1 of 2

মানুষ দস্তানার কাহিনি

মানুষ দস্তানার কাহিনি

পুরোনো আমলের আইনরক্ষক অফিসার হিসেবে চোখের সামনেই দেখেছি সিডনি শহরকে গড়ে উঠতে। ঝোঁপঝাড়ভরা ছোটখাটো একটা নগরই দেখতে দেখতে ফুলেফেঁপে উঠে ঠাঁই দিল

বিশ লক্ষ বাসিন্দাকে। পাপ আর অপরাধের দিকে থেকেও এর চাইতে ভালো বা খারাপ শহর আর আছে বলে মনে হয় না আমার।

সুকঠোর দুস্তর পথ পেরিয়ে তবে আমাকে নিউ সাউথ ওয়েলসের কমিশনার হতে হয়েছিল। সত্য কথা বলতে কি বীটের কনস্টেবলের স্তর থেকে ধীরে ধীরে উঠতে হয়েছে আমাকে এই দায়িত্বপূর্ণ পদে। তেতাল্লিশ বছরের দীর্ঘ কর্মজীবনে আমার অন্তত বিশ্বাস আইনের সব রকম শত্রুকেই আমি দেখেছি। সামান্য চোর-ছ্যাচোড় থেকে শুরু করে জালিয়াত কলমেন দাঙ্গাবাজ খুনে-গুন্ডা–কিছুই বাদ যায়নি। এদের মধ্যে অনেকেরই উচ্চাশার বহর শুনলেও তা লেগে যায়।

বর্তমান শতাব্দী শুরু হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই সিডনি পুলিশ হেড কোয়ার্টারের নিরুদ্দেশ ব্যক্তি বিভাগে সার্জেন্টের পদে উন্নীত হলাম আমি। আঙুলের ছাপ নিয়ে অপরাধী সনাক্তের পদ্ধতি সে সময়ে সদ্য প্রচলিত হয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন বিজ্ঞানসম্মত এই তদন্ত পদ্ধতি আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল গতানুগতিক পুলিশী ধারায়। অস্ট্রেলিয়াতে সর্বপ্রথম এই অভিনব পদ্ধতির প্রচলন হয় আমাদের ডিপার্টমেন্টেই।

তন্ময় হয়ে গেলাম আমি আঙুলের ছাপের এই বিশাল দুনিয়ায়। বিভিন্ন ছাপের রেখার ফাঁস, আবর্ত আর বেঁকা খিলের সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞানলাভের পর নিউ সাউথ ওয়েলস কারাগারের আট হাজার বাসিন্দার একটি রেকর্ড তৈরি করে ফেললাম।

সে সময়ে ডিপার্টমেন্টের কর্মীসংখ্যা পাঁচজনের বেশি ছিল না। কিন্তু আজ প্রায় একশো মেয়েপুরুষ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বিভাগের কর্মীবর্গ। সারা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর অন্যান্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের প্রায় দশ লক্ষ অপরাধী আর সন্দেহভাজনের আঙুলের ছাপের সারি সারি ফাইলও সংরক্ষিত রয়েছে আমাদের রেকর্ড বিভাগে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের হেড কোয়ার্টার হয়ে দাঁড়িয়েছে নিউ সাউথ ওয়েলসের আঙুলের ছাপের বিভাগ। শুধু তাই নয়। সারা বিশ্বে যে-কটা অত্যন্ত দক্ষ ফিংগার প্রিন্ট ডিপার্টমেন্ট বর্তমানে রয়েছে, আমাদের এই বিভাগটি তাদেরই অন্যতম।

কর্মজীবনের গোড়ার দিকে আঙুলের ছাপ সম্বন্ধে এই বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছিলাম বলেই মানুষ দস্তানা হত্যা-তদন্তের সুরাহা করতে পেয়েছিলাম আমি।

প্রথমেই বলে রাখি, আমি কমিশনার হয়েছিলাম মাত্র কয়েক বছরের জন্যে। ১৯৩৩ সালের বড়দিনে একটা লাশ চোখে পড়ল দুই ভদ্রলোকের। মুরুবিজী নদীতে ছুটির দিনে মাছ ধরতে গিয়েছিল দুজনে। স্টেটের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী কৃষিপ্রধান কেন্দ্র ওয়াগা থেকে কয়েক মাইল গেলেই পাওয়া যাবে এই নদীটি।

লাশটি পুরুষমানুষের। খুন করা হয়েছিল তাকে বেশ কিছুদিন আগেই। কিন্তু তীরের কাছে উপড়ে পড়া একটা গাছের শাখাপ্রশাখার দেহটা আটকে পড়েছিল কটা দিন। তাছাড়া মুখখানা এমনভাবে থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল যে সনাক্তকরণের উপায় ছিল না।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে সনাক্ত করার শুধু একটি পন্থাই আমি জানতাম এবং তা হল আঙুলের ছাপের সাক্ষ্য। যদিও এক্ষেত্রে এ পন্থায় সুফলের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। কেননা, নিহত ব্যক্তি হয়তো সমাজের বিলক্ষণ সম্মানীয় পুরুষ এবং সারা জীবনে পুলিশের দপ্তরে আঙুলের ছাপ দেওয়ার দুর্ভাগ্য তাঁর কোনওদিনই হয়নি। আইনভঙ্গের দায়ে পুলিশের হাতে ধরা না পড়লে নিউ সাউথ ওয়েলেসের কোনও নাগরিকেরই আঙুলের ছাপ রাখতাম না আমরা।

কেসটা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্যে গোয়েন্দারা হেডকোয়ার্টার থেকে রওনা হলেন। চিফ ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর প্রায়রকে ডেকে আমি বলে দিলাম–আপনার সাঙ্গোপাঙ্গরা আর যাই করুক না কেন, আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু আঙুলের ছাপ যেন নিয়ে আসে ওরা। লাশ সনাক্ত করতে গেলে সম্ভবত এছাড়া আর কোনও উপায় আমাদের নেই।

ম্যাকরে, ক্রসবি আর রেমাসকে দ্রুতগামী গাড়িতে ওয়াগা পাঠিয়ে দিলেন প্রায়র। সিডনির গোয়েন্দা বাহিনী আর ওয়াগার পুলিশ-ফোর্স একযোগে অতিরিক্ত যত্ন নিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলেন নদী এবং তার দু-তীরের জমি। লাশটা পাওয়া গেছে যেখানে, খুনটা সেখানে হয়নি, তা ঠিক। কিন্তু ঠিক কোন জায়গায় তার প্রাণবায়ু বেরিয়েছে, তাও বলা সম্ভব ছিল না কারও পক্ষে। কেননা, উপড়ে পড়া গাছটার ডালপালার ফাঁকে দেহটা কত হপ্তা যে আটকা পড়েছিল এবং নদীর জলে লাশটা ফেলে দেওয়ার পর স্রোতের টানে যে কতখানি পথ তা পেরিয়ে এসেছে তাই বা জানছে কে। আরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাশ পরীক্ষা করতে গিয়ে ওরা আবিষ্কার করলে লোকটির ডান হাতটারই কোনও পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ নিহত ব্যক্তিকে সনাক্ত করার শেষ ক্ষীণ সম্ভাবনাটুকুও অন্তর্হিত হল তার নিখোঁজ ডান হাতের সঙ্গে সঙ্গে।

কিন্তু নদীর তীর বরাবর ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্যে তল্লাশী-পর্ব চালাতে গিয়ে আরও একটা জিনিস আবিষ্কার করলে একজন গোয়েন্দা। ছোট্ট একটা চ্যাপ্টা বাদামি থলি।

থমকে গিয়ে ঝুঁকে পড়েছিল গোয়েন্দা প্রবর থলিটা তুলে নেওয়ার জন্যে। সূত্রের সন্ধান পাওয়ার আশায় আনন্দে আর তর সইছিল না তার। আর তার পরেই নিঃসীম বিভীষিকায় বিস্ফারিত হয়ে উঠল তার দুই চোখের তারা। জিনিসটা বাদামি থলি নয়। মানুষের চামড়ার এতটুকু একটা টুকরো। তখনও ডান হাতের বুড়ো আঙুলের বিবর্ণ নখটা লেগে ছিল চামড়ার সঙ্গে।

সন্তর্পণে মোড়কের মধ্যে করে এই নতুন আবিষ্কারকে পাঠিয়ে দেওয়া হল হেড কোয়ার্টারের আঙুলের ছাপ বিভাগে। জিনিসটা পরীক্ষা করার পর শল্য-চিকিৎসকদের আর কোনও সন্দেহই রইল না। বিবর্ণ নখ সমেত চামড়ার টুকরোটা এক সময়ে একজন পুরুষ মানুষেরই ডানহাতের অংশ ছিল।

ওয়াগার পুলিশ-ডাক্তার রিপোর্ট দিলে নিহত ব্যক্তির কব্জি কৃমিকীট খেয়ে ফেলেছে।

নদীর স্রোতে ভেসে আসার সময়ে কোনও কাঠের গুঁড়িতে আটকে যায় লাশটা হাতটা সম্ভবত বেরিয়েছিল জলের ওপরে। তখনই হাতের নরম মাংস নিয়ে মহাভোজ শুরু করে দেয় কৃমিকীটবাহিনী–পড়ে থাকে শুধু চামড়ার খোলসটা। পরে যখন স্রোতের হ্যাঁচকা টানে লাশটা ভেসে যায় নদীর তীর থেকে, তখনই এই চর্ম-আবরণই ছিঁড়ে গিয়ে লেগে থাকে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে। তীক্ষ্ণ-চক্ষু গোয়েন্দা প্রবর পরে যা উদ্ধার করে আসলে তাকে, মানুষ দস্তানা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

ঠিক এই জিনিসটাই চাইছিলাম আমরা। ১৯৩৪ সাল শুরু হওয়ার অনতিকাল আগে পুলিশ ল্যাবরেটরিতে একজন পুলিশ সার্জন মৃত পুরুষের চামড়াটা নিয়ে জলে ভিজিয়ে নরম করে যে নাটকীয় মুহূর্তের সৃষ্টি করেছিলেন, তাও আমি কোনও দিন ভুলব না।

একজন গোয়েন্দাকে ডান হাতে সার্জিক্যাল দস্তানা পরবার নির্দেশ দিলেন ডাক্তার। তারপর চামড়াটা টানটান করে বিছিয়ে ধরতেই দস্তানা পরা ডান হাতটা সন্তর্পণে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন গোয়েন্দা ভদ্রলোক।

প্রায় খাপে-খাপে লেগে গেল চামড়াটা। এর পর কালির প্যাডে আঙুল টিপে ধরে কাগজের ওপর ছাপ দিলেন গোয়েন্দাটি। অর্থাৎ মানুষ দস্তানার ছাপ থেকেই নিহত ব্যক্তির আঙুলের ছাপ উদ্ধার করা হল।

কিন্তু খুনিকে পাকড়াও করতে হলে আরও অনেক কাঠখড় পোড়ানো দরকার। লাশটা পড়ে ছিল ওয়াগা জেলা হাসপাতালের মর্গে। ডান হাতের ছাপ উদ্ধার করার পর বাঁ-হাতের চামড়াটাও লাশের দেহ থেকে ছাড়িয়ে আনা একান্ত দরকার। কিন্তু মুশকিল তো এই বাঁ-হাত নিয়েই। পচে গলে দফারফা হয়ে এসেছিল চামড়াটার।

অত্যন্ত বীভৎস কাজের দায়িত্ব পড়ল ডাক্তারের ওপর। কিন্তু পেছপা হলেন না তিনি। সাদা গাউন, মুখোশ আর টুপি পরা তিনজন গোয়েন্দার সাহায্য নিয়ে শুরু করলেন অপারেশন। তারপর ছাড়ানো চামড়াটা সন্তর্পণে প্যাক করে হুঁশিয়ার বার্তাবাহকের হাতে পাঠানো হল হেড কোয়ার্টারে। সেখানকার ডাক্তাররা আর একবার মানুষ দস্তানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে আমাদের হাতে তুলে দিলেন বাঁ-হাতের সবকটি আঙুলের ছাপ।

তারপর শুরু হল অত্যন্ত বিরক্তিকর একঘেয়ে কিন্তু রীতিমতো পদ্ধতি মাফিক এক তল্লাসী পর্ব। ফিংগার প্রিন্ট দপ্তরে আঙুলের ছাপ ছিল প্রায় পাঁচ লক্ষ। এই রাশি রাশি ছাপের মধ্যে কোন ছাপটি যে আমাদের সংগৃহীত ছাপের অনুরূপ তারই সন্ধানে তন্ময় হয়ে গেলাম আমরা।

কাজটা সময়সাপেক্ষ। ঘণ্টার পর ঘন্টা কেটে গেল বিরামবিহীন ক্লান্তিহীন এই অনুসন্ধানে। তারপর সার্থক হল আমাদের এত পরিশ্রম। মানুষ দস্তানার সঙ্গে হুবহু মিলে যাওয়া ছাপের হদিশ পেলাম ছাপ পঞ্জির মধ্যে। এর পরেই সর্বত্র নিহত ব্যক্তির চেহারার একটা বর্ণনা ছড়িয়ে দিলেন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর প্রায়র। বর্ণনাটা এই রকম : চল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন বছর বয়স, উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি, মাঝারি গড়ন, দাড়ি-গোঁফ কামানো পরিষ্কার গোল মুখ, ওজন প্রায় ১০ স্টোন ৭ পাউন্ড। ওপরের আর নীচের সারিতে দাঁত নেই কয়েকটা। পরনে কালো রঙের টিউনিক, ধূসর ফ্লানেল শার্ট, নীল রঙের পুরু ডুংগারি কাপড়ের ট্রাউজার্স, শক্ত চামড়ার রুচার হাফ-বুট আট নম্বর সাইজ, মোজা নেই।

লোকটার নাম পার্সি স্মিথ। কিন্তু নামটা কাগজে দিলাম না বিশেষ কারণে। আমাদের মতলব ছিল নাম ঘোষণা করে খুনিকে সচকিত না করে তুলে গোপনে তার গতিবিধি নজর রাখা। বছর চারেক আগে মাতলামো আর উঞ্চবৃত্তির জন্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল স্মিথকে এবং এই লোকই যে সেই স্মিথ, সে সম্বন্ধে সন্দেহের ছায়ামাত্র ছিল না আমাদের কারো মনে।

আমাদের পরম সৌভাগ্য অল্পায়াসেই হদিশ পাওয়া গেল পার্সি স্মিথের। লোকটার কতকগুলো অসুবিধে ছিল। যেমন, যাচ্ছেতাই রকমের তোতলামো। কাজেই চট করে লোক তাকে ভুলতে পারত না। অচিরেই স্মিথ সম্বন্ধে আরও অনেক খবর সংগ্রহ করে ফেললাম আমরা। যাযাবরের মতো দেশময় চর্কিপাক দিত নিজের ওয়াগনেট হাঁকিয়ে। এটা কিন্তু দেশভ্রমণের বাতিক নয়। জীবিকার তাগিদে এ-শহর থেকে সে-শহরে ঘুরত টুকিটাকি কাজ পাওয়ার আশায়। মন্দার বছরগুলিতে অন্যান্য অনেক বেকারের মতো বাধ্য হয়ে এইরকম ভ্রাম্যময় কর্মজীবন নিতে হয়েছিল তাকে। যেখানেই কাজ পেত, সেইখানেই আস্তানা গেড়ে বসে যেত স্মিথ। কিন্তু দিন কয়েকের বেশি কোনও কাজই টিকত না। কাজ শেষ হলেই তল্পিতল্পা নিয়ে ওয়াগনেট হাঁকিয়ে যাত্রা করত অন্য কোনও অঞ্চলে।

দীর্ঘকাল ধরে খোঁজ-খবর নেওয়ার পর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্মিথের গতিবিধির পূর্ণ বিবরণ পেলাম। ১৮ ডিসেম্বর মোরে নামে এক বন্ধুর সঙ্গে তাকে দেখা গিয়েছিল। সেই দিনই তার ওয়াগনেট যে জায়গায় দাঁড়িয়েছিল তার কয়েক মাইল দূরেই পরে পাওয়া গিয়েছিল। তার মৃতদেহ।

সাক্ষীরা ১৯শে ডিসেম্বরেও স্মিথকে দেখতে পেয়েছিল তার ওয়াগনেটে। কিন্তু পরের রাত্রে মোরে একলাই ফিরে এল যাযাবর কর্মীদের ক্যাম্পে। তার ভঁবুর গায়ে অনেকেই রক্তের দাগ লেগে থাকতে দেখেছিল। মোরে কিন্তু নির্বিকার ভাবে একটা ঘোড়া আর কয়েকটা ব্যক্তিগত জিনিস বিক্রি করে দিলে সঙ্গীসাথীদের মধ্যে। পরে দেখা গিয়েছিল প্রতিটি জিনিসেরই প্রকৃত মালিকানা স্বত্ব ছিল স্মিথেরই।

জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে মোরেকে খুঁজে পেতে আনার হুলিয়া বেরিয়ে গেল তক্ষুনি। আবার প্রসন্ন হলেন আমাদের ভাগ্যদেবী। দেখা গেল, আদত লোকটা পুলিশের হেপাজতে রয়েছে। বড়দিনে ছোটখাটো অপরাধের অভিযোগে অল্প কয়েক দিন হল পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল তাকে। হপ্তা-দুয়েকব্যাপী হাজত বাস করে এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করছিল সে। ইতিমধ্যে আরও একটা খবর পেলাম আমরা। জেমস এন্ডেজ নামে এক গ্যারেজের মালিক ওয়াগার কাছেই থাকতেন। ১৬ ডিসেম্বর তিনিও দেখেছিলেন মোরেকে এবং তার চার দিন পরেও আবার শ্রীমানের দর্শনলাভের সৌভাগ্য হয় তাঁর। দ্বিতীয় দর্শন ঘটে তাঁর গ্যারেজেই। একটা ওয়াগনেট হাঁকিয়ে এসেছিল মোরে। টুকটাক কয়েকটা মেরামতি কাজের জন্যে নগদ টাকাও ধরে দিয়েছিল সে।

হাজতের মধ্যে মোরেকে প্রশ্ন করা হলে অম্লান বদনে সে বললে ওয়াগনেটটা তার কাছে বিক্রি করেছে ও ডাউড নামে এক ভদ্রলোক। ওয়াগার কাছেই তার নিবাস। কিন্তু বহু লোকের এজাহারের সঙ্গে এতটুকু সাদৃশ্য ছিল না তার এই জবানবন্দীর। কাজে-কাজেই স্মিথকে হত্যার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হল।

বিচার শুরু হয় ১৯৩৪ সালের ৮ মে। তিলধারণের স্থান ছিল না ওয়াগার ছোট্ট আদালত-ভবনে। কেসটার প্রচার তো কম হয়নি। কাজেই বহু মহিলাও সেদিন ভিড় করেছিলেন পাবলিক গ্যালারিতে। নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল মোরে। অশান্ত মনোভাবের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল

তার অসুস্থ-চঞ্চল হাবভাবে। প্রতিবাদীর বিশেষ সুবিধার সুযোগ নিয়ে সে চ্যালেঞ্জ করে বসল বারোজন। জুরিকে।

জুরিকে দিয়ে চরম শপথ নেওয়ার আগে হামেশাই আদালত-কক্ষের গোলমাল থামানোর জন্যে হাতুড়ি পিটতে হয় ধর্মাবতারকে। কিন্তু সেদিন টু শব্দটি শোনা গেল না ঘরের মধ্যে। একের পর এক সাক্ষী কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যা বললে, তা একটু একটু করে জুড়ে গড়ে উঠল অবস্থাঘটিত প্রমাণ বা পরোক্ষ প্রমাণের এক সুদৃঢ় যুক্তি শৃঙ্খল। প্রথম সাক্ষী দিলে ক্যাম্পবাসীদেরই একজন। মোরেকে রক্তমাখা তাঁবু নামাতে দেখেছিল সে। রক্তের দাগের হেতুও জিজ্ঞেস করেছিল সে। উত্তর ধমকে উঠেছিল মোরে। মুখ বন্ধ করে নিজের চরকায় তেল দেওয়ার মূল্যবান উপদেশ শুনিয়েছিল দাঁত কিড়মিড় করে।

গ্যারাজের মালিক আরও একটা নতুন সংবাদ পরিবেশ করলেন। ওয়াগনেটের ক্যানভাসের মধ্যে গাঁথা একটা ছুরি দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। রক্তরঞ্জিত ছিল ছুরিটার হাতল। আরও প্রমাণ পাওয়া গেল। এক ভদ্রলোকের কাছে একটা সোনার ঘড়ি বিক্রি করেছিল মোরে। এস অক্ষরটি খোদাই করেছিল ঘড়ির গায়ে। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে মাঝারি আকারের একটা জ্যাকেটও কিনেছিলেন ভদ্রলোক ওর কাছে থেকে। এস চিহ্নিত ঘড়ি এবং বিশেষ মাপের জ্যাকেট দুটোই সূচনা করছে সেই একই সন্দেহের।

সাক্ষীদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিলেন যিনি তাঁর নাম জোন্স। পুলিশের কাছে তিনি বিবৃতি দিয়েছিলেন যে মোরে আর স্মিথের মধ্যে দারুণ কথা কাটাকাটির সময়ে তিনিও হাজির ছিলেন। রেগে আগুন মোরে শেষকাল স্মিথকে খতম করে দেওয়ার হুমকি দেখায়। আদালত থেকে যখন ডাক পড়ল এই সাক্ষীর, তখন কিন্তু তাঁর আর পাত্তা পাওয়া গেল না। কাজেই সেদিনের মতো মুলতুবী রাখা হল বিচারের পর্ব। পরের দিন সকালে আদালত শুরু হতেই বিচারপতি জিগ্যেস করলেন এজাহার দেওয়ার জন্যে সাক্ষী প্রস্তুত আছেন কিনা। কিন্তু সাক্ষীর বদলে কাঠগড়ায় উঠে এলেন এক পুলিশ অফিসার। বললেন–সাক্ষী মৃত। মাথার পেছনে বুলেট বিদ্ধ অবস্থায় তার লাশ আবিষ্কার করেছি আমরা।

তদন্তে প্রকাশ পেল যে নিহত ব্যক্তির স্ত্রীর সঙ্গে মোরের অবৈধ বন্ধুত্ব ছিল। স্বামী হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার করা হল ভদ্রমহিলাকে। কিন্তু পরে তাকে খালাস করে দেওয়া হয়। খুনটা নাকি ইচ্ছাকৃত নয়। নেহাতই দুর্ঘটনা।

এজন্যে কিন্তু মোরের বিচার-পর্বে কোনও ছেদ দেওয়া হয়নি। আঙুলের ছাপের বিশেষজ্ঞ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মানুষ দস্তানা মাধ্যমে নিহত ব্যক্তির আঙুলের ছাপ উদ্ধারের চাঞ্চল্যকর কাহিনি বর্ণনা করলেন, তখন জুরিরাও একাগ্র মনে শুনলেন সেই বীভৎস কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক উপাখ্যান। মোরে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি অভিযোগই অস্বীকার করলে। ক্রাউন প্রসিকিউটরও প্রতিবাদী পক্ষের সঙ্গে একমত হয়ে বললেন যে মোরের বিরুদ্ধে কেটি যে সব সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো অবস্থাঘটিত পরোক্ষ প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু তবুও এ সব প্রমাণ এত বেশি এবং এমনই জোরালো যে একবাক্যে মোরেকেই হত্যাকারী স্বীকার না করে উপায় নেই।

জুরিদের মতেও দোষী সাব্যস্ত হল মোরে। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করার সময়ে এক হাত নিজের ঘাড়ে রেখে আর এক হাতের শক্ত মুঠিতে চেপে ধরল সে নেকটাইয়ের গিটটা। পরে মৃত্যুদণ্ড লাঘব করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয় তাকে। ১৯৫৩ সালের পয়লা ডিসেম্বর যক্ষ্মারোগাক্রান্ত মোরেকে মুক্তি দেওয়া হয় কারাগারের অন্ধকার থেকে। বিশ বছর শ্রীঘর বাস করে বন্ধু হত্যার চরম প্রায়শ্চিত্ত করে গেল সে রাজরোগকে আশ্রয় করে।

* ওয়ালটার হেনরী চাইল্ডস্ (অস্ট্রেলিয়া) রচিত কাহিনি অবলম্বনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *