1 of 2

পুলিশের ঘাড়ে কবিতা ভূত

এডগার ওয়ালেস-এর গল্প নিয়ে গোয়েন্দা ধাঁধা
পুলিশের ঘাড়ে কবিতা ভূত

ব্যাঙ্কটা লুঠ হওয়ার মতো নয়, তবুও লুঠ হয়ে গেল।

ছোট শাখা হলেও ব্যাঙ্কের লেনদেন বড় কম নয়। তিন-তিনটে পেল্লায় কোম্পানির টাকা পয়সা থাকে সেখানে। মাইনে দেওয়ার আগের দিন যথারীতি একলক্ষ পাউন্ড এনে রাখা হয়েছিল স্ট্রং রুমে। রাত ফরসা হওয়ার আগেই টাকার কাড়িও ফরসা হয়ে গেল সুরক্ষিত পাতালকুঠরী থেকে।

আশ্চর্য! সত্যিই আশ্চর্য! স্ট্রং রুমটা ইস্পাত আর কংক্রিট দিয়ে তৈরি। কুঠরীর ছাদে ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের প্রাইভেট অফিস। সে-ঘরে ঢুকতে হলে বাইরের অফিস দিয়ে আসতে হয়। দরজা একটাই। ইস্পাতের দরজা। এই দরজা পেরোলে তবে ম্যানেজারের অফিস।

সুতরাং দরজাটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই দরজার মাথায় সারারাত জ্বলে একটা বিদ্যুৎ বাতি। সেই আলোয় রাস্তা থেকেই দেখা যায় দরজাটা বন্ধ রয়েছে। একজন পুলিশ কনস্টেবল ঠিক চল্লিশ মিনিট অন্তর সামনের রাস্তা দিয়ে যায়।

শুধু পুলিশ আর ইস্পাতের দরজাতেও নিশ্চিন্ত হয়নি ব্যাঙ্কের মালিক। তাই একজন রাতের পাহারাদার মোতায়েন করা হয়েছে প্রাইভেট রুমে। জানলা দিয়ে সে মুখ বাড়িয়ে বলে দেয় রাতের পুলিশকে–সব ঠিক হ্যায়!

সে রাতেও যথারীতি চল্লিশ মিনিট অন্তর ঘুরপাক দিচ্ছে পুলিশ কনস্টেবল বার্নেট। হঠাৎ দেখলে আলোটা নেভানো। পিলে চমকে উঠল বার্নেটের। রাতের পাহারাদারের জন্যে দাঁড়িয়ে না থেকে দৌড়ে এল দরজার সামনে। বুক ধড়াশ করে উঠল পাল্লা দু-হাট দেখে। জড়ের মতো ভেতরে ঢুকলে দেখলে একটা অদ্ভুত দৃশ্য।

রাতের পাহারাদার শুয়ে আছে মেঝেতে। হাতে আর পায়ে হাতকড়া। নাকের ওপর তুলোর প্যাড। ইঞ্চি কয়েক ওপরে ঝুলছে একটা ফুটো টিন। টপটপ করে ক্লোরোফর্ম ঝরছে তুলোর প্যাডে। মিষ্টি গন্ধে ঘর ভরপুর।

রাতের পাহারাদারের নাম আর্থার মলিং।

তৎক্ষণাৎ ফোন করা হল পুলিশ ফাঁড়িতে। ওই রাস্তাতেই থাকতেন মিস্টার গ্রীন–ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। পুলিশ আগে দৌড়ল তার কাছে। গিয়ে কী দেখল?

বাক্স-বিছানা বেঁধে চম্পট দেওয়ার আয়োজন করছেন মিস্টার গ্রীন। ভীষণ উত্তেজিত। এত রাত্রে যাওয়া হচ্ছে কোথায়, এই প্রশ্নের উত্তরে বললে আমতা আমতা করে, কাজ আছে। মালিককে একটা চিঠি লিখে যাচ্ছেন অবশ্য। চিঠি আর চাবি অফিসঘরের ড্রয়ারে রেখে এসেছেন।

কিন্তু ড্রয়ারে চাবি বা চিঠি কোনওটাই পাওয়া গেল না। স্ট্রং রুমেও পাওয়া গেল না এক লক্ষ পাউন্ড।

সোজা কেস! দিনের আলোর মতো স্পষ্ট! খাঁচায় পোরা হল মিস্টার গ্রীনকে। টাকা? ধোলাই দিলেই বেরিয়ে পড়বেখন।

পুলিশ কতকগুলো আঁচড়ের রহস্য কিন্তু ধরতে পারল না। আর্থার মলিংয়ের হাতের তেলোয়। পাওয়া গিয়েছিল রক্ত রেখাগুলো।

ব্যাঙ্ক লুঠের দিনই সক্কালবেলা চার্জ বুঝে নিতে এলেন মিস্টার রীডার। ইন্সপেক্টর হলফর্ড কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে বললে–ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের সেই ভীষণ চুরি আপনিই ধরে দিয়েছিলেন। কিন্তু দোহাই আপনার, আজকের চুরি নিয়ে খামোকা মাথা ঘামাতে যাবেন না। মিস্টার গ্রীন জেলখাটা

আসামি। ব্যাঙ্কেরই কেস। নাম ভঁড়িয়ে ম্যানেজারি করেছে অ্যাদ্দিন।

জানি, বিষণ্ণ চোখে বললেন মিস্টার রীডার, আমিই ধরে দিয়েছিলাম গ্রীনকে। টাকা ধার দিয়ে ফেঁসে গিয়েছিল। স্বীকার করলেই ল্যাটা চুকে যেত বেচারা।

ভুরু কুঁচকে বললেন ইন্সপেক্টর হলফর্ড–গ্রীনের সঙ্গে মোলাকাত করার ইচ্ছে আছে নাকি?

আছে।

ফলে, হাজতে হাজির হলেন মিস্টার রীডার। দেখেই চিনতে পারলেন মিস্টার গ্রীন। হাউ হাউ করে বললেন অনেক কথা। একটা উড়ো চিঠি পেয়েই দেশ থেকে পালাচ্ছিলেন তিনি। চিঠিতে লেখা ছিল, গ্রীন যে জেলখাটা আসামি, পত্রলেখক তা জানে। পাছে মুখে চুনকালি পড়ে তাই নতুন জায়গায় গিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করবেন ভেবেছিলেন গ্রীন। এই বয়েসে বিয়ের ইচ্ছেও হয়েছিল। মেয়েটার বয়স যদিও তার চাইতে তিরিশ বছর কম কিন্তু পোড় খাওয়া মেয়ে তো, এক বদমাসকে বিয়ে করে অনেক জ্বলেছে। সে বিয়ে ভেঙে গেছে। নাম তার মিস ম্যাগডা গ্রেন। থাকে এই পাড়াতেই। পাড়ার কিছু ছেলেছোকরা এর মধ্যেই ঘুরঘুর করতে শুরু করেছে বাড়ির আশেপাশে। উদ্দেশ্য, প্রেম করা। এদের মধ্যে পুলিশ কনস্টেবল বার্টেও আছে। সে আবার কবিতা লিখেলিখে ছুঁড়ে দেয় তার ভাবী বউকে। যাক, এখন আর সে ভাবী নয়। এ মুখও তিনি দেখাতে চান না ম্যাগডাকে।

মাথার মধ্যে চিন্তার বোঝা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন মিস্টার রীডার। সারারাত ঘুমোতে পারলেন না। হাজতে যাওয়ার আগেই কনস্টেবল বার্নেটের রিপোর্টটা তিনি পড়েছিলেন। তাতে লেখা আছে, ব্যাঙ্কের কাছাকাছি আসতেই একটা লোককে মোড় ঘুরতে দেখেছিল সে। ভালো করে দেখবার আগেই হোঁচট খেল একটা লোহার নালে। নীচু হয়ে নালটা দেখে ফের সিঁধে হয়ে লোকটাকে সে আর দেখতে পায়নি।

সকাল আটটা নাগাদ–পাড়া ঘুরতে বেরোলেন মিস্টার রীডার। দেখলেন ম্যাগডার বাড়ির সামনে একটা ছোট্টা বাগান। বাগানের কাছে একটা গোলাপগাছ। ধুকছে বললেই চলে। বাদামি হয়ে গেছে পাতা।

শহরের মস্ত বাগানের ধারে গিয়ে ফুলগাছগুলোর দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন মিস্টার রীডার। ফিরে এলেন ম্যাগড়ার বাড়িতে। ম্যাগডার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেখলেন একটা ফুলদানিতে একগুচ্ছ গোলাপ। বাজে অছিলায় পাশের ঘরে পাঠালেন ম্যাগডাকে। গোলাপগুচ্ছ টেনে নিয়ে দেখলেন। বোঁটাগুলো কঁচি দিয়ে কাটা নয়–টেনে ছেঁড়া। নোট বইয়ের একটা পাতা দিয়ে আগে মোড়া হয়েছে বোঁটাগুলো তার ওপর জড়ানো সুতো। ভিজে পাতার ওদিকে লাল কালি দিয়ে কী যেন লেখা।

নেমে এলেন মিস্টার রীডার। বাগানে পেলেন একটা লোহার নাল। জানলা থেকে ম্যাগড়া ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল বাগানে।

গেলেন কনস্টেবল বার্নেলের কাছে। কথায় কথায় জানলেন, লোহার নালে হোঁচট খাওয়ার পরেই রাত দুপুরে কবিতা লেখার ইচ্ছে হয়েছিল বার্নেটের। শহরের বাগানে গিয়ে অনেকগুলো গোলাপ ছিঁড়ে ছিল। নোটবইয়ের পাতায় কবিতা লিখেছিল। সেই কবিতা দিয়েই গোলাপগুলো মুড়ে লোহার নাল দিয়ে ভারী করে ছুঁড়ে দিয়েছিল ম্যাগডার জানলা দিয়ে।

সেইদিনই বিকেলবেলা জানলা থেকে ম্যাগডা দেখলে বিষণ্ণ মুখ সেই লোকটা ফের আসছে। পেছনে একজন পুলিশ ডিটেকটিভ।

নিমেষ মধ্যে বিছানার গদি তুলে ফেলল ম্যাগডা। প্যাডের মতো সাজানো ব্যাঙ্ক নোটের বাণ্ডিলগুলো তুলে নিয়ে ঠাসল একটা ব্যাগে। পেছনের জানলা খুলে রান্নাঘরের ছাদে ব্যাগটা ফেলে দিয়ে নিজেও লাফ দিয়ে নামল ছাদে। সেখান থেকে বাগানে। বাগান থেকে রাস্তায়। চলন্ত ট্যাক্সি থামিয়ে উঠে বসল টাকার থলি সমেত। মিশে গেল জনারণ্যে।

.

গোয়েন্দা ধাঁধার সমাধান

ঠকে গেলেন। মেয়েটা মোটেই চুরনী নয়, হত্যাকারীও নয়।

চোর রাতের পাহারাদার নিজেই। হত্যাকারীও সে নিজে! মানে, নিজেই খুন করে ফেলেছে টাকার আলি চুরি করার পরেই! কিন্তু খুন সে হত না। যদি রাতের পুলিশের ঘাড়ে কবিতার ভূত না চাপত।

প্ল্যানটা অনেক দিনের। আর্থার মলিং নিজেও দাগী আসামি। ম্যাগডা তারই মেয়ে।

ষড়যন্ত্র মতো ম্যাগড়া তালাক দেওয়া ম্যাগড়া গ্রেন সেজে বাড়ি নিয়েছিল ব্যাঙ্ক পাড়ায়। তারপর ছেনালি করে পটিয়ে ফেলেছিল গ্রীনকে। মেয়ের মুখেই স্ট্রংরুমের খবরাখবর সংগ্রহ করত আর্থার মলিং।

তারপরেই মনিকাঞ্চন যোগ ঘটল। উড়ো চিঠি এল গ্রীনের নামে। চম্পট দেওয়ার আয়োজন করলেন গ্রীন। সেইদিনই এক লাখ পাউন্ড এসেছে স্ট্রং রুমে।

আর্থার মলিংয়ের কাছে নকল চাবিও ছিল। কিন্তু ড্রয়ারের চাবি দিয়েই স্ট্রং রুম খুলল। টাকার আণ্ডিল এনে পুঁতে রাখল গোলাপ গাছের তলায়। ফিরে এল অফিসে। যেই দেখলে বার্নেট আসছে, ঝাঁ করে গিয়ে হাত-পায়ে হাতকড়া লাগিয়ে শুয়ে পড়ল ফুটো টিনভরতি ক্লোরোফর্মের তলায়।

জ্ঞান হারাল সঙ্গে-সঙ্গে। হিসেব মতো তখনি বার্নেটের এসে পড়ার কথা। প্রাণটা তাহলে বেঁচে যেত। কিন্তু তার মাথায় তখন কবিতা ভূত চেপেছে। ফুল ছিঁড়ে, কবিতা পাঠিয়ে ফিরে এল দশ মিনিট পরে। ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।

কিন্তু ষড়যন্ত্রটা মিস্টার রীডার আঁচ করলেন কী করে?

ম্যাগডার বাড়ির বাগানে নেতিয়ে পড়া গোলাপ গাছ দেখে। নিজের মনটাও ক্রিমিন্যালের মন তো। তাই তক্ষুনি মনে হয়েছে, মাঝরাতে এক কাড়ি টাকা গোলাপগাছের তলায় তাড়াতাড়ি পুঁততে গেলে হাতে কাটার আঁচড় তো লাগবেই।

পুলিশ যে রহস্যের সমাধান করতে না পেরে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল, সে রহস্যের সমাধানও হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ!

মৃত আর্থার মলিংয়ের হাতের তেলোর রক্তরেখাগুলো আর কিছুই নয়–গোলাপ কাঁটার রক্ত-সূত্র!

* সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় প্রকাশিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *