পাগল খুনি
কাগজটার চারদিক দিয়ে চার হাত-পা বেরিয়েছিল। চুরি পরা হাত, শাড়ি ঢাকা পা। যেন কাগজটারই হাত-পা বেরিয়েছে। একটু পরে কাগজই যেন কথা বলে উঠল নারীকণ্ঠে, পড়েছ? আমি বললাম, পড়ব কখন? কাগজ বলল, কাগজ নিয়ে তোমার মাথাব্যথা নেই বলেই আমাকে পড়তে হয়।
জোর খবর আছে মনে হচ্ছে?
লোম খাড়া করা খবর।
যথা?
খুন।
রোজই হচ্ছে।
এ-খুন সে-খুন নয়।
তবে?
রহস্যজনক খুন।
কাগুজে ভাষা। জোলো হয়ে গেছে।
খুনি হয় বর্বর, নয় উন্মাদ।
খুন হয়েছে কে?
একটা মেয়ে।
সেক্স ম্যানিয়াক মনে হচ্ছে?
ও ইয়েস, মাই বর্বর স্বামী। তুমি কি শুনবে?
তোমার কৌতূহল যখন জাগ্রত হয়েছে–
এবং গা শিরশির করছে–
তখন শুনব বইকি। হতভাগিনীর বডি নিয়ে নিশ্চয় ছিনিমিনি খেলেছে সেক্স ম্যানিয়াক?
কাগজ নামিয়ে বড় বড় চোখে তাকাল কবিতা। লাল হয়ে উঠেছে ফরসা মুখ-চোখে গা রিরি করার আভাস। বললে সামান্য ভাঙা গলায়, কুৎসিতভাবে। বলতেও কষ্ট হচ্ছে। তুমি পড়ে নাও।
অবাক হলাম। ক্রাইমের গল্প আর খবর কবিতাকে চুম্বকের মতো টানে চিরকাল। বীভৎস খুন দেখেওছে। কিন্তু ঠিক এভাবে কখনও শিউরে উঠতে দেখিনি।
হাত বাড়িয়ে বললাম, দাও।
কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে কবিতা বলে, শুধু মেরে ফেললেই পারত। ওইভাবে–
কীভাবে?
বলতে পারব না। পড়ো।
সত্যিই তা বলা যায় না। কাগজ পড়বার পর বুঝলাম। বর্বর খুনি মেয়েটার…
অসম্ভব! লিখতে পারছি না। সাংবাদিক যা পারে, সাহিত্যিক তা পারে না। তাই সংবাদটা হুবহু তুলে দিচ্ছি।
.
বীভৎস হত্যা–কামিনী নিয়ে ছিনিমিনি
রঙ্গিলানগর। দুপুরের খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। অথচ সাড়া নেই নীল কপোত হোটেলের চার নম্বর ঘরে। প্রাণের স্পন্দন যেন মুছে গেছে ঘরের ভেতরে ঠিক এই রকমেরই মনে হয়েছিল যোড়শী পরিচারিকা কাত্যায়নীর–ঘর পরিষ্কার করা যার রোজকার কাজ। মেজাজ খিঁচড়ে গেছিল প্রথমে দুপুর গড়িয়ে গেলে রাগ হওয়া স্বাভাবিক। সব ঘরেই ঝটপাট চুকে গেছে বাকি শুধু এই চার নম্বর। মরে গেল নাকি ঘরের মানুষ দুটো? কড়া নেড়ে আর ধাক্কা মেরেও যখন কেউ সাড়া দেয়নি–তখন চাবির ফুটো দিয়ে উঁকি মেরেছিল যুগলবন্দি দৃশ্য দেখবার মতলবে। সারারাত দাপাদাপি করেছে নিশ্চয়–এখন ঘুমিয়ে মড়া হয়ে গেছে। ষোড়শী কাত্যায়নীর ঔৎসুক্য কিন্তু মেটেনি। বাদ সেধেছিল চার নম্বর ঘরের নিকষ অন্ধকার। দিনের বেলাতেও ঘরের মধ্যে এককণা আলো নেই। দিনকে রাত বানিয়ে রেখেছে মানুষ দুটো। বলিহারি যাই আদিম রিপুর তাড়নাকে।
ফের দুমদাম ঘুসি মেরেছিল কাত্যায়নী দরজার কপাটে। নিথর কক্ষে জাগ্রত হয়নি এতটুকু শব্দতরঙ্গ। নিস্তব্ধ ঘরে শুধু প্রতিধ্বনিত হয়েছে কপাট কাঁপার আওয়াজ–তার বেশি কিছু না।
কুম্ভকর্ণের ঘুমও যে হার মেনে যায়!
কাত্যায়নী তখন খবর দিয়েছে বৌদিমণিকে। উনিশখানা ঘরওলা নীল কপোত হোটেলের দেখাশুনো করতে হয় এই মহিলাকেই। নাম তার শ্রীমতী চারুবালা মৈত্র। সংক্ষেপে ম্যাডাম। ঝি চাকরদের কাছে বউদিমণি। কারণ, হোটেলের মালিক গগনচাঁদ মৈত্রর তিনি পুত্রবধূ।
কাত্যায়নীর ব্যাজার মুখ দেখেই দেওয়ালের কোয়ার্জ ঘড়ির দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করেছিলেন ম্যাডাম। দেখেছিলেন, কাঁটায়-কাঁটায় দুটো। কাত্যায়নীর রাগ কি অকারণে হয়েছে?
তবে ভুরু কুঁচকে গেছিল ম্যাডামের। বঙ্কিম হয়েছিল ললাটরেখা। উনিশখানা ঘরে উনিশটা উপন্যাস রচিত হয়েছে প্রতিরাতে। অবশ্যই মিলনান্তক। বিয়োগান্তক কিছু ঘটে গেল নাকি?
তদন্ত প্রয়োজন–অবিলম্বে।
পাশ কী বের করেছিলেন ম্যাডাম। হোটেলে নিশা সমাপনের অভিলাষে যাঁরা কক্ষ দখল করেন, তাঁদের হাতে একখানা চাবি গছিয়ে দিয়ে বলে দেওয়া হয়–একটাই চাবি এই ঘরের, হারিয়ে ফেলবেন না যেন।
কিন্তু তা নয়। ডুপ্লিকেট চাবি থাকে হোটেল মালিকের কাছে। পাশ কী যার নাম। সঙ্কট মুহূর্ত ছাড়া যে চাবি অদৃশ্যই থাকে।
এখন দৃশ্যমান হল সেই চাবি। প্রবিষ্ট হল চাবির গর্তে। উন্মুক্ত হল কপাট।
কিন্তু ঘর যে কবরখানার মতোই নিস্তব্ধ। শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজও যে নেই!
চৌকাঠে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন ম্যাডাম। উৎকর্ণ হয়েও যখন সক্রিয় ফুসফুঁসের ক্রিয়াকলাপের কীর্তি কানে ধরা পড়েনিনয়নশক্তি তীক্ষ্ণতর করেও যখন নিশ্চিদ্র তমিস্রায় কিছুই অবলোকন করতে পারেননি তখন তিনি পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেছিলেন জানলার দিকে। টেনে সরিয়ে দিয়েছিলেন পরদা। ছিটকিনি খুলে দু-হাট করে দিয়েছিলেন বাতায়নের পাল্লা।
আলোর ভেসে গেছিল ঘর। সেই আলোর উদ্ভাসিত হয়েছিল লোমহর্ষক এক দৃশ্য।
দুশয্যার এই ঘরে পাশাপাশি লাগানো রয়েছে দুটো সিঙ্গল বেড। একটা খাটে শয়ান এক কৃষ্ণকেশী কৃষ্ণা। বিছানার চাদর আর কম্বল দিয়ে মোড়া তার গলা থেকে পা পর্যন্ত। বস্ত্রাবরণ
সরিয়েই বলা যায় শূন্য হয়েছে তার প্রাণপিঞ্জর। পাশের সিঙ্গল খাটের চাদরে অজস্র রক্তচিহ্ন বহন করছে সেই কাহিনি।
শিহরিত ম্যাডাম তৎক্ষণাৎ সচকিত করেছিলেন আরক্ষা বাহিনীকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদের আবির্ভাব ঘটেছিল রুধিরলাঞ্ছিত চার নম্বর ঘরে। চাদর আর কম্বল তারাই অপসারণ করেছিলেন বিগতপ্রাণার হিমশীতল নশ্বর দেহ থেকে। দেখেছিলেন নিষ্করুণ এক দৃশ্য।
পৈশাচিকভাবে বিকৃত করা হয়েছে শরীরটাকে।
সে দৃশ্য বাস্তবিকই অবর্ণনীয়। সুস্থ চিন্তার অধিকারী কোনও পুরুষের পক্ষে কি কোনও নারীর অঙ্গহানি করা সম্ভব এইভাবে?
লেখনী মন্থর হলেও পাঠকদের জ্ঞাতার্থে লিখতেই হবে। জনগণ জানুক, আজ এই মুহূর্তে এক নররূপী পশু বিচরণ করছে এই শহরে…স্টোনম্যান-এর চাইতেও যে বিকট এবং বিকৃত যৌনানন্দের অভিলাষী…
কৃষ্ণা সুন্দরীর বক্ষদেশের পদ্মকোরক দুটি কামড়ে প্রায় কেটে ফেলা হয়েছে ঝুলছে চিবোনো চামড়ার ওপর।
বিবমিষা জাগ্রত হলেও এই সংবাদ যাঁরা পাঠ করছেন, তাঁদের কাছে একান্ত অনুরোধ আরও একটু ধৈর্য ধরুন। কসাই-খুনির কদাকার অন্তর-প্রকৃতি এখনও যে উদঘাটিত হয়নি।
নির্মমভাবে পেটানো হয়েছিল মেয়েটাকে। ভয়াল কামনা যখন প্রকৃতই নারকীয় হয়ে ওঠে তখনই বুঝি এইভাবে কোমলাঙ্গী নারীদেহকে চাবুক মেরে ক্ষতবিক্ষত করা যায়। মোট সতেরোটা রক্তজমা গভীর ক্ষতচিহ্নময়, লম্বা দাগ ভয়াবহরূপে মুখব্যাদান করে রয়েছে হতভাগিনীর মুখে, বুকে, পেটে ও পিঠে।
মোট সতেরোবার তাকে কষাঘাত করা হয়েছে। কখনও চিৎ করে, কখনও উপুড় করে।
সাধারণ চাবুক নয়, অসাধারণ চাবুকের প্রহারে শক্তিমান উচ্চৈঃশ্রবাও উন্মাদ হয়ে গিয়ে নিশ্চয় মৃত্যুবরণ করত। নরম মেয়েটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে গুনে-গুনে সতেরোবার সেই চাবুক হাঁকড়েছে বর্বর খুনি চোখের পাতা না কাঁপিয়ে এবং চাপা অট্টহাসিতে ঘর মুখর করে।
নরদানব অবশ্যই।
চাবুকটা? ছ-ইঞ্চি অন্তর লোহার কাঁটা বল লাগানো। মোট ছটা কন্টকময় লৌহগোলক। বাদশাহী আমলেও এরকম নির্যাতন বোধহয় কল্পনাতেও আনতে পারেনি কেউ। এক-একবারের কষাঘাতে ছটা কাটাবল একই সাথে, ছটি করে কূপ রচনা করে গেছে মাংস ভেদ করে, অস্থি পিঞ্জর চূর্ণ করে দিয়ে। ললাট ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে। নাক ভেঙে হেলে পড়েছে, মেরুদণ্ডের কশেরুকা আস্ত থাকেনি।
পাশের খাটে রক্ত থইথই করেছিল কেন? এখন তা জমে শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে বটে– কিন্তু অত রক্ত অবশ্যই অভাগিনীর শরীর থেকে অবিরল ধারায় ঝরানো হয়েছিল ওই খাটে– কণ্টকাকীর্ণ লৌহবর্তুলের মুহুর্মুহুঃ প্রহারে–তারপর দেহটাকে টেনে এনে ফেলা হয়েছে এই খাটে– চাদর আর কম্বল দিয়ে সযত্নে মুড়ে রেখেছে বিকট চাবুকের মালিক।
বালিশের ওপর তখন রাখা হয়েছিল চাবুকটা। রক্তমাখা চাবুকের দাগ জেগে রয়েছে শুভ্র ওয়াড়ে।
কদর্যতম বিকৃতির কাহিনি লিখতে কলম সরতে চাইছে না, কিন্তু তা লিখতেই হবে। নইলে যে জনসাধারণ জানতেই পারবেন না, কতবড় নরাধম বিচরণ করছে এই মুহূর্তে আমাদের আশেপাশে –পরবর্তী নারীশিকারের প্রতীক্ষায়।..কদর্যতম বিকৃতিটা এই : ঘরের খিল উপড়ে এনে ঘাতক তা দিয়ে তলপেটে আঘাত করেছে। তখন সে দুই গোড়ালি বেঁধে রেখেছিল বড় রুমাল দিয়ে।
কিন্তু হতভাগিনীকে কি জ্যান্তই পিটিয়ে গেছিল নরদানবটা তার যন্ত্রণা তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করার জন্যে? ভয়াল চাবুকের এক ঘা-ই যথেষ্ট প্রাণপাখিটাকে উড়িয়ে দেবার পক্ষে বাকি ষোলটা কশাঘাত কি টের পেয়েছিল কালো সুন্দরী?
এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেননি মর্গের পোস্টমর্টেম করার প্যাথলজিস্ট। তিনি শুধু বলেছিলেন, মেয়েটা মারা গেছে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন। হয়তো মুখের মধ্যে ন্যাকড়া ঠুসে দিয়ে ফুসফুঁসে বাতাস যাতায়াতের পথ রোধ করে দেওয়া হয়েছিল–অথবা, বালিশ চেপে ধরা হয়েছিল মুখে।
প্রহারের আগে, না পরে? মুখে কাপড় ঢুকিয়ে মরণ চিৎকারের পথ বন্ধ করেই নিশ্চয় চাবুক লকলকিয়ে উঠেছিল তার নিরাবরণা শরীরের প্রতিটি বর্গ ইঞ্চির ওপর। খিল উপড়ে আনা হয়েছিল তার আগে না পরে?
বীভৎস! অতিবড় দুঃস্বপ্নেও যে এহেন নারী নিধনের পরিকল্পনা মাথায় আনা যায় না। হত্যাকারী কি তবে উন্মাদ? যৌন বিকৃতিতে আচ্ছন্ন এক শরীরী আতঙ্ক?
পুলিশ তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। মেয়েটির হাড়গোড় ভাঙা ছিন্নভিন্ন দেহটা পাওয়া গেছিল শুক্রবার, ২৪ জুন, ১৯৯৪। তার আগের রবিবারে চার নম্বর ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছিল যে পুরুষ অতিথিকে, তার সঙ্গে ছিল এক মহিলা–যে-মহিলা খুন হয়েছে, সে নয়। হোটেল রেজিস্টারে সই করেছিল পুরুষটি মিস্টার অ্যান্ড মিসেস এন. জি. সহায় নাম দিয়ে–ঠিকানা লিখেছিল মহম্মদবাজারের এক বাড়ির।
পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন নিজেই এই নিষ্ঠুর হত্যার তদন্ত শুরু করেছেন। পাঠক সাধারণের স্মরণ থাকতে পারে, গতবছর ইনি পুলিশ মেডেল পেয়েছিলেন দিল্লি থেকে ভারতের এক নম্বর মানুষ স্বর্ণপদক তুলে দিয়েছিলেন ভারতের এক নম্বর পুলিশ অফিসারের হাতে। কৃতী পুরুষ ইকবাল হোসেন তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আর বিদ্যুৎগতি তদন্তের অন্যতম নিদর্শন হাজির করেছেন কৃষ্ণাকামিনীর নিঠুর ঘাতকের সন্ধানে।
কয়েক ঘণ্টাও অতিক্রান্ত হয়নি–ঘাতকের হদিশ তিনি বের করে ফেলেছেন। নাম তার নটগোপাল সহায়। সুদর্শন। বয়স ২৯। একদা ছিল আর্মি অফিসার। বিলক্ষণ লম্বা–পাক্কা ছফুট। ক্রিমিন্যাল রেকর্ডের অধিকারী। সেসব ক্রাইমের মধ্যে অবশ্য ভায়োলেন্স নেই। খুন জখম মারপিটের দাগ নেই তার অতীত ইতিহাসে–তবে ধোয়া তুলসিপাতা নয়।
শনাক্ত করা গেছে হতভাগিনী মেয়েটিকেও। বয়স তার ৩২। নাম, মিসেস বিদ্রোহিনী বরাট। মাঝে-মাঝে ফিল্মে এক্সট্রা হয়েছে। স্বামী পরিত্যক্তা। হল্লামুখর বোহেমিয়ান জীবনযাপনে অভ্যস্ত। নিত্যনতুন আদমের সঙ্গে নিশাযাপন তার চরিত্রের মস্ত দিক।
খুনের আগের রাতে সে আকণ্ঠ সুরা পান করেছিল। শুধু বিকিনি এবং অতি ক্ষীণ বক্ষবাস পরে উল্লোল নৃত্য নেচেছিল নটগোপাল সহায়ের সঙ্গে স্থানীয় পানামা ক্লাবে। মধ্যযামিনী নাগাদ ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল দুজনে কোমর ধরাধরি করে। দাঁড় করিয়েছিল চলমান এক ট্যাক্সিকে। সোজা গেছিল নীল কপোত হোটেলে। ট্যাক্সিচালক উমেশ খান্না প্রখর স্মৃতিশক্তির নিদর্শন রেখেছে পুলিশ সুপারের রিপোর্টে। বলেছে, ওরা তো ট্যাক্সির মধ্যেই গুজুর-গুজুর করছিল, চাপা হাসি হাসছিল, এলোমেলো চুম্বনও চলছিল। মদের গন্ধে ভুরভুর করছিল ট্যাক্সি। এসব লোকদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। বেশি বেলেল্লাপনা করলে নিশ্চয় গলা তুলতাম। কিন্তু তার দরকার হয়নি। নীল কপোত হোটেল যখন প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে, ট্যাক্সি থামিয়ে নেমে পড়েছিল দুজনে, ঢ্যাঙা লোকটা জিগ্যেস করেছিল–ভাড়া কত হয়েছে? উমেশ বলেছিল–বাইশ টাকা। দশটাকার তিনখানা নোট উমেশের হাতে গুঁজে দিয়ে মেয়েটার কোমড় জড়িয়ে ধরে সোজা হোটেলের দিকে টলতে টলতে এগিয়ে গেছিল দুজনে–ঢুকে গেছিল লোহার গেট পেরিয়ে ভেতরে।
তদন্ত ধারা নিশ্চয় আরও এগিয়েছে। কিন্তু বিচক্ষণ ইকবাল হোসেন এর বেশি খবর দিতে চাননি আমাদের প্রতিবেদকের কাছে। তবে পুলিশের সাহায্য ছাড়াই আমরা এই নরপিশাচের সন্ধান নেওয়া শুরু করেছি। আমরা নিছক সংবাদদাতা নই, সমাজসেবকও বটে। আমাদের সাংবাদিক শুধু সংবাদ সংগ্রহই করেন না সমাজশত্রুর অন্বেষণও করেন। অচিরেই আমরা এই দুষ্ট ব্রণর নাগাল ধরে ফেলতে পারব–এই আশা রাখছি।
.
কাগজ নামিয়ে রেখে তাকালাম কবিতার দিকে। গালে হাত দিয়ে প্রোজ্জ্বল চোখে সে তখনও তাকিয়ে আমার পানে।
আমি বললাম, দৈনিক ক্রাইম ইন্ডিয়াকে একমাত্র ক্রাইম ডেলি বলেই জানতাম কিন্তু ডিটেকটিভগিরি শুরু করেছে, এটা জানা ছিল না।
জবাবটা ভেসে এল চৌকাঠ থেকে, এবং আমিই সেই ডিটেকটিভ।
সচমকে তাকিয়েছিলাম কণ্ঠস্বরের অধিকারীর দিকে। মিটিমিটি হাসছে দরজার দুই পাল্লায় হাত রেখে। খাসা মানিয়েছে পাটভাঙা গরদের পাঞ্জাবি। চুনোট করা কেঁচার অগ্রভাগ লুটিয়ে রয়েছে। দুই পায়ের ফাঁকে মেঝের ওপর।
চোখের তারা নাচিয়ে সে বললে, হ্যাঁ, আমিই সেই গোয়েন্দা শ্রীহীন ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
গাল থেকে হাত নামিয়ে গলা শক্ত করে বললে কবিতা, ঠাকুরপো, স্বামী-স্ত্রীর কথার মধ্যে আড়ি পাতা অত্যন্ত কু-অভ্যেস।
আড়ি তো পাতিনি। পুনর্বার চক্ষুনৃত্য দেখিয়ে এবং কণ্ঠস্বরের অর্গান বাজিয়ে বললে শ্রীযুক্ত ইন্দ্রনাথ রুদ্র, সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি তীর্থের কাকের মতোনসুবচনী বউদির হাতে এক কাপ চা খাব বলে কিন্তু বউদির নয়নজ্যোতি যে মৃগাঙ্কর অঙ্কেই নিবদ্ধ।
গাল লাল হল কবিতার। মুখে আঁচল চাপা দিয়েই সরিয়ে নিয়ে বললে, ভেতরে আসা হোক। অভিনয় যথেষ্ট হয়েছে। আইবুড়ো হলেই কি এমনি হয়?
কেমনি? ভেতরে এসে ধপ করে কবিতার পাশে দেহভার ন্যস্ত করে বললে ইন্দ্রনাথ, একাধারে স্ত্রীত্ব, মাতৃত্ব, বন্ধুত্ব তোমার মাঝে দেখবার জন্যে ছুটে আসি যেমনিভাবে–তেমনি?
তোমার সঙ্গে কথায় আজকে অন্তত পারব না।
কেন? কেন? কেন? আজ তোমার জিহ্বাাসরস্বতী কি নিদ্রিতা?
মূর্চ্ছিতা।
কেন? কেন? কেন?
দৈনিক ক্রাইম রিপোর্টেড ওই পাষণ্ডটার কাণ্ড পড়বার পর।
পাষণ্ড করেছে পাষণ্ডর কাজ–তাতে তোমার মস্তিষ্ক লণ্ডভণ্ড কেন?
তার আগে বলো, দৈনিক ক্রাইম তোমাকে অ্যাপয়েন্ট করেছে?
হ্যাঁ। নটগোপাল সহায়কে ধরবার জন্যে?
হ্যাঁ।
সন্ধান পেয়েছ?
না।
ইকবাল হোসেন ত্বরিৎ গতিতে এগিয়ে গেলেন, খুনির নাম বের করে ফেললেন, আর তুমি তার—
টিকি ধরতে পারছি না, এই তো? হে বউদি, ইকবাল যা কিছু খবর পেয়েছেন সবই তো
ওই নাইট ক্লাব থেকে। সেখানে রেগুলার যারা আসে, তাদের নামধাম রেজিস্টারে লেখা থাকে। তারপর?
তারপর কী?
সব ফলস। ইকবাল হোসেন তাই এখন ল্যাজেগোবরে।
বিশদ করো ঠাকুরপো।
ইকবাল খোঁজ নিয়েছিলেন নটগোপালের রেসিডেন্সে–সেখানে ওই নামে কেউ থাকে না।
নটগোপাল তাহলে আর্মিতেও ছিল না?
মনে তো হয়।
তার ক্রিমিন্যাল কীর্তিকলাপ ইকবাল হোসেন জানলেন কী করে?
ক্লাবেই বড়াই করত নটরাজ—
নটগোপাল।
ওই হল গিয়ে। মদের বেঁকে এন্তার কথা বলেছে সমাজশ্রেণির মানুষদের কাছে। নাইট ক্লাবে কখনও যাওনি–গেলে বুঝতে সেখানে কী শ্রেণির লোক আসে।
তুমি যাও বুঝি?
পা নাচিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল ইন্দ্রনাথ। তারপর পকেট থেকে বের করল পাইপ আর টোব্যাকো।
কবিতা বললে, তবুও ভালো। নস্যিটা ছেড়েছ।
কিছুই ছাড়িনি। সবই আছে। দরকার মতো ইউজ করি। যেমন করেছি ধনগোপালকে কজা করার জন্যে।
ধনগোপাল আবার কে?
বিদ্রোহিনীর হাজব্যান্ড।
ঝট করে শিরদাঁড়া সিধে করে ফেলল কবিতা, বিদ্রোহিনী! সেই কুলটা মেয়েটা?
মেয়েরাই মেয়েদের বড় শত্রু। কুকর্মের এহেন সাজাপ্রাপ্তির পরেও তাকে কুলটা বলাটা অন্যায়।
কে এই ধনগোপাল?
লাটনগরের নাম শুনেছ? শোনোনি। শিগগিরই দৈনিক ক্রাইমে বেরোবে দ্বিতীয় কিস্তি– তখন জানতে পারবে।
তার আগে তোমার মুখে শুনব।
শোনো।
সমুদ্রের ধার বরাবর পান্থনিবাস গড়বার একটা হিড়িক খুব লক্ষ করা যাচ্ছে। ইদানীং দেশ বেড়ানোর বাতিক যাদের, তারা এইসব জায়গায় কিস্তিতে টাকা নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেও রাখছে।
লাটনগরও সমুদ্রের ধারে–গভীর ঝাউবনের মধ্যে। কিন্তু এ যুগের প্রোমোটারদের জন্ম হওয়ার আগে পরিকল্পিত। সিপাই বিদ্রোহের ঠিক পরে লাটনগরের পত্তন ঘটে সুন্দরবনের গভীর গহন অঞ্চলে। সেখানে গেলে ইতিহাস যেন গাছের পাতায়-পাতায় কথা কয়। আমি সেই কথা শুনে এসেছি।
সিপাই বিদ্রোহ যখন শুরু হয়নি, মঙ্গল পাণ্ডে যখন ব্যারাকপুরে রুখে দাঁড়ায়নি, তখন এক কর্মঠ ব্রাহ্মণ যজমানি ত্যাগ করে সেই অঞ্চলে চলে যান শান্তিতে থাকবেন বলে। মানুষের সঙ্গ তার ভালো লাগেনি বিশেষ একটা কারণে। নাম তার মাধবেন্দ্র আচার্য বারেন্দ্র। ঘণ্টা বাজানো তিনি ঘৃণা করতেন, কিন্তু কুড়ুল চালাতে পারতেন ভালো। বন্দুক আর তলোয়ার ছিল তার নিত্য সঙ্গী। তার ভেতরে ছিল বজ্র–আগুন ছিল চোখে। এই পৃথিবীর একটা মানুষ জাতকে তিনি অন্তরের দাবানল দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিলে স্বস্তি পেতেন।
সে জাতটা ইংরেজ জাত।
কারণ, তাঁর সুন্দরী যুবতী বধূকে উপভোগ করে গেছিল এক ইংরেজ সামরিক অফিসার। ছফুট লম্বা মাধবেন্দ্র আচার্য তাকে ক্ষমা করেননি কুড়ুলের এক কোপে খুলি দু-ফাঁক করে দিয়েছিলেন।
ধর্ষিতা স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেছিলেন জঙ্গলে। সেইখানেই ফুটেছিল ধর্ষণের ফুল। মাধবেন্দ্র তাকে নিজের ছেলে বলেই গ্রহণ করেছিলেন। বড় করে তুলেছিলেন।
সেই যুগে জায়গাজমি নিয়ে এত লেখাজোখা হত না। জঙ্গলের জমিতে কে বাড়ি বানিয়ে জমি দখল করেছে–অত ভাববার দরকার হত না। কুড়ুল চালিয়ে গাছ সাফ করে সুন্দর একটা আস্তানা বানিয়ে তুলেছিলেন মাধবেন্দ্র। কুড়ুলের কোপে বাঘ মেরেছেন, সাপ সাফ করেছেন।
এই সময়ে সিপাই বিদ্রোহ শুরু হল এবং শেষও হয়ে গেল। আঁচ পৌঁছল না জঙ্গলের শান্তিঘেরা অঞ্চলে।
ব্রিটিশ সরকার কিন্তু বিদ্রোহের গতিপ্রকৃতি আর নেতৃত্বের পরিচয় জানবার জন্যে খোঁজ নেওয়া শুরু করেছিল। দেখা গেছিল, বিদ্রোহ ঘটেছে শুধু উত্তরভারতেই–যে জায়গাটা আর্যদের বাসভূমি বৈদিক আর্যাবর্ত। বিদ্রোহের নায়করা প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণ।
সেনাদলে নৈতিক নেতৃত্ব নিল কীভাবে ব্রাহ্মণরা? খোঁজ নিয়ে জানা গেছিল–সবই বেদের ক্ষমতা। ব্রিটিশ সরকার তখন বেদের ব্যাখ্যা করিয়েছিল ম্যাক্স মুলারকে দিয়ে। একই সঙ্গে খতম করতে চেয়েছিল ব্রাহ্মণদের–শুরু হয়েছিল শত্ৰুসংহার বড় ভয়ানকভাবে। শাহী সড়ক বা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের দু-ধারে গাছে-গাছে ফাঁসিতে লটকে দেওয়া হয়েছিল পৈতেধারী ব্রাহ্মণদের–গাঁয়ে হানা দিয়ে ব্রাহ্মণ পেলেই ধরে এনে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ঝুলন্ত ব্রাহ্মণদের নামিয়ে এনে সৎকার করতেও দেওয়া হয়নি।
এই সময়ে বৈকুণ্ঠ বরাট নামে এক ধনকুবের সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ জায়গা ইজারা নেয় ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে বিদ্রোহ দমনে বিস্তর সাহায্য করার পারিতোষিক হিসেবে।
মাধবেন্দ্রকে উৎখাত করার দরকার হয়েছিল তখনই। অথচ তাকে যমের মতোন ভয় পেত বৈকুণ্ঠ। প্রথমে বন্ধুত্ব দিয়ে জয় করার চেষ্টা করেছিল মাধবেন্দ্রকে। সমুদ্রের ধারে নিজের প্যালেস যখন তৈরি হচ্ছে, মাধবেন্দ্রকে ডেকে এনে খাইয়েছে, নামী আর্টিস্টকে দিয়ে তার অয়েল পেন্টিং আঁকিয়ে ঘরে ঝুলিয়েছে, টাকা পয়সাও দিতে চেয়েছে।
মাধবেন্দ্র কিন্তু টলেনি।
তাই একদিন দেখা গেল, ব্রিটিশ সৈন্য অতর্কিতে হানা দিয়ে মাধবেন্দ্রকে ঝুলিয়ে দিয়েছে ফাঁসির দড়িতে–তাঁরই প্রিয় বটগাছের ডালে। অপরাধ–সিপাই বিদ্রোহে মদত দেওয়া।
পালিয়ে বাঁচল মাধবেন্দ্রর কিশোর পুত্র–যার ধমনীতে রয়েছে ইংরেজ রক্ত স্ত্রীর মৃত্যু আগেই ঘটেছিল।
যে কজন জানল ব্যাপারটা, তারা মুখে চাবি দিয়ে রইল বৈকুণ্ঠর ভয়ে।
প্যালেস ঘিরে গড়ে উঠল বসতি। বরাট এর ব বাদ দিয়ে নাম দেওয়া হয়েছিল রাটনগর। কালক্রমে তা দাঁড়িয়েছে লাটনগর।
এই লাইনগরের বর্তমান মালিক ধনগোপাল বরাট দিন কয়েক আগে এসেছিলেন আমার কাছে। বিদ্রোহিনীর মার্ডারারকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে।
দৈনিক ক্রাইমে খবরটা পড়ে?
হ্যাঁ। প্রথমে গেছিলেন পত্রিকা অফিসে। আত্মপরিচয় দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, বিদ্রোহিনীকে তিনি ত্যাগ করেননি বিদ্রোহিনীই তাঁকে ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়েছিল। কারণ, তিনি তাঁর বিধবা পুত্রবধূর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করে চলেছেন।
চোখের তারা স্থির হয়ে গেল কবিতার। মুখে কথা নেই।
জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে গেল ইন্দ্রনাথ।
.
ভদ্রলোকের মুখাবয়ব শেয়ালের মতোন ছুঁচোল। চোখ কোটরে ঢোকানো। কান খাড়া– খরগোশের কানের মতোন। ভয়ানক ফরসা রং যেন ফেটে পড়ছে। নিখুঁতভাবে কামানো গাল আর চিবুক–ঠোঁটের নীচের গোঁফজোড়া কিন্তু বাইসনের বাঁকানো শিং-এর অনুকরণে মোম দিয়ে সযত্নে পাকানো। গায়ে গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি। চাহনি চঞ্চল এবং ধূর্ততায় পিচ্ছিল। প্রথম দর্শনেই তার চরিত্রের সততা সম্বন্ধে সন্দেহ জেগেছিল দৈনিক ক্রাইম পত্রিকার নিউজ এডিটরের মনে।
জিগ্যেস করেছিলেন, আপনার স্ত্রী? ত্যাগ করেছিলেন কেন?
আমি করিনি। অম্লানবদনে বলেছিলেন ধনগোপাল, পালিয়ে গেছিল।
কেন?
আর বলেন কেন। বউ মরে গেল–ছেলেটার বিয়ে দিলাম–একই ছেলে। সে ব্যাটাও অক্কা পেল। কী করি বলুন? ঘরের বউকে তো পরকে দেওয়া যায় না। তাই একটু ইয়েটিয়ে করতাম।
শাট আপ। আপনি আসতে পারেন।
আসব মানে? লাটনগর থেকে এতটা পথ ঠেঙিয়ে এলাম কি আপনার বদনচন্দ্র দেখে বিদায় নেব বলে? মেয়েটাকে কে মারল, তা জানব না!
আপনি যান।
না, যাব না। দ্বিতীয় পক্ষের বউ হয়ে এসেছিস, সেইভাবে থাকলেই পারতিস। খাওয়া পরার অভাব তো ছিল না–তা না, আমি আমার ছেলের বউয়ের সঙ্গে কী করছি তাই নিয়ে মাথা গরম।
গেট আউট।
বুঝেছি। আপনার কম্ম নয়। ইন্দ্রনাথ রুদ্র নামে কে একটা ডিটেকটিভ যেন আছে? সত্যি, না সেটাও বোলচাল কাগজ কাটানোর গল্প? আছে? দিন, দিন, ঠিকানা দিন–দেখি তার মুরোদ।
আপনিই ইন্দ্রনাথ রুদ্র? চেহারাটা বাগিয়েছেন খাসা–লায়ক-লায়ক।
লায়ক নয়–নায়ক।
নস্যি-নস্যি…নাক বুজে গেছে মশায়–আপনিও নেন? দিন।
আপনার কুকীর্তি এখুনি শুনলাম–টেলিফোনে।
ভ্যানতারা নিউজ এডিটরটা ফোন করেছিল? বোগাস লোক মশায়–আমি চাই বিদ্রোহিনীর মার্ডারারকে। কেন? দূর মশায়, গলা কাটতে যাব কেন? গালে চুমু খাব। মাগিকে টাইট দিয়েছে ভালোই।
আপনি খুশি?
বিলক্ষণ। পেটের ভাত জোগাতে বেশ্যাগিরি করছে, সে খবর পেয়েছিলাম। ঘরে ফিরিয়ে আনতেও চেয়েছিলাম।
আপনার মনে লম্পটের ঘরে?
সে নিজেই বা কম যাচ্ছিল কীসে! এইসব মেয়েদের পিটোতে আমার ভারি–
তাই ফিরিয়ে আনতেন?
হা-হা! ঠিক ধরেছেন। কাটাওলা চাবুক তো ঘরেই আছে।
আপনার ঘরে?
মাইরি মশায়, কী ভাবেন আমাকে? বাপ চোদ্দো পুরুষের চাবুক যত্ন করে রাখব না? ছেলের বউ তো চাবুকের ভয়েই–
আমাকে দেখাবেন?
নজর দেবেন? যা ফিগার আপনার—
চাবুকটা দেখতে চাই।
তাই বলুন! চলুন না–গাড়ি রেডি।
ঝাউবন দিয়ে ঘেরা সারি-সারি কটেজ। একপ্রান্তে একটা দোতলা বাড়ি। ব্রিটিশ স্থাপত্য বনেদ থেকে ছাদ পর্যন্ত। বড়-বড় থাম কলকাতার সেনেট হাউসের অনুকরণে।
এই বাড়িটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাগান সমেত। পাঁচিলের বাইরে ঝাউবনের মাঝে-মাঝে কটেজ ভাড়া দেওয়া হয়। তিন দিকে। আর একদিকে সমুদ্র।
দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধনগোপাল বললেন, অনেকটা পথ এসেছেন। রাতও হয়েছে। একটু মাল চেখে নেবেন?
চাবুকটা দেখান।
অ্যাবাউট টার্ন করুন। ওই যে হলঘর–এ বাড়ির নাচঘর। দেওয়ালে-দেওয়ালে ওই যে অয়েল পেন্টিংগুলো দেখছেন–আমার পূর্বপুরুষদের শুরু সেই বৈকুণ্ঠ বরাট থেকে। এই যে এই ছবিটা–পাশেরটা কার বলুন তো? হা-হা–সেই গবেটটার–যাকে ফাঁসিতে লটকে ছিল বৈকুণ্ঠ বরাট কায়দা করে–
মাধবেন্দ্র আচার্য।
নামটা মনে রেখেছেন তাহলে! গাড়ির ঝাঁকুনিতে অনেক কথাই পেট থেকে বেরিয়েছে দেখছি। –কে?
হলঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা ছায়ামূর্তি, আমি।
বিলকুল?
আজ্ঞে।
মশায় ডিটেকটিভ, এই আমার ম্যানেজার–এর মুখেই খবর পেয়েছিলাম, কেলে বউটা কেলোর কীর্তি করে বেড়াচ্ছে–জানতেও পাঠিয়েছিলাম–তার আগেই গেল ফরসা হয়ে। বিলকুল, ওই ঝাড়বাতিটা জ্বালো।
জ্বলে উঠল ইলেকট্রিক ঝাড়বাতিলাটনগরের পাওয়ার হাউস চলে হাওয়া কলের দৌলতে সমুদ্রের হাওয়ায়। ধনগোপালের ব্রেন।
ম্যানেজার বিলকুল ঘুরে দাঁড়াল দেওয়ালের সুইচ বোর্ডের সামনে। লোকটা যেমন দীর্ঘকায়, তেমনি অস্থিময়। রোগা হাড় নয়–মোটা হাড়। চোয়াল বুলডগের চোয়ালের মতোন চৌকো। চোখ দুটো ধীর স্থির শান্ত।
ধনগোপাল বললেন, বিলকুলের ডানদিকের দেওয়ালে আলমারিতে রয়েছে কাটা চাবুক। দেখুন আপনি–আমি একটু মাল খেয়ে আসি।
বিদায় হলেন ধনগোপাল–কেঁচা লুটিয়ে। বিলকুল আর ইন্দ্রনাথ তাঁর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল সেকেন্ড কয়েক।
তারপর বললে ইন্দ্রনাথ, আপনার নামটা অদ্ভুত।
অবাঙালি বলে মনে হয়? হাড় খটখটে চেহারা হলেও বিলকুলের গলা মার্জিত মিষ্টতা আছে।
তা বটে। পদবী কী আপনার?
আচারিয়া। ইন ফ্যাক্ট, আমরা ইউ-পির মানুষ। বাঙালি বনে গেছি।
বিদ্রোহিনী বরাটের খবর আপনি পেলেন কী করে?
এস্টেট ম্যানেজ করতে গেলে শহরে যেতেই হয় সর্বত্র গতিবিধি রাখতে হয়। এসব কটেজ যারা ভাড়া নেয় তারা কেউ নিখাদ সোনা নয়। এ-ওর বউকে ভাঙিয়ে নিয়ে রাত কাটিয়ে যায়, কখনও অফিসের মেয়ে, কখনও পাড়ার দিদি-বোন-বউদি, কখনও স্রেফ কলগার্ল।
বুঝেছি। লাটনগর তাহলে আসল পাপনগর?
গম্ভীর মুখে কিন্তু শান্ত চোখে সংক্ষেপে জবাব দিল বিলকুল, ব্যাবসা।
কালো ব্যাবসা। পাপ তো এই প্রাসাদেও, তাই না?
চুপ করে রইল বিলকুল। কিন্তু জবাবটা ভেসে এল দূর থেকে একটা নারী কণ্ঠের আর্ত চিৎকারের মধ্যে দিয়ে। সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে, ঝাউ গাছগুলোর মর্মরধ্বনি ডুবিয়ে–ক্ষণস্থায়ী কিন্তু আকুল সেই চিৎকার রণরণিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে গেল প্রাসাদের অলিন্দে-অলিন্দে বেশ কয়েক সেকেন্ডে। তারপর সব চুপ।
দেওয়ালে প্রলম্বিত অয়েল পেন্টিং-এর দিকে চোখ তুলে নিশ্চুপ দেহে দাঁড়িয়ে বিলকুল। নির্বিকার।
কার কণ্ঠ? প্রশ্ন ইন্দ্রনাথের।
মৌমিতার।
ধনগোপাল বরাটের পুত্রবধু?
হ্যাঁ।
চেঁচাল কেন?
অয়েল পেন্টিং থেকে চোখ নামিয়ে ঠান্ডা গলায় বললে বিলকুল, আপনি তা জানেন।
এত নিশ্চিতভাবে বলছেন কেন?
কারণ, বস সবার কাছে বড়াই করেন।
এই প্রথম বিলকুলের কণ্ঠস্বরে ঈষৎ উত্তাপের আভাস লক্ষ করল ইন্দ্রনাথ। বললে, যে অয়েল পেন্টিংটা এতক্ষণ চোখের পাতা না কাঁপিয়ে দেখছিলেন–সেটা কার, তাও বলেছেন।
অয়েল পেন্টিংয়ের দিকে ফের চোখ ঘুরে গেল বিলকুলের, বেচারা। কিন্তু শেষ অভিশাপ ঘুরছে এই প্রাসাদের বাতাসে।
কেন?
কয়েকটা রাত থাকলেই বুঝবেন।
প্রেতাত্মার কথা বলছেন?
হ্যাঁ। শুনেছি, ফাঁসিতে ঝোলাবার আগে বৈকুণ্ঠ বরাটের দিকে তাকিয়ে তিনি দাঁতে দাঁত পিষে বলেছিলেন–আমার জারজ সন্তান এর শোধ নেবে বৈকুণ্ঠ।
আপনি জানলেন কী করে?
আপনিও জানতে পারবেন। কদিন থাকুন। এই ঝাউবনের বাইরে যারা থাকে, তারা জানে। দেখছেন না, এ বাড়ির কেউ স্বাভাবিক নয়। বিধবা পুত্রবধূর মৃত্যুও বুঝি এর চাইতে ভালো ছিল। বিদ্রোহিনী পালিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু কী হল!
মাধবেন্দ্রর ছেলে তো এখন বেঁচে নেই–থাকলে বলতাম খুনটা করেছে সেই।
থাক সে কথা।
আমার তো মনে হয় এ ভিটেতে ঘুঘু চড়িয়ে ছাড়বে মাধবেন্দ্রর প্রেতাত্মা।
পূর্ণ চোখে ইন্দ্রনাথের পানে তাকাল বিলকুল–আশ্চর্য নয়।
কাঁটা চাবুকটা দেখান।
আসুন। এই দেখুন। লাল ভেলভেটের ওপর কত যত্নে সাজিয়ে রাখা–যেন অমূল্য ধন। শেষের দিকের শ্লেষ আর প্রচ্ছন্ন রইল না বিলকুলের কণ্ঠে।
আলমারিটা খুলুন—
হাতে নিয়ে দেখবেন? দেখুন।
কী লাগানো রয়েছে বলুন তো? ভেসলিন নয়কালচে…এ যে রক্ত…শুকনো রক্ত!
পাথরের মতোন শক্ত হয়ে গেল বিলকুলের দুই চক্ষু দুই মণিকা এখন গ্র্যানাইট কঠিন—রক্ত!
হ্যাঁ।–পুত্রবধূকে পেটান হয়েছিল নাকি?
হলে জানতে পারতাম।
আপনাকে মৌমিতা সব কথা বলে মনে হচ্ছে?
ঠিক ধরেছেন। আমার কিছু করার নেই। গৃহভৃত্য ছাড়া আমি কিছুই নই।
চাবুকের রক্ত খুব পুরোনো নয়।
তাই তো দেখছি।
কার রক্ত বলে মনে হয়?
চোখ নামিয়ে নিয়ে বললে বিলকুল, সেটা আপনি বলবেন। আমি যাই, আপনার আহারাদির ব্যবস্থা করি।
ঘর যখন ফাঁকা হয়ে গেল, তখনও ইন্দ্রনাথ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল অয়েল পেন্টিংয়ের সামনে। কাটা চাবুক তার দু-হাতে।
চমক ভাঙল মরণাত্মক আর্তনাদে।
নারীকণ্ঠের আর্তনাদ। একবার…দুবার…তারপর নৈঃশব্দ্য।
ধাবমান পায়ের আওয়াজ শোনা গেল চওড়া বারান্দায়–যেদিকে রয়েছে সমুদ্র।
ঘরে ঢুকল বিলকুল। চক্ষু বিস্ফারিত। হাঁপাচ্ছে, শুনলেন?
কার কণ্ঠ? একইরকম নিরুত্তাপ স্বরে বললে ইন্দ্রনাথ।
মৌমিতার।
সে এখন কোথায়?
আসুন।
বারান্দার শেষের দিকে যাওয়ার পথে পাশের একটা ঘর থেকে হাঁক শোনা গেল ধনগোপালের, কে যায়?
আমি। বললে বিলকুল।
কে চেঁচাল অমন করে?
আপনার পুত্রবধূ? এবারের জবাবটা ইন্দ্রনাথের। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। সাদাকালো মার্বেল বাঁধানো মেঝের ওপর কার্পেট পাতা। মখমলের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে ধনগোপাল। সামনে হুইস্কির বোতল আর গেলাস। বললে স্থালিত স্বরে, মাগির বড় বাড় বেড়েছে। যাচ্ছি।
বিলকুল ঢুকল ঘরে। কার্পেট থেকে ধনগোপালকে টেনে তুলল দুই বগলের নীচে হাত গলিয়ে, চলুন।
ফের বারান্দা। দু-খানা ঘর পরেই ডানদিকের দরজা খোলা। আলো জ্বলছে।
চৌকাঠে থমকে দাঁড়াতে হল তিনজনকেই।
মাতালের গলা দিয়ে বেরিয়ে এল শুধু একটা শব্দ, যাচ্চলে।
বিশাল পালঙ্কে এলিয়ে রয়েছে অর্ধনগ্না গৌরবর্ণা এক নারীদেহ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত।
গোটা শরীর ফালাফালা হয়ে গেছে ধারাল নখের খাবলানিতে। লম্বালম্বি টান। বুকের ফুল টুকরো-টুকরো। ঠোঁট আধখানা নেই। সবচেয়ে বেশি আঁচড়ানি দুই জঙঘার মাঝে–পৈশাচিক আক্রোশ যেন সেইখানেই।
চেঁচিয়েছিল তখনই–যন্ত্রণায় আকুল হয়ে–চেঁচানি স্তব্ধ হয়েছে শাণিত নখ যখন একটানে দু-টুকরো করেছে কণ্ঠনালি।
.
বারান্দায় নীচে বাগানে এখন জঙ্গল বাগানের নামগন্ধ নেই। এই জঙ্গল শেষ হয়েছে সমুদ্রের ধারে বালির সৈকতে।
গভীর রাতে একটা টর্চ বারকয়েক জ্বলে উঠে নিভে গেল এই জঙ্গলের অন্ধকারে।
যেন হারানো নিধি খুঁজছে অন্ধকারের প্রেত।
.
ডেডবডি তখনও চাদর দিয়ে চাপা। পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল প্রাসাদের গাড়ি-বারান্দায়। গাড়ি থেকে নামলেন সুদেহী এক অফিসার। কোমরে রিভলভার।
অভ্যর্থনা জানাল শুধু ইন্দ্রনাথ।
অফিসার বললেন, ফোর্স আনতে বারণ করলেন কেন?
দরকার কী? আপনার আর আমার রিভলভারই যথেষ্ট।
যদি গুলি ফসকায়…না, না, আপনার নয়…আমার।
ইকবাল হোসেনের গুলি আকাশের উড়ন্ত পাখিকেও মাটিতে নামিয়ে আনে।
প্রেতের গায়ে কি গুলি লাগবে?
লাটনগরের প্রেত? ওই সেই বটগাছ–ওই সেই ডাল–যেখানে ঝুলছিল তার নশ্বর দেহ। ইকবাল হোসেন, হয়তো তিনি এখনও আছেন।
বাঘের আঁচড় মশায়–বারান্দা টপকে ঢুকেছিল–বারান্দা টপকে পালিয়েছে।
শিকারকে মুখে না নিয়ে?
যা চেঁচিয়েছিল মেয়েটা—
বাঘ কখনও মেয়েদের গোপন জায়গায় আক্রোশ দেখায়?
সেক্স ম্যানিয়াক বাঘ নাকি?
তার চাইতেও জঘন্য–মানুষ।
সে কে?
স্বচক্ষে দেখে যান।
.
নাচঘরে এখন সাদা পাথরের গোল টেবিলে মুখোমুখি বসে বিলকুল আর ধনগোপাল, ইকবাল আর ইন্দ্রনাথ।
শেষের দুই ব্যক্তির সামনে দুটি রিভলভার, বিলকুলের সামনে নামী ব্র্যান্ডের সেলোটেপ আঁটা এক প্যাকেট সিগারেট, ধনগোপালের সামনে রুপোর নস্যির ডিবে।
ইন্দ্রনাথ বললে, গল্পটা ছোট করে আনছি। এ বাড়িতে অভিশাপ লেগেছে। বৈকুণ্ঠ বরাটের শেষ বংশধর ধনগোপাল বরাট মরলেই বংশ ধ্বংস হবে। ওঁর স্ত্রী মারা গেছেন সেক্স ম্যানিয়াকের হাতে। ওঁর পুত্রবধূ মারা গেলেন–
বাঘের নখে, বললেন ধনগোপাল।
না। মসৃণ গলায় বলে গেল ইন্দ্রনাথ, একই সেক্স ম্যানিয়াকের হাতে।
পাগলের হাতেও অমন নখ থাকে না।
বানিয়ে নেওয়া যায়।
ম্যাজিকের মন্ত্র পড়ে?
এইভাবে, পকেট থেকে রুমালের পুঁটলি বের করে টেবিলে বিছিয়ে দিল ইন্দ্রনাথ। পাঁচটা ইঞ্চি দেড়েক লম্বা নরুণ। গায়ে সেলোটেপ জড়ানো।
ইন্দ্র বললে, পাঁচ আঙুলে সেলোটেপ দিয়ে বাঁধা হয়েছিল পাঁচটা খুদে নরুণ। শিবাজির বাঘনখ থেকে আইডিয়াটা ধার করেছিল হত্যাকারী–মেয়েদের নরম শরীর ফালাফালা করে উকট আনন্দ পাওয়ার জন্যে।
বুঝলাম, শেয়াল-চোখে ধূর্ততার ঝিলিক ঝলসিয়ে বললেন ধনগোপাল, মালগুলো পেলেন কোথায়?
আপনার পুত্রবধূ যে ঘরে খুন হয়েছে, সেই ঘরের সামনের বারান্দায় নীচের জঙ্গলে। খুন। করেই সে একটানে নরুণ পাঁচটা খুলে নিয়ে জঙ্গলে ফেলে দিয়েছিল–যেখানে কেউ খুঁজতে যাবে নাজানা না থাকলে চোখে পড়লেও মাথা ঘামাবে না। কিন্তু আমি জানতাম না–তাই খুঁজছিলাম।
নরুণ বাহিনী। মৃদু স্বরে বললেন ইকবাল হোসেন।
হ্যাঁ, বললে ইন্দ্রনাথ, আপনার মুখেই শুনেছি। পার্টির ছেলেরা নরুণ বাহিনী গড়েছে পুলিশি অ্যারেস্ট রোখবার জন্যে। যাক সে কথা। এ নরুণ যে চালিয়েছে, সে চাবুকও হাঁকড়েছে। বিদ্রোহিনীর বডিতে।
চাবুকটা পেয়েছেন?
ওই তো রয়েছে আলমারির মধ্যে…রক্ত লেগে রয়েছে…ফোরেনসিক সায়েন্স বলে দেবে, এ রক্ত বিদ্রোহিনীর।
কিন্তু সে রক্ত ঝরাল কে? ইকবালের প্রশ্ন।
সেক্স ম্যানিয়াক, নরম গলায় বললে বিলকুল। বলে তাকাল ধনগোপালের দিকে।
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন ধনগোপাল–শুয়ার কা…। গেট আউট। নেমকহারাম!
ধীরে-ধীরে, ধনগোপালবাবু, ভেলভেট কোমল গলায় বলে গেল ইন্দ্রনাথ, আপনি সেক্স ম্যানিয়াক নিঃসন্দেহে চাবুকের ভয় দেখিয়ে বিধবা পুত্রবধূকে উপভোগ করেছেন নিশ্চয় এই চাবুকের ভয়েই আপনার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পালিয়েছিলেন–এবং হয়তো তাকে চাবুক মারবেন বলেই বিলকুল আচারিয়াকে পাঠিয়েছিলেন তাঁকে পাকড়াও করে আনার জন্যে কিন্তু ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেল চোরে-চোরে মাসতুতো ভাইয়ের ব্যাপার বিলকুল আচারিয়া–টেবিল থেকে হাত সরান–
কিন্তু অনেক বেশি ক্ষিপ্র বিলকুল। মুখচোখের ভাব পালটাচ্ছিল একটু-একটু করে ইন্দ্রনাথের শেষ কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই চোখের তারায় অমানবিক নৃশংসতা বিচ্ছুরিত হয়েছিল–এখন বুঝি বিদ্যুতের চাইতেও বেশি গতিবেগে দু-মুঠোয় তুলে নিল সিগারেটের প্যাকেট আর নস্যির ডিবে– চেয়ার উলটে ফেলে দিয়ে পেছনে ছিটকে গিয়েই সিগারেট প্যাকেট ছুঁড়ে দিল ইন্দ্রনাথের দিকে– একই সঙ্গে নস্যির ডিবে নিক্ষিপ্ত হল ধনগোপালের দিকে।
হতচকিত ধনগোপাল চেয়ার ছেড়ে ওঠবার সময় পাননি–তাই নস্যির ডিবে ফাটল তাঁর মুখের ওপর–ভয়ানক বিস্ফোরণ–মুণ্ড উড়ে গেল ধড় থেকে।
সিগারেট প্যাকেটও ফাটল ইন্দ্রনাথের সামনে টেবিলের পাথরে। বিস্ফোরণের পর দেখা গেল, সাদা মর্মর প্রায় সাদা পাউডার হয়ে ঘরময় উড়ছে।
বিলকুল তখন বাইরে। ছুটছে। বারান্দা দিয়ে। দশহাত পেছনে ইন্দ্রনাথ আর ইকবাল। দুজনের হাতেই রিভলভার। গজরাল আগ্নেয়াস্ত্র–একইসঙ্গে ছিটকে পড়ে মসৃণ পাথরের মেঝে দিয়ে পিছলে গেল বিলকুল। তার দুটো মালাইচাকি গুঁড়িয়ে গেছে।
.
কবিতা বললে, বিলকুলকে কেন সন্দেহ করলে?
ওর পদবী শুনে আর অয়েল পেন্টিং দেখে।
পদবী তো আচারিয়া।
ওরফে আচার্য। মাধবেন্দ্র আচার্যর শেষ বংশধর।
ও মা!…আর অয়েল পেন্টিং?
জীনতত্ত্ব যেন তার প্রমাণ রেখে গেছে চোয়াল, চোখ, নাকে। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায়–বংশের ছাপ রয়েছে।
কিন্তু মাধবেন্দ্রর ছেলে ছিল তো জারজধমনীতে ছিল ইংরেজের রক্ত–তার বংশধরের চোয়াল, চোখ, নাক মাধবেন্দ্রর মতন হবে কেন?
প্লাস্টিক সার্জারির দৌলতে। প্রতিহিংসাপাগল বিলকুলের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল আইডিয়া। প্রথমে এসেছিল কটেজের গেস্ট হয়ে মাধবেন্দ্রর ফটো নেয় অয়েল পেন্টিং থেকে। যায় প্লাস্টিক সার্জনের কাছে–ফাঁসিতে লটকানো পূর্বপুরুষের আদল অর্জনের পরেই মাথাটা বিগড়োয় একেবারে। চাকরি নেয় ধনগোপালের কাছে তাকে নির্বংশ করবে বলে। করেছে। সেইসঙ্গে মিটিয়ে নিয়েছে। যৌনক্ষুধা। মৌমিতাকেও বাদ দেয়নি।
কিন্তু ইকবাল হোসেনকে ডেকে আনলে কেন?
কী মুশকিল! বড্ড লেটে বোঝ বউদি। নীল কপোত হোটেলে স্টাফ তো দেখেছিল নটগোপাল সহায়-কে। তাদের বর্ণনা থেকে স্কেচ আঁকিয়ে খুনির মুখের চেহারা দাঁড় করিয়েছিলেন দক্ষ অফিসার ইকবাল হোসেন। কিন্তু সে ছবি কাগজে ছাড়েননি খুনি হুঁশিয়ার হয়ে যাবে বলে। তবে থানায়-থানায় ফটো চলে গেছিল। আমি হাতিয়েছিলাম কৌতূহলকে বাগে রাখতে। নিয়ে গেছিলাম লাটনগরে। বিলকুলকে প্রথম দেখেই চিনেছিলাম–তারও হাইট ছফুট।
সিগারেট প্যাকেট আর নস্যির ডিবে অমনভাবে ফাটল কেন?
খুব সম্ভব আর ডি এক্স ছিল ভেতরে। এখনকার ছেলেরা যে বোমা ছোঁড়ে–তা পাট দিয়ে বাঁধা নয়–অবিকল সিগারেট প্যাকেট আনকোরা নতুন, নয়তো ম্যাচবক্স। নস্যির কৌটোয় বোমা বানিয়ে এনেছিল বিলকুল, অতীতের খুনের দৃশ্যটাকে আরও নারকীয়ভাবে দেখানোর জন্যে। ফাঁসির দড়িতে ঘাড় ভেঙেছিল মাধবেন্দ্র আচার্যর–বিলকুল আচার্যর বোমাবাজিতে উড়ে যেত বৈকুণ্ঠ বরাটের শেষ বংশধরের গোটা মুণ্ডটাই। হলও তাই।
বিলকুল বলেছে বুঝি?
সব। আরও বলেছে, এখন ওর মাথা ঠিক হয়ে গেছে–ছেড়ে দিলে আর মেয়ে খুন করবে না।
পাগল শিউরে উঠে বললে কবিতা।
* সানন্দা পত্রিকায় প্রকাশিত। (ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫)।