে লাগেনি। হিপ পকেট থেকে এত দ্রুত রিভলভার বের করার দৃশ্য কেবল সিনেমাতেই দেখা যায়।

তৃতীয়বার ট্রিগার টেপবার সময় দেয়নি ইন্দ্রনাথ।

আধঘণ্টার মধ্যে এসে গেলেন আই. ও. বীরেন শাসমল। ইন্দ্রনাথের রামরা খেয়ে বেহুঁশ আশু দাসকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেলেন তারই ফ্ল্যাটে। টুরুম ফ্ল্যাট। খাটের ওপরেই পাওয়া গেল নীল নাইলন দড়ির একটা গোলা। প্যাকেটের দড়ি যে এই গোলা থেকেই কেটে নেওয়া হয়েছে, তা কাটা প্রান্ত দুটো মেলাতেই পরিষ্কার হয়ে গেল।

ইন্দ্র বললে, আশু দাস, আপনার জ্ঞান এখন টনটনে। পম্পাকে যে আপনিই খুন করেছেন, সে প্রমাণ আমাদের হাতে। কিন্তু, দড়ির ফাস না লাগিয়ে স্কার্ফ দিয়ে দমবন্ধ করলেন কেন?

হিমচোখে ইন্দ্রনাথকে নিরীক্ষণ করে নিয়ে আশু দাস বললে, পম্পার লাভার নাকি?

আজ্ঞে না। তবে, আপনার মতোই ব্যাচেলর–কিন্তু চরিত্র খোয়াইনি। পম্পা সান্যাল তো বেলি ড্যান্সার। হোটেলে-হোটেলে নাচ দেখাত। লাকি নীলকান্তমণির খোঁজে পেছনে লেগেছিলেন? রিয়্যাল লাভ নয়? ছি!

পাওয়া গেছে নীলকান্ত?

গেছে, ছোট্ট হাসল ইন্দ্রনাথ, এখুনি দেখবেন।

ঘরেই ছিল?

ছিল। আপনার চোখের সামনেই–আপনার হাতের মুঠোয়।

আমার হাতের মুঠোয়?

আমার প্রথম প্রশ্নের জবাব কিন্তু এখনও পাইনি। সঙ্গে নাইলন দড়ি নিয়ে গেছিলেন গলায় ফঁস লাগাবেন বলে। কিন্তু দড়ি রইল পড়ে–পাঁচ দিলেন স্কার্ফ দিয়ে। কেন?

আশু দাস নিরুত্তর।

জবাবটা দিল ইন্দ্রনাথই, স্কার্ফের ঝুমকোর গিট খুললেই নীলকান্তমণি পাবেন বলে। তাই না?

আমাকে তো তাই বলল।

হাতও চালালেন সঙ্গে-সঙ্গে। স্কার্ফ দিয়েই খতম। গিঁট খুললেন–দেখলেন মাউন্ট মেরির লকেট। ঘর তছনছ করলেন। কিছু না পেয়ে খুনের সব প্রমাণ গুছিয়ে নিলেন প্যাকেটে। এই সেই প্যাকেট। এর মধ্যে রাখলেন মোমবাতি স্ট্যান্ড। এই সেই স্ট্যান্ড। জমাট মোম খোদল থেকে কেন বের করলেন না আশু দাস?

বলে, খোঁদলের মোম খুঁচিয়ে বের করল ইন্দ্রনাথ।

দেখা গেল, নীল সূর্যের মতোন জুলন্ত সেই পাথর…নীলকান্ত মণি।

.

নবকল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত। (শারদীয় সংখ্যা, ১৪০২)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *