1 of 2

আবার জিরো জিরো গজানন

আবার জিরো জিরো গজানন

বেপারিটোলা লেনের অত্যাধুনিক অফিসকক্ষে বসে জিরো জিরো গজানন ওরফে বেলেঘাট্টাই গজানন টেবিলের ওপর দু-পা তুলে দিয়ে পাইপ টানা প্র্যাকটিস করছে। এককোণে টাইপরাইটার নিয়ে বসে উদাসভাবে কাঁচের জানলা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট মিস প্রীতি বল ওরফে পুঁতিবালা। বোধহয় নাগরের কথা ভাবছে।

জিরো জিরো গজাননের প্রথম কাহিনি যাঁরা পড়েছেন, তাদের কাছে এই দুজনের নতুন পরিচয় দেওয়ার আর দরকার নেই। গজানন একসময়ে ছিল মেন্টাল ক্লিনিকে রাগের মাথায় লরির ওপর লাফিয়ে উঠে এক লাথিতে উইন্ডস্ক্রিন চুরমার করে ড্রাইভার-ট্রাইভার সবাইকে পিটিয়ে ঠান্ডা করার পরেই তার মাথার গোলযোগ দেখা যায় এবং বন্ধুরা টেনে হিঁচড়ে তাকে নিয়ে যায় পাগলের ডাক্তারের কাছে। ওষুধ নয়, স্রেফ বাক্যের মহিমায় সুস্থ হয় গজানন এবং ডাক্তারের নির্দেশে প্রতিভাকে কাজে লাগায় দেশের স্বার্থে।

অর্থাৎ স্পাইয়ের ব্যবসা করে। এ ব্যবসায় মারপিট উত্তেজনা হাঙ্গামা আছে, প্রাণটা যখন তখন পালাই-পালাই করে এবং সেইটাই গজাননের প্রচণ্ড রাগী ব্রেনটাকে বরফের মতো ঠান্ডা রেখে দেয়।

পুঁতিবালাকে সে সংগ্রহ করেছে হিন্দ সিনেমার সামনে থেকে। সন্ধের দিকে দাঁড়িয়ে কাপ্তেন পাকড়াবার ফিকির আঁটছিল চটুল চোখের ঝলক হেনে, অভাবে স্বভাব নষ্ট আর কী! দেখেই মাথা ঝ-আঁ করে উঠেছিল জিরো জিরো গজাননের।

তার ওই ঝাকড়া অসুর মার্কা চুলের রুদ্রমূর্তি আর তীব্র চাহনি দেখেই প্রমাদ গুনেছিল পুঁতিবালা। কিন্তু পালাবে কোথায়? গজানন তাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট বানিয়েছে, তবে ছেড়েছে। তবে বয়সের ধর্ম তো যায় না। শিকার ধরতে বেরোলেই শ্রীমতী পুঁতিবালা একটু-আধটু এদিক-ওদিক করে বসে। গজানন তা জানে। বকে। দরকার হলে টি-টাটিও মারে। দুজনের মধ্যে কিন্তু ভারি মিষ্টি ভাইবোনের সম্পর্ক।

এই গেল গজানন-পুঁতিবালার ইতিবৃত্ত। দার্জিলিঙে হিপনোটিক কিলারদের বিরাট গ্যাংটার বারোটা বাজানোর পর থেকে গজাননের দক্ষিণা আর খাতির দুটোই বেড়ে গেছে। ইন্টারন্যাশনাল সিক্রেট সোসাইটি ত্রিশূল এখন আর তাকে ব্যঙ্গার্থে নেকনজরে দেখে না, সত্যি সত্যিই নেকনজরে দেখে এবং জটিল প্রাণঘাতী কেস না হলে তাকে তলব করে না।

গজাননের সুবিধে হচ্ছে সে একাই অ্যাকশনে নেমে পড়ে। ইন্ডিয়ান আর্মির রেড ডেভিল কম্যান্ডোদের মতো। হয় কাজ শেষ করে ফরসা হয়ে যাও, নইলে মরো–এই হল তার সোজা সরল কাজের দর্শন। কারও সাহায্য চাই না। এসেছি একলা, যাইব একলা, কেউ তো সঙ্গে যাবে না জিরো জিরো গজাননের এটা একটা প্রিয় গান। আর একটা প্রিয় গান হল, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে। গজানন লেখাপড়া শেখবার চান্স পায়নি কিন্তু গুরুদেবকে বেশ শ্রদ্ধা করে।

হঠাৎ পাইপ টানা বন্ধ করল গজানন। সাদা প্রিয়দর্শিনী টেলিফোনের পাশে লাল ইলেকট্রনিক আলোটা জ্বলছে আর নিভছে।

ত্রিশূল-এর টেলিফোন এসেছে। এসব কারিগরি ত্রিশূল কর্তৃপক্ষদের। স্পেশাল এজেন্টের স্পেশাল ব্যবস্থা তারাই করে দিয়ে গেছে।

মুখ থেকে পাইপ এবং টেবিল থেকে পা দুখানা ঝট করে নামিয়ে নিয়ে রিসিভার তুলে নিল গজানন। মেরুন কালারের টি-শার্টের ওপর সাদা যন্ত্রটাকে প্রায় ঠেকিয়ে সদ্য রপ্ত করা ইয়াঙ্কি টানে বললে–ইয়া..ইয়া…দিস ইজ জিরো জিরো গজানন।

ওপার থেকে ভেসে এল রামভেটকি সুরকিওয়ালার অতীব মধুর কণ্ঠস্বর–গজানন, মাই ডিয়ার গজানন, আর ইউ ফ্রি নাই?

আই অ্যাম অলওয়েজ ফ্রি ফর দ্য কানট্রি। এ কটা কথাও লিখে লিখে প্র্যাকটিস করে নিয়েছে গজানন। দু-চারটে ইংলিশ বুকনি না ছাড়লে এ লাইনে প্রেস্টিজ থাকে না।

গজানন, মাই সুইট গজানন, এখুনি চলে আসুন; ভেরি সুইট গলায় বললে রামভেটকি সুরকিওয়ালা–যার চোদ্দো পুরুষেও রামছাগল, ভেটকি মাছ বা সুরকির ব্যবসা করেনি। গুপ্তচর পেশায় নাকি অদ্ভুত-অদ্ভুত নাম নিলে শত্রুপক্ষের গায়ে কাঁটা দেয়। রামভেটকি সুরকিওয়ালাকে এমনিতে দেখলেও অবশ্য গায়ে কাঁটা না দিয়ে যায় না।

গজাননের সঙ্গে অনতিকাল পরেই দেখা হল এহেন লোমহর্ষণকারী পুরুষটির। ছোট্ট একটা বুলেটপ্রুফ ঘরের মধ্যে বসে তাড়ি খাচ্ছিল রামভেটকি। তাড়ি খেলে নাকি হাঁপানি সেরে যায়। তাই হুইস্কি ছেড়ে তাড়ি ধরেছে অতিশয় কদাকার এবং রীতিমতো ভয়ানক এই মানুষটা। মানুষের আগের কোন এক পুরুষ গরিলা ছিল। কীভাবে জানা নেই, বিধাতার দুর্বোধ্য লীলাহেতু বহু জন্ম পারের সেই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে রামভেটকি জন্ম নিয়েছে। গুলি বিনিময়ের ফলে একটা কান হারিয়েছে। বুকেও একটা ফুটো আছে–সেই থেকেই হাঁপানির ব্যয়রাম, ডাইরেক্ট অ্যাকশনে আর নামতে পারে না। কিন্তু ডাইরেক্ট ডিসিশন নিতে তার জুড়ি নেই। ব্ল্যাক ক্যাট কম্যান্ডো ছিল সে এক সময়ে। যুদ্ধের সময়ে শত্রুপক্ষের পেছনে প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে নেমেছে, টেলিকমিউনিকেশন সেন্টার ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে, অপারেশনাল হেড কোয়ার্টারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, বড় ঝামেলা পাকাচ্ছিল বলে বিশেষ এক কম্যান্ডারকে খতমও করেছে। ফিরে আসার পর এমন প্রস্তাবও উঠেছিল ব্ল্যাক ক্যাট কম্যান্ডের নাম এখন থেকে ব্ল্যাক গরিলা কম্যান্ডো রাখা তোক।

কিন্তু বেসরকারি সংস্থা ত্রিশূল তাকে টেনে নিয়েছে ভারতের স্বার্থরক্ষার জন্যে। এখন রামভেটকি সুরকিওয়ালার ডিম্যান্ড দেশে-বিদেশে–আজ কলকাতায়, এক মাস পরে মস্কোয়, তার পরের মাসে হয়তো ওয়াশিংটনে।

এহেন কালান্তক যমের সামনে অকুতোভয়ে দাঁড়িয়ে বললে আমাদের জিরো জিরো গজানন, ইয়েস বস, হোয়াট অর্ডার?

গজানন, কেস সিরিয়াস। অবতার সিং খতম।

অবতার সিং…অবতার সিং!…কোন অবতার?

ননসেন্স! অবতার সিং আমাদের কান্ট্রির বেস্ট সায়েন্টিফিক ব্রেন মিলিটারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এমন গবেষণা করেছেন যে ভয়ে কাঁটা হয়ে গেছে তামাম দুনিয়া।

তাই নাকি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। একটু কারেন্ট খবর রাখুন, গজানন। এই যে আইসল্যান্ড সামিট ব্যর্থ হল, গর্বাচভ আর রেগান যে যাঁর দেশে ফিরে গেলেন। কারণ কী? স্টার ওয়ার্সের চাইতেও ভয়ানক যুদ্ধ পরিকল্পনা অবতার সিং মাথায় এনে ফেলেছিলেন বলে। খবরটা হাইলি সিক্রেট–তা সত্ত্বেও লীক আউট হয়ে গেছিল। ফলে আইসল্যান্ডের আইস গলল না–মাঝখান থেকে অবতার সিং এর মাথাটা গেল।

মাথাটা গেল? বসে পড়ল গজানন। রামভেটকির শেষের কথায় মাথাটা শব্দের ওপর কেন এত জোর দেওয়া হল? নিশ্চয় তার মানে আছে।

হ্যাঁ, অবতার সিং-এর ব্রেন সমেত মাথাটা উধাও হয়েছে। শুধু চোয়াল আর মাথার পেছন দিকটা গলার সঙ্গে লেগে আছে।

.

দমদম এয়ারপোর্ট থেকে হেলিকপ্টারটা কলাইকুন্ডার যেখানে এসে নামল, তার আশেপাশে ধু-ধু মাঠ! বেশ কয়েক বছর আগে এখানে এয়ারফোর্সের মহড়া দেখে গেছিল গজানন। সে এক সাঙ্ঘাতিক দৃশ্য। ভারতীয় বিমানবহর যে কী দুর্ধর্ষ, সেদিন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছিল।

রামভেটকি আগে নামল কপ্টার থেকে। পেছন-পেছন গজানন। এই ফাঁকা মাঠে মুন্ডুহীন একটা দেহ দেখবার প্রত্যাশায় যখন ইতি-উতি তাকাচ্ছে, রামভেটকি তখন হেলিকপ্টারকে পেছনে ফেলে হেলেদুলে এগিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট একটা টিলার দিকে। কপ্টারের বিকট আওয়াজ শোনা গেল পেছনে। সচমকে ঘাড় ফিরিয়ে গজানন দেখলে শূন্যে উড়েছে অতিকায় গঙ্গাফড়িং। একটু কাত হয়ে উড়ে যাচ্ছে যেদিক থেকে এসেছে, সেই দিকেই। দেখতে-দেখতে দিকচক্রবালে হারিয়ে গেল যন্ত্রযান।

এটা আবার কী ব্যবস্থা? ফেরা হবে কী করে? চমক ভাঙল পেছন থেকে গরিলা বপুর সুমধুর কণ্ঠস্বরে, মাই ডিয়ার গজানন, হাঁ করে তাকিয়ে না থেকে চলে আসুন।

পেছন ফিরল গজানন। রামভেটকি টিলার কাছে পৌঁছে গেছে। এরকম উইয়ের ঢিপির মতো টিলা অজস্র রয়েছে এ অঞ্চলে। বিশেষ এই টিলাটির সঙ্গে রামভেটকির এত প্রণয় কেন বুঝল না।

তবুও পা দুটোকে টেবিল ফ্যানের মতো বনবন করে ঘুরিয়ে পৌঁছে গেল অতীতের ব্ল্যাক কম্যান্ডোর কাছে।

রামভেটকি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল। গজানন জানে ঠিক ওইরকম স্বর্গীয় হাসি হাসতে-হাসতে রামভেটকি যে-কোনও মানুষের টুটি কেটে দিতে পারে–চক্ষের নিমেষে, অথবা জামাকাপড়ের অদৃশ্য কোনও অঞ্চল থেকে ফস করে আগ্নেয়াস্ত্র টেনে বের করে বেধড়ক গুলি চালিয়ে যেতে পারে নির্ভুল নিশানায়। রামভেটকি মূর্তিমান আতঙ্ক অকারণে হয়নি।

এহেন জীবন্ত বিভীষিকাটি মিঠে হেসে বুক পকেট থেকে একটা সরু ডটপেন বের করে হেঁট হল টিলার ওপর। এক হাতে খানকয়েক নুড়ি আর কিছু মাটি সরাতেই চোখে পড়ল এক ইঞ্চি বর্গক্ষেত্রের একটা ইস্পাতের পাত। ঠিক মাঝখানে ছোট্ট একটা ফুটো।

ডটপেনের যে জায়গা দিয়ে লেখা হয়, সেই জায়গাটা পেঁচিয়ে খুলে নিল রামভেটকি। কালির ছোট্ট টিউবটাও বেরিয়ে এল সেইসঙ্গে। এবার ডটপেন টর্চের মতো ফোকাস করল ইস্পাতের পাতটার ওপর। পেছনের ক্লিপটা ঘুরোতেই সরু রশ্মি রেখা গিয়ে পড়ল প্লেটের মাঝখানকার ফুটোয়। ক্লিপ আরও ঘোরাতেই সরু হয়ে এল রশ্মি–শেষপর্যন্ত বিন্দুর আকারে স্পর্শ করল ছোট্ট ফুটোটাকে।

সঙ্গে-সঙ্গে ভোজবাজি দেখা গেল চোখের সামনে। বেলেঘাটার মস্তান গজানন এরকম ম্যাজিক জীবনে দেখেনি সিনেমা টিনেমায় দেখার কথাটা ধর্তব্যের মধ্যে নয় বলে বাদ দেওয়া গেল।

বাঁ-দিকের কাকড় ছাওয়া ভূতল নিঃশব্দে সরে গেল পাশের দিকে। চৌকোনা ফোকর বেরিয়ে পড়েছে। সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে।

চোখ ছানাবড়া করল না গজানন। না করার জন্যে ট্রেনিং নিতে হয়েছে বিস্তর। শুধু বললে সহজ গলায়–যে ফুটোটায় রে ফেললেন, ওটা তো বৃষ্টির জলে নষ্ট হয়েও যেতে পারে।

ডটপেনের রিফিল লাগিয়ে নিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে বললে রামভেটকি, মাই ডিয়ার গজানন, ওই গুপ্ত রহস্যটা আপনাকেও দেখাইনি।

মানে?

ফুটোর মুখটা ঢাকা ছিল। পায়ের চাপে অনেক আগেই ঢাকনা সরিয়েছি।

ম্প্রিং টিপে?

হ্যাঁ। কিন্তু স্প্রিং লাগানো বোতামটা কোথায় আছে, তা জানতে চাইবেন না। দেখলেন না হেলিকপ্টারটাকেও সরিয়ে দিলাম। আমাদের এই গোপন আস্তানার খবর যত কম লোকে জানে, ততই ভালো। আসুন! বলে সিঁড়িতে পা দিলে রামভেটকি।

একটু পরেই কবন্ধ দেহ দেখে শিউরে উঠল গজানন।

কলাইকুণ্ডার এই তেপান্তরের মাঠের পাতালে এরকম এলাহি কাণ্ডকারখানা কে কবে দেখেছে? গজানন আবার পাগল হয়ে যাচ্ছে না তো?

দু-হাতের দুই মুঠো দিয়ে আঁকড়া চুল খামচে ধরে মাথাটাকে বেশ করে কঁকিয়ে নিল জিরো জিরো গজানন। স্পেশাল কম্যান্ডো ট্রেনিং নেওয়ার সময়ে সুবেদার ছাতু সিং ওকে পইপই করে বলেছিল, বাপুহে, চুল কেটে ছোট করে নাও। কেউ যেন খামচে ধরে তুলে আছাড় না মারতে পারে।

ভীষণ রেগে গেছিল গজানন, ধরলেই হল? আমার চুল ধরবে আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের আছাড় খাওয়া দেখব? ধরুন না আপনি..চেষ্টা করে দেখুন।

গজাননের কটমটে চোখ আর অসুরমার্কা মুন্ডু দেখে সুবেদারের আর সে ইচ্ছে হয়নি। শুধু বলেছিল, বুঝবে ঠ্যালা।

চুল কাটব না।

হাজার হোক বাঙালি মস্তান। স্যামসনের চুলের মধ্যেই শক্তি নিহিত ছিল। বাঙালি মস্তানরাও তা বিশ্বাস করে। চুল কাটতে দেবে কেন? চুলের বাহারেই যে আসল বল।

তাই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যেতেই চুল ধরে মাথাটাকে কঁকিয়ে নিল গজানন। অন্য কারও ঘিলু হলে নিশ্চয় নড়ে যেত, কিন্তু জিরো জিরোর ঘিলু যে-সে ঘিলু নয়–নিরেট। তাই অমন প্রচণ্ড আঁকুনিতেও স্থানচ্যুত হল না।

কী দেখল গজানন? লম্বা করিডর সিঁড়ির একদম নিচের ধাপ থেকে শুরু হয়েছে। শেষ দেখা যাচ্ছে না–কেননা আলোগুলো সব নিভানো রয়েছে। সিঁড়ির মাথা থেকে দেখেছিল নিরন্ধ্র অন্ধকার বিরাজ করছে পায়ের তলায়। শেষ ধাপে পা দিতেই আপনা হতেই দপ করে জ্বলে উঠেছিল গোপন আলো–ঠিক পনেরো ফুট পর্যন্ত করিডর আলোকিত হয়েছিল সেই আলোর আভায়। রামভেটকি হনহন করে এগিয়েছে, যতই এগিয়েছে, ততই সামনের করিডর আলোকিত হয়েছে এবং পেছনের ফেলে আসা করিডর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে।

তাজ্জব হলেও চোখেমুখে তা প্রকাশ করেনি গজানন। সবই অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা অতি সাবধানতা। দৈবাৎ যদি পাতাল ঘাঁটিতে কেউ প্রবেশ করে, অন্ধকারে নিশ্চয় টর্চ ফেলবে…

ফেলেওছিল গজানন। সিঁড়ির মাথা থেকেই অন্ধকারকে টিপ করে পেনসিল টর্চ ফোকাস করেছিল।

সঙ্গে-সঙ্গে অভূতপূর্ব কাণ্ড। সিঁড়িটা আচমকা লাল আলোয় ছেয়ে গেছিল। দু-পাশের দেওয়ালের গায়ে সারি-সারি ফোকর আবির্ভূত হয়েছিল এবং প্রত্যেকটা ফোকর দিয়ে একটা করে কালচে ইস্পাতের আগুন বর্ষণ করার নল বেরিয়ে এসেছিল। সবকটা নল ফেরানো টর্চ যে ধরে রয়েছে তার দিকে। অর্থাৎ গজাননের দিকে।

মেঘমন্ত্র চ্যালেঞ্জ শোনা গেছিল স্পিকারে–পাতাল পথ গমগম করে উঠেছিল সেই আওয়াজে, হু ইজ দেয়ার?

চকিতে পেছন ফিরে হতচকিত গজাননের হাত থেকে পেনসিল টর্চ ছিনিয়ে নিয়েছিল রামভেটকি সুরকিওয়ালা, স্পিকারে ততক্ষণে কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে।

থ্রি..টু…ওয়ান… ।

জিরো বলার আগেই ত্রিশূল বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল রামভেটকি, সেইসঙ্গে একটা সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করেছিল। খুবই জটিল এবং খটমট মন্ত্র। কিন্তু কীভাবে জানা নেই, গজাননের গজ মস্তিষ্কে তা অক্ষরে অক্ষরে গেঁথে গেছিল।

ঐন্দ্রীকুলিশপাতেন শততো দৈত্যদানবাঃ।
পেতুর্বিদারিতাঃ পৃথাং রুধিরৌঘ প্রবার্ষিণঃ।

ব্যস, অমনি লাল আলো গেল মিলিয়ে, তার আগেই রোমাঞ্চিত কলেবরে গজানন প্রত্যক্ষ করে নিয়েছিল, সারি-সারি নলগুলোও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ফোকরগুলোর মধ্যে।

ভয়ের চোটে যে গা ঘামে, তা সেদিন হাড়ে-হাড়ে উপলব্ধি করেছিল গজানন। কপালের ঘাম মুছতে-মুছতে কাষ্ঠ হেসে জিগ্যেস করেছিল রামভেটকিকে, ওটা কীসের মন্ত্র, বস্?

চণ্ডীপাঠ করলাম। প্রতিবার শ্লোক পালটায়। মুখস্থ করেও লাভ নেই। ইডিয়ট। আর আলো জ্বালাবেন না।

না, আর আলো জ্বালায়নি গজানন। শুধু তখনই মাথার চুল খামচে ধরে ঘিলু নাড়ানোর চেষ্টা করে ধাতস্থ হয়েছিল এবং তারপরেই দেখেছিল, পরের পর অদৃশ্য আলো জ্বলছে আপনা থেকেই করিডর বেয়ে এগোনোর সঙ্গে-সঙ্গে। সুবোধ অনুচরের মতো রামভেটকির পেছনে-পেছনে যেতে-যেতে দেখেছিল দু-পাশে সারি-সারি দরজায় সংস্কৃত অক্ষরে একটা করে লাইন লেখা রয়েছে। গজানন আবার সংস্কৃত পড়েনি। কোনও ল্যাঙ্গুয়েজই ভালোভাবে পড়েনি, সংস্কৃত বয়কট করেছিল বাল্যকালেই। তাই মানে বুঝতে পারেনি। কিন্তু রামভেটকি টোলের পণ্ডিতের মতো প্রতিটি নামের ওপর চোখ বুলিয়ে বিড়বিড় করে পড়তে-পড়তে সহসা থমকে দাঁড়াল একটা দরজার সামনে। পাল্লায় হাত বুলিয়ে অদৃশ্য কোনও বোতামে চাপ দিল বোধহয়–নিঃশব্দে পাল্লা সরে গেল পাশে।

আলো ঝলমল ঘরের মধ্যে দেখা গেল…

.

পুরো ঘরটাই খুব সম্ভব অ্যালুমিনিয়াম জাতীয় ধাতুর প্লেট দিয়ে মোড়া। এমন কিছু পেল্লাই ঘর নয়। লম্বায় চওড়ায় বড় জোর দশ ফুট। ঠান্ডা কনকনে ঘর। মনে হল যেন এইমাত্র ফ্রিজের পাল্লা খোলা হল। ভেতরে পা দিতেই গজাননের হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠল শুধু ঠান্ডায় নয়, টেবিলের ওপর রাখা বস্তুটি দেখে।

একটাই মাত্র টেবিল ঘরের ঠিক মাঝখানে। চকচকে স্টেনলেশ স্টিলের। তার ওপর শায়িত বস্তুটাকে এখন বস্তুই বলা উচিত, কেননা, যার মধ্যে প্রাণের নাচানাচি নেই, তাকে বস্তু বলাই সঙ্গ

এই যে বস্তুটা জিরো জিরো গজাননের হাড় পর্যন্ত কালিয়ে দিল, এর হাত-পা-বুক-পেট অবিকল মানুষের মতোই। কিন্তু মানুষ নামক প্রাণীটার মুণ্ডু বলেও একটা জিনিস থাকে ধড়ের আগায়–এর তা নেই।

শুধু নেই বললে কম বলা হবে, মুন্ডু যেখানে থাকবার কথা, সেখানে রয়েছে কাটা নখের মতো একফালি চোয়াল আর চিবুক। মুখের ওপর দিকটা অবিশ্বাস্যভাবে গোল করে কেটে নেওয়া হয়েছে। চোয়ালের আর চিবুকের হাড় মাখনের মতো যেন কেটে গেছে শল্যচিকিৎসকের ছুরিতে। কিন্তু এক ফোঁটা রক্ত নেই। চুঁইয়েও পড়েনি। ক্ষত মুখ বেমালুম জুড়ে গেছে।

পেটের মধ্যে গুলতানি শুরু হয়েছে টের পেল গজানন। এরকম তো কখনও হয় না। বেলেঘাট্টাই গজানন মুন্ডুহীন ধড় অনেক দেখেছে, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল হাসপাতালের মর্গে উঁকি মেরে দেখেছে কবন্ধ দেহ (ফুটবল পেটানোর ফাঁকে-ফাঁকে), কিন্তু মানুষের মুন্ডু নিয়ে এরকম বিচ্ছিরি কারবার কখনও দেখেনি।

চিত্রার্পিত, মানে, ছবির মতোন দাঁড়িয়ে থাকা গজাননের পাশে এসে দাঁড়িয়ে রামভেটকি বললে, এই হচ্ছে অবতার সিং।

ঢোক গিলে গজানন বললে, কালী কালী… (গজানন সার্বজনীন কালী পুজোর বিরাট পাণ্ডা ছিল এককালে)–অবতার সিং বলে চিনব কী করে?

আপনি জীবনে দেখে থাকলে তো চিনবেন। আমরা দেখেছিলাম। এখন চিনেছি ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলিয়ে দেখে।

অবতার সিং!

আধ কলসি জল কঁকুনি দিলে যেরকম আওয়াজ হয়, প্রায় সেই ধরনের একটা আওয়াজ বেরোল রামভেটকির গলা দিয়ে। হাসি না হাহাকার ঠিক বোঝা গেল না।

বললে, না, অবতার সিং নন।

চমকে উঠল গজানন। এত জোরে পাশের দিকে মুন্ডু ঘোরাল যে কঁকড়া চুল চোখে মুখে এসে পড়ল।

বললে স্থলিত স্বরে, একবার বলছেন অবতার সিং, আবার বলছেন অবতার সিং নন। মানে…মানেটা কী?

মাই ডিয়ার ডিয়ার গজানন, হুঁশিয়ার হতে হয় এ লাইনে গোড়া থেকেই। অবতার সিং অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন, এই আশঙ্কায় আমরা নকল অবতার সিংকে বাজারে ছেড়ে রেখেছিলাম– আসল অবতার সিং এখন বহাল তবিয়তে আছেন আমাদের গোপন আস্তানায়।

আসল নকল। গজানন ঈষৎ বিমূঢ়।

ইয়েস, ইয়েস, মাই—

নিককে পেলেন কোত্থেকে?

যমজ ভাই অবতার সিং-এর।

কালী! কালী!

জিরো জিরো গজানন,–অকস্মাৎ কঠিন হয়ে ওঠে রামভেটকির স্বর, এ কাজ নিতে পারবেন?

মুন্ডুকাটাদের ঠিকানা বার করতে হবে?

হ্যাঁ। এভাবে মুন্ডু উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা কারা ঘটাতে পারে, তারা কোন দেশের মানুষ। কীভাবে ঘটায়–সব জানতে হবে। দেশের স্বার্থে।

দেশের স্বার্থে; প্রতিধ্বনি করল গজানন। কানের মধ্যে অনুরণিত হল ডাঃ বক্সীর উপদেশ, দেশের স্বার্থে প্রতিভাকে কাজে লাগাবে গজানন, মস্তানিতে নয়।

জীবন যায় যাক, নৃশংস হত্যাকারীকে দরকার হলে হত্যাও করতে হতে পারে।

তা আর বলতে, দাঁত বার করে হাসল গজানন। এতক্ষণে বেশ ফ্রি মনে হচ্ছে নিজেকে। কতদিন যে খুনজখম, দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়নি।–লাশটা পেলেন কোথায়?

দুর্গাপুরের জঙ্গলে।

.

নক্ষত্ৰবেগে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে গজাননের গাড়ি। লেটেস্ট মডেলের মারুতি। মেরুন কালার। ড্রাইভ করছে নিজেই। হাতে কাজ নিয়ে বেপারীটোলা লেনের অফিস ঘরে বসে থাকবার পাত্র সে নয়। পুঁতিবালাকে রেখে এসেছে অফিস ম্যানেজ করতে। ছুটকো পার্টি এলে ভাগিয়ে দেবেখন। গা-গতরের ব্যাপার থাকলে নিজেই ভিড়ে যাবে। ভাবতে ভাবতেই মুচকি হাসল গজানন। পুঁতিবালার এই দেহসর্বস্ব তদন্তধারা খুবই বাজে ব্যাপার সন্দেহ নেই, কিন্তু ওই তো বয়স..বয়সের ধর্ম তো থাকবেই, তাছাড়া কাজও হয় বটে…

আচমকা ব্রেক কষল গজানন। সরু রাস্তার ওপর দমাস করে একটা শালগাছ ফেলা হল। এই হল, এইমাত্র। আর একটু আগে ফেললে নির্ঘাত উলটে যেত মারুতি।

হালকা গাড়ি নিমেষে এক পাক ঘুরে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল বটে, কিন্তু বগলের তলা থেকে রিভলভারটা টেনে বের করার আগেই ঝনঝন করে জানলার কাঁচ ভেঙে ঠিকরে এল ভেতর দিকে, সেই সঙ্গে ভীমের গদার মতো একটা শাল কাঠের খুঁটি।

খুঁটির টিপ ঠিক করাই ছিল। রগে ধাঁই করে মারতেই যে-কোনও ভদ্র সন্তানের মতো চোখে সরষের ফুল দেখল গজানন।

সিটে এলিয়ে পড়া দেহটার ঠ্যাং চেপে ধরে এক হ্যাঁচকায় রাস্তার ওপর টেনে নামাল যে দৈত্যটা, আকারে আয়তনে সে দানবসমান হলেও মানুষ। ঘাড় পর্যন্ত লুটোচ্ছে বাবরি চুল। কপালের ওপর দিয়ে একটা বড় চিত্রবিচিত্র রুমাল মাথার পেছন দিকে গিঁট দিয়ে বাঁধা। পরনে ঢিলে পায়জামা আর পাঞ্জাবি–দুটোই রঙিন ছিটের! মুখখানা রোদেপোড়া। গোঁফ আর দাড়ি প্রায় জঙ্গলের মতো বললেই চলেকুচকুচে কালো।

যে শালকাঠের খুঁটি দিয়ে গজাননের জ্ঞানলোপ করা হয়েছে, সেটা এক হাতেই ছিল। চটি পরা পা দিয়ে জিরো জিরোর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা দেহটাকে ঠোক্কর মেরে চিৎ করে শোয়াল মানুষ-দানব। তারপর হাতের খুঁটি দু-হাতে বাগিয়ে ধরে আর একটা মোক্ষম ঘা মারল গজাননের মাথায়।

জিরো জিরোর মাথা বলেই রক্ষে, সাধারণ মানুষের মাথা ওই চোটেই দু-ফাঁক হয়ে যেত। কিন্তু শৈশব থেকেই গজাননের মাথার খুলির হাড় খুব মোটা–বোধহয় মোটা বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই স্রষ্টা মাথার ডিজাইনটা করেছিলেন।

খটাং করে করোটিতে চোট পড়তেই গজাননের ব্রেনের ভেতরে রাশি-রাশি নিউরোণের মধ্যে নিমেষে অজস্র সঙ্কেত বিনিময় ঘটে গেল। মগজের রহস্য বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মগজ বিশারদরাও আজও জানতে পারেননি–গজাননের মতো সৃষ্টিছাড়া মগজের খবর কে রাখে?

চক্ষের পলকে চনমন করে উঠল গজাননের সমস্ত সত্তা। ঠিক যেন প্রলয় ঘটে গেল কোষে কোষে, সেন্টারে-সেন্টারে। মুহূর্তের মধ্যে সটান উঠে বসল গজানন। এ আর এক গজানন। বেলেঘাট্টাই গজানন। চোখ জ্বলছে। দাঁত কিড়মিড় করছে।

মাথার খুলি দুফাঁক হওয়া দূরে থাক, এ যে উঠে বসেছে! তাকাচ্ছে অমানুষিক চোখে। দানোয় পেল নাকি? মারাদাঙ্গা দানবটা ক্ষণেকের জন্যে ঘাবড়ে গেছিল।

ওইটুকু সময়েরই দরকার ছিল গজাননের। পুরো শরীরটা বসা অবস্থাতেই শূন্যে ছিটকে গেল বিশাল আততায়ীর দিকে। (এই পাঁচটা জনৈক ব্ল্যাকবেল্ট ক্যারাটে মাস্টারের কাছে শিখেছে গজানন) এবং ছফুট শূন্যে উঠেই জোড়া পায়ের সজোর লাথি কষিয়ে দিল খুঁটিধারীর চোয়াল লক্ষ্য করে।

চোয়াল ভেঙে গেল আততায়ীর। কয়েকটা দাঁত ছিটকে পড়ল এদিকে-সেদিকে এবং সেইসঙ্গে নিজেও উলটে পড়ল পেছন দিকে।

গজানন শূন্য থেকে অবতীর্ণ হল তার বিশাল বপুর ওপর এবং পলকের মধ্যে দমাদম ক্যারাটে মার মেরে গেল চোখ, নাক টুটি লক্ষ্য করে। ফলে লোকটা চোখে অন্ধকার দেখল, ভাঙা নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে টের পেল এবং কণ্ঠনালীর বারোটা বাজায় বিষম শব্দে কাশতে লাগল।

কিন্তু নাম তার খান বুদোশ। জিপসীদের পাণ্ডা খান বুদোশ। পূর্বপুরুষদের ইরানি রক্ত বইছে ধমনী-শিরায়। দু-হাজার জিপসী তার কথায় ওঠে-বসে। পয়সার বিনিময়ে হেন কাজ নেই যা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

খান বুদোশের মুখে লাথি? গায়ে হাত? চোখে এমনিতেই অন্ধকার দেখছিল খান বুদোশ, এবার যন্ত্রণায় বুদ্ধির আলোও গেল নিভে। বিকট জিপসী হুঙ্কার ছেড়ে পাঞ্জাবির তলা থেকে টেনে বের করল রিভলভার এবং ট্রিগার টিপে গেল আন্দাজে জিরো জিরোকে তাগ করে।

নিস্তব্ধ বনভূমি শিউরে ওঠে হুঙ্কার এবং গুলিবর্ষণের শব্দে। বনের মধ্যে থেকে শোনা গেল আরও কয়েকজনের চিৎকার। হইহই করে ছুটে আসছে। চেঁচাচ্ছে অনেকগুলো কুকুর।

আসছে খান বুদোশের সাঙ্গপাঙ্গরা। ইরান যাদের নাগরিক অধিকার দেয়নি–তারা। ইরানে ফিরতে না পেরে বনের নেকড়ের মতো রয়েছে যারা তারা।

তারা এসে পড়লে গজাননের মুন্ডু নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলা হত নিঃসন্দেহে, হাত-পা-ধড় চিবিয়ে খেত উপোসী কুকুরগুলো।

কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল একটা আশ্চর্য ব্যাপার।

খান বুদোশ রিভলভার ধরতেই বিদ্যুৎগতিতে গজানন সরে গেছিল নিরাপদ দূরত্বে। দমাদম শব্দে গুলিগুলো এদিক-ওদিক ধেয়ে যাচ্ছে দেখে নিঃশব্দে শিস দেওয়ার ভঙ্গি করেছিল আপনমনে। মাথার মধ্যে সেই চিড়বিড়ে ভাবটাও অনেক কমে এসেছে।

এমন সময়ে জঙ্গলের গহনে শোনা গেল আগুয়ান কোলাহল।

সচকিত হল জিরো জিরো। কী করবে ভাবছে, অতর্কিতে বনের মধ্যে থেকে কক্ষচ্যুত উল্কার মতো ধেয়ে এল যেন সাক্ষাৎ বনদেবী।

অহো! অহো! কী রূপ! কী বিম্বাধর। কী তনুবর! কী বক্ষদেশ! টাইট জিন প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা এহেন রূপসী শরীরী বিদ্যুতের মতো ছুটে এসে গজাননকে বলল, কুইক। খান বুদোশকে তুলুন গাড়ির মধ্যে।

খান বুদোশ। ফ্যালফ্যাল করে অপরূপার দিকে চেয়ে বললে গজানন।

আমাকে দেখবার অনেক সময় পাবেন। (অসহিষ্ণু স্বর বিম্বাধরার–ওরা যে এসে গেল। বলেই কোত্থেকে একটা রিভলভার বের করে দমাস করে মারল খান বুদোশের মাথায়। বেশ ভালো মার। জ্ঞান হারাল জিপসী-পাণ্ডা। ওদিকে গাছপালাদের ফাঁক দিয়ে দলে-দলে বেরিয়ে আসছে রংবেরঙের পোশাক পরা জিপসীদের দল।

দেখেই টনক নড়ল জিরো জিরোর। শুধু জিগ্যেস করলে, সুন্দরী, কে আপনি?

ত্রিশূল।

ও মাই গুডনেস, বলেই বীর বিক্রমে খান বুদোশকে টেনে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দিল মারুতির পেছনের সিটে। ত্রিশূল সুন্দরীও সেখানে বসে পকেট থেকে নাইলন দড়ি বের করে বাঁধতে লাগল জিপসী সর্দারের হাত পা।

ততক্ষণে গাড়ি ঘুরে গিয়ে ছুটছে কলকাতায় দিকে–টপ স্পিডে। মাথার ফুলোটায় হাত বুলোতে-বুলোতে যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে গানটা গলা ছেড়ে গাইছে গজানন।

.

বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাথা ঠান্ডা করে ফেলল গজানন। ত্রিশূল সংস্থাটার শুধু টাকার জোর নেই, রুচিও আছে বটে। খাসা বাংলো-বাড়ি! দার্জিলিংয়ে কালিম্পঙে যেমন কটেজ প্যাটার্নের দোতলা বাড়ি দেখা যায়, (গজানন শুনেছে বিলেতেও নাকি এমনই বাড়ি আছে)–অবিকল সেই ধরনের ছিমছাম বাড়ি গড়ে তুলেছে সল্টলেকের এই নিরালা সেক্টরে। চারপাশে অনেকখানি বাগান–মাঝে তন্বী শিখরদশনা পীন পয়োধরার মতো এই বাড়ি। বাস্তবিকই মনোরম।

ত্রিশূল সুন্দরীর নাম এলোকেশী, নামটা শুনে প্রথমে হেসেই ফেলেছিল গজানন। এলোকেশী তো তার পিসির নাম। ন্যাড়ামাথা বুড়িকে কতই না খেপিয়েছে গজানন। আর এই ডানাকাটা অপ্সরীর নাম কিনা এলোকেশী। যার চুল এলিয়ে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কারণ চুল তো ব্যাটা ছেলের মতো ছোট-ছোট করে কাটা।

এলোকেশী মুক্তাহাসি হেসে গজাননকে নিয়ে এসেছে সল্টলেকের এই ডেরায়। একাই থাকে নাকি এখানে। দেশবিদেশ থেকে ত্রিশূল এজেন্টরা এলে নিশ্চয় ওঠে এখানে। এলোকেশী অবশ্য তা বলেনি, বুঝে নিয়েছে গজানন।

অচৈতন্য খান বুদোশকে একতলার হলঘরে শুইয়ে এলোকেশী গেল একটা দেওয়ালের সামনে। গজাননকে বললে, আপনি বারান্দায় যান–দোতলায়।

গজানন এতটা পথ ড্রাইভ করে এসে ভেবেছিল এলোকেশীর সঙ্গে কিঞ্চিৎ হাস্য পরিহাস করবে অথবা একত্রে রামভেটকিকে ফোন করবে। তাই একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েই হনহন করে চলে গেল দোতলায়।

যাওয়ার আগে আড়চোখে দেখে নিল পকেট থেকে ডটপেন বার করছে এলোকেশী। এই সেই ধরনের ডটপেন যার দৌলতে রামভেটকি পাতাল বিবরের দ্বার উন্মোচন করেছিল। এখানেও নিশ্চয় সেইরকম ব্যাপার ঘটবে। দেওয়াল চিচিং ফাঁক হয়ে যাবে আলিবাবার রত্ন গুহার মতো।

কিন্তু দাঁড়িয়ে দেখবার প্রবৃত্তি হয়নি। এলোকেশী যখন সরাতে চায়, তখন সরেই যাওয়া যাক।

তখন সবে সন্ধে নামছে। সামনের বাগানে আধো-অন্ধকার। গজানন সিগারেট ফিগারেট খায় না। পাইপ টানে অথবা নস্যি নেয়। নস্যির ডিবেটা বার করে বাঁ-হাতের তেলোতে বেশ খানিকটা ঢালছে, এমন সময়ে চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল নিচের বাগানে গাছপালার তলা দিয়ে সাঁৎ করে মিলিয়ে গেল একটা ছায়ামূর্তি।

হাতের নস্যি থেকে চকিতে চোখ তুলেছিল গজানন। কিন্তু ছায়ামূর্তি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ওপর থেকে ভালো করে ছাই দেখাও যায় না। কাজেই নস্যিটাকে সশব্দে নাকের ফোকরে চালান করে দিয়ে প্রবল বেগে নেমে এল নিচের তলায়। সামনের ঘরটা পেরিয়ে তবে যেতে হবে বাগানে। কিন্তু ঘরটা আর পেরোতে হল না।

সোফা থেকে গড়িয়ে পড়েছে খান বুদোশ। পুরো বুকখানা জুড়ে রয়েছে একটা গোল গহ্বর। ধড়ের ঠিক মাঝখানে এরকম খাঁ-খাঁ শূন্যতা চোখে দেখা যায় না।

গজাননের মনের চোখে ভেসে ওঠে অবতার সিং-এর মুন্ডুহীন ধর। এখানে রয়েছে বক্ষহীন ধড়।

কারা করছে এই কু-কাণ্ড? কীভাবে?

.

ত্রিশূল-এর গোপনঘাঁটির কি শেষ নেই? গজানন তাজ্জব হয়ে গেল এই কলকাতারই বুকে আর একটা অত্যাধুনিক ঘাঁটি দেখে।

ওকে সল্টলেকের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল রামভেটকি। এলোকেশী গুম হয়ে বসে রয়েছে পাশে। নক্ষত্ৰবেগে গাড়ি এল দমদম এয়ারপোর্টের দিকে। তারপর ঢুকে গেল একটা বাগানবাড়ির মধ্যে।

খান বুদোশের বক্ষহীন ধড় আগেই পাচার করে দিয়েছিল রামভেটকি।

গাড়ি দাঁড়াতেই প্লেন ড্রেস পরা একজন কম্যান্ডো (চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। কদমছাঁট চুল, বুলডগের মতো মুখ, পেটাই চেহারা।) এসে শুধু বলল গজাননকে, আজকের মন্ত্র?

সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর টাইপের ব্যাপারটা হয়ে গেল না? চড়াৎ করে রক্ত চড়ে গেল গজাননের মাথায়। একে তো সংস্কৃতটা সে জানে না, তার ওপর ডাইনে বাঁয়ে ত্রিশূল-এর দুই কেউকেটা থাকতে তাকে মন্ত্র জিগ্যেস করা কেন?

মুচকি হেসে (গরিলা মুখে যতটা হাসা যায়) রামভেটকি বললে, সিকিউরিটি কাউকে বিশ্বাস করে না–আমাদেরকেও নয়। মন্ত্রটা আমাদের তিনজনকেই বলতে হবে।

কিন্তু জিগ্যেস তো করা হল শুধু আমাকে। গজাননের গলা তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে।

আপনার মুখ এখানে নতুন বলে,–বলেই রামভেটকি নোটবই বের করে একটা পাতা খুলে বলল, যা লেখা আছে, তাই বলুন।

দেখল গজানন। একটাই মন্ত্র। ছোট্ট।

বলল, হ্রীং।

ক্রিং। বলল রামভেটকি।

ক্রিং। বলল এলোকেশী।

পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল প্লেন ড্রেসের কম্যান্ডো।

গাড়ি ছেড়ে নেমে পড়েছে তিনজনে। গাছপালার মধ্য দিয়ে কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল একটা কটেজ প্যাটার্নের বাড়ি। দু-দিকে অ্যাসবেসটসের এবং অন্য দু-দিকে লাল টালির ঢালু ছাদ। অ্যাসবেসটসের চালে আঁকা একটা লাল হরতন।

এটা কি তাসের দেশ? বলে ফেলেছিল গজানন।

রামভেটকি কিছু না বলে গটগট করে গিয়ে দাঁড়াল দরজার সামনে। দরজা মানে একটা গোটা টেক্কা তাস। সামনে দাঁড়াতে-না-দাঁড়াতেই পাল্লা সরে গেল পাশে। পরপর ঢুকে এল তিনজনে। গজানন দেখল ও-পাশে আর একটা ঘর। এদিকের দরজা থেকে ওদিকের দরজা পর্যন্ত তেরোজন ঘণ্ডামার্কা কম্যান্ডো দাঁড়িয়ে লাইন দিয়ে। প্রত্যেকেই অ্যাটেনশন ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে সামনের দিকে।

এদের সামনে দিয়ে গজানন, রামভেটকি আর এলোকেশীকে যেতে হল ওদিকের দরজার সামনে এবং যাওয়ার সময়ে আড়চোখে গজানন দেখলে প্রত্যেকেই খর চোখে দেখে নিচ্ছে তিনজনের মুখ, কেউ-কেউ হাতের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখছে ঠিক লোক যাচ্ছে কিনা সামনে দিয়ে। গজাননের ছবিও তাহলে আছে এদের কাছে।

সামনের দরজা আপনা হতেই খুলে গেল রামভেটকি কপাটের সামনে হাজির হতেই। ভেতরে একটা লম্বা টেবিলে শোয়ানো খান বুদোশের বীভৎস দেহাবশেষ। পাশে দাঁড়িয়ে দাড়িওলা এক বৃদ্ধ। চোখে চশমা, গায়ে সাদা অ্যাপ্রন।

পরিচয় করিয়ে দিল রামভেটকি, জিরো জিরো গজানন, ইনিই আমাদের ব্যালিস্টিক এক্সপার্ট ডক্টর সিঙ্কারো। এককালে হিটলারের কনসেনট্রেসন ক্যাম্পে ছিলেন। গ্যাস চেম্বারে ঢুকে ছেলেবেলায় মরতে-মরতে বেঁচে গেছিলেন। সিঙ্কারো ওঁর ছদ্মনাম, আসল নাম জানলে বুঝবেন হিটলারের কত কাছের লোক ছিলেন ইনি। ডক্টর সিঙ্কারো, কী বুঝলেন? যে অস্ত্র দিয়ে এইভাবে মানুষ খুন করা হচ্ছে, তা তৈরি হয়েছে কোন দেশে?

নো, ছোট্ট জবাব ডক্টর সিঙ্কারোর। বৃদ্ধের চুলগুলো ধবধবে সাদা, এলোমেলো, অনেকটা আইনস্টাইনের মতো মুখে কেবল পাইপটা নেই।

তার মানে কোন দেশ আমাদের পেছনে লেগেছে, তা জানা যাচ্ছে না। আর কোনও খবর? কাঁপা গলায় আশ্চর্য বাংলা বলে গেলেন ডক্টর সিঙ্কারো। গজানন তো হতবাক।

হিটলার যখন বাঙ্কারে বসে বার্লিনের সাবওয়েতে জল ঢুকিয়ে গাদাগাদা মানুষকে ইঁদুরের মতো চুবিয়ে মারছে, তখন একজন বলেছিল, নতুন অস্ত্রটা এদের ওপর পরখ করুন নাজলে চুবিয়ে মেরে কী হবে? চেহারাগুলো হবে এই রকম। বলে একটা কন্ধকাটা নাশ দেখিয়েছিল–যার মুন্ডুটা অবতার সিং-এর মুণ্ডুর মতো মাঝখান থেকে অর্ধেক উধাও।

মাই গড! নিমেষে অ্যাটেনশন হয়ে গেল রামভেটকি। এ অস্ত্র তাহলে জার্মান ব্রেনের?

এগজ্যাক্টলি। কিন্তু এখন আর জার্মানদের হাতে নেই। পরে আমি অনেক খুঁজেছি। অস্ত্রটাকেও চোখে দেখিনি–ডিজাইনও পাইনি।

কীভাবে এরকম গর্ত হচ্ছে বলে মনে হয় আপনার?

মাথা চুলকোলেন ডক্টর সিঙ্কারো, সেইটাই তো মাথায় আসছে না। একটা বিস্ফোরণ ঘটছে। শরীরের মধ্যে কিন্তু রক্ত-মাংস-হাড় সব হাওয়া হয়ে যাচ্ছে কীভাবে, ঠিক বুঝতে পারছি না।

একটা হাতিয়ার হাতে পেয়ে গেলে বুঝতে সুবিধে হবে?

চোখ উজ্জ্বল হল ডক্টর সিঙ্কারোর–নিশ্চয়।

.

গজানন দাঁড়িয়ে আছে মেরিন ড্রাইভার-এর একটা খানদানী হোটেলের বারান্দায়। দুর্গাপুরের জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজে খান বুদোশের দলকে আর পাওয়া যায়নি। পায়ে হেঁটে নয়, ট্রেনে চড়ে তারা নাকি এসেছে আমেদাবাদে। দলে আছে গাপ্পা বুদোশ–খান বুদোশের ছোট ভাই। নওজোয়ান গাপ্পা বুদোশ নাকি চেহারায় চলনে বলনে ইউরোপিয়ান। রামভেটকির ধারণা এই গাপ্পাই হল পালের গোদা। ইরান থেকে খেদিয়েছে, এখন কোন দেশের টাকা খেয়ে ইন্ডিয়ায় মানুষ খতম করে চলেছে, তা গাপ্পাকে গায়েব করতে পারলেই ধরা যাবে।

তাই গজানন এসেছে প্রাণটাকে হাতে নিয়ে। একা। কিন্তু ও জানত না ওকে গার্ড দেওয়ার জন্যে এলোকেশীকেও পাঠানো হয়েছে ওর অজান্তে।

জানল বোম্বাই হোটেলে পা দেওয়ার দিনই রাতে। মেরিন ড্রাইভ-এর হাওয়া খেয়ে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে গজানন, এমন সময় নজরে পড়ল মাইক্রো-ক্যামেরাটা টেপ দিয়ে লাগানো দরজার ফ্রেমে পায়ের কাছে।

নিজেই লাগিয়ে দিয়েছিল ঘর থেকে বেরোনোর সময়ে। রামভেটকির দেওয়া ক্যামেরা। ডটপেনের ডগা পেঁচিয়ে খুলে নিলেই বেরোয় এই ক্যামেরা। আর একটা ডটপেনের মধ্যে থাকে মাইক্রোব্যাটারি। পাশাপাশি রাখলেই চুম্বকের টানে জুড়ে থাকে ব্যাটারি আর ক্যামেরা। ক্যামেরা তখন অটোমেটিক হয়ে যায়, অন্ধকারে বা আলোয় ঘরের মধ্যে যে-ই ঢুকুক না কেন, তার ছবি উঠে যাবেই।

ফ্রেমের ফাঁকে প্রায় অদৃশ্য ও খুদে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসল গজানন। এই মুহূর্তে তারও ছবি উঠছে ক্যামেরার। সেকেন্ডে পাঁচটা। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার।

ঘরে ঢুকল গজানন। দরজা বন্ধ করে দিয়ে আলো জ্বালল। ঘরে কেউ নেই। জামাকাপড় খুলে সটান ঢুকে গেল স্নান ঘরে। পাঁচ তারা হোটেলের স্নান কক্ষ দেখলে দিল্লির বাদশারাও ট্যারা হয়ে যেতেন নিশ্চয়। গজানন তো হবেই। বেলেঘাটায় কে কবে দেখেছে এমন এলাহি ব্যবস্থা।

নরম-গরম জলের শাওয়ারটা খুলে দিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছে, এসেছি, একা যাইব একলা, কেউ তো সঙ্গে যাবে না, হাত থেকে সড়াৎ করে পিছলে গেল সাবানটা। হেঁট হয়ে মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিতে গিয়ে হামাগুড়ি দিয়েছে সবে, এমন সময়ে…

শাওয়ারের ঠিক পাশেই গ্লেজড টালি উড়ে গেল পরপর তিনটে। খান-খান হয়ে এসে পড়ল গজাননের মাথাতেই খটাং খট করে।

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকিয়েছিল গজানন। টালির জায়গায় তিনটে গর্ত দেখেই চোখ কপালে উঠে গেছিল ক্ষণেকের জন্যে। তারপরই চোখ ঘুরিয়ে দেখলে স্নানকক্ষের প্রবেশ পথের দামি পরদাটাতেও তিনটে ছাদা পাশাপাশি। তখনও ধোঁয়ার সুতো বেরোচ্ছে পরদা থেকে।

অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে গজানন–শুধু ওই হড়কে যাওয়া সাবানটার জন্যে। পরদা ফুটো করে টালি উড়িয়ে দেওয়ার পথেই তো ছিল গজাননের প্রিয় নিরেট মাথাটা। এতক্ষণে তারও উড়ে যাওয়ার কথা।

অতএব দিগম্বর গজানন আরও একটু সরে গেল কলতলার বাথটবের দিকে। নজর পরদার দিকে। পরদা দুলে উঠল। প্রথমে দেখা গেল একটা বিদঘুঁটে অস্ত্র। পেটমোটা রিভলভার। জন্মে এমন রিভলভার দেখেনি গজানন।

রিভলভার ধরে যে লোকটি ঢুকল ঘরের মধ্যে, তাকে যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। চোখে তার বাঘের চাহনি, পা ফেলার ভঙ্গিমাও বাঘের মতো। লাফ দেয় আর কী!

লোকটা দেখে ফেলেছে শাওয়ারের নিচে প্রত্যাশিত বস্তুটা নেই; অর্থাৎ গজাননের কবন্ধ দেহ নেই। চকিতে বিদঘুঁটে রিভলভার বাগিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছে, তার আগেই যেন বাজ ভেঙে পড়ল মাথায়।

গজানন, ন্যাংটা গজানন, এখন ফুল ফর্মে। ক্যারাটে গুরু কি বৃথা মার শিখিয়েছেন? বোধহয় আলোর চেয়ে বেশি গতিবেগে দিশি গাঁট্টা মেরেছে গুপ্তঘাতকের মাথায়। ক্যারাটের মশলা মিশোনো গাঁট্টা তো–এক মারেই চোখে সর্ষে ফুল দেখতে-দেখতে বাথটবের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বদমাশটা। গরম জলের কলটা খুলে দিল গজানন। মুখে ফোঁসকা পড়ুক আগে-পরে আরও পেটানো যাবে।

আগে দেখা যাক বিদঘুঁটে অস্ত্রটা। গাঁট্টার চোটে হাতিয়ার ঠিকরে গেছে কলতলার বাইরে ঘরের কার্পেটে। হেঁট হয়ে পাশে বসল গজানন। কার্পেট পুড়ছে কেন? আশ্চর্য আগ্নেয়াস্ত্রের পেটটা দেখে মনে হচ্ছে যেন গভীর জলের মাছ জেলের জালে পড়ে উঠে এসে পড়ে আছে সমুদ্রের বালির ওপর হাওয়া ঢুকে পেটটা ফুলেই চলেছে। একটু যেন লালও হয়ে উঠেছে। গনগনে আভা ছাড়ছে। কার্পেট পুড়ছে সেই কারণেই।

সভয়ে চেয়ে রইল গজানন। ফাটবে নাকি? কিন্তু একটু আগেই তো এই অস্ত্র ধরেই আততায়ী তার মাথা ওড়াতে গেছিল। নলচেটা বেঁটে, কিন্তু বেশ ফঁদালো। রিভলভার এরকম হয় নাকি? জল-পিস্তল বলেই তো মনে হচ্ছে। দোল খেলার সময়ে পিচকিরির মতো জল ছুঁড়ে দেওয়ার খেলনা।

কিন্তু এ খেলনার মুখ থেকে বেরোয় সাক্ষাৎ মৃত্যু। এ আবার কী ধরনের মারণাস্ত্র?

বিমূঢ় গজাননের চোখের সামনেই বিচিত্র মারণাস্ত্রের উদর আরও একটু স্ফীত হল। গগনে আভা আরও একটু প্রকট হল। কোনও ধাতু যে এভাবে রবারের মতো ফুলতে পারে, তা তো জানা ছিল না গজাননের।

হঠাৎ গজাননের গজ-মস্তিষ্কের কোষগুলোয় কী সঙ্কেত বিনিময় ঘটল, তা দেবা না জানন্তি। মৃত্যুকে সামনে দেখলেই বরাবরই ও এমনিভাবে হাত বাড়িয়ে মৃত্যুকে কাঁক করে ধরতে যায়।

চ্যাপটা হাতল ধরে মারণাস্ত্রটা তুলে দূরের খাটের দিকে তাগ করল গজানন।

সঙ্গে-সঙ্গে একটা জার্ক লাগল হাতে। প্রচণ্ড আঁকুনি। কিন্তু হাত স্টেডি রইল। কানে ভেসে এল একটা বিস্ফোরণের শব্দ।

খাটের ওদিকের স্টিল আলমারিটা বিস্ফোরিত হয়েছে। বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে যে বস্তুটি তা খাটের গদির এদিক থেকে ঢুকে ওদিক দিয়ে বেরিয়েছে।

কী ভয়ানক শক্তি অদৃশ্য বিস্ফোরকের। মাখনের মতো গদি ফুটো করে বেরিয়ে গিয়ে শক্ত আলমারিতে আছড়ে পড়তেই ফাটিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে আলমারি।

হাতের মারণাস্ত্রের দিকে তাকিয়ে থ হয়ে গেল গজানন। পেটের ফুলোটা হঠাৎ এত কমে গেল কী করে? গনগনে আভাটাও আর নেই।

ভয়ে-ভয়ে আজব অস্ত্রকে কার্পেটে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল গজানন। যার হাতে এই অস্ত্র একটু আগে শোভা পেয়েছে সেই ব্যাটাচ্ছেলেকে মনের সুখে এবার ধোলাই দেওয়া যাক।

কলতলার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল পরদা সরিয়ে বিহ্বল দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে ঘাতক মহাশয়। বিস্ফারিত চক্ষু যুগল নিবদ্ধ কার্পেটের ওপর রাখা বিটকেল অস্ত্রটার দিকে। একটু আগে আলমারি বিস্ফোরণের শব্দ শুনে এবং গরম জলের ছ্যাকা খেয়ে নিশ্চয় সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে।

এখন আবার সম্বিৎ হারাবে নাকি? ওরকম আতঙ্কঘন চোখে চেয়ে আছে কেন পেটমোটা দানব অস্ত্রর দিকে?

গজানন যখন এই প্রশ্নটা মাথার মধ্যে এনে মন্থরগতিতে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছে, ঠিক সেই সুযোগে লোকটা সোজা ডাইভ মারল মারণাস্ত্রের দিকে।

নিমেষে গজানন ফিরে এল গজাননের মধ্যে। বাঁ-পায়ের শট ওর চিরকালই প্রচণ্ড। ঘাতক প্রভু যখন মেঝের ছইঞ্চি ওপর দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে মারণাস্ত্রের দিকে ঠিক তখনি পাশ থেকে বাঁ পায়ে পেনাল্টি কিক করল গজানন–লোকটার পেটে।

কোঁক-ধড়াম–ধুম। পুরো বপুটা নিক্ষিপ্ত হল শূন্য পথে। খাটের ওপর দিয়ে ছিটকে পড়ল জানলার সামনে।

মারণাস্ত্র পাকড়ে ধরে সেইদিকেই তাক করল গজানন। অমনি নরকের বিভীষিকা যেন ফেটে পড়ল খুনে লোকটার চোখেমুখে।

ঠেলে বেরিয়ে আসা দুই চোখ মেলে সেকেন্ড কয়েক চেয়ে রইল বিকট অস্ত্রের দিকে। পরক্ষণেই ম্প্রিংয়ের পুতুলের মতো লাফিয়ে উঠে ছুটে গেল খোলা জানলার দিকে এবং একলাফে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।

বাইশ তলা শূন্যপথ অতিক্রান্ত হতে গেলে যেটুকু সময়। তারপর বাইশ তলা নিচ থেকে ভেসে এল আছড়ে পড়ার শব্দ।

ফ্যালফ্যাল করে হাতের অস্ত্রটার দিকে চেয়ে রইল গজানন।

গজাননের চমক ভাঙল দরজায় টোকা পড়ায়। খট খটখট খট খট খট…খট!

ত্রিশূল দলের সঙ্কেত! কে এল?

বিকট অস্ত্র হাতে নিয়েই দরজার সামনে ছুটে গেল গজানন। ম্যাজিক হোলে চোখ রেখে দেখল…

বাইরে দাঁড়িয়ে এলোকেশী।

এলোকেশী। এ সময়ে? এখানে?

ঝটাং করে পাল্লা খুলতেই এলোকেশী আঁতকে উঠে বললে, গজাননবাবু, ডোন্ট বি সিলি। বলেই বোঁ করে পেছন ফিরে বললে, জামাকাপড় পরে নিন।

তাই তো! গজাননের খেয়ালই নেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে গায়ে সুতোটি চাপাবার সময় পায়নি। দুই সারি গজদন্তের ফাঁকে বিরাট জিভটা ঠেলে দিয়ে সাঁৎ করে ঢুকে গেল কলতলায় এবং এক মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে এল পাজামায় পা গলিয়ে।

এসেই সে কী তড়পানি, আপনি কোত্থেকে এলেন?

এলোকেশী তখন একটা সোফায় বসে বুকের উপত্যকায় ঝোলানো একটা নেকেড মেয়ের লীলায়িত পোজের লকেটের দিকে নির্নিমেষে চেয়ে রয়েছে। গজাননের প্রশ্নটা শুনে আড়চোখে এমনভাবে তাকাল প্রশ্নকর্তার দিকে যে, সেই ব্যক্তির পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ থেকে মাথার চুলের ডগা পর্যন্ত শিরশির করে উঠল অনাস্বাদিত পূর্ব উত্তেজনায়। এ সেই চাহনি যার সামনে মুনিঋষিরা টলে যান, দেব সাধন ভুলে বাৎস্যায়ন শাস্ত্রচর্চায় মত্ত হন।

গজাননের ফুলোফুলো পাথরের মতো পেশিগুলো অনাবৃত অবস্থায় দেখেই যে এলোকেশী এলিয়ে পড়েছে, তা হাড়ে-হাড়ে বুঝল জিরো জিরো।

বাট ডিউটি ইজ ডিউটি–মেয়েরাই সব সাধনার পতন ঘটায়, শাস্ত্র-টাস্ত্র না পড়লেও গজানন তা জানে। তাই গলাটাকে যদূর সম্ভব কর্কশ করে (করা কি যায়!) বললে, এখানে কেন এসেছেন?

কাম-টু-দ্য-বেড় চোখ তুলে তাকাল এলোকেশী। যার সাদা বাংলা হল, এসো, শোবে এসো। কিন্তু ছুঁড়িদের সঙ্গে শোওয়া গজাননের পোষায় না। ওইরকম চাহনি দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে যায়। একটু আগে আচমকা চাহনির ঝলকে গা শিরশির করার জন্যে (হাজার হোক পুরুষ মানুষ তো) রাগও হয়ে গেল নিজের ওপর। গজদন্ত খিঁচিয়ে আর একবার যেই দাবড়ানি দিতে যাচ্ছে, এলোকেশী বললে, আমি এসেছি আপনাকে গার্ড দিতে।

এমন নেচে উঠল গজানন (অভিনব পিস্তল হাতেই রয়েছে), পাজামার দড়ি ঢিলে হয়ে গেল। এবং পাজামা নেমে এল ইঞ্চি তিনেক নিচে। খপ করে দড়ি ধরে পাজামা তুলে বললে যথাসম্ভব বজ্রগর্ভ স্বরে, একমাত্র ভগবান শালা ছাড়া আমাকে গার্ড দেওয়ার কেউ নেই।

অহো! অহহ! কী ডুমাডুমো পেশি বুকের! মিঃ ইউনিভার্স হলে পারত গজানন। মুগ্ধ (এবং বিলোল) চোখে চেয়ে এলোকেশী বললে, নিচের তলায় এখুনি একটা লাশ পড়ল আপনার জানলা থেকে।

তিড়বিড়িয়ে ওঠে গজানন, জানলা থেকে জ্যান্তই বেরিয়ে গেছিল–নিচে গিয়ে লাশ হয়েছে।

আপনি ফেলে দিয়েছেন?

আজ্ঞে না, অজান্তেই দাঁত কিড়মিড় করে ফেলে গজানন, ধরতে পারলে মুন্ডুটা ছিঁড়ে নিতাম।

ও, ঠোঁটের ওপর ছোট্ট তিলটা চুলকে নিল এলোকেশী। অমনি গজাননের মনে পড়ে গেল পিসির কথা–ওরে গজানন, ঠোঁটে তিলওয়ালা মেয়ে দেখলেই জানবি পরপুরুষে আসক্তি আছে। ঠিকই বলেছে তো পিসি। এলোকেশীর রকমসকমও ভালো ঠেকছে না। এমনভাবে চাইছে যেন গজানন একটা মুচমুচে নানখাতাই বিস্কুট, পেলেই চিবিয়ে খাবে।

কাজেই শক্ত চোখে চাইতে হল গজাননকে, রাস্কেলটা এসেছিল এই দিয়ে আমার মুন্ডু উড়োতে, দেখাল হাতের বিদঘুঁটে অস্ত্রটা।

জীবনে দেখিনি বাপু এমনি রিভলভার। নিন, ব্যাগের মধ্যে রাখুন, বলে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ধরল এলোকেশী।

গজানন কিন্তু দেখেছে বিটকেল হাতিয়ার মাঝে-মাঝে বিচ্ছিরিভাবে ফুলে ওঠে, লাল হয়, বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে। কাজেই টেবিলের ওপর থেকে নিজের বুলেটপ্রুফ ব্রিফকেসটা টেনে নিতে নিতে বললে, এর মধ্যেই থাক।

ব্রিফকেস আর হাতছাড়া করেনি গজানন। রামভেটকি বলেছিল আজব হাতিয়ার একখানা আনতেই হবে। এই সেই হাতিয়ার।

হোটেলের ঘর থেকে বেরোনোর আগে, দরজার ফ্রেমের পাশ থেকে মাইক্রো ক্যামেরা খুলে নিয়ে রেখেছিল ডটপেনের মধ্যে।

এলোকেশী তখন নেমে গেছে। দেখতে পায়নি খুদে ক্যামেরার গোপন অবস্থান। পায়নি বলেই রক্ষে। নইলে…

.

কানহেরী কেভস বোম্বাই শহর থেকে বেশ দূরে। পর্বতগুহা দেখতে বিস্তর টুরিস্ট যায় ইলেকট্রিক ট্রেনে, ফরেন টুরিস্টরা যায় গাড়িতে। ঝকঝকে গাড়ি ধূলি ধূসরিত হয়ে যায় গুহা অঞ্চলে একবার টহল দিয়ে।

কিন্তু সে ধুলো বাইরে, মানে, এই আস্তানার বাইরে। এলোকেশী বিলিতি গাড়িতে চাপিয়ে গজাননকে ঝড়ের বেগে কানহেরী কেভস অঞ্চলের এই গোপন আস্তানায় এনে ফেলার পর বেলেঘাট্টাই মস্তান বেচারার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে একটার পর একটা কাণ্ডকারখানা দেখে।

জবরদস্ত পার্টি বটে এই ত্রিশূল। সংগঠন কাকে বলে দেখিয়ে দিয়েছে, সারা ভারতটাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফেলেছে বিবরঘাঁটি আর গুপ্তচর দিয়ে। উদ্দেশ্য একটাই, ভারতের স্বার্থরক্ষা। সরকারি ব্যবস্থায় যে সর্ষের মধ্যে ভূত, তা বুঝে গেছে।

দেশকে সত্যিই ভালোবাসে এই ত্রিশূল। যতই দেখছে গজানন, ততই বিমোহিত হচ্ছে। কোনওকালে ভাবতেও পারেনি গুহা থেকে বেশ খানিকটা দূরে জঙ্গলের মধ্যে এ রকম একখানা আস্তানা বানিয়ে বসে আছে রামভেটকির ওপরওয়ালারা।

গাড়িখানা এলোকেশীই চালিয়ে নিয়ে এসেছে। জঙ্গলের মধ্যে বাঁই-বাঁই করে ঢুকে পড়েছে। দূর থেকে মনে হয় যেন একটা পায়ে চলা পথ কিছুদূর গিয়েই বনের মধ্যে হারিয়ে গেছে অথবা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুদূর ঢোকবার পর দেখা যায় মাটির রাস্তা পিচের রাস্তা হয়ে গেছে এবং এক-এক জায়গায় রাস্তা চার-পাঁচটা রাস্তা হয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেছে। যে-কোনও নবাগত এই পয়েন্টে পৌঁছেই দুরুদুরু বুকে নিবিড় বনানীর রহস্যময়তা উপলব্ধি করেই পিছু হটে আসবে।

কিন্তু পথ যারা চেনে, তারা পেছোয় না। পিচমোড়া এই রাস্তার গোলকধাঁধা ইচ্ছে করেই সৃষ্টি হয়েছে কৌতূহলীদের দূরে ঠেকিয়ে রাখার জন্যে, দলের লোকেদের নির্বিঘ্নে নিয়ে আসার জন্যে।

এলোকেশীর গাড়িও তাই চরকিপাক দিতে দিতে এ রাস্তা সে রাস্তা হয়ে ঢুকে গেল গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলে। এক জায়গায় একটা পরিত্যক্ত এয়ারপোর্টও দেখতে পেল গজানন। যুদ্ধের আমলে নিশ্চয় বিমানবাহিনী বানিয়েছিল, এখন আর তার খোঁজ কেউ রাখে না। বিলিতি গাড়ি প্রায় নিঃশব্দে গিয়ার চেঞ্জ করতে করতে সেই এয়ারপোর্টের পাশ দিয়েই ঢুকল অন্য একটা রাস্তায়। রাস্তা হঠাৎ শেষ হয়েছে একটা ফাঁকা জায়গায়। যেন টেক অফ করার জন্যেই রাস্তার শেষ ওখানেই।

গাড়িটা কিন্তু টেক অফ করল না, টেক ডাউন করল। মানে, স্রেফ পাতালে ঢুকে গেল। রাস্তাটা যে আসলে ইস্পাতের ঢাকনি তা কে জানত। কবজার ওপর লম্বাটে কৌটোর ঢাকনি যেমন ওপর দিকে খুলে যায়, ঠিক সেইভাবে প্রায় পনেরো ফুট রাস্তা মেঝে উঠে গেল ওপর দিকে।

গাড়ি থেকে নেমে গেল ঢালু পাতাল-বিবরে। মাথার ওপরকার ঢাকনি নেমে এসে বন্ধ করে দিলে বিবর পথ।

আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল গজাননের। এ কাদের পাল্লায় পড়েছে সে? এরা যে আরব্য রজনীর মতো কাণ্ডকারখানা দেখিয়ে চলেছে ভারতের বুকে।

কাণ্ডর তখনও দেখেছে কী গজানন দ্য গ্রেট। দেখল এরপরেই।

.

গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দাঁড়াল একটা কুয়োর ওপরকার চাতালে এবং চাতালটা লিফটের মতো নেমে গেল কুয়োর মধ্যে। সাঁ-সাঁ করে বেশ খানিকটা নামবার পর রুদ্ধ হল নিম্নগতি।

আলো ঝলমলে একটা বিশাল হলঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। জানলার কাঁচের মধ্যে দিয়ে হলঘরের বিশালতা এবং বিচিত্র যন্ত্রপাতির বিপুল সমাবেশ দেখে গজানন দ্য গ্রেট চোখ দুটো প্রায় ছানাবড়ার মতো করে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ।

হলঘরের চারপাশে ছড়ানো ছিটোনো যন্ত্রপাতিগুলো চলছে আপনা হতেই। অনেকগুলো বিদঘুঁটে চেহারার রোবট চালাচ্ছে কলকবজা। নিজেরাও তো এক-একটা কল, কাউকে দেখতে বাচ্চাদের মোটরগাড়ির মতো–চাকার ওপর গড়গড়িয়ে যাচ্ছে।

এই রকমই একটা খুদে মোটরগাড়ি সাঁ করে ছুটে এল গজাননদের দিকে। চকিতে টান টান হয়ে গেল গ্রেট স্পাইয়ের আপাদমস্তক। কেননা, আগুয়ান যন্ত্রের মাথার ওপরে একটা ইস্পাতের নল ফেরানো রয়েছে তাদের দিকে। পেটের কাছে একটা টিভি স্ক্রিনের মতো পরদায় রংবেরঙের জ্যামিতিক নকশা আঁকা হয়ে যাচ্ছে অতি দ্রুত ছন্দে।

বগলের তলা থেকে লুগারটা টেনে বের করতে যাচ্ছে গজানন, বাধা দিল এলোকেশী। মুখে সেই অপ্সরা হাসি।

বললে স্টিরিও মিউজিক কণ্ঠে, গজাননবাবু, ঘাবড়াবেন না, রোবট সেন্ট্রিকে গুলি করবারও সময় পাবেন না।

তা বটে। এলোকেশী ওর হাতখানা বেশ মোলায়েম করে ধরে (এত মোলায়েম ভাবে যে সন্দেহ হতে লাগল যার ঠোঁটে তিল…) নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। পুঁচকে মোটরগাড়িটা তখন সামনেই দাঁড়িয়ে। মাথার ওপরকার ইস্পাতের নলচের সরু ফুটোটার দিকে সভয়ে তাকিয়ে গজানন।

এলোকেশী হেসে চণ্ডীপাঠ করে গেল। টিভি স্ক্রিনের বুকে লেখা হয়ে গেল–Ok Hop in.

মানে, সব ঠিক আছে। গাড়িতে লাফ দিয়ে উঠে পড়।

বলে কী খুদে গাড়ি। ওইটুকু গাড়িতে…

এলোকেশী ততক্ষণে উঠে গেছে গাড়িতে।

খেলনার গাড়ির সিটের মতো ছোট্ট সিটে বসে হাতছানি দিয়ে আর চোখ টিপে ডাকছে গজাননকে।

–আচ্ছা ঢলানি মেয়ে তো। রাগে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গেল গজাননের। গালের কাটা দাগটাও সুড়সুড় করে উঠল এই সময়ে। কিন্তু অতিকষ্টে সেখানে হাত বুলেল না গজানন। কেননা, ওর মারদাঙ্গা ফিচারের সুইচ ওই কাটা দাগটা। হাত বুলোলেই মাথার মধ্যে পটাং করে যেন তার ছিঁড়ে যায়, তারপর প্রলয় ঘটিয়ে ছাড়ে চক্ষের নিমেষে–নিজের অজান্তেই।

অতএব কাটা জায়গায় হাত বুলোনো সমীচীন হবে না। বিশেষ করে ইস্পাতের নলচেটা এখনও যে ফিরে রয়েছে তার দিকেই।

অগত্যা মুখটা পাচার মতো করে গাড়িতে উঠে এলোকেশীর গায়ে গা দিয়ে বসল গজানন। মুহূর্তের মধ্যে পুঁচকে মোটর ভীষণ বেগে ছুটে গেল হলঘর পেরিয়ে একটা করিডরের দিকে। এ করিডর সে করিডর ঘুরে দাঁড়াল একটা দরজার সামনে।

এলোকেশী নেমে পড়েছে। ডাকছে গজাননকে। হাতের ব্রিফকেস নিয়ে নামতে যাচ্ছে সে, এমন সময়ে একটা কলের হাত এসে খামচে ধরল ওর হাত হাতটা বেরিয়ে এল গাড়ির অজস্র কলকবজার মধ্যে থেকেই।

ফিউরিয়াস হয়ে গেছিল গজানন। সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরা হাতটাকে ছাড়াতেও পারছে না, ধস্তাধস্তিই সার।

আবার সেই স্টিরিও মিউজিকের মতো হাসি হাসল এলোকেশী, আমার ব্যাগ রেখে এসেছি দেখছেন না? আপনারটাও রেখে আসুন। কমপিউটার চেকিং হবে।

কমপিউটার চেকিং। সেটা আবার কী?

গজগজ করতে করতে নেমে এল গজানন। কলের হাত ওর হাত ছেড়ে দিয়েই আচমকা পেছন থেকে এমন একটা পদাঘাত করল পশ্চাৎদেশে যে ছিটকে গিয়ে দড়াম করে দরজার ওপর পড়ল গজানন দ্য গ্রেট এবং দরজা স্পর্শ করার আগেই পাল্লা খুলে গেল আপনা থেকে। তাল সামলাতে না পেরে গজানন মুখ থুবড়ে পড়ল ভেতরে।

এ অবস্থায় গজানন কেন, স্বয়ং দশাননও মাথার ঠিক রাখতে পারে না। তিড়িং করে লাফিয়ে মোটরটাকে তুলে আছাড় মারবে বলে বেরোতে যাচ্ছে গজানন এমন সময় দরজা বন্ধ করে দিয়ে ছিটকিনি টেনে সামনে এসে দাঁড়াল এলোকেশী।

আশ্চর্য এইটুকু সময়ের মধ্যেই ভোল পালটে ফেলেছে। জিনস প্যান্ট আর ঢিলে শার্ট অন্তর্হিত হয়েছে। পরনে শুধু ব্রা আর ব্রিফ। ফরসা বডিখানা লীলায়িত ভঙ্গিমায় মেলে ধরেছে গজাননের সামনে। কণ্ঠে মদির আহ্বান, গজানন, এখন আমাদের আধঘণ্টার রেস্ট। কাম, এনজয়–আই ওয়ান্ট ইউ।

বলে কী হারামজাদি! আই ওয়ান্ট ইউ বললেই হল! গজানন কি তেলেভাজা যে ফুটপাতে কিনতে পাওয়া যায় এবং খাওয়া যায়?

কিন্তু…কিন্তু গজানন এরকম হকচকিয়ে যাচ্ছে কেন? ঘরের মায়াময় আলো-আঁধারির জন্যে কি? ছোট্ট ঘর। একপাশে পুরু গদির ডাবল বেড। গজাননকে ওই দিকেই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে প্রায় বিবসনা এলোকেশী। গজাননের সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসছে। হাত বাড়িয়ে গজাননের সার্টের বোতাম খুলে দিচ্ছে এলোকেশী। খাটে বসে পড়েছে গজানন। ভ্যাবা গঙ্গারামের মতো চেয়ে রয়েছে এলাকেশীর সরীসৃপের মতো ক্ষিপ্রতার দিকে। পাশের ছোট্ট টেবিল থেকে একটা মদের বোতল তুলে নিয়ে দুটো গেলাসে ঢেলে একটা এগিয়ে ধরেছে গজাননের দিকে। না…না…গজানন সুরাপান করবে না…কিছুতেই না…! এলোকেশী দু-হাতে দুটো গেলাস নিয়ে সবলে জাপটে ধরেছে গজাননকে–ঠোঁটে ঠোঁট…গরম হলকায় যেন পুড়ে যাচ্ছে গজাননের মুখ..কিন্তু মুখ সরাতে পারছে না..লিপস্টিকে মুখ মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে–তবুও না–গজানন চিৎ হয়ে পড়ে গেছে খাটে। গেলাস দুটো টেবিলে রেখে টান মেরে ট্রাউজার্সটা খুলে দিল এলোকেশী। চকিতে গজাননের দিকে পেছন ফিরেই ব্রায়ের মধ্যে থেকে একটা হোমিওপ্যাথিক গ্লোবিউলের মতো সাদা জিনিস বের করে ফেলে দিল একটা গেলাসে। পরমুহূর্তেই দুটো গেলাস নিয়েই ঘুরে দাঁড়াল গজাননের দিকে। যে গেলাসে পড়েছে সাদা গ্লোবিউল, সেই গেলাসটা ঠুসে ধরল গজাননের হাঁ করা ঠোঁটের মধ্যে।

আর একটু হলেই সুরাপান করে বসত গজানন। তারপর ইয়া আল্লা বলে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিত নিজেকে। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে ছোট্ট ঘরের একদিকের দেওয়ালের খানিকটা সরে যেতেই চৌকো খুপরির মধ্যে দিয়ে আবির্ভূত হল একটা বিকটাকার মুখোশ–শূন্যে ভাসছে। মুখোশের দাঁতের ফাঁকে একটা সিগারেট। সিগারেটের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল একটা ছোট্ট বুলেট–ঢুকল এলোকেশীর রগে।

গজাননের ঠোঁটের সামনে থেকে মদিরাপাত্র ছিটকে গেল খাটে। এলোকেশী তার নরম বুক নিয়ে শিথিল দেহে পড়ে রইল গজাননের ওপর।

.

গজানন এখন জামাপ্যান্ট পরে নিয়েছে। আঙুল দিয়ে আঁচড়াচ্ছে মাথার লম্বা চুল। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে রামভেটকি এবং ডক্টর সিঙ্কারো নামে সেই দাড়িওলা বৃদ্ধ যিনি কিনা এককালে হিটলারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।

ডক্টরের হাতে রয়েছে বিদঘুঁটে সেই অস্ত্র। জোরালো স্পট লাইটের তলায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছেন।

রামভেটকি হাসি গোপন করার চেষ্টা করে বলছে, মাই ডিয়ার গজানন, আপনার পদস্খলন হচ্ছিল বলে এলোকেশীকে শট ডেড করা হয়েছে একথা যেন ভাববেন না।

কটমট করে তাকাল গজানন, টার্গেট ছিলাম নিশ্চয় আমি?

জিভ কাটল রামভেটকি। গরিলামুখে জিভ কাটার ফলে আরও হাস্যকরই দেখাল শ্রীহীন। মুখাবয়ব।

বলল, ও নো। কমপিউটার চেকিং-য়ে ধরা পড়ল এলোকেশী ডাবল গেম খেলে চলেছে।

মা–মানে?

দরজার ফ্রেমে লাগানো আপনার ক্যামেরার ফিল্মে কার ছবি উঠেছে জানেন? এলোকেশীর। বিটকেল ওই হাতিয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসছে আপনার ঘর থেকে।

এলোকেশী।

ও ইয়েস। যাকে আপনি এনজয় করতে যাচ্ছিলেন।

শাট আপ।

এলোকেশীই প্রথম গিয়েছিল আপনাকে সাবাড় করতে–তখন আপনি ঘরে ছিলেন না। নিশ্চয়–

ডাইনিং রুমে গেছিলাম। রাইট।

তারপরেই এল সেই লোকটা। তার ফটোও উঠেছে সিক্রেট ক্যামেরার।

গজাননের গজমস্তিষ্কে একটা সূক্ষ্ম চিন্তা স্মৃতির আকারে কঁ করে দেখা দিল সেই মুহূর্তে। মস্তিষ্ক কখন যে কী করে বসে তা তাবড় মস্তিষ্কবিশারদরাও জানেন না। তাই আচম্বিতে গজাননের মনে পড়ে গেল সল্টলেকের ত্রিশূল ঘাঁটির দোতলায় দাঁড়িয়ে যখন যে নস্যগ্রহণ করছে, নিচের বাগানে সন্ধের আঁধারে সাঁৎ করে মিলিয়ে গেছিল একটা ছায়ামূর্তি। তড়িঘড়ি নিচে নেমে এসে দেখেছিল খান বুদোশের কবন্ধ দেহ।

এলোকেশীই কি তাহলে…?

সন্দেহটা মুখে প্রকাশ করতেই রামভেটকি সায় দিলে, রাইট ইউ আর। খান বুদোশ অনেক জানত। তাই মুন্ডু উড়িয়ে দিয়েছিল এলোকেশীই ইস তখন যদি জানতাম।

হারামজাদি ওই জন্যেই সরিয়ে দিয়েছিল আমাকে, দাঁত কিড়মিড় করে গজানন।

গলা খাঁকারি দিলেন ডক্টর সিঙ্কারো। ভালো বাংলায় বললেন, মহাশয়গণ, এই সেই অস্ত্র যার গোপন ফরমুলা হিটলার ছাড়া কাউকে জানানো হয়নি।

সিঙ্কারো এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। হাতে সেই ভয়াল অস্ত্র।

বলছেন, অজানা এক দো-আঁশলা ধাতু দিয়ে এর বডি তৈরি হয়েছে। সামান্য তাপ পেলেই রবারের মতো ফুলে উঠতে থাকে। তারপর আগের অবস্থায় ফিরে যায় হঠাৎ। চেম্বারে যে অ্যাটমিক রিঅ্যাকশন ঘটে, তার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দেয় প্রচণ্ড প্রেসার দিয়ে। এক সেন্টিমিটার ডায়ামিটারের গোল বুলেট ঠিকরে গিয়ে ফাটে ছোট্ট অ্যাটম বোমার মতো কিন্তু শব্দ হয় না। নিশ্চিহ্ন করে দেয় টার্গেট।

চোয়াল ঝুলে পড়েছিল গজাননের। রবারের মতো বেড়ে যায় এ আবার কী ধাতু?

রামভেটকি কিন্তু চোয়াল শক্ত করে বললে, এরকম কটা গুলি আছে ভেতরে।

আরও ছত্রিশটা।

মাই গড।

এই ট্রিগারটা টিপলেই–

ঘরে ঢুকল একটি মূর্তি। পুরুষ। ভাবলেশহীন মুখে রামভেটকির দিকে তাকিয়ে বললে, মেসেজ এসেছে জিরো ওয়ান ফোর টু থেকে।

গজাননের ঝোলা চোয়াল উঠে এসেছিল লোকটাকে দেখেই। আচমকা সুড়সুড় করে উঠেছিল গালের কাটা দাগটা। অজান্তেই হাত বুলিয়ে ফেলতেই মাথার মধ্যে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।

রামভেটকি আর সিঙ্কারো দেখলেন শুধু আশ্চর্য দৃশ্য। দাঁড়িয়ে থেকেই বডি থ্রো করল গজানন। দু-হাত সামনে প্রসারিত। কাঁক করে পুরুষমূর্তির গলা টিপে ধরে হেঁকে উঠল ছাদ কাঁপানো স্বরে– অত উঁচু থেকে পড়েও মরিসনি?

রহস্য! রহস্য! রহস্য!

কে এই আগন্তুক যাকে দেখেই গজাননের তাৎক্ষণিক পাগলামি চাগিয়ে উঠল?

এই সেই আততায়ী–বোম্বাই হোটেলে যে বিকট হাতিয়ার নিয়ে গজাননকে কবন্ধ বানাতে গেছিল–গজাননের হাতে হাতিয়ার দেখেই জানলা দিয়ে লাফ মেরেছিল। কিন্তু সে কি মরেনি?

মরেছিল। হাড়গোড় ভেঙে পিণ্ডি পাকিয়ে গেছিল।

তবে এ লোকটা কে?

তারই ডবল।

রহস্য পরিষ্কার হয়েছিল আস্তে-আস্তে অনেক জেরা এবং অনেক কাণ্ডকারখানার পর।

অবতার সিং-এর নকল সাজিয়েছিল ত্রিশূল আসল অবতার সিংকে বাঁচাবার জন্যে। বিকট হাতিয়ারের কোপটা তাই গেছে নকল অবতারের মুন্ডুর ওপর দিয়ে।

কিন্তু যারা এই নৃশংস কাণ্ড করে চলেছে, তারা নকল মানুষ বানানোর ব্যাপারে এগিয়ে গেছে আরও কয়েক ধাপ। যে-কোনও প্রাণীর দেহকোষ থেকে সম্পূর্ণ সেই প্রাণীটাকে সৃষ্টি করতে পারে ল্যাবরেটরিতে। এক কথায় যাকে বলে ক্লোনিং। আফ্রিকান ব্যাঙকে ক্লোন করে নকল ব্যাঙ তৈরির পর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এক বৈজ্ঞানিক হুঁশিয়ার করেছিলেন–খবরদার। মানুষ ক্লোন করতে যেও না। দানব তৈরি হয়ে যেতে পারে।

গুপ্ত শত্রুরা ঠিক তাই করেছে। রামভেটকির এই বিশ্বস্ত অনুচরটিকে মদের আড্ডায় ঘুম পাড়িয়ে তার হাতের চামড়া চেঁচে নিয়ে সেই কোষ থেকে বানিয়েছিল হুবহু দুই অনুচর। একজনকে পাঠানো হয়েছিল গজানন নিধনে। আর একজন মোতায়েন রয়েছে ত্রিশূলেরই এই গোপন আস্তানায়। গজানন যদি তাকে চিনে না ফেলত, না জানি আরও কত নৃশংস কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়ত দানব-মগজওলা এই নকল পুরুষটি।

আসল অনুচরটি তাহলে এখন কোথায়?

সব চেয়ে কঠিন প্রশ্ন!

জবাব পেতে কালঘাম ছুটে গেছিল ত্রিশূলবাহিনীর। নিষ্ঠুর নিপীড়নে প্রাণটাকে শুধু টিকিয়ে রেখেছিল নকল অনুচরদের মধ্যে। তারপর হিপনোটিক সাজেশানের পর বেরিয়ে এল জবাবটা।

আন্দামান আর নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের যে কটি দ্বীপে আগ্নেয়গিরি আছে, তারই একটিতে নিবিড় বনানীতে ভারত-শত্রুদের ঘাঁটিতে বন্দি রয়েছে ত্রিশূলের পরম বিশ্বস্ত এই অনুচরটি। হয়তো তার দেহকোষ থেকে অ্যাদ্দিনে তৈরি হয়ে গেছে আরও অনেক চলমান দানব।

.

ডুবো জাহাজ চলেছে আন্দামানের জলতল দিয়ে। ভারত সরকারের সাবমেরিন। যেন একটা তিমি মাছ।

আগ্নেয়দ্বীপে দিবালোকে বা নিশীথ রাতে ডাঙায় নামা বিপজ্জনক, এ খবরটা আগেই দিয়ে রেখেছিল নকল অনুচর। তাই এই ব্যবস্থা।

গজানন গ্যাঁট হয়ে বসে ছোট্ট একটা চেম্বারে। বেপারীটোলা লেনের অফিসে বসে থাকার মতোই পোজ মেরে রয়েছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন বেড়াতে বেরিয়েছে। মাথার কোটরে যে চিন্তাকীট রাশি-রাশি কুরেকুরে খাচ্ছে, তা প্রকাশ পাচ্ছে না মোটেই। একেই বলে গুরুর ট্রেনিং।

গুরুর নির্দেশটাও সুরুৎ করে চলে যাচ্ছে মগজের অযুত নিযুত রন্ধ্রের মধ্যে দিয়ে। দেশের সেবায় এই দেহমন্দিরকে উৎসর্গ করে চলেছে গজানন দ্য গ্রেট। শত্ৰুপুরীতে প্রবেশ করবে একা।

তারপর?

তারপর নাস্তি।

রামভেটকি এসে দাঁড়াল সামনে। গরিলাআননে সংশয়। পারবে তো গজানন দুর্ভেদ্য দুর্গকে। ভেতর থেকে উড়িয়ে দিতে?

গজানন সটান চাইল রামভেটকির চোখে-চোখে। মাথার মধ্যে চিন্তাকীট রাশি রাশি ফুসফাস করে মিলিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। রামভেটকির ওই সংশয় ভরা চাহনি নিমেষে পালটে দিয়েছে গজাননের মুখচ্ছবি। কঠিন প্রত্যয় আর সর্বনাশা জেদ ফের মাথাচাড়া দিয়েছে।

বললে সংক্ষেপে, নামবার সময় হয়েছে?

হ্যাঁ।

.

গজানন এখন দ্বীপে দাঁড়িয়ে। সাবমেরিন বিদায় নিয়েছে। ইষ্টমন্ত্র জপ করতে গিয়ে পুঁতিবালার নাম স্মরণ করে ফেলেছে গজানন বেশ কয়েকবার। ভাবনাটা যে শুধু ওকে নিয়েই। ছাতার তলায় ছিল এতদিন। গজানন অক্কা পেলে ভেসে যাবে বেচারি। রূপ আর যৌবন…

অন্ধকার অন্ধকার…চারিদিকে নিঃসীম অন্ধকার। আশেপাশে ছোট-বড় গাছের ভিড়। পেছনে সমুদ্রের বিরামবিহীন কলরব। রাতজাগা প্রাণীও কি নেই ছাই এই ভয়ঙ্কর দ্বীপে?

এত নৈঃশব্দ্য ভালো লাগছে না গজাননের। পায়ে-পায়ে নিবিড় বনানী ছাড়িয়ে এক চিলতে ফাঁকা জায়গায় আসতেই আচম্বিতে সারা দেহে অনুরণন অনুভব করল গ্রেট জি।

প্রতিটি লোমকূপ যেন তরঙ্গায়িত হচ্ছে। গোড়ায়-গোড়ায় যেন বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হচ্ছে। বডিটাও বেশ হালকা লাগছে। পা ফেলতে গিয়ে সেটা আরও ভালোভাবে টের পাওয়া গেল। পা খানা মাটিতে পড়ল না।

জোর করে পা দিয়ে মাটি স্পর্শ করতে গিয়ে পেছনের পা-খানাও উঠে এল মাটি ছেড়ে– গজানন না চাইতেই।

পায়েদের এবম্বিধ অবাধ্যতা গজানন অন্তত সইতে পারে না। কোনওমতেই না। হেঁট হয়ে তাই দেখতে গেছিল পা দুখানা আছে কোথায়…

চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।

দুটো পা-ই মাটি থেকে অনেক ওপরে। তা প্রায় দশফুট তো বটেই। অন্ধকারে সঠিক মালুম হচ্ছে না। তবে হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

গজানন শূন্যে ভেসে উঠেছে। এবং আরও উঠছে। দেখতে-দেখতে গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে দেহমন্দির উঠে এল বেশ উঁচুতে।

আর তারপরেই দেহময় বিদ্যুৎপ্রবাহ এমনই প্রবল হয়ে উঠল অকস্মাৎ যে জ্ঞান লোপ পেল গজাননের।

.

গজানন জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে আছে। মাথার ওপর জ্বলছে চৌকো টালির মতো একটা সাদা আলো। নরম আভায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে না।

চোখের মণি ঘুরিয়ে (দেহ না নাড়িয়ে) আশপাশ দেখে নিল গজানন। জ্ঞান ফিরে পেলেই তথাকথিত নায়কদের মতো আমি কোথায়? বলার ট্রেনিং সে পায়নি। ব্যাপারটা গুরুতর, তা আঁচ করেছে চৈতন্য ফিরে আসতেই। তার আগে জানা দরকার, বেলুনের মতো শূন্যে ভাসিয়ে তাকে আনা হয়েছে কোথায়।

বিশাল গহ্বর মনে হচ্ছে না? আশেপাশে অনেকদূর পর্যন্ত ফাঁকা তারপর পাহাড়ের দেওয়াল বলেই তো মনে হচ্ছে। সে দেওয়াল আঁধারের মাঝে উঠে গেছে অনেক ওপরে–অনেকটা গম্বুজঘরের মতো গোল হয়ে জড়ো হয়েছে মাথার ওপর।

চৌকো আলোক-টালির ফাঁক দিয়ে বহু উঁচুতে দেখা যাচ্ছে রন্ধ্রপথ। পর্বতচূড়া নিঃসন্দেহে। আকাশ আর তারা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে সুস্পষ্ট।

জয় মা কালী! এ কোথায় এনে ফেললে মা আমাকে! এ যে ফোঁপরা পাহাড়। প্রকৃতিতে এরকম বিস্ময় বিরল নয়, তা জানে গজানন। নেচার বহুত মিস্টিরিয়াস। কি কিন্তু শত্রু ঘাঁটি এহেন স্থানে।

জুলজুল করে চেয়েই রইল গজানন। একটা আঙুল আগে নাড়াল। নড়ছে। তারপর টের পেল সারা দেহটাই নাড়ানো যাচ্ছে। অর্থাৎ, শত্রুপক্ষ তাকে না বেঁধেই ফেলে রেখে গেছে। তোবা! তোবা! কিন্তু কেন? লম্ফ দিয়ে চম্পট দেবে নাকি?

কিন্তু তা হল না। ওই একটু আঙুল নাড়ানোতেই সজাগ হয়ে উঠেছিল পাশের একটা যন্ত্র। দেখতে অবিকল স্টার ওয়ার্স সিনেমার পিপে রোবটের মতো। যন্ত্রচক্ষু এতক্ষণ সজাগ নজর রেখেছিল তার ওপর। এবার সরব হল যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর।

গজানন মহাশয়, আপনি অযথা নড়িবেন না। প্রাণ যাইতে পারে।

ওরেব্বাস! এ যে সাধু ভাষায় কথা বলে। গলার আওয়াজটা যদিও খাসা স্টিরিও বাজনার মতো।

যথাসম্ভব মধুর কণ্ঠে গজানন বললে, বৎস রোবট, আমাকে এই স্থানে লইয়া আসিয়াছ কেন?

আপনার মস্তিষ্ক কাটিয়া ক্লোনিং কপি রোবট বানাইব বলিয়া।

ভেতরে-ভেতরে আঁতকে উঠলেও গজানন অকস্মাৎ অট্টহাস্য করে উঠল। যন্ত্ররা বিরক্ত হতে জানে না। তাই অবিচল কণ্ঠে বললে, হাস্যের কারণ জানিতে পারি কি?

নিশ্চয়, নিশ্চয়। বৎস রোবট—

আমার নাম সি-কে-টু-ফোর।

ওকে! ওকে! মাই ডিয়ার সি-কে-টু-ফোর, আমি যে অলরেডি রোবট।

প্রাঞ্জল করিয়া বলুন।

আমি উন্মাদ হইয়া গিয়াছিলাম। মানসিক ডাক্তার আমার ব্রেনটাকে বদলাইয়া দিয়া সুস্থ করিয়াছে।

ব্রেন স্ক্যান করিয়া সেরূপ কোনও লক্ষণ দেখা যায় নাই।

তোমাদের যন্ত্রে দেখা যাইবে না। ইহা এক প্রকার কেমিক্যাল হরমোন-ধাতু নয় যে দেখা যাইবে।

কেমিক্যাল হরমোন?

ইয়েস মাই ডিয়ার সি-কে-টু-ফোর, ইতিপূর্বে ক্লোনিং কপি রোবট বানাইয়াছ এবং আমাকে খতম করিবার জন্য পাঠাইয়াছ, তাহাদের আমি খতম করিয়াছি এই কারণেই।

যন্ত্র চুপ। আর এক দফা অট্টহাসি হাসল গজানন।

বলল, শূন্যপথে আনিলে কীভাবে আমাকে?

হাইপার ফোর্স দ্বারা।

সে বস্তুটা কী?

অ্যান্টিগ্র্যাভিটি।

সে তো কল্পবিজ্ঞানে হয় শুনিয়াছি।

বিজ্ঞান তাহার হদিশ জানিয়াছে। এই পৃথিবীতেই ছশো ফুট ওপর পর্যন্ত হাইপার ফোর্সের অস্তিত্ব রহিয়াছে। আমরা কেবল তাহাকে জোরদার করিয়াছি।

উত্তম করিয়াছ। এবার আমাকে ছাড়িয়া দাও।

তৎপূর্বে আপনার ব্রেনের কেমিক্যাল টেস্ট হইবে।

তোমার মুণ্ডু হইবে, বলেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছে গজানন, এমন সময়ে থ হয়ে গেল পুঁতিবালাকে দেখে।

বহু উঁচু থেকে পাহাড়চুড়োর ছিদ্রপথ দিয়ে লম্বভাবে সটান শূন্যপথে নেমে এল একটা নারীমূর্তি। দাঁড়াল তার সামনে।

পুঁতিবালা। কটমট করে তাকিয়ে আছে সি-কে-টু-ফোরের দিকে। সি-কে-টু-ফোর যেন সন্ত্রস্ত হল সেই মূর্তি দেখে। কয়েক ইঞ্চি পেছনে সরেও গেল। কিন্তু তার আগেই ধেয়ে গেল পুঁতিবালা। খোঁপা থেকে একটা চুলের কাটা বের করে ঢুকিয়ে দিলে রোবটের অনেকগুলো ফুটোর একটায়।

সবকটা আলো নিভে গেল সি-কে-টু-ফোরের গায়ে, গোঙানির মতো একটা যান্ত্রিক আওয়াজ কেবল নির্গত হল স্পিকার থেকে।

ঘুরে দাঁড়াল পুঁতিবালা। বললে খুব সহজ গলায়–ফিউজ করে দিলাম।

তু-তুই এখানে কীভাবে এলি? গজানন হতবাক।

সে অনেক কথা। পরে শুনবে, হারামজাদারা অনেক আগেই এনেছিল আমাকে। এদের বস ব্যাটাচ্ছেলের নিজের বউ আছে কিন্তু পরকীয়া লোভী কিনা–তাই… নিগুঢ় হাসল পুঁতিবালা।

গা পিত্তি জ্বলে গেল গজাননের।

এখানেও ওই সব করছিস।

ডিউটি ফাস্ট, উৎকট গম্ভীর মুখে বললে পুঁতিবালা, বাকি সব নেক্সট। পুরো তল্লাটটার খবর নেওয়া হয়ে গেছে। ওরা মোট নজন আছে। ওদিকের স্টিল চেম্বারে একজনকে ক্লোনিং কপি রোবট বানাচ্ছে–আমাকেও করত। পরকীয়ার জোরে ফিক করে হেসে ফেলে পুঁতিবালা।

কী করবি এখন? রাগ চেপে বলে গজানন।

এসো আমার সঙ্গে, এগিয়ে যায় পুঁতিবালা হরিণীর মতো ক্ষিপ্র গতিতে। গজাননও চলে পেছন-পেছন।

সাদা হেলিকপ্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বললে পুঁতিবালা, চালাতে জানো?

সব জানি।

তবে উঠে বোসো।

তারপর? পাহাড়ের ওই ফুটো দিয়ে হেলিকপ্টার তো বেরোবে না।

ফুটো দিয়ে নয়, এই বোতামটা টিপলেই– পাহাড়ের গায়ে একটা বোতাম টিপল পুঁতিবালা–চিচিং ফাঁক করে।

হলও তাই। পাথুরে দেওয়াল সরে গেল একপাশে। স্টিল ডোর। পাথরের মতো নকশা করা বলে পাথুরে দেওয়াল বলে মনে হয়েছিল এতক্ষণ।

সামনে খোলা চত্বর। তারপর…

পুঁতিবালাকে ফেলেই ভেতরে উঠে গেল গজানন। রামভেটকির দাপটে তাকে অনেক কিছুই শিখতে হয়েছে। এবার তা কাজে লাগাল।

কিন্তু পুঁতিবালা আসছে না কেন?

হেঁকে ডাকা তো যাচ্ছে না। মুখ বাড়িয়ে চক্ষু স্থির হয়ে গেল গজাননের।

লাল রঙের একটা পেল্লায় ঘড়ির কাঁটা ঘুরোচ্ছে পুঁতিবালা। ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে এক জায়গায় রেখেই দৌড়ে এসে উঠে পড়ল হেলিকপ্টারে।

বললে রুদ্ধশ্বাসে, ঝটপট চলল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সরে যেতে হবে। আওয়াজ পেয়ে ওরা ছুটে এলেই–

আর বলতে হল না গজাননকে। ইঞ্জিন স্টার্ট করে হেলিকপ্টার চালু করল চক্ষের নিমেষে। পর্বতকন্দর থরথর করে কেঁপে উঠল ভীষণ আওয়াজে। হইহই আওয়াজ শোনা গেল দূরে। ঘাড় কাত করে দেখল গজানন নটা মূর্তি ছুটে আসছে এদিকে। দুমদাম শব্দে তপ্ত বুলেট ঠিকরে আসছে ওদের দিকে।

আর তাকায়নি গজানন। ঈষৎ কাত হয়ে হেলিকপ্টার চক্ষের নিমেষে বেরিয়ে এল পাহাড়ের বাইরে এবং সেইভাবেই ছিটকে গেল আকাশের দিকে।

পাঁচমিনিট পূর্ণ হতেই পুঁতিবালার হাতে সেট করা টাইম বোমা বিস্ফোরিত হল।

বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। আন্দামানের সেই দ্বীপটি আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন বললেই চলে।

গুপ্তচর বাহিনীর বাকি ঘাঁটিগুলোও নির্মূল হয়েছে এরপরে পুঁতিবালার সংগৃহীত তথ্যের বলে।

অতএব অতীব রোমাঞ্চকর এবং অবিশ্বাস্য এই কাহিনিরও সমাপ্তি এইখানে।

* দ্বীপবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত। (শারদীয় সংখ্যা।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *