1 of 2

জুয়েল বক্স

জুয়েল বক্স

জুয়েল বক্স চুরির গল্প এটা নয়। বরং ঠিক তার উলটো। অথচ তা অপরাধ।

নিভা আর নিখিল বিয়ে করেছিল ভালোবেসে। প্রথম দেখায় ভালোবাসা। লেকে বেড়াতে

বেড়াতে প্রথমে চার চোখের মিলন। তারপর আঙুলে-আঙুল ঠেকে জাপানি মন্দিরের ধ্যানী বুদ্ধের সামনে। দ্রিমি-দ্রিমি বাজনার তালে-তালে ওদেরও হৃদপিণ্ড দ্রিমি-দ্রিমি নেচেছিল সেই মুহূর্তে।

পরিণাম যা হয়, তাই হয়েছে। নিভার সীমন্তে সিঁদুর টেনে দিয়েছে নিখিল। তারপর ওই লেক রোডেই একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সংসার পেতেছে।

এই গেল আদি পর্ব।

পরের পর্বে দেখা গেল খিটিমিটি লেগেছে দুজনের মধ্যে। নিভা রূপসি হতে পারে, নিভা চটুলাও হতে পারে, নিভা ময়ুরী হতে পারে কিন্তু নিভার ভেতরে আছে এমন কয়েকটা বদ বাতিক, যা নিয়ে সুখী হওয়া যায় না। সেই সঙ্গে আছে প্যানপেনে কান্না। যখন তখন।

দুদিনেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে নিখিল। মনের রং ছুটে গেল কয়েক মাসেই। তারপর পালাই পালাই রব উঠল মনের কোণে কোণে।

এবার আসা যাক শেষ পর্বে।

এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছল নিখিলের গাড়ি। ইঞ্জিন বন্ধ করতেই ফোঁসফোঁস করে ফের কেঁদে উঠল নিভা। নিখিলের মনে হল, প্রচণ্ড ক্রোধে বুঝি ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে যাচ্ছে। অতি কষ্টে সামলে নিল নিজেকে।

বলল, নিভা, মনকে ঠিক কর। মায়ের ডাকে যাচ্ছ মায়ের কাছে এক মাস জিরেন নিতে। প্রথমে লাফিয়ে উঠেছিলে যাওয়ার জন্যে–তারপর বেঁকে বসলে না যাওয়ার জন্যে। এখন আবার শুরু করলে কান্নার সেই ঘেঁদো নাটক। কী চাও? যাবে, না যাবে না?

আ-আমি যাব…না, যাব না।ফোঁপানির মধ্যেই নিভা যা জানাল তার কোনও মানেই হয় না।

হাল ছেড়ে দিল নিখিল। একী গেরো রে বাবা! মাথা হেলিয়ে দিয়ে কটমট করে চেয়ে রইল গাড়ির ছাদের দিকে। সেকেন্ড কয়েক পরেই ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো হঠাৎ সিধে করল শিরদাঁড়া– টংকার শোনা গেল কস্তু কণ্ঠে।

নিভা তুমি যাচ্ছ। গেট রেডি।

ঘটাং করে দরজা খুলে নেমে পড়ল নিখিল। গাড়ির পেছনে গিয়ে আরও জোরে শব্দ করে খুলল ট্রাঙ্কের ডালা। কুলি সামনেই দাঁড়িয়েছিল রামভক্ত হনুমানের মতো। হেঁকে বলল নিখিল, দুটো সুটকেশ। বোম্বাই ফ্লাইট। জলদি।

আমার জুয়েল বক্স? গাড়ির ভেতর থেকে যেন আর্তনাদ করে উঠল নিভা।

পেছনের সিটে ব্রিফকেশের মধ্যে। মনে নেই গতবার দিল্লি থেকে জুয়েল বক্স কোলে নিয়ে ফেরবার পর কী কাণ্ড ঘটেছিল? জুয়েলভরতি বক্স সিটে রেখেই তো নেমে এসেছিলে। এবার তাই ব্রিফকেসের মধ্যে রইল তোমার সাধের রত্নবাক্স। বুঝেছ? রেগে তিনটে হয়ে বলল নিখিল।

কুলি ইতিমধ্যে সুটকেশ দুটো বগলদাবা করে এগিয়েছে। নিখিলও গেল পেছনে। কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার আগে পেছন ফিরে দেখল গাড়ির মধ্যে বসে তখনও রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে নিভাননী ওরফে নিভা।

ডিসগাস্টিং! বলেই সামনে ঘাড় ফেরাল নিখিল। কাঁচের কপাটে প্রতিফলিত আপন মুখচ্ছবি দেখে নিজেই চমকে উঠল। কাগজের মতো সাদা হয়ে গিয়েছে সে মুখ।

নিভার হাতে টিকিট গছিয়ে দিয়ে নিখিল বললে, তোমাকে আর একটা জিনিস দিতে বাকি রইল। তোমার রত্নবাক্সর চাবি। এই নাও। বলে রূপোর চেনে গাঁথা সোনার চাবিটা নিভার গলায় লকেটের মতো ঝুলিয়ে দিল নিখিল। এতক্ষণ দিইনি হারিয়ে ফেলবে বলে। জুয়েল বক্স খুলবে বাড়ি গিয়ে–বোম্বাইতে। তার আগে নয়। কেমন? দু-হাতের মধ্যে নিভার শ্যামল মুখশ্রী কাছে টেনে নিল নিখিল। এদিক-ওদিক দেখে টুক করে মুখ চুম্বন করে বলল, বিদায় ডার্লিং, বিদায়।

আবার কেঁদে উঠল নিভা। বিদায়কালীন শেষ চুম্বনে কী জাদু ছিল কে জানে, নিভা আর নিজেকে রুখতে পারল না। লাজলজ্জা ভুলে গলা জড়িয়ে ধরল নিখিলের।

একরকম জোর করেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিল নিখিল। ঠেলে দিল নিভাকে দণ্ডায়মান উড়োজাহাজের দিকে। কাঁদতে কাঁদতে এগুলো নিভা। এয়ারপোর্টের জোর হাওয়ায় নিশানের মতো উড়তে লাগল ওর ব্লু জর্জেটের আঁচল।

শেষদৃশ্য–বলল নিখিলের মন।

.

কয়েক মিনিট পর।

গাড়িতে এসে বসল নিখিল। মনটা বলাকার মতো পাখা মেলে উড়ে যেতে চাইছে সুনীল গগনে। মুক্তি! মুক্তি! চিরমুক্তি!

ইঞ্জিন গর্জে উঠেছে। ওর এক্সপার্ট হাতের মোচড়ে প্রবল পাক খেয়ে গাড়ি ছুটেছে এয়ারপোর্টের বাইরে। ভি-আই-পি রোডে এসে সিগারেট নিতে সামনের খোপে হাত দিল নিখিল। হাতে ঠেকল একটা ভাজ করা কাগজ।

লাল কাগজ। চিঠি। লিখেছে নিভা।

প্রিয়তম,

আমি জানি তুমি আর আমাকে চাও না। কিন্তু বিশ্বাস কর আর নাই কর– আমি তোমাকে ভালোবাসি। বোম্বাই থেকে ফিরে এসে তোমাকে আর দেখতে পাব কি না জানি না। কিন্তু আমার ভালোবাসার চিহ্ন স্বরূপ তোমার দেওয়া জুয়েল বক্স তোমাকেই দিয়ে গেলাম। ফের যদি বিয়ে করতে মন চায় তো আমার সতীনকে দিও।

নিভা।

আঁতকে উঠল নিখিল। জুয়েল বক্স! গাড়ির মধ্যে!

ব্রেক কষল তৎক্ষণাৎ। কিন্তু কোথায়…কোথায় সেই জুয়েল বক্স?

সময় নেই…আর সময় নেই…নিজের হাতে জুয়েল বক্সের মধ্যে টাইম ফিউজ বোমা রেখেছে নিখিল…উড়ন্ত অবস্থাতেই যাতে প্লেন ফেটে উড়ে যায় যাতে প্লেনের মধ্যে নিভাননীর নরম তনুটা ছিঁড়ে পুড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে শূন্যে ছড়িয়ে যায়–তাইতো তার সাধের রত্নবাক্সের মধ্যে টাইমবোমা রেখেছিল নিখিল। তারিফ করার মতো বউ নিধনের পরিকল্পনা কি শেষে বুমেরাং হয়ে যাবে? জুয়েল বক্স ফাটবে তারই গাড়ির মধ্যে–সেই সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হবে নিখিল?…

কোথায় জুয়েল বক্স? কোথায় সেই অভিশপ্ত জুয়েল বক্স? বি

দ্যুৎ চমকের মতো এতগুলো ভাবনা ঝলসে উঠল মনের আকাশে। বি

স্ফোরণটা ঘটল সঙ্গে-সঙ্গে।

গাড়ি আর নিখিলের দেহ অনেক টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল রাস্তার দুপাশে।

*অপ্রকাশিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *