1 of 2

শিয়রে শমন

শিয়রে শমন

গোয়েন্দানী নারায়ণী বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। তার নীল রঙের দু ৬।পকেটওলা ডেনিম শার্টের দুটো পকেটই ঠেলে উঠেছে। উদ্ধত বুকের নিচেই কটিদেশ ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়েছে দেড়ইঞ্চি চওড়া বেল্টের বন্ধনে। নিম্নাঙ্গ আবৃত ব্লু-জিনস প্যান্টে। নিতম্ব কামড়ানো জিনস।

গোয়েন্দানী নারায়ণী প্রসাধন পছন্দ করে না। সুর্মাটানা চোখের চাইতে অনেক বেশি বিপজ্জনক ওর পিঙ্গল চক্ষুর চাহনি। বাঘিনী চক্ষু বললেই চলে। নিমেষে হিপনোটাইজ করে ফ্যালে। রসিকা প্রকৃতিদেবী তার অধর আর ওষ্ঠের আধারে এত রস দিয়েছেন যে রঞ্জক পদার্থ দিয়ে তাদের আকর্ষণ বৃদ্ধির দরকার হয় না।

এই মুহূর্তে সে মুক্তোর মতো সুন্দর সাজানো দাঁত দিয়ে কামড়ে রয়েছে নিচের ঠোঁটের বামপ্রান্ত।

সে ভাবছে। খুন করবে, না স্রেফ পিটিয়ে ছেড়ে দেবে।

আয়নার ঠিক ওপরের জোরালো স্পট লাইট ফোকাস করে রয়েছে ওর তিলোত্তমা দেহবল্লরীকে। প্রতিটি লোমকূপে বিধৃত অজস্র রূপের কণা। বিধাতা মাঝেমধ্যে এই রকম এক একটি রমণীকে সৃষ্টি করেন। পুরুষের প্রতাপ ভাঙবার জন্যে। অন্যায়ের কাণ্ডারিদের নিধন করবার জন্যে। তিল-তিল সঞ্চিত রূপরাশিই এদের অমোঘ অস্ত্র। কটাক্ষের দামিনীই এদের দধীচির অস্থি। এরা সুন্দরী অথচ ভয়ঙ্করী। এদের সাবধান।

কলিকালের কুটিল কলকাতায় নারায়ণী তাই মূর্তিমতী বিভীষিকা। যারা ওর রূপের আকর্ষণে কাছে এসেছে–তারাই টের পেয়েছে, নারায়ণীকে বিধাতা শুধু রূপের অস্ত্রই দেননি–দিয়েছেন পেশির শক্তি। নারায়ণী নিয়মিত শরীরচর্চা করে এই পেশিদের বজ্ৰাধিক সর্বনাশা করে তুলেছে। মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ ওর নরম শরীরে এনে দিয়েছে মৃত্যুর হাতছানি। সেই সঙ্গে গ্রহণ করেছে আধুনিক মারণাস্ত্রের সর্ববিধ শিক্ষা।

তাই বলছিলাম, রূপসী নারায়ণীর রণরঙ্গিনী রূপের স্বাদ যারা পেয়েছে, তাদের অধিকাংশই ধরাধাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে যাদেরকে শেষ মুহূর্তে কৃপা করেছে রহস্যময়ী এই নিতম্বিনী– তারাই পঙ্গু দেহে আতঙ্কিত কণ্ঠে হুঁশিয়ার করে গেছে জানপহচান ব্যক্তিদের? খবরদার, ল্যাজে পা দিও না নারায়ণীর। নিজেকে সে গোয়েন্দানী বলে ঠিকই কিন্তু আইনের ধরাবাঁধা লাইনে গোয়েন্দাগিরি করে না। যে দেশে বিচারপতিকেও কাঠগড়ায় উঠতে হয়, যেদেশে কুখ্যাত বহু-বিজ্ঞাপিত খলনায়করা নির্বিচারে পার পেয়ে যায়, সে দেশে থানা-পুলিশ-প্রমাণ-আদালতের প্রহসন কীসের?

নারায়ণী তাই নিজেই শিকার ধরে, নিজেই তার বিচার করে, নিজেই তাকে নিকেশ করে। নারায়ণীর বিচারালয়ে আপিল হয় না, পলিটিক্যাল কানেকশন কাজ দেয় না, উৎকোচের স্তূপ তাকে আরও ক্ষমাহীনা করে তোলে।

এই মুহূর্তে তাই ঘটেছে। তার কাছে একটা লকারের চাবি এসেছে। ব্যাঙ্ক লকারের চাবি। বিলিতি ব্যাঙ্ক। এ ব্যাঙ্কে যাদের লকার থাকে, তারা কোটিপতি তো বটেই বিদেশের বহু ব্যাঙ্কেও তাদের বেনামি অ্যাকাউন্ট খুলে রাখতে হয় বিবিধ গোঁজামিল ব্যবসার জন্যে।

চকচকে চাবিটা আয়নার সামনে। সামান্য একটা চাবি। কিন্তু এই চাবি যে লকারের দ্বার উদঘাটন করে দেবে–তার অন্দরে যে আলিবাবার রত্ন আছে নারায়ণী তা জানে।

জানে বলেই কঠিন চোখে নিজেকে দেখছে আয়নার মধ্যে দিয়ে। জিগ্যেস করছে বিবেককে, কী করব? খুন? না, পিটুনি?

খুন, জবাব দিল বিবেক।

.

পরের দিন কাঁটায়-কাঁটায় দশটায় ব্যাঙ্কের সামনে ব্রেক কষল একটা হেভি মোটর বাইক। বাইক যে চালিয়ে নিয়ে এল, তার ওজন বাইকের চাইতে কম। কিন্তু গুরুভার গম্ভীর নিনাদী এই বাইক তার হাতে যেন খেলার পুতুল। পৃথিবীবিখ্যাত এই ব্র্যান্ডের বাইক একসময়ে ছিল ব্রিটিশ আর্মিতে। ১৯৪০-এ তারা বেচে দেয় ভারতের মানুষকে। আজকে সেই বাইক রূপান্তরিত হয়েছে। দিল্লির ফটফটিয়া-য় রেড ফোর্ট থেকে কনট সার্কাস যায় একেবারে আটজন যাত্রী নিয়ে। মাথাপিছু ভাড়া তিনটাকা।

কিংবদন্তীসম এই বাইক পথের রাজা হয়ে রয়েছে ১৯৩০ সাল থেকে–যে সালে রাইট ব্রাদার্স আকাশে উড়িয়েছিলেন তাঁদের প্রথম উড়োজাহাজ।

আজও সে পথের রাজা। হার্লে ডেভিডসন। ব্যাঙ্কের সামনে এসে দাঁড়াল লেটেস্ট মডেল– আলট্রা ক্লাসিক ইলেকট্রা গ্লাইড। ১৩৪০ সিসি ইঞ্জিন থেকে গম্ভীর গজরানি বেরয় এই কারণেই। ঝকঝক করছে পেছনের টুরিং কম্পার্টমেন্ট–সেখানে রয়েছে দুটি ফুল-ফেস হেলমেট। হেলমেটের মধ্যে রয়েছে স্পিকার যাতে চালক রেডিও ইনটারকম-এর মাধ্যমে কথা বলতে পারে পেছনের রাইডারের সঙ্গে, রয়েছে ইলেকট্রনিক কুইজ কন্ট্রোল, ক্যাসেট স্টিরিও সিসটেম।

ছোট গাড়ির চাইতে অনেক বেশি দাম এই দ্বিচক্রযানের। কিন্তু এ বাহন যাকে সাজে, দামের পরোয়া সে করে না। কারণ, স্পিড তার কর্মযজ্ঞের মূল মন্ত্র, জীবন আর মৃত্যু তার দুই পায়ের দুই ভৃত্য।

নিতান্ত অবহেলায় মেটাল মন্সটারকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে ব্যাঙ্কের প্রবেশ পথের দিকে অগ্রসর হল টেরিফিক বিউটি। পথের লোক হাঁ করে চেয়ে রয়েছে তার দিকে আর তার চোখ ধাঁধানেনা বাহনের দিকে। মাথায় তার হেলমেট নেই কারণ কলকাতায় সার্জেন্টদের সে তোয়াক্কা করে না। হালকা খাটো চুলের শোভা নষ্ট করতে যাবে কেন শিরস্ত্রাণ দিয়ে? কক্ষনও না। অঙ্গে গাঢ় বেগুনি প্যান্টসুট। কঁধ, বুকের ওপর দিক আর বাহু সম্পূর্ণ অনাবৃত। কলমকারি ছাপার একটা হালকা চাদর একটা কাঁধের কিছুটা ঢেকে রেখেছে বাকি চাদর ঝুলছে বামবাহুর ওপর। এইভাবেই সে হার্লে ডেভিডসন চালিয়ে এসেছে রাজপথ দিয়ে–নিশানের মতো পতপত করে উড়ছে তার কলমকারি ফুলকাটা চাদর।

মোহিনী নারায়ণী নেমেছে অভিযানে। পাঠক, এস্ত হোন।

পাথরের চওড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে বাঁদিকে মোড় নিল নারায়ণী। বিশাল হলঘর পুরোপুরি এয়ারকন্ডিশনড। মোলায়েম শীতলতায় শীতল প্রত্যেকেরই মস্তিষ্ক। তা সত্ত্বেও রুধির স্রোত দ্রুতগতি হল সামনের সুবেশ তরুণের ধমনীতে। পার্সোনাল কমপিউটার নিয়ে বসে আছে সে লকার-হোল্ডারদের পথ দেখিয়ে পাতাল ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। নারায়ণীর পেলব বাহু আর ঝকঝকে পিঙ্গল চোখ উত্তাল করেছে তার হৃৎপিণ্ডকে।

বাক্যব্যয় করল না নারায়ণী। কোড নাম আর নম্বর লেখা কার্ডে বাঁধা চাবিটা রাখল টেবিলে।

নিমেষে ভাবলেশহীন হয়ে গেল সুবেশ তরুণের মুখমণ্ডল।

যেন তৈরি ছিল এই চাবি আর এই কোড নম্বর দেখবার জন্যে। আশা করেনি শুধু নারায়ণীর মতো অপ্সরাকে। অথচ হাঁটছে দেখ! চলমান দামাস্কাস তরবারি বললেই চলে।

তরুণের মুখচ্ছবি পাঠ করে নিয়েছে নারায়ণী। সব মিলে যাচ্ছে। অঢেল পয়সা উড়ছে। ক্রীতদাস বনেছে এই ছোকরাও।

উঠে দাঁড়িয়েছে ছোকরা। ফাইলিং ক্যাবিনেটের সামনে গিয়ে দোসরা চাবি বের করে এসে বসল টেবিলে। এখন একটা ফর্ম সই করতে হবে। নারায়ণী জানে। লকার খোলা হয়েছে তারই নামে। সই নিয়ে যাতে মাথা ঘামানো না হয় তাই তো কেনা হয়েছে ছোকরাকে।

ফর্মে সই টেনে দিল নারায়ণী। বললে, বাকি যা লেখবার লিখে নেবেন। চলুন।

রোবটের মতো উঠে দাঁড়াল ছোকরা। ডানাকাটা পরীর গলা দিয়ে যে এরকম গম্ভীর মেঘের ডাক বেরতে পারে, তা সে জানত না। পট-পট করে নেমে গেল বাঁ দিকের সিঁড়ি বেয়ে। লাল কার্পেট পাতা পাতাল ঘরের সিঁড়ি। নিচের চাতালে নেমেই ডাইনে লকার রুম। সারি-সারি লোহার ক্যাবিনেট। ফাইলিং ক্যাবিনেট বলেই মনে হয়।

নম্বর মিলিয়ে একটা চাবি লাগিয়ে ঘুরিয়ে দিয়েছে তরুণ। নারায়ণী লাগাল নিজের চাবি। শুধু চাইল তরুণের দিকে। সরে গেল সে নিঃশব্দে। হাড় হিম হয়ে গেছে তার ওই এক চাহনিতেই। বাঘিনীর কটাক্ষ কি এরই নাম?

চাবি ঘুরিয়ে হাতল ধরে টান দিল নারায়ণী। বেরিয়ে এল একটা ড্রয়ার। লকার। গুপ্তধন রাখার আইনসঙ্গত অধিকার।

পাতাল ঘরে আর কেউ নেই।

ড্রয়ারে রয়েছে তাড়াতাড়া নোট। একশো টাকার নোট। পঁচিশটা থাক। প্রতিটা থাকে দশটা বান্ডিল।

এক-এক বান্ডিলে দশ হাজার। মোট পঁচিশ লাখ।

অনিমেষে সেকেন্ড কয়েক চেয়ে রইল নারায়ণী। স্পর্শ করল না। শুধু তেউড়ে গেল রসালো অধর। শ্বাপদ ভঙ্গিমায়।

.

ঠিক এই সময়ে বেলেঘাটার সুভাষ সরোবরের পাড়ে ইন্দ্রনাথ রুদ্রর বৈঠকখানা ঘরে জমে উঠেছে আর এক নাটক।

অনেকদিন পর পাইপের তাম্রকুট সেবন করছে ইন্দ্রনাথ। ব্রায়ার নয়, স্ট্রেট পাইপ। ডানহিল পাইপ, শুধু পাইপটারই দাম পাঁচ হাজার টাকা। এইমাত্র উপহার দিলেন অ্যাডভোকেট রতিকান্ত সমাদ্দার।

উনি বসে আছেন ইন্দ্রনাথের সামনের সোফায়। বয়স প্রায় পঞ্চান্ন। অতিশয় রোমশ। তার কানে চুল। ভুরুর চুল বাড়ির কার্নিশের মতো ঠেলে রয়েছে। মাথাভরতি কঁচাপাকা চুল গালপাট্টা হয়ে নেমে এসেছে চোয়াল পর্যন্ত। বলিষ্ঠ আকৃতি। গায়ে খদ্দরের হাফহাতা বুশশার্ট। ট্রাউজার্স এতই ঢলঢলে যে পাজামা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। বড় গম্ভীর। কাজ ছাড়া কিছু বোঝেন না।

আসন গ্রহণ করেই তিনি বলেছিলেন, ইন্দ্ৰনাথবাবু, শুনেছি আপনি রহস্যভেদ করেন তাতে আনন্দ পান বলে। ব্রেনওয়ার্ক না থাকলে কেস টেকআপ করেন না। আমি এইরকম একটা কেস আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। যার কেস, মানে আমার যে মক্কেল, সে খুন হয়েছে গতকাল রাতে। প্রাইভেট ডিটেকটিভ অ্যাপয়েন্ট করার ভার সে আমাকে দেয়নি। টাকা পয়সার ব্যবস্থাও করে যায়নি। আমি নিজেই এসেছি। পারিশ্রমিক দিতে পারব না। তবে একটা স্মোকিং পাইপ উপহার দেব। যা আপনি একসময়ে খুব ভালোবাসতেন।

ভূমিকা শেষ করে ডানহিল পাইপটা আর টোব্যাকো ইন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিয়েছিলেন

রতিকান্ত সমাদ্দার।

মৌজ করে সেই পাইপ থেকেই এখন অনর্গল ধূম বিতরণ করছে ইন্দ্রনাথ। আধবোজা চোখে চেয়ে আছে সমাদ্দার মশায়ের দিকে।

রতিকান্তবাবু বলছেন :

আমার সমস্ত মক্কেল অবাঙালি। গুড পে-মাস্টার। পয়সাকড়ি নিয়ে কখনও ভোগায় না। রাকেশ মালহোত্রা এদের একজন।

জন্ম তার পাঞ্জাবে। ডাকাতদের গুলিতে খতম হয়েছিল বাবা আর দাদা। তখন তার বয়স বারো। মাকে নিয়ে লড়তে হয়েছে তখন থেকেই। লেখাপড়া করবার সুযোগ পায়নি। পয়সা তো ছিল না। মায়ে-পোয়ে রাস্তাও ঝেটিয়েছে, নর্দমা সাফ করেছে, তাতেও দুবেলা খাবার জোটেনি।

একটু বড় হয়ে ট্রাক ড্রাইভারি আরম্ভ করেছিল। বছর তিনেক সেই কাজ করে হাতে একটু পয়সা জমতেই চলে আসে কলকাতায়। হাওড়া স্টেশনে যখন পা দিয়েছিল, তখন তার পকেটে ছিল মাত্র চোদ্দো টাকা।

নতুন জায়গা। নতুন মানুষ। বাংলাও জানে না। কিন্তু উদ্যোগী পুরুষের ভাগ্য সহায় হয়। কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল একটা গ্যারেজে। লরির যন্ত্রপাতিতে গ্রিজ লাগানোর বাঁদুরে কাজ, মজবুত চেহারার দৌলতে পরে একটা কারখানায় দারোয়ানি করেছে। রাস্তায় হেঁকে তালা বিক্রিও করেছে।

কিছু টাকা জমতেই চলে গেছে অমৃতসর। মা ছিল ওইখানেই। নিয়ে এসেছে কলকাতায়। তারপর শুরু করেছে জমি কেনাবেচার কাজ।

ভাগ্য খুলেছে তখন থেকেই। ফুলে উঠেছে ব্যাঙ্কের ব্যালেন্স। পরের কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার ঘুরে এসেছে অমৃতসরে। একা। কারণ অমৃতসরে ছিল ওর গার্লফ্রেন্ড। মার্গারেট। জন্ম তার গোয়ায়। খ্রিস্টান। বাবার চাকরি ছিল অমৃতসরে। বন্ধুত্ব জমেছিল রাকেশের সঙ্গে।

কিন্তু ওই পর্যন্তই। বছরের পর বছর, সেধেছে রাকেশ। কলকাতায় আসেনি মার্গারেট। বিয়ে নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার চলে না।

ফলে, শীতল হয়ে আসে দুজনের সম্পর্ক।

এদিকে ফুলে ফেঁপে উঠছিল রাকেশের বিজনেস। জমি কেনাবেচা ছাড়াও ফ্ল্যাট বানিয়ে বেচে দেওয়ার আইডিয়াটা তখনই মাথায় আসে ওর। এখন যাকে প্রোমোটার বলি, তাই। কোম্পানির নাম দিয়েছিল ইডেন গার্ডেন্স লিমিটেড।

চড়চড় করে ব্যবসা বেড়ে যেতেই যাতায়াত শুরু হয়েছিল বোম্বাইতে। টাকা তো ওখানেই। কৌশলও ওখানে।

এই সময়ে ক্রিস্টিন-এর সঙ্গে আলাপ হয় রাকেশের। গোয়ানিজ খ্রিস্টান। লাভলি মেয়ে। রিয়াল বিউটি। পেশায় ছিল মডেল। রাকেশের সঙ্গে আলাপ একটা ফিল্ম প্রোডিউসারের অফিসে। এই অফিসেই মডেলিং করছিল ক্রিস্টিন। রাকেশ গেছিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সম্বন্ধে জানতে। কঁচা টাকা হাতে এলে সবাই যা করতে চায়।

শেষ পর্যন্ত ফিল্ম লাইনে যায়নি রাকেশ। তবে ওই লাইন থেকেই তুলে এনেছিল ক্রিস্টিনকে। যে প্রোডিউসারের অফিসে আলাপ, তাকেই বিয়ে করবে ঠিক করেছিল ক্রিস্টিন। কিন্তু সে প্ল্যান ভেস্তে দিয়েছিল রাকেশ। টাকা মানুষকে পালটে দেয়। কথায় সে চৌকস। চেহারায় রাজপুত্র। টাকার কুমির। প্লেনে চাপিয়ে ক্রিস্টিনকে নিয়ে এল কলকাতায়। বিয়ে করল পরের মাসেই।

বিয়ের পরও মডেলিংয়ের কাজ ছাড়েনি ক্রিস্টিন। এ এক নেশার কাজ। আনন্দ ছাড়া বাঁচবে কী করে মেয়েটা। তাই পার্ক স্ট্রিটের একটা মডেলিং এজেন্সিতে নাম লিখিয়ে রেখেছিল। তখন ওর বয়স সাতাশ। সূচনা থেকে বোঝা গেছে উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে বিলক্ষণ। বম্বের মেয়ে, গোয়ানিজ কালচার। ফ্রী, ফ্র্যাঙ্ক, স্মার্ট, ইজি। বিজ্ঞাপনের একটা সিরিজে ওই মেয়ে ছাড়া আর কাউকে পাওয়াই গেল না কলকাতায়। গাড়ি কোম্পানির বিজ্ঞাপন। বেরিয়েছিল খবরের কাগজে। চিতাবাঘের চামড়া দিয়ে তৈরি অদ্ভুত ড্রেস পরে বাগিয়ে রয়েছে একটা বর্শা বিঁধিয়ে দিতে যাচ্ছে সামনের চকচকে সাদা গাড়িটার গায়ে। আইডিয়ার বলিহারি যাই! কাগজে দেখেছেন? গুড। সেই মেয়েই হল ক্রিস্টিন– আমার মার্ডাড ক্লায়েন্ট। ক্লিক করেছিল সিরিজটা। কপাল খুলে গেছিল ক্রিস্টিনের।

সেই সঙ্গে ওর স্বামীরও। কথায় বলে স্ত্রীভাগ্যে ধন। টাকায় টাকা বাড়ে। রাকেশের টাকা বস্তায় বেঁধে রাখবার সময় এসে গেছিল। দুদিনেই একটা আনকোরা নতুন মারসিডিজ বেঞ্জ কিনে দিয়েছিল ক্রিস্টিনকে। বিয়ের উপহার। ওই গাড়ি নিয়েই বেরিয়েছিল দেশ বেড়াতে আপনারা যাকে বলেন হানিমুন–তাই আর কি–গেছিল গোয়ায়। টাকা উড়িয়ে ছিল জলের মতো। শ্বশুরবাড়ির লোকের চক্ষুস্থির করে ছেড়েছিল ঐশ্বর্য দেখিয়ে। হইহই পড়ে গেছিল গোটা গোয়ায়।

থাক সে কথা। কলকাতায় ফিরেই নিজের নতুন বাড়ি বানিয়েছিল রাকেশ। এতদিন পরকে জায়গাজমি বাড়ি জুটিয়ে দিয়েছে–এবার বউয়ের চাঁদমুখে আরও হাসি ফুটোনোর জন্যে তৈরি করে নিল নিজের থাকবার জায়গা। ছোটখাট একটা প্রাসাদ। শহর থেকে অবশ্য দূরে। ডায়মন্ডহারবার যাওয়ার পথে। ছ-বিঘে ফুলের বাগানের ওপর ছিমছাম বাড়ি। অথচ তার মধ্যে আছে রাজসিক রুচি। বিলাস কাকে বলে, এ বাড়িতে ঢুকলে হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া যায়। এমনকি গাড়ি রাখার গ্যারেজেও রেখেছে চোখ ট্যারা করে দেওয়ার ব্যবস্থা। গ্যারেজের সামনে এসে দাঁড়ায় গাড়ি। ড্রাইভার গাড়িতে বসেই রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে রোলিং শাটার ঘুরিয়ে তুলে দেয় ওপরে। শুনেছেন? তাহলে দেখেই আসুন। রাকেশের সঙ্গে আপনার কথা বলা দরকার।

সুখেই ছিল দুজনে। এ যুগের লায়লা মজনু। দেখে ঈর্ষা হত মশাই। চোখ টাটাত পাঁচজনের। হিন্দি সিনেমাতেই এমনি রূপকথা দেখা যায়। রূপকথা যে সত্যি হয়, তা এই কলকাতায় এসে দেখিয়ে দিল রাকেশ। ছেঁড়া কাঁথা থেকে সোনার খাটে গা রূপোর খাটে পা। বুক ফেটে যাবে না?

পরশ্রীকাতরদের কথা বাদ দিচ্ছি। কথায় বলে নজরে বিষ থাকে। সেই বিষেই বুঝি ধ্বংস হয়ে গেল সুখের ফ্যামিলিটা। এবার আসি সেই কথায়।

কয়েক হপ্তা ধরেই ডায়মন্ডহারবার অঞ্চলের খুনখারাপির কথা কাগজে বেরচ্ছে বটে কিন্তু দায়সারাভাবে। গোটা দেশজুড়ে চলছে নারকীয় নৃত্য। ডায়মন্ডহারবারের দু-চারটে মানুষের প্রাণ গেলে কারও গদি কাঁপে না।

কয়েক সপ্তাহের আগের ঘটনা বলছি। স্কুলের একটি মেয়েকে রেপ করে মেরে ফেলা হয়। রাকেশ-ভিলা থেকে মাত্র মাইলখানেক দূরে। আর একটা মেয়েকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না।

তারপরেই ঘটল কাল রাতের ঘটনা।

বাড়িতে লোকজন এসেছিল। রাকেশেরই বন্ধুবান্ধব। হইহুল্লোড় চলেছে সকাল থেকেই। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, সাঁতার…

বলতে ভুলে গেছি। ছবিঘে বাগানবাড়ির মধ্যে সুইমিং পুলও রেখেছে রাকেশ। ভারি সুন্দর ডিজাইন। ঠিক যেন নীল রঙের একটা ঝিনুকের খোলা।

একদম তলায় কাঁচটাকা আলো। সে আলো জ্বললে মনে হয় বুঝি মুক্তো ঝিলিক মারছে শুক্তির বুকে।

দুপুর নাগাদ খানাপিনা শেষ করে বন্ধুবান্ধব নিয়ে কলকাতায় শপিং করতে গেছিল রাকেশ। নিয়ে গেছিল ক্রিস্টিনের মার্সিডিজ ৩০০ সেল গাড়িখানা। নিজের ক্যাডিলাক গাড়ি রেখে গেছিল গ্যারেজে। টাকার তো মা-বাপ নেই। প্রোমোটার হলে যা হয়–যেভাবে পারে টাকা উড়িয়েছে।

ফটকে দাঁড়িয়ে বিদায় জানিয়েছিল ক্রিস্টিন। সঙ্গে যায়নি। বাড়িতে তার অনেক কাজ। ঘরদোর পরিষ্কার করতে হবে। রাতের খানাপিনা রেডি করতে হবে। তিন বছরের মেয়েটাকে সঙ্গ দিতে হবে।

কত বয়স ক্রিস্টিনের।

তেত্রিশ। রাকেশের চল্লিশ। দেখলে অবশ্য বুঝবেন না। সুখ মানুষের বয়স কমিয়ে দেয়।

গেস্টদের নিয়ে রাত পৌনে নটায় বাড়ি ফিরেছিল রাকেশ। গাড়িতে বসে বলেছিল বন্ধুদের, কাঁটায় কাঁটায় পৌনে নটা। এক রাউন্ড কফি হয়ে যাক। তারপর চলবে হুইস্কি। জনি ওয়াকার।

এই বলেই রিমোট কন্ট্রোলে খুলে দিয়েছিল গ্যারেজের রোলিং শাটার, মার্সিডিজের জোরালো হেডলাইট গিয়ে পড়েছে শাটারে। মেঝে ছেড়ে একটু-একটু করে উঠছে ওপর দিকে। তলার ফাঁকে দেখা গেছিল চকচক করছে রক্তের ধারা–গড়িয়ে বেরিয়ে আসছে গ্যারেজের ভেতর থেকে।

শাটার তখনও উঠছে ওপর দিকে। স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে থ হয়ে বসে রয়েছে রাকেশ। চোখ ঠিকরে আসছে গেস্টদের। তারপরেই শুধু একটা নাম আর্তনাদের আকারে বেরিয়ে এল রাকেশের ভাঙা গলা দিয়ে–ক্রিস্টিন।

শাটার পুরো উঠে গেছে ওপরে। মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে ক্রিস্টিন। রক্তের নদীর মধ্যে। রক্ত ছিটকে লেগেছে পাশের ক্যাডিলাক গাড়িতে। ভোতা ভারি হাতিয়ার দিয়ে পিটিয়ে ছাতু করা হয়েছে মাথা। পাশবিক জিঘাংসা না থাকলে এমনভাবে খুন করা যায় না।

গ্যারেজে যখন নরপশু পিটছে মা-কে, মেয়ে তখন কোথায় জানেন? ওপরতলায়। মুগ্ধ চোখে দেখছে টেলিভিশন। রোলিং শাটার যখন উঠে গেল–তখন সে বসে টিভির সামনে। মা কখন আসবে, গল্প বলবে, ঘুম পাড়াবে–এই প্রতীক্ষায় একদম নড়েনি বিছানা ছেড়ে। পুলিশ এসেছিল কাল রাতেই। পাড়াপড়শি বলেছে, এ সেই প্রফেশনাল কিলার-এর কাজ। হপ্তা কয়েক আগেই যে লোকটা স্কুলের মেয়েকে রেপ করে পিটিয়ে মেরেছে–একই ভাবে মাথা গুঁড়িয়েছে ডান্ডা মেরে–আর একটা মেয়েকে তো খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না।

ক্রিস্টিনের সুন্দর শরীরটাকেও কি ভোগ করেছিল নরপশু?

টাকায় সব হয়। কনট্যাক্ট থাকলে সবাই নড়ে বসে। আজ সকালেই স্পেশাল অটোন্সি রিপোর্ট পাওয়া গেছে। রেপ করা হয়নি ক্রিস্টিনকে। খুবলোয়নি শরীরের কোনও জায়গা। শুধু সাতবার ডান্ডা মেরেছে মাথায়।

পুলিশের সিদ্ধান্ত এক্ষেত্রে যা হওয়ার তাই হয়েছে; কেস আত্মহত্যার নয়নরহত্যা। চুরি ডাকাতিও হয়নি। রাকেশ সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত। কোনও জিনিসই খোয়া যায়নি। খুন হয়েছে চকিতে আর নিঃশব্দে। এত চুপিসারে যে নির্জন বাড়ির দোতলায় বসে টিভি দেখে গেছে তিনবছরের মেয়েটা টের পায়নি কিছু। রাকেশরা ফিরে আসার একটু আগেই হয়েছে মার্ডার। কেননা, ডেডবডির চারপাশে পড়ে থাকা রক্ত তখনও ছিল টকটকে লাল–পুরোপুরি অক্সিজেন বোঝাই। ফুলবাগান আর গাছপালা দিয়ে ঘেরা বলে বাড়িটা পাড়াপড়শিদের উঁকিঝুঁকির বাইরে। খুনি সহজেই চম্পট দিয়েছে।

ইন্দ্রনাথবাবু, এই পর্যন্ত সব পরিষ্কার। এ কেস নিয়ে পুলিশ আর মাথা ঘামাবে না–তাদের অনেক বড় কাজ রয়েছে। স্ত্রী যখনই খুন হচ্ছে, রাকেশ তখন বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রায় বিশ মাইল দুরে কলকাতার নিউমার্কেটে সুতরাং স্ত্রী হত্যার দায়ে তাকে ফেলা যায় না।

কিন্তু আমার সন্দেহ তাকেই। কারণ? মাস তিনেক আগে ক্রিস্টিন আমার কাছে গেছিল। গোয়া থেকে তার বাবা আর মা বলেছিল অ্যাডভোকেটকে সব কথা জানিয়ে রাখতে। সব কথার সার একটাই কথা। রাকেশকে ডিভোর্স করতে চায় ক্রিস্টিন। বাবা-মাকে যা লিখে জানিয়েছে আমাকেও বলে গেল সেই কথা।

বাইরে সুখের চালচিত্র আঁকলেও ভেতরে-ভেতরে জ্বলছিল অশান্তির আগুন। সুখের হয়নি এ বিয়ে। আগেই বলেছি আপনাকে, অমৃতসরের বান্ধবী মার্গারেটকে কলকাতায় এনে বিয়ে করতে চেয়েছিল রাকেশ। মার্গারেট আসতে চায়নি কারণ, তখন রাকেশের পকেট ছিল গড়ের মাঠ– ছুঁচোয় ডন মারছিল সেখানে। ঘোড়েল মেয়ে মার্গারেট তাই ছিল তফাতে।

বোম্বাই গিয়ে আর এক গোয়ানিজ মেয়ে পেয়ে তাই বর্তে গেছিল রাকেশ। মার্গারেটকে টাইট মারার মোক্ষম সুযোগ। টাইট খেয়ে গেছিল মার্গারেট।

গোয়ায় ক্রিস্টিনকে নিয়ে গিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজের ঐশ্বর্যের কথা জাহির করেছিল রাকেশ ভয়ানক ঘুঘু বলেই খবর চলে যাক মার্গারেটের কাছে। জ্বলে মরুক ঈর্ষায়।

হয়েও ছিল তাই। ধূর্ত মার্গারেট যখন দেখলে, পাখি প্রায় উড়ে গেছে, তখন ফঁদ পেতেছিল মেয়েদের চিরকালের ছলাকলা দিয়ে।

সে ফঁদে ধরা পড়েছিল রাকেশ।

চিঠিপত্র চলছিল সমানে–প্রথম-প্রথম ক্রিস্টিন কিসসু জানতে পারেনি।

পারল সেইদিনই, যেদিন মার্গারেট এল কলকাতায়। লর্ড সিনহা রোডের একটা গোয়ানিজ ফ্যামিলির বাড়িতে উঠল পেয়িং গেস্ট হয়ে। গোপনে দেখাসাক্ষাৎ চালিয়ে গেল রাকেশের সঙ্গে।

ক্রিস্টিনের তা অজানা রইল না। প্রথম সন্দেহটা হয়েছিল রাকেশের হাবভাব দেখে। মেয়েরা সব বোঝে। ওদের কাছে কিছুই লুকোনো যায় না। প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়ে–

এই পর্যন্ত শুনে ইন্দ্রনাথ ডানহিল নামালো দাঁহের ফঁক থেকে।

বললে, জানি।

আশ্চর্য হলেন রতিকান্ত সমাদ্দার, কীভাবে?

প্রথমে এসেছিল আমার কাছে। এসব পেটি কেস আমি হ্যান্ডল করি না শুনে রেগেমেগে বেরিয়ে গেছিল। তবে কোথায় গেছিল, সেটা জানি। ঠিকানাটা আমিই দিয়েছিলাম।

জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে রইলেন রতিকান্ত সমাদ্দার।

ইন্দ্রনাথ বললে, প্রেমচাঁদ প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে–আমার বন্ধুর অফিসে। তারপর?

.

রতিকান্ত সমাদ্দার বলে চললেন তার বাকি কথা। প্রায় একই কথা।

ঠিক সেই সময়ে শোনা যাচ্ছিল গোয়েন্দানী নারায়ণীর কণ্ঠ–অন্য জায়গায়।

সে এখন বসে রয়েছে রাজাবাজারের বস্তি পাড়ায়। দিনের আলোয় এখানে হাজারো বিজনেসের জলুস। রাতের অন্ধকারে গলিখুঁজিতে চোখ জ্বলে আদিম কামনায়, চলে হরেক পাপের অগুন্তি ব্যবসা। গেরস্থরা সেসবের খবর রাখে না।

রাখে কিন্তু গোয়েন্দানী নারায়ণী। সে যে এই লাইনের লোক। বিচরণ করে অবশ্য রাজহংসীর মতো। কাদা আর পাঁক গায়ে লেগে থাকে না।

রাতের নগরী কলকাতায় যে-যে অঞ্চল কুৎসিত আর ভয়াবহ হয়ে ওঠে–এই পাড়া সেগুলোর একটা।

বড় রাস্তায় ট্রামলাইন ঘেঁষে সারি-সারি ঝকমকে দোকান। তিনতলা একটা বাড়ির একতলাতেও তাই। দোতলা আর তিনতলায় অন্য অফিস। বৈধ উপায়ে অবৈধ কাজের অফিস।

নারায়ণী বসে রয়েছে এমনি একটা অফিসে। ওর সামনে একটা চৌকোনো টেবিল। অদ্ভুত ডিজাইন। ঘরটাও চৌকোনা। সিলিং খুব নিচু। সাদা প্লাস্টারের ফুল লতাপাতা। দেওয়ালে ডুমোডুমো ফোম রবারের গদি। সাউন্ড-প্রুফ ঘর। একটি মাত্র দেড় টন এয়ারকন্ডিশনার চলছে ফুরফুর করে।

টেবিলের ওদিকে বসে কর্নেল ফ্লিন্ট। সেল্ফ-স্টাইলড কর্নেল। আর্মিতে জীবনে নাম লেখায়নি। তার আর্মি সে নিজে গড়ে নিয়েছে। বেকারের অভাব নেই। তার কাজের লোকের অভাব নেই। নিজে জন্মেছিল পতিতার গর্ভে। ব্যবসা জমিয়েছে পতিতাপল্লীতেই। জমজমাট ব্যবসা। তার শেকড় সর্বত্র। বটগাছ বললেই চলে।

বয়স বেশি নয় কর্নেল ফ্লিন্টের। মাত্র পঁয়ত্রিশ। নিপাট ভালো মানুষের মতো চেহারা। রোগা। বেঁটে। শুকনো। এরকম অ্যাংলো গণ্ডায়-গণ্ডায় দেখা যায় ইলিয়ট রোডে।

নারায়ণী তার চোখে-চোখে চেয়ে বলে যাচ্ছে, কর্নেল, প্রেমাদ ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ক্রিস্টিন দরবার করার আগে ওর প্রাণের সখী সিনথিয়াকে জানিয়ে রেখেছিল রাকেশের সঙ্গে বিয়েতে ঘুণ ধরেছে। এজেন্সি থেকে সিক্রেট রিপোর্ট পাওয়ার পর বলেছিল সিনথিয়াকে, ওরা আমাকে সরিয়ে দেবেই। ঘর করছি একটা পিশাচের সঙ্গে। ডিভোর্স দেবে না। দিলেই তো খোরপোষ চাইব। প্রপাটির শেয়ার চাইব। বিজনেস দারুণ চলছে। বছর পনেরো নিশ্চিন্ত টাকার হিসেব থাকবে না। ডিভোর্স দেবে না ওই জন্যেই। কিন্তু আমাকেও বাঁচতে দেবে না। সিনথিয়ার বিশ্বাস, রাকেশই খতম করেছে। ক্রিস্টিনকে। কাল এসে বলে গেল সব কথা। পুলিশ কিছু করবে না। কিনে রেখেছে রাকেশ। সিনথিয়াকে বলে দিয়েছি, রাকেশকে দিয়েই কবুল করাববিশ মাইল দূরে থেকেও ভাড়াটে লোক দিয়ে সে-ই খুন করিয়েছে ওয়াইফকে।

কর্নেল এক দৃষ্টে চেয়ে আছে নারায়ণীর চোখের দিকে–যে চোখে চোখ রাখলেই রোমাঞ্চিত কলেবর হয় না–এমন পুরুষ ধরাধামে নেই।

কর্নেল ফ্লিন্টের ধমনীতে বইছে অর্ধেক ব্রিটিশ রক্ত। বাকি অর্ধেক এসেছে আরবের মরুভূমি থেকে।

ধূসর নির্ভাষ চোখে তার আভাস মেলে যখন সে পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে। এখনও সে চেয়ে আছে সেইভাবে।

শকুনির চোখে পলক পড়ছে না।

নারায়ণী বললে, প্রেমাদ ডিটেকটিভ এজেন্সির রিপোর্ট সব রহস্য ফাঁস করে দিয়েছে। প্রমাণ এনে দিয়েছে ক্রিস্টিনের হাতে। মার্গারেটের সব চিঠি রাকেশ রেখে দিয়েছিল অফিসে। বিজনেস ফাইলে। চিঠির তাড়া চলে এসেছিল ক্রিস্টিনের হাতে। ব্যভিচারিতার কেস মজবুত করার ডকুমেন্টারি এভিডেন্স। রাকেশকে চার্জ করেছিল ক্রিস্টিন। বলেছিল–শেয়ার দাও–ডিভোর্স দেব। প্রচণ্ড চেঁচামেচি হয়ে গেছিল সেদিন। বাড়ির ঝি জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে। যাওয়ার সময়ে বলে গেছে– এ বাড়িতে আর টেকা যাবে না। ঝি-কেও জেরা করে প্রেমাদ ডিটেকটিভ এজেন্সি জেনেছে সেদিন কী কী কথা হয়েছিল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে।

কী যেন জিজ্ঞেস করতে গিয়েও চুপ করে গেল কর্নেল ফ্লিন্ট।

নারায়ণী বললে, ক্রিস্টিন খুন হয়েছে, এ খবর পেয়েই অত রাতে সিনথিয়া ছুটে এসেছিল আমার কাছে। রাকেশের পরনারী গমনের ডকুমেন্টারি এভিডেন্স তুলে দিয়ে গেছে আমার হাতে। তার কিছুক্ষণ পরেই পেলাম একটা খাম। লকারের চাবি আর তোমার চিঠি। টাকা নিয়ে সরে দাঁড়াতে বলেছ। তাই এলাম তোমার কাছে। চিঠির জবাব মুখেই দিয়ে যাই। রাকেশ মরবে–আমার হাতে। এই রইল তোমার লকারের চাবি–ক্ষমতা আছে বটে তোমার। অত রাতে বিলিতি ব্যাঙ্কের লোককে ম্যানেজ করলে কীভাবে?

বুকের খাঁজে হাত গলিয়ে দিয়ে লকারের চাবি টেনে এনে টেবিলে ছুঁড়ে দিল নারায়ণী। সেদিকে তাকাল না কর্নেল।

শুধু বললে রেশম মসৃণ নরম গলায়, দেবী, তুমি কথা বলছ ঠিক ভারতীয় নারীদের মত। অনেকদিন ধরেই তোমার খোঁজ রাখছিলাম। তুমি আমাদের পথের কাঁটা। পঁচিশ লাখেও তোমাকে কেনা গেল না। এরকম পঁচিশ আরও পেতে সুন্দরী যদি আসতে আমার আর্মিতে। চোখা মেয়ের বড় অভাব চলছে। যাক, যখন এলে না–তখন তোমাকেও রাখব না। পায়ের তলাতে ঘাস গজাতে আমি দিই না। ক্রিস্টিন আর সিনথিয়ার যে দশা হয়েছে–তোমারও হবে তাই।

চোখের পাতা একটুও কাঁপল না নারায়ণীর, দুহাত রয়েছে টেবিলের ওপর। চোখের কোণ দিয়ে টের পেল পেছনের দরজা নিশ্চয়ই একটু ফাঁক হয়েছে আলো ঢুকছে সেই কারণে। ফাঁক যখন হয়েছে, ফায়ার আর্মস-এর চোখও নিশ্চয় টিপ করেছে ওর পৃষ্ঠদেশ।

পিঠ সিধে রেখে বললে, ক্রিস্টিনকে খুন করেছে তোমার লোক?

এ বাড়িতেই সে আছে। আগে বসিং লড়ত। এখনও লড়ে দুশমনদের সঙ্গে। বড় বাজে অভ্যেস। হাত ভেঙে দেয় মোচড় দিয়ে। তোমার সঙ্গেও লড়বে। ধৈর্য ধরো, ভারতীয় নারী।

অবিচলিত কণ্ঠে বললে নারায়ণী, সিনথিয়ার কী দশা হয়েছে?

ভারি মিষ্টি হাসল কর্নেল ফ্লিন্ট, সে তো আমার হিট লিস্টেই ছিল। যার নুন খাব, তার কাজ পুরো করে দেব। রাকেশ সাহেবই দিয়েছিল মেয়েটার নাম ঠিকানা। নজরে ছিল বলেই দেখলাম অত রাতে দৌড়েছে তোমার কাছে। মাই গড। তোমার ডেরা থেকে বেরতেই তুলে আনলাম। সারারাত তাকে এনজয় করেছে আমার লোকগুলো। এখন ঘুমোচ্ছে। আজ রাতে তোমার পালা। তার রেস্ট। এইভাবেই চলুক কিছুদিন–তারপর লড়িয়ে দেব বক্সারের সঙ্গে–মেয়ে মর্দানির সঙ্গে কক্ষনও লড়েনি। নতুন টেকনিক দেখাবে মনে হচ্ছে। হাত ভেঙে হয়তো টেনে ছিঁড়ে আনবে–

বলে নারায়ণীর বক্ষশোভার দিকে তাকিয়ে উচ্চহাস্য করে উঠল ফ্লিন্ট।

এইটাই ছিল সঙ্কেত। এই হাসিটা। পুরো খুলে গেল পেছনের দরজা। উঠতে যাওয়াটা ভুল হবে বুঝে বসেই রইল নারায়ণী। পিঠে অনুভব করল শক্ত খোঁচা। ফায়ার আর্মস।

মিঠে হাসে ফ্লিন্ট, আমার অস্ত্রাগারের লেটেস্ট অটোমেটিক এখন তোমার পিঠে লেগেছে, সুন্দরী। দলে এসো, এরকম জিনিস অনেক পাবেনা এলে, ঈষৎ সঙ্কুচিত হল ফ্লিন্টের একটা চোখ।

খুলে গেল পরক্ষণেই, ভালো কথা, মাই বিউটি। এই কেসে অনেক খবরই রেখেছ–একটা খবর পাওনি। জানা দরকার তোমার। জানবার পর হয়তো রাকেশ হত্যার প্ল্যান মাথা থেকে মুছে ফেলবে। মাসুদ, লক্কা পায়রাটাকে পাঠিয়ে দে।

নারায়ণীর পিঠ থেকে নলচে সরে গেল না। মাসুদ নামধারী স্যাঙাৎ নিশ্চয় দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। ফ্লিন্ট চেয়েছিল সেইদিকেই। পায়ের আওয়াজ সরে গেল দুরে।

ফ্লিন্ট বলে গেল সিল্ক-নরম গলায়, তোমার মতো সুন্দরী একজনও যদি থাকত আমার আর্মিতে–ডোজ পড়লেই সুর অবশ্য পালটাবে–খালিস্তানিদের হাতেই তোমাকে ছেড়ে দেব ভাবছি। কলকাতায় ওদের সেলটার দিচ্ছি তো আমিও–মাথা পিছু এক লাখ অ্যাডমিশন ফী–রাতের খরচ আলাদা–তুমি থাকলে রোজগার হবে ভালোই।–এই যে লক্কা, এসো, ভেতরে এসো।

মার্জারের মতো নিঃশব্দ চরণে একব্যক্তি টেবিল ঘুরে গিয়ে দাঁড়াল ফ্লিন্টের চেয়ারের পাশে। গায়ে গিলে করা কেমব্রিকের পাঞ্জাবি। বোতাম হিরের। ভেতরে গেঞ্জি নেই। ফরসা গা ফুটে বেরচ্ছে। ডুমোডুমো পেশি ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঘাড়েগদানে সমান। শুয়োরের মতোন। মুখখানাও সেইরকম। অমানুষিকতা প্রকট হয়েছে প্রতিটি রেখায়। চাহনি ক্ষুধার্ত। চোখ দিয়ে যেন চেটে খাচ্ছে নারায়ণীর সর্বাঙ্গ।

সিল্ক-সফট গলায় ফ্লিন্ট বললে, এই আমাদের লক্কা বাহিনীর বক্সার হাত ভেঙে দেয় হারিয়ে দিয়ে। তোমার কী করবে, সেটা পরে টের পাবে। লক্কা, তুই খুন করেছিস ক্রিস্টিনকে? উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতলবে হপ্তাকয়েক আগে স্কুলের মেয়েটাকে রেপ করে খতম করেছিলিস? আর একটা মেয়েকে লোপাট করে চালান দিয়েছিস?

ঘাড় নেড়ে সায় দিল লক্কা। চোখ কিন্তু নারায়ণীর দিকে। ঠোঁট চাটছে জিভ দিয়ে।

ক্রিস্টিনকে তুই আগে থেকে চিনতিস? আবার ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে গেল লক্কা নামধারী লম্পট।

সেই জন্যেই নির্জন বাড়ির গ্যারেজ ঘরে দেখা করেছিল তোর সঙ্গে?

হ্যাঁ, এতক্ষণে একটি অক্ষরে জবাব দিল লক্কা। চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেললে কণ্ঠস্বর যেরকম দাঁড়ায়-লক্কার গলার সুর সেইরকম।

তার আগে ক্রিস্টিনের সঙ্গে তোর আলাপ হয়েছিল কেন?

দাঁত বেরিয়ে পড়ল লক্কার। লালচে-হলুদ দাঁত। হাসছে। হেসে-হেসে যা বলে গেল, শুনে থ হয়ে গেল গোয়েন্দানী নারায়ণী।

.

বকে-বকে ক্লান্ত হয়েছেন রতিকান্ত সমাদ্দার। এখন তিনি স্তব্ধ।

ইন্দ্রনাথ ডানহিল নামিয়ে রেখেছে। দুই চোখে দূরবিস্তৃত চাহনি। চিন্তাচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে আছে ঘরের ওপর কোণে।

একটু পরে দৃষ্টি ফিরে এল টেলিফোনের দিকে। তুলল রিসিভার। কথা হয়ে গেল প্রেমাদ ডিটেকটিভ এজেন্সির ক্যালকাটা ব্রাঞ্চে। ছোট্ট রিপোর্ট শুনে নিল টেলিফোনেই।

বললে, ডকুমেন্টারি এভিডেন্স সবই কি ক্রিস্টিনের কাছে?

না, জবাব এল তারের মধ্যে দিয়ে, উনিই আমাদের জানিয়েছিলেন বাড়িতে রাখা নিরাপদ নয় বলে গচ্ছিত রেখেছেন বান্ধবীর কাছে।

বান্ধবীর নাম?

সিনথিয়া ডিয়েট্রিক।

তার ঠিকানা জানেন? জানেন। দেখুন তাকে পান কিনা।

আস্তে রিসিভার নামিয়ে রাখল ইন্দ্রনাথ। চিন্তাকুটিল চোখে কিছুক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললে রতিকান্ত সমাদ্দারকে, রাকেশের ঠিকানা দিয়ে যান। হ্যাঁ, আপনি যান– আপনার কার্ডও রেখে যান। এর মধ্যে ব্রেনওয়ার্কটা কোথায়, তাই তো বুঝছি না। রাকেশ মার্ডার করিয়েছে কাউকে দিয়ে–তাকে চাই?

আজ্ঞে। তাহলেই রাকেশকে কোর্টে ফাসানো যাবে।

দেখি।

.

একঘণ্টা পরে বাজল রিঙ। ঘর এখন ফাঁকা। আর এক ছিলিম টানা হয়ে গেছে ডানহিলে। ঘণ্টা বাজতেই ছোঁ মেরে রিসিভার তুলে নিল ইন্দ্রনাথ। কানপেতে শুনল পিক পিক রিপোর্ট। নামিয়ে রাখল যন্ত্র।

সিনথিয়া কাল রাত থেকে নিরুদ্দেশ।

.

বাড়ি বটে একখানা। ছবিঘে ফুলবাগানে মাত্র দোতলা বাড়ি। প্রাসাদের খুদে সংস্করণ।

একতলার ঘরে পরিচয় হল রাকেশ মালহোত্রার সঙ্গে। অতিশয় সুদর্শন, অতিশয় মিষ্টভাষী, অতিশয় সফিসটিকেটেড এক যুবক। হিন্দি সিনেমার পরদা থেকে নেমে আসা হিরো বললেই চলে। এখন তার মুখ জুড়ে থইথই করছে বিষাদ-সমুদ্র। ঘরে সে একা ছিল না। সমবয়েসি প্রায় সমান সুদর্শন এক যুবক বসেছিল গম্ভীর মুখে। রাকেশই আলাপ করিয়ে দিল তার সঙ্গে। যুবকের নাম রোশনলাল। বাড়ি চণ্ডীগড়ে। অফিসও সেখানে। সল্টলেকে এসেছিল অফিসের কাজে। সকালে ইংরেজি কাগজ খুলে খবরটা পড়েই দৌড়ে এসেছে। রাকেশ তার অনেকদিনের বন্ধু। বিয়ের আগে থেকে।

পরিচয়-পর্ব সাঙ্গ হওয়ার পর রাকেশ চতুরভাবে চট করে চলে এল কাজের কথায়, মিঃ রুদ্র, আপনি ডিটেকটিভ। এ কেসে কে আপনাকে লাগিয়েছে?

কেউ না। নিজের ইন্টারেস্টেই এলাম।

সরু চোখে চেয়ে রইল রাকেশ। এখন তার মুখের বিষাদের মেঘ অনেকটা ফিকে।

কী জানতে চান বলুন?

আপনার স্ত্রীর এক বান্ধবীর নাম সিনথিয়া? সিনথিয়া ডিয়েট্রিক?

ঘাড় নেড়ে নীরবে সায় দিয়ে গেল রাকেশ। অনিমেষ চক্ষু নিবদ্ধ ইন্দ্রনাথের হীরক চক্ষুর ওপর।

গলায় শান দিয়ে নিল ইন্দ্রনাথ, তিনি এখন কোথায়?

অসাধারণ অভিনেতা বটে রাকেশ। অবিচল রইল মুখভাব। কিন্তু চোখের তারায় যেন লাগল ছোট্ট ধাক্কা। ক্ষীণ কঁপুনি চোখ এড়াল না ইন্দ্রনাথের।

রাকেশ বলল, এ প্রশ্ন আমাকে কেন?

কারণ তাকে পাওয়া যাচ্ছে না কাল রাত থেকে।

সিনথিয়া? কাল রাতেই তো ফোন করেছিল–যাকে চাইছিল, সে তখন ছিল না। এর বেশি তো জানা নেই।

উঠে দাঁড়িয়েছে রোশনলাল। হাওয়া যেরকম ভারি হয়ে উঠেছে, তার আর থাকা সমীচীন নয়। রাকেশের অনুরোধ এড়িয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। একটু পরেই শোনা গেল তার গাড়ির আওয়াজ। জানলা দিয়ে নম্বর প্লেটটা দেখে নিল ইন্দ্রনাথ।

শক্ত গলায় বললে রাকেশ, মিঃ রুদ্র, কেউ যখন আপনাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়নি–তখন আমি দিচ্ছি আপনাকে। পুলিশকে দিয়ে হবে না। ক্রিস্টিন-এর মার্ডারারকে বের করুন। আপনার পারিশ্রমিক কত?

একটু থেমে ইন্দ্রনাথ বললে, টোয়েন্টি থাউজান্ড। ফিফটি পারসেন্ট ইন অ্যাডভান্স।

পাঁচ মিনিট পরে ট্যাকসিতে উঠে বসল ইন্দ্রনাথ। ওর পকেটে ফুটছে দশহাজার টাকার একখানা চেক।

ঘুষ!

.

রাকেশ ভিলা থেকে বেরিয়ে কিছুদূর এসে তেমাথা। বাঁদিকে মোড় নিতে গিয়ে দাঁড় করাতে হল ট্যাক্সি।

রোশনলাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে। হাত বাড়িয়ে রুখেছে ট্যাক্সি। বললে, ট্যাক্সি ছেড়ে দিন, ইন্দ্রনাথবাবু, চলে আসুন আমার গাড়িতে।

.

সুভাষ সরোবর। ইন্দ্রনাথের বাড়ি। বৈঠকখানা ঘর।

ইন্দ্র বলছে, প্রথম পরিচয়েই আপনার পরিষ্কার বাংলা শুনে আঁচ করেছিলাম আপনি আদতে কলকাতার মানুষ। গাড়ির নাম্বার নোট করে নিয়েছিলাম–খুঁজে বের করতামই। কিন্তু আপনি এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। যা বললেন তা থ্রিলিং।

রোশনলাল বললে, কিন্তু প্রমাণ?

এই নিন টেপরেকর্ডার। ফিরে যান বন্ধুর কাছে। ছোট্ট ক্যাসেট রেকর্ডার। পকেটেই রাখবেন। কথা বলুন পুরোনো প্রসঙ্গ নিয়ে–সেই সব কথা–যা শুধু প্রাণের বন্ধু হিসেবে রাকেশ বলেছিল আপনাকে। ক্রিস্টিনকে খুন করবার কত রকম ফন্দি এঁটেছিল–।

মোট আটরকম। প্রথমে ঠিক করেছিল, গুলি করাবে ভাড়াটে খুনি দিয়ে ডাকাতির অছিলায়। তারপর ভেবেছিল, গাড়ির ব্রেক বিগড়ে রাখবে। তিন নম্বর প্ল্যানটা ছিল, সুইমিং পুলে ইলেকট্রোফিউশন–

ক্যাসেট ফুরোনোর আগেই সব কথা বলবেন–ওকে দিয়েও সায় দেওয়াবেন। বলবেন, কাজটা ভালো করলে না…

.

পরের দিন সকালে ক্যাসেট রেকর্ডার পৌঁছে গেল ইন্দ্রনাথের বাড়িতে। শেষের দিকে রাকেশ বলছে, তুমিই শুধু জানলে…।

ইন্দ্রনাথের টেপ শেষ হল, হার্লে ডেভিডসন ব্রেক কষলো ওর বাড়ির সামনে। আওয়াজ শুনেই উঠে দাঁড়িয়েছিল ইন্দ্রনাথ–ঘর থেকে বেরোনোর আগেই ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল একটি নারীমূর্তি। তার নাকের পাটা ফুলে-ফুলে উঠছে, দুই চোখে আগুন ঝরছে। চুল তার উসকোখুসকো, পোশাক ছেঁড়াখোঁড়া।

মূর্তিমতী প্রভঞ্জন বললে তীব্রস্বরে, আপনি ইন্দ্রনাথ রুদ্র? আমি গোয়েন্দানী নারায়ণী।

স্থির চোখে তাকিয়ে ইন্দ্র বলল, নাম শুনেছি। কী কাণ্ড করে এলে, বোন?

কর্নেল ফ্লিন্টের আস্তানা উড়িয়ে দিয়ে এলাম। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একটা পাপের ডেরা। রাজাবাজার বস্তির আগুন নেভাতে কলকাতার সব দমকল এখন হাজির। নাইট্রোগ্লিসারিন আর আর. ডি, এক্স-এর গুদোম ছিল–উড়িয়ে দিয়েছি রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে। আমার গায়ে হাত। শয়তান। সিনথিয়াকে কিন্তু বাঁচাতে পারলাম না।

চমকে উঠল ইন্দ্রর শিরদাঁড়া, সিনথিয়া ওখানে?

হ্যাঁ আপনাকেও যেতে হত। রাকেশ ফোনে জানিয়ে দিয়েছে ফ্লিন্টকে। তাই তাড়াতাড়ি বেরোতে গিয়ে লক্কাও খতম হয়ে গেল। যাকে দিয়ে খুন করানো হয়েছে ক্রিস্টিনকে। কিন্তু আপনি আসল জিনিসটা জানেন না–আমিও জানতাম না। জানত লক্কা–সে থাকলে নিজেই কবুল করত।

আসল জিনিস মানে?

লক্কার কাছে অ্যাপ্রোচ করেছিল ক্রিস্টিন-ও। খুন করাতে চেয়েছিল রাকেশকে। স্বামী আর স্ত্রী দুজনেই চেয়েছে একজন আর একজনকে খতম করতে। হরিবল। ইন্দ্রনাথদা, আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম–খতম করবই রাকেশকে।

মেহনিবিড় গলায় বললে ইন্দ্রনাথ, দরকার কী? বাঘের শত্রু ষাঁড়ে মারে। রাকেশের বিরুদ্ধে কেস পাকা করে এনেছি। এগোক আইনের পথে।

তাহলে আমি চলি আমার পথে।

নিমেষে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল মূর্তিমতী প্রভঞ্জন। নিরেট গম্ভীর নিনাদে সুভাষ সরোবর কাঁপয়ে উধাও হয়ে গেল মেটাল মন্সটারি।

প্রশ্ন একটাই থেকে যায়। একা নারায়ণী কর্নেল ফ্লিন্টের দুর্ভেদ্য দুর্গ উড়িয়ে দিল কী করে? বেরিয়ে এল কীভাবে?

আজকের ভারতীয় নারীই বিশ্বের প্রথম নারী যারা এভারেস্টের শৃঙ্গ জয় করেছে।

কৌশলে সবই হয়। সূক্ষ্ম বুদ্ধির কাছে চিরকালই পরাজিত হয়েছে মোটা বাহুবল।

মার্শাল আর্টে বলীয়সী নারায়ণী অবশ্য বাহুবলের একটা স্বাক্ষর রেখে গেছে দুর্গ উড়িয়ে দেওয়ার আগে। লক্কার পায়রার শিরদাঁড়া মাঝখান থেকে ভেঙে দিয়েছে। মুচড়ে দিয়েছে গলা– পুরো একপাক।

বাকি কাহিনি দীর্ঘ, বীভৎস এবং লোমহর্ষক। রক্ত জল হয়ে যেতে পারে। সুতরাং…!

* মিনোরমা পত্রিকায় প্রকাশিত। (শারদীয় সংখ্যা, ১৪০০)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *