1 of 2

রাতের আতঙ্ক

রাতের আতঙ্ক

রবিবার সকাল। দূরদর্শনে মহাভারতের পাট চুকে গেছে। সাপ্তাহিক আড্ডা মারতে বন্ধুবান্ধব আসবে এখন। আমি কলম মুড়ে রাখলাম। কবিতা আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে এসে বসল আমার পাশের চেয়ারে।

গিন্নি, তোমার গা রে গন্ধ। বিয়ের আগে অকাখেকে অর্জন করেছি।

বললাম, গিন্নি, তোমার গা থেকে পাঁঠা-পাঁঠা গন্ধ বেরোচ্ছে।

কবিতা বললে, ওটা সঙ্গ দোষের গন্ধ। বিয়ের আগে যখন আধপাগল হয়েছিলে, তখন পেতে আতরের গন্ধ–এখন পাচ্ছ পাঁঠার গন্ধ। সুতরাং গন্ধটা কোত্থেকে অর্জন করেছি, তা কি বলে দিতে হবে?

আমি বললাম, বুঝলাম। আমি পাঁঠা। কিন্তু তুমি পাঁঠার ঝোল খেতে চেয়েছিলে বলে পাঁঠা কিনে আনলাম। পাঁঠাতে তোমার রুচি আছে বলেই পাঁঠার মালা গলায় পরেছ। তবে, পাঁঠার ঝোল তোমার এত প্রিয় জানলে তোমার ছায়া মাড়াতাম না।

তোমাকে বেঁধে খেয়ে ফেলব, সে আশায় থেকো না। তুমি একটা অখাদ্য।

অখাদ্য!

এক্কেবারে। নইলে কোনকালে চেখে দেখতাম।

রোজই তো সে কর্মটা করছ। করে করে বুঝে গেছ, আমি একটা অখাদ্য।

মরণ।

এই বলে রূপসী ভার‍্যা আরও একটু গা-ঘেঁষে বসল। অমনি দোরগোড়ায় শোনা গেল অতি পরিচিত বিষম-খাওয়ার শব্দ।

ঠোঁট বেঁকিয়ে চোখ পাকিয়ে কবিতা বললে, আপদ! সাতসকালে গলায় কাঁটা ঢুকিয়ে বসে আছে।

চৌকাঠ পেরিয়ে এসে উত্তমকুমার ঢঙে ইন্দ্রনাথ বললে, হে মোর বন্ধুপত্নী, এ কাটা প্রেমালাপের কাটা। তোমাদের কাছে যা মধুময়, আমার কাছে তা কণ্টক।

বিষদৃষ্টিতে সুদর্শন বন্ধুবরের আসন গ্রহণ নিরীক্ষণ করতে করতে কবিতা বললে, তোমার মতো সুপুরুষ আইবুড়োদের এই ধরনের সেক্সয়াল অ্যাভারসন থাকলেই ধরে নিতে হবে তোমরা প্রত্যেকেই এক-একটা ক্রিমিন্যাল।

খুনে ক্রিমিন্যাল, হৃষ্ট কণ্ঠে বললে ইন্দ্রনাথ, যেমন ছিল জন জর্জ হেগ। ১২৩ বছর আগে বেচারা ফাঁসিকাঠে ঝুলেছে। খুন করে গলা কেটে গেলাস ভরে রক্ত নিয়ে পান করত ঢকঢক করে। ভারি সুন্দর চেহারা, মেয়েবন্ধু ছিল অনেক, কিন্তু প্রেম করত না কারুর সঙ্গে বিয়ের কথাও ভাবত না। খুন করে আর কঁচা রক্ত খেয়েই তার যত আনন্দ। শেক্সপীয়রের কথা ভুল বলে প্রমাণ করে দিয়েছিল। প্রচণ্ডভাবে সঙ্গীতপ্রিয় ছিল–গানবাজনা ওকে নিয়ে যেত সুরলোকে–এই লোকই আবার অসুর হয়ে যেত, অনর্গল মিষ্টি মিথ্যে বলে যেত, পাকা শিল্পীর মতো সই জাল করত, হাতের লেখা নকল করত। খুন-টুন করে লাশগুলোকে সালফিউরিক অ্যাসিডে নিশ্চিহ্ন করে দিত। রির্মাকেবল!

রিমার্কেবল! শিউরে উঠল কবিতা।

ইন্দ্রনাথ সিগারেট ধরিয়ে বললে, হেগ নাকি সিজোফ্রেনিয়া রোগে ভুগত। মনের রোগ। আমার কিন্তু সে রোগ নেই, বউদি। সুতরাং নির্ভয়ে থেকো।

এইবার আর-একটা অতিপরিচিত কৃত্রিম কাশির আওয়াজ ভেসে এল দোরগোড়া থেকে। কাশতে কাশতেই ভেতরে এসে ইন্দ্রনাথের পাশে এসে বললে পুলিশবন্ধু জয়ন্ত, মাই ডিয়ার টিকটিকি এইসব ব্যাপারই এখন আমার মাথায় ঘুরছে।

রক্ততৃষ্ণা জাগছে বুঝি? সকৌতুকে বললে ইন্দ্রনাথ।

অতীতে এ-রোগ কাদের হয়েছিল, সেই খোঁজ নিচ্ছি। হেগ রক্ত খেতে শিখেছিল ডাবল লাইফ বইটা পড়ে তাই না?

গম্ভীর হয়ে গিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে, খবর রাখিস তাহলে। গুড। ডাবল লাইফ এক কশাই এর গল্প। মানুষ মেরে তাদের রক্ত খেত, মাংস বেচে খদ্দেরদের খাওয়াত। এর বেশি আর কিছু জানিস?

জয়ন্ত বললে, আরও আছে?

আছে। ডাবল লাইফ উপন্যাসের নায়ক মনগড়া নয়। হ্যাঁনোভারে তার নিবাস। নাম, ফ্রিজ হারম্যান। চব্বিশটা ছেলেকে খুন করে তাদের মাংস বেচেছে আর রক্ত খেয়েছে।

মাই গড! বললে জয়ন্ত।

ইন্দ্রনাথ বললে, হেগ-এর রক্ততৃষা জেগেছিল আরও একজন নরপিশাচের কীর্তিকাহিনি পড়ে। নাম তার সিলভেস্টার মাটুস্কা। ১৯৩১ সালে বুদাপেস্তে ইচ্ছে করে ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে বাইশটা নরহত্যা ঘটিয়ে অসীম তৃপ্তি পেয়েছিল। মানুষ মেরেই আনন্দ পেত সিলভেস্টার। হেগ আর সিলভেস্টারের মধ্যে এক জায়গায় অমিল আছে মিল আছে অনেক জায়গায়।

অমিলটা কী? জয়ন্তর প্রশ্ন।

হেগ পাগলামির ভান করেছিল বাঁচবার জন্যে সিলভেস্টার তা করেনি। সাফ বলেছিল, মানুষকে মরতে দেখলে আনন্দ পাই বলেই ট্রেন ধ্বংস করি।

মিলগুলো কোথায়? জয়ন্ত ঝুঁকে বসেছে।

একটাই এখন শোন। দুজনেই মনে করত, একটা অদৃশ্য অশরীরী সত্তার হিপনোটিক হুকুমে এ-কাজ তাদের করতে হয়।

অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল কবিতা, প্লীজ। বিকট এই আলোচনা আর ভালো লাগছে না।

তর্জনী তুলে ইন্দ্রনাথ বললে, তাহলে বলো আর কক্ষনও আমাকে ক্রিমিন্যাল বলবে না।

তুমি স্যাডিস্ট। মানুষকে দগ্ধে মেরে আহ্লাদে আটখানা হও।

তাহলে তো তোমাকে ডক্টর নক্স-এর গল্প শুনতে হয়।

ডক্টর নক্স!

এডিনবরার ডাক্তার। থাকতেন দশ নম্বর সার্জন স্কোয়ারে। লাশ কাটাকুটি করার জন্যে মানুষ মারিয়ে আনতেন খুনে দালাল লাগিয়ে। শেষকালে তিলোত্তমা এক বারবনিতার মড়া দেখে এমনই মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে তাকে তিনমাস ধরে ডুবিয়ে রাখলেন হুইস্কির চৌবাচ্চায়। তিনমাস ধরে রূপসুধা পান করেছেন শিল্পীদের ডেকে এনে সুন্দরীর ছবি আঁকিয়েছেন।

জয়ন্ত বললে, ইন্দ্র, রক্ত আর রূপের তেষ্টা নিবারণের গল্প শুনে মোহিত হলাম। কিন্তু এখন যে জঘন্য খুনগুলো হয়ে চলেছে এই শহরে সেগুলোর মূলে কী ধরনের তেষ্টা আছে বলে তোর মনে হয়?

ইন্দ্রনাথ পোড়া সিগারেট ফেলে দিয়ে নস্যির ডিবে খুলতে খুলতে মঞ্চ-নায়কের পোজে আড়চোখে কবিতার দিকে চেয়ে বললে, সরি বউদি…খুবই নোংরা অভ্যেস কিন্তু ভিখিরি জেমি উইলসনের পকেটে তামার নস্যির ডিবে আর পিতলের নস্যির চামচ ছিল বলেই ডক্টর নক্সের ল্যাবোরেটরিতে তার লাশ কাটাকুটি হয়ে যাওয়ার পরেও ধরা গেছিল খুনিকে–ডিবে আর চামচ পাওয়া গেছিল খুনে দালালের পকেটে।

ঠাকুরপো! ফের!

জয়ন্ত বললে, আমার প্রশ্নটার জবাব জানা নেই মনে হচ্ছে?

ইন্দ্রনাথ বললে, সত্যিই জানা নেই, জয়ন্ত। থাকলে এই নারকীয় কাণ্ড বন্ধ করতে আগে কোমর বেঁধে লাগতাম আমি। আবার কার মাথা ছাতু হল?

এমন সময়ে ঘরে ঢুকল লোকনাথ পাল। ট্রাফিক পুলিশের ওসি। যেমন টল, তেমনি হ্যান্ডসাম। যেন পাথরের গ্রীকমূর্তি হঠাৎ প্রাণ পেয়েছে। দুই চোখ আশ্চর্য শান্ত। ঠোঁটের কোণে কোণে হাসির ঝিলমিল। ঈর্ষাকাতর মহলে শোনা যাচ্ছে, ডি-সি ট্রাফিক তাকে আরও ওপরে তুলবেন ঠিক করে রেখেছেন।

লোকনাথ বললে, হ্যালো বউদি, জয়ন্তদা এখানে কফি খেতে এসেছে শুনেই ভটভটি নিয়ে চলে এলাম। ইদা, এবার মাথা গুঁড়োল যার, সে নিজেই পাগল। বয়স তিরিশও ছাড়ায়নি। নার্সিংহোম থেকে পালিয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল ফুটপাতে। রাতের আতঙ্ক যথারীতি তার মাথার ঘিলু বের করে নিয়ে গেছে।

কোথায়? নস্যি নেওয়া শেষ করে বললে ইন্দ্রনাথ।

এখান থেকে মিনিট দশেকের পথ। যাবেন? ডেডবডি এখনও পড়ে রয়েছে।

উঠে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। সেইসঙ্গে আমি আর জয়ন্ত। ফ্যাকাশে মুখে বসে রইল কবিতা।

কিন্তু অতবেলা পর্যন্ত মড়া ফেলে রাখে না পুলিশ। ফটোগ্রাফাররা এসে পড়ার আগে লাশ পাচার হয়ে গেছে।

পুলিশের লাল মোটর সাইকেল দেখে ভিড় যেন আরও বাড়ল। ইঞ্জিন চালু রেখেই লোকনাথ বললে, মর্গে যাবেন?

ইন্দ্রনাথ বললে, তাই চল।

আমি বললাম, তাহলে আমি বাড়ি যাই।

গিয়ে পাঁঠার ঝোল খা আর বউ-এর মুখনাড়া, বলে আমাকে ঠেলে বাইক থেকে নামিয়ে দিল ইন্দ্র।

.

লাশকাটা টেবিলে শোয়ানো মড়াটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ইন্দ্রনাথ বলেছিল, হাঘরের ছেলে বলে তো মনে হচ্ছে না।

সত্যিই তাই। করোটি গুঁড়িয়ে ঘিলু বেরিয়ে গেলেও চোখ-মুখের গড়নে শিক্ষাদীক্ষার ছাপ রয়েছে। গায়ের রং ময়লা হলেও চামড়ার কোথাও ময়লা নেই। গালে সামান্য দাড়ি–দিন কয়েক কামানোর জন্যে। ঠোঁটের আর নাকের ধারে বুদ্ধির ছাপ রয়েছে।

লোকনাথ বলেছিল, কেয়াতলার পোবন নার্সিংহোমে ছিল। মেন্টালি ডিরেঞ্জড। পকেটে কার্ড দেখে বুঝলাম।

প্রথম তুই-ই দেখেছিলি।

হ্যাঁ। রাত দুটো নাগাদ। ঘণ্টা দুই আগেও পাক দিয়ে গেছি। একেও ঘুমোতে দেখেছি।

একা?

হ্যাঁ। ল্যাম্পপোস্টের তলায়। ও অঞ্চলে ফুটপাতের বাসিন্দা তেমন নেই।

ইন্দ্রনাথ আর কথা না বাড়িয়ে থেঁতলানো করোটিটা খুঁটিয়ে দেখেছিল। এক ঘায়েই খুলি গুঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে। মগজের গ্রে-ম্যাটার আর হোয়াইট ম্যাটার লাল রক্তের সঙ্গে মিশে বেরিয়ে এসেছে।

ইন্দ্রনাথ বলেছিল, পাথরটা?

পড়েছিল ডেডবডির পাশে।

তুই যখন প্রথম দেখেছিলি, তখন ছিল না নিশ্চয়।

মনে তো পড়ে না। রানিং বাইক থেকে অত দেখা যায় না।

দুটো নাগাদ চোখে পড়েছিল?

ডেডবডির বুকের ওপরেই ছিল যে।

সে পাথর এখন কোথায়? চিল, নিজে দেখবে।

যাচ্ছি। বলে, মৃতদেহের ডানহাতটা তুলে নিয়ে কনুইয়ের ভেতর দিকে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ। চেয়ে থেকেই বললে, খুনিকে আটকাতে গেছিল ভিকটিম।

কী করে বুঝলে?

পাথরের চোটে থেঁতলে গেছে শিরা-টিরাগুলো। মাথায় পাথর পড়েছে বুঝেই নিশ্চয় রুখতে গেছিল। হাত জখম হওয়ার পরেই মাথা গুঁড়িয়েছে। আগের পোস্টমর্টেম রিপোর্টগুলো দেখা যাবে?

দেখবে? চলে এসো।

.

একটার পর একটা রিপোর্ট পড়ে নিয়ে ফাইল নামিয়ে রাখল ইন্দ্রনাথ।

লোকনাথ বললে, কী বুঝলে?

নিহত হওয়ার আগে প্রত্যেকেই পাথর আটকানোর চেষ্টা করেছিল। কখনও বাঁ-হাত দিয়ে, কখনও ডান হাত দিয়ে।

অনুমানের কারণ তেলানো কনুই?

কনুইয়ের ভেতর দিক।–অর্থাৎ প্রত্যেকেই দেখেছে পাথর নেমে আসছে মাথার ওপর। রুখেছে। তবুও মরেছে। আশ্চর্য!

কেন?

একটা পাথর দেখাবি?

একটা কেন সবকটা দেখাব। খুনে পাথরের মিউজিয়াম তৈরি হচ্ছে বলেই তো আমি পাগল হতে বসেছি, ইন্দ্রদা।

আমি এখনও হইনি।–চ।

.

পাথরের মিউজিয়ামই বটে। তাকের ওপর সারি-সারি সাজানো পাথর। প্রত্যেকটার তলায় একটা কাগজ। তাতে লেখা কবে কোথায় কার ডেডবডির কাছে পাওয়া গেছে রক্তপিপাসু প্রস্তুরকে। বেশির ভাগই মধ্য কলকাতায়। দুটি নর্থে। একটি সাউথে। এবং শেষেরটাই কাল রাতে উড়িয়েছে পাগলের প্রাণপাখি।

ফিতে আছে? বললে ইন্দ্রনাথ।

ফিতে? কীসের ফিতে? লোকনাথের প্রশ্ন।

মাপবার ফিতে।

মিউজিয়ামের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। টেবিলের সামনে গিয়ে ড্রয়ার টেনে ফিতে বের করে এনে দিলেন ইন্দ্রনাথের হাতে।

প্রতিটি পাথর মাপল ইন্দ্রনাথ।

বললে, কোনওটাই দেড়ফুটের বেশি লম্বা নয়, এক ফুটের বেশি চওড়া নয়, আড়াই ইঞ্চির বেশি পুরু নয়।–নিন, আপনার ফিতে। চলো হে লোকনাথ, বড় খিদে পেয়েছে।

তাহলে আমার ডেরাতেই খেয়ে নেবেন চলুন। আপনিও একা, আমিও একা।

ঘর থেকে বেরোতে-বেরোতে মুচকি হেসে ইন্দ্রনাথ বললে, তুমি একা থাকতে যাবে কোন দুঃখে? কত প্রজাপতি উড়ছে তোমাকে ঘিরে।

সিঁড়ির ধাপে পা দিয়ে হাসতে হাসতে লোকনাথ বললে, ভালো চাকরি আর ভালো চেহারা থাকলে বিয়ে পাগলীদের অভাব হয় না, ইন্দ্রনাথদা। আপনি নিজেও তা জানেন।

জানি, কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইন্দ্রনাথ, কিন্তু আমার মতো ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা তো তোমার নেই। গুজব যা শুনছি–

গুজব? ঘাড় ফেরায় লোকনাথ। এখন তার চোখেও হাসি।

তুমি নাকি ভীমরুলকে বিয়ে করবেই ঠিক করে ফেলেছ।

প্রাণখোলা হাসি হেসে লোকনাথ বললে, ভোমরার নাম শেষপর্যন্ত ভীমরুল হয়ে দাঁড়াল আপনার কাছে?

কথা তো নয়–কটাস-কটাস হুল ফোঁটানো। ও মেয়েকে বিয়ে করলে পস্তাবে, লোকনাথ।

করছে কে?

তার মানে? বাইকের সামনে থমকে গেল ইন্দ্রনাথ, কটাস-কটাস কপচানি মিঠে-মিঠে বুলির চেয়ে অনেক ভালো? সাচবাত কোনকালে মিঠে হয়? ভোমরা ভালো মেয়ে।

কিক দিয়ে লোকনাথ বললে, নিঃসন্দেহে। কিন্তু বিয়ের বাঁধন এখন নয়।

তবে কখন?

খুনে পাথরের মালিককে ধরবার পর। আমার ইজ্জত ঢিলে করে ছেড়েছে হারামজাদা।

.

ভোমরা কিন্তু সশরীরে হাজির ছিল লোকনাথের নিরালা আলয়ে। কালো কুচকুচে মেয়ে– এক্কেবারে কালনাগিনী চেহারা। চোখমুখ যেন কাটারি দিয়ে তৈরি। তেমনি জিভের ধার। জীনস এর দু-পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছোটবড় কোঁকড়ানো চুল আঁকিয়ে বললে, স্বাগতম ভ্যামপায়ার!

হেসে ফেলে বললে ইন্দ্রনাথ, দরজা বন্ধ অথচ ভেতরে তুমি, ব্যাপারটা কী কটকটি?

কটকটি কাকে বলছেন?

তোমাকে। তোমার নাম ভীমরুল, তোমার নাম কটকটি, তোমার নাম তেড়িমড়ি কালকুটি তো বলিনি।

কালকুটি! সঙ্গে-সঙ্গে ফণা তুলে ফেলল কালনাগিনী।

আহা! আহা! লোকনাথ তোমাকে আদর করে কালকুটি বলে ডাকতে পারে কিন্তু আমি তো জানি কালো হিরে যদি কোথাও থাকে–তবে সে তুমি।

কালো হিরে তো কয়লা! আমি কয়লা?

কয়লাই তো সব গুণের আকর। কয়লার ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে গোটা পৃথিবীর মোটা মোটা ইনডাস্ট্রি!

কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না, টিপ্পনী কাটল লোকনাথ।

আর যায় কোথায়! তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল ভোমরা। তুমি কী? তুমি তো রকবাজ, রিপ্টুবাজ, ভ্যানতারা ভ্যামপায়ার!

কানে দু-আঙুল গুঁজে ইন্দ্রনাথ, মাথা ভেঁ-ভোঁ করছে! একী গরম-গরম গালাগাল রে বাবা। মানেও তো জানি না। ভ্যানতারা ভ্যামপায়ার কেন হবে লোকনাথ?

সারারাত তো বৈঠকবাজি করে বেড়ায়! কাজের নামে অষ্টরম্ভা। ফেরেববাজ কোথাকার!

কিন্তু রকবাজি লাইফে করিনি, হাসি-হাসি মুখে বললে লোকনাথ। বলতে-বলতে কোমরের রিভলভার সমেত বেল্ট-টেণ্ট খুলে রাখল টেবিলে। কোনও বন্ধুই ছিল না ছেলেবেলায়, বাবা-মা মিশতেই দেয়নি।

এখন তো লুসিমিসিবাবারা লাইন দিয়ে আছে পেছনে, কালনাগিনীর গলায় সত্যিই যেন এখন হিসহিসানি শোনা যাচ্ছে।

যেমন তুই দিয়ে আছিস, চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে-বসতে বললে ইন্দ্রনাথ, কিন্তু কুকুরের ল্যাজে যতই তেল দিয়ে মলো না কেন–ও ল্যাজ সিধে হবে না। তাই না লোকনাথ? বিয়ে তো তুমি করবে না?

যাও বা করবকরব ইচ্ছে করেছিল, এইরকম ক্যাটক্যাটানি শুনে মন এখন পালাই-পালাই করছে। শার্টের বোতামে হাত দিল লোকনাথ, রান্নাঘরে যাও না কালকুটি, দেখছ না জামা খুলছি?

ওরকম বুকের নোম অনেক দেখেছি!..ইস কী বলতে কী বলে ফেললাম।

অট্টহেসে ঘর ফাটিয়ে দিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে, এই জন্যেই তো তোর ভাবী স্বামী বলে, তোকে বিয়েই করবে না।

ইস! আমি ছাড়া ওর গতি-ই নেই। জানেন না তো মেয়ে মহলে ওর কি নাম।

কী নাম রে? রূপকুমার দ্য ইমপোটেন্ট।

ছিঃ ছিঃ ছিঃ? তা তুই-ই গণ্ডাখানেকের মা হয়ে দুর্নামটা ঘুচিয়ে দিস।

দেবই তো। সেই জন্যেই তো ঘুরঘুর করছি। রূপকুমার অবশ্য বস্তা-বস্তা চিঠি লিখেই যাচ্ছে। অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গর সই জাল করে–

মানে?

অঙ্গ-বঙ্গ কলিঙ্গকে চেনেন না? আপনি আর কী করে চিনবেন। আমার তিন স্তাবক– লাভারও বলতে পারেন যদিও আমি লাভ-টাভ করি না–শুধু মিশি।

শুধু–মিশিস?

পারমিসিভ সোসাইটি না? সবার সঙ্গে মিশতে হয় সবার সঙ্গে ঘুরতে হয় কিন্তু কারও কোলে ধরা দিতে নেই।

শুধু রূপকুমার ছাড়া–

ইয়েস, স্যার। তারপর শুনুন–অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গকে খুব নাচিয়ে চলেছি–আর নিজে নেচে চলেছি এই কলির কেষ্টটার সঙ্গে ইনি কী করেন জানেন? শুনলে ফের কানে আঙুল দেবেন..অঙ্গ–বঙ্গ-কলিঙ্গর নামে বিচ্ছিরি-বিচ্ছিরি চিঠি লেখে আমার কাছে আমি তো চিঠি পেয়েই তেড়ে গিয়ে ধরেছিলাম তিনজনকে। তিনজনেই বললে, হা, হ্যাঁ, আমাদেরই হাতের লেখা, সইগুলোও হুবহু এক– তবে মা কালীর দিব্যি–আমরা লিখিনি। তবে কে লিখেছে? ওরা ফের মা কালীর দিব্যি গেলে বললে, রূপকুমার। রূপকুমার! জালিয়াতি নম্বর ওয়ান! তাই তো এসেছিলাম হেস্তনেস্ত করতে। এসব কী হচ্ছে–হ্যাঁ কী হচ্ছে?

লুঙ্গি পরতে-পরতে লোকনাথ বললে, ওরা বলল আমি জালিয়াত?

তবে না তো কি ভগবান? তুমিই বলোনি আমাকে ছেলেবেলায় বাবার সই জাল করে মাস্টারদের ধোঁকা দিয়েছ?

বেশ করেছি।

কোনটা বেশ করেছ? অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গকে ভড়কি দেওয়া, না, বাবার নাম ডুবোনো?

বাবার নাম ডুবোব কোন দুঃখে? অঙ্কের ক্লাসের চাইতে গানের ক্লাস ভালো লাগত বলেই সই জাল করেছি।

মিটিমিটি হাসতে হাসতে ইন্দ্রনাথ বললে, কালকুটি, থুড়ি, কটকটি, তুই-ই বা অত খাপ্পা হয়ে যাচ্ছিস কেন? কোন পুলিশের লোক এরকম গান-পাগল হয় রে? ও হে লোকনাথ, মোজার্ট শোনাও, বিঠোফেন রবিশঙ্কর শোনাও, বিসমিল্লা শোনাওযা হয় একটা কিছু শোনাও নইলে কালনাগিনী তোমাকে ছোবল মেরেই যাবে।

ঢোঁড়া সাপের বিষে আমার কচু হবে, বলে একটা ক্যাসেট বেছে নিয়ে স্টিরিওতে ঢুকিয়ে দিল লোকনাথ। ঘর গমগম করে উঠল পাগল করা সুরের ইন্দ্রজালে। সঙ্গে-সঙ্গে চোখের তারা ছোট হয়ে এল ভোমরার।

বললে অন্য সুরে, এই সুরটাই সেদিন তুমি অর্গানে তুলছিলে না?

লোকনাথের চোখেও যেন ঘোর লেগেছে। গলার স্বরে তার রেশ ভেসে ওঠে, হ্যাঁ, মোজার্টের সব চাইতে ফেমাস সুর। যতবার শুনি মনে হয় আমি এ জগতে আর নেই।

ইন্দ্রনাথ বললে, আপাতত এই জগতেই থাকো–কেন না আমার খিদে পেয়েছে।

তাই তো…তাই তো…খিদে নিয়েই তো আপনি এসেছেন…ভোমরা, ও ভোমরা…দুটো ভাত ফুটিয়ে দেবে…মাংস করাই আছে ফ্রিজে।

আমি পারব না।

তবে আমার গিন্নি হবে কী করে?

ওঃ! গিন্নি হব কি তোমার রাঁধুনিগিরি করবার জন্যে! সিলি! তোমাকে চোখে-চোখে রাখতে হবে না?

ঠিক যেমন এখন রেখেছিস, বলে ইন্দ্রনাথ, এখনও কিন্তু বলিসনি–ঘরে ঢুকলি কী করে? নাইটল্যাচের চাবি নিশ্চয় কাছে রাখিস?

ঠোঁট উলটে ভোমরা বললে, রাখতে হয় বইকি। নাইট বার্ডকে ফলো করার জন্যে অনেক কিছুই করতে হয়।

বেশ..বেশ..সেই জন্যেই রূপকুমারের বুকের লোম পর্যন্ত চেনা হয়ে গেছে।

অসভ্য! ঠিকরে গিয়ে ফ্রিজ খুলল ভোমরা এক ঝটকায়, এই তো রয়েছে ব্রেড, এই তো রয়েছে মুরগির কারি–আর কী চাই? এসো, বোসো হে রূপকুমার।

লোকনাথ বললে, আগে গেস্ট দুজনের উদর ঠান্ডা হোক–আমি আসছি টয়লেট ঘুরে। হোল নাইট–

লাম্পট্য করে এসেছ, এই তো? নিশাচর বাদুড় কোথাকার। বলে ঘটাং-ঘটাং করে টেবিল সাজাতে শুরু করল ভোমরা।

ইন্দ্রনাথ নস্যির ডিবে খুলতে খুলতে ঘরের জিনিসপত্র দেখতে লাগল। পুলিশম্যানের ন্যাড়া ঘর। দেওয়ালের তাকে খানকতক বই আর ম্যাগাজিন, একটা ইংরেজি বই হেগ-এর জীবন কাহিনি। একটা কালো ট্রাঙ্ক কাঠের টেবিলের ওপর। সিঙ্গল খাটের সাদা চাদর লাটঘাট হয়ে রয়েছে। ঘরের কোণে টানা দড়িতে ঝুলছে পুলিশি জামাপ্যান্ট। নিচে একটা টুল। টুলের তলায় একটা বড় মুখ কাঁচের জার, তার মধ্যে তরল পদার্থে চর্বির মতো কী যেন ভাসছে। হেঁট হয়ে জারটা টেনে নিয়ে গন্ধ শুঁকে ইন্দ্রনাথ বললে, অ্যাসিড।

ভোমরা বলে উঠল, কলতলার জিনিস, কলতলায় রাখলেই হয়। এত অগোছালো ইন্দ্রদা, কী আর বলব, এ লোককে কে বিয়ে করবে?

কেউ নেই বুঝি?

আমি তো আছি। কিন্তু খালি ল্যাজে খেলছে। আপনিই বলুন, জোয়ান মানুষের জোয়ানী থাকলে মানায়?

খাটের ওপর বসতে-বসতে ইন্দ্রনাথ বললে, তোদের মধ্যে মিল আছে একটা জায়গায়।

কোন জায়গাটায়? পাউরুটি কাটতে কাটতে বললে ভোমরা।

তোরা দুজনেই পাগল।

আমার চোদ্দোপুরুষ পাগল নয়।

কিন্তু তুই বদ্ধ পাগল। পয়লা নম্বর বিয়ে-পাগল, আর তোর ভাবীবর গান-পাগল।

অমনি চোখে ঘোর এসে গেল ভোমরার, তা যা বলেছেন দাদা–এই কাঠখোট্টা বেটনবাবু– খোদ রবিশঙ্কর হয়ে যায় ক্লাসিক্যাল মিউজিক শুনলেই। আমারও অবশ্য তাই হয়।

সুতরাং পাগলে-পাগলে মিলবে ভালো।

বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে লোকনাথ বললে, আপনার পাগলি বোনকে বলে দিন খাওয়া-দাওয়ার পর যেন কেটে পড়ে–টেনে ঘুম দিতে হবে।

সটাৎ করে ফণা তুলে ফেলল কালনাগিনী, বয়ে গেছে তোমার সঙ্গে দুপুর কাটাতে। খাওয়ার টেবিলের চেয়ার টানতে টানতে ইন্দ্ৰনাথ শুধু বলল–নারদ! নারদ!

.

গভীর রাত। শহরের পথগুলো এখন খাঁ-খাঁ করছে বললেই চলে। মাঝেমধ্যে একটা করে ট্যাক্সি উড়ে যাচ্ছে। তারপরেই আবার নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে চারদিক।

নৈঃশব্দ্য ভাঙল একটা মোটর সাইকেলের আওয়াজে।

ধীর গতিতে রাস্তা কামড়ে ধরে গড়িয়ে যাচ্ছে চাকাদুটো। একচক্ষু দানবের চোখ জ্বলছে– অমাবস্যার রাতে আরও ধকধকে মনে হচ্ছে সেই চোখকে। মোড় ঘুরে দূর হতে দূরে মিলিয়ে গেল দ্বিচ্যান।

প্রায় নিঃশব্দে গড়িয়ে আসা মারুতিটাকেই দেখা গেল এরপরেই। হেডলাইট জ্বলছে না। টিমটিমে সাইডলাইট দুটো কোনওরকমে নিয়মরক্ষে করে চলেছে।

আচমকা ব্রেক কষেই বাঁয়ের গলিতে ঢুকে গেল ডিপ গ্রিন কালারের মারুতি।

মোটর সাইকেলের আওয়াজটা শোনা গেল তারপরেই। একটু আগেই যেদিকে অদৃশ্য হয়েছিল। একচক্ষু ধীরগতি দ্বিচক্র দানব–এখন সেইদিক থেকেই উল্কাবেগে ধেয়ে আসছে এই মোটর সাইকেল। আওয়াজের গভীরতা একই। থ্রি পয়েন্ট ফাইভ হর্সপাওয়ারের এ মডেল একটা কোম্পানিই তৈরি করে ইন্ডিয়ায়।

মোড় ঘুরেই গতি কমে এল মোটর সাইকেলের। আস্তে ব্রেক কষল ল্যাম্পপোস্টের পাশে। চালক নেমে দাঁড়িয়ে স্ট্যান্ডে তুলে দিল ভারি যন্ত্রযান। পেছনের চাকার পাশের বাক্সে লাগাল চাবি।

ল্যাম্পপোস্টের অত্যাধুনিক আলোয় বড় লোলুপ, বড় তৃষিত মনে হচ্ছে লোকটার দুই চক্ষু। চোখের পাতা তার পড়ছে না। শিকারি শ্বাপদের মতোই অনিমেষে চেয়ে রয়েছে ফুটপাতে নিদ্রিত বাসিন্দাটির দিকে। বয়স তার অনেক, এক মুখ দাড়িগোঁফ সবই সাদা। ময়লায় জট পাকানো চুলও সাদা। সুতো দিয়ে বাঁধা পুরু লেন্সের চশমাটা সযত্নে রেখেছে একরাশ বইয়ের পাশে। এই সেই পণ্ডিত পথের পাগল যার ছবি কিছুদিন আগে বেরিয়েছিল খবরের কাগজে। সারাদিন রোদে বই মেলে পড়ে হেঁট হয়ে–রাতে ল্যাম্পপোস্টের আলোয়–তারপর ঘুমোয় ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত। অজাতশত্রু এই গ্রন্থকীটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে যমালয়ের দূত…

বাক্স খুলে গেছে। ঘুমন্ত উন্মাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বাক্সের মধ্যে থেকে একটা পাথর টেনে বের করল নিশাচর পিশাচ। এখন জ্বলছে তার চোখ দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা উদগ্র হয়ে উঠেছে শিরায় উপশিরায়।

পাথরটা লম্বায় দেড় ফুটের বেশি নয়, চওড়ায় এক ফুটের বেশি নয়, আড়াই ইঞ্চির বেশি পুরু নয়। বলিষ্ঠ দুই লোমশ হাতে পাথর ধরে মোটর সাইকেলকে পাক দিয়ে ঘুমন্ত বৃদ্ধের দিকে এগোল রাতের আতঙ্ক…

আচমকা দুটো বলিষ্ঠতর হাত ছোঁ মারল পেছন থেকে।

ছিনিয়ে নিল পাথর। একই সঙ্গে আগন্তুকের চামড়ার হোলস্টার থেকে ছিনতাই হয়ে গেল রিভলভার।

নল ঠেকল তারই পিঠে।

পাথর কঠিন কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হল কানের কাছে, ঢের হয়েছে ভ্যামপায়ার–সিরিঞ্জটা এবার দাও।

কবিতা বললে, আঁচ করলে কী করে?

ইন্দ্রনাথ বললে, ক্যালকুলেশন করে।

ধুত্তোর তোমার ক্যালকুলেশন। ঝেড়ে কাশো, ঠাকুরপো।

আর্থার লা বার্ন-এর লেখা হেগ–দ্য মাইন্ড অফ-এ মার্ডারার বইখানা তাকে যখন দেখলাম, কাঁচের জারে যখন অ্যাসিডে চর্বি ভাসতে দেখলাম–তখনি আমার সন্দেহের প্রমাণ পেয়ে গেলাম।

আরে গেল যা। সন্দেহটা তোমার মাথায় এল কী করে?

বউদি, এই জন্যেই বৈজ্ঞানিকরা বলেছেন, মেয়েদের মগজের ওজন পুরুষদের চেয়ে কম।… হ্যাঁ, হা, বডি ওয়েটের সঙ্গে রেসিও-টা ঠিকই আছে…কী বলছিলাম? সন্দেহ…হেগ একখানা উপন্যাস পড়ে আর জনাকয়েকের জীবনী জেনে ঠিক সেইরকমই হতে চেয়েছিল। হেগ-এর মতোই হাতের লেখা নকল করতে পোক্ত ছিল রাতের আতঙ্ক, হেগ-এর মতোই ছেলেবেলায় তার বাবা-মা সমবয়সিদের সঙ্গে তাকে মিশতে দেয়নি। হেগ-এর মতোই সে সঙ্গীতপাগল, সুদর্শন, রমণীপ্রিয় অথচ বিবাহে নারাজ। সুতরাং হেগ তাকে ইন্সপায়ার করেনি তো? বাড়িতে দেখলাম হেগ-এর চাঞ্চল্যকর জীবনকাহিনি, দেখলাম কাঁচের জারে সালফিউরিক অ্যাসিডে ইঁদুর গলানোর চিহ্ন–হেগও এইভাবে প্র্যাকটিস করেছিল..ঠিক এইভাবে সালফিউরিক অ্যাসিডে ইঁদুর ফেলে দিয়ে দেখত গলে যায় কীভাবে…শুধু একটা ব্যাপারে মোডাস অপারেল্ডি-তে ইমপ্রুভমেন্ট দেখিয়েছিল রাতের আতঙ্ক…হেগ রক্ততৃষ্ণা মেটাত শিরা কেটে গেলাস ভরে রক্ত নিয়ে…আমাদের এই রক্তলোলুপের তৃষ্ণা মিটত সিরিঞ্জ ভর্তি রক্ত টেনে নিয়ে কনুইয়ের কাছে শিরা থেকে–তারপর পাথর দিয়ে ঘেঁতো করে দিত ছুঁচ ফোঁটানোর চিহ্ন।

নিরক্ত মুখে কবিতা বললে, কিন্তু ওকেই ঠিক সন্দেহ করলে কেন? কেন রাতের-পর-রাত মারুতি নিয়ে পেছনে লেগেছিলে?

কী বুদ্ধি! এখনও ধরতে পারলে না? সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে সেই সর্ষে পোড়ায় ভূত পালায় কি? রক্ষক যদি ভক্ষক হয়–আইন কি রক্ষে পায়? ভারি পাথর নিয়ে কোনও খুনি কি আজ সেন্ট্রাল, কাল নর্থ, পরশু সাউথে খুন করে বেড়াতে পারে? পাথরগুলো মাথায় বয়ে নিয়ে গেলেও তো টহলদার ট্রাফিক সার্জেন্টদের চোখে পড়বে? তবে কী করে বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মারণ প্রস্তর হাতিয়ার? রক্ষকদের বাহনে নয় তো? কিন্তু এক এরিয়ার ট্রাফিক সার্জেন্ট অন্য এরিয়ায় যায় কী করে? আজ মধ্য, কাল উত্তর, পরশু দক্ষিণ করে বেড়াচ্ছে কী করে? সারা শহরে টহল দিয়ে বেড়ানোর এমন অবাধ অধিকার থাকে কার? এমন একজন অফিসারের যার কাজের পরিধি সারা শহর জুড়ে। খোঁজ নিয়ে জেনে গেলাম, ঠিক যে-যে রাতে পাথর নেমে এসেছে পথের ঘুমন্ত মানুষের মাথায় ঠিক সেই-সেই রাতে নাইট ডিউটি নিয়ে শহর তোলপাড় করেছে আমাদের এই রাতের আতঙ্ক…রক্ততৃষ্ণায় গলা টা-টা করলেই সে বুকপকেটে সিরিঞ্জটা আর মোটর সাইকেলের মেটাল বক্সে পাথর ভরে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত মনের মতো শিকারের খোঁজে…প্রথমে দেখে যেত… তারপর ফিরে আসত…মনের মতো পাথরগুলো পেত কোথা থেকে? একটাই জায়গা থেকে…ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাশের পাশে নতুন বাড়িঘরদোরের জন্য এনে রাখা পাথরের গাদা থেকে…ভোমরা কি জানে? নিশ্চয় জানে…বিষে বিষক্ষয় হয়েছে…ভাবী বরের বিকট পাগলামির খবর পেয়ে ওর উকট বিয়ের পাগলামি সেরে গেছে…এখন চলি, বউদি…ফির মিলেঙ্গে।*

.

* কাহিনি-কল্পনার মূলে আছে যে অব্যাখ্যাত রহস্য, সবাই তা জানেন। তথ্য বর্ণনা এবং চরিত্র-চিত্রায়ণ একেবারেই মনগড়া নিছক গল্পের খাতিরে। কোনও ব্যক্তি বা দপ্তরের প্রতি তির্যক শর নিক্ষেপের তিলমাত্র অভিলাষ নেই। উদ্দেশ্য একটাই– পাঠকের চিত্ত বিনোদন।

*কোলফিল্ড টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত (শারদীয় সংখ্যা, ১৩৯৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *