1 of 2

সোনার খড়ম

সোনার খড়ম

কে, মৃগাঙ্ক রায়?

মিহির কাঞ্জিলালের কণ্ঠস্বর মনে হচ্ছে।

অধমের নাম তাই বটে। রায়মশায়ের হাত কি খালি?

নতুন লেখার জন্যে? হবে না–হাতে ব্যথা।

যাচ্চলে। কথাটা শুনবেন তো।

শুনছি। শুনছি। শুনছি।

খেপে আছেন কেন? না, না, গল্প-টল্প চাই না। তবে গল্পের মশলা জুটিয়ে দিতে পারি।

এবার কিঞ্চিৎ আগ্রহ প্রকাশ করতে হল। গোয়েন্দা গল্প লেখা ইদানীং কষ্টকর হয়ে পড়েছে ভালো উপাদানের অভাবে। এখানকার খুনেরা পুলিশদের চেয়ে বেশি ধুরন্ধর তো বটেই, অস্ত্র সম্ভারেও পুলিশদের টেক্কা মেরেছে। এখন তাদেরই হাতিয়ারের প্রদর্শনী দেখতে এবং তা থেকে জ্ঞান অর্জন করতে দৌড়চ্ছে পুলিশের লোক।

সুতরাং পুলিশ মহল থেকে উত্তম মালমশলা পাওয়া দুষ্কর। বন্ধুবর ইন্দ্রনাথ রুদ্রও চ্যালেঞ্জিং কেস ছাড়া মাথা ঘামাতে চাইছে না। ও বলে, অবলা অবোধ নারীই এখন বধ্যভূমিতে অবতীর্ণ হয়ে মানুষ বধ করে চলেছে অবলীলাক্রমে, অতএব আমি আর নেই।

আরে, নেই বললে আমার কি আর চলে। দুটো পাতা লিখলে তবে দুটো পয়সা পাওয়া যায়। পয়সার অবশ্য আমার তেমন দরকার নেই কিন্তু কাজের দরকার তো আছে। কঁহাতক বসে বসে আর গিন্নির সঙ্গে কেঁদল করে দিন কাটানো যায়। বিশেষ করে যে গিন্নি গোয়েন্দা গল্পের নম্বর ওয়ান পোকা এবং আমার কলম দিয়ে আর গোয়েন্দা গল্প বেরুচ্ছে না বলে উদয়াস্ত টিটকিরি দিয়ে চলেছে।

মিহির কাঞ্জিলালের সুমিষ্ট বচন শুনে তাই অন্তরে পুলক অনুভব করলাম।

মিহির আমাদের পুরোনো দোস্ত। একটু-আধটু পলিটিক্স করে বটে, তবে তোক ভালো। সব পলিটিসিয়ান তো হৃদয়হীন নয়। নীতিবোধ, মূল্যবোধ আছে অনেকেরই। এই রকমই এক ব্যক্তির সান্নিধ্যে থেকে এবং ইন্ডিয়া জোড়া এহেন কু-রাজনীতির তুফানের মধ্যে থেকেও গা-বাঁচিয়ে চলছে মিহির; সেইসঙ্গে চুটিয়ে সম্পাদনা চালিয়ে যাচ্ছে একটা কাগজের। সাহিত্যও ভালোবাসে। তাই আমরাও ওকে ভালোবাসি এবং সুযোগ পেলেই মুখ নাড়া দিই।

সেই কাঞ্জিলাল ফোন করেছে গল্পের মশলা দেবে বলে।

অতএব নড়ে বসতে হল।

বললাম, বৎস কাঞ্জিলাল–

বৎস! বয়সে তো মোটে তিন বছরের ছোট—

এই ক্ষেত্রে আপনাকে গো–বৎস বলতে চাইছি। অর্থাৎ বাছুর। ঢুঁ মারা হয়েছে কোথায়?

টেলিফোনের আওয়াজ শুনে ধরতে পারছেন না?

টেলিফোনের আওয়াজে কি টেলিফোন-ভুসির ঠিকানা থাকে?

খুব স্পষ্ট শুনছেন বলে মনে হচ্ছে?

স্পষ্টই তো।

ফোন করছি কিন্তু অনেক দূর থেকে।

কতদূর থেকে?

ব্যাঙ্গালোর থেকে।

থমকে গেলাম। তারপর, কী হয়েছে সেখানে?

খুন।

পুলিশ নেই ব্যাঙ্গালোরে?

আছে। কিন্তু গোয়েন্দা নেই।

আমি গোয়েন্দা নই।

আপনার বন্ধু তো বটে।

ইন্দ্রনাথ? ছ্যাঁচড়ামি ও ছেড়ে দিয়েছে।

বাট দিস ইজ নট ছ্যাঁচড়ামি। একটা মানুষ খুন হয়েছে নিরপরাধ আর একটা মানুষকে নিয়ে পুলিশ টানাহ্যাঁচড়া করছে–

মাইশোরের পুলিশ ওইরকমই করে। চন্দন কাঠ ডাকাতদের নিয়ে কী কাণ্ডটা চলছে দেখছেন তো–

ব্যাপারটা চন্দনকাঠ ঘটিতও হতে পারে। মৃগাঙ্কবাবু, কেস ইজ ইন্টারেস্টিং। এর মধ্যে রয়েছে একটি মেয়ে। বেজায় ধনবতী। পৃথিবীর একশো জন বড়লোকের মধ্যে না হলেও দুশো জনের মধ্যে পড়ে। ইন্দ্রনাথ রুদ্রর সাহায্য চাইছে সে।

ইন্দ্রনাথকে চেনে মাইশোরের মেয়ে?

বাঙালি যে। আপনার গল্পের ফ্যান। খুনি সাব্যস্ত করা হয়েছে তার ভাবী বরকে।

মাই গড! তাহলে তো ইন্দ্রনাথকে খোশামোদ করতেই হয়।

করুন। কখন ফোন করব?

আধ ঘণ্টা পরে।

পরের দিন সকাল ছটা কুড়ির ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স-এর বিমানে চেপে ব্যাঙ্গালোরের মাটি ছুঁলাম কাঁটায়-কাঁটায় আটটা পঁয়তাল্লিশে।

ভীষণ উদ্বিগ্ন মুখে অভ্যর্থনা জানাল মিহির কাঞ্জিলাল। যেহেতু ব্যাঙ্গালোর জায়গাটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আড়াই হাজার ফুট উঁচুতে এবং ধারে কাছে কোথাও সমুদ্র নেই–তাই বেশ নাতিশীতোষ্ণ আর ঘাম-টাম হয় না বললেই চলে। মওকা বুঝে সুট পরার রেওয়াজ ওখানে বেশি। দিশি সাহেব প্রায় প্রত্যেকেই।

মিহির কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে চিরকালের খদ্দরের খয়েরি পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে। চুল যেমন থাকে বরাবর–অর্থাৎ উস্কখুস্ক। বয়সের অনুপাতে পেকেছে বেশি। দাড়ি-গোঁফও কামায়নি–বুঝলাম, ঘুম ভেঙেছে এখুনি।

সদা উদ্বিগ্ন থাকা ওর একটা স্বভাব। দুনিয়ার টেনশন যেন মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কবিতাকে দেখেই কিন্তু এহেন টেনশনও মিলিয়ে গেল মুহূর্তে।

বললে সোল্লাসে এবং সহাস্যে, আরে পুঁটলি বউদিও যে।

আমার গিন্নি কবিতা যদিও পুঁটলির ধারকাছ দিয়েও যায় না। বম্বের মেয়ে হয়েও খাঁটি বাঙালি কিন্তু পুটলি নয়।

চোখ পাকিয়ে সে বললে, ফের।

আধ হাত জিভখানা সড়াৎ করে বেরিয়ে এল মিহিরের মুখবিবর থেকে, সরি বৌদি। কিন্তু দাদার কেঁচা ধরে সব সময়ে ঘোরেন তো–

উলটো। আপনার দাদাই আমার আঁচল ধরে ঘোরে।

পেছন থেকে গম্ভীর গলায় ইন্দ্রনাথ বললে, রহস্যালাপ পরে হবে। আগে যাওয়া যাক পারমিতার কাছে।

.

আমরা এখন বসে রয়েছি পারমিতা হাজরার বৈঠকখানায়। ঘরের বর্ণনা আর দেব না– তবে বাড়িটার বর্ণনা এক ঝলকে জানিয়ে দিই। বাকিংহাম প্যালেসে নাকি ৬৬২টা ঘর আছে। ব্যাঙ্গালোরের বাইরের দিকে ম্যাঙ্গালোর যাওয়ার পথে–জঙ্গল ঘেঁষা এই প্রকাণ্ড প্রাসাদেও মনে হল ঘরের সংখ্যা ওইরকমই হবে। কত পয়সা থাকলে এই আক্রাগণ্ডার যুগে এতবড় বাড়ি একটা মানুষ বানাতে পারে–তা ভাবতে গিয়ে মাথা ঘুরে গেছিল। এই মুহূর্তে এই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনীব্যক্তি এখন ব্রুনেই-য়ের সুলতান। ৩,৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের মালিক। পারমিতা হাজরার বাবা কত টাকার মালিক, তা এই দেশের ইনকাম ট্যাক্স অফিসাররাও আঁচ করতে পারে না–ঘাঁটাতে যায় না। যার টাকা আছে, তার ক্ষমতাও আছে–তাকে দূর থেকে পেন্নাম ঠোকাই ভালো। তবে স্ক্যাম এর চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা উনি নাকি ইচ্ছে করলেই মিটিয়ে দিতে পারেন–এমন একটা আভাসও দিয়েছিলেন বন্ধু মহলে।

এমন ব্যক্তির একমাত্র মেয়ে এই পারমিতা। অপ্সরা তো কোনওদিন দেখিনি, পারমিতাকে দেখে আশ মিটিয়ে নিচ্ছিলাম। এত টাকার মালিক বলে মনেই হয় না। কবিতার সঙ্গে জমে গেল চক্ষের নিমেষে।

ইন্দ্রনাথ এখন নস্যি আর পাইপ দুটোই চালাচ্ছে। এই মুহূর্তে ও পাইপ টানছে আর পারমিতার কথা শুনছে। ওর বাবা বিশ্ববন্ধু এখন ইন্ডিয়ায় নেই।

ভদ্রলোকের চন্দন কাঠ আর হাজারো ব্যাবসা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না পারমিতার। শিক্ষা দীক্ষা সবই তো আমেরিকায়। হার্ভার্ড-এর পড়াশুনা শেষ করে ঢোকে মাইক্রোসফট কর্পোরেশনে, যেখানে কাজ করতে করতে কম্পিউটরের এমন একটা প্রোগ্রামিং আবিষ্কার করে, যা কম্পিউটরের যে কোনও ভাইরাসের যম। ফলে, পৃথিবীর কোটি-কোটি পারসোনাল কমপিউটার-ওয়ালারা ওর এই প্রোগ্রাম কিনছে। বেলজিয়ামের নতুন-নতুন তুখোড় ভাইরাসও কাছে ঘেঁষতে পারছে না।

ব্যাঙ্গালোরেই কিন্তু হেডকোয়ার্টার বানিয়েছে পারমিতা। ইন্ডিয়ার ইলেকট্রনিক সিটি তো এখন ব্যাঙ্গালোর। আগে যার নাম ছিল গার্ডেন সিটি অফ ইন্ডিয়া। পৃথিবীজোড়া কোম্পানির কয়েকশ ব্রাঞ্চে পাঠিয়ে দিচ্ছে নতুন প্রোগ্রামিং সফটওয়্যার রপ্তানি করে দেদার টাকা এনে দিচ্ছে ভারত সরকারকেও।

কাজেই ওর সময় অঢেল। বাপের আর নিজের টাকা আগামী পঞ্চাশ জন্মেও উড়িয়ে পুড়িয়ে শেষ করতে পারবে না বলে ফঁক পেলেই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডায় জমে যায়।

ওর প্রিয়তম আচ্ছা হল বনে-বাদাড়ে। শিকার করা মোটামুটি নিষেধ। কিন্তু জঙ্গলে জন্তু থাকলেই বন্দুকধারীদের হাত নিশপিশ করবেই। কখনও হাঁস, কখনও হায়না–এইসব নিয়েই মেতে থাকে। ম্যাঙ্গালোরের দিকে যেতে মার্কারা-র গভীর জঙ্গলে একটা ক্লাব-হাউসও বানিয়ে রেখেছে। জায়গাটা জেনারেল কারিয়াপ্পার বাড়ির কাছেই। সব সময়েই সেখানে মেঘ আর কুয়াশা পাহাড় ঘিরে থাকে। এখানকারই একটা পাহাড়ে বসে ইন্ডিয়ার সেরা সূর্যাস্ত দেখা যায়। বিধান রায়ও দেখে গেছিলেন। সেরা সূর্যোদয় দেখার জায়গাটা টাইগার হিলে সবাই তা জানেন।

এই ক্লাব-হাউসে তিন দিন আগে চার বন্ধুকে নিয়ে সময় কাটাতে গেছিল পারমিতা। ব্যাঙ্গালোরের মালেশ্বরমে বাঙালিদের মস্ত ঘাঁটি আছে। চার বন্ধুই থাকে সেখানে। চারজনেই বাঙালি। চার জনেই জোয়ান পুরুষ।

হ্যাঁ, পুরুষ। নারী বন্ধু একদম পছন্দ করে না পারমিতা।

এই চারজনের একজনের নাম ওথেলো। ওথেলো বোনার্জি। বিলেতে থাকবার সময়ে ব্যানার্জিকে বোনার্জি বানিয়েছে।

ওথেলোকেই বিয়ে করবে পারমিতা এইটাই ঠিক হয়ে রয়েছে, মানে কানাঘুষো সেই রকমই যখন চলছে ঠিক সেই সময়ে ওথেলোকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল রামকুমারকে গুলি করে খুন করার অভিযোগে।

রামকুমার সান্যালও পারমিতার প্রণয় প্রার্থী। যে চারজনকে নিয়ে জঙ্গলের হাওয়া খেতে গেছিল পারমিতা সেই চারজনই ওকে ভালোবাসে। কিন্তু চারজনেই জানে পারমিতা মালা দেবে কার গলায় আর কে হবে পৃথিবীর অন্যতম ঈর্ষণীয় বড়লোক।

এহেন পরিস্থিতিতে জঙ্গলের মধ্যেই গুলিবিদ্ধ হল রামকুমার। ওথেলো ছিল চন্দন লেক এর উত্তর-পূর্ব কোণে। বিশ গজ ডাইনে রামকুমার। রামকুমারের বিশ গজ ডাইনের জায়গাটা খালি ছিল পারমিতার জন্যে। কিন্তু পারমিতা যায়নি–শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে পড়ায় বলেছিল, একটু দেরি করে যাবে। এই ফাঁকা জায়গাটার আরও বিশ গজ ডাইনে ছিল তপনমোহন শিকদার, তারও বিশ গজ ডাইনে চন্দন লেকের একদম দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বীরেশ্বর ভৌমিক।

অর্থাৎ চন্দন লেকের গোটা পুব পাড়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল চারজনে।

এই পাড়ের ঘাসবন প্রায় বারো ফুট উঁচু। কেউ কাউকে দেখতে পায় না। ছোট-খাট জন্তুরা ঘাসে গা লুকিয়ে আসে জল খেতে। তার মধ্যে বড় জন্তু থাকলেও রক্ষে নেই। কারও কিছু বলবার নেই। কেননা, এ তল্লাটের বনজঙ্গল পাহাড় সবই তো পারমিতার বাবার। প্রাইভেট এরিয়া।

সন্ধে সাতটার মধ্যেও পারমিতা যেতে পারেনি শরীরটা বড় ম্যাজম্যাজ করছিল বলে। কিন্তু ফায়ারিং আওয়াজ শুনেছে ক্লাবহাউসে বসেই। সাতটার মধ্যেই সবার ফেরার কথা। সাড়ে সাতটা নাগাদ ফিরে এল তপন, বীরেশ্বর, ওথেলো।

ফিরল না শুধু রামকুমার।

মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় একটু বেশি মাত্রায় সজাগ থাকে। তাই খচ করে উঠেছিল পারমিতার বুক।

তপন, বীরেশ্বর, ওথেলো–এই তিনজনেও অবাক হয়েছিল রামকুমারের না ফেরায়। ওরা ভেবেছিল, আগেভাগে পারমিতার কাছে রামকুমার ফিরে এসেছে নিরিবিলিতে পারমিতাকে কাছে পাওয়ার জন্যে।

ছটা পর্যন্ত রামকুমারের বন্দুকের আওয়াজ শুনেছে ওথেলো। ও ছিল বাঁ-দিকে। বিশ গজ দূর থেকেই দেখেছে বারো ফুট লম্বা ঘাসের মাথায় ধপাধপ পড়ছে মরা হাঁস–প্রায় তিরিশ চল্লিশ ফুট ওপরকার উড়ন্ত হাঁস যে ওর গুলি এড়িয়ে যেতে পারছে না–তা তো দেখা যাচ্ছিল।

ছটার পর থেকেই হাঁসেরা উড়ে গেছে রামকুমারের মাথার ওপর দিয়ে। বন্দুকের আওয়াজও তাই শোনা যায়নি। তাই সাতটা বাজতেই চন্দন লেকের উত্তর পাড় ধরে ক্লাবহাউসে ফিরে এসেছে। ওথেলো।

দক্ষিণ পাড় বেয়ে ফিরেছে তপন আর বীরেশ্বর।

এসে দেখল ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে পারমিতা। কাছে দাঁড়িয়ে সত্যনারায়ণ। আগে ছিল আর্মিতে। এখন এই ক্লাবহাউসের কেয়ারটেকার।

রামকুমারের খোঁজে বেরিয়ে গেছিল এই সত্যনারায়ণ।

ডেডবডি সে-ই দেখেছে। বারোফুট উঁচু ঘাসের মধ্যে একটুখানি ফাঁকা জায়গা। রামকুমার মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে সেখানে। গুলি তার পিঠে ঢুকে বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে।

বডি ঘাড়ে করে ফিরে এসেছে সত্যনারায়ণ। পুলিশ এসেছে। তারা পিঠ-বুকের ফুটোর মাপ নিয়েছে। যে মাপের গুলি পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে বেরিয়ে গেছে, সেই মাপের গুলিই ওথেলো ছুঁড়েছে মাত্র বিশ গজ দূরে।

ও-মাপের গুলি আর বন্দুক নেই অন্য দুজনের কাছে।

ওথেলোই যে খুনি–তার পয়লা নম্বর প্রমাণ এটা।

নম্বর দুই প্রমাণ ও পায়ের ছাপ।

চার বন্ধুই বন্দুক ঘাড়ে করে চন্দন লেকের দক্ষিণ পাড়ে গেছে যে-যার জায়গায়। জায়গা আগে থেকেই ঠিক করে রেখে দিয়েছিল সত্যনারায়ণ। কাদার ওপর রয়েছে চারজনের পায়ের ছাপ– ফিরেছে দুজন–সেই ছাপ। ওথেলোর পায়ের ছাপ লেকের পুব পাড় বেয়ে সটান চলে গেছে উত্তর পুব কোণ পর্যন্ত নিজের জায়গায়। সেইখান থেকেই একসারি পায়ের ছাপ ফিরে এসেছে উত্তর পাড় বেয়ে–যখন ফিরেছে, তখনকার ছাপ।

এ ছাড়াও রয়েছে আরও দু-সারি পায়ের ছাপ–মানে, জঙ্গল-বুটের ছাপ। ওথেলো নেমে এসেছে নিজের জায়গা ছেড়ে। কাদা মাড়িয়ে ফিরে গেছে রামকুমার যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার পেছনে লেকের পাড়ে। আবার ফিরে এসেছে নিজের জায়গায়।

যেন, কথা-বলা পায়ের ছাপ। যা বলতে চাইছে। তাই এই : ওথেলো এখান দিয়ে গিয়ে রামকুমারকে পেছন থেকে গুলি করে মেরে ফিরে গেছে নিজের জায়গায়।

তেসরা প্রমাণ জুগিয়েছে তপন আর বীরেশ্বর।

দক্ষিণ পাড় বেয়ে শিকার-অভিযানে যাওয়ার আগে তুমুল ঝগড়া চলছিল রামকুমার আর ওথেলোর মধ্যে। ওরা দুজনে এগিয়ে গেছিল–অনেক পেছনে যাচ্ছিল তপন আর বীরেশ্বর! দু চারটে কথা কানেও এসেছে।

ঝগড়াটা পারমিতাকে নিয়ে।

রামকুমার টিটকিরি দিচ্ছিল ওথেলো-কে। কীরে! শেষকালে টাকার লোভে গলায় মালা পরতে যাচ্ছিস? রেগে আগুন হয়ে গেছিল ওথেলো।

তারপরেই রামকুমার খতম।

এবং ওথেলো গ্রেপ্তার।

পাইপ নামিয়ে বললে ইন্দ্রনাথ, পারমিতা, আপনার কী মনে হয়? ওথেলো খুন করেছে। রামকুমারকে?

পারমিতা ইন্দ্রনাথের চোখে-চোখে চেয়ে বললে, না। ওকে দেখলে বুঝবেন।–দেখবেন?

চার চোখ এক হয়ে রইল কিছুক্ষণ।

আস্তে বললে ইন্দ্রনাথ–তাকে এখানে আনা হয়েছে?

আপনি আসছেন বলে। পুলিশ আমার কথা শোনে।

আনান এখানে।

গায়ত্রী, একটু গলা চড়িয়ে ডাকল পারমিতা।

ঘরে ঢুকল মাঝ বয়সি একটি স্ত্রীলোক। মাইশোরের মেয়ে অবশ্যই। শাড়ি পরা দেখেই মালুম হয়। খুব ফরসা। চোখমুখ একটু চোয়াড়ে। ঠোঁট ফুলে রয়েছে। একহাতে চাপা দিয়ে রয়েছে।

কানাড়া ভাষায় হুকুম দিল পারমিতা। বেরিয়ে গেল গায়ত্রী।

কবিতা বলে ওঠে, ওর ঠোঁটে কী হয়েছে?

দাঁত ভেঙেছে–মুখ থুবড়ে পড়ে গেছিল। এদিকে এই অবস্থা–ওদিকে ওর মুখ রক্তারক্তি।

এখানেই থাকে?

ক্লাবহাউসে থাকে। সত্যনারায়ণের স্ত্রী। একটাই ছেলে ছিল। বকাটে। মারা গেছে। দুজনেই সব দেখে। আজকে আনিয়েছি দুজনকেই।

গায়ত্রীর পেছন-পেছন ঘরে ঢুকল তিনজন পুরুষ।

প্রথমজনের দাড়িওয়ালা রাগী চেহারা দেখেই মনে হল নিশ্চয় ওথেলো। লম্বায় ইন্দ্রনাথের সমান যায়, দেখতেও প্রায় সেইরকম–দাড়িটা বাড়তি। চোখের চেহারা প্রায় একইরকম। বড়-বড়। ঝকঝকে। মনের ভাষা লুকোতে পারে না। এই মুহূর্তে সেই চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরোচ্ছে।

পারমিতা বললে, ওথেলো, তুমি আমার পাশে বসো। তুমি যে নিরপরাধ, তা প্রমাণ করতে এসে গেছেন ইন্দ্রনাথ রুদ্র। ওঁর এপাশে মৃগাঙ্ক রায়, ওপাশে কবিতা বউদি। এঁকে তো চেনই, মিহির কাঞ্জিলাল–এবারের শিকার অভিযান নিয়ে আর্টিকেল লিখতে এসেছিলেন। ইন্দ্রনাথবাবু, কী দেখছেন?

ইন্দ্রনাথ চেয়েছিল ওথেলোর পেছনের দুই পুরুষমূর্তির দিকে। একজনকে তো চেনাই যাচ্ছে– পুলিশ অফিসার নিঃসন্দেহে পাহারা দিয়ে নিয়ে এসেছে ওথেলোকে। আর একজন? আবলুস কাঠের মতোন তার গায়ের রং। কালো পাথর কুঁদে তৈরি মূর্তি। চোখ দুটো শক্ত আর লালাভ।

সত্যনারায়ণ–পরিচয় করিয়ে দিল পারমিতা। এক্স আর্মি ম্যান। কথাবার্তাও সেইরকম– উগ্ৰক্ষত্রিয় টাইপের।

ইন্দ্রনাথ প্রথমে কথা বলল এর সঙ্গেই–অবশ্য ইংরেজিতে। তারপর কথা হল পুলিশ অফিসারের সঙ্গে। ইতিমধ্যে কফি রেখে গেল গায়ত্রী। কফি শেষ করেই ইন্দ্ৰনাথ উঠে দাঁড়িয়ে বললে, চলুন, সন্দেহজনক পায়ের ছাপের সারি দুটো আগে দেখে আসি। সত্যনারায়ণ, আপনি দেখবেন চলুন। আপনারা বসুন। মিহিরবাবু, আসবেন? আসুন। মৃগ, তুমিও এসো।

ঘণ্টাতিনেক লাগল গাড়িতে করে যেতে। মিহির আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল– যাতে বেলাবেলি অকুস্থল দেখা যায়।

চন্দন লেক বাস্তবিকই বড় মনোরম জায়গা। গাড়ি ছাড়া আসা যায় না। চারদিকে শুধু পাহাড় আর উঁচু গাছ, কুয়াশা আর মেঘ। বড় সঁতসেঁতে।

এরই মাঝে চন্দন লেক যেন পটে আঁকা ছবি। ক্লাবহাউসে দাঁড়িয়ে অবশ্য লেক দেখা যায় না। চারদিকে গাছ আর গাছ। উঁচু পাঁচিল। বড় নিভৃত, নিরিবিলি জায়গা।

গাছপালার মধ্যে দিয়ে পথ বেয়ে পৌঁছলাম লেকের পাড়ে।

বিশাল লেক। ওপাড় দেখা যায় না। বহু পাখি উড়ছে। হাঁস ভাসছে জলে।

এপাড়ে ঘাটে বাঁধা একটা নৌকো। দাঁড় তোলা রয়েছে ভেতরে।

আমরা দক্ষিণ পাড় বেয়ে পায়ের ছাপ দেখতে-দেখতে গেলাম। পুব পাড়ে পৌঁছে পদচিহ্ন অনুসরণ করলাম। চারজনের থেকে হল তিনজনের বীরেশ্বর উঠে গেল নিজের জায়গায়। তারপর হল দুজন–তপন গেল। তারপর একজনের রামকুমার গেল ওপরে। একা ওথেলো এগিয়ে গেছে– বিশেষ বন্টু মারা জঙ্গল-বুট পরে।

শুকতলায় বড়-বড় দাগ।

সত্যনারায়ণ বললে, চারজনেই এখানে এসে জুতো পালটে নেন। ক্লাব হাউসেই সব থাকে। বন্দুক, টোটা–সব।

বোবা হয়ে গেছে ইন্দ্রনাথ। মিহির মোহিত হয়েছে নিসর্গ দৃশ্য দেখে। জাপানি ক্যামেরা বের করে ক্লিক-ক্লিক করে ফটো তুলে যাচ্ছে।

হেঁট হয়ে অনেকক্ষণ ওথেলোর পায়ের ছাপের দিকে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।

সিধে হল। চোখ কুঁচকে চেয়ে রইল লেকের দিকে। কুয়াশা বুঝি এখনও সরেনি। নিস্তরঙ্গ জল। হাঁস সাঁতরাচ্ছে বলেই একটু যা ঢেউ উঠছে।

ডাকল মিহিরকে। বললে, ছাপগুলোর ক্লোজ আপ ফটো তুলে দেবেন?

নিশ্চয়, ক্যামেরা নামাল মিহির।

ইন্দ্র বললে, ওথেলোর তিনসারি বুটের ছাপ একই প্রিন্টে যাতে আসে, সেইভাবে তুলবেন।

ও-কে, ও-কে।

নিস্তব্ধ সরোবরের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে পাখির ঝক। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। মাঝে-মাঝে ক্যামেরার ক্লিকিং।

ইন্দ্র বললে, সত্যনারায়ণ সাহেব।

ইয়েস স্যার। মিলিটারি কায়দায় অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে গেল আবলুস মূর্তি। আর্মির জাতই আলাদা।

ওথেলো গুলি ছুঁড়েছিলেন রামকুমারের পেছনে গিয়ে?

ইয়েস স্যার।–ওই তো ওইখান থেকে।

প্রায় বিশগজ দুরে লেকের পাড়ে একটা জায়গার দিকে আঙুল তুলে দেখাল সত্যনারায়ণ।

ইন্দ্র বললে, মিহিরবাবু, আপনার এদিকের ফটো তোলা হয়ে গেলে আসবেন।

যাই।

আমরা তিনজনে এগোলাম। সত্যনারায়ণ আঙুল নামিয়ে দেখাল কাদার ওপর অনেকগুলো জঙ্গল-বুটের ছাপ। এলোমেলো। সব কটাই ওথেলোর বুটের ছাপ।

লম্বা ঘাসের মধ্যে দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম তিনজনে। নরম মাটিতে একটা গোলমতো জায়গা দেবে গেছে।

সত্যনারায়ণ বললে, এইখানে রামকুমার সাহেব হাঁটু পেতে বসে বন্দুক ছুঁড়ছিলেন।

সেখানে দাঁড়িয়ে ঘাসের পাঁচিল ভেদ করে লেকের জল দেখা যাচ্ছে বটে। খুব অল্প।

ভুরু কুঁচকে জলের ধারে ফিরে এল ইন্দ্রনাথ। পেছনে আমরা। মিহির এসে গেছে। মন দিয়ে ফটো তুলছে জঙ্গল-বুটের দাগগুলোর। সামনেই একটা বড় লম্বা গুঁড়ি জলে পড়ে রয়েছে। অল্প গভীর জলে কাদায় গেঁথে রয়েছে। একটা প্রান্ত ঠেকে রয়েছে পাড়ে–আর,-একটা প্রান্ত প্রায় দশ হাত দূরে জলে।

ইন্দ্রনাথ এই গুঁড়ির ওপর দিয়ে ব্যালেন্স করে এগিয়ে গেল। ওদিকে পৌঁছে ঘুরে দাঁড়াল। চেয়ে রইল মিহিরের দিকে। তারপর ঘাসবনের দিকে।

তারপরেই মুখটা একটু বিকৃত হল।

যেন একটা কষ্ট চাপবার চেষ্টা করছে। খামচে ধরল পেটটা। গুঁড়ি বেয়ে টলতে টলতে ফিরে এল পাড়ে। বললে, টয়লেট যাব।

সত্যনারায়ণ বললে, চলুন।

ইন্দ্র বললে, আপনি মিহিরকে হেল্প করুন। লেকের উত্তর পাড় আর দক্ষিণ পাড়–যেখানে যেখানে ওথেলোর জঙ্গল-বুটের ছাপ ফটো চাই। টয়লেটটা ক্লাব হাউসের কোন দিকে?

ডান দিকে।

কষ্ট-বিকৃত মুখে আমাকে ডেকে নিয়ে প্রায় দৌড়েই ক্লাব হাউসে ফিরে এল ইন্দ্রনাথ। গাড়িটাকে ড্রাইভার গেটের মধ্যে এনে রেখেছে। পাঁচিল ঘুরে আমরা ভেতরে ঢুকে দেখলাম, গাড়ির মধ্যেই বসে রয়েছে সে।

ইন্দ্র গলা নামিয়ে বললে, মৃগ, তুমি শিস দিয়ে তোফা গান গাও শুনেছি।

অবাক হলাম, হঠাৎ এ কথা?

ড্রাইভারকে নিয়ে লেকের পাড়ে যাও–নৌকোয় চড়বার অছিলায়।

তারপর?

নৌকোয় চড়বে। পাড়ের কাছেই ঘুরবে। সত্যনারায়ণকে ফিরে আসতে দেখলেই শিস দিয়ে গান গাইবে। খুব জোরে। যাতে আমি শুনতে পাই।

তথাস্তু।

উত্তেজনায় চাহে কোই মুঝে জংলি কহে সুরটা শিস দিয়ে বের করে ফেলেছিলাম–মিহিরকে পেছনে ফেলে সত্যনারায়ণ তখন হনহন করে ফিরছে। আমার শিস শুনেই থমকে দাঁড়াল। তারপরেই আরও জোরে পা চালিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ক্লাবহাউসের দিকে–গাছপালার মধ্যে।

মিনিট কয়েক পরেই শুনলাম, বন্দুকের আওয়াজ। একবারই।

মিহির আগে দৌড়েছিল। পেছনে আমি আর ড্রাইভার। গেট পেরিয়েই বাঁ-দিকে কেয়ারটেকারের কটেজ–সামনে, চত্বরের ঠিক মাঝখানে, ক্লাবহাউস।

ইন্দ্ৰনাথ দাঁড়িয়ে আছে কটেজের সামনে। ধুতি আর পাঞ্জাবির লণ্ডভণ্ড অবস্থা দেখে বুঝলাম ভয়ানক ধস্তাধস্তি হয়ে গেছে এখুনি।

পারমিতা বললে, সত্যনারায়ণ! খুনি?

কথাটার জবাব না দিয়ে পুলিশ অফিসারকে বললে ইন্দ্রনাথ, শুধু একটা কলারবোন ভেঙে দিয়েছি। আর রদ্দা মেরে অজ্ঞান করে বেঁধে ফেলেছি–নইলে গুলি খেয়ে মরতাম।

ভালোই করেছেন। মুখখানা উল্কট গম্ভীর করে বললেন নাগরাজন। পুলিশ অফিসার। খুব সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা করছেন। কারণ, ভেতরে কৌতূহলে ফেটে পড়েছেন, কিন্তু আঁচ করলেন কী করে?

ওথেলোর পায়ের ছাপ দেখে।

ওথেলো এখন বসে পারমিতার পাশেই। চোখে সেই স্ফুলিঙ্গ আর নেই। শান্ত সরোবর বললেও চলে।

কী ছিল পায়ের ছাপে? নাগরাজনের প্রশ্ন।

সামান্য তফাত। জঙ্গল-বুট পায়ে দিয়ে ওথেলো যখন হেঁটে গেছেন–তখন তার শরীরের ভার সমান ভাবেই পড়েছে সব ছাপে। যে-ছাপের সারি নিয়ে আপনার সন্দেহবা, যা আপনার দোসরা প্রমাণ–

বলুন, বলুন—

ওথেলো নিজের জায়গা থেকে নাকি বেরিয়ে এসে, পাড় বেয়ে রামকুমারের পেছনে গিয়ে, গুলি ছুঁড়ে আবার ফিরে গেছে নিজের জায়গায়।

হা, হ্যাঁ, এই দুই সারি বুটের ছাপ তাই বলে বটে।

না, বলে না।

কেন বলে না?

মিহির ফটো তুলেছে, ক্যামেরা তুলে দেখাল মিহির কাঞ্জিলাল, আপনি বড় প্রিন্টে তফাতটা দেখতে পাবেন।

কী তফাৎ?

বুটের ছাপ কখনও সমান গভীর নয়। কখনও কম, কখনও বেশি। ওথেলো কি কখনও হালকা, কখনও ভারী হয়ে গেছিলেন?

ওথেলো নির্বাক।

নাগরাজনের প্রশ্ন, ছাপটা নকল?

অবশ্যই। হাতে ধরে কেউ নকল ছাঁচ কাদায় চেপে-চেপে বসিয়ে গেছে।

অসম্ভব। তারও পায়ের ছাপ থাকত কাদায়। নিশ্চয় শূন্যে উড়ে আসেনি।

না। জলে এসেছে।

চেয়ে রইলেন নাগরাজন। পাতলা ঠোঁট শক্ত করে চেপে রয়েছেন।

ইন্দ্রনাথ বললে, নৌকোয় করে সে এসেছিল। নৌকো থেকে নীচু হয়ে কাদায় ছাপ আঁকতে আঁকতে গেছে।

গুলিও ছুঁড়েছে নৌকো থেকে? পেছন-আঁকুনিতে টিপ ঠিক থাকে?

জবাব দিল না ইন্দ্রনাথ।

বললে, পেটের অসুখের অছিলায় চলে গেলাম সত্যনারায়ণের কটেজে। গাড়ি থেকে নেমেই সে আগে কটেজে ঢুকেছিল–দরজা ভেজানো ছিল। ভেতরে গেলাম। একটু খুঁজতেই পেলাম চারটে জিনিস।

বন্দুক আর গুলি দেখেছি। একই কোম্পানির তৈরি, একই মাপের, একই গুলি। ওথেলোসাহেবের যা আছে। অনেকদিন ধরেই সত্যনারায়ণ তাহলে তৈরি হচ্ছিল–এক্স আর্মি ম্যান– ফায়ার আর্মস-এর অসুবিধে ছিল না।

হ্যাঁ, অনেকদিন ধরেই তৈরি হচ্ছিল, ইন্দ্রনাথের গলার সুর এখন অন্যরকম। হেঁয়ালি ভাসছে কথার সুরে।

আরও একটু শক্ত হল নাগরাজনের ঠোঁট, তৃতীয় আর চতুর্থ জিনিস কী পেলেন?

এইটা, বলে পাঞ্জাবি তুলে কোমরে ধুতির ফঁক থেকে একজোড়া বস্তু বের করে টেবিলে রাখল ইন্দ্রনাথ।

ঝুঁকে পড়লাম আমরা সকলেই। ফ্ল্যাশ মেরে একখানা ফটোও তুলে নিল মিহির। ঝিলিক মেরে গেল সোনার গায়ে।

সোনার খড়ম। একজোড়া।

ইন্দ্রনাথ বললে, উলটে দেখুন। লেখা আছে রামকুমারকে দিলাম–স্বামী আত্মানন্দ। বাংলায় লেখা। আপনি বুঝবেন না। কিন্তু এটা তো বুঝছেন, খড়মজোড়া রামকুমারের।

স্খলিত স্বরে নাগরাজন বললেন, স্বামী আত্মানন্দ? মিশনের মহারাজা?

আপনি চেনেন?

না। নাম শুনেছি।

মিশনে টেলিফোন নিশ্চয় আছে? ফোনে কনট্যাক্ট করে দেবেন?

স্বামী আত্মানন্দ?

বলছি। আপনি?

ইন্দ্রনাথ রুদ্র। প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

বলুন।

রামকুমার সান্যালকে আপনি চেনেন?

চিনি।

তিনি খুন হয়েছেন।

ও। কে করেছে?

জানবার জন্যেই এই ফোন। আপনি এক জোড়া সোনার খড়ম তাকে দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

আপনার খড়ম?

আমার বটে। রামকুমারেরও বটে।

প্রাঞ্জল করে দেবেন?

এই মিশনের জমি আর বাড়ি রামকুমারের দান–সেইসঙ্গে ওই সোনার খড়ম। আমি তা পায়ে দিয়ে ওরই নাম লিখে উপহার দিয়েছিলাম। কিন্তু তা তো চুরি হয়ে গেছে।

কে চুরি করেছে জানেন?

না। ডাকাত পড়েছিল রামকুমারের বাড়িতে। চন্দনকাঠের ডাকাত। লুঠপাট করাই ছিল মতলব। সোনার খড়ম নিয়ে পালায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুলি চালিয়েছিল রামকুমার। জখমও করেছিল কয়েকজনকে। কিন্তু মেরে ফেলতে পারেনি। সে তো প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। খড়ম কোথায়?

আমার সামনে।

.

পারমিতা বললে, বছর চারেক হল সত্যনারায়ণ ক্লাবহাউসের চার্জে এসেছে। এক্স আর্মি ম্যান। দাঁতে দাঁতে পিষে, আগে ছিল চন্দন ডাকাত। এখন খুনি।

গায়ত্রীকে ডাকবেন? ইন্দ্রনাথের স্বর আশ্চর্য শান্ত। চোখে কিন্তু হিরের ঝিলিক–সেই রোশনাই, যা বিশেষ উপলক্ষে দেখা দেয়।

সোনার খড়মজোড়া তুলে রাখল পেছনে।

.

গায়ত্রী সামনে দাঁড়িয়ে। ও এখনও জানে না, সত্যনারায়ণ খুনি!

ইন্দ্রনাথ আমার দিকে চাইল। বললে, নৌকোয় রক্ত দেখেছিলে?

হ্যাঁ, বললাম আমি।

পারমিতা, ইন্দ্রনাথ এবার তাকিয়েছে পারমিতার দিকে, রামকুমারের খুনের খবর পেয়ে মরা হাঁস আর পাখিগুলোকে নৌকোয় করে আনা হয়নি? ঘাস বনেই পড়েছিল?

নিশ্চয়। তখন হাঁসের মাংস কে খাবে?

গায়ত্রী, এবার গায়ত্রীর দিকে তাকিয়েছে ইন্দ্রনাথ, ইংরেজি বোঝ?

ঘাড় নেড়ে সায় দিল গায়ত্রী। চোয়াড়ে মুখ শক্ত। যেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে।

ইন্দ্র বললে, সত্যনারায়ণ তোমাকে বন্দুক চালানো শিখিয়েছিল?

মনে হল, যেন একটা ঝিলিক দেখলাম গায়ত্রীর খরখরে চোখে। সে জবাব দিল না।

ইন্দ্র বললে, তোমার দাঁত ভাঙল কী করে?

গায়ত্রী নিশ্চপ। শরীর তার অল্প-অল্প দুলছে।

আমি বলছি, বলে গেল ইন্দ্রনাথ, নৌকো নিয়ে দুজনে বেরিয়েছিলেন। পারমিতা তখন বিছানায়। পাড়ে জুতোর ছাপ এঁকে গেল সত্যনারায়ণ। পোড়ামাটির ছাঁচ তোমার ঘরে পেয়েছি। মিঃ নাগরাজন–চতুর্থ জিনিস এই নকল জুতোর ছাঁচগাড়ির মধ্যে রেখেছিনিয়ে নেবেন। গায়ত্রী, তারপর তুমি উঠে দাঁড়ালে কাঠের গুঁড়িতে। গুলি চালালে বন্দুকের বাঁট পেছনে ছিটকে এসে তোমার দাঁত ভেঙে দিল–।

শ্বাপদ গর্জন শুনলাম গায়ত্রীর কণ্ঠে। চোখে বাঘিনীর চাহনি। বললে হিসহিসিয়ে, আই ডোন্ট কেয়ার।

কিন্তু কেন? কেন মারলে রামকুমারকে?

আমার ছেলেকে মেরেছিল বলে।

গুলি করে? বারান্দা থেকে? সোনার খড়ম নিয়ে পালানোর সময়ে? ডাকাত ছিল তোমার ছেলে?

পেছন থেকে সোনার খড়ম জোড়া সামনে এনে বাড়িয়ে ধরল ইন্দ্রনাথ।

জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল গায়ত্রী।

*দক্ষিণী বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত। শারদীয় সংখ্যা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *