সোনার আতা
কে জানত সোনার আতা সত্যিই অভিশপ্ত? কে জানত স্বয়ং যক্ষ এর রক্ষক? কে জানত গোরস্থানেও গুপ্তধন থাকে?
এ-কাহিনি ইন্দ্রনাথের হেরে যাওয়ার কাহিনি–কিন্তু রোমাঞ্চকর। তাই শোনাই।
ক্যাম-মুক্স-এর আসল নাম কমলিকা মুখার্জি। বাবা বিলেত ঘুরে এসেও লুঙ্গি পরতেন। কিন্তু মা বিলেত ফেরত স্বামীর প্রেস্টিজ বজায় রাখলেন। মেয়েকে কনভেন্টে ঢোকালেন। ভাটিয়া-পাঞ্জাবি মাদ্রাজিদের সঙ্গে এলিমেন্টারি বাংলা পড়ালেন। নামটাকে পর্যন্ত পালটে দিলেন।
কমলিকার আড্ডাখানা পার্ক স্ট্রিটে। সেখানকার নাচের আড্ডায়, মদের আড্ডায়, কালচারাল আড্ডায় সে একটি সুপরিচিত ভোমরা। তার সম্পূর্ণ নগ্ন পিঠ এবং প্রায় নগ্ন বক্ষদেশের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে পরিচিত সকলেই। চকচকে রঙচঙে তেলতেলে মুখ, এলোমেলো আছাঁটা চুল, ইট-রঙিন রাক্ষুসি নখ এবং নিতম্ব কামড়ানো স্ন্যাকস পরা নাগর জোটানো ক্যাম মুক্সকে চেনে না এমন উজবুক ও পাড়ায় নেই। খোকা-খোকা ক্লাউন সদৃশ নব্যযুবক থেকে আরম্ভ করে হোটেল-বারের বেয়ারা বাবুর্চি পর্যন্ত সবাইকেই সে ধন্য করেছে তার মদির কটাক্ষ আর বিলোল হাসির প্রসাদ দিয়ে। চুম্বনের স্বর্গে পর্যন্ত টেনে তুলেছে কয়েকজন ভাগ্যবানকে–আরও অধঃপতন ঘটেছে কি না জানা নেই।
এমন সময়ে কমলিকা হারাল তার বাবা এবং মাকে একই দিনে সাংঘাতিক মোটর দুর্ঘটনায়। চোখের জল শুকিয়ে যাওয়ার পর খুলল বাবার সিন্দুক। পেল অনেক কিছু। সেই সঙ্গে একটা সোনার আতা আর একটা তাম্রপত্র।
চক্ষুস্থির হল ম্যাড়মেড়ে তাম্রফলককে চকচকে করতেই। খুদে-খুদে ইংরেজি হরফে উত্তীর্ণ একটা উদ্ভট ইতিহাস। আর একটা গুপ্তধনের নকশা। বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির বাজারে তার পরিমাণ প্রায় তিরিশ কোটি টাকা।
সিপাই বিদ্রোহের সময়ে সর্বনাশ করা হয়েছিল এক নেটিভ রাজার। লুষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর কুবের সম্পদে ঠাসা কোষাগার। সোনার আতা বোঝাই একটা মস্ত সিন্দুক ছিল ধনরত্নের মধ্যে। বিদ্রোহ থেমে গেলে কলকাতায় বদলি হল ব্রিটিশ অফিসারটি। সঙ্গে এল সোনার আতা। পুঁতে রাখা হল পার্ক স্ট্রিটের পুরোনো কবরখানায় একটি কবরের তলায়।
বংশ পরম্পরায় হাত বদল হয়েছে নকশা আঁকা এই তাম্রফলক। এখন পৌঁছল কমলিকার হাতে। কমলিকার মায়ের পূর্ব-পুরুষই সেই নৃশংস ইংরেজ সেনাপতি। তৈমুর লং নাদির শাকেও সে লজ্জা দিয়েছিল সোনার আতা লুঠ করার সময়ে। শেষকালে অবশ্য ধর্মে মতি হয়েছিল এক হিন্দু বিধবাকে বিয়ে করার পর।
স্বর্ণ পিণ্ডের বিপুল স্তূপ নাকি আজও অভিশপ্ত। বাবার সিন্দুকে একটা চিঠিও পেল কমলিকা। মেয়েকে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। জীবিতকালে সোনার আতার কথা ইচ্ছে করে বলেননি। কাঁচা বয়েসে লোভের বশে সর্বনাশ আসতে কতক্ষণ? সাবধান! সাবধান! সুদীর্ঘ দুটি শতাব্দী অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু কারা যেন এখনও আগলে রেখেছে স্বর্ণ ভাণ্ডারকে। গোরস্থান অত্যন্ত নিরাপদ বিবেচনা করেই গুপ্তধনকে গুপ্ত রাখা হয়েছিল সেখানে বিশেষ একটি স্মৃতিসৌধের তলায়। কিন্তু কে জানত কবরখানার অতৃপ্ত আত্মারাই পুঞ্জীভূত অশুভ শক্তি নিয়ে আগলে রাখবে রাজরক্তে রঞ্জিত স্বর্ণ ভাণ্ডারকে? কে জানে নিষ্ঠুরভাবে সবংশে নিহত সেই রাজন্যবর্গই যুগ-যুগ ধরে প্রহরা দিচ্ছে কিনা তাদের লুণ্ঠিত কোষাগারকে?
সঠিক কিছুই জানা যায়নি। শুধু জানা গেছে স্বর্ণলোভে উন্মাদ হয়ে যারাই হানা দিয়েছে প্রেতমহল্লায় তারাই মায়া কাটিয়েছে ইহলোকের রাত পোহাতে-না-পোহাতে। হিমকঠিন প্রাণহীন দেহ পাওয়া গিয়েছে কবরখানার জঙ্গলে।
যে দুজন পূর্বপুরুষ এইভাবে প্রাণ হারিয়েছেন তারা ভীতু ছিলেন না। তবুও বিষম ভয়ে দু-জনেরই মুখের চেহারা নাকি পালটে গিয়েছিল। সুতরাং কমলিকা যেন গোরস্থানের ত্রিসীমানাও না মাড়ায় এবং গুপ্তধনের হদিশ গল্পচ্ছলেও কারও কাছে না বলে। সম্পদ থেকেই বিপদ আসে। এবং গুপ্তধন যেন ব্যক্ত না হয়।
কন্যা-অন্ত পিতৃদেবের জ্ঞানগর্ভ পত্র পেয়ে চমকৃত হল কমলিকা। বিলেত ঘুরে এসেও এত কুসংস্কার? ভূতপ্রেত পিশাচ দানো তো মনের বিকার। মাইক্রোসকোপ দিয়ে যাদের দেখা যায় না, স্পেকট্রামে যাদের ঠিকানা থাকে না, ক্যামেরায় যাদের ছবি ওঠে না, তারা আবার আছে নাকি? কবরখানায় যাঁরা অক্কা পেয়েছেন তাঁরা ভয়ের চোটেই টিকিট কেটেছেন। নিশ্চয় হার্টের রোগ ছিল। আগাছায় পা বেঁধে গিয়ে অথবা শেয়ালের তাড়া খেয়ে অথবা পাচার ডানা ঝটপটানিতে অথবা বাদুরের ছায়াপাতে অথবা…ইত্যাদি ইত্যাদি।
পদস্খলন আগেই নিশ্চয় ঘটেছিল। এবার একটু ভালো করেই ঘটল। স্যাম্পেনের ঝেকে সরস আকারে কাহিনিটি পরিবেশন করা হল দুই বয়ফ্রেন্ডের কাছে। ব্যক্ত হল গুপ্তধন।
সাতদিনও গেল না।
ইন্দ্রনাথের মেসে দেখা গেল কমলিকাকে। বলল ত্ৰাস-বিস্ফারিত উদ্বেগ-থরথর চোখে– আমাকে বাঁচান। ওরা হয় নিজেরা মরবে নয় আমাকে মারবে।
কামপঙ্কে নিমজ্জিত কমলিকার কেচ্ছাকালো মুখের দিকেও তাকাতে পারছিল না ইন্দ্রনাথ। নখ খুঁটতে-খুঁটতে বলল, কেন?
গুপ্তধনের খবরটা যাতে আর না ছড়ায়। ভূপেশ আর মাইকেল দুজনেই পকেটে ছুরি নিয়ে ঘুরছে। দুজনেই দুজনকে মারতে চাইছে। তারপর নকশাটা ভোগা মেরে গুপ্তধনের মালিক হতে চাইছে।
নকশাটা কোথায়?
বলব কেন? এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি কেউ খুঁজে পাবে না। তাছাড়া সোনার আতার জন্যে তো আসিনি আপনার কাছে।
তবে কেন এসেছেন?
বাঁচতে।
.
কিন্তু বাঁচানো গেল না।
সেইদিনই রাত আটটায় পার্ক সার্কাসের পুরোনো কবরখানায় খতম হয়ে গেল ক্যাম মুক্স। নিভে গেল বংশের প্রদীপ। সম্পূর্ণ হল স্বর্ণপিণ্ডের অভিশাপ। কায়াহীনের মায়াঘেরা কাঞ্চন ভাণ্ডারের রক্ষক স্বয়ং রাজ্যক্ষ কি না তা নিয়ে কিন্তু মোটেই মাথা ঘামাল না ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর জয়ন্ত চৌধুরী।
টেলিফোন এল রাত দশটায়।
ইন্দ্রনাথ? আমি জয়ন্ত বলছি। ক্যাম-মুক্স খুন হয়েছে গোরস্থানের মধ্যে। ওর হ্যান্ডব্যাগে তোর নাম ঠিকানা লেখা একটা কাগজ পেলাম। তুই কিছু জানিস?
জানি। বলে মুখ কালো করে সব বলল ইন্দ্রনাথ। মুখ কালো হল তীব্র গ্লানিতে। মেয়েটা বাঁচতে এসেছিল। কিন্তু…
সব শুনে জয়ন্ত বললে, রাত সাড়ে সাতটার সময়ে লালবাজারে ফোন করে ভূপেশ বলল এইমাত্র নাকি ক্যাম মুক্সকে ছুরি মেরে পালিয়েছে মাইকেল। জিপ নিয়ে ছুটলাম তক্ষুনি। গাড়ি দাঁড়াতে না-দাঁড়াতেই পেট্রল পাম্পের দিক থেকে ছুটে এল ভূপেশ ছোকরা। বেলবটমের মতো লটপটে জিন আর গা কামড়ানো স্কিনি গেঞ্জি। লম্বা-লম্বা চুল আর চিনেম্যানের মতো ঝোলা গোঁফ। ভীষণ উত্তেজিত। সে নাকি গোরস্থানের নিরিবিলিতে বসে গল্প করছিল ক্যাম- মুক্সকে নিয়ে। প্রোগ্রাম ছিল এখান থেকেই সটান যাবে ইন অ্যান্ড আউটয়ের সাইকেডেলিক নাচের আসরে।
এমন সময়ে ঝোঁপের মধ্যে থেকে বিদ্যুৎবেগে বেরিয়ে এল একটা ছায়ামূর্তি। দমাস করে ক্যাম-মুক্স-এর বুকে ঘুসি মেরেই পালিয়ে গেল এঁকেবেঁকে। তারার আলোয় মুখের আদল আর ছোটার ধরন দেখেই মাইকেলকে চিনতে পেরেছিল ভূপেশ।
ঘুসি খেয়ে ছিটকে পড়েও কেন তেড়ে উঠছে না ক্যাম-মুক্স তা দেখবার জন্যে লাইটার জ্বালিয়েছিল ভূপেশ। বুকের বাঁ-দিকে ছুরির ফুটো আর ফিনকি রক্ত দেখেই সটান ছুটেছে পেট্রল পাম্প থেকে লালবাজারে ফোন করতে।
জিগ্যেস করেছিলাম, পার্ক স্ট্রিটের পুলিশ ঘাঁটি তো পাশেই ছিল। লালবাজারে ফোন করা হল কেন? সে বললে, দুদিন আগে ডিসি-ডিডি-র আবেদন পড়েছিল স্টেটসম্যানে–চুরি-ডাকাতি খুন-খারাপির খবরটা তাঁকে সোজা জানালে নাকি অপরাধীকে ঝটপট ধরা যায়।
মেয়েটাকে মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। ভূপেশকে আরও জেরা করার জন্যে লালবাজারে নিয়ে এলাম। ঘরে ঢুকতেই একটা ছোকরা তেড়ে এসে গলা টিপে ধরল ভূপেশের। সেপাই এসে ছাড়াল। এই ছোকরাই মাইকেল। লালবাজারে এসেছে ভূপেশের কুকীর্তি ফাঁস করতে। পকেট থেকে এক জোড়া মিনার্ভার টিকিট বের করে দেখাল নাইট শোয়ের টিকিট। কথা ছিল ক্যাম-মুক্স সঙ্গে যাবে। তার আগে কবরখানার নিরিবিলিতে বসে একটু ইয়ে করেছিল। এমন সময় ঝোঁপের মধ্যে থেকে বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে এল একটা ছায়ামূর্তি..
বাকি কথাগুলো ভূপেশের কথার মতোই–তফাত নেই। দুজনের চেহারাও একরকম। তালঢ্যাঙা, লম্বাচুল, ঢিলে জিন টাইট স্কিনি, ঝোলা গোঁফ। মেয়ে কি মদ্দা বোঝা যায় শুধু ওই গোঁফ দেখে। দুজনেরই পকেটে সমান মাপের দুটো ছুরি। দুজনেই বলছে ছুরি রাখতে হয়েছে আত্মরক্ষার জন্যে। ভূপেশ বলছে, মাইকেল ওকে ছুরি মারবে ক্যাম-মুক্সের মুখে শুনে অবধি সে ছুরি রেখেছে। পকেটে। ঠিক উলটো গীত গাইছে মাইকেল। দুজনকেই ফাটকে ঢুকিয়েছি।
কিন্তু মিথ্যে বলছে কে ধরা যাবে একটি সূত্র ধরে।
কী সুত্র? শুধোল ইন্দ্রনাথ।
মাইকেলের ছুরিতে রক্ত লেগেছিল রুমাল দিয়ে মুছেছে। ওর বুড়ো আঙুলটাও বেশ কেটে গেছে। বলছে হঠাৎ কেটে গেছে। মেডিক্যাল রিপোর্টে ধরা যাবে ছুরির রক্ত আর ক্যাম-মুক্স-এর রক্ত এক গ্রুপের কি না।
ভালো সূত্র, বললে ইন্দ্রনাথ। সেইসঙ্গে আরও একটা পয়েন্ট চেক করিস কাল দিনের আলোয়।
কী?
আজকের বৃষ্টিতে গোরস্থানের ভিজে মাটিতে নিশ্চয় পায়ের ছাপ পড়েছে দুজনের। শ্রীচরণ থেকে জুতোগুলো খুলে নিয়ে গিয়ে মিলিয়ে দেখবি।
তুই বলার আগেই সে ব্যবস্থা হয়ে গেছে। দড়ি দিয়ে জায়গাটা ঘিরে সেপাই বসিয়ে এসেছি। আমি নিজে যাচ্ছি কাল সকালে।
পরের দিন দুপুরবেলা ফের ফোন এল।
ইন্দ্রনাথ? জয়ন্ত বলছি। সব গুবলেট হয়ে গেল।
কেন?
ছুরির রক্ত আর ক্যাম-মুক্স-এর রক্ত এবি গ্রুপের। কিন্তু মাইকেলের রক্তও যে এবি গ্রুপের। সুতরাং কিছুই প্রমাণ করা যাচ্ছে না।
জগাই মাধাইয়ের চরণ চিহ্ন?
সে গুড়েও বালি ব্রাদার। মাসখানেক আগে দু-জনেই একই দিনে একই মাপের বাটার রবারসোল স্পোর্টস শু কিনেছিল। দু-জোড়া জুতোই সমানভাবে ক্ষয়েছে। কবরখানায় প্রিয়ামিলনে গিয়েছিল দু-জনেই ওই জুতো পরে। দুজনের জুতোতেই কাদা মাখামাখি। একী ঘ্যাঁচাকল রে বাবা। কী করি বলত?
একটুও না ভেবে ইন্দ্রনাথ বলল–ভূপেশকে গ্রেপ্তার করবি। রবারসোলের জুতো পরে কেউ ইন অ্যান্ড আউটের সাইকেডেলিক নাচের আসরে যায়? গুল মারবার আর জায়গা পায়নি? *যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত (শারদীয় সংখ্যা, ১৩৮১)।