1 of 2

প্রেতিনী কন্যার কাহিনি

প্রেতিনী কন্যার কাহিনি

আপনি ভূত মানেন?

মানি।

তবে কেন বলছেন, পেতনি খুন করেনি আপনার নাতনিকে?

অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন জগদীশ গুপ্ত। ভদ্রলোক প্রায়-বৃদ্ধ। অথচ বেশ শক্ত সমর্থ। দাড়িগোঁফ ভালোই কামিয়েছেন। কিন্তু চুল আঁচড়াননি। একমাথা সাদা চুল পাখির বাসার মতো ছড়িয়ে রয়েছে মাথা ঘিরে। ফরসা তিনি কোনওকালেই নন। তার ওপর রোদে পুড়েছেন সারাটা জীবন। খদ্দরের ধুতি আর পাঞ্জাবিও লাট খাওয়া। পাঞ্জাবির বোম থেকে কালো কার বেরিয়ে ঢুকে রয়েছে চোরা-পকেটে। নেহাতই সেকেলে মানুষ। এখনও পকেটঘড়ির অভ্যেস ছাড়তে পারেননি।

ইন্দ্রনাথ রুদ্রর বসবার ঘরে বসে অনেক অদ্ভুত কাহিনি শুনেছি। অনেক রোমাঞ্চর স্বাদ পেয়েছি। কিন্তু যে কাহিনিটা আজ বলতে বসেছি তা লিখতে গিয়েও আমার গা শিরশির করছে।

চোখ কুঁচকে জগদীশবাবুর দিকে চেয়ে আছে ইন্দ্রনাথ। আমি বসেছি ওর পাশে। সকালে এইখানেই আমার আড়া। সেই আড্ডায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছেন জগদীশ গুপ্ত।

এসেই জানিয়েছেন, তাঁর একমাত্র নাতনিকে পাথর দিয়ে পিটিয়ে মেরেছে একটা পেতনি। তিনি বিপত্নীক। তেল-সাবান কারখানার মালিক। স্বদেশি জিনিস প্রচার করার আদর্শ সামনে রেখে ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। এখন তার ভেষজ সাবান ভারতের পয়লা সারির সাবান। পয়সা কামিয়েছেন অনেক। দানধ্যানও করেছেন প্রচুর। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন কারখানারই ম্যানেজারের সঙ্গে। প্লেন অ্যাকসিডেন্টে একই সঙ্গে মারা গেছে তার স্ত্রী, মেয়ে আর জামাই। নাতনি ছাড়া দুনিয়ায় কেউ ছিল না। মাত্র ষোলো বছর বয়স তার। বড় দুরন্ত। মা ছাড়া কি বাচ্চা মানুষ করা যায়? নাতনিকে নিয়েও তিনি হিমশিম খেয়েছেন। মেয়ে বলে কথা। মা বেঁচে থাকলে তাকে চোখে-চোখে রাখতে পারত। জগদীশবাবু তা পারেননি। ভূতের বাড়িতে অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়েই সেই নাতনিই প্রাণ দিয়েছে। একটা ফরাসি পেতনি পাথর দিয়ে পিটিয়ে তার খুলি ভেঙে দিয়েছে।

ভূতের বাড়িটা চন্দননগরে। তিনশো বছর ধরে হানাবাড়ি হিসেবে কুখ্যাত হয়ে রয়েছে।

তিনশো বছরের হানাবাড়ি? কৌতূহলী হয়েছিল ইন্দ্রনাথ।

জগদীশবাবু তখন শুনিয়েছিলেন গা-ছমছমে সেই কাহিনি। অবিশ্বাস্য অথচ সত্য।

ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভারতে এসেছিল ফরাসিরা। চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বকালে গড়ে ওঠে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কুঠি বসায় চন্দননগরে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে। তার কবছর পরেই গঙ্গার ধারে গড়ে ওঠে সন্ন্যাসীদের একটা মঠ। পুরুতমশায়ের দোতলা বাড়িও ছিল এই মঠের এলাকায়।

এই বাড়িই এখন ভূতের বাড়ি দুর্নাম কিনেছে দেশ-বিদেশে। এসেছেন অনেক ভূত-শিকারি। তারাও হতভম্ব হয়েছেন।

বাড়িটা কদাকার। লাল ইট দিয়ে তৈরি। জানলাগুলো লম্বাটে আর সরু। আলো ঢুকতেও যেন ভয় পায়। সবসময়ে যেন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে সামনের নোংরা লনের দিকে। এ লনে গাছের চাইতে বেশি আছে আগাছা। বড়-বড় ঘাস। কাটাঝোঁপ।

তিনশো বছর বয়েসেও বাড়িটায় চিড় খায়নি–একখানা ইটও খসে পড়েনি। তবে ছাতলা লেগেছে সারা গায়ে। কখনও সবুজ, কখনও কালচে। পেটাই ছাদ নেই। আছে ঢালু টালির চাল। এককালে লাল ছিল এই টালি–এখন তা বহুবর্ণ।

লনের তিনদিকে বড়-বড় ঝুপসি গাছ। বটগাছই বেশি। মোটা ডাল লতিয়ে থাকে মাটির ওপর। বটের ঝুরি বাড়তে বাড়তে পুরো জায়গাটাকে দুর্গম করে তুলেছে।

গঙ্গার দিকেও রয়েছে বড়-বড় গাছ। এই গাছের সারির জন্যেই গঙ্গার বুক থেকে দেখা যায় না হানাবাড়িকে। চোখে পড়ে শুধু একটা জঘন্য জঙ্গল। রাতে সেখানে জোনাকি জ্বলে। পুরো জায়গাটাকে আরও ভয়াবহ মনে হয়।

তল্লাটের সব্বাই জানে, এ বাড়িতে ভূত আছে। তাদের আবির্ভাব বিশেষ একটা লোমহর্ষক ঘটনার পর থেকেই। তিনশো বছর ধরে ঘটনাটা মুখে-মুখে টিকে রয়েছে। বীভৎস কাহিনি। সে ঘটনা না ঘটলে এ বাড়ি নাকি প্রেতপুরী হত না।

এ জন্যে দায়ী তিনশো বছর আগের ধর্মান্ধ কিছু মানুষ। জাতে তারা ফরাসি। ধর্মে খ্রিস্টান। ভারতের মাটিতে উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার জন্যে তাদের অনেকেই ছিল আদিম বর্বর। তাদের এই পৈশাচিকতাই নাকি নিঃশব্দ প্রতিবাদ তুলেছে প্রেতলোকে। আজও তাই রক্ত-জল করা ঘটনার পর ঘটনা চলেছে এই নির্জন নিকুঞ্জে।

মঠে ছিল সন্ন্যাসিনীদেরও আস্তানা। ফ্রান্সের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় মব্লা, যেখানে ইতালির সঙ্গে সীমান্ত রচনা করেছে, দুর্গম সেই পাহাড়ি অঞ্চলের একটি মেয়ে ছিল মঠে। গঙ্গার রূপ দেখত সে সকাল-সন্ধে, ১৫,৭৮১ ফুট উঁচু মব্লাঁ-র রূপও ভাসত চোখের সামনে। বিশাল পাহাড় আর বিরাট নদী নিশ্চয় আকুল করেছিল তার অন্তর। বড় বেশি নিঃসঙ্গ মনে হয়েছিল নিজেকে।

প্রকৃতির হাতছানি যখন প্রবল হয়ে ওঠে মনের মণিকোঠায়, তখন কিন্তু শিথিল হয়ে পড়ে নিয়মের নিগড়।

রূপসী, তরুণী, একাকিনী এই সন্ন্যাসিনীর অন্তরে প্রেমের তুফান রচিত হয়েছিল তখন থেকেই। মনের দিক দিয়ে একাকিনী। তাই অন্বেষণ করেছিল মনের মতো দোসর।

পেয়েও ছিল।

মঠেরই এক সন্ন্যাসীকে।

প্রথমে মিটেছিল চোখের তৃষ্ণা। দূর থেকে দুজনে দুজনকে দেখে মিটিয়েছিল হৃদয়ের আশ। মন কিন্তু ইন্ধন জুগিয়ে গেছিল শরীরকে। তিল তিল করে কামনা সঞ্চিত হয়েছিল প্রতিটি রক্তবিন্দুতে। লোমকূপের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমেছিল বারুদ শরীরী-তৃষ্ণার বিস্ফোরক। দেহমিলনেই যার পরিসমাপ্তি– আর কিছুতে নয়।

তাই একদিন দেখা গেছিল অভাবনীয় সেই দৃশ্য। তামাটে রঙের দুটি ঘোড়া পবনবেগে টেনে নিয়ে চলেছে একটা শকটকে। মাথায় ছাদ নেই। লাগাম ধরে বসে আছে তরুণ সন্ন্যাসী। হাওয়ায় উড়ছে তার লম্বা সোনালি চুল। পাশে বসে মুক্তির আনন্দে ঝকমকে চোখে শেষবারের মতো মঠ দেখবে সন্ন্যাসিনী। ফ্রান্সে তাদের একজনের জন্ম ইতালির সীমান্তে, আরেকজনের স্পেনের সীমান্তে। পাহাড় আছে দু-জায়গাতেই। গঙ্গা খুঁচিয়ে জাগিয়ে দিয়েছে পাহাড়ের আহ্বানকে।

আচমকা মুখ শুকিয়ে গেল মেয়েটির। অশ্ব নীরবে চলতে শেখেনি–বিশেষ করে ছোটবার সময়ে। যুগল অশ্বের খুরধ্বনিতে মুখর হয়েছিল নির্জন বন। সেই সঙ্গে চাকার ঘড়ঘড় আওয়াজ। মঠের মানুষরা তো সচকিত হবেই।

তাই তারা বেরিয়ে এসেছে দলে-দলে। তাদেরও বাহনের অভাব নেই। ধেয়ে আসছে দুই পলাতককে পাকড়াও করবে বলে।

ধরা পড়েছিল তিনশো বছর আগের সেই রোমিও আর জুলিয়েট। প্রেমের পূতশিখায় জীবন উজ্জ্বলতর করে নেবে ভেবেছিল তারা। কিন্তু তা হল না। বিচার হয়ে গেল দুজনের। শাস্তি একটাই। মৃত্যু।

লনের একটা গাছ থেকে দড়ি ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হল তরুণ সন্ন্যাসীকে।

নির্মমতম মৃত্যুর স্বাদ দেওয়া হল তরুণীকে।

জীবন্ত কবর দেওয়া হল মঠেরই দেওয়ালে–দাঁড়ানো অবস্থায়।

সেই মঠ এখন পরিত্যক্ত। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাদেরকে যমালয়ে পাঠানো হয়েছে সূক্ষ্ম শরীরে আজও তারা টহল দিচ্ছে মঠের সর্বত্র। আজও দেখতে পাওয়া যায়, গাছতলা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বিষণ্ণবদনা এক নারীমূর্তি। হাওয়ায় উড়ছে তার শ্বেতবসন, উড়ছে স্বর্ণকেশ। মুখ তার ফ্যাকাসে, চক্ষু নিবদ্ধ পথের দিকে।

দেখা যায় ঘোড়া দুটিকেও। গায়ের রং তাদের ঘোর তামাটে। বায়ুবেগে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে সেকেলে শকট। মঠের বাগানেই তার আবির্ভাব ঘটে, মিলিয়ে যায় সেখানেই।

ষোলো শতক থেকেই নাকি চলছে এই কাণ্ড। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সবকটা ফরাসি উপনিবেশ ইংরেজদের অধিকারে চলে যায়। ফিরে পায় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা চুক্তির শর্ত অনুসারে।

অশরীরীরা কিন্তু থেকে যায় এই সময়েও। পার্থিব সম্পত্তির হাত বদলে তারা নির্বিকার। অপার্থিব আকৃতি নিয়ে মঠকে দখলে রেখে দিয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।

প্রেতলোকের বাসিন্দাদের সঙ্গে সহাবস্থান সম্ভব হয়নি মঠের মানুষদের। যদিও বিদেহীরা কক্ষনও কারও ক্ষতি করেনি–শুধু বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার। দেখা গেছে, দু-হাত বাড়িয়ে সাদা পোশাক পরা দুটি মূর্তি পায়ে-পায়ে এগোচ্ছে পরস্পরকে বুকে টেনে নেবে বলে– কিন্তু মিলিয়ে যাচ্ছে মুখোমুখি হয়েই।

দিনের-পর-দিন, রাতের-পর-রাত এ দৃশ্য কি দেখা যায়? চম্পট দিয়েছে মঠের সবাই।

বনাকীর্ণ হানাবাড়ি নিয়ে কেউ আর তেমন মাথা ঘামায়নি। বাঙলার মানুষ বাঘ আর ভূতের সঙ্গে ঘর করে অভ্যস্ত। সাপ আর মশা তাদের গা-সওয়া।

সাড়া পড়ে গেল কিন্তু ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে। তখনও চন্দননগর ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে আসেনি–এসেছিল ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে। ভারতের মাটিতে ফরাসি উপনিবেশ দেখতে ছুটে আসত সাহেব-মেমরা। পণ্ডিচেরি আর কারিক, মাহে আর ইয়ানাম তাদের বুকে যত না স্পন্দন জাগিয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি উত্তাল করেছে হুগলি জেলার এই চন্দননগর।

কারণ এখানে রয়েছে একটা ভূতের বাড়ি। সত্যি ভূতের বাড়ি। ফরাসি বর্বরতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে বিদেহীরা। কখনও মানুষের চেহারায়, কখনও ঘোড়ার চেহারায়।

পর্যটকরা চাঞ্চল্যকর সংবাদটা পৌঁছে দেয় লন্ডন শহরে। লুফে নেয় ডেলি মিরর দৈনিক পত্রিকা। হেডলাইন দিয়ে ছেপে দেয় চন্দননগরে হানাবাড়ির লোমহর্ষক সমাচার আর তিনশো বছর আগেকার ফরাসি বর্বরতার মুখরোচক কাহিনি।

খবরটা পড়েই লম্ফ দিয়ে ভারতে ছুটে আসেন বিখ্যাত ভূত-শিকারি এডগার লুসি। ভূতের বাড়ির খবর পেলেই ভদ্রলোক ছুটে যেতেন। সত্যি ভূত হলে তাদের রিপোর্ট লিখে বই ছেপে ফেলতেন। মিথ্যে ভূত হলে তাদের জালিয়াতি ধরিয়ে দিতেন।

ভূত-শিকার ছিল তার নেশা। নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পেশা। ভূত ধরার কাহিনি কে না পড়তে চায়। বই বিক্রি হত দেদার। রোজগার হচ্ছিল ভালোই।

ব্রিটিশ ভারতে ফরাসি উপনিবেশে কায়াহীনরা গাট হয়ে বসে রয়েছে শুনেই তিনি জাহাজের খরচ পকেট থেকে বের করেছিলেন।

এসে দেখেছিলেন হানাবাড়ির দুর্নাম ঘোচানোর জন্যে এক পাদরি সেখানে বসবাস শুরু করেছেন। নাম তার রেভারেন্ড অ্যান্টনি গোমেজ। স্বামী-স্ত্রী থাকেন। বাচ্চাকাচ্চা নেই। ভয়ডরও কম।

ভূত আছে কি? ঘোড়া ভূত?

ভূত-শিকারির প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন পাদরি সাহেব–বিলক্ষণ আছে। একটু-আধটু উপদ্রব করে বটে। কিন্তু অনিষ্ট তো করে না। একসঙ্গে আছি বেশ।

উপদ্রবগুলো কীরকম?

পাদরি সাহেব তখন সব লিখে দিয়েছিলেন। সেই লেখা বগলে নিয়ে ভূত-শিকারি ফিরেছিলেন। লন্ডনে। প্রতিবেদন বেরিয়ে গেছিল ডেলি মিরর পত্রিকায়।

অদ্ভুত কাণ্ডকারখানাগুলো কী ধরনের?

তালা ঝুলছে ঘরের বাইরে থেকে। অথচ আলো জ্বলে ওঠে ঘরের মধ্যে। সেই আলো নড়েচড়ে বেড়ায়। লণ্ঠন নিয়ে কেউ বা কারা যেন ঘরে পায়চারি করছে।

পায়চারি করছে? পায়ের আওয়াজ শোনা যায় না?

নিশ্চয় যায়। পা ঘষটানির আওয়াজ। পা যেন চলতে চাইছে না। ক্লান্ত চরণ। তবুও হাঁটতে হচ্ছে পায়ের মালিক বা মালকিনকে। দুলছে লণ্ঠনের আলো।

ঘোড়ার গাড়ি? সত্যি দেখা গেছে?

স্বচক্ষে দেখেছে বাড়ির ঝি। লনের ওপর দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে গেছে অশ্বশকট। তারার আলোয় স্পষ্ট বোঝা গেছে গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুটি ঘোড়া। সওয়ার দুজন পাশাপাশি বসে। দুজনেরই গায়ে সাদা পোশাক। বাগান পেরিয়ে ফটক পর্যন্ত গিয়েই আচমকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ছায়াবাজি।

ছায়াবাজি? চোখের ধাঁধা নয়তো? অথবা ধোঁকাবাজি? ম্যাজিক লণ্ঠনের কারসাজি?

তাহলে ফিসফিস করে কারা অত কথা বলে ঘরে-ঘরে? তালাবন্ধ ঘরে কে তাদের ঢুকতে দিয়েছে? শোনা যায় পুরুষকণ্ঠে বিড়বিড় বকুনিনারীকণ্ঠের চাপা কান্না।

নারীকণ্ঠ? দেখা দেয়নি সেই রমণী?

অবশ্য দিয়েছে। বহুবার দিয়েছে।

গোটা তল্লাট জুড়ে তখন খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছিলেন ভূত-শিকারি। এ ব্যাপারে ভদ্রলোক শার্লক হোমসের কায়দায় ডিটেকটিভগিরি করেন। জোচ্চুরি ফঁস করতে গেলে গোয়েন্দাগিরির মুন্সিয়ানা তো দরকার। জনে-জনে জিগ্যেস করে একটা ব্যাপারে তার বেজায় খটকা লেগেছিল।

যে বাড়িতে এখন ভূতের খেলা চলছে, সন্ন্যাসীদের মঠ আদৌ সেখানে ছিল কিনা–এই একটি ব্যাপারে তো কেউ দিব্যি গেলে কথা দিতে পারছে না। তিনশো বছর আগের ব্যাপার। কেউ বলে, মঠের পুরুত থাকতেন এই হানাবাড়িতে। কেউ বলেন সন্ন্যাসীদের থাকার জায়গাও ছিল এই বাড়ি।

সন্ন্যাসিনীদের আস্তানা? থাকার কথা তো এই মঠের এলাকাতেই। কিন্তু সেরকম কোনও ডেরা দেখতে পেলেন না এডগার লুসি। তবে কি সবটাই কপোলকল্পনা? গ্রাম্য উপকথা?

সন্ন্যাসিনী-প্রেতিনীর সম্ভাবনা তাই উড়িয়ে দিলেন ভূত-শিকারি। গোয়েন্দারা তাই করেন। যার প্রমাণ নেই–তা খারিজ করেন।

কিন্তু তামাটে ঘোড়ায় টানা সেই গাড়িটাকে তো দেখা গেছে বারবার। পনেরো শতকের আগে ঘোড়ায় টানা গাড়ির আবির্ভাব ঘটেনি খাস লন্ডন শহরেও। কিন্তু ষোড়শ শতকে সেই গাড়ি যদি চন্দননগরের ফরাসি মঠে দেখা যায়, তাহলে তো গ্রামের মানুষদের মনে দাগ কেটে যাবেই। বানিয়ে নেওয়াও সম্ভব নয়। না দেখলে বলতে যাবে কেন?

তবে হ্যাঁ, সন্ন্যাসিনীরা যত বেয়াদপিই করুক, জ্যান্ত গোর দেওয়ার নজির তো গোটা ইউরোপে কখনও দেখা যায়নি। ইউরোপীয়রা এত বর্বর নয়। এরকম বর্বর ছিল নাকি মোগল পাঠান সুলতান নবাব-বাদশারা। কোমলপ্রাণ পাদরি সাহেব মঠের মেয়েকে মঠের দেওয়ালেই দাঁড় করিয়ে ইট গেঁথে কবর দেবেন–এমন পৈশাচিকতা কল্পনাও করা যায় না।

ভৌতিক কাহিনির এই অংশটুকুও স্রেফ মনগড়া–এই সিদ্ধান্তেই এলেন ভূত-শিকারি সাহেব প্রাথমিক তদন্তের পর।

বেশ, বেশ, গোর দেওয়ার ব্যাপারটা না হয় শোনা কথা। চোখে তো কেউ দেখেনি। রং চড়ানো রটনা হলেও হতে পারে।

কিন্তু বিদেশিনী প্রেতিনীকে তো দেখা গেছে। বহুবার বহু জায়গায়। কখনও লনে, কখনও বাগান, কখনও ঝোঁপের বর্ডার দেওয়া পথে। শুধু রাতে নয়–দিনের আলোতেও।

দিনের আলোয়? সুক্ষ্মশরীরীর পক্ষে তো কায়াগ্রহণ সম্ভব নয়। একটোপ্লাজম জোগাড় করবে কী করে? আলোকতরঙ্গের ধাক্কায় তো শরীরী হওয়া যায় না।

নিছক গল্পকথা নিশ্চয়। তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিলেন ভূত-শিকারি ইংরেজ।

আর তারপরেই শুরু হল তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। প্রেতলোক যেন এই কদিন তর্কে তক্কে ছিল–তার হাস্যকর অনুসন্ধান-পর্বের ইতি হওয়ার প্রতীক্ষায় ছিল। অবিশ্বাসের হাসি হেসে সব বুজরুকি–এই রিপোর্ট যেদিন লিখলেন, তার পরের দিন থেকেই শুরু হয়ে গেল হানাবাড়ির হট্টগোল।

এবার আরও বেশিমাত্রায়। যেন তাকে তুমুল অভ্যর্থনা জানাতে কোমর বেঁধে লেগেছে সাহেব ভূতপেতনীরা। হাজার হোক, একই মহাদেশের মানুষ তো। এত দূর থেকে, এত পয়সা খরচ করে এসে খালি হাতে ফিরে যাবেন?

গেঁইয়াদের গল্প–এইরকম একটা শিরোনামও লিখেছিলেন লুসিসাহেব তার ডাইরিতে। লিখেছেন রাত্রে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে। সকালে উঠে নাস্তা সেরে ফের কলম বুলোতে গেছিলেন ডাইরিতে।

চক্ষুস্থির হয়েছে তখনি।

গেঁইয়াদের গল্প–এই হেডলাইনটাই নেই। ডাইরির যেখানে লিখেছিলেন সেখানটা বিলকুল সাদা। কস্মিনকালেও যেন সেখানে কলমের আঁচড় পড়েনি। ম্যাজিক কালি দিয়ে লিখতেও তো নিব চেপে বসার দাগ থাকবে। তাও নেই। ম্যাজিক কালির প্রশ্ন অবশ্য ওঠে না। একই দোয়াতের কালি দিয়ে বাকি অংশটা লিখেছেন–তা যেমন তেমনই রয়েছে।

নেই শুধু গেঁইয়াদের গল্প শিরোনামটা!

তাজ্জব কাণ্ড! গালে হাত দিয়ে বসে রইলেন ভূত-শিকারি ইংরেজ। কায়াহীন বড় রসিক তো! হেডলাইনটাকেই উড়িয়ে দিয়েছে।

উপদ্রব শুরু হল সেইদিনই সন্ধে থেকে। উপদ্রবের পর উপদ্রব। উৎসব শুরু হয়ে গেছে যেন অতিপ্রাকৃত দুনিয়ায় অসম্ভব কাণ্ড ঘটাতে লেগেছে কোমর বেঁধে।

দোতলার ঘরে বসেছিলেন ভূত-শিকারি। বড় ঘর। এক কথায়, হলঘর। আড্ডা মারবার জন্যে তৈরি। খানদানি সাহেববাড়ি আর জমিদারবাড়িতে এই ধরনের বড়-বড় ঘর দেখা যায়। বিলাসী জমিদারবাবুরা নাচঘর বানাতেন এই কায়দায়। গোটা ঘর মোড়া থাকত দামি কাশ্মিরী কার্পেটে।

সেসব দিন গেছে। চন্দননগরের এই ফরাসি যাজক বোধহয় সেই বাবুয়ানির রেশ টেনে আনতে চেয়েছিলেন বিশাল এই ঘরখানায়। গাঁয়ের লোকদের মুখে কানাঘুষোয় অনেক গল্পকথাও শুনে এসেছেন ভূতশিকারি। ষোড়শ শতকের পাদরির কিঞ্চিৎ নারীঘটিত দোষ ছিল। মঠের মেয়েদের মাঝেমাঝে এই ঘরে নিয়ে আসতেন। যে মেয়েটি অশরীরী হয়ে আজও টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে, তাকেও কবজা করতে চেয়েছিলেন। রূপে সে ছিল তিলোত্তমা, স্বভাবে সরস্বতী। যাজকের কামনার ইন্ধন জোগাতে মন চায়নি। প্রেমের আগুনেই পুড়ে মরেছে। মঠেরই সন্ন্যাসীকে নিয়ে চম্পট দেওয়ার চেষ্টায় শাস্তি হয়েছে ভয়াবহ। কুটিল পাদরি একটা দৃষ্টান্ত খাড়া করতে চেয়েছিলেন। ভবিষ্যতে কেউ যেন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়ার দুঃসাহস না দেখায়।

বিরাট এই ঘরেই রেভারেন্ড অ্যান্টনি গোমেজের সঙ্গে বসেছিলেন এডগার লুসি। ছিলেন মায়া গোমেজরেভারেন্ডের সাতপাকে বাঁধা বউ। হিন্দুমতে বিয়ে। মায়া চন্দননগরের সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের মেয়ে। ভয়ানক রূপসী। রং যেন ফেটে পড়ছে। চোখে যেন বিদ্যুৎ জ্বলছে–রেগে গেলে মনে হয় মা দুর্গা মহিষমর্দিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণা হতে চলেছেন।

মায়া বিদূষী মেয়ে সুবর্ণবণিক মেয়েদের মতো লবঙ্গলতিকা নয়। পড়াশুনা শেষ করেছিল কনভেন্টে। তারপর রেভারেন্ডের টানটান বপু, মিষ্টি-মিষ্টি হাসি আর চোখাচোখা বুলি শুনে তাকেই বিয়ে করে ফেলে। সাতগেঁইয়া নিষেধের তোয়াক্কা রাখেনি।

লুসির সঙ্গে খোশগল্প চালিয়ে যাচ্ছে এই মায়া। ঘরে জ্বলছে তেলের প্রদীপ আর মোমবাতি। ১৯২৯ সালেও এই হানাবাড়িতে বিদ্যুতের লাইন আনাননি রেভারেন্ড। মায়া-ই আনতে দেয়নি। বাড়িটার সাবেকিয়ানা তাহলে যে গোল্লায় যাবে। এ বাড়িতে থাকার মাধুর্যই যে নিষ্প্রদীপের রোমাঞ্চ!

 বোগাস! বলেছিলেন লুসি। এইরকম একটা বুড়ো বাড়ি আর বাগানকে যদি আলো অন্ধকারের ছায়ামায়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়, তাহলে গা ছমছম করবে আপনা হতেই বিদেহিনীকে কষ্ট করে প্রেতলোক থেকে জার্নি করতে হবে না।

কথাটা সবে বলেছেন লুসি সাহেব বলেই হো-হো করে অবশ্য হেসেছিলেন–এমন সময়ে ঘটল সেই কাণ্ড।

পেল্লায় একটা শামাদান হেলেদুলে বাতাসে ভাসতে ভাসতে দরজা দিয়ে ঢুকল ঘরে।

দেখেই আতীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠেছিল বেনের মেয়ে মায়া, এ কী ম্যাডাম! আমার বাবার দেওয়া বিয়ের জিনিস! এই নিয়ে এ কী ইয়ার্কি!

শামাদানটা বিলকুল বেলজিয়ান কাঁচ দিয়ে তৈরি। লম্বা স্ট্যান্ডের ওপর পাঁচখানা মোমবাতি বসানো যায়। চিলেকোঠার ঘরে ঠাকুরঘর বানিয়ে মায়া এই দীপাধার রেখে দিয়েছিল সেখানে। বিলিতি পন্থায় পঞ্চপ্রদীপের আরতি করবার জন্যে।

আশ্চর্য সুন্দর গুরুভার সেই বাতিদানই বাতাসে ভেসে এসে ঢুকল হলঘরে।

দমাস করে আছড়ে পড়ল লুসির পায়ের কাছে।

বলা বাহুল্য, ওইরকম একটা আছাড় খাওয়ার পর কাঁচের শামাদান আর আস্ত থাকতে পারে না। খানখান হবেই। প্রায় ডুকরে কেঁদে উঠেছিল মায়া মল্লিক, থুড়ি, গোমেজ।

তড়াক করে সটান দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন ভূত-শিকারি ইংরেজ মহাশয়। এসব ভেলকি তিনি অনেক দেখেছেন। কিছু ভূত অবশ্য বিশেষ এই ক্ষমতার অধিকারী হয় বটে, কিন্তু চন্দননগরের মতো নেটিভ জায়গায় এহেন ভৌতিক ক্রীড়া আশা করা যায় না।

অতএব তিনি স্বজাতীয় ভাষায় তীব্র কণ্ঠে জানতে চাইলেন–এইসব গাড়োয়ানি ফচকেমির মানেটা কি?

বলেই, তার খেয়াল হয়েছিল তিনি বসে আছেন ফরাসি মঠে। এখানকার জড়পদার্থের অণু পরমাণুতেও ফরাসিয়ানা বিধৃত রয়েছে।

সুতরাং গমক মারা যাক ফরাসি ভাষায়। তাই করেছিলেন।

পরিণামটা হল আরও ভয়ানক।

রাশি-রাশি নুড়ি উড়ে এল দরজা দিয়ে কড়াংকড়াং দুমদাম ঠকঠকাস করে আছড়ে পড়ল লুসি সাহেবের পায়ের কাছে। কখনও একটা, কখনও একাধিক শূন্যপথে ধেয়ে এসেই পড়ছে। সাহেবের সামনে।

চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল সাহেবের। এ নুড়ি তিনি চেনেন। বাগানের পথে রয়েছে বিস্তর।

আচম্বিতে বন্ধ হয়ে গেল নুড়ির স্রোত। লুসি সাহেব তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ পাকিয়ে চেয়ে আছেন দরজার দিকে। লম্বায় তিনি প্রায় সাড়ে ছফুট। বাঁশের মতো শক্ত সিধে শিরদাঁড়া। লম্বা নাকের নিচে গোঁফজোড়া ঝোঁপের মতো এলোমেলো করে রাখেন ইচ্ছে করে বুজরুকরা দেখলেই যাতে ভয় পায়।

সেই গোঁফ এখন খাড়া হওয়ার উপক্রম হল বিদেহীদের পরবর্তী বিটলেমি দেখে।

বাগানের কুয়োর ধারে পাড়ে পড়ে থাকে বিস্তর ভাঙা ইট আর পাথর। বেশ কয়েকটা আধলা নিশ্চয় সাড়া দিয়েছে কায়াহীনদের আহ্বানে। শ্যাওলামাখা নোংরা আধলাগুলো সগৌরবে দরজা দিয়ে ধেয়ে এসে দমাদম করে আছড়ে পড়ল সাহেবের পদতলে।

বাকরহিত হয়ে গেছেন এখন তিনজনেই। সাহেব প্রত্যক্ষ করছেন অবিশ্বাস্য দৃশ্য–রেভারেন্ড গোমেজ এবং তদীয় স্ত্রী অবলোকন করছেন শিষ্ট ভূতপ্রেতের অশিষ্ট আচরণ। তারা বিলক্ষণ বিক্ষুব্ধ। অতিথি আপ্যায়নে এহেন ত্রুটি বরদাস্ত করা যায় না।

কিন্তু ভূতপ্রেতের দল কি সহসা ক্ষিপ্ত হয়েছে? মস্তিষ্ক কি তাদের উত্তপ্ত হয়েছে? এত কাণ্ডের পরেও কি তাদের কি ক্ষ্যামা দেওয়া উচিত ছিল না? ঢের হয়েছে–এই বলে রঙ্গ বন্ধ করা উচিত ছিল না?

তা না করে, তারা এবার গাছের শুকনো পাতা বাগান থেকে এনে উড়িয়ে দিয়েছে ঘরময়।

ঘরে হাওয়া নেই। শীতের সন্ধে। জানলা বন্ধ। অথচ যেন হাওয়া ঘূর্ণিপাক রচনা করে চলেছে বিশাল হলঘরে। ঘুরে-ঘুরে নাচের ছন্দে উড়ছে ঝরাপাতার দল।

ক্লাইমাক্সটা ঘটল তারপরেই। নাটকীয় সেন্স না থাকলে এমন চরম কাণ্ড ঘটানো যায় না।

ঢং-ঢং-ঢং-ঢং করে বেজে উঠল একতলার দরজা-ঘণ্টা। সাবেকি বাড়ির সব হালচালই বজায় রেখেছিল বেনের মেয়ে মায়া। সদর দরজায় অতিথি-ঘণ্টা বাজালে অদ্ভুত আভিজাত্যে বাড়ি গমগম করে ওঠে।

সেই ঘণ্টাই এখন বাজছে অশরীরীদের হাতে। মাংসহীন অস্থিহীন করপল্লবে ঘণ্টার দড়ি ধরে বোধহয় ফরাসিনী প্রেতিনী হ্যাঁচকা টান মারতে মারতে নাটকীয়ভাবে জানান দিয়ে যাচ্ছে তার অস্তিত্বের, আমি আছি! আমরা আছি। ও সাহেব লিখে রাখো আমরা ছিলাম, আছি, থাকব!

এই জাতীয় বেল্লিকপনা কোনও সাহেব ভদ্রলোক সইতে পারে? সকালে উঠে খটকা লেগেছিল ডাইরির পাতা থেকে হেডলাইন অদৃশ্য হওয়া দেখে সন্ধে হতেই হানা দিল অদৃশ্য কারিগররা? এইভাবে?

সেই রাতেই তন্নতন্ন করে অভিযান চালালেন লুসিসাহেব। নিচের দরজা বন্ধ ছিল ভেতর থেকে–নেমে নিয়ে দেখলেন বন্ধ রয়েছে তখনও। ঝি-চাকররা কেউ রাত কাটায় না এ বাড়িতে হাজার বখশিস দিলেও। বাড়িখানাও এককালে মঠবাড়ি ছিল বলে এমন কায়দায় নির্মিত যে, সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেলে বাড়িতে প্রবেশের আর কোনও পথ থাকে না।

তা সত্ত্বেও বাগানের পাথর আর নুড়ি, কুয়োর ইট আর পাথর, গাছতলার ঝরাপাতা তারা বোধহয় ঝুড়ি ভরতি করে দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে কি এক অলৌকিক পন্থায় পাচার করেছে বাড়ির ভেতরে।

তদন্ত সম্পন্ন হল রাতেই। আর কোনও নাটক দেখায়নি বিদেহীরা। বোধহয় সারারাত হেসেই কুটিপাটি হয়েছে।

পরের দিন পিঠটান দিলেন এডগার লুসি। খিদিরপুরে গিয়ে জাহাজে চেপে লন্ডন। লন্ডনে পৌঁছেই লম্বা কাহিনি ছাপিয়ে দিলেন ডেলি মিরর কাগজে। হইহই পড়ে গেল গোটা কন্টিনেন্টে এবং এই উপমহাদেশেও। ভূত-শিকারির বিশ্বাস জেগেছে যে হানাবাড়িতে রাত্রিবাস করে সে বাড়ি তো একবার দেখে আসা দরকার।

হুজুগে মানুষের অভাব কোনও দেশেই নেই। বিলেত-আমেরিকার মানুষ দলে-দলে তো এলই–এল ভারতের নানান অঞ্চলের মানুষও। বেশি এল কলকাতার মানুষ। হুজুগের চাটনি ছাড়া যাদের ভাত হজম হয় না।

ফলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়াল মায়া আর রেভারেন্ডের। নির্জনে রোমান্স আর রোমাঞ্চর ডবল লাভের আশাতেই ঘর বেঁধেছিলেন তারা এই পোড়োবাড়িতে। দিনগুলো যাচ্ছিল ভালোই। সূক্ষ্মশরীরীরা ঈর্ষায় জ্বলে গেলেও স্থূলশরীরী দুজনের পাকাধানে মই দেয়নি এতদিন। এখনও দিল না। তবুও বাড়ি ছেড়ে সরে পড়তে হল গোমেজ দম্পতিকে। ভূতের উৎপাতে নয় দর্শনার্থীদের উপদ্রবে। দিবারাত্র খালি লোক আর লোক। বাগানে লোক, বাগানের বাইরে লোক, ঘরে লোক। ঘণ্টা বাজছে যখন-তখন। পিলপিল করে আসছে উৎসুক মানুষ–চন্দননগরের সস্তা সুপেয় পানীয় পান করছে এবং ঢংঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে দেখছে–বিদেহীদের হাতে কতখানি শক্তি থাকলে তবে এই ভারি পেতলের ঘণ্টার কণ্ঠা নাড়ানো যায়।

তাই পালিয়ে গেলেন রেভারেন্ড দম্পতি। লুসিসাহেব যেদিন কাষ্ঠ হেসে বিদায় নিলেন, ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে, বাড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে, বিদেহীদের উদ্দেশে টা-টা, অ-রিভয়ের, অ্যাডিউ বলে গেলেন তার একমাস পরেই ছলছল চোখে মায়াও খ্রিস্টান স্বামীর হাত ধরে চলে এল শ্রীরামপুরে।

তারপর কেটে গেছে আঠারোটা মাস। পরিত্যক্ত থেকেছে পোড়োবাড়ি।

১৯৩১-এর নভেম্বরে আর এক কাঠগোঁয়ার রেভারেন্ডের ইচ্ছে হল ওই বাড়িতে থাকবেন। বিলিতি শিক্ষার একটু ছোঁয়া পেলেই দেশীয় বিশ্বাসগুলোকে কুসংস্কারের বাতি জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়ার মহান উদ্দেশ্য প্রজ্জ্বলিত তখন অনেক মহাশয় ব্যক্তির মধ্যে। রেভারেন্ড রামকানাই বিশ্বাস তার ব্যতিক্রম নন। ইনিও এলেন তার বাঁজা বাঙালি বউকে নিয়ে। সন্তান-টন্তান না হলে মেয়েদের মাথায় বোধহয় ছিট গজায়–সবকিছুর মধ্যেই বাতিক দেখা যায়। বাঁজা বউটির নাম ময়নামতী। খাসা নাম। রামকানাই এই নাম শুনে আর শ্যাম অঙ্গ দেখে ময়নামতাঁকে সহধর্মিণী বানিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর বুক ফুলিয়ে একদিন উঠে এলেন পোড়োবাড়িতে।

বুক চুপসে গেল দুদিনেই। অপদেবতারা মানুষের অহঙ্কার দু-চক্ষে দেখতে পারে না। চোখের ঘুম উড়ে গেল রামকানাই আর ময়নামতীর। রাতের শয়ন পর্যন্ত নির্বিঘ্ন রইল না।

রামকানাই পড়েছিলেন এডগার অ্যালান পো-র ব্ল্যাক ক্যাট গল্পটা। দেওয়ালে জ্যান্ত কবরস্থ হয়েছিল কালো বেড়াল বাড়ির বউয়ের ডেডবডির সঙ্গে। তাই তিনি মঠের সমস্ত দেওয়াল ঠুকে ঠুকে দেখতেন ফোঁপরা দেওয়াল কোথাও পাওয়া যায় কিনা।

আর যায় কোথাও ভয়ানক খেপে গেছিল প্রেতিনী আর তার হবু বর। বাগানের নুড়ি ছুঁড়ে জানলার কাঁচ গুঁড়িয়েছে, ঘণ্টা বাজিয়ে কান ঝালাপালা করে দিয়েছে। তাতেও যখন পোড়োবাড়ি ছেড়ে পাদমেকং ন গচ্ছামি পণ করেছে রেভারেন্ড দম্পতি–তখন আরও উৎপাত শুরু করেছে ফরাসি ভূতপেতনি।

ময়নামতী এক সন্ধ্যায় বায়ুসেবন করছিল বাগানের পথে। আচমকা একটা আধলা ইট তেড়ে এসেছে তাকে লক্ষ্য করে। অদৃশ্য হাতে ইটের আবির্ভাব ঘটেছে দেখে বুদ্ধিমতী ময়নামতী পিছু ফিরেই দৌড়েছিল সদর দরজার দিকে। বেরসিক বিদেহী তখন সেই ইট আছড়ে মেরেছে তার পিঠে।

বউয়ের গায়ে হাত! রেগে লাল হয়েছিলেন রামকানাই রেভারেন্ড। চিঠি লিখেছিলেন এডগার লুসিকে। এই আঠেরো মাস চন্দননগরের পোডড়াবাড়ির নামও মুখে আনেননি ভূত-শিকারি। রামকানাইয়ের সনির্বন্ধ অনুরোধ পায়ে ঠেলতে পারলেন না। ফের এলেন বাংলার হুগলি জেলায়।

হাওয়ায় খবর এসে গেছিল পোড়োবাড়িতে তৈরি হয়েই ছিল অশরীরীগণ। চৌকাঠে পা দিলেন এডগার লুসি–ঢংঢং করে বেজে উঠল পেতলের মস্ত ঘণ্টা!

থ হয়ে গেলেন ভূত-শিকারি। আপ্যায়নটা হুবহু আগের মতোই হবে নাকি?

হলও তাই। আবার দোতলার ঘরে উড়ে এল ঝরাপাতা আর নুড়ি–আছড়ে পড়ল আধলা ইট!

ভাবনায় পড়লেন ভূত-শিকারি। এ বাড়ির ভূতপেতনি তাঁকে বন্ধু হিসেবে দেখছে, না শত্রু হিসেবে চোখে-চোখে রেখেছে, আঁচ করতে পারলেন না। তবে ক্ষণে-ক্ষণে রোমাঞ্চিত হতে লাগল তাঁর উসকোখুসকো গুম্ফ।

উঠে গিয়ে টেনে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তুলে দিলেন ছিটকিনি।

তার চোখের সামনেই খট করে নেমে এল ছিটকিনি-ফট করে দু-হাট হল দরজা।

চোয়াল ঝুলে পড়েছিল সাহেবের। আর ঠিক তক্ষুনি হিপপকেট থেকে তাঁর রূপোর চিরুনি উঠে এসে ঠকাস করে মাথায় বাড়ি মেরে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।

সাধের চিরুনি আর খুঁজে পাননি এডগারসাহেব।

ক্ষিপ্ত অশরীরীদের ঠান্ডা করার জন্যে ধূপ জ্বালিয়েছিল ময়নামতী। নিভে গেছিল সেই ধূপ। ভূত-শিকারির মাথায় এসেছিল বদবুদ্ধি। মেয়েভূতকে বশ করার জন্যে ল্যাভেন্ডারের শিশি খুলে ঘরময় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সুগন্ধি।

দক্ষিণ ফ্রান্সের হালকা সুবাস কিন্তু পাগল করে দিয়েছিল ফরাসি ভূতপেতনি দুজনকে। মুহুর্মুহুঃ  বেজে গেছিল পেতলের ঘণ্টা, দেওয়াল থেকে আছড়ে-আছড়ে পড়েছিল ছবির-পর-ছবি।

তিন দিনের বেশি হানাবাড়িতে থাকতে পারেননি এডগারসাহেব। আগে যা হয়নি–এবার তা হয়েছে। ইট আর পাথর ছোঁড়া হয়েছে তাকে টিপ করে। বুকে আর পিঠে।

তিন দিন পর, সটান বিলেতে ফিরে গেলেন ভূত-শিকারি। লিখলেন ইন্ডিয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত হানাবাড়ি নামে একখানা বই। সেই বই ছেপে বেরোতে-বেরোতে গেল একটা বছর।

এই এক বছর কিন্তু হানাবাড়িতেই থেকেছেন রেভারেন্ড রামকানাই এবং তার ভার্যা। লিপিবদ্ধ করেছেন প্রায় দুহাজার অলৌকিক ঘটনা। তার মধ্যে আছে শূন্য থেকে মদের বোতলের আবির্ভাব চেয়ারে আছড়ে পড়ে গুঁড়িয়ে যাওয়া। অবশ্যই তা চন্দননগরের বিখ্যাত সরাব। সাদা দেওয়ালে অদৃশ্য হাতে লিখন। একটাই নাম বারবার লেখা হয়েছে দেওয়ালে। মেরিয়ানা সেই নাম।

রামকানাই প্রতি ঘটনা চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন এডগার লুসিকে। বইতে ঠাই পেয়েছিল সমস্ত ঘটনা।

বইটা বেরিয়ে যাওয়ার পর বাড়িময় যেন তাণ্ডব নৃত্য আরম্ভ হয়ে গেছিল। ময়নামতীর সাধের কাঁচের বাসনপত্র যখন চুরমার হতে লাগল, গয়নার বাক্স আলমারি থেকে উধাও হয়ে পড়ে রইল লনে–তখন স্বামী-স্ত্রী লম্বা দিলেন বাড়ি ছেড়ে।

জগদীশ গুপ্তর একটা হাস্যকর মুদ্রাদোষ আছে। তিনি তোতলা নন, কিন্তু কথা শুরু করার আগে প্রথম অক্ষরটা জোর দিয়ে বার কয়েক উচ্চারণ করেন। দীর্ঘকাহিনি তিনি নিবেদন করলেন এইভাবেই। বলার ভঙ্গিমা অতিশয় বিরক্তিকর। কিন্তু কাহিনির প্রমাদে উৎকর্ণ হয়ে রইলাম।

তিনি স্তব্ধ হতেই ইন্দ্রনাথ বললে, বুঝলাম। পার্থিব পন্থায় আপনার নাতনি খুন হয়েছে– পেতনি করেনি–এ বিশ্বাসটা কেন আপনার মাথায় এসেছে, তার জবাব পেলাম।

ক্যা ক্যাক্যানো বলুন তো?

ফরাসি ভূতপেতনী ভয় দেখিয়েছে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলেনি কক্ষনও, বড় অনিষ্ট করেনি।

ঠি-ঠি-ঠিক ধরেছেন। তবে কেন নাতনির খুলি গুঁড়িয়ে গেল?

মানুষের হাত গুঁড়িয়েছে?

হ্যাঁ।

একাই গেছিল?

সেটা আপনি বের করুন। একা যাওয়ার মেয়ে সে নয়। গাদাগাদা ছেলেবন্ধু। শাড়ি কক্ষনও পরেনি। জিনস আর শার্ট। ক্যারাটে জানত। ফায়ার আর্মসয়ে দারুণ ইন্টারেস্ট। চালাতেও জানত। গুলি ফসকায়নি। নীতিবোধ কম। কী বলছি, বুঝছেন নিশ্চয়। দাদু হয়ে আর কী বলব। আমি স্বদেশি করেছি, দেশসেবা করেছি, জীবনে আদর্শ রেখে এতগুলো বছর কাটালাম। এসব আমার ভালো লাগে না। মা নেই, বাবা নেই আমি আর কতদিক দেখব?

বুঝেছি। ভূতের বাড়ির খবরটা পেল কী করে?

জগদীশ গুপ্ত তখন তাঁর ব্যাগের চেন টানলেন। একটা বই বের করলেন। ইন্দ্রনাথের হাতে গছিয়ে দিয়ে বললেন, এই বই পড়ে।

বইটার নাম দ্য মোস্ট হন্টেড হাউস ইন ইন্ডিয়া। লেখকের নাম এডগার লুসি।

চোখ তুলে বললে ইন্দ্রনাথ, পুস্তনিতে তো দেখছি আপনার নাম লেখা রয়েছে।

আমারই বই। এসব ব্যাপার মানি বলেই কিনি। ময়না যে এই পড়ে দৌড়বে, তা ভাবিনি।

.

ময়না? আপনার নাতনির নামও ময়না?

ময়নামতী। ওর মায়ের নাম ছিল ইন্দুমতী। তার মায়ের নাম বিন্দুমতী-মানে, আমার স্ত্রী।

চুপ করে রইল ইন্দ্রনাথ। ভাবছে।

বললে, বইখানা আমার কাছে থাক। আপনার নাম-ঠিকানা ফোন নম্বর দিয়ে যান।

.

ঘণ্টাখানেক লাগল বাগবাজারে পৌঁছতে। ইন্দ্রনাথ আমাকে ল্যাজে বেঁধে নিয়ে গেল। মান্ধাতার আমলের দোতলা বাড়িটার সরু সিঁড়ি দিয়ে সটান উঠে গেল। চাতালে দাঁড়িয়ে তিন দিকের তিনটে দরজার একটার কড়া নেড়ে বললে, ভূতনাথবাবু, জেগে আছেন, না ঘুমোচ্ছেন?

কর্কশ খিটখিটে বুড়োটে জবাব ভেসে এল ভেতর থেকে, আবার কে আপদ এল? মোক্ষদা…ও মোক্ষদা…বলে দে ঘুমোচ্ছি।

দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। ভেতরে পা দিল ইন্দ্রনাথ। আঠার মতো পেছনে লেগে আছি আমি। ঢুকেই বললে, মানুষ বিপদে পড়লেই আপনার কাছে আসে। আপদ হব কেন?

তক্তপোশে বসে এক বুড়ো। তিনদিকে তিনটে তাকিয়া। শিরদাঁড়া কুঁজো। গায়ে ময়লা গেঞ্জি। একমাথা টাক। গোটা শরীরটার হাড়গুলো চামড়া কুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কোনও মানুষ যে এত রোগা আর কঙ্কালসার হয়, না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

চশমাটা চোখে আঁটতে-আঁটতে খিটখিটে বুড়ো বললেন, চেনা-চেনা গলা মনে হচ্ছে…আরে কে ও! ইন্দ্রনাথ…ভূতনাথের চ্যালা..কী জাদু…এতদিন পরে কী মনে করে? ভূতধরা আমি ছেড়ে দিয়েছি। গেট আউট।

অম্লানবদনে তক্তপোশে গিয়ে বসল ইন্দ্রনাথ। আমাকে বললে বসে পড়তে। বুড়োর তেউড়ে যাওয়া ওপরের শিরদাঁড়া টিপে দিতে দিতে বললে, ব্যথাটা তো এই তিনখানা ভার্টিব্রায়?

হ্যাঁ…হ্যাঁ…ন্যাকামো হচ্ছে?

ভূতনাথবাবু, এডগার লুসিকে চেনেন?

দ্যাট ফোর-টোয়েন্টি? চারশো বিশ নম্বর ওয়ান? চন্দননগর নিয়ে যে গুলগাপ্পা ঝেড়েছে?

দ্য মোস্ট হন্টেড হাউস ইন ইন্ডিয়া আপনি পড়েছেন?

হোয়াট! এডগারের নষ্টামি আমি পড়ব না? গেট আউট। শিরদাঁড়া টিপতে টিপতে ইন্দ্রনাথ বললে, আরাম লাগছে?

হুঁ।

এডগার ফোর-টোয়েন্টি কেন?

সব বোগাস। ও বাড়িতে কী আছে, সেটা এখনও গবেষণার বিষয়। আমার শিরদাঁড়াটা বেগড়বাঁই না করলে অ্যাটেম্প নিতাম। তবে এডগার ব্যাটাচ্ছেলে অ্যান্টনি গোমেজ আর রামকানাইয়ের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সব বানিয়ে লিখেছে। যত না কাণ্ড ঘটেছে, তার বিশ গুণ বাড়িয়েছে। ননসেন্স। স্কাউন্ডেল!

আপনি জানলেন কী করে?

ইউ ফুল! ইউ ড্যাম! আমি জানলাম কী করে? ভূত-শিকারি ভূতনাথকে এ কথা বলবার সাহস তোমার হয়? গেট আউট!

বলুন না।

ইন্ডিয়ার একমাত্র ভূত-শিকারি আমি। ভূতের বাড়িগুলোর বদনাম ঘোচানোর জন্যে কোথায় যাইনি? কিন্তু বদনাম বাড়িয়ে লিখে যে লোক বই বিক্রির ধান্দায় থাকে–সে আমাদের প্রফেশনের কলঙ্ক। এডগার তাই করেছে। টাইমস আর বিবিসি থেকে রিপোর্টার পাঠিয়েছিল ঘটনাগুলোর সত্যি মিথ্যে যাচাই করতে। গোমেজের ওই বউটার নাম যেন কী?

মায়া।

বেনেদের সেই মেয়েটা। ভালো মেয়ে। ইংরেজিটা বেশ জানে। স্বামীর কুকীর্তি চিঠি লিখে আমেরিকাব সাইকিক্যাল রিসার্চ সোসাইটিতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ওদের জার্নালে তা ছেপে বেরোয়– ওই তো ওই তাড়ার মধ্যে আছে। খাসা চিঠি। নাম কেনার জন্যে অ্যান্টনি হাত মিলিয়েছিল এডগারের সঙ্গে। মায়ার তা ভালো লাগেনি।

ময়নামতী কিছু বলেনি?

রামকানাইয়ের সেই মিচকেপোড়া বাঁজা বউটা? দুটোই ফোর টোয়েন্টি। নাম আর পয়সা– দুটোরই দরকার ছিল। কম দক্ষিণা লুটেছে?

কিন্তু লোকে তো দেখেছে ভৌতিক কাণ্ড?

ভৌতিক কাণ্ড? স্টুপিড! ওসব ম্যাজিক আমিও জানি। বুড়বকদের বুদ্ধ বানাতে জানতে হয়। সৎ বলেই এই হাল আমার।–এসেছ কেন? মতলবটা কী?

ওই বাড়িতে একটা মেয়েকে মেরে ফেলা হয়েছে।

কে মেরেছে?

ভূতে নিশ্চয়। পাথর পিটে খুলি ভাঙা হয়েছে।

খবরদার! খবরদার! মেরিয়ানা খুনি নয়। অভাগিনী মুক্তি পাচ্ছে না বলেই দুষ্টুমি করছে খুন করার ধাত তার রক্তে ছিল না–মনেও ছিল না।

মরে গেলে তো ধাত পালটে যায়?

কোথাকার জ্ঞানদাতা রে? গেট আউট! গেট আউট! পরলোক নিয়ে পকড়-পকড় করতে এসেছে ভূতনাথ শিকদারের কাছে। যা জানতে চাও, সেটা জেনে যাও। মেরিয়ানার প্রেতাত্মাকে কেউ স্কেপগোট খাড়া করতে চেয়েছ। পাথর পিটিয়ে খুলি গুঁড়িয়ে বোঝাতে চাইছে–প্রেতিনীর কীর্তি। কক্ষনও না। মানুষের কীর্তি। মাগী ওখানে গেছিল কেন?

মাগী নয়–মেয়ে। ষোলো বছর বয়স।

আইব্বাস! লভ করতে তো? ওই হানাবাড়ির বাগান তো লভের জায়গা। কলকাতা থেকেও ছোটে ছোঁড়াছুঁড়িরা। এই ছুঁড়িটার লাভার আছে…নিশ্চয় আছে…গেট আউট..আমার খিদে পেয়েছে।

.

চন্দননগর পুলিশ থানা।

থানাদার ডিসুজা সাহেব বেশ খাতির করলেন আমাদের। ইন্দ্রনাথের চেয়ে বেশি করলেন আমাকে। কারণ আমি লিখি। ট্র্যাকের জোর না থাকলেও আজকাল লেখকরা ইদানীং বেশ কলকে পাচ্ছে এই একটা জোরে। কলমের জোরে।

অ্যালকাথিনের একটা প্যাকেট ইন্দ্রনাথের সামনে রেখে তিনি বললেন, গল্পের গোয়েন্দা আমি নই। হলে তুচ্ছ এই জিনিসটা নিয়ে মাথা ঘামাতাম।

খোঁচাটা হজম করে নিয়ে বুদ্ধদেবের হাসি হাসল ইন্দ্রনাথ। হাসিতে যেন বরাভয় ঝরে পড়ছে। বললে, কোথায় পেলেন?

বাগানের রাস্তায়। পাথর নুড়ির ওপর পড়েছিল। কত ছোট দেখেছেন? আলপিনের ডগার চেয়ে একটু বড়।

রঙটা সবুজ।

জিনিসটাও। ম্যাগনিফাইং গ্লাসে দেখেছি। শার্লক হোমস-এর মতো।

এবারের খোঁচাটা যেন শুনতেই পেল না ইন্দ্রনাথ, বস্তুটা ধার দেবেন?

স্বচ্ছন্দে। আমরা প্র্যাকটিক্যাল ডিটেকটিভ। নাইনটি পারসেন্ট পার্সপিরেশন–টেন পারসেন্ট ব্রেন ওয়ার্ক। আচ্ছা আসুন, নমস্কার।

.

জগদীশ গুপ্ত সত্যিই আদর্শবান পুরুষ। এত বড় শিল্পপতি–অথচ তিনতলা বাড়িটাকে বানিয়েছেন মধ্যবিত্তের মতো।

দোতলার বৈঠকখানা ঘরে বসে তিনি বললেন, আপনাকে তো বলেইছি, ময়নার নীতির বালাই ছিল না। দেদার ছেলে-বন্ধু।

মেয়ে-বন্ধু?

কম।

বিশেষ কারও নাম?

রিসিভারের দিকে হাত বাড়ালেন জগদীশবাবু, কমলি, স্কুটারটা আছে? নিয়ে চলে আয়। দশ মিনিটের মধ্যে।

.

কমলির পরনে কমলা রঙের সালোয়ার কামিজ। কালো বডিখানা স্টিলের তলোয়ার বললেই চলে।

বললে, একটা ছেলেই বড় হ্যাংলামো করত ময়নার সঙ্গে। আমাদের সঙ্গেও করেছে। একটু বেশি চায়। ও দাদু, আপনি কানে চাপা দিন।

ইন্দ্রনাথ বললে, তার কি সবুজ গাড়ি আছে?

চোখ বড় হয়ে গেল কমলির, মারুতি।

কোথায় পাব তারে?

গ্রেট ইন্ডিয়ান রেফ্রিজারেশন কোম্পানির মালিকের একমাত্র ছেলে তার চেম্বারে বসে বললে, হ্যাঁ, আমার মারুতি আছে। সবুজ রঙের। চন্দননগরের ডিসুজাসাহেবেরও পার্সোনাল গাড়িটা মারুতি। সবুজ রং। চেনেন ডিসুজাকে? থানাদার ডিসুজা?

এখুনি এলাম তার কাছ থেকেই।

থানায় গেছিলেন? গাড়িটা দেখেননি? ওর অফিসের সামনেই থাকে।

আপনার গাড়িটা কোথায়?

এই জানলা দিয়ে তাকান। ওই দেখুন।

ইন্দ্ৰনাথ উঠে গেল জানলার কাছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে গেছে ছেলেটাও। মিঠুন চক্রবর্তীর কায়দায় চুলের ছাঁট। পাতলা নাক, একটু টিকোলো। শান্ত সুন্দর চোখের চাহনি–অনেকটা ইন্দ্রনাথের মতোই। লম্বায় দুজনেই সমান। দেখতেও সমান সুন্দর। শুধু পোশাক আলাদা। ধুতি-পাঞ্জাবির পাশে সাফারি সুট।

এখন ওরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। চোখে-চোখে তাকিয়ে।

আপনি তাহলে যাননি ময়নার সঙ্গে?

না।

কোথায় ছিলেন?

এখানে।

তার প্রমাণ? আপনি মালিকের ছেলে। হাজিরার খাতা আপনার জন্যে নয়।

কাঁধ আঁকাল সুদর্শন তরুণ, বিশ্বাস করুন।

.

জয়ন্তকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে ফিরলাম ইন্দ্রনাথের ডেরায়।

জয়ন্ত, বললে ইন্দ্রনাথ, থানাদার ডিসুজার মারুতি আর সুরেশ লাম্বার মারুতি–দুটোই এখন সন্দেহের আওতায় চলে এসেছে।

সুরেশ লাম্বা সুদর্শন ওই ছেলেটার নাম। চেহারায় নবাবপুর। স্বভাবে মেয়েঘেঁষা। মাড়োয়ারি জন্মসূত্রে শিক্ষায়-দীক্ষায় বাঙালি।

জয়ন্ত বললে, থানাদারের গাড়ি তোলা পরে হবেখন। সুরেশের গাড়ি তুলিয়ে নিচ্ছি। আর কী হুকুম?

জবাব না দিয়ে টেলিফোন তুলল ইন্দ্রনাথ। নিমেষে তারের ও-প্রান্তে এসে গেল প্রেমাদ– প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কর্ণধার। দিল্লি যার হেড অফিস।

দিল্লি আর কলকাতায় কথা হয়ে গেল এইভাবে :

ইন্দ্র বলছি। হেল্প চাই।

ফরমাইয়ে।

সরকারি ফোরেনসিক ল্যাবের দুরবস্থা তোর অজানা নয়।

সেইজন্যেই তো ইমপোরটেড ইকুইপমেন্ট দিয়ে সাজিয়েছি আমার ফোরেনসিক ডিপার্টমেন্ট। সেটাও তোর অজানা নয়।

কাল সকালে ক্যালকাটা অফিসের ইনচার্জকে পাঠিয়ে দে।

তোর কাছে? কী মতলবে?

এক টুকরো রং পাঠাব..না, না, দুটো টুকরো। দুটোই সবুজ রঙের।

বেশ?

স্পেকটোগ্রাফিক অ্যানালিসিস করতে হবে।

প্রতিটি নমুনায় কী কী উপাদান আছে জানতে হবে? মিলে যাছে কিনা বলতে হবে?

ইয়েস, মাই বয়।

হেল উইথ ইউ। ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে এইভাবে কেউ কথা বলে?

প্রেম, স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোসকোপ আছে? যা দিয়ে এক্স-রে অ্যানালিসিস করা যায়?

কী নেই বন্ধু? দিস ইজ প্রেমাদ প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি—

রঙে কটা স্তর আছে, বলতে হবে।

আর কী?

লেজার এনার্জি দিয়ে এক-একটা রঙের স্তরকে ভেপার করে দেওয়ার প্রসেসটার কী যেন নাম?

লেজার মাইক্রোপ্রোব। ভেপারকে অ্যানালাইজ করতে হয় এমিসন স্পেকট্রোগ্রাফি দিয়ে। রঙের প্রত্যেকটা উপাদানের ওয়েভ লেন্থ জানা যায়। এত দরকার আছে কি?

আছে। অকাট্য প্রমাণ ছাড়া মাল ফসকে যাবে। টাকার মালিক। পলিটিক্যাল কানেকশন আছে নিশ্চয়। আমি চাই বৈজ্ঞানিক প্রমাণ। হেল্প মি।

ডোন্ট ওয়ারি।

অনেক রাতে বাড়ি ফিরলাম। কবিতা সারাদিন হেদিয়ে মরেছে। ভাগ্যিস ইন্দ্র সঙ্গে আসেনি। ঝেটিয়ে বিষ ঝেড়ে দিত কবিতা।

কথার তোড় নীরবে শুনে গেলাম। তারপর বললাম সারাদিনের কাহিনি। সবশেষে বললাম, সুরেশ লাম্বাই গেছিল ময়নার সঙ্গে হানাবাড়িতে।

জানলে কীভাবে?

বাগানের নুড়ি চাকায় লেগে ছিটকে গিয়ে লেগেছিল ড্রাইভারের দরজার প্যানেলে। রং চটে গিয়েছিল নুড়িতেই। ডিসুজা কূর্ম অবতার-থানাদার হলেও এই একটি উত্তম কাজ করেছে। কুচি

রং হুবহু মিলে গেছে চটা রঙের জায়গায়। নিজের চোখে দেখে এলাম।

হুম করে দম ফেলে কবিতা বললে, ঠাকুরপোর ব্রেন আছে বটে। ডিটেকশনে ডক্টরেট। এখন মাইক্রোসকোপিক এগজামিনেশন করে মিলিয়ে নেওয়া বাকি। ফাইন! লাম্বা ছোঁড়া কি লম্বা দিয়েছে?

তাকে বাড়ি ছেড়ে নড়তে বারণ করে এল ইন্দ্রনাথ। লোকাল থানাদারও নজর রেখেছে।

নজর রাখাই সার হয়েছিল।

.

পরের দিন সকালেই টেলিফোন এসেছিল ইন্দ্রনাথের, মৃগ চলে আয়। লাম্বা-লম্বা দিয়েছে।

গেলাম লাম্বার বাড়ি। ঊষালগ্নে গোটা বাড়ি কেঁপে উঠেছিল ঘন-ঘন গুলির আওয়াজে। গুলি চলছে সুরেশ লাম্বার ঘরে। আধ মিনিটেই থেমে গেছিল শব্দ।

দরজা ভেজানো ছিল। মেঝেতে লুটিয়ে আছে সুরেশ। হাতে রয়েছে দুশমন আকৃতির একটা হ্যান্ডগান। ভোদা, কালচে। চিক্কণ নয় মোটেই। খাদা চোঙা লম্বায় মোটে দুইঞ্চি। দেখলেই গা হিম হয়ে যায়। স্টার ওয়ার্স সিনেমার ডার্থ ভেডার-এর রশ্মিবন্দুক বললেই চলে।

আমেরিকার কুখ্যাত কোবরে M-11/9–যার ম্যাগাজিন থেকে বত্রিশটা নাইন মিলিমিটার সাইজের তামার গুলি বেরিয়ে যায় পরপর–একবার ট্রিগার টিপে ধরলেই।

সুরেশ তার নিজের ব্রেন আঁঝরা করেছে বত্রিশটা মৃত্যুদূতকে দিয়ে।

তার আগে লিখে গেছে ছোট্ট চিঠি। পরিষ্কার বাংলায়:

আমার অপরাধ আমি মারোয়াড়ির ছেলে। ময়নাকে এত ভালোবেসেও তার মন পেলাম না। ও আমাকে চায়নি। চেয়েছিল আমার কোবরেকে। হানাবাড়িতে গেছিল কোবরের শক্তি যাচাই করতে। খালি করেছিল ম্যাগাজিন। তারপর সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি দিইনি। কেড়ে নিতে গেছিল। পারেনি। ক্যারাটে চপ মেরেছিল আমার কণ্ঠা টিপ করে। আমি থার্ড গ্রেড ব্ল্যাক বেল্ট ও নই। ঘুরে গিয়ে বেঁচে গেছিলাম। হাতের কোবরেও ঘুরে গিয়ে ওর মাথায় মেরেছিল। ভীষণ ভারি। মারা যায় তক্ষুনি। বাঁটের খাঁজ ছিল চোট-এর জায়গায়। লেভেল করে দিয়েছিলাম পাথর দিয়ে। ময়না নেই। আমি চললাম। রইল অভিশপ্ত কোবরে। আর যেন কাউকে ছোবল না মারে।

* নবকল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত (শারদীয় সংখ্যা, ১৪০০)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *