1 of 2

প্রবঞ্চক সম্রাট

প্রবঞ্চক সম্রাট

যে কোনও ব্যাঙ্কে চলে আমার নোট? দেখবেন হাজার টাকার নোট কীভাবে ডবল করি।

রোমাঞ্চর প্রিয় সম্পাদক মহাশয়,

আমার নাম ইন্দ্রনাথ রুদ্র। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আমার সঙ্গে আপনার পরিচয় আমার অসাহিত্যিক বন্ধু মৃগাঙ্কর সৌজন্যে। আমার ডাইরি থেকে দু-চারটে ছেঁড়া কাহিনি মাঝে-মাঝে ও উদ্ধার করে এবং তাই নিয়ে ফুলিয়ে ফঁপিয়ে গল্প নামক যে বস্তুগুলি রচনা করে, আমার মতে তা শুধু অপাঠ্যই নয়–আগাগোড়া ভুল। আমার কানে আসে সেসব গল্পে নাকি আমাকে ও অতিমানব সাজায়। ম্যাজিশিয়ান আর ডিটেকটিভ যে একই জীব, এইটা প্রমাণ করবার চেষ্টা করে। আমার আপত্তি সেইখানেই। আমি ম্যাজিশিয়ান নই। অলৌকিক শক্তিধরও নই। আমি সাধারণ মানুষ। পরাজয়ের গ্লানি আমার ললাটেও জোটে। কিন্তু মৃগাঙ্ক কি কোনওদিন আপনাদের শুনিয়েছে আমার পরাজয়ের কাহিনি? শুনিয়েছে কি দুরন্ত এক প্রবঞ্চক-সম্রাটের কাছে কীভাবে আমি বারংবার হার স্বীকার করেছি? শুনিয়েছে কি রাজা কঙ্কর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আর দুর্জয় সাহসের আশ্চর্য উপাখ্যান?

জানি কী বলবেন। বলবেন, শুনিয়েছে বইকী। রাজা কঙ্কর প্রতারণা কাহিনি রোমাঞ্চতেই প্রকাশ পেয়েছে এই সেদিন। আরে মশাই, সে কাহিনিতে আমার পরাজয়ের বর্ণনা কতখানি ছিল, তা কি তলিয়ে দেখেছেন? দেখেননি। এটা ঠিক, রাজা কঙ্কর টিকি একবারই আমি স্পর্শ করতে পেরেছিলাম। হিমাচল থেকে সিন্ধু অঞ্চল পর্যন্ত সুপুরুষ যে মানুষটি যাদুকরেরই মতো লোক ঠকিয়েছে মাসের পর মাস যার নাম শুনলেই এখনও শিহরিত হয় পুলিশ মহল, ধুরন্ধর শিরোমণি সেই রাজা কঙ্ককে একবারই আমি বাগে আনতে পেরেছিলাম।

রাজা কঙ্কর সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র পাঁকাল মাছের। একাধিকবার গো-হারান হারিয়েছে সে আমায়, বলতে গেলে কাছে এসেও গালে ঠোনা মেরে চম্পট দিয়েছে। সে শঠ, সে প্রতারক, সে কপট; কিন্তু সে মহা ওস্তাদ, মহা ধড়িবাজ, মহা শক্তিমান। রূপে সে কার্তিক, বাকল্লায় সেলসম্যান। তার টাক উঁচুমহলের রাঘববোয়ালের ট্যাকের দিকে; ডাগর মেয়েদের প্রয়োজন কেবল ফঁদ পাতার খাতিরে শিকারকে ডেড়েমুষে নেওয়ার পর ডাকসাইটে সুন্দরীকেও হেলায় পরিত্যাগ করতে দ্বিধা করে না বিন্দুমাত্র। সে যখন আসরে অবতীর্ণ হয়, তখন আসে সবার সামনে দিয়ে– পাঁদাড় দিয়ে নয়। মহা ধুমধাড়াক্কা সহকারে শুরু হয় তার দাঁও মারার কারবার। সোমত্ত মেয়েরা পাগল হয়ে যায় তার রূপে, তার চাল-চলনে। ধূর্ত ধনীরা মোহিত হয় তার বনেদিয়ানায়, রাজার মতো খানদানি পট্টি মারায়। তারপর শুরু হয় ধোঁকাবাজ-শিরোমণির শেষ খেলা। অতি বড় সেয়ানাকেও পটকে দিয়ে পিট্টান দেয় রাজা কঙ্ক। উধাও হয়ে যায় রাতারাতি।

রাজা কঙ্ক! রাজা কঙ্ক! রাজা কঙ্ক! রাজা সে কোনোকালেই ছিল না। কিন্তু তার নেকনজর রাজারাজড়ার দিকেই। ভাড়াভাড়ির মস্ত আর্টে সে কুশলী আর্টিস্ট। ভড়ং দিয়ে ভাওতা মারার মহাবিদ্যায় সে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। সে জানে, বারফট্টাইয়ের প্রয়োজন ঠিক কখন এবং ভেড়া বানাবার মুহূর্ত আসে কোন সময়ে। রূপচাঁদ তার একমাত্র সাধনা, লোচ্চামো নয়। নারী তার সাধনা-সহচরী– অঙ্কে শোয়ানোর জন্য নয়।

রাজা কঙ্ক তাই একটা বিস্ময়। অন্তত আমার কাছে। রাজা কঙ্কর কাহিনি অলীক নয়, রাজা কঙ্কর কাহিনি কপোলকল্পিত নয়–এ কাহিনি সূর্যের মতো সত্য, ঈশানী ঝড়ের মতো নিষ্ঠুর। কিন্তু এমন আশ্চর্য উপাখ্যানকেও হরেকরমবা কাহিনি বানিয়ে ছেড়েছে আমার বন্ধু মৃগাঙ্ক।

রাজা কঙ্ককে একবারই আমি বাগে এনেছিলাম। কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি। উধাও হয়ে গিয়েছিল রাজা। কোনও হদিশ আর পাইনি। পেলাম যখন-তখন আর একজনের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। গল্পটা শুনলাম, তারই মুখে।

গোয়ার সাগর সৈকত। ঝিকঝিকে সাদা বালির ওপর যেন চাঁদের হাট বসেছে। রূপ আর যৌবনের সেই মেলায় অনভ্যস্ত চক্ষু বিস্ফারিত হয় বইকী।

কিন্তু রাজা কঙ্কর দৃষ্টি নেই কোন দিকে। গোঁয়ার কোলভা বিচ তার কাছে নতুন কিছু নয়। সাগর, জমি আর আকাশ যেখানে একাকার হয়ে গিয়েছে, যেখানকার নিসর্গশ্রী নেহাত অকবিকেও কবি হতে বাধ্য করে, আশ্চর্য সুন্দর সেই কোলভা সৈকতে রূপ আর রুপো নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে আসে কেবল ধনীর দুলালরা। তারা আসে বোম্বাইয়ের রুপোলি পরদার জগৎ থেকে, আসে কোটিপতিদের কুবের মহল থেকে।

রাজা কঙ্ক এদের নাড়িনক্ষত্র জানে। বোম্বাইয়ে তার লীলাখেলা ঘটেছে একাধিকবার। তার মুখশ্রীর সঙ্গে পরিচয় অনেকেরই। রাজা কঙ্ক তবুও রাজা কঙ্ক। অকুতোভয়, নির্ভীক, দুর্মদ।

তাই কোলভা সৈকতে আবার দেখা গেল রাজা কঙ্ককে। রাজার মতোই তার আর্বিভাব। সাড়া পড়ে গেল প্রথম আবির্ভাবেই। প্রকাণ্ড রোলসরয়েস গাড়ি এসে দাঁড়াল সব চাইতে বিলাসবহুল হোটেলের সামনে। ঝলমলে রোলসরয়েসের সোফারটিও রীতিমতো ঝলমলে। যেমনি সাজের বাহার, তেমনি চেহারা। লোকটা জাপানি।

বাতায়নে বারান্দায় ভিড় জমে গেল আরোহীর দর্শনলাভের প্রত্যাশায়। জাঁকালো মূর্তি। চোখে মনোবল। খানদানি রূপ বটে।

কিন্তু আশ্চর্য মানুষ তো রাজা কঙ্ক! সেই যে নিজের ঘরে ঢুকল, আর দেখা নেই। ঝাড়া দুটো দিন যেন ধ্যানস্থ হয়ে রইল ভদ্রলোক নিজের স্যুটে।

বিদ্যুৎচমকের মতো একবারমাত্র দেখা দিয়েই অন্তর্ধান করাটা রাজার একটা মস্ত কায়দা। চোখ ঝলসে দিয়েই উধাও হওয়ায় কৌতূহল বৃদ্ধি পেতে থাকে উত্তরোত্তর। না জানি কত বড় যক্ষপতি! ধার ধারে না কারও।

পুরো দুটো দিন গেল এইভাবে। কৌতূহলে যেন ফেটে পড়তে লাগল আশপাশের সবাই। দুদিন পরে সৈকতে দেখা গেল রাজা কঙ্ককে। মাথার ওপর রঙিন ছাতা। হাতে ভোলা বই। ভিড় যেখানে, সেখান থেকে বেশ খানিকটা তফাতে বসে মৌনি বুদ্ধের মতো ধ্যানস্থ অলীক কাহিনির পৃষ্ঠায়।

কিছুক্ষণ পরেই সৈকতের বালি মাড়িয়ে হনহন করে প্রায় দৌড়ে এল জাপানি সোফার। হাতে একটা টেলিগ্রাম।

ধ্যান ভাঙল রাজার। উদাসীন দুই চোখে ঈষৎ বিরক্তি। সেইসঙ্গে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস, কী জ্বালা! দু-দণ্ড শান্তিও কি নেই?

টেলিগ্রামে চোখ বুলিয়েই ফিরিয়ে দিল রাজা। মাথা নেড়ে জানাল জবাব দেবার কোনও সদিচ্ছাই তার নেই।

এক ঘণ্টাও গেল না। আবার দ্রুতছন্দে আবির্ভাব ঘটল জাপানি সোফারের। হাতে আর একটা টেলিগ্রাম। না, এবারও জবাব দেবে না রাজা। কিছুক্ষণ যেতে-না-যেতেই এল আবার একটা টেলিগ্রাম। এবারও বিষম বিরক্তিতে মাথা নাড়ল রাজা। একই দৃশ্যের পুনরাভিনয় হয়ে চলল বারংবার।

সারাদিন গেল। পরের দিন গেল। তার পরের দিনও ঘটল তাই। পরপর তিন দিন একই দৃশ্য ঘটে চলল ঘণ্টায়-ঘণ্টায়। রাজা কঙ্ক উদাসীন। কিন্তু বিরাম নেই টেলিগ্রাম আসার। উদগ্র কৌতূহলে থমথম করতে লাগল সারা সমুদ্র-সৈকত।

সাহস করে কেউ যদি একখানা টেলিগ্রামেও চোখ বুলোত, থ হয়ে যেত সঙ্গে-সঙ্গে।

কেন না, প্রতিটি টেলিগ্রামই ফাঁকা–একটি শব্দও লেখা নেই তাতে।

এতবড় ধোঁকাবাজি অনুমান করার ক্ষমতাও এল না কারও মাথায়। তাই পুরো একটা সপ্তাহ গেল শুধু এই খেল দেখেই। রহস্য যখন তুঙ্গে পৌঁছল, আসর যখন গমগমে হয়ে উঠল, রাজার নামে টেলিগ্রাম আসা নিয়ে যখন সমুদ্র-সৈকতের ফিসফিসানি সমুদ্র গর্জনের সঙ্গে একাকার হয়ে গেল, তখন খানদানি খোলস খুলে ঈষৎ আত্মপ্রকাশ করল রাজা। তাও সোফারের মুখ দিয়ে।

টেলিগ্রাম কীসের? আরে ছোঃ! দেশ বিদেশের বহু কারবারি চাইছে তার উপদেশ, চাইছে তার সাহায্য, সহযোগিতা। বড়-বড় কারবারে রাজা কঙ্কর টাকা চাই। রাজা কঙ্ক থাকলেই চলবে সেসব কারবার, নইলে নয়। কিন্তু নাম-মাহাত্ম্যর বিড়ম্বনায় রাজা বিলক্ষণ বিড়ম্বিত। কারণ, রাজা কঙ্কর আর টাকার দরকার নেই। এত টাকা জমেছে তার ভঁড়ারে যে নতুন অর্থের কোনও লালসাই আর নেই। তাই রাজা উদাসীন। তাই টেলিগ্রামের পর টেলিগ্রাম আসছে, কিন্তু জবাব যাচ্ছে না কোনওটারই।

সাড়া পড়ে গেল কোলভা বিচে। সাক্ষাৎ কুবের নাকি? এত টাকাও মানুষের থাকে?

সফল হল রাজার প্রথম চাল। খানদানি মহলে কায়েমি হয়ে গেল রাজার মৌরসী পাট্টা। তবুও রাজার প্রাণে সুখ নেই। কেন না, উঁচু মহলকে নিয়ে তো তার দরকার নয়। দরকার এমন একজনকে যে উঁচু মহলের বাসিন্দা নয়, অথচ নজর সেই দিকেই। প্রাণে শখ অনেক, কিন্তু সাধ্য নেই। কারণ, তার অর্থ চাই–আরও অর্থ।

রাজা খুঁজছে এমনি এক শিকারকে। কোন হতভাগ্যের ওপর শ্যেন দৃষ্টি পড়বে রাজার, তা এখনও জানা যায়নি বটে, তবে জমি প্রস্তুত। এখন শুধু প্রতীক্ষা।

পুরো তিনটে দিনও গেল না সার্থক হল প্রতীক্ষা। কোলভা বিচে আবির্ভাব ঘটল এক আজব জীবের। ঝলমলে ইমপালা গাড়ি থেকে নামলেও সাগর স্নান সম্বন্ধে বিলক্ষণ শঙ্কিত লোকটা। তেল-চুকচুকে মুখ। কিন্তু টাই স্যুট পরে কী হনু একটা ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা সর্বক্ষণ। কয়েকবার দেখেই জীবটিকে পছন্দ হয়ে গেল রাজা কঙ্কর।

কী হনু প্রাণীটির নাম নাকি নির্বাণকুমার। ফিল্মস্টারদের নামের অনুকরণে নামগ্রহণের মধ্যেও উঁচু মহলে ওঠার প্রয়াস। চডুকে হাসি সবসময়েই অট্টহাসির সামিল। বিচে যারা কেষ্টবিষ্টু, তাদের গায়ে গা ঘষবার চেষ্টা অষ্টপ্রহর। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। দেখেশুনে পুলকিত হল রাজা কঙ্কর চিত্ত। যাক, এতদিনে পাওয়া গেছে আসল মালকে! এবার টোপ ফেলা, তারপর খেলিয়ে তোলা।

নির্বাণকুমারের চডুকে হাসি আর গায়ে পড়ে আলাপ করার ব্যর্থ চেষ্টায় সবারই ভুরু যখন উত্থিত, এবং কোথাও কল্কে না পেয়ে নির্বাণকুমার নিজেও যখন দমিত, ঠিক তখনি সিগার-স্ট্যান্ডে যেচে কথা বলল রাজা কঙ্ক। আকাশের চাঁদ হাতে পেল নির্বাণকুমার। গোটা বিচের কাউকে যে মানুষটা পাত্তা দেয় না, সেই রাজা কঙ্ক স্বয়ং আলাপ করতে চাইছে তার সঙ্গে? কৃতার্থ হয়ে গেল নির্বাণকুমার।

সুতরাং আলাপ জমতে দেরি হল না। দু-দিন যেতে-না-যেতেই নিবিড় সখ্যতা গড়ে উঠল দুজনের মধ্যে। কাজের কথা এল তারপরে।

নির্বাণকুমার অবাক হয়েছিল রাজার হাতে একটি বাক্স দেখে। চৌকোণা বাক্স। তাতে কয়েকটা ছিদ্র, চাকা, বোতাম ইত্যাদি। কাঠের বাক্স। কিন্তু বাক্সের উদ্দেশ্য বোঝা ভার। রাজকীয় চালচলনের মধ্যেও কেন যে বাক্সটাকে অষ্টপ্রহর সঙ্গে রাখে রাজা, সেই হেঁয়ালির রহস্য উদ্ধার করতেই কালঘাম ছুটে গেল নির্বাণকুমারের।

রাজা কিন্তু নির্বিকার। বাক্স আগলায় যকের ধনের মতো। দিন নেই, রাত নেই সর্বক্ষণ কদাকার চেহারার বাক্স রয়েছে সঙ্গে। যেন নয়নের মণি, যেন সাত রাজার ধন, যেন সাগরসেঁচা মাণিক। ব্যাপারস্যাপার দেখে নির্বাণকুমার তো হতবাক। দু-একবার কথা পাড়তে গিয়েও বেকুব হল। রাজা কঙ্ক বাক্স প্রসঙ্গের ধার দিয়েও গেল না।

অবশেষে সময় এল। কথা হচ্ছিল ব্যালকনিতে। টাকাকড়ি নিয়ে আলোচনা। কথায় কথায় নির্বাণকুমার ব্যক্ত করল তার মনোভাব। আহারে! কী সুখেই না রয়েছেন রাজা কঙ্ক! টাকার পাহাড়ে বসে কী নিরবচ্ছিন্ন শান্তি! ধমনীতে বইছে নীলরক্ত মানে ব্লু ব্লাড। খানদানি রক্ত। কোষাগারে কাঁড়ি কাঁড়ি ধনরত্ন। কাজেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা রোজগারের কোনও ভাবনাই নেই রাজা কঙ্কর।

সুযোগ বুঝে রাজা কঙ্ক শুরু করল আত্মকাহিনি। বলা বাহুল্য সবটাই গাঁজার দম। বলল, দেশবিভাগের আগের ঐশ্বর্য। সবই তো পড়ে পাকিস্তানে। জমিজমা-সোনাদানাস–ব। প্রথম-প্রথম কী কষ্টেই না দিন গেছে। বাইরে লণ্ঠন, ভেতরে ঠনঠন। ঠাট বজায় রাখতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া!

তবে উদ্যোগী পুরুষের হাতেই দুনিয়া আসে। রাজা কঙ্কও বিস্তর মেহনত করে সংগ্রহ করেছে এমন একটা যন্ত্র, যা দিয়ে দুনিয়াটাকে কেনা যায়।

শুনে তো চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার উপক্রম হল নির্বাণকুমারের। আশ্চর্য যন্ত্রর কাহিনি তাকে শুনতেই হবে। অনেক কঁদুনির পর নিমরাজি হয়ে রাজা কঙ্ক নিবেদন করল অদ্ভুত যন্ত্রর বিচিত্র উপাখ্যান।

বলল, এ মেশিন আমার হলেও আবিষ্কারটা আমার নয়। আধুনিক বিজ্ঞান তাকে মেশিনই বলবে। কিন্তু কলকজার বাহাদুরি বিজ্ঞানের নয়।

কীসের?

তন্ত্রের।

তন্ত্রের?

হ্যাঁ, তন্ত্রের। এক তান্ত্রিক-সাধকের সাক্ষাত পেয়েছিলাম কখলে। বস্তুবিজ্ঞান তন্ত্রসাধকের কাছে কতখানি অকিঞ্চিৎকর, তারই প্রমাণ দেওয়ার জন্যে তিনি যন্ত্রটা বানিয়েছিলেন আমারই সামনে। ভেতরে আছে অদ্ভুত-অদ্ভুত কতকগুলো আরক আর জড়িবুটি। আশ্চর্য এদের ক্ষমতা। যে-কোনও টাকার নোটকে ডবল করে দিতে পারে! এক টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকার নোট পর্যন্ত। হুবহু কপি করে দেয়।

কী করে? হাঁ বন্ধ করে শুধোয় নির্বাণকুমার।

মন্ত্রের ক্ষমতায় তো বটেই। তা ছাড়া আরকের গুণও আছে। হাজার টাকার নোট এদিক দিয়ে ঢুকিয়ে দিন-ওদিক দিয়ে বেরিয়ে আসবে পরপর দুটো নোট হুবহু একরকম।

নির্বাণকুমার নির্বোধ নয়। তাই অবিশ্বাসের মেঘ ঘনায় কুতকুতে দুই চোখে। শুধোয় সন্দিগ্ধ কণ্ঠে, ঠাট্টা করছেন?

যেন বিষম আহত হল রাজা কঙ্ক। আরক্ত মুখে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। অবশেষে বলল অতি মৃদু কণ্ঠে, আমি ঠাট্টা করি না। আমি মিথ্যে বলি না। ও দোষ আমার রক্তে নেই।

কিছুক্ষণ বিরতি। তাইতেই কাজ হল। এমন সাংঘাতিক ধাক্কা খেল নির্বাণকুমার যে কথাই বলতে পারল না কিছুক্ষণ। রাজা কঙ্ক নিজেই কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বললে, এ মেশিন পৃথিবীতে আর দুটি নেই। সাধকের সাক্ষাত পাওয়াও এখন মুশকিল। আপনি অবিশ্বাস করতে পারেন। কিন্তু তাতে আমার কী?

ঢোক গিলে তাড়াতাড়ি বলে নির্বাণকুমার, না..না..অবিশ্বাসের কথা বলিনি। বলছিলাম কি, নোটজালের কারবারে ঝুঁকি তো অনেক

কথাটা শেষ করতে পারল না নির্বাণকুমার। বাকি শব্দগুলো স্রেফ গিলে ফেলল রাজা কঙ্কর চোখ দেখে।

সেকী চোখ! বাঘের চোখেও এত তেজ থাকে কি না সন্দেহ। সেই সঙ্গে নিঃসীম অপমানের ধিকধিক বহ্নি।

অনেকক্ষণ পরে সামলে নিল রাজা। বলল অবরুদ্ধ কণ্ঠে, আমি জালিয়াত নই। নোট জাল করা আমার পেশা নয়। মন্ত্রের কৃপায়, আরক আর জড়িবুটির মাহাত্ম্যে, তান্ত্রিক সাধকের দৌলতে আমি যা বানাই, তা জালনোট নয়–আসল নোট। নকল নয় কেননা, কোনও তফাত থাকে না আসলের সঙ্গে। তাই যে-কোনও ব্যাঙ্কে চলে আমার নোট। দেখবেন হাজার টাকার নোট কীভাবে ডবল করি?

নির্বাণকুমার তো তাই চায়। সঙ্গে-সঙ্গে গেল রাজা কঙ্কর ঘরে। বাক্সটা কাছেই ছিল। রোজউড টেবিলের ওপর রাখা হল কদাকার বস্তুটা। দু-দিকে দুটো ফুটো। ঝকমকে তামা পিতল-ইস্পাতের নাট, বল্ট, চাকা আর টেলিফোন ডায়ালের মতো ডায়াল। দেখতে কিম্ভুতকিমাকার সন্দেহ নেই। কিন্তু কারিগরির বাহাদুরিতে, বিশেষ করে তান্ত্রিক সাধুর কপোল কাহিনি শোনার পর, কিম্ভুত বাক্সটাই অদ্ভুত শক্তিশালী মনে হল নির্বাণকুমারের চোখে।

হাজার টাকার একটা নোট বার করল রাজা কঙ্ক। পরখ করতে দিল নির্বাণকুমারকে। তারপর রোল করে পাকিয়ে ঢুকিয়ে দিল একদিকের ফুটো দিয়ে। অন্যদিকের ফুটো দিয়ে ঢোকাল আর একটা কাগজের রোল। কাগজের সাইজ হাজার টাকার নোটের মতোই। একটুও ছোট নয়, বা বড় নয়। ডায়াল ঘোরাল খুব হিসেব করে। কতকগুলো চাকা নাড়াল খুব সন্তর্পণে। টিপল বোতাম, আলগা করল নাট, খটাস করে তুলে দিল একটা সুইচ।

বলল, এখন আরকে ডুবে রয়েছে সাদা কাগজ আর নোট। আরক আর জড়িবুটির কাজ শুরু হয়ে গেছে। রোল করা অবস্থাতেই নোটটার হুবহু কপি উঠে যাবে রোল করা সাদা কাগজে। সময় লাগবে ছঘণ্টা। ছঘণ্টা পরে দেখবেন আসল নোট আসলই রয়ে গেছে–কোথাও আঁচড় পড়েনি। পাশাপাশি থাকবে আরও একটা আসল নোট।

বাকতাল্লার তুফানে নির্বাণকুমারের মাথায় তখন চর্কিপাক লেগেছে। কাজেই ছটি ঘণ্টা যে কীভাবে উড়ে গেল, তা টের পেল না ভদ্রলোক। ছঘণ্টা পর অসীম উৎকণ্ঠা নিয়ে দুজনে এল রাজার ঘরে। অতি সন্তর্পণে আবার ডায়াল ঘোরাল রাজা, চাকা নাড়াল হিসেব করে, বোতাম টিপল পটাপট শব্দে, সবশেষে হাতলে চাপ দিতেই ফুটো দিয়ে পরপর বেরিয়ে এল দু-দুটো নোট।

হাজার টাকার নোট!

চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল নির্বাণকুমারের। দুটো নোটই তখনও ভিজে। টেবিলের ওপর পাশাপাশি নোট দুটো বিছিয়ে ধরল রাজা। দেখল, নির্বাণকুমারের ছানাবড়া চোখে তখনও যেন কিছুটা অবিশ্বাস। তাই বলল সহজ সুরে, এক কাজ করুন। দুটো আলাদা ব্যাঙ্কে গিয়ে ভাঙিয়ে আনুন নোট দুখানা। এক ব্যাঙ্কে একই নম্বরের দু-খানা নোট নিয়ে যাবেন না। কী দরকার খামোকা ওদের কৌতূহল বাড়িয়ে। মাঝখান থেকে আমার গোপন যন্ত্র আর গোপন থাকবে না।

দুরুদুরু বুকে নির্বাণকুমার ছুটল দু-হাতে দু-খানা নোট নিয়ে। ফিরে এল নাচতে নাচতে। দু-হাজার টাকার ভাঙানি দু-হাতে।

রাজা কঙ্ক কিন্তু নির্বিকার। নোটের ভাঙানি তো মিলবেই। দুটো নোটই যে আসল। আগে থেকেই আর একটা হাজার টাকার নোট অদ্ভুত যন্ত্রর মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল রাজা। তবে নয়া নোটের নাম্বারে অবশ্য সামান্য কারসাজি করতে হয়েছিল আগেভাগে। বেশি কিছু নয়। ইংরেজি 3 আর ৪ কে সযত্নে কলম বুলোতে হয়েছিল। ফলে হুবহু মিলে গিয়েছিল দুটো নাম্বার।

কিন্তু নির্বাণকুমারের উল্লাস দেখবার মতো। ভুড়ি নাচিয়ে ঘরময় সে কী রক-এন-রোল ড্যান্স! অতি কষ্টে হাসি চেপে চুরুট নিয়ে বসে রইল রাজা কঙ্ক।

কিছুক্ষণ পরে বেদম হাঁপিয়ে কাছে এল নির্বাণকুমার। বলল, রাজাসাহেব, দুনিয়ায় এ মেশিন একটাই আছে, তাই না?

হ্যাঁ। বলে নির্বাণকুমারের মুখে ভাবের খেলা দেখল রাজা। উল্লাস তিরোহিত হচ্ছে–আসছে উদ্বেগ। দেখে মিষ্টি গলায় বলল, অবশ্য সাধুর ঠিকানা আমিই কেবল জানি। দুর্গম পথ। হিমালয় অঞ্চল তো।

শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলোয় নির্বাণকুমার। অধীর আগ্রহে শুধোয়, দেখা হলে আপনার কথা শুনবেন তো?

কী কথা?

মানে…ইয়ে..আর একটা যন্ত্র যদি চান?

চুপ করে রইল রাজা কঙ্ক। সঙ্গে-সঙ্গে কোনও জবাব দিল না। মিনিট কয়েক চুরুট টানার পর সাসপেন্স যখন তুঙ্গে পৌঁছল, তখন ছোট্ট করে বলল, কেন?

আপনার এই মেশিনটা তা হলে আমি কিনে নিতাম।

আবার সাসপেন্স। এমনভাবে চেয়ে রইল রাজা কঙ্ক, যেন সামনে একটা ডাহা উন্মাদ দাঁড়িয়ে। সে কী অভিনয়। দানীবাবুও ছার তার সেই প্রতিভার কাছে।

কিনবেন? অপরিসীম তাচ্ছিল্য দেখাল রাজা। মেশিন কিনবেন? কত টাকা আছে আপনার?

তোতলা হয়ে গেল নিবার্ণকুমার, সঙ্গে তো বেশি আনিনি। তিরিশ হাজার এখুনি দিচ্ছি। ওয়াইফের জড়োয়া সেট দিচ্ছি–দাম লাখতিনেক তো হবেই। তারপরও লাখ টাকা নগদ দেব বোম্বাই গিয়ে। কথা দিচ্ছি। জানি এ মেশিনের দাম টাকা দিয়ে হয় না। কিন্তু বন্ধুর একটি কথা রাখুন… তুবড়ি ছোটাল নির্বাণকুমার। হিসেবি বুদ্ধি গোল্লায় গেল। জুয়োর নেশা চাপলে ঘাড়ে যেমন ভূত চাপে–নির্বাণকুমারেরও হল তাই। ঝাড়া আধ ঘণ্টা সে কী নাকে কঁদুনি মেশিনটার জন্যে। চুরুট মুখে দিয়ে বোবার মতো বসে রইল রাজা কঙ্ক। অনেকক্ষণ পরে পাঁজর গুঁড়োনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবল বলল, জলের দাম দিচ্ছেন আপনি।

এরপর শুরু হল বিড়াল তপস্বীর সর্বশেষ চাল। বলল, বন্ধুর মান আমার কাছে সবার আগে। টাকার অভাব আমার নেই। সাধুবাবার সঙ্গে দেখা হলে আর-একটা ব্যবস্থা না হয় করা যাবে। বেশ, কী আছে আপনার এনে দিন। হিসেব করে দেখল রাজা, নোট ডবল হতে ছঘণ্টা লাগে। এর মধ্যেই পগারপার হওয়া যাবে গোয়া ছেড়ে।

সঙ্গে-সঙ্গে লাখ তিনেক টাকার জড়োয়া এল রাজার হাতে। সেই সঙ্গে তিরিশ হাজার নগদ। বিনিময়ে মেশিন সমর্পণ করল নির্বাণকুমারের হাতে। খুঁড়ো শিয়াল আশ্চর্য বাক্স নিয়ে তৎক্ষণাৎ ঊধ্বশ্বাসে দৌড়োল গৃহিণীর কাছে।

আর, ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে রোলসরয়েস নিয়ে চম্পট দিল প্রবঞ্চক-সম্রাট।

প্রবঞ্চনা ধড়া পড়ল কিন্তু ছঘণ্টারও অনেক ঘণ্টা, অনেকদিন পরে। ডবল নোটের সৃষ্টি চোখের সামনে দেখে নির্বাণকুমারের মনে বিশ্বাস বটগাছের শেকড়ের মতোই দৃঢ়মূল হয়ে গিয়েছিল। তাই, রাজা যে তাকে বোকা পাঁঠা বানিয়ে লম্বা দিয়েছে, এই সহজ সত্যটা কিছুতেই মাথায় আনতে পারছিল না বেচারি। ছঘণ্টা পরেও যখন ডবল নোট বেরুল না বাক্স থেকে, তখন ভাবল নিশ্চয় যন্ত্র চালানোয় কিছু ভুল হয়েছে। তাই ফের বসল খুটখাট করতে। এইভাবে নোটের পর নোট ঢুকল ভেতরে। গেল বেশ কয়েকটা সপ্তাহ।

অবশেষে একদিন ধৈর্যচ্যুতি ঘটল খাণ্ডার বউয়ের। তিন লাখ টাকার জড়োয়া গচ্ছা দিয়ে মন করকর করছিল বেচারির! তাই নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিনের-পর-দিন বাক্স নিয়ে কস্তাকস্তির হেস্তনেস্ত করল ভদ্রমহিলা এক মিনিটেই।

বিশেষ কিছু না। বাক্সটি নিয়ে সজোরে আছাড় মারল মেঝেতে। তারপর হাতুড়ি-পেটা করতেই ডালা উড়ে গেল। ভেতরে দেখা গেল তালগোল পাকানো কিছু আস্ত নোট্য নির্বাণকুমার ঠেলে ঠেলে ঢুকিয়েছে ডবল করার প্রচেষ্টায়। আর কয়েকটা রোলার আর একটা খালি টিন।

ব্যস, আশ্চর্য বাক্সর মধ্যে আর কিছুই নেই। আরক, জড়িবুটি, মন্ত্র-তন্ত্র কিছু না।

পলকহীন চোখে চেয়েছিল নির্বাণকুমার। অনেকক্ষণ পরে শুধু বলেছিল, বুঝেছি, আরক শুকিয়ে গেছে। তাই বিগড়েছে মেশিন। ঠিক আছে। রাজার সঙ্গে দেখা হলেই চেয়ে নেওয়া যাবে নতুন আরক। তারপর কামানো যাবে লাখ-লাখ টাকা। গিন্নি, আমি কুবের হব।

কিন্তু আক্কেল দাঁত যে কী জিনিস–জড়োয়া খুইয়ে গৃহিণী তখন তা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছিল। সুতরাং নির্বাণকুমারের কুবের হওয়ার সাধ নাকি খেংরে ঝেড়ে দিয়েছিল ভদ্রমহিলা।

সম্পাদক মশায়, সংক্ষেপে এই হল রাজা কঙ্কর অসামান্য প্রতারণা কাহিনির একটি মাত্র অধ্যায়। একাহিনির উপসংহার কবে টানব, তা জানি না। কারণ, রাজা এখনও রাজা। স্বাধীন। ইন্দিরা গান্ধীর সহস্র প্রচেষ্টাও তার রাজা খেতাব মুছতে পারবে না। কারণ রাজত্ব তার কস্মিন কালেও ছিল না, থাকবে না। কিন্তু রাজা সে থাকবেই। রাজা ঐশ্বর্যের মোহ দিয়ে অন্ধ করে লুণ্ঠনও করবে হবু রাজাদের। এই তার জীবনের ব্রত।

আমি তার ঠিকানা খুঁজছি। মোলাকাতের সখ হয়েছে। রাজার নতুন কীর্তিকলাপের সন্ধান পেলে জানাবেন? আপনার বহুল প্রচারিত পত্রিকার অগণিত পাঠকসাধারণের একজনের ধারে কাছে যদি রাজার মতো কেউ আসে রাজকীয় ঠাটবাট নিয়ে, তবে তিনি যেন সাবধান হন। রূপে সে সত্যিই রাজা, বাকতাল্লায় পুঁদে সেলসম্যান। রোলসরয়েস কি মনোপ্লেন দিয়ে হয়তো চোখ ধাঁধিয়ে আগমন ঘটবে তার। ঝোঁপ বুঝে কোপটি মেরেই উধাও হবে অশরীরীর মতো।

উধাও হওয়ার আগেই যদি খবরটা পাঠান আমায়, সমাজের একটা উপকার করতে পারতাম।

নমস্কার জানবেন। ইতি–

প্রীত্যৰ্থী
ইন্দ্রনাথ রুদ্র

*রোমাঞ্চ পত্রিকায় প্রকাশিত (জানুয়ারি, ১৯৭১)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *