1 of 2

হীরক বন্দরের হিরের কলম

হীরক বন্দরের হিরের কলম

সিনথিয়া উল্কাবেগে ঘরে ঢুকে বললে, আপনিই তো ইন্দ্রনাথ রুদ্র? একটু আগে আপনিই তো টেলিফোন ধরেছিলেন? হাঁ করে তাকিয়ে দেখছেন কী?

দেখছি স্টার অ্যাকট্রেস-কে। হ্যাঁ, আমিই ফোন ধরেছিলাম। আপনার কলম চুরি গেছে– আমাকে উদ্ধার করে দিতে হবে, এই তো? আমার সময় নেই।

ইন্দ্রনাথের গা-ঘেঁষে সোফায় বসে পড়ল বিখ্যাত চিত্রতারকা সিনথিয়া। নামটা ইংরেজি হলেও মেয়েটা খাঁটি বাঙালি। চেহারায়, পোশাকে, কথায়।

সময় আপনাকে করতেই হবে। কলমের বাতিক আমার নেই। কিন্তু জড়োয়া কলমদের কোন মেয়ে ভালোবাসে না?

জড়োয়া কলম?

ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার। রত্ন বসানো মোগল আমলের কলম, হিরে বসানো নিরেট সোনার কলম, জুয়েল সেট করা ডাইনোসর কলম–মোট তেরখানা এইরকম কলম। দাম শুনলে আপনার মাথা ঘুরে যাবে, তাই বলব না। আপনার মাথা ঘুরে গেলে আমার জুয়েল পেন আর ফিরে আসবে না। জুয়েল পেন ফিরে না এলে আমার মাথা কাটা যাবে। চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজ আমাকে চোর বলবে। বলবে, বউ হব বলে ভড়কি দিয়ে কলমগুলো হাতিয়ে নিয়ে আর বউ হতে চাইছি না। কুৎসা ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়বে। মিস্টার ইন্দ্রনাথ রুদ্র, আমাকে বাঁচান। বলে ইন্দ্রনাথের দুহাত জড়িয়ে ধরল সিনথিয়া।

ইন্দ্রনাথ বললে, দেখুন, আমি ব্যাচেলর মানুষ। মেয়েরা আমাকে ছুঁয়ে ফেললে আমার সব গোলমাল হয়ে যায়। আপনি একটু সরে বসুন।

ঝট করে সরে বসে, তর্জনি তুলে, শাসনের চোখে সিনথিয়া বললে, তাহলে খুঁজে দেবেন?

চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজ লোকটা কে?

আপনি কোন জগতের লোক? ভরদ্বাজ স্টুডিওর নাম শোনেননি? ডায়মন্ডহারবারের ফেমাস স্টুডিও। লেটেস্ট স্টুডিও। টেলিফিল্ম তোলার এমন জায়গা গোটা কলকাতায় আর নেই। স্টিভেন স্পিলবার্গ বর্তে যেতেন এই স্টুডিওর সন্ধান পেলে। ওঁর লেটেস্ট ফিল্ম দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড এখানেই তুলতেন।

মিনমিন করে ইন্দ্রনাথ বললে, দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড তো টেলিফিল্ম নয়।

ওটা কথার কথা। মুম্বাইতে হিরের বিজনেস করে বাংলার জুয়েল চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজ এবার হলিউড-টলিউড-বলিউড-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে নেমেছে। এতবড় খবরটা আপনার জানা উচিত ছিল।

কাষ্ঠ হেসে ইন্দ্রনাথ বললে, এই ব্যক্তির সঙ্গে ঘর করবেন ঠিক করেছিলেন?

তাহলে আর বলছি কী। আমার নাম সিনথিয়া–যেখানে সেখানে নিজেকে বাঁধি না। এনগেজমেন্ট পর্যন্ত হয়ে গেছিল। সব্বাই জেনে গেছে, আমিই ভরদ্বাজের বাগদত্তা। গতকাল ভেঙে গেল এনগেজমেন্ট। ভীষণ রাফ। আমিও কম যাই না। বিয়েই করব না অমন রাফ রাস্কেলকে। তাই আজ হিরের প্রেজেন্টেশনগুলো সব নিয়ে গেছিলাম ফিরিয়ে দেব বলে। একটা শুটিং শেষ করে গ্রিনরুমে ফিরে এসে দেখি সব লোপাট। এখন তো ভরদ্বাজ আমাকে ছেড়ে দেবে না। জিনিসগুলোও স্রেফ হিরে মুক্তো চুনি পান্না সোনাদানা নয়। আমি একটু কবিতা-টবিতা লিখি বলে, রাইটার্স এগজিবিশন থেকে বেছে-বেছে শুধু জুয়েল পেন কিনে আমাকে প্রেজেন্ট করেছিল ভরদ্বাজ। মিস্টার ইন্দ্রনাথ রুদ্র, প্লিজ রিকভার দ্য লট। আই উইল পে ইউ এ লট।

থ্যাংক্স এ লট। এই পর্যন্ত বলেছে ইন্দ্রনাথ। এমন সময় বাজল টেলিফোন। রিসিভার তুলল ইন্দ্রনাথ। তারের মধ্যে দিয়ে ভেসে এল কর্কশ কণ্ঠস্বর, মিঃ শার্লক নাকি?

ইন্দ্রনাথ বললে, অধমের নাম ইন্দ্রনাথ রুদ্র।

সেটা জেনেই ফোন করা হচ্ছে। দম্ভ ফেটে-ফেটে পড়ছে উচ্চারণ ভঙ্গিমায়। এক শ্রেণির লোক আছে, যারা মনে করে পৃথিবীটা তাদের পায়ের তলায়। তারা এইরকম গলায় কথা বলে, মিঃ শার্লক, সিনথিয়া আপনার কাছে গেছে?

আপনাকে বলে এসেছে নাকি? বলে, সিনথিয়ার দিকে চাইল ইন্দ্রনাথ। কৃত্রিম হ্রাসে চক্ষু বিস্ফারিত করল সিনথিয়া।

দুমদুম করে দম্ভের বোমা ফাটিয়ে-ফাটিয়ে বললে দাম্ভিক লোকটা, নিশ্চয় পিণ্ডি চটকাচ্ছে আমার। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিই সেই রাফ রাস্কেল চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজ। সব ব্যাচেলরের ওপরেই ওর একটু দুর্বলতা আছে। আপনার ওপরও। সেটা জেনেই ফোন করা হচ্ছে। আপনি তো নামকরা টিকটিকি। ভালো পয়সা পাবেন। এখানে একটা খুন হয়েছে। খুনিকে ধরে দিন।

ইন্দ্রনাথের গলায় আওয়াজ এবার বদলে গেল। চাইল সিনথিয়ার দিকে। বললে মাউথপিসে, কলম চুরির পরেই মানুষ খুন। কে খুন হয়েছে?

সেটা সিনথিয়াকে নিয়ে এসে দেখে যান। চেনা মাল। ও তো নিজেই গাড়ি হাঁকিয়ে গেছে। ওর গাড়িতেই চলে আসুন। ছাড়লাম।

রিসিভার নামিয়ে রেখে ইন্দ্রনাথ বললে, খুন যে হয়েছে, তাকে আপনি চেনেন? এই গেল এক নম্বর। নম্বর দুই প্রশ্ন, ড্রাইভার ছাড়াই এতটা পথ ড্রাইভ করে এলেন?

তাকে খুঁজেই পেলাম না। কিন্তু কে খুন হল?

গিয়ে দেখা যাক।

.

গাড়ি একখানা কিনেছে বটে সিনথিয়া। ভেতরে বসে মনে হবে যেন ছোটখাটো একটা পাঁচতারা হোটেল। সিনথিয়া গাড়ি চালায়ও ভালো। বেলেঘাটার সুভাষ সরোবর থেকে ডায়মণ্ডহারবারে উড়ে গেল পক্ষিরাজের বেগে–নিঃশব্দে।

যাওয়ার পথে তন্ময়চিত্ত সিনথিয়াকে খানকয়েক জুতসই প্রশ্ন করেছিল ইন্দ্রনাথ। যেমন, খুন যে হয়েছে, সে নাকি সিনথিয়ার চেনা মাল। চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজের ভাষায়। তার মানে, মরে গিয়েও লোকটা ভরদ্বাজের দু-চোখের বিষ হয়ে আছে। এবং তাকে চেনে সিনথিয়া। সে কে হতে পারে?

জেরায় কোণঠাসা হয়ে গিয়ে সিনথিয়াকে বলতেই হল, একটা লোকই চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজের দুচোখের বিষ হয়েছিল। সিনথিয়ার ড্রাইভার।

কেন? ইন্দ্রনাথের সপেটা প্রশ্ন।

জেলাসি; সিনথিয়া রাস্তার দিকে চেয়েই বলে গেল।

ড্রাইভারের সঙ্গে প্রেম-ট্রেম ছিল?

চন্দ্রকান্তর সন্দেহ হয়েছিল। গতকাল তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল তো এই নিয়েই। দুর্যোধনের স্ক্রিন টেস্টের কথা বলতেই জ্বলে উঠল চন্দ্রকান্ত। ড্রাইভার হলেও সে তো মানুষ। দেখতে শুনতেও খারাপ নয়। চান্স যদি পায়, অনেক কিছু করতে পারে। ট্যালেন্ট সার্চ করতে জানে না চন্দ্রকান্ত। স্টুপিড। ডায়মণ্ড ছাড়া কিছু চেনে না।

তাই ডায়মন্ডহারবারে খুলেছে স্টুডিও। হীরক বন্দর। কিন্তু এত জায়গা থাকতে হীরক বন্দরকে পছন্দ হল কেন? সল্টলেকে তো অনেক সুবিধে।

সেখানেও তো রয়েছে কুমতোলব।

যেমন?

যত রিসর্ট তো এই ডায়মন্ডহারবারেই। কলকাতা থেকে গিয়ে এক রাতের ফুর্তি সেরে ভালোমানুষের মতো ফিরছে কলকাতায় যে যার বাড়ি। উচ্ছন্নে গেছে দেশটা। উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে এই চন্দ্রকান্তর মতন স্কাউলেরা। স্টুডিওর একপাশে রেখেছে রিসর্ট। বার। জুয়োর আড্ডা। সবই বেআইনি। কিন্তু ম্যানেজ করে চলেছে চন্দ্রকান্ত। ওইজন্যেই তো খুনের খবর আগে পুলিশকে না দিয়ে দিল আপনাকে।

পুলিশকে দেয়নি জানছেন কী করে?

চন্দ্রকান্তকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনে ফেলেছি। গরিলার বাচ্চা কোথাকার! লাশ পর্যন্ত উড়িয়ে দিতে পারে।

এই লাশটা কি দুর্যোধনের বলে মনে হয়?

হলে আশ্চর্য হব না।

কদ্দিন গাড়ি চালাচ্ছে আপনার?

বছরখানেক। চন্দ্রকান্তই দিয়েছে। স্লট মেশিনে জুয়োর আড্ডায় ঢুকিয়েছিল নিজের লোক। খুব বিশ্বাস করে। আমার গাড়ির ভার ওকে দিয়েছে তো ওই মতলবেই। আমি এদিক ওদিক করলে খবর যেন পায় চন্দ্রকান্ত। জানেন তো ড্রাইভারগুলোই হয় স্পাই।

চন্দ্রকান্তর লোক দুর্যোধন? জুয়ো খেলার স্লট মেশিনের নাড়ি নক্ষত্র জানে?

হ্যাঁ।

পুরো নাম কি দুর্যোধন পাড়োয়াল?

এইবার চকিতে ইন্দ্রনাথের দিকে চোখ ফিরিয়েই ফের রাস্তার দিকে তাকাল সিনথিয়া, চেনেন মনে হচ্ছে?

এ নাম একবার শুনলে ভোলা যায় না। নামের জন্য অনেকে বিখ্যাত হয়ে থাকে। দুর্যোধন পাড়োয়াল বিখ্যাত আর এক কারণে। জানেন কী কারণে?

সত্যি জানি না।

বছরতিনেক আগে জলপাইগুড়ি জেলের পাঁচিল টপকে পালিয়েছিল দুর্যোধন। অদ্ভুত বুদ্ধি খাঁটিয়ে। জেলখানায় ইলেকট্রিক্যাল কানেকশনের জন্যে এখানে সেখানে পড়েছিল লোহার পাইপ। সেইসব পাইপ একটা-একটা করে জেলখানার ভেতরেই বাথরুমের পেছনে কঁকা জায়গায় জড়ো করেছিল দুর্যোধন। জেলখানার গুদোমে ছিল নুনের বস্তা। নাইনলের দড়ি খুলে নিয়েছিল সেইসব বস্তা থেকে। লোহার পাইপগুলোকে পরপর বেঁধে তৈরি করেছিল সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে জেলখানার চোদ্দো ফুট পাঁচিল টপকেছিল দুর্যোধন।

ব্রিলিয়ান্ট ব্রেন। ফস করে বলে ফেলেই সামলে নিল সিনথিয়া, পুলিশ আর ওকে ধরতে পারেনি?

পুলিশের কত কাজ। ইন্ডিয়াটা বিরাট। যেন উবে গেছিল দুর্যোধন পাড়োয়াল। এখন তো দেখছি জহুরী চন্দ্রকান্ত ঠিক জহর চিনেছে।

নাকের পাটা শক্ত করে সিনথিয়া বললে, নইলে ক্রাইমের ব্যাবসা চালাবে কী করে?

.

সমুদ্র নীল পোশাক পরা অপরূপা সিনথিয়ার সামনে চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজকে গরিলার বাচ্চার মতনই লাগছিল। বিশেষণটা মন্দ দেয়নি সিনথিয়া।

ওরা এখন দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রকান্তর খাস কামরায়। দরজায় দাঁড়িয়ে রিভলভার হাতে চন্দ্রকান্তর দেহরক্ষী। তার গায়ের রং কষ্টি পাথরকে হার মানায়। বসনও কুচকুচে কালো। দেখলে ভয় হয়। এই মুহূর্তে তার মাথায় বিরাট ব্যান্ডেজ। হঠাৎ দেখলে মনে হবে শিখদের পাগড়ি।

অঘটনের পর অঘটন ঘটে চলেছে এখানে। হিরের কলম চুরি গেছে। জুয়ো খেলার ঘরের সামনে মুখোশধারী দুজন দুশমন দুর্যোধনের খুলি চুরমার করেছে, ব্ল্যাক কমান্ডোর আয়ু ছিল বলে মাথায় ডাণ্ডা খেয়েও বেঁচে আছে।

পুরো স্টুডিও আর রিসর্ট এরিয়া পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। যেন, চায়না টাউন। জবরদস্ত সিকিউরিটি এজেন্সির হাতে পাহারাদারির ভার তুলে দিয়েছে চন্দ্রকান্ত। নিকষকালো এই ব্ল্যাক কমান্ডোই সিকিউরিটি চিফ। তার নাম অর্জুন পাণ্ডে।

এইমাত্র ঘটনা পরম্পরাগুলো তিনজনের মুখে শুনে নিয়েছে ইন্দ্রনাথ। অর্জুন কালো পাথরের থামের মতোন দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রনাথ, গিলে করা অর্গান্ডির পাঞ্জাবি আর চুনোট করা ধুতির বাবুয়ানি দেখে মনে হতে পারে হিরোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেই তার আগমন ঘটেছে স্টুডিওতে। ইন্দ্রনাথের একপাশে গোল কাঁধ আরও গোল করে আর বিশাল লম্বা হাত দুখানা প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ঝুলিয়ে গনগনে চোখে সিনথিয়ার দিকে চেয়ে আছে চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজ। সিনথিয়াও তার অনিন্দ্যসুন্দর চক্ষুরত্ন দুটোকে একজোড়া মরকত গুলি বানিয়ে চেয়ে আছে চন্দ্রকান্তর দিকে। এই মুহূর্তে তার হাতে এসে গেছে আর একটা বস্তু। একটা ছোট্ট রিভলভার। ডান হাতে অস্ত্রটাকে বাগিয়ে ধরে চন্দ্রকান্তর দিকে নলচে ফিরিয়ে নাচাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে, দুর্যোধনকে তুমিই খুন করেছ, ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে গিয়ে–ইউ মার্ডারার।

ইন্দ্রনাথ খুব ঠান্ডা গলায় বললে, এই কোঁদলের মধ্যে আমাকে টেনে আনার দরকার ছিল না। লেডি সিনথিয়া, এই মাত্র কী শুনলেন? আপনি যখন শুটিংয়ে ক্যামেরার সামনে, তখন দুর্যোধন পা টিপেটিপে, চোরের মতন এদিক-ওদিক দেখতে-দেখতে গ্রিনরুমে ঢুকছিল। অর্জুন পাণ্ডে, আপনি দেখেছিলেন?

কষ্টিপাথর অর্জুন বললে পাথুরে গলায়, ওইভাবে ঢুকতে দেখেই তো আমার খটকা লেগেছিল। কিন্তু তা নিয়ে ভাবিনি। তারপর যখন সিনথিয়া দেবী গ্রিনরুমে ঢুকেই গলা চিরে চিৎকার করে উঠলেন, তখনই বুঝলাম, হিরের কলম চুরির মতোলবেই গ্রিনরুমে ঢুকেছিল দুর্যোধন। তখুনি দৌড়লাম তার খোঁজে। দেখলাম, ডেডবডি মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে জুয়ো ঘরের দরজার সামনে। মাথার ঘিলু বেরিয়ে এসেছে ভাঙা করোটির ফাঁক দিয়ে। পকেটে কিন্তু হিরের কলম নেই। ভাবলাম, জুয়ো ঘরের মধ্যে রেখেছে। ঢুকতে যাচ্ছি, মাথায় পড়ল ডাণ্ডা। জ্ঞান হারানোর আগে দেখেছিলাম কালো মুখোশ পরা দুটো লোককে। নেহাত নিরেট মাথা, তাই বেঁচে গেছি। স্যার, চোরের ওপর বাটপারি হয়েছে। গ্রিনরুম থেকে চুরি করেছে দুর্যোধন, দুর্যোধনকে খতম করে হিরে নিয়ে পালিয়েছে দুই দুশমন।

ইন্দ্রনাথ জিগ্যেস করল, লেডি সিনথিয়া, ট্রিগার থেকে আঙুলটা সরিয়ে কথা বলুন। গাড়িতে আসবার সময় দুর্যোধনকে বলেছিলেন হিরের কলমের কথা?

কেন বলব না? ফোঁস করে উঠল সিনথিয়া, বিয়েই যখন করব না, তখন প্রেজেন্টেশন কাছে রাখতে যাব কেন? ঢাক পিটিয়ে ফেরত দেব সবার সামনে। তাই বলেছিলাম।

বেশ করেছিলে। গরগর করে উঠল চন্দ্রকান্ত, একটা চোরের সঙ্গে লটর-ঘটর করতে গেছিলে। ইউ ন্যাস্টি গার্ল। দাও আমার ডায়মন্ড।

এই নাও তোমার ডায়মন্ড। বলেই চন্দ্রকান্তর দিকে ছোট্ট রিভলভার তুলল সিনথিয়া।

খবরদার, বলে হেঁকেই গুলি চালাল অর্জুন পান্ডে, অবশ্য সিলিং লক্ষ করে। কিন্তু তাইতেই ভড়কে গিয়ে সত্যি-সত্যিই ফায়ারিং করল সিনথিয়া-অর্জুনকে লক্ষ করে। আনাড়ি হাতের গুলি লাগল অর্জুনের হাতে, রিভলভার গেল ছিটকে। গুলিবিদ্ধ হাত ঝাড়তে ঝাড়তে মেঝেতে পড়ে থাকা রিভলভারের দিকে লাফিয়ে যেতেই ধুতি পাঞ্জাবি পরা ইন্দ্রনাথ চিতাবাঘের মতোন লাফিয়ে গিয়ে মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিল রিভলভারটা। বললে, তিষ্ঠ, তিষ্ঠ, অর্জুন পাণ্ডে। মাথার ব্যান্ডেজটা অত আনাড়ি ভাবে বাঁধা কেন বৎস? নিজের বাঁধা, না ডাক্তারের হাতে বাঁধা?

থতমত খেয়ে গেল কষ্টিপাথর কমান্ডো চিফ। তেড়ে আসতে গিয়েও থমকে গেল। কেননা, তার এক হাতের মধ্যে দিয়ে গুলি ঢুকে বেরিয়ে গেছে ইন্দ্রনাথের হাতের রিভলভার কিন্তু টিপ করে রয়েছে তার দিকেই।

সুতরাং সে জবাব না দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয় মনে করল।

চোখ তার দিকেই রেখে চন্দ্রকান্তকে বললে ইন্দ্রনাথ, অনুগ্রহ করে আপনার দেহরক্ষীর মাথার পাগড়িটা খুলবেন?

নীরবে হুকুম তামিল করে গেল গরিলা-তনয়সম চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজ। অনেকগুলো ফেটি খুলে আনবার পর ব্যান্ডেজ দিয়ে তৈরি গোটা পাগড়িটা খসে এল হাতের মধ্যে।

দেখা গেল, অর্জুন পাণ্ডের মাথা বিলকুল অক্ষত। ডাণ্ডা-ফাণ্ডা কিছুরই চোট পড়েনি মাথায়।

মিহি গলায় বললে ইন্দ্রনাথ, এই সন্দেহটাই করেছিলাম আনাড়ি হাতের ব্যান্ডেজ দেখে। ঠিক যেন পাগড়ি। মিস্টার চন্দ্রকান্ত ভরদ্বাজ, চোরের ওপর বাটপারি করেছে আপনার সবচেয়ে কাছের লোক–এই দুঃশাসন, ইয়ে অর্জুন পাণ্ডে। দুর্যোধনের অতীত ভালো নয়। হিরের কলমের লোভ সে সামলাতে পারেনি। লেডি সিনথিয়া কখন ক্যামেরার সামনে থাকবে সে জানত। সেই ফাঁকে হিরে হাতিয়েছে, কিন্তু নিজের কাছে রাখেনি। লুকিয়ে রেখে যখন বেরিয়ে আসছে, তখন আপনার কমান্ডো চিফ আগে তার মাথা ছাতু করেছে, তারপর পকেট সার্চ করেছে, হিরে পায়নি। জুয়োর ঘরে সার্চ করেও হিরে পায়নি।

তখন মুখোশধারী দুই হানাদারের গল্প শুনিয়েছে, দুর্যোধনকে খতম করে হিরে হাতিয়ে নিয়ে তারাই চম্পট দিয়েছে। কিন্তু হিরের কলম আছে এই স্টুডিওর মধ্যেই। কোথায় আছে, তাও আন্দাজে বলতে পারি।

কোথায়? বিচ্ছিরি কর্কশ গলায় বলল চন্দ্রকান্ত।

আপনার প্রিয় দুর্যোধন কোন বিষয়ে এক্সপার্ট ছিল? জুয়ো খেলার স্লট মেশিনে। এই মেশিনগুলো এক একটা আয়রন সেফের মতন। কম্বিনেশন লক তো থাকেই–আরও অনেক কিছু জানতে হয়। তবেই টাকা বেরোয় মেশিনের ভেতর থেকে। ঠিক বলছি?

বলছেন।

আপনি জানেন আটটা মেশিনের কম্বিনেশন লকের সিক্রেট?

জানি।

খুলতে পারেন আয়রন সেফের প্লেট?

পারি।

চলুন তাহলে খোলা যাক। অর্জুন পাণ্ডে, দু-হাত মাথার ওপর রেখে সামনে-সামনে চল। অনেক কমান্ডো নাচিয়েছি, তোমাকে শুইয়ে দেব। খেল দেখাতে যেও না।

জুয়োর ঘর। পাশাপাশি সাজানো আটটা স্লট মেশিন। একটার মধ্যে পাওয়া গেল তেরটা হিরের কলম।

ঠিক সেই সময় একটা অত্যন্ত অশোভন আচরণ করে বসল সিনথিয়া। হাতের রিভলভার ফেলে দিয়ে দু-হাতে জাপটে ধরল চন্দ্রকান্তকে এবং ভেঙে পড়ল অকৃত্রিম এবং অনাটকীয় কান্নায়, আমার ভুল হয়েছে, আমার ভুল হয়েছে।

দু-চোখ বুজে সিনথিয়ার মাথায় হাত বুলোতে-বুলোতে চন্দ্রকান্ত বললে, ওরকম হয়, ওরকম হয়…যত রাগ, তত ভাব।

* স্বস্তিকা পত্রিকায় প্রকাশিত (পূজা সংখ্যা, ১৪০৪)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *