সবুজফল ও শ্বেতসুন্দরী
নোগোনে ক্ৰীয়ের হলদে জলে বিদ্যুৎবেগে দাঁড় টানতে টানতে বললে জো–মিঃ গড, যমের মুখে যাচ্ছেন কিন্তু।
ক্যানোর মুখে দাঁড়িয়ে ধর্মের বই পড়ছিল সুদর্শন এক তরুণ। চোখ তুলে হেসে বললে– বলছি না, আমাকে মিঃ গড বলবি না?
উকো দিয়ে ঘষা দাঁত বার করে হাসল পাপুয়ান।
–কেন বলব না? আপনি তো ভগবানের দূত। মিঃ গড। কিন্তু বড় বোকা। শিগগিরই মরে ভূত হবেন।
–তা হলে এলি কেন আমার সঙ্গে?
–ভয় পাই না বলে।
বইটার পাতায় চিহ্ন দিয়ে মুড়ে রাখল তরুণ পাদ্রী। বললে হল্যানডিয়ার বর্বরদের মতই কি এরা বিপজ্জনক?
–তার চাইতেও খারাপ। এরা মানুষ খায়।
–বলিস কিরে?
–আজ্ঞে। আমার বাবা ওদের নজনকে খেয়েছিল লড়াই জেতার পর। সে কী পেট কামড়ানি। সাধুদের পেটে মানুষ সয় না।
–বাবার মত তুইও মানুষ খাস নাকি?
–দরকার কী? আমার কি খাবারের অভাব?
ঠিক এই সময়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত একজন দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে ঝলক রক্ত উঠে এসে ছলকে পড়ল পাদ্রীর সাদা গাউনে। মুখ থুবড়ে পড়ল সে ক্যানোর মধ্যে। পিঠে একটা তির। সবুজ টিয়ার পালকগুলো কেবল বেরিয়ে রয়েছে বাইরে।
জলের ধারে ম্যাড়মেড়ে লাল অর্কিডের মধ্যে কী যেন নড়ে উঠল।
হতভম্বের মতো সবুজ পালকের দিকে তাকিয়ে বললে তরুণ পাদ্রী–জো, এ তো দেখছি—
হ্যাঁচকা টানে পাদ্রীকে ক্যানোর মধ্যে শুইয়ে দিয়ে জো বললে–উপুড় হয়ে শুয়ে থাকুন। দেখলেন তো, জো মিথ্যে বলে না।
খেপে গেল পাদ্রী–জো, ওল্ড টেস্টামেন্ট যা বলেছে, এখন ঠিক তাই করব। রাইফেলটা দে।
–শুয়ে থাকুন।
কক্ষনো না। খুনেদের ঢিট করতে ওল্ড টেস্টামেন্টই দরকার। দে রাইফেল আমার। ঠিক আছে। দাঁড় করা ক্যানো।
অর্কিডের দিকে ৩০৩ উদ্যত হতেই সবেগে নিক্ষিপ্ত হল অর্কিডের একটা লতা–সে জায়গায় আবির্ভূত হল একটা মুখ।
বিকট মুখ। কপাল আর চিবুকে কমলা কাদা। থ্যাবড়া নাকের দুদিক দিয়ে বেরিয়ে একটা লম্বা রূপোলি হাড়। ক্রুর দু-চোখে জ্বলন্ত চাহনি। পরমুহূর্তেই মুখ ঢেকে উঠে এল একটা ধনুক।
সঙ্গে-সঙ্গে গর্জে উঠল পয়েন্ট তিন-শুন্য-তিন। শূন্য পথে ধেয়ে এল একটা তির। বিধল গাছের ডালে। পাকসাট খেয়ে জল থেকে লাফিয়ে উঠেই মুখ থুবড়ে পড়ল একটা উলঙ্গ পুরুষ।
–সাবাস! দারুণ হাত তো আপনার।
–যাচ্ছলে! মরে গেছে দেখছি।
জো একাই দাঁড় টানতে লাগল দুই হাতে। মৃত দাঁড়িকে ফেলে দেওয়া হল জলে ভার কমানোর জন্যে। ধর্মের বই খুলে আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা শেষ করে পাদ্রী বললে গ্রামে গিয়ে কি এইরকম অভ্যর্থনাই পেতে হবে, জো?
–গাঁয়ের লোক খারাপ। তার চাইতেও খারাপ সাদা মানুষ।
–কেন?
–শয়তানের জল খাওয়ায়। সোনালি পাখির চামড়া নিয়ে যায়।
চুপ করে রইল পাদ্রী। জিন মদের চালান দিয়ে বার্ড অফ প্যারাডাইজের চামড়া কিনে নিয়ে যায় একজন শ্বেতাঙ্গ। এই জঙ্গলে। ডাচ নর্থ নিউগিনির প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে মৃত্যু ওৎ পেতে আছে। কিন্তু সেখানেও পাপের ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছে একজন। কে সে?
সূর্য ডুবে গেল। নোগোনে গ্রামের ছায়ায় এসে ক্যানো ভিড়ল।
এক হাতে বাইবেল, আর এক হাতে রাইফেল নিয়ে তিরে নামল পিটার থারপ্তরুণ পাদ্রী। গোধূলির ম্লান আলোয় দেখল, সারি-সারি কুঁড়েঘর দানবিক মাকড়সার মতো খাড়া লিকপিকে সরু সরু ঠ্যাঙের ওপর।
হাঁক দিল জো। গাঁয়ের লোক এল সেই হাঁক শুনে। উলঙ্গ জংলি। পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল গাঁয়ের নতুন পাদ্রীকে।
বিরাট অগ্নিকুণ্ডের সামনে এসে দাঁড়াল পিটার। আগুনের পাশে আটটা খুঁটির ডগায় লাগানো আটটা বিকট নরমুণ্ড। কয়েক শ জংলি দাঁড়িয়ে খুঁটিগুলোর ওপাশে।
পিটারের কুঁড়ে এই আগুনের পাশেই।
জোকে ডাকল পিটার ক্যাম্প-খাট পাত। বলে দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে যেন দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছে, এমন সময় উলঙ্গ বর্বরদের ঠেলে সামনে এগিয়ে এল একটা জীবন্ত বিস্ময়।
থ হয়ে গেল পিটার।
–জো! আগে বলিসনি কেন? দাড়িটা পর্যন্ত যে কামাইনি এখনও।
আগুনের ধারে দাঁড়িয়ে এক শ্বেতসুন্দরী।
জো নিজেও চমকে উঠেছে–জানলে তো বলব। এ আবার কে?
–গুড ইভনিং! গুড ইভনিং! আপনি কি স্বর্গ থেকে নেমে এলেন?
দরজার সামনেই এসে দাঁড়াল শ্বেতসুন্দরী। সস্তা পোশাক কুঁড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া উদ্ধত যৌবনের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল, পিটার, তরুণ পাদ্রী। হাতির দাঁত আর গোলাপ মিলিয়ে ঈশ্বর যেন সৃষ্টি করেছেন অপরূপা এই মেয়েকে। কিন্তু এই জঙ্গলে এ হেন রূপসি কেন?
ঠোঁট কেঁপে উঠল শ্বেতসুন্দরীর–আপনি তো পাদ্রী?
–একশ বার। কিন্তু কী মিষ্টি গলা আপনার।
হাসল শ্বেতসুন্দরী–পাদ্রীর মত কথা বলছেন না কিন্তু।
–পাদ্রী হলেও আমি তো মানুষ। পিটার থারথ আমার নাম। আপনার?
জ্যাসোনা ল্যামারে। নোগানোতে থাকি। এই গ্রামেই আমার বাড়ি। আপনাকে ভালো লাগল। তাই বলছি, এখুনি সরে পড়ুন।
–এ আবার কী কথা। ভালো লাগল, অথচ বিদেয় হতে বলছেন?
–আপনার ভালোর জন্যেই বলছি। যান–এখুনি।
–আপনি এখানে কেন? গির্জের কেউ কি?
–আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন। এখানেই মারা যান। আমরা ফরাসি। আমার মা নোগোনের রাজকুমারী।
–মানে?
–মানে আবার কী? মাকে বাবা বিয়ে করেছিলেন বাইবেলের মন্ত্র পড়ে।
–ভালোই হল। আপনার সাহায্যও পাওয়া যাবে গির্জের কাজে।
সাহায্য! আরে মশাই, সরে পড়ুন–এখনি, এই রাতেই।
–কেন?
–এখুনি আসছে সে।
–জিন মদের কারবার করে যে?
–হ্যাঁ।
–বদলোক বুঝি?
–কোরাল সাপ দেখেছেন? ঠিক সেই রকম। সুন্দর, কিন্তু মারাত্মক। আপনি থাকলে তার কাজের অসুবিধে হবে। খুন করে ফেলবে। যান–এখুনি যান।
–জ্যাসোনা, এমন একটা সুন্দর রাত নষ্ট করতে রাজি নই। আসুন, গল্প-সল্প করা যাক।
–প্রাণে বড় শখ হয়েছে দেখছি।
অন্ধকারের মধ্যে থেকে ভেসে এল একটা কণ্ঠস্বর। দরজা পেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল ছফুট লম্বা এক শ্বেতকায়। চওড়া কাঁধ। গলায় ঝুলছে একটা আগাটা রুবি পাথর। দুই চোখে যেন চুম্বকের আকর্ষণ। সুপুরুষ। কিন্তু ভয়াল।
–পাদ্রী যে, খবর ভালো?
–গুড ইভনিং।
–কী নাম আপনার?
–থারথ। আপনার?
–আর্চিবল্ড ওয়েপস্।
কিছুক্ষণ আর কথা নেই। তারপর যেন আঁতকে উঠল তরুণ পাদ্রী।
আর্চিবল্ড অক্সফোর্ড ওয়েপস্?
–কিছু বাজে লোক ওই নামেই ডাকে আমাকে।
–ওয়েপস্! খুনি ওয়েপস্?
–ঠিকই ধরেছেন।
–ওয়েপসক্রীতদাসকারবারি ওয়েপস্?
–নিঃসন্দেহে।
–জংলি বউ নিয়ে যে ঘর করে, সেই ওয়েপস?
–মোট চারটে বউ আমার। চারটেই জংলি মেয়ে। কিন্তু খাসা।
–আপনার কথাবার্তা–
–বরদাস্ত করা যায় না, কেমন? বেশ তো, যাওয়ার আগে আসুন, একসঙ্গে খেয়ে যান।
–আমি থাকতে এসেছি, যেতে নয়।
দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল দানবপুরুষ। প্যান্টের পকেট থেকে লাল বেরি বার করে মুখে পুরে বললে–জিন আর ধর্ম পাশাপাশি থাকতে পারে না। অশান্তি করবেন না। পথ দেখুন।
–যদি না যাই?
–তাহলে জোর করে যাওয়াব। বেরি খাবেন? খাসা খেতে।
–ধন্যবাদ। জোর করলেও যদি না যাই?
–অদৃশ্য করে দেব।
–ম্যানোকড়ির ওপরতলা কিন্তু ছেড়ে দেবে না।
–সে ভাবনা আমার। আপনি পথ দেখুন।
সিগারেট বার করে ধরাল পাদ্রী।
বললে—জ্যাসোনা—ইয়ে–মিস ল্যামারে। যা বলছিলাম আপনাকে–কথাটা মাঝপথে আটকে গেল খট করে একটা শব্দ হওয়ায়। পাদ্রীর বাঁ-হাতের তর্জনী আর অনামিকার মধ্যে দিয়ে একটা ছোরা বিঁধে রয়েছে প্যাকিং কেসে।
ঠান্ডা গলায় বললে ওয়েপস–ফের যদি মিস ল্যামারের নাম মুখে শুনি, ওই ছোরা বুকে বিধবে। পায়ের তলায় ঘাস গজাতে দেয় না আর্চিবল্ড ওয়েপস্। সরে পড়ুন। নইলে নোগোনে ক্রীকয়ের কুমিরদের পেট ভরাব আপনার মাংস দিয়ে। চলবে একটা বেরি? না? গুড নাইট!
–দাঁতখোটাটা ফেলে গেলেন যে?
কাঠের গায়ে ইস্পাত গেঁথে যাওয়ার তীব্র শব্দ হল। আর্চিবন্ডের কানের এক ইঞ্চি পাশে দরজার ফ্রেমে গেঁথে গেছে ছোরাটা। ফলার দিকে চোখ কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল দানবপুরুষ।
বললে টেনে-টেনেহাতটা ভালোই দেখছি। বলেই অদ্ভুত হেসে হলদে চিতাবাঘের মতো একলাফে অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরের অন্ধকারে।
পেছন থেকে হেঁকে বলল পাদ্রী–গুড নাইট।
নিরুদ্ধ নিশ্বাসে এতক্ষণ বাদে কথা বলল শ্বেতসুন্দরী–এবার যাবেন তো?
–যাব? কক্ষনো না।
–থাকলে মারা পড়বেন। জংলিদের লেলিয়ে দেবে।
–দিক।
–ঠিক আপনার মতো একজনেরই পথ চেয়েছিলাম এতদিন।
অন্ধকারে হারিয়ে গেল শ্বেতসুন্দরীও।
.
পরের দিন থেকেই পরিবর্তন দেখা গেল নোগোনে গ্রামে। নরমুণ্ড শিকারিদের গ্রামে সেই প্রথম প্রতিষ্ঠিত হল সত্যিকারের গিঞ্জে। বড় করে নেওয়া হল পিটারের কুঁড়ে ঘর। প্রতিদিন জংলিদের নিয়ে ধর্মালোচনা আরম্ভ হল সেই ঘরে।
দিন কয়েক বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যেই কাটল কিন্তু পিটার থারথের। দানবপুরুষ ওয়েপস্ হুমকি দিয়ে গিয়েছিল তার মাংস দিয়ে পেট ভরাবে কুমিরের। কিন্তু তার টিকি দেখা যাচ্ছে না।
দেখা গেল তার নাম লেখা কার্ডটাকে তার বদলে।
একদিন বিকেলে ঘরে ফিরে পিটার দেখল বন্দুক ঝোলানোর পেরেকে গাঁথা রয়েছে কার্ডটা : আর্চিবল্ড ওয়েপস, এফ. আর জি. এস.।
নেই কেবল রাইফেলটা।
কার্ডের তলায় লেখা–ভীমরুলের হুল না থাকাই ভালো।
তৎক্ষণাৎ আর্চিবল্ডের কুঁড়েঘরে ধাওয়া করেছিল পিটার। ন্যাংটা চাকরটা জঙ্গলের দিকে আঙুল তুলে বলেছিল–ওইখানে। এখানে নেই।
রাইফেল তো গেল। তা সত্ত্বেও পিটার থারথের চঞ্চল মন শান্ত হয়ে রইল শ্বেতসুন্দরীর সান্নিধ্যে। প্রতিদিন সে আসত। প্রথমে গির্জেতে বসে তরুণ পুরুতের মুখে বাইবেল অথবা স্তোত্রপাঠ শুনত। ভগবানের নামগানের ফাঁকে-ফাঁকে ভয়াবহ এই জঙ্গলের অনেক খবর শিখিয়ে দিত পুরুতঠাকুরকে। কোথায় গুঞ্জন-পক্ষী থাকে, কোন লাল বেরি ফল নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়। কিন্তু তাদের জাতভাই সবুজ বেরি ফলকে জিভেও ঠেকাতে নেই। পাকা হলেও সবুজ সেই ফল বিষে ভরা– মৃত্যু আসে সঙ্গে-সঙ্গে। শিখিয়ে দিল পাইথনের গন্ধ চিনতে হয় কীভাবে এবং কোন গাছের রস দিয়ে গেছো মাকড়সার হুলের জ্বালা কমানো যায় চক্ষের নিমেষে।
পারস্পরিক শিক্ষার মাধ্যমে অনেক কাছে চলে এল দুটি মন।
একদিন গোধূলি লগ্নে নদীর ধারে পাশাপাশি বসে দুজনে শেখাচ্ছে দুজনকে, গাছের মাথায় চঁদ উঁকি দিয়ে দেখছে আদম আর ঈভের কাণ্ড। এমন সময়ে দুজনেরই মুখের কথা হারিয়ে গেল নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করে চলল কেবল গাইয়ে ব্যাঙের দল বিরামহীনভাবে।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পিটার বললে কথাটা পেটে গজগজ করছে। কিন্তু মুখে আনতে পারছি না।
–কী কথা?
–বলব?
–নিশ্চয়।
–আ-আমি তো-তোমাকে–
–ভালোবাসো। এই তো? শ্বেতসুন্দরীর হাতের পরশ পেল তরুণ পুরুষ। খসে গেল সংযমের বাঁধন। ঠিক সেই সময়ে নির্ভুল লক্ষে দুষ্ট চন্দ্র তার কিরণপাত করল শ্বেতসুন্দরীর মোমের মতো সাদা নরম মুখে।
বিহ্বল কণ্ঠে পিটার বললে–জ্যাসোনা।
–পিটার, আমিও –তুমিও?
–যেদিন থেকে তোমাকে দেখছি, সেইদিন থেকে। এই কদিন যে সুখ পেয়েছি তোমার সঙ্গে থেকে, তা হারাতে চাই না।
–জ্যাসোনা।
–আমাকে হরণ কর, পিটার।
–হরণ!
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। আজ রাতেই চল পালাই।
–সে ভাবা যাবেখন।
–নাগো, না। আজ রাতেই পালাতে হবে। আর সুযোগ আসবে না।
–কেন? আজ রাতেই কেন? কী বলতে চাও তুমি?
দ্বিধায় জিভ জড়িয়ে গেল জ্যাসোনার।
বললে আস্তে আস্তে–ওয়েপস্ আজ আমাকে চেয়েছে।
–চেয়েছে? মানে, ওয়েপস্ তোমাকে ভালোবাসে?
–দুর! আমাকে..আমাকে ওর দরকার।
–ওঃ! মাটির দিকে চেয়ে রইল পিটার। কথাটার মানে বুঝতে যেটুকু সময় লাগল, তার মধ্যেই দূরে জঙ্গলের মধ্যে শোনা গেল ব্যাঞ্জোর ঝংকার।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে জ্যাসোনা বললে–এসে গেছে ওয়েপস। যেতে আমাকে হবেই, পিটার। জংলিরা ওর হাতের মুঠোয় জিনের লোভে। গুলিবারুদও কেবল ওর কাছেই। উপায় নেই, পিটার, উপায় নেই। যেতে আমাকে হবেই।
লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল পিটার। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে উন্মত্ত আবেগে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে তিরের মতো জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে গেল শ্বেতসুন্দরী।
দন্তনির্ঘোষ শোনা গেল পেছনে। দাঁত কিড়মিড় করছে পিটার।
.
পরের দিন সন্ধ্যার দিকে গির্জের ঘরে নতুন দৃশ্য দেখা গেল।
জংলিরা যোদ্ধার বেশে এসেছে। মুখে লাল আর হলদে কাদার প্রলেপ, চুলে মধু-পক্ষী আর বুনো ময়ূরের পালক, গলায় মানুষের দাঁতের মালা। বাঁশের চেয়ারে আসীন তরুণ পুরুতের দিকে তাকিয়ে মশগুল নিজেদের মধ্যে।
উসখুস করে উঠল জো। কোমরের খাপে গোঁজা ছোরার বাঁটে হাত চলে গেল বারবার।
বাইরে তখন সবুজ গোধূলি।
অবাক হয়ে চেয়েছিল পিটার। নিরস্ত্র সে। কিন্তু নির্ভিক।
জোকে বলল–কী চায় এরা?
জো জিগ্যেস করলে জংলি ভাষায়। ওয়েপসের দৌলতে কিছু কিছু ইংরেজি শব্দ জানে। জংলিরা। একজন লাফিয়ে উঠে বুক বাজিয়ে দাঁতের মালা কঁকিয়ে উগ্র নাচ নেচে যা বললে জগাখিচুড়ি ভাষায়, জো তার সাদা মানে করে দিলে পিটারকে।
গির্জার দফারফা করে দেওয়া হবে। সোনালি মানুষ বলেছে, শয়তানের জল বন্ধ হয়ে যাবে পিটার এ গাঁয়ে থাকলে। কাজেই খানাপিনা নাচগান হবে শিগগিরই। চাই শয়তানের জল। মিঃ গড যেন কেটে পড়েন তার আগেই।
–খানাপিনা নাচগান তোক না, আমিও থাকব। নিরীহ সুরে বললে পিটার।
–হেড-হান্টারদের খানাপিনা নাচগানে কী হয় জানেন? অধীর কণ্ঠে বললে জো–কেন মুণ্ডুটা খোয়াবেন?
–জো, আরও নিরীহ সুরে পিটার বললে–ওদের বলে দাও, সোনালি মানুষ যদি ভগবানের পথ জুড়ে দাঁড়ায়, তাহলে তাকেও যেতে হবে শয়তানের কেল্লায়–সেইসঙ্গে নিয়ে যাবে সব্বাইকে– যারা যারা খাবে শয়তানের জল।
শুনে আর একটি কথাও বলল না জংলি যোদ্ধার দল। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল কুঁড়ে ছেড়ে।
পনের মিনিটও গেল না।
দোলনা-বিছানায় শুয়ে বই পড়ছে পিটার, এমন সময়ে খুকখুক কাশি শুনে চোখ তুলে দেখল দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দানবপুরুষ ওয়েপস্। মুখে মিষ্টি হাসি। গালে বেরি ফল।
চিবোতে চিবোতে বললে মধুক্ষরা কণ্ঠে হ্যালো পাদ্রী, বাইবেল পালিশ করছেন নাকি?
–না। আপনার পথ চেয়ে আছি।
–আমার পথ চেয়ে? সত্যি?
–রাইফেলটা এনেছেন?
–রাইফেল!
–রাইফেলটা ফিরিয়ে দেবেন, এই আশায় পথ চেয়ে আছি।
–সে গুড়ে বালি, পাদ্রী, তা ছাড়া ভগবানকে নিয়ে যে ব্যাবসা করে, তার রাইফেল দরকার হয় না।
–আমার দরকার হয়।
–সেকথা যাক। শুনুন। কালকেই আপনি এ গা ছেড়ে যাবেন।
–আবার সেই হেঁদো কথা?
–যাওয়ার আগে একটা ছোট্ট পুরুতগিরি করে যাবেন।
–যথা?
–জ্যাসোনার সঙ্গে আমার বিয়েটা দিয়ে যাবেন।
–কক্ষনো না।
–তাহলে তাকে রক্ষিতা করেই রাখব।
হ্যামক থেকে ছিটকে গেল পিটার। কিন্তু দানবপুরুষ তৈরি ছিল। মোক্ষম এক ঘুষিতে পিটার ছিটকে গেল মাটিতে।
আঙুলের গাঁটে ফুঁ দিয়ে বললে ওয়েপস্–ঠিক এইভাবেই শেষ হয়ে যাবেন আপনি। ছোরা ছুঁড়তে শিখিয়ে দেব বিশ ফুট দূর থেকে চোখের পাতা কীভাবে কাটতে হয়–শিখিয়ে দেব। ইডিয়ট! রাইফেল পর্যন্ত নেই–এত সাহস কীসের?
মুখ থুবড়ে পড়ে রইল পিটার। জবাব দিল না।
পকেট থেকে আর এক মুঠো লাল বেরি বার করে মুখে পুরে বললে ওয়েপস্ কালকে বিয়ে দেবেন। আর আজ রাত্রে ঠিক আটটার সময়ে পাকা দেখার খানা খেয়ে নেবেন। এই ঘরেই। বেচাল দেখলে শেষ করে দেব। রাত ঠিক আটটার।
শূন্য হল দোরগোড়া। একভাবে মেঝেতে মুখ দিয়ে পড়ে রইল পিটার। পাক্কা আধ ঘণ্টা।
তারপর উঠে বসল। ঝোলা টেনে নামাল। ছবি আঁকা তার হবি। রঙের তুলি আর লাল রঙের শিশিটা নিয়ে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের অন্ধকারে।
ফিরে এল আধ ঘণ্টা পরে। ঘর খালি। জংলি রাঁধুনী উধাও। কিন্তু টেবিল সাজিয়ে রেখে গেছে। পাঁচটা মোমবাতি জ্বলছে। অর্কিড ফুল ছড়ানো রয়েছে। বেগুনি পায়রার রোস্ট, মিষ্টি আলু আর এক বাটি লাল বেরি। যেমনটি ভেবে রেখেছিল পিটার–ঠিক তাই।
পকেট খালি করে ফেলল তরুণ পাদ্রী। মুখ ধুয়ে এসে বসল হ্যামকে। কিন্তু হনুর কালসিটে মিলেল না।
ঠিক আটটার সময়ে ঘরে ঢুকল ওয়েপস্। পেছনে মোমসুন্দরীর মতোই তার ভাবী বউ। কাঠের পুতুল যেন। বসল টেবিলের সামনে।
হাসিমুখে দোলনা-বিছানা ছেড়ে নেমে এল পিটার। বসল ওয়েপসের ঠিক সামনের চেয়ারে।
হাসছিল ওয়েপস্। উল্লাসের হাসি। কিন্তু আস্তে-আস্তে তা মিলিয়ে গেল পিটারের হাসি দেখে।
ভ্রূকুটি করে বললে–এত হাসি কীসের পাদ্রী?
–পাকা দেখার সময় মুখ গোমড়া করতে নেই। অমঙ্গল হয়।
নির্নিমেষে চেয়ে রইল ওয়েপস্ম তলবটা কী?
–কিসসু না। আজ পাকা দেখা–
–পাদ্রী, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় না থাকলে এত বিপদ মাথায় নিয়ে এ জঙ্গলে কেউ থাকতে পারে । আমার তা আছে। মেয়েদের মতোই আসন্ন বিপদ টের পাই আমি। রাত ফুরোলেই যার প্রিয়তমা আমার শয্যাসঙ্গিনী হয়ে যাচ্ছে বাইবেল সাক্ষী রেখে–আজ তার মুখে এত হাসির ফোয়ারা কেন?
হাসতে হাসতেই বললে পিটার পাদ্রী–সেইটাই যে আমাদের কাজ।
নির্নিমেষে তবুও চেয়ে রইল ওয়েপস্। অন্যমনস্কভাবে হাত বাড়িয়ে বাটি থেকে পাকা বেরি তুলে নিয়ে গালে ফেলে চিবুতে চিবুতে কী যেন ভাবতে লাগল। চোখ ঘুরে এল ঘরময়। কোথাও কোনও অস্ত্র নেই। চোখ ফিরে এল পিটারের ওপর। মুখে হাসি লেগে তখনও।
আর এক মুঠো বেরি মুখে পুরল ওয়েপস্। মুখটা বিকৃত হয়ে এসেছে।
না, রাগে নয়। যন্ত্রণায়। চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঠোঁটের কোণ দিয়ে গাজলা বেরুচ্ছে।
টলছে তার দৈত্যদেহ। পরক্ষণেই থুথু করে মুখ ভরতি আধ চেবানো বেরি ফল পিটারের দিকে ছিটিয়ে দিয়ে বললে অবরুদ্ধ স্বরে–তু–তুই–
উঠে দাঁড়াল পিটার। এখন আর হাসছেন।
বললে–হ্যাঁ, ওয়েপস্। শয়তানের জল খেয়েছ এতদিন–এবার খেলে শয়তানের ফল। সবুজ বেরি। পাকা। কিন্তু লাল রং করা। আমিই করে এনে মিশিয়ে রেখেছিলাম লাল বেরির বাটিতে। মিষ্টি খেতে না?
জবাব দিতে পারল না ওয়েপ। হুমড়ি খেয়ে পড়ল টেবিলে। সেখান থেকে মেঝেতে।
জ্যাসোনা উঠে দাঁড়াল আস্তে-আস্তে। মৃত্যু স্বচক্ষে দেখেও সে প্রশান্ত। চাউনি অতলান্ত।
ধীরকণ্ঠে বললে পিটার–আজ আমাদের পাকা দেখা। এসো।
.
পরের দিন সকালে জো ক্যানো নিয়ে রওনা হল শহরের দিকে। গাঁয়ের লোককে বলে গেল– ডাক্তার আর ওষুধ আনতে যাচ্ছে ওয়েপসের জন্যে। বড় অসুস্থ সে। প্রাথমিক চিকিৎসার ভার রইল পাদ্রীর ওপর। জংলিরা যেন তাকে সাহায্য করে।
তীরে দাঁড়িয়ে অপলকে পিটার আর জ্যাসোনা চেয়ে রইল অপসৃয়মান ক্যানোর দিকে।
ওরা জানেকাকে নিয়ে আসবে জো।
*নবকল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত। জানুয়ারি, ১৯৮১।
অ্যাড্রিয়ান কন্যান ডয়ালের গল্প অবলম্বনে।