1 of 2

বেঁচে উঠলেন ফাদার ঘনশ্যাম

বেঁচে উঠলেন ফাদার ঘশ্যাম

সুনামের মতো একটা জিনিস ফাদার ঘনশ্যাম মণ্ডল মাঝে-মাঝে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন। আবার এক-একটা সময় আসে, সুনামের আনন্দে বুঁদ হয়ে থাকতে পারেন না। অল্প সময়ের জন্য হলেও এইরকম ঘটনা তার জীবনে প্রায় ঘটে। কখনও তিনি কাগজে-কাগজে পৃথিবীর নবম আশ্চর্য হয়ে থাকেন, সাপ্তাহিকীর সমালোচনা স্তম্ভের বাগবিতণ্ডার মধ্যেও তাঁর ঠাই হয়ে যায়, ক্লাব আর ড্রইংরুমে তাঁকে নিয়ে মুখরোচক আড্ডা জমে–সেইসব আড্ডায় তার নিপুণ আর বুদ্ধিদীপ্ত গোয়েন্দাগিরির অনুপুঙ্খ বর্ণনা অত্যন্ত ভুলভাবে পরিবেশন করা হয়। আর এই জিনিসটা বেশি করে ঘটে এই পশ্চিমবঙ্গেই। ফাদার ঘনশ্যামকে যারা জানে, তাদের কাছে এই গপ্পোগুলো বেশ বেখাপ্পা আর অবিশ্বাস্য মনে হয়। তা সত্ত্বেও, ডিটেকটিভ হিসাবে ফাদার ঘনশ্যামের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি অনেক ম্যাগাজিনেই বেরচ্ছে।

আশ্চর্য এই যে, ভ্রাম্যমান এই বহুল প্রচারিত আলোকবর্তিকা দীপ্যমান হলেন অতি প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে সুদূরের সেই অঞ্চল তাঁর নিবাস থেকে বহু-বহু দূরে। তাকে একটা দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল বিশেষ সেই জায়গায়। কাজটা মিশনারী বিষয়ক বটে, আবার গ্রাম্য গির্জা বিষয়কও বটে। জায়গাটা ভারতের একদম উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। যেখানে স্বাধীনতাকামী উপজাতীয়রা নিত্য সংঘর্ষ আর চোরাগোপ্তা খুন-জখম যেন তেন প্রকারেণ চাগিয়ে রেখেছে, যেখানকার সন্ত্রাসবাদে গোপনে মদত দিয়ে চলেছে ভারতের বাইরের রাষ্ট্রশক্তিরা–ভারতকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন আর দুর্বল করার প্রয়াসে। সব রকম গাত্রবর্ণের মানুষই এখানে থাকে সাদা, কালো, হলদেটে। পর্যটন পিয়াসীরা প্রায় সারা বছর টহল দিয়ে যায় সেখানে কারণ, জায়গাটাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে ভারতের দ্বিতীয় ভূস্বর্গ বলা চলে।

গোলমালটা শুরু হল এইরকমই এক পর্যটককে নিয়ে। দ্বিতীয় ভূস্বর্গে পা দিয়েই তিনি তার একটা ব্যাগ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ভীষণ বিরক্ত, ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন প্রথমেই যে বাড়িটা দেখলেন, সেই বাড়ির মধ্যে।

বাড়িটা সেই অঞ্চলের মিশন-হাউস, গ্রাম্য-গির্জা রয়েছে পাশেই। বাড়ির সামনে টানা লম্বা বারান্দা। সারি-সারি পোঁতা খুঁটি পাক দিয়ে বেড়ে উঠেছে কালো আঙুর–পাতায় ম্যাড়মেড়ে লালচে ভাব। এর ঠিক পেছনে একইভাবে সারবন্দি ভাবে বসে রয়েছে সিধে শক্ত খুঁটির মতো অনেকগুলো মানুষ–গায়ের রং তাদের আঙুর ফলের মতোই কালো। তাদের কারোরই চোখের পাতা পড়ছে না। চামড়ায় লেগে আছে যেন বৃষ্টিবনের গাছের শ্যাওলা। এদের অধিকাংশ লম্বা বিড়ি টানছে– ছোট চুরুট বলা যায়। ছোট্ট এই দলে ধূমপানই একমাত্র নড়াচড়ার চিহ্ন। পর্যটক মহাশয়ের বর্ণনায় এরা নিছক উপজাতি ছাড়া কিছু নয়। যদিও এদের কয়েকজন মহাভারতের মধ্যম পাণ্ডবের বংশধর বলে দাবি করে।

ভদ্রলোক কলকাতায় থাকেন। একটি দৈনিক সংবাদপত্রের সাংবাদিক। ছিপছিপে তনু, চুল ফঁকা-ফাঁকা, অসাধারণ নাক। অ্যাডভেঞ্চারাস এই নাক দেখলেই মালুম হয় পিঁপড়ে-খেকো প্রাণী যেমন তার দীর্ঘ নাকের ডগা দিয়ে পরখ করে নেয় সামনের পথ ঠিক আছে কিনা, ইনিও সেই বিদ্যায় বিলক্ষণ রপ্ত। সংবাদ নাকি সাংবাদিকদের কাছে দৌড়ে চলে আসে। ইনি এঁর নাকের ডগা দিয়ে সংবাদ টেনে নেন, যাচাই করেন, তারপর ছেপে দেন।

আশ্চর্য এই পুরুষের নামটাও। নাক উঁচু করে চলবেন ভবিষ্যতে, নামকরণের সময়ে তাঁর বাবা-মা বোধহয় সেই তথ্য অবগত ছিলেন–তাই তার নাম রেখেছিলেন–নাকেন্দ্র। পরে নিশ্চয় তারা ধ্যানযোগে উপলব্ধি করেছিলেন, এহেন নামের অধিকারী হয়ে পুত্রকে বিস্তর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই তারা অন্য একটা নাম দেন-বরেন্দ্র। যৌবন উপস্থিত হওয়ার পর বরেন্দ্র জানতে পারলেন, দুটি কারণে তিনি কোনও মহিলার বর হতে পারছেন না। এক, তার অ্যাডভেঞ্চারাস নাক– দুই, তাঁর বরেন্দ্র নাম। নাক ছাঁটাই করা সম্ভব নয়। তাই তিনি নাম ছাঁটাই করলেন। বর বাদ গেল, হয়ে গেলেন শুধু ইন্দ্র। যদিও নামের দৌলতে ঋগবেদের প্রধান দেবতার একটি ছাড়া কোনও গুণই তিনি অর্জন করতে পারলেন না। যেটি পারলেন, সেটি হল, অন্যান্য সাংবাদিকদের ওপর ছড়ি ঘোরানো। যেমন করতেন দেবরাজ–দেবতাদের ওপর কর্তৃত্ব।

এঁর উন্নাসিকতা একটি ব্যাপারে তাকে উগ্রপন্থী করে তুলেছিল। ধর্মচর্চা তোক স্বতঃস্ফূর্ত– তা যেন থাকে সংগঠনের বাইরে। দেবালয় ছিল তাঁর দু-চক্ষের বিষ, সাংগঠনিক ধর্ম প্রচারের ব্যাপারে তাঁর কলম থেকে অ্যাসিড ঝরে। এহেন মানসিকতার মানুষ যখন ব্যাগ হারিয়ে ক্ষিপ্ত হন এবং প্রথম বাড়িটাকেই দেখেন মিশন-হাউস, তখন তার ওপর উগ্রচণ্ডীর ভর হওয়া স্বাভাবিক। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো তিনি দেখলেন বিলকুল নিষ্কর্মা এবং ধরণী সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন কয়েকটি মানুষ নিমগ্নচিত্তে বিড়ি সেবন করছে কাষ্ঠ পুত্তলিকাবৎ। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি প্রদানের মতোই চিড়বিড় করে উঠলেন ধ্যানস্থ ধূমপায়ী ওই কয়েকজনের ওপর। নির্লজ্জভাবে সময়ের এহেন অপব্যবহার যে নিদারুণ অদক্ষতার লক্ষণ, তা জ্বালাময়ী ভাষায় প্রকাশ করতে কসুর করলেন না। অতঃপর তিনি যে প্রশ্নবাণটি নিক্ষেপ করলেন, সেটি তাঁর প্রিয় ব্যাগঘটিত। প্রিয় বস্তু ফিরিয়ে আনার তিলমাত্র উদ্যোগ না দেখিয়ে ধূমপায়ী কজন যখন ধূমপানকেই ধ্যানযোগের প্রথম ধাপ বলে বিবেচনা করল এবং বাক্যহারা হয়ে রইল–তখন তিনি বাগবিস্তারের গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে রাখলেন এবং একাই কথা বলে গেলেন।

কল্পনার চোখে দেখে নিন, প্রখর রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে কয়েক বিঘৎ লম্বা পেরেকের মতো সিধে একটা লোক গলা চড়িয়ে কথাই বলে যাচ্ছেন, তার পোশাক অতীব পরিচ্ছন্ন, ইস্পাতকঠিন মুঠোয় ঝুলছে একটা ব্রিফকেস। ছায়ায় সমাসীন নিষ্কম্প কয়েকটি মানুষকে লক্ষ করে তিনি অনর্গল বকে চলেছেন। উচ্চকণ্ঠে অতি যত্নে তিনি প্রথমে ব্যাখ্যা করেছিলেন কীভাবে ধূমপায়ী পুরুষ কজন এমন অলস আর কদর্য হয়ে উঠেছে। এদের এই পশুবৎ আচরণ চূড়ান্ত তামসিকতার লক্ষণ এবং এরা পশুর চাইতেও অধম। অনেক আগেই নিজেদের এহেন আদিম বর্বরতা এদের বোঝা উচিত ছিল। বক্তার ধারণা, পাদরিদের অনিষ্টকর প্রভাব রয়েছে এর মূলে। এই একটি কারণে এতগুলি লোক। দারিদ্রের চরম সীমায় পৌঁছেছে, চূড়ান্তভাবে নির্যাতিত হয়েছে এবং উপায় না পেয়ে ছায়ায় বসে অনর্গল ধূমপান করে চলেছে।

তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতার শেষাংশ ছিল এইরকম, অত্যন্ত নরম প্রকৃতির মানুষ তোমরা, তাই তোমাদের পায়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে মুকুটধারী পাদরিরা, তাদের গায়ে ঝকমকে সোনার আলখাল্লা, তোমাদের পরণে ছেঁড়া পোশাক। অত্যাচারীর ভূমিকায় থেকে এরা ফেটে পড়ছে আত্মম্ভরিতায়। ঠকিয়ে যাচ্ছে তোমাদের ঝকমকে ক্রাউন, চাদোয়া আর পবিত্র ছাতার ঐশ্বর্য দেখিয়ে, তোমরা বোবা বনে রয়েছ এদেরই সামনে। ভাবছ এবং তোমাদের ভাবানো হয়েছে–এরাই নাকি ধরণীর রাজা, আকাশ থেকে নেমে এসেছে তোমাদের ভালো করার জন্যে। কতখানি ভালো হয়েছে তা আয়নায় নিজেদের দেখলেই হাড়ে হাড়ে টের পাবে। নিজেদেরই কান্না পাবে। বড়-বড় কথা আর জাঁকজমক দেখিয়ে তোমাদের ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে বলেই আজ তোমাদের এই হাল হয়েছে। বর্বরতার পর্যায়ে নেমে এসেছ, লিখতে জানো না, পড়তেও জানো না–

ঠিক এই সময়ে পাদরিসাহেব স্বয়ং বেরিয়ে এলেন মিশন-হাউসের বাইরে। নিতান্ত দীনহীন পোশাকে। প্রায় ছুটতে ছুটতে এলেন। তাঁর মাথায় নেই স্বর্ণকিরীট, অঙ্গে নেই মহার্ঘ বস্ত্র। চালচলন মর্যাদাব্যঞ্জক নয় মোটেই। বরং তার বিপরীত। গগন থেকে খসে পড়া ধরণী-সম্রাট মনে হওয়া দূরে থাক, প্রথম দর্শনেই তাকে নিতান্ত হাঘরে মানুষ বলে মনে হয়। অন্যের ব্যবহার করা কালো আলখাল্লায় মোড়া যেন একটা বেঢপ বান্ডিল। মাথায় মুকুট- ফুকুটের বালাই নেই। চকচক করছে টাক। হোঁকা আকৃতি নিয়ে তিনি বিষম বেগে বেরিয়ে নিস্পন্দ ধূমপায়ীদের কী যেন বলতে গেলেন, কিন্তু আগন্তুককে দেখেই দ্রুতস্বরে বললেন–

আরে! আরে! বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি। ভেতরে আসতে পারেন–স্বচ্ছন্দে।

ভেতরে এলেন সাংবাদিক ইন্দ্র। বিবিধ বিষয়ে তার জ্ঞানবৃদ্ধিও ঘটতে লাগল তখন থেকে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, পূর্ব ধারণার চাইতে শক্তিশালী ছিল ভদ্রলোকের সাংবাদিক-কৌতূহল আর সহজাত প্রবৃত্তি। সেয়ানা সাংবাদিকদের যা অবশ্যই থাকে। প্রচুর প্রশ্ন করে গেলেন। জবাব শুনে চমৎকৃত হলেন। আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পেল। যা ছিল তার বক্তৃতার পাদদেশে–অর্থাৎ কেলে মর্কট মানুষগুলো লিখতে জানে না, পড়তেও জানে না–এই ব্যাপারেই আবিষ্কৃত করলেন যে তথ্য, তা তাঁর পূর্ব ধারণা নস্যাৎ করে ছাড়ল। এরা সবাই দিব্বি লিখতে পারে, চমৎকার পড়তে পারে। কারণ একটাই। বেঢপ চেহারার এই পাদরি নিজে তাদের লিখতে পড়তে শিখিয়েছেন। কিন্তু কেউই এই দুটোর ধার ধারে না। তার কারণ আছে। ওরা কথা বলতে ভালোবাসে। কথার মাধ্যমেই শেখে, কথার মাধ্যমে শেখায়, কথার মাধ্যমেই বোঝায়। স্রেফ প্রাকৃতিক পন্থা তাদের বেশি পছন্দসই। সাংবাদিক মশায় আরও জানলেন, এই যে অদ্ভুত মকুটে মানুষগুলো আবলুস কাঠের তৈরি পুতুলের মতো চুপচাপ বসে, মাথার এক গাছি চুলও না নাড়িয়ে, অপদার্থ অলসের মতো এক নাগাড়ে লম্বা বিড়ি টেনে যাচ্ছে–এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত কর্মঠ নিজস্ব জমিতে। সাংবাদিকের বিস্ময় আরও বেড়ে গেল যখন জানলেন, ভিখিরির মতো দেখতে হলেও ওদের প্রত্যেকের নিজেদের চাষ-আবাদের জমিজমা রয়েছে। অর্থাৎ দারিদ্র্য কী জিনিস, তার স্বাদ এখনও পায়নি। এরা গতর খাটায়, অল্পে সন্তুষ্ট হয়, বাকি সময়টা প্রতিবেশীদের মঙ্গল চিন্তা করে এবং অত্যন্ত সুখী জীবনযাপন করে। জমিজমার মালিক হওয়ার ব্যাপারে পাদরি সাহেবের অবদান আছে সামান্য এবং পলিটিক্সে শুধু এই ক্ষেত্রেই তিনি নাক গলাতে বাধ্য হয়েছেন। বংশ পরম্পরায় এরা জমি ভোগ করে এসেছে। পাদরি সাহেব শুধু দেখেছেন, বংশধরদের কেউই যেন জমি নেই বলে গা ঢালা দিয়ে কাটায়। জমি পাইয়ে দিয়েছেন প্রত্যেকেই। স্থানীয় পলিটিক্সে এইটাই সর্বশেষ হস্তক্ষেপ। নাস্তিকদের আধিপত্য এখানে বেড়েই চলেছে। তাদের প্রচার বিজ্ঞানকেন্দ্রিক। ফলাও করে বিজ্ঞান যুক্তিনিষ্ঠ সংগঠনরা জানিয়ে যাচ্ছে, ভগবান টগবান কিছু নেই। চার্বাকনীতি অনুসরণ করো। পরলোকের কথা না ভেবে ইহলোকেই গুছিয়ে নাও। ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে ব্যবসা, তা লাটে তুলে দাও। দৈব ঘটনা, অলৌকিক ঘটনা–এসব ধর্মব্যবসায়ীদের বাকতাল্লা–একদম কান দেবে না। জানবে, সবই বিজ্ঞাননির্ভর। বিজ্ঞানে যার ব্যাখ্যা হয় না, বুজরুকি দিয়েও তা মগজে ঢোকানো যায়। ব্যাখ্যা একটা কোথাও আছে, বিজ্ঞান সেই ব্যাখ্যার নাগাল ধরে ফেলবেই। সেদিনই বুঝবে দৈব মাহাত্ম স্রেফ বোলচাল, ধর্মের নামবলী গায়ে দিয়ে লোক ঠকানোর কারবার।

একটা গুপ্ত সমিতির অভ্যুদয় ঘটেছে স্থানীয় পলিটিক্সের এহেন গোলমেলে পরিস্থিতিতে। মাঝে-মাঝে দাঙ্গা বাধাচ্ছে এই সমিতি বিজ্ঞান আর সমাজ কল্যাণের অজুহাতে। প্রচলিত বিশ্বাস আর সংস্কারের এক তীব্র সমালোচক এই সমিতির কর্ণধার। নাম তার আলভারেজ। পূর্বপুরুষ ছিলেন পর্তুগীজ। রক্তের গরম এখনও তার ধমনিতে বইছে। নিন্দুকরা অবশ্য বলে, নিগ্রো রুধির কিঞ্চিৎ পরিমাণে মিশেছে তার ধমনীতে। ভদ্রলোক সুসংগঠক। এ জায়গার বেশ কয়েকটা লজ আর মন্দিরের একচ্ছত্র অধিপতি, সেসব জায়গায় গোপনে চলে নাস্তিকতার আরাধনা কাজকর্ম বিলক্ষণ হেঁয়ালিপূর্ণ।

রক্ষণশীল যারা, তারা সংগঠিত হয়েছে যে ব্যক্তির ছাতার তলায় তিনি বিলক্ষণ বিত্তবান পুরুষ। বেশ কয়েকটা কারখানার মালিক। পয়সা আছে, মানসম্মানও আছে। তবে তার নাম শুনলেই লোকে চনমনে বোধ করে না। নিজে সম্ভ্রান্ত হয়েও পাঁচজনের সঙ্গে মিশে থাকেন। নাম তার রঞ্জুলাল। রঞ্জুলাল যদি উঠেপড়ে না লাগতেন এবং মিশন-হাউসের পাদরির সঙ্গে হাত না মেলাতেন তাহলে এখানকার সব চাষি জমির মালিক হতে পারত না। ফাদার ঘনশ্যাম মণ্ডল সুকৌশলে এই ব্যক্তিকে দিয়ে মস্ত এই কাজটা করাতে পেরেছেন বলেই দাঙ্গাহাঙ্গামা এখানে কমে গেছে-শান্তি-শৃঙ্খলা বহাল রয়েছে।

সাংবাদিক ইন্দ্রকে এইসব কথা যখন বলে যাচ্ছেন ফাদার ঘনশ্যাম, সেই সময়ে রক্ষণশীল নেতা রঞ্জুলাল ঢুকলেন ঘরে। ভদ্রলোক কৃষ্ণকায় পুরুষ। অস্বাভাবিক পেটমোটা। গোটা শরীরটায় যেন হাওয়া ঢুকিয়ে ফুলিয়ে টানটান করা হয়েছে–ফুটবলে যা করা হয়। টোকা মারলেই বুঝি টং করে আওয়াজ হবে। তার মুখ গোল, গালে আর চিবুকে প্রচুর মাংস, কিন্তু মাথায় চুল নেই মোটে, বিলকুল তেলতেলে মাথা। সুগন্ধী চুরুট টানতে টানতে ঘরে ঢুকেই তিনি থিয়েটারি ঢঙে চুরুট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে নিভিয়ে দিলেন। যেন ফাদার ঘনশ্যামকেই তিনি খোদ গির্জে বলে মনে করছেন। বাতাসে মাথা ঠুকে অভিবাদনও সারলেন আশ্চর্যভাবে কোমর বেঁকিয়ে–ওইরকম টাইট ফিগারে ঝট করে এতখানি বেঁকে পড়া অসম্ভব। কিন্তু অসম্ভবকেই তিনি সম্ভব করলেন। তবে হ্যাঁ, সামাজিক মেলামেশায় রঞ্জুলাল অতি মাত্রায় নিষ্ঠাবান পুরুষ বিশেষ করে ধার্মিক ব্যক্তিদের সমীপে এলে তিনি যেন তার সমস্ত অহংবোধ নিমেষে নিক্ষেপ করেন মাটির দিকে। এই ব্যাপারে তিনি পাদরিদের চেয়েও বেশি পাদরিপ্রতিম। বিড়ম্বিত বোধ করলেন ফাদার ঘনশ্যাম–প্রাইভেট লাইফে এতটা বিনয় তাঁকে বরাবর বিচলিত করে।

বললেন ফিকে হেসে, পাদরিদের মতো গড়ে উঠিনি আমি। তবে এটাও ঠিক যে পাদরিদের হাতে গড়বার ভার পুরো ছেড়ে দিলে, পাদরিজননাচিত হত না কিছুই।

হঠাৎ উৎফুল্ল হলেন সাংবাদিক ইন্দ্র–মিঃ রঞ্জুলাল, আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় তো আগেই ঘটেছে। মনে পড়ছে? বম্বের ট্রেড কংগ্রেসে গেছিলেন?

মিঃ রঙুলালের মাংসল চোখের পাতা পাখা ঝাঁপটাল বারকয়েক। হাসলেন নিজস্ব ঢঙে। বললেন, মনে পড়েছে।

ঘণ্টা দুয়েক চলেছিল মিটিং। কাজ হয়েছিল অনেক। আপনিও অনেক বদলে গেছেন।

কপাল ভালো অমন জায়গায় যেতে পেরেছিলাম, রঞ্জুলাল বেশ বিনীত।

সৌভাগ্য তাদের কাছেই আসে সৌভাগ্যকে যারা লুফে নিতে পারে,–সোৎসাহে বলে গেলেন সাংবাদিক ইন্দ্র, কথায় বাধা দিচ্ছি না তো?

একদম না। রঞ্জুলালের জবাব, পাদরিসাহেবের কাছে হামেশা আসি স্রেফ দুটো কথা বলার জন্য–যা প্রাণে আসে, তাই বলে যাই কাজের কথা থাকে না।

ফাদার ঘনশ্যামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর অন্তরঙ্গতা সঞ্চারিত হয়েছিল সাংবাদিক ইন্দ্রর মধ্যেও। দেখতে-দেখতে নৈকট্যবোধ এসে গেল তিনজনের মধ্যেই। রকমারি আলোচনায় মুখর হলেন তিন পুরুষ। অচিরে সাংবাদিক ইন্দ্র উপলব্ধি করলেন, মিশন-হাউস ইত্যাদি ব্যাপারে তার পূর্ব ধারণাকে বেশি পাত্তা দেওয়া ঠিক হচ্ছে না সাদামাটা পাদরির সামনে। ইনি মুখে খই না ফুটিয়ে আর চেহারায় চমক না দেখিয়ে সমাজের যা মঙ্গল করে চলেছেন, তা অনেক বাক্যবীরের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি নিজেই শেষকালে প্রস্তাব করলেন, ফাদার ঘনশ্যামের এত কিছু সুকর্ম, তিনি দেশময় প্রচার করতে চান তাঁর সুলেখনীর মাধ্যমে। আর ঠিক সেই কথার পরেই ফাদার ঘনশ্যাম বুঝলেন, সাংবাদিক ইন্দ্রর বৈরী আচরণ যদিও বা বরদাস্ত করা যায়, তার সহানুভূতির সুর তিনি সহ্য করতে পারছেন না।

সাংবাদিক ইন্দ্র কিন্তু এমন উপকরণ কি ছাড়তে পারেন? কোমর বেঁধে লেগে গেলেন। ফাদার ঘনশ্যামকে নিয়ে ফিচারের পর ফিচার লিখে গেলেন ইংরিজি আর বাংলা পত্রপত্রিকায়। উচ্চ প্রশংসায় ঠাসা সেইসব লেখা সাগরপাড়ের কাগজেও ছাপা হতে লাগল বিশেষ করে আমেরিকায়। মধ্যপ্রাচ্য ছেয়ে গেল তার লেখালেখিতে। মিডলওয়েস্টের দেশগুলি উদগ্রীব হয়ে রইল ফাদার ঘনশ্যামের নতুন নতুন কাহিনি জানবার আশায়। খর্বকায় কুমড়ো আকৃতি ফাদারের নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার ফটো তোলা হল দেদার এবং বিশাল ছবি ছাপা হয়ে যেতে লাগল যুক্তরাষ্ট্রের বহুল প্রচারিত রবিবাসরীয় পত্রিকাগুলোয়। বেচারা ফাদার ঘনশ্যাম! প্রচারের দানবিক চাকার ঘূর্ণন বন্ধ করতে পারলেন না তিনি কিছুতেই। তার নিছক কথাগুলোকে তার বাণী বানিয়ে কাগজে-কাগজে ছাপিয়ে যেতে লাগলেন সাংবাদিক ইন্দ্র। ফাদার ঘনশ্যামের বাণী ফ্যালনা জিনিস নয়। বড়-বড় পোস্টার বানিয়ে বিক্রির ব্যবসাও জমে উঠল দেখতে-দেখতে। মোটা হরফের ওপর ফাদারের শ্রীহীন আকৃতি শোভা পেতে লাগল ঘরে-ঘরে। এরপর দেখা গেল, তার মুখের সামান্য কথা বাণীতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর স্লোগানে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন মিছিলে সেই স্লোগান পাইকারি হারে কাজে লাগানো হচ্ছে। আমেরিকা ছাড়া অন্য দেশের মানুষের কাছে একসময় বড় একঘেয়ে লাগতে লাগল ফাদার ঘনশ্যামকে নিয়ে বাড়াবাড়ি দেখে। কিন্তু আমেরিকা জাতটা আলাদা। ম্যাডাম ব্ল্যাভাটস্কি, কর্নেল অলকট, অ্যানি বেসান্ত প্রমুখ থিয়সফিস্টদের ধারণা অনুসারে মানুষ জাতটার বর্শাফলক এই আমেরিকান জাত– এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। নতুন কিছু পেলে তার সমাদর করতে তারা জানে। তাই তারা সাদর আমন্ত্রণ জানাল ফাদার ঘনশ্যামকে। বেশি কিছু না, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি স্টেটে যাবেন এবং একটি করে বক্তৃতা দেবেন। ফাদার ঘনশ্যাম সবিনয়ে সেই সব আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করলেন। পরিণামে তার সম্পর্কে আমেরিকান মানুষের শ্রদ্ধা দ্বিগুণ-ত্রিগুণ হয়ে গেল। ফাদার ঘনশ্যাম নাকি এক বিস্ময়। আমেরিকায় বিনা পয়সায় বেড়াতে চান না যিনি, তিনি নিশ্চয় লোকাতীত ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং আরও লোভনীয় প্রস্তাবের পর প্রস্তাব আসতে লাগল তার কাছে। বেচারি ফাদার ঘনশ্যাম! ঠিক এই সময়ে গল্পের সিরিজ ছাপা হতে লাগল তাঁকে কেন্দ্র করে, শার্লক হোমস-এর গল্পের মতো। বলা বাহুল্য, এই জাতীয় গল্প লেখা আর ছাপানোর মূলেও সক্রিয় রইল সাংবাদিক ইন্দ্রর অত্যুৎসাহ। প্রায় সব গল্পের প্লটে অনুরোধ থাকছে একটাই–মহামান্য বুদ্ধিবর ফাদার ঘনশ্যাম যেন এই জটিল সমস্যাটার সমাধান করে দিয়ে যান শার্লক হোমস স্টাইলে। গল্পের স্রোত বাড়তে বাড়তে যখন মহানদী হতে চলেছে, অনুরোধ-উপরোধের ঢেউ যখন প্লাবন আকারে ফাদার ঘনশ্যামকে ভাসিয়ে দিতে চলেছে, যখন প্রত্যাখান করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন ফাদার, তখন তিনি একটাই অনুরোধ করেছিলেন– বন্ধ করো এইসব গল্প ছাপানো, প্রত্যাখ্যান করলেই যখন তা নব কলেবরে নতুন আমন্ত্রণ আকারে আবির্ভূত হচ্ছে, তখন দিলেন স্থগিতাদেশ, অবশ্যই বিনীত অনুরোধের মোড়কে পুরে।

সাংবাদিক ইন্দ্র এই পয়েন্টটা লুফে নিয়ে মোচড় দিলেন অন্যদিকে। গুজবের স্রোত বইয়ে দিলেন অন্য খাতে। ডক্টর ওয়াটসনের হিরো একদা সাময়িকভাবে পাহাড়চুড়ো থেকে যেভাবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল–ফাদার ঘনশ্যাম মণ্ডলও সেইভাবে সাময়িকভাবে অদৃশ্য হয়ে গেলেই তো হয়।

যথা নিয়মে কাকুতি-মিনতি তেড়ে এল ফাদার ঘনশ্যামের দিকেই। কেন তিনি বিশ্ববরেণ্য শার্লক হোমসের অনুকরণে সাময়িকভাবে লোকচক্ষু থেকে অদৃশ্য হচ্ছেন না?

দাবির পর দাবি। দাবির পর দাবি। হেদিয়ে উঠেও অপরিসীম ধৈর্য সহকারে প্রতিটি দাবির জবাব লিখে জানিয়ে দিলেন ফাদার ঘনশ্যাম, সাময়িকভাবে নিজেকে অন্তর্ধান করানোর বিকল্প প্রস্তাবে জানালেন তাকে নিয়ে লেখা গল্পগুলো সাময়িকভাবে অন্তর্ধান করলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। তিনি নিজে অন্তর্হিত হবেন কি না হবেন–সেটা নির্ভর করছে গল্পগাছার তিরোধানের ওপর। দিনে দিনে জবাব দেওয়া তিনি কমাতে লাগলেন। জবাবের বয়ানও দিনে দিনে সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর হতে লাগল। শেষ জবাবটা লেখবার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

আমেরিকা জুড়ে যখন কোনও হইচই আরম্ভ হয় তখন তার রেশ এসে পড়ে এই পোড়া দেশে। একেই বলে পশ্চিমী প্রভাব। সাদা চামড়া যখন নেচেছে কালো চামড়ার ফাদার ঘনশ্যামকে নিয়ে, তখন এখানেও শুরু হয়ে যাক হুজুগের নাচ। বিশেষ করে যে অঞ্চলটিতে ফাদার ঘনশ্যাম প্রায় লুকিয়ে থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন প্রচার আর আড়ম্বর বাদ দিয়ে, ঠিক সেই জায়গাটাতেই হুদো-হুঁদো পর্যটকের আসা শুরু হয়ে গেল, শুধু গোটা ভারত থেকে নয়, আমেরিকা আর ইউরোপ থেকেও। পর্যটন ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো ঘটে গেল। ফাদার ঘনশ্যামের নামাঙ্কিত পথ নির্দেশক ফলক পুঁতে দেওয়া হল রাস্তার মোড়ে-মোড়ে। ফাদার ঘনশ্যামের নাম লেখা বিশেষ টুরিস্ট বাসও আসতে লাগল। দুর্গমতম সেই দ্বিতীয় ভূস্বর্গে। দলে-দলে মানুষ পিলপিল করতে লাগল ছোট্ট ওই জায়গায়। যেন কুতুবমিনার দেখতে ছুটছে। সবচেয়ে ঝামেলা বাধাল স্থানীয় দোকানদাররা। তাদের কেউ ফাদার ঘনশ্যামের মূর্তি বানিয়ে চড়া দামে বেচে লাল হয়ে গেল দু-দিনেই, কেউ বেচতে বসল তাবিজ-মাদুলি-লকেট। সবেতেই ঝুলছে ফাদার ঘনশ্যামের ছবি, নয়তো লেখা রয়েছে তার মুখনিঃসৃত অমৃতবাণী। নাজেহাল হলেন আর এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের ধান্দাবাজিতে। অষ্টপ্রহর তারা হানা দিয়ে গেল গোবেচারা পাদরির ওপর একটা মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের বানানো দ্রব্যটার গুণের তারিফ করে দেওয়া হোক লিখিতভাবে। কোনও শংসাপত্রই যখন ছাড়া হল না ফাদারের তরফ থেকে, তখন আসতে লাগল চিঠির স্রোত। সবাই জানে ফাদার ঘনশ্যামের এই একটি দুর্বলতার সংবাদ সাহিত্যিক না হয়েও তিনি পত্র-সাহিত্যের সমাদর করেন। কারও মনে কষ্ট দেন না। চিঠি এলে চিঠির জবাব দেন। প্রথম-প্রথম তিনি পত্রদাতাদের উদ্দেশ্য ধরতে পারেননি বলে এন্তার জবাব দিয়ে গেছেন। তারপর জানলেন–তার সই-এর জন্যই এত চিঠি লেখা হচ্ছে, আর তাঁর অটোগ্রাফ চড়া দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ভালো মানুষের এই অবস্থাই হয়। কাউকে ফেরাতে পারেন না, ফেরাতে পারেননি মদ্য প্রস্তুতকারক সুরজলালকে। খচমচ করে দুটো লাইন লিখে দিয়েছিলেন পুঁচকে একটা কার্ডে। আর এই লেখাটাই হল তার কাল। জীবনের মোড় ফিরিয়ে দিল বড় ভয়ংকরভাবে।

সুরজলাল মানুষটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অনর্থক বাড়াবাড়ি করেন। ছোটখাটো চেহারা, কঁকড়া চুল, চোখে সোনার রীমলেস চশমা। উনি একটা মেডিসিন্যাল পোর্ট মদ্য প্রস্তুত করেছিলেন। দাম খুবই কম রেখেছেন। গরিব-গেরস্তরা যাতে অসুখ-বিসুখ কাটিয়ে উঠে স্বচ্ছন্দে কিনে খেতে পারেন। ফাদার ঘনশ্যাম গরিবদের কাছে ভগবান সমান। তিনি যদি এই ওষধি-সুরা সামান্য চেখে দেখেন এবং তার মতামত জানিয়ে দেন, তাহলে আখেরে গরিবদেরই উপকার হবে। এরপরেও একটু আম্বা দেখালেন সুরজলাল। কখন এবং কোথায় বসে সুরা চাখবেন ফাদার ঘনশ্যাম তা যদি দয়া করে সংলগ্ন কার্ডটায় লিখে দেন, তাহলে চিরঋণী থাকবেন মদমেকার সুরজলাল।

আম্বা শুনে অবাক হলেন না ফাদার ঘনশ্যাম। বিজ্ঞাপনদাতাদের উকট উন্মাদনা কত দিকে মোড় নিতে পারে, তা তাঁর অজানা ছিল না। তাই তিনি কার্ডে যৎসামান্য লিখে দিয়ে হাতের কাজে মন দিলেন। যে কাজ করলে তিনি আনন্দ পান। কিন্তু বাধা পেলেন আবার। এবার চিরকূট পাঠিয়ে কাজে বাগড়া দিলেন যিনি, তিনি বাজে লোক নন। পাঠিয়েছেন তাঁর পলিটিক্যাল শত্রু আলভারেজ। গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ের মিটমাট করতে চান তিনি। মিটিং হোক আজকেই রাতে শহরের প্রাচীরের বাইরে একটা কফি হাউসে। ফাদার ঘনশ্যাম যদি রাজি থাকেন, এক লাইন লিখে বার্তাবাহকের হাতে যেন এখুনি পাঠিয়ে দেন। বার্তাবাহক লোকটা মার্কামারা দাঙ্গাবাজ টাইপের। যেমন চেহারা, তেমনি চাহনি। তাকে বিদেয় করার জন্য ঝটপট এক লাইনে সম্মতি জানিয়ে দিলেন ফাদার ঘনশ্যাম। তারপর দেখলেন, এখনও ঘণ্টাদেড়েক হাতের কাজ করা যাবে। সুতরাং তন্ময় হলেন সেই কাজে। ঘড়ি দেখে কাজ বন্ধ করলেন। কুতকুতে দুই চোখে কৌতুক ভাসিয়ে সুরজলালের পাঠানো অত্যাশ্চর্য ওষধি সুরার দিকে চেয়ে রইলেন, এক গেলাস পান করলেন এবং নিশার আঁধারে বেরিয়ে পড়লেন।

কড়া চাঁদের আলোয় ছোট্ট শহর ভেসে যাচ্ছে। ছবির মতো সুন্দর ফটকের ওপর বাঁকা খিলেনের দিকে চেয়ে রইলেন ফাদার। ফটকের ওদিকে রয়েছে আশ্চর্য বাহারি পাম গাছের ঝালর। ফোকাস মেরে যেন রঙ্গমঞ্চ সাজানো হয়েছে। খিলেনের অন্যদিকে ঝুলছে পাম গাছের খাঁজকাটা একটা পাতা। চাঁদ রয়েছে তার পেছন দিকে। এদিক থেকে মনে হচ্ছে যেন কালো কুমিরের চোয়াল। স্রেফ এই কল্পনায় তিনি আকৃষ্ট হতেন না যদি না তাঁর সহজাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে ফেলত আরও একটা ব্যাপার। বাতাস কোথাও নেই, সবই নিথর। অথচ স্পষ্ট দেখলেন, ঝুলে থাকা পামগাছের পাতা একটু-একটু নড়ছে।

চারপাশ দেখলেন। উপলব্ধি করলেন, তিনি একা নন। ছাড়িয়ে এসেছেন শহরের শেষ বাড়ি। বেশিরভাগ বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। জানলার পাল্লাও অনেক বাড়িতে খোলা নেই। উনি হেঁটে চলেছেন দুটো দেওয়ালের মাঝখান দিয়ে। এবড়োখেবড়ো আর বড়-বড় পাথর দিয়ে তৈরি। পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে গজিয়েছে গোছা-গোছা কাটা ঝোঁপ। দেওয়াল দুটো সমান্তরালভাবে প্রসারিত ফটকের দিকে। ফটকের ওদিকে কফি হাউসের আলো দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয় অনেক দূরে রয়েছে। ফটকের নিচে কী রয়েছে, তাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। শুধু বোঝা যাচ্ছে, বড়-বড় পাথর দিয়ে মেঝে বাঁধাই করা হয়েছে। চাঁদের আলো ঠিকরে যাচ্ছে সেই পাথর থেকে। এখানে সেখানে রয়েছে এলোমেলো ন্যাশপাতি গাছ। দেখেই অশুভ সংকেতের ডংকা বাজল তার মনের মধ্যে। অদ্ভুত একটা চাপ অনুভব করলেন। কিন্তু পা থামালেন না। একটুও থমকে দাঁড়ালেন না। সাহস তাঁর আছে। সাহসকে ছাড়িয়ে যায় তার কৌতূহল। সারাজীবন কাটিয়েছেন সত্যের অন্বেষণে, ক্ষুধিত বুদ্ধিসত্তা দিয়ে মিথ্যের বিনাশ ঘটিয়েছেন। সত্যানুসন্ধান যত তুচ্ছ ব্যাপারেই হোক না, কৌতূহল চরিতার্থ করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা তাকে বিপদের দিকে টেনে নিয়ে যাবে জেনেও পেছিয়ে আসেননি। তবে মাত্রা ছাড়িয়ে যাতে না যায়, সেদিকে খরনজর রেখেছেন। নিজেকেও সেই অজুহাতে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখেছেন। এক্ষেত্রে তার অন্যথা ঘটল না। সোজা হেঁটে গেলেন পাম গাছের দিকে। গাছের ওপর থেকে লাফিয়ে এসে একটা লোক ছোরা মারল তাকে। একই সময়ে বানরের ক্ষিপ্রতায় পাঁচিলের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ধেয়ে এল একটা লোক। সে উঁচিয়ে রয়েছে একটা কাঠের মুগুর। ছোরা মারার সঙ্গে-সঙ্গে মুগুরও নেমে এল তার মাথার ওপর। ফাদার ঘনশ্যাম একপাক ঘুরে গিয়ে টলে উঠলেন এবং মালভর্তি বস্তার মতো ধপ করে পাথরের মেঝেতে পড়ে গেলেন। পড়ে যখন যাচ্ছেন, তখন তার মুখের পরতে-পরতে ফুটে উঠল মৃদু কিন্তু নিবিড় বিস্ময়বোধ।

নান্দুরাম ঠিক এই সময়ে জানলায় দাঁড়িয়েছিলেন। ভদ্রলোক ধর্মে খ্রিস্টান কিন্তু চার্চে যান না। তবে যে-কোনও কারণেই তোক সমীহ করেন ফাদার ঘনশ্যামকে। এই শহরেই তাঁর জন্ম। শিক্ষাদীক্ষা আমেরিকায়। পেশায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কাজ কারবারও করেন আমেরিকায়। পয়সাকড়ি আছে, নাম-যশ আছে, তাই আলাপ পরিচয় আছে সাংবাদিক ইন্দ্র, ব্যবসায়ী কিন্তু ধার্মিক রঞ্জুলাল আর নাস্তিক শিরোমণি আলভারেজের সঙ্গে। তিনি এক বিচিত্র চরিত্র। বৈচিত্র্য-পিয়াসী বলেই ফাদার ঘনশ্যামকে ভালোবাসেন।

এহেন মানুষটাকে কালো কুমড়োর মতো ছাতা বগলে জানলার সামনে দিয়ে এমন সময়ে হেঁটে যেতে দেখে তিনি অবাক হলেন। চাঁদের আলোয় চকচকে ওই টাক, ওইরকম বিচ্ছিরি আলখাল্লা আর ভাঙা ছাতা বগলে যাচ্ছেন কোথায় ফাদার?

চোখ ছিল তার জানলার দিকে। তাই পরক্ষণেই দেখলেন আরও দুটো মনুষ্যাকৃতি হনহনিয়ে চলে গেল তার জানলা পেরিয়ে। কঁকড়া চুলো খর্বকায় মানুষটাকে এক ঝলকেই চেনা গেল– মদ্য প্রস্তুতকারক সুরজলাল। কিন্তু তার পাশে ঢ্যাঙা বৃষস্কন্ধ ও লোকটা কে?

হুমড়ি খেয়ে জানলায় পড়লেন নান্দুরাম। পেছন থেকে বৃষস্কন্ধ ব্যক্তিকে চিনতে পারলেন। ডাক্তার যোশী। রঙুলালের ব্লাডপ্রেসার দেখতে গেছিলেন যখন তখন আলাপ হয়েছিল নান্দুরামের সঙ্গে।

ঠিক এই সময়ে আর্ত চিৎকার শুনলেন ফটকের দিক থেকে। ধপ করে একটা আওয়াজ। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে অনেক লোকের চিৎকার। হট্টগোল।

নান্দুরাম বেগে নামলেন পথে। দৌড়লেন চন্দ্রালোকিত ফটকের দিকে। দেখলেন, ঠিক নিচেই লম্বমান কালো বস্তাবৃত একটা খুদে দেহ। ফাদার ঘনশ্যাম মণ্ডল। তিনি নড়ছেন না।

কফি হাউস থেকে দৌড়ে এসেছে অনেক লোক। এসেছেন স্বয়ং আলভারেজ। তিনি ফাদারের বডির কাছে কাউকে আসতে দিচ্ছেন না। এই মুহূর্তে তার পরনে রয়েছে রক্তরাঙা সফরি স্যুট। মাথার লম্বা সোনালি চুলে চাঁদের আলো ঠিকরে দিচ্ছে সোনালি আভা। মাথায় তিনি কম করেও সাত ফুট। সেই অনুপাতে প্রস্থেও বিশাল। রাজ সেনাপতির মতো খানদানি বন্ধু নিয়ে তিনি দুদিকে দুহাত বিস্তার করে জনগণকে রুখে দিচ্ছেন। নিরক্ত মুখে পাশে দাঁড়িয়ে সুরজলাল। নান্দুরাম যখন হাঁফাতে-হাঁফাতে এসে পৌঁছলেন, তখন ফাদারের নাড়ি দেখা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে আখাম্বা চেহারার ডাক্তার যোশী বললেন একটাই কথা, ডেড।

সন্ত্রাসবাদীরা শেষ করে দিল একটা ভালো মানুষকে, উৎফুল্ল গলায় বললেন আলভারেজ, আমি কিন্তু মারিনি, তোক দিয়েও মারাইনি। যদি সেরকম লোক ধরা পড়ে, এই মুহূর্তে তাকে লটকে দেব এই গাছে।

নান্দুরাম বললেন, আপনি কোথায় ছিলেন?

কফি হাউসে। ফাদারের জন্য বসেছিলাম। গোপন মিটিং ছিল জরুরি বিষয়ে। সুরজলাল আর ডাক্তারকে দেখিয়ে বললেন, এঁরাও যাচ্ছিলেন মিটিং-এ।

গাছের ছায়া থেকে ফ্যাকাশে মুখে বেরিয়ে এলেন সাংবাদিক ইন্দ্র, সর্বনাশ হয়ে গেল। গোটা পৃথিবীর ক্ষতি হয়ে গেল। ফাদার ঘনশ্যাম ইজ ডেড।

রঞ্জুলাল এলেন দৌড়তে-দৌড়তে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে, বললেন ডাক্তারকে, সিওর ডেথ?

হানড্রেড পারসেন্ট।

তাহলে ফাদারের ডেডবডি সরিয়ে নেওয়া হোক।

টলতে টলতে বাড়ি ফিরে এলেন নান্দুরাম। ঝিম মেরে বসে রইলেন ঘরে। ফাদারের সঙ্গে তার দোস্তি তেমন প্রগাঢ় না থাকলেও লোকটার বোকা বোকা চেহারা আর ভালো ভালো কাজগুলো তাঁর ভালো লাগত। এমন একটা মানুষকে খতম করে দিয়ে গেল চণ্ডালরা। ঘরে বসেই শুনলেন, রাত ভোর হওয়ার আগেই কবরস্থ হবেন ফাদার ঘনশ্যাম। খবরটা দিয়ে গেলেন সাংবাদিক ইন্দ্র। কারণ, ভয়ানক দাঙ্গা লাগবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ঝটপট ডেডবডি মাটির নিচে চালান করে দিতে হবে। মিশন-হাউসে লোক জড়ো হচ্ছে।

আলো ফোঁটার আগেই কফিনে শোয়ানো হল ফাদারকে। তার মুখের বিস্ময় বোধ প্রকৃতই রহস্যবহ। আততায়ীদের অন্য কেউ না জানলেও, ফাদার ঘনশ্যাম নিশ্চয় চিনতে পেরেছিলেন। তাই অত অবাক হয়েছিলেন। আলভারেজ কিন্তু কফিনের কাছেই দাঁড়িয়ে গলাবাজি করে গেলেন সমানে। এ খুন তিনি করেননি। তার দলের কেউ করেনি। খুনিকে পাওয়া গেলে তিনি নিজের হাতে তাকে ফাঁসিতে লটকাবেন।

মিশন-হাউসের মস্ত ক্রসের তলায় রাখা হয়েছে কফিন। একটু উঁচু জমিতে, তিনদিকে সবুজ ঝোঁপ, সামনের দিকে কিছু নেই, তাই রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে কফিন। কাতারে কাতারে লোক দাঁড়িয়ে গেছে রাস্তায়। তাদের চোখ ছলছল করছে। পিতৃহারা হওয়ার শোকে আচ্ছন্ন প্রত্যেকেই। একদম বোবা। কোথাও নেই কোনও শব্দ। এমনকী আলভারেজও আর তড়পাচ্ছেন না।

অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে, আর সময় নেই দেখে রঞ্জুলাল আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। টাইট গোল শরীরের গলা দিয়ে যতখানি আওয়াজ বের করা সম্ভব, ততখানি আওয়াজ ছেড়ে বললেন-কে খুন করেছে ফাদার ঘনশ্যাম মণ্ডলকে? তাকে দুচক্ষে দেখতে পারত না যে লোকটা–খুন করেছে সে।

আর যায় কোথা। এতক্ষণ যে আম জনতা গলা বুজিয়ে ছিল, অট্টরোলে ফেটে পড়ল তারা। তাদের ক্ৰোধারুণ চোখ ঝলসে ফেলছে একজনকেই–আলভারেজকে।

বীর-শরীরী আলভারেজ যেন এইরকম একটা মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। নিমেষে তার চেহারা গেল পালটে। আফ্রিকার অরণ্যের জঘন্য জিঘাংসা আশ্রয় করল তার সমস্ত মুখাবয়ব। রক্তলাল পরিচ্ছদের মতনই লাল টকটকে হয়ে উঠল দুই চক্ষু। সাত ফুট লম্বা শরীরটা ফুলে যে ডবল হয়ে গেল এবং মনে হল, আদিম বর্বরতা যদি কোথাও থাকে, তবে তা এখানে, এই দেহে।

গলা চিরে বেরিয়ে এল নারকীয় হুঙ্কার–খবরদার। ফাদারকে খুন করেছে খোদ ভগবান। যদি বিশ্বাস থাকে ভগবানে। কিসসু নেই। এই ব্রহ্মাণ্ডে ভগবান-টগবান কেউ নেই। থাকলে মরতে হত না নিরীহ মানুষটাকে।

ওই একটা বক্তৃতাই যথেষ্ট। তৎক্ষণাৎ জনগণের অট্টনিনাদ হল স্তব্ধ। এইবার নিশ্চয় শোনা যাবে গুলিগোলার আওয়াজ। কিন্তু তা হল না।

নৈঃশব্দ্য খান-খান করে দিয়ে বিষম বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন সাংবাদিক ইন্দ্র, ফাদার নড়ছেন।

বাতাস পর্যন্ত বুঝি থেমে গেল এই কথায়। নিথর হল গাছের পাতা।

কফিনের ওপর ঝুঁকে পড়েছেন ডাক্তার যোশী। দেখলেন, ফাদারের মুখ পাশ ফিরেছে।

তারপরেই নান্দুরাম দেখলেন, ফাদার চোখ পিটপিট করছেন। গুঙিয়ে উঠছেন। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে বসে কুতকুতে চোখে জ্বলজুল করে তাকিয়ে আছেন ডাক্তার যোশীর দিকে।

জীবনে অনেক ইলেকট্রিক্যালমির‍্যাকল দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন নান্দুরাম, কিন্তু এইমির‍্যাক কখনও দেখেননি। কোনও বিজ্ঞানের ক্ষমতা নেই এরকম মিরাকল দেখায়। অসম্ভবকে প্রত্যক্ষ করা কাকে বলে, সেই প্রথম তিনি জানলেন। হাজার বছরেও যা দেখা যায় না, তা দেখবার জন্য আধঘণ্টার মধ্যে ভেঙে পড়ল গোটা শহরের মানুষ। ঈশ্বরকে সশরীরে ধরায় অবতীর্ণ হওয়া বুঝি একেই বলে। হাজার-হাজার লোক উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল সামনের রাস্তায়। এমন অলৌকিক ঘটনা কে কবে দেখেছে? এমনকী আলভারেজের মতো পাষাণ হৃদয় মানুষেরও মাথা ঘুরে গেল। দু-হাতে রগ টিপে ধরে তিনি ঘাসের ওপর বসে পড়লেন।

স্বর্গসুখের এহেন টর্নাডোর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা খর্বকায় ব্যক্তিটার কোনও কথাই শোনা গেল না। একে তো তিনি চেঁচিয়ে কথা বলতে পারেন না, তার ওপর মরে বেঁচে ওঠার ধকলে তাঁর কণ্ঠস্বর ক্ষীণতর হয়েছে। হট্টগোলও কর্ণবধিরকারী। তার দুর্বল অঙ্গভঙ্গি দেখে শুধু বোঝা যাচ্ছে, তুমুল এই হর্ষ তাঁর চিত্তে বিলক্ষণ বিরক্তি উৎপাদন করছে। জনতার সামনে উঁচু জমিতে এসে দুহাত নেড়ে উত্তাল জনগণকে শান্ত করবার বৃথা চেষ্টা করে চলেছেন–হাত নাড়া দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা পেঙ্গুইন পাখনা ঝাঁপটাচ্ছে। উদ্দামতা একটু স্তিমিত হতেই গলা চড়িয়ে, তাঁর পক্ষে যতখানি রাগ দেখানো সম্ভব, ততখানি রাগ দেখালেন, আঃ! কী হচ্ছে!

পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়ালেন সাংবাদিক ইন্দ্রর দিকে। বললেন, এখুনি এই মুহূর্তে ফ্যাক্স করে গোটা পৃথিবীতে আসল খবরটা ছড়িয়ে দিন।

মির‍্যাকল? মিনমিন করে বুঝি জীবনে এই প্রথম কথা বললেন সাংবাদিক ইন্দ্র।

না, না, না। ঠিক উলটো। এখানে কোনও মিরাকল ঘটেনি। আমি মিরাকল ঘটাতে পারি না।

ঢোক গিললেন সাংবাদিক ইন্দ্র। অধোবদনে নেমে গেলেন ফ্যাক্স মেশিনের সন্ধানে।

নান্দুরাম বললেন, ফাদার, আপনার সঙ্গে কথা আছে।

কুতকুতে চোখে তাকিয়ে গোলমুখে বোকা-বোকা ভাব ফুটিয়ে বললেন ফাদার ঘনশ্যাম, কী কথা?

কৌতূহল।

চলুন।

ওঁরা এখন বসে আছেন গিঞ্জের আচার্যর ঘরে। কাগজপত্র যেভাবে গতকাল ছড়িয়ে গেছিলেন ফাদার, রয়েছে সেইভাবেই। পাশেই ওষধি সুরার বোতল এবং শূন্য গেলাস।

গম্ভীর বদনে বললেন ফাদার, কীসের কৌতূহল?

নান্দুরাম বললেন, মরে বেঁচে উঠলেন কীভাবে?

ফাদার বললেন, জীবনে বেশ কিছু মার্ডার কেসের সমাধান ঘটিয়েছি। এবার তদন্ত হবে আমার নিজের মার্ডারের।

নান্দুরাম বললেন, যদি কিছু মনে না করেন, বোতল থেকে ঢেলে একটু মদ খাব?

উঠে দাঁড়ালেন ফাদার ঘনশ্যাম। গেলাসে সুরা ঢাললেন। গেলাস চোখের সামনে এনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর গেলাস নামিয়ে রেখে ফের চেয়ারে বসলেন।

বললেন, মরার সময়ে আমি কী অনুভব করছিলাম জানেন? শুনলে বিশ্বাস করবেন না। বিস্ময়সীমাহীন বিস্ময়বোধে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম।

মাথায় চোট পাওয়ায়?

ঝুঁকে পড়লেন ফাদার। বললেন খাটো গলায়, মাথায় চোট না পাওয়ার জন্যই অবাক হয়েছিলাম।

চেয়ে রইলেন নান্দুরাম। ভাবলেন, চোট-টা নিশ্চয় তেমন জোরদার হয়নি। বললেন, কী বলতে চান?

বলতে চাই যে, লোকটা অত জোরে মুগুর নামিয়ে আনল মাথা টিপ করে, কিন্তু মুগুর থেমে গেল মাথার কাছে এসে খুলিতে ছোঁয়া পর্যন্ত লাগল না। একইভাবে আর একজন ছোরা মারল বটে, কিন্তু ছোরার ডগা আমার গা স্পর্শ করল না। ঠিক যেন খেলার ছলে খুনজখম করা। হ্যাঁ, ঠিক তাই। অসাধারণ ব্যাপারটা ঘটল ঠিক তার পরেই।

চিন্তাবিষ্ট চোখে টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্রের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফের মুখ খুললেন ফাদার, মুগুরের চোট, ছোরার কোপ–কোনওটাই গায়ে লাগল না। অথচ টের পেলাম আমার হাঁটু ভেঙে যাচ্ছে, প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। চোট খেয়েই প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছে, তা বুঝলাম। তবে সেটা মুগুর বা ছোরা নয়। কোনও অস্ত্র নয়, জানেন কী?

এই বলে দেখালেন টেবিলে রাখা মদ।

মদের বোতল তুলে নিলেন নান্দুরাম। গন্ধ শুঁকলেন।

বললেন, মনে হচ্ছে আপনি ধরেছেন ঠিক। ড্রাগিস্ট-এর কাজ করেছিলাম আমেরিকায় বছর খানেক। কেমিস্ট্রি পড়েছিলাম। অ্যানালিসিস না করে সঠিক বলতে পারব না, শুধু বলব, অস্বাভাবিক কোনও উপাদান রয়েছে এই মদের মধ্যে। আফ্রিকার জঙ্গলের মানুষরা একরকম আরকের খবর রাখে, যা মৃত্যুর মতো সাময়িক নিদ্রা এনে দেয়।

শান্ত গলায় বললেন ফাদার, কারেক্ট। যে কোনও কারণেই হোক, একটামির‍্যাকল ঘটানো হয়েছে। যা বিলকুল ধাপ্পাবাজি। অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার দৃশ্য নাটক ছাড়া কিছু নয়। ঘড়ি ধরে কাজ করা হয়েছে। সাংবাদিক ইন্দ্র পাবলিসিটির বাহবা পেতে-পেতে মাথা খারাপ করে ফেলেছেন বলেই মনে হয় আমার। তবে শুধু এই কারণে এতদূর উনি যেতে পারবেন বলে মনে হয় না আমার। একবার আমাকে জাল শার্লক হোমস হিসাবে ওয়ার্ল্ড পাবলিসিটি দিয়েছেন। আবার

বলেই থেমে গেলেন। যেন দম আটকে এল। টলতে টলতে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে।

ব্যাকুল গলায় বললেন নান্দুরাম, যাচ্ছেন কোথায়?

প্রার্থনা করতে।

হঠাৎ এই সময়ে?

সমাধানটা ঈশ্বর আমার মাথায় খেলিয়ে দিলেন বলে। যাই–

দাঁড়ান। সমাধানটা কী?

ওই যে বলছিলাম, জাল শার্লক হোমসের কথা। শার্লক হোমস আর সাংবাদিক ইন্দ্র– এই নাম দুটো পাশাপাশি মাথায় আসতেই পরমপিতা সত্যের ঝলক ঘটালেন মগজের মধ্যে। উঃ। কী বোকা আমি।

বলুন। আমাকে বলে যান।

আমাকে শার্লক হোমসের কায়দায় মরিয়ে বাঁচিয়ে তোলার গল্পের কথা মনে পড়ছে? আইডিয়াটা সাংবাদিক ইন্দ্র মাথায় এনেছিলেন তখনই। মরে বেঁচে উঠব আমি শার্লক হোমসের মতো। আরক মিশোনো মদ খাওয়ানো হয়েছিল ঘড়ি ধরে–মড়ার বেঁচে ওঠার সময়ও নির্ধারণ করা হয়েছিল ঘড়ি ধরে। কী বুঝলেন?

মাথা নাড়তে নাড়তে নান্দুরাম বললেন, হ্যাঁ, এবার বুঝছি।

মিরাকলের খবর বোমা ফাটাত গোটা দুনিয়ায়। তারপরেই মিরাকল-এর জালিয়াতি ধরিয়ে দেওয়া হত। প্রমাণ করে ছাড়ত, ষড়যন্ত্রে রয়েছি খোদ আমি–ফাদার ঘনশ্যাম মণ্ডল। আর-এক দফা পাবলিসিটি অভিযানে জগৎ ছেয়ে যেত–খ্যাতির মধ্যগগনে পৌঁছে যেতেন সাংবাদিক ইন্দ্র।

সোজা চোখে তাকালেন নান্দুরাম, আর কটা নরপশু আছে এই ষড়যন্ত্রে?

আলভারেজ তো বটেই, ভুয়োমির‍্যাকল প্রমাণ করতে পারলে তার পোয়াবারো।

আর?

রঞ্জুলাল। ওঁর ভাড়ামি আর ভণ্ডামি অনেক আগেই আঁচ করেছিলাম। ওঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের কাটা ছিলাম আমি।

এতগুলো বাজে লোকের সঙ্গে এখানে থাকতে চান? চলুন আমার সঙ্গে আমেরিকায়।

তৎক্ষণাৎ মদের বোতলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন ফাদার ঘনশ্যাম, তাহলে এক গেলাস খাই?

(বিদেশি ছায়ায়)
* স্বস্তিকা পত্রিকায় প্রকাশিত (পূজা সংখ্যা, ১৪০৩)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *