1 of 2

বনি আর ক্লাইড

বনি আর ক্লাইড

দিবসরজনীর বিভীষিকা ছিল ওরা…
মরণের ডঙ্কা বাজিয়ে গেছে নগরে নগরে…
এক কিশোর আর কিশোরীর রুধির-পিপাসার রক্তাক্ত কাহিনি।

.

হলিউডের ফিল্ম ক্যামেরা বিপুল গ্ল্যামার এনে দিয়েছে বনি আর ক্লাইডের শোণিতসিক্ত জীবন

উপাখ্যানে। সময় অনেক কিছুই গ্রাস করে, আবার অনেক কিছুকেই মর্যাদা দেয়। বনি আর ক্লাইড এমনই দুটি ব্যক্তি যাদের মহাকাল মুছে ফেলতে পারেনি, রুপোলি পরদার মহিমায় যারা কলঙ্কিত চরিত্র নিয়েও বীরত্বের শিরোপা পেয়েছে।

রবিনহুড চরিত্রকে কেন্দ্র করে কিংবদন্তীর অভাব নেই। বনি আর ক্লাইডও বহু আশ্চর্য কিংবদন্তীর স্রষ্টা। রবিনহুড ছিল ধনীর ত্রাস। গরিবের সহায়। বনি আর ক্লাইডও ছিল নিয়মের নিগড় পরা সমাজে বিদ্রোহের বহ্নিশিখা। লড়ে গেছে আমৃত্যু নিজেদের দাবি আদায়ের সংগ্রামে, সারা আমেরিকা জুড়ে তখন নেমেছে নৈরাশ্যের নিকষ তমিস্রা। বনি আর ক্লাইড নগরে-নগরে উড়িয়েছে মরণের কেতন, খেলেছে রক্তের হোলিখেলা।

কিন্তু সত্যিই কি মাথায় তুলে নাচার মতো মানুষ ছিল বনি আর ক্লাইড?

না! না! একেবারেই না!

যুগল-খুনে ডাকাত ছাড়া তাদের আর কিছুই বলা যায় না। বড় মাপের খুনি নয়, ডাকাতও নয়। রবিনহুড বা বিশে ডাকাতের মতো মহান আর দরদি ছিল না তারা কস্মিনকালেও। লুঠ করেছে নিছক নিজেদের স্বার্থে–দশের কল্যাণের জন্যে নয়। নরহত্যা করেছে নির্বিচারে কেবল মাত্র ধরা পড়ার ভয়ে। পুলিশকে ঘৃণা করত তারা সমস্ত অণু-পরমাণু দিয়ে অধিকাংশ নীচুদরের অপরাধীর মতোই। নরশোণিতের তৃষ্ণা জাগ্রত হয়েছে মজ্জাগত এই ঘৃণা থেকেই। আমেরিকার পয়লা সারির খুনে গুন্ডারা বলত, জনসাধারণের এক নম্বর শত্রু হল বনি আর ক্লাইড।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল তারা এদের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে।

বনি আর ক্লাইড! দুবৃত্তদেরও দিবানিশির আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল অতি সাধারণ দুটি ছেলে আর মেয়ে। ছিমছাম ব্যাঙ্ক ডাকাতদেরও, মাথা হেঁট হয়ে যেত এদের এক একটা নারকীয় কীর্তির পর। খুন! খুন! খুন! খুন করাটাই ছিল তাদের একমাত্র উকট উল্লাস। জাহান্নমে যাওয়া এক কিশোর আর এক কিশোরীর অন্তরের অন্দরে এহেন পৈশাচিক আনন্দের চাহিদা এল কীভাবে, এবার তা দেখা যাক।

.

প্রচণ্ড প্রেম

ক্লাইডের পুরো নাম ক্লাইড চেস্টনাট বারো। বাবা ছিল টেক্সাসের গরিব চাষা। আট ছেলে মেয়ে। ষষ্ঠজন এই কীর্তিমান ক্লাইড।

ক্লাইডের জন্ম ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের চব্বিশে মার্চ। ছেলেবেলা থেকেই অতিশয় বদমেজাজি। মাথায় রক্ত চড়ে যেত একটুতেই। ভয়ানক অবাধ্য আর একগুঁয়ে। আর একটা গহিত বাসনা সুপ্ত ছিল তার চরিত্রে তখন থেকেই সমকামিতা!

কিন্তু তার প্রচণ্ড প্রেম ছিল মাত্র দুটি বস্তুর ওপর।

একটি ধ্বংসের দূত, আর একটি গতিবেগের।

বন্দুক আর মোটরগাড়ি ছিল তার জীবনের সব চাইতে প্রিয়…প্রাণের চাইতেও।

ক্লাইড-চরিত্রের সবচেয়ে ভয়ানক দিকটি ছিল কিন্তু তার মানসিক বিকৃতি। স্যাডিজ! অপরকে কষ্ট দিয়ে বুকভরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত বাচ্ছাবেলা থেকেই। আর এই মানসিক বিকৃতির জন্যেই অমানুষিক নিষ্ঠুরতা প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে তার চরিত্রে কঁচা বয়স থেকেই।

ক্লাইডের পৈশাচিক প্রবৃত্তির কিছু কিছু ঘটনা পাওয়া গেছে তার বাল্যবন্ধুদের কাছ থেকে। সাক্ষী আছে প্রতিবেশীরাও। মুরগি ছানার ঘাড় মুচড়ে রগড় দেখত ক্লাইড–মরো মরো না হলে ছাড়ত না। একটা জীবন্ত প্রাণীকে অকারণে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিয়ে নারকীয় উল্লাস চোখেমুখে ফুটিয়ে তুলত, যা নাকি নজিরবিহীন। যন্ত্রণায় ছটফট করত মুরগি ছানা, পরমানন্দে তা প্রত্যক্ষ করত ক্লাইড। কখনও-সখনও পাখা ভেঙে দিত পাখির। ভাঙা ডানা নিয়ে ওড়বার বৃথা চেষ্টায় যখন ঘুরে-ঘুরে আছড়ে পড়ত হতভাগ্য বিহঙ্গ–অকপট হর্ষে অট্টহাস্য করত ক্লাইড।

বনি মেয়েটাও একসময়ে শক্ত ধাঁচের মেয়ে বলে নাম করেছে। মেয়েরা সিগারেট খায়– কিন্তু চুরুট খায় কি? বনি কিন্তু দাঁতে কামড়ে চুরুট খেত পাকা চুরুটখেকোদের মতো। যেন ইস্পাত দিয়ে গড়া বনি বালিকা বয়স থেকেই অতিরিক্ত যৌনক্ষুধায় ছটফট করেছে। রতিক্রিয়ায় ভঁটা দেয়নি কখনও।

ক্লাইডের চেয়ে বয়েসে সে ১৮ মাসের ছোট। তবে সামাজিক প্রতিপত্তির দিক দিয়ে ক্লাইডের চেয়ে এক ধাপ উঁচুতেই ছিল বলা যায়। ক্লাইডের বাবা ছিল চাষা। আর বনির বাবা তৈরি করত ইট।

বনির বাবা মারা যান বনির চার বছর বয়সেই। পুরো ফ্যামিলিটা তখন চলে আসে টেক্সাসে। ডালাসের কাছে সিমেন্ট সিটিতে আস্তানা নেয়।

ক্লাইড কিন্তু তার আগে থেকেই আসর জাঁকিয়ে বসেছিল পশ্চিম ডালাসে। বাবা চাষবাস করে সংসার চালাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল বলেই মাঠ ছেড়ে চলে আসে পেট্রল পাম্পের ব্যবসায়। গাড়ি আসছে এন্তার, খালি তেল ভরে দেওয়া। রোজগার মন্দ হচ্ছিল না।

বনি আর ক্লাইডের প্রথম দেখাশুনা কবে কীভাবে হয়েছিল–তা কিন্তু সঠিক জানা যায়নি। বেধড়ক খুন আর ডাকাতি করে যাওয়ার ব্যাপার-স্যাপারগুলো যেমন রহস্যাবৃত খুঁটিনাটি বিবরণ জানা যায়নি কোনওদিনই–ঠিক তেমনি এই কীর্তিধন্য ব্যক্তি দুটির প্রথম মিলন কাহিনিও ধোঁয়াটে রয়ে গেছে আজও।

তবে বনির মা মিসেস পার্কারের মুখে যে ঘটনাটা শোনা গেছে, অজস্র রোমান্টিক রটনার মধ্যে সেইটাকেই খুবই সম্ভাব্য বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। ক্লাইডের বয়স যখন একুশ আর বনি সবে উনিশ বছরের জন্মদিবস পালন করেছে–সেই সময়ে দেখা হয় দুজনের দৈবাৎ। বনির এক বান্ধবী ছিল ক্লাইডেরও বান্ধবী। কমন ফ্রেন্ড। মেয়েটির হাত ভেঙে যাওয়ায় তার সেবায় উঠে পড়ে লেগেছিল ক্লাইড। বনি আর ক্লাইডের ঘটনাবহুল জীবন-সড়কের মিলন ঘটেছিল হাতভাঙা এই মেয়েটির বিছানার পাশে।

বনিকে দেখেই পটেছিল ক্লাইড। প্রথম দর্শনেই প্রেম। এমন কিছু আহামরি দেখতে ছিল না বনি। ছোটখাটো আকৃতি। পাঁচ ফুট লম্বাও নয়। চোখের রং নীল। নির্লজ্জভাবে উদ্ধত আর বেহায়া। লাল মুখ।

ক্লাইডকেও এক নিমেষ ভালোবেসে ফেলেছিল বনি, অথচ চোখ যার সাপের মতো, চালচলন যার মেয়েলি–তাকে মেয়েরা চট করে জীবনমরণের সখা বলে বুকে জড়িয়ে ধরে না!

কিন্তু ভবিতব্য এড়ানো যায় না। অন্যদের কাছে এই দুই মূর্তি অচল হতে পারে–দুজনে দুজনের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠল পলক দর্শনেই।

শুরু হয়ে গেল বনি আর ক্লাইডের যুগল ক্রীড়া। রক্তজমানো বুক কাঁপানো ঘটনার পর ঘটনা।

সেই রাতেই সিমেন্ট সিটির বাড়িতে বনি এল ক্লাইডকে সঙ্গে নিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কত কথাই বলে গেল দুজনে। কথা যেন আর ফুরোয় না। আশ মিটিয়ে দুজনে দুজনকে দেখছে তো দেখছেই।

রাত গম্ভীর হল। এত রাতে দুরন্ত মেয়ের রহস্যময় বন্ধুকে তো আর বলা যায় না বাপু হে, এবার পথ দেখো। চোখ যার সাপের মতো–তাকে অন্তত সাফ কথাটা বলতে পারেননি মিসেস পার্কার। উলটে বসবার ঘরে একটা বড় সোফায় তার শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

পরে বলেছিলেন–যাক বাবা, বাঁচা গেল! রয় সরে পড়ার পর থেকেই হেদিয়ে মরছিল মেয়েটা। ক্লাইডকে নিয়ে মেতেছে–ভালোই করেছে।

.

যে কাজ অপরাধীদের মানায়

রয়! সে কে?

পুরো নাম তার রয় থর্টন। যে বয়েসে ছেলেমেয়েরা নির্মল মেলামেশা আর খেলাধুলোয় মেতে থাকে–সেই বয়েসেই রয়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম এবং ইত্যাদি চালিয়ে গেছে বনি। যৌনপিপাসার নিবৃত্তি ঘটাতেই মাত্র ষোল বছর বয়েসে প্রিয়তম রয়কে বিয়েও করে ফেলেছিল বনি। যার প্রতিটি রক্তকোষ কামনার লেলিহান শিখায় সদা উদ্দীপ্ত–তার পক্ষেই মানায় এতটা বেহায়াপনা।

কিন্তু শাশুড়িঠাকরুণের দাপটে বিয়ে ভেঙে দিতে হয় বছর কয়েকের মধ্যেই। ছেলের ওপর ধকল যাচ্ছে দেখে ছেলের মা স্থির থাকতে পারেনি। দূর দূর করে খেদিয়ে দিয়েছে খুদে বউকে– যার লাসলা আর কামনা, দেহের আর মনের খিদে মিটোনোর ক্ষমতা ছিল শুধু একজনেরই ক্লাইডের!

বিতাড়িত হয়ে মায়ের কাছে ঠাই পেয়েছে বনি। আবার এই মা-ই ক্লাইডকে ঠাই দিয়েছে। বাড়িতে প্রথম দর্শনের দিনেই। বনির জীবনে তাই একটা বিরাট ভূমিকা নিয়েছে এই মা। ক্লাইডের কাছেও মা ছিল শ্রদ্ধা আর সম্মান, ভালোবাসা আর পরম আশ্রয়ের স্থল। আতঙ্কের পর আতঙ্ক সৃষ্টি করে দুজনে যখন বেশ কয়েকটা স্টেটের পুলিশ বাহিনীকে সন্ত্রস্ত আর সজাগ করে তুলেছে তখনও পুলিশের চোখে বেমালুম ধুলো দিয়ে বনি আর ক্লাইড হাসতে হাসতে দেখা করে গেছে যে-যার মায়ের সঙ্গে। প্রতিটি অভিযান রোমাঞ্চকর এবং রক্তঝরানো–তবুও পুলিশ তাদের টিকি ধরতে পারেনি।

বিশ্ব ইতিহাসে এমন কুলিশকঠোর করাল নির্মম চরিত্র আর আছে কিনা সন্দেহ।

বনি আর ক্লাইডের মিলন ঘটে যাওয়ার দিন থেকেই বলা যায় শুরু হয়ে গেল ওদের যৌথ অ্যাডভেঞ্চার। মিসেস পার্কারের দৌলতে বড় সোফায় শুয়ে নিরুদ্বেগে নাক ডাকাচ্ছে ক্লাইড রাতভোর হয়েছে, ভোরের পাখি ডাকছে…এমন সময় পুলিশ হানা দিল সেই ঘরেই!

ক্লাইডকেই চাই তাদের। কেন? কারণটা শুনে মিসেস পার্কার তো থ! চোখ দেখেই নাকি মানুষ চেনা যায় ক্লাইডের সাপের মতো চোখ দেখে তাহলে তিনি অকারণে শঙ্কিত হননি।

ছোটখাটো মেয়েলি চেহারার ছোকরার গুণের তো ঘাট নেই! এই বয়সেই গাড়ি চুরি করেছে বেধড়ক, ডাকাতি করেছে হাসতে-হাসতে। এক-আধটা নয় সাত-সাতটা চার্জ ঝুলছে তার বিরুদ্ধে। সপ্ত অপরাধে অপরাধী ফিচেল ছোকরা এর পরেও ভিজে বেড়ালের মতো নিরীহ নিপাট ভদ্রলোক সেজে প্রেম করতে পারে তার মেয়ের সঙ্গে এবং যেন ভাজামাছটি উলটে খেতে জানে না–এমনি শান্তশিষ্ট সুবোধ বালকের মতো অমন বিচ্ছিরিভাবে নাসিকা গর্জন করে ঘুমোতে পারে প্রণয়িনীর বসবার ঘরে?

বেচারি মিসেস পার্কার! ভেবেছিলেন, প্রথম জামাই সরে পড়ার পর দ্বিতীয় জামাইকে নিয়ে দিনগুলো শান্তিতে কাটাবেন। কিন্তু এ কী আপদকে সোফায় ঘুমোতে দিয়েছেন? এ যে খাল কেটে কুমির ডেকে আনা!

বনি কিন্তু চেঁচিয়ে-মেচিয়ে একসা করেছিল। তার চোখের সামনেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে ক্লাইডকে? এত বড় স্পর্ধা? হিস্টিরিয়া রোগে পেয়েছিল তাকে সেই মুহূর্তে! তারপর কিন্তু চোখের পাতা আর কঁপেনি।

একেবারেই না। নরহত্যা, চুরি, ডাকাতি আর গুলিবৃষ্টির ঝড় বইয়ে দিয়েছে দুজনে মিলে কিছুদিন পর থেকেই। দাঁতে চুরুট কামড়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়েছে মুখে–আগ্নেয়াস্ত্রের ঘোড়া টিপে ধূম্রজাল রচনা করেছে নগরে-নগরে। চিত্ত চঞ্চল হয়নি এতটুকুও। মনের মানুষকে পেয়ে বনি দেখিয়ে দিয়েছে নারী নারকীয় হতে পারে কতখানি।

জেলখানায় থাকতেই হত ক্লাইডের টানা চোদ্দো বছর। কিন্তু ভিজে বেড়ালের গাঁটে-গাঁটে কুচুটে বুদ্ধির তো অন্ত নেই। তাই ভেবেচিন্তে সাতটা অপরাধের মধ্যে তিনটে অপরাধের আদ্যোপান্ত স্বমুখে নিবেদন করল আদালতে৷ অপরাধী নিজেই যখন অপরাধ স্বীকার করে, কবুল জবাব দেয়– তখন ধর্মাবতারের কঠিন প্রাণ গলে যায়, শাস্তির বহর কিঞ্চিৎ কমিয়ে দেন।

ধুরন্ধর ক্লাইড এমন অভিনয় করে গেল যেন নিদারুণ আত্মগ্লানি আর অনুশোচনা তাকে কুরেকুরে খাচ্ছে ভেতর থেকে। বোকা বনে গেল প্রত্যেকেই। চোদ্দ বছরের জায়গায় মাত্র দু-বছরের শ্রীঘর বাসের সাজা মাথা পেতে নিয়ে মুখ টিপে হেসে জেলখানার চেহারাটা দেখতে গেল ক্লাইড।

কৌতূহলী পাঠিক পাঠিকা নিশ্চয় জানতে ইচ্ছুক, কড়া ধাতের মেয়ে বনি সাধারণ মেয়ের মতো অত চেঁচামেচি করেছিল কেন ক্লাইডকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময়ে?

খুবই সমীচীন কৌতূহল!

বনির মা মিসেস পার্কার সর্পচক্ষু ভাবী জামাইয়ের অতীত কাহিনি কিছুই জানতেন না। তাই তিনি ভেবেছিলেন এবং পরে সবাইকে বলে দিলেন–আহা রে! সদ্য ভালোলাগা মানুষটা এত কুকাণ্ড করে বসে আছে, জানতে পেরে মেয়ে আমার বড় শ পেয়েছিল!

ভুল! ভুল! মা হয়েও মেয়েকে তিনি চিনতে পারেননি।

বনি সব জানত। পরিচয়ের প্রথম পর্বেই নরপিশাচ ক্লাইড তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝে ফেলেছিল–এই সেই বিরল কন্যা যার কাছে তার যাবতীয় দুষ্কৃতির কেচ্ছা অকপটে বিবৃত করা যায়। তাই কিছুই গোপন করেনি ক্লাইড। সাত-সাতটা অপরাধের ইতিবৃত্ত সগৌরবে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিল নিবিষ্টচিত্ত শ্রোতা বনির কর্ণরন্ধ্রে৷

পুলকিত হয়েছিল বনি। খুবই! এই বয়েসেই এত কুকীর্তি। অহো! অহো! মনুষ্যদের মধ্যে এমন প্রাণী যে অতিশয় দুষ্প্রাপ্য।

এহেন মনের মানুষকেই কিনা রাত ভোর হতেই চোখের সামনে দিয়ে ধরে নিয়ে গেল। বেআক্কেলে পুলিশ!

প্রচণ্ড ক্রোধে তাই ফেটে পড়েছিল বনি। বিপুল নৈরাশ্যে আচ্ছন্ন হয়েছিল তার চিত্তাকাশ! হায়! হায়! হায়! কত স্বপ্ন সে দেখেছিল এই একটা রাতেই। অজস্র রোমাঞ্চ কল্পনায় বিভোর ছিল সুখনিদ্রায়! কত স্বপ্নই দেখেছিল একটি মাত্র বিভাবরীতে সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে গেল হতচ্ছাড়া পাজি বদমাশ পুলিশবাহিনী!

রাগ হবে না? হওয়াই উচিত! অন্তত বনির মতো ডাকসাইটে মেয়ের। নতুন মানুষটাকে বুকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল যে আরক্ষাবাহিনী, তাদের সে ক্ষমা করতে পারেনি আমৃত্যু শুধু এই কারণেই।

কিন্তু মনের মধ্যে রাগ পুষে রেখে প্রিয়তমের ছবি বুকে নিয়ে দু-দুটো বছর প্যান প্যান করে কেঁদে কাটিয়ে দেওয়ার মানুষ নয় বনি–সে যে কী ধাতু দিয়ে তৈরি তা তার গর্ভধারিণী জননীও অতিবড় দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করে উঠতে পারেননি। তা না হলে তিনি বলেন–ক্লাইড ছোঁড়াটাই যত নষ্টের গোড়া। ওই হাবাতেটার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে আমার মেয়ে অপরাধ কী জিনিস জানত না–অপরাধীদের ছায়া পর্যন্ত মাড়াত না!

মায়েরা অন্ধ হন চিরকালই। মিসেস পার্কারের তাই দোষ নেই।

বলা যাক বনির কথা। ক্লাইড তো গেল হরিণবাড়ি, মানে, জেলে। বণি কিন্তু পণ করল, এইরকম একটা ক্ষণজন্মা পুরুষকে দু-দুটো বছর জেলখানার পাঁচিল দিয়ে ঘিরে রাখলে দেশের বিরাট ক্ষতি অনিবার্য! সুতরাং অবিলম্বে তার মুক্তির ব্যবস্থা করা যাক।

বলা বাহুল্য, ব্যবস্থাটা আইনের পথে নিশ্চয় নয়। বিলক্ষণ প্রশান্তচিত্তে একদা এক শুভলগ্নে একটা রিভলভার নিয়ে জেলে ঢুকল বনি–পাচার করে দিলে ক্লাইডের হাতে।

রক্ত নেচে উঠল ক্লাইডের ধমনীতে। মারণাস্ত্রকে কোমরে লুকিয়ে রেখে রইল সুযোগের প্রতীক্ষায়। এবং সুযোগ যখন এল, তখন উপর্যুপরি রিভলভার নির্ঘোষে সচকিত হল জেলখানা। উধাও হয়ে গেল শ্রীমান ক্লাইড।

একা নয়–সঙ্গে আরও দুজন জেলখাটা আসামিকে নিয়ে।

কিন্তু জেলখানার জাল পা থেকে ছাড়াতে পারল না অত চটপট। আবার শ্রীঘরে ফিরে আসতে হল অল্পদিনের মধ্যেই–

না, না, জেল থেকে পালানোর নিছক অপরাধে নয়–আরও একটা আনকোরা অপরাধ করে ফেলায়।

হাত নিশপিশ করছিল ক্লাইডের। বনের পাখিকে খাঁচায় পুরে রাখলে তার মনে ময়লা লাগবেই। এই ময়লা সাফ করার জন্যেই যেন পাগল হয়ে গেছিল ক্লাইড। তাই আর তর সইল না।

ওহিও-র মিডলটন শহরের রেলওয়ে অফিসে হানা দিল ক্লাইড। দুর্বার বেগে তছনছ করে দিয়ে গেল গোটা অফিস। লুটপাট, ডাকাতি। একাই একশো।

মন তাতে একটু শান্ত হল বটে, কিন্তু অশান্ত হল পুলিশবাহিনী। বড় চতুর, বড় দক্ষ সে দেশের নগর রক্ষীরা, তাই ঝটপট জালে ফেলে তুলে নিল শ্রীমান ক্লাইডকে! চালান করল আদালতে। আদালত থেকে শ্রীঘরে। এবার দয়াদাক্ষিণ্য, কৃপা, অনুকম্পা নয়–পুরো চোদ্দ বছর বনবাস, থুড়ি, শ্রীঘরবাস করতে হবে ক্লাইড মহাপ্রভুকে।

এবং এই শ্রীঘরবাসের ফলেই বেশ খানিকটা পালটে গেল ক্লাইড। ছেলেবেলা থেকেই যে ছিল বুনো, দামাল, দুর্বার কিন্তু স্নেহকোমল–জেলখানায় থেকে সে হল কুলিশকঠোর এবং তিক্ত। সুকুমার মনে অপরকে ভালোবাসার যেটুকু প্রবৃত্তি প্রচ্ছন্ন ছিল–হরিণবাড়ির রূঢ় বাস্তবতায় তা উবে গেল একেবারেই। জেলখানায় থেকে ক্লাইড হয়ে গেল পুরোপুরি নিষ্করুণ, নির্দয়, নির্মম!

টেক্সাসের জেলখানা তো আর প্রমোদকেন্দ্র নয়–পিকনিক করার জায়গায়ও নয়। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যেতে হত আসামিদের রৌদ্রতপ্ত তুলোর খেতে। কাজে ঢিলেমি দিলে অথবা এত খাটতে পারছি না বলে গাঁইগুই করলেই রাম ধোলাইয়ের ব্যবস্থাও আছে। মারের চোটে চোখে সর্ষেফুল দেখিয়ে ছাড়ে পিতৃপুরুষের নামও বিস্মৃত হতে হয়। মার খেয়ে এবং ক্লান্ত গতরে কাহিল হয়ে গেলেও রাত নামলেই ছুটে-ছুটে সমস্ত রাস্তা পেরিয়ে ফিরে আসতে হয় জেলখানায় খাঁচাবন্দি হতে। ঘোড়ায় চড়ে ওয়ার্ডাররা তাড়িয়ে নিয়ে যায় চাবুকের সুমধুর সঙ্গীত শোনাতে-শোনাতে এবং কশাঘাতের তীব্র জ্বলুনি সওয়াতে-সওয়াতে। পিছিয়ে পড়লেই চাবুক আর চাবুক! পালানোর প্রশ্নই ওঠে না।

.

প্রথম নরহত্যা

সুতরাং কাজ না করার একটা উপায় বের করতে হয়েছিল কয়েদিদের। বড় অভিনব উপায়। শুনলেও গা শিরশির করে।

গোড়ালির করা অর্থাৎ টেন্ডন কেটে দিত নিজেরাই। অমানুষিক পরিশ্রম থেকে পলায়নের অমানুষিক প্রক্রিয়া।

সোনার চাঁদ ক্লাইড এগিয়েছিল আরও একধাপ বেশি। জনাকয়েক কয়েদিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নৃশংসতম একটা কাজে তাকে সাহায্য করতে রাজি করিয়েছিল। বাঁ পাখানা তাদের সামনে এগিয়ে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল বন্ধু কয়েদিদের–হাঁ করে দেখছ কী? চালাও?

ক্লাইডের কাণ্ড দেখে হতবাক হলেও তার অনুরোধ রেখেছিল কয়েদি-বন্ধুরা। মাথার ওপর তুলে ধরেছিল ধারালো কুঠার। এক কোপে বাঁ পায়ের পাতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল দু-দুখানা আঙুল।

এরই নাম ক্লাইড! কশাই ক্লাইড! অভীষ্ট সিদ্ধির জন্যে কোনও কাজই পরাঙ্মুখ নয়।

হাড়ভাঙা খাটুনি বন্ধ হল আঙুলহারা ক্লাইডের। হাঁটাচলা করার জন্যে জেলখানা থেকেই তাকে দেওয়া হল একজোড়া ক্ৰাচ। এই ক্রাচেই ভর দিয়ে ঘুরে-ঘুরে সময় কাটাত নিষ্কর্মার ধাড়ি। এমন সময়ে ভগবান ক্লাইডের ভগবান–মুখ তুলে চাইলেন।

১৯৩২ এর ফেব্রুয়ারি মাসে জেল থেকে অকস্মাৎ খালাস পেল ক্লাইড। টেক্সাসের নতুন গভর্নর হয়ে এসেছিলেন একজন দয়াময়ী। সবাই তাকে মা বলে ডাকত। নামটাই হয়ে গেছিল মা ফাগুসন। ইনি গভর্নর হয়েই সমস্ত কয়েদিদের মুক্তি দিলেন। ভালোভাবে থাকো, সৎপথে থাকো– এই ছিল তাঁর বিদায়বাণী।

একই সদুপদেশ দিয়েছিলেন বনির গর্ভধারিণী মিসেস পার্কার। বলেছিলেন–এবার আক্কেল হয়েছে তো? শুধু নিজের জন্য নয়–অন্তত বনি মেয়েটার মুখ চেয়ে বাকি জীবনটা সরল পথে কাটিয়ে দাও।

জেল থেকে ফিরে বাড়ি ঢুকতেই হাসতে-হাসতে কাঁদতে কাঁদতে এই কথাই মিসেস পার্কার বলেছিল গুণধর ভাবী জামাইকে।

বচনে তুখোড় ক্লাইড তৎক্ষণাৎ আশ্বস্ত করেছিল শাশুড়িঠাকরুণকে এই ভাষায়–চেষ্টা আমি করে যাব। তবে কি জানেন, সরলপথে বেঁচে থাকাটা আর তত সহজ হবে না। কে কাজ দেবে আমাকে? তাছাড়া যখনি যেখানে ডাকাতি হবে–গোয়েন্দারা ডাকাতদের টিকি ধরতে না পারলেই আমাকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করবেই। চাকরি যদিও বা পাই, সে চাকরি থাকবে না।

চাকরির চেষ্টা করেছিল বইকি ক্লাইড। খুবই সাধারণ দাসত্ব মাথা পেতে নেওয়ার প্রথম প্রয়াসে ছিল বিলক্ষণ আন্তরিকতা। ওর এক বোনের বান্ধবীর স্বামী কাজ করত ম্যাসাচুসেটস্ এর একটা ঘরবাড়ি তৈরির কোম্পানিতে। ক্লাইডকে সে কথা দিয়েছিল–চাকরি জুটিয়ে দেবেই একই কোম্পানিতে।

কিন্তু ম্যাসাচুসেটস্ তো দশ-পা দুরের জায়গা নয়–দেশের একেবারে অন্য প্রান্তে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেক দূরের জায়গায় ক্লাইড গেছে বহুবার–কিন্তু এতদুরে তো কখনও যায়নি।

গৃহছাড়া ক্লাইডকে এতদূরের জায়গায় বড় একা-একা থাকতে হয়েছিল পুরো আধমাস! তারপর বাড়ির জন্যে এমনই মন কেঁদে উঠল যে আর তাকে সেখানে ধরে রাখা গেল না।

পুলিশের ভয়ে জুজু হয়ে থাকতেও ভালো লাগছিল না ভালোমানুষ ক্লাইডের। তাই একদিন ফিরে এল পশ্চিম ডালাসে। ফিরে আসার কারণটা ধানাইপানাই করে বুঝিয়ে দিলে এইভাবে–সারাটা জীবন যদি পুলিশের চোখ এড়িয়েই আমাকে থাকতে হয়, তাহলে এমন জায়গায় থাকতে চাই যেখান থেকে ঘাপটি মারা যাবে যখন তখন–দোস্তদের সঙ্গে দহরম-মহরম করে আসা যাবে।

এর ঠিক তিনদিন পর…মানে, ম্যাসাচুসেটস্ থেকে সৎকর্মের সুযোগ ছেড়ে ক্লাইডের ফিরে আসার ঠিক তিনদিন পর…গৃহত্যাগ করল বনি।

মাকে বলে গেল–হিউসটনে একটা কাজ পেয়েছি। দোকানে বসে কসমেটিকস্ বিক্রির কাজ।

কথাটা ডাহা মিথ্যে। দু-বছরব্যাপী রক্তঝরানো অভিযানে ক্লাইডকে সঙ্গ দিতে ঘর থেকে পথে নেমেছিল বনি। ডাকাতি আর নরহত্যার অভিযানে। পরে এই খুনে ডাকাতদের দলটারই নাম হয়েছিল বারো গ্যাং। জনগণের পয়লা নম্বর শত্রু। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে বিভীষিকা সৃষ্টি করে বেরিয়েছিল একটানা দু-বছর!

তখন মার্চ মাস, ১৯৩২ সাল। বারো গ্যাং-এর প্রথম নরহত্যা অনুষ্ঠিত হল সতেরোই এপ্রিল। টেক্সাসের হিরো শহরে জন ডব্লিউ বুচার নামে এক মণিকারকে গুলিতে-গুলিতে ঝাঁঝরা করে ছাড়ল শোণিতপিপাসুরা। লুঠ করল কত? মাত্র চল্লিশ ডলার!

মাত্র চল্লিশ ডলারের জন্যে খুনটা তাহলে করল কোন নরাধম? ক্লাইডের সাফাই যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে অন্তত এই ঘটনায় সে নিষ্পাপ। ক্লাইড গাড়ি চালাচ্ছিল–দলবলকে গাড়িতে তুলে চম্পট দিয়েছিল।

গুলি চালিয়েছিল দলের দুই স্যাঙাত!

বনি তখন কোথায়?

ঠিক এই ঘটনার সময়ে সে তখন জেলখানায়। গাড়ি চুরির অপরাধে ধরা পড়েছিল পুলিশের হাতে। ছাড়া পেয়েছিল তিনমাস পরে কিন্তু নিষ্কৃতি পেয়েছিল গাড়ি চুরির অপবাদ থেকে।

আর ঠিক এই সময়েই হত্যা-পাগল ক্লাইড নতুন স্যাঙাত নের হ্যামিলটন এবং আরও দুই দোস্তকে নিয়ে যমালয়ে পাঠিয়েছে ওকলাহোমার ওটোকা শহরের ডেপুটি শেরিফ মুরকে।

আচমকা গুলি বর্ষণটা ঘটেছিল একটা নাচঘরের বাইরে। আকণ্ঠ মদ্যপান করছিল ক্লাইড আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা। একজন স্যাঙাত আস্ত একটা হুইস্কির বোতল টেনে নিয়ে গলায় উপুড় করে দিতেই ডেপুটির সহকারী ম্যাক্সওয়েল বলে উঠেছিল–ঢের হয়েছে। এবার থামাও! এসব লোচ্চামো এখানে চলে না।

কথাটার মধ্যে অন্যায় ছিল না এতটুকুও। কেননা, শহরে তখন মদ্যপান নিষিদ্ধ। কিন্তু রক্তপাগলদের রক্ত গরম হয়েছিল হুকুম শুনেই। গর্জে উঠেছিল রিভলভার। ডবল বুলেট বেরিয়ে গেছিল মুর-এর মাথা আর বুক ফুঁড়ে–পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়েছিল নিমেষ মধ্যে। মারাত্মকভাবে জখম হয়ে মুখ থুবড়ে ফুটপাতে আছড়ে পড়েছিল ম্যাক্সওয়েল।

বনি জেল থেকে বেরিয়েই নাচতে নাচতে ভিড়ে গেল ক্লাইড আর হ্যামিলটনের দলে। বেশ কিছু স্যাঙাত জুটিয়ে নিয়ে বাজপাখির মতো ছোঁ মারল টেক্সাসের গ্র্যান্ড প্রেরির একটা পেট্রল পাম্পে। সাড়ে তিন হাজার ডলার লুঠ করে উধাও হয়ে গেল ঝড়ের বেগে।

সেইদিন পর্যন্ত বারো গ্যাং এত টাকা একবারে কখনও রোজগার করেনি। গুলিবর্ষণও করতে হয়নি। করার দরকারও হয়নি। বারো গ্যাং যে গুলি করে মানুষ খুন করতে বড্ড মজা পায় এ খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল আগুনের মতো। তাই রুদ্রমূর্তিদের দেখে কেউ আর হঠকারিতা দেখায়নি– বাধা দেয়নি। ফলে, রক্তারক্তিও হয়নি।

একগাদা ডলার নিয়ে খুনে ডাকাতদের দল উৎসব করতে গেল মিচিগানে হ্যামিলটনের বাবার বাড়িতে। হ্যামিলটনের শেষদিন ঘনিয়ে এল সেখানেই।

অত্যধিক মদ্যপান করেছিল হ্যামিলটন। বড় বেশি কথাও বলে ফেলেছিল। ফলে ধরা পড়ল পুলিশের হাতে। চালান করা হল টেক্সাসে। উপর্যুপরি ডাকাতি আর হিস্করো মার্ডারের অভিযোগে তাকে ২৬৩ বছরের জন্যে পাঠিয়ে দেওয়া হল জেলখানায়।

বেচারা! হিস্করো মার্ডারের মধ্যে হ্যামিলটন কিন্তু জড়িত ছিল না কোনওমতেই।

কিন্তু ধর্মের কল নড়ে যে এইভাবেই।

.

অতৃপ্ত কামনা

যে হ্যামিলটন পচুক জেলে বনি আর ক্লাইডের বয়ে গেছে তাতে! দুজনেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে প্রমোদভ্রমণে। পকেটে প্রচুর টাকা, হাতে অঢেল সময় আর মনে অপার ফুর্তি। মিচিগান থেকে ক্যানসাস, ক্যানসাস থেকে মিসৌরীপুরো সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর মাস গেল পকেট ফতুর করতে। সবসেরা হোটেল, খানদানী রেস্তোরাঁ আর চড়া দামের জামাকাপড় বিলাসিতার অন্ত নেই দুজনেরই। ছেলেবেলায় দুজনেই বিবিধ অনটনে কাটিয়েছে–তারই প্রতিক্রিয়া প্রকটভাবে প্রকাশ পেল জামাকাপড়ের খুঁতখুঁতুনির মধ্যে। ফিটফাট সাজগোজ না হলে মনের ময়লা যেন কাটতে চায় না কিছুতেই। চুল আর মুখের সৌন্দর্য বাড়াতে বনি নিয়মিত যেত হেয়ারড্রেসার আর বিউটি পারলারে। ফলে, দুমাসেই উড়ে গেল লুঠের টাকা–পকেটে রইল মাত্র দুটো ডলার! অতএব পুনরায় ডাকাতি না করলেই নয়! গা ঝাড়া দিল দুই নরাধম। টেক্সাসের শেরমান শহরের হাওয়ার্ড হল নামে এক ৬৭ বছরের বৃদ্ধ কসাইকে পেটে গুলি করল পর-পর তিনবার একটি মেয়ে। চুল তার সোনালি। লুটে নিয়ে গেল বুড়োর সমস্ত টাকা।

কিন্তু সোনালি চুল কার?

কার আবার, বনির! হেয়ারড্রেসারের কাছে গিয়ে রূপবতী হওয়ার সাধনায় মেতেছিল যে গত দুমাস!

লুঠতরাজ আর নরহত্যার ঝড় বয়ে গেল মিসৌরীর নানা জায়গায়। কার্থেজে একটা ব্যাঙ্ক লুঠও করল দুজনে। সবই ঝোঁকের মাথায়–আচমকা। কোনওরকম প্ল্যান প্রোগ্রাম না করেই।

ব্যাঙ্ক লুঠ করে কিন্তু লাভ হয়নি তেমন। পাওয়া গেছিল মাত্র আশি ডলার!

নৈরাশ্য-নিপীড়িত বনি আর ক্লাইড নবীন উদ্যমে তাই লুঠ করতে গেছিল আর একটা ব্যাঙ্ক। প্ল্যান না করেই গেছিল। তাই গিয়েই দেখেছিল…

চারদিন আগে উঠে গেছে বিশেষ সেই ব্যাঙ্ক!

এর পরের খুনটাও করেছে দুজনে একই রকম হঠাৎ খেয়ালের বশবর্তী হয়ে। বাঁধাধরা কাজ নেই, কাজের ছকও নেই ইচ্ছে হল–খুন করা যাক একটা। ব্যাপারটা ঠিক তাই।

এই সময় উইলিয়াম ড্যালিয়েল জোন্স নামে একটি ষোল বছর বয়সের কিশোরকে দলে টেনে নেয় ক্লাইড। নিছক দল ভারী করার উদ্দেশ্যে নয়। মূল কারণটা ছিল অতিশয় কদর্য।

বনির যৌন কামনা মিটিয়ে উঠতে পারছিল না একা ক্লাইড। তাই নাকি উইলিয়ামকে দরকার হয়ে পড়েছিল।

উইলিয়াম ছেলেও তেমনি। যেন একই ছাঁচে তৈরি। ক্লাইডের ছেলেবেলা যেমন কেটেছে পশ্চিম ডালাসের আধাবস্তি অঞ্চলে–উইলিয়ামের আশৈশব ইতিহাস ছিল তাই। নষ্ট-চরিত্র অকালপক্ক বদ কিশোর। ক্লাইডকে পুজো করত সাক্ষাৎ অবতারজ্ঞানে।

ক্লাইডও চাইছিল এই রকম একটি সেঁপো এঁচোড়েপাকা ছোকরাকে। হ্যামিলটন গেছে জেলে। বনির যৌনখিদের কিছুটা সে মিটিয়ে এসেছিল এতদিন। উইলিয়ামকে পেয়ে তাই বাঁচল ক্লাইড।

তিনজনে মিলে টেক্সাসের টেম্পল শহরে একটা গাড়ি চুরি করতে গিয়ে প্রাণপ্রদীপ নিভিয়ে দিল গাড়ির মালিকের ছেলে ডয়াল জনসনের। বনি বলেছিল পরে–বাধা দিতে গেছিল কেন ছোঁড়া? এত বড় স্পর্ধা কবজি চেপে ধরে জোন্সের? গুলি করতে তাই বাধ্য হয়েছিল জোন্স। ক্লাইড কিন্তু ভীষণ রেগে গেছিল জোন্সের ওপর–খামোকা রক্তগঙ্গা বওয়ানোর জন্যে!

সেদিনের তারিখটা ছিল পাঁচই ডিসেম্বর, ১৯৩২। পুলিশ কিন্তু বিশ্বাস করেনি বনির ভঁওতাবাজি। গুলি চালিয়েছিল আসলে ক্লাইড। পরের মার্ডারটাও করেছিল নিজের হাতে। নতুন বছরের সূচনাতেই জানুয়ারি মাসের ছতারিখে ঠান্ডা মাথায় বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল ডেপুটি শেরিফ ম্যালকম ডেভিসের নশ্বর দেহ।

অথচ ক্লাইডের মুখোমুখি হওয়ার আদৌ কোনও ইচ্ছেই ছিল না ডেপুটি শেরিফের। ফাঁদ পাতা হয়েছিল ওডেল চ্যান্ডলেস নামে আর একজন ব্যাঙ্ক ডাকাতকে পাকড়াও করার জন্যে।

বেপরোয়া ক্লাইড না জেনে পা দেয় ফাঁদে এবং অম্লান বদনে খুন করে ম্যালকমকে।

১৯৩৩-এর জানুয়ারি থেকে ১৯৩৪-এর মে মাস পর্যন্ত কত ডাকাতি আর কত খুন যে করেছে বনি আর ক্লাইড–তার ফর্দ করা সম্ভব হয়নি পুলিশের পক্ষে। খুন আর ডাকাতির পরিসমাপ্তি ঘটেছিল কিন্তু ওই মে মাসেই–পুলিশের হাতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মর্ত্যধাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয় বিকারগ্রস্ত বনি আর ক্লাইড। যে গাড়িতে বসে তারা লড়াই চালিয়েছিল পুলিশের সঙ্গে–সেটিও গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত রোজগার করে গেছে দুজনে বিরামবিহীন লুঠতরাজের মাধ্যমে–এ ছাড়া পেট আর মন ভরাবার আর কোনও পন্থা তাদের পছন্দ হয়নি। খুন করেছে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো ধরা পড়ার সম্ভবনা এলেই মুখর করেছে আগ্নেয়াস্ত্রকে–পরিণাম চিন্তা করেনি কখনওই।

.

তাড়া খাওয়া জন্তু

পুলিশের অকর্মণ্যতার জন্যেই এতদিন ধরে এত কুকর্ম করে যেতে পেরেছে দুজনে। আরও একটা কারণ আছে। সারা আমেরিকা জুড়ে নেমেছে সেই সময়ে নৈরাশ্যের নিষ্ক্রিয়তা। সেই সঙ্গে বেড়েছে অপরাধ করার হিড়িক। একই পুলিশকে সামলাতে হয়েছে সবদিক।

তবে হ্যাঁ, বহুবার ধরা পড়তে-পড়তে বেঁচে গেছে বনি আর ক্লাইড। ১৯৩৩ এর মার্চে মিসৌরির জোপলিনে একটা ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে আত্মগোপন করেছিল বনি, ক্লাইড আর জোন্স। সঙ্গে জুটেছিল ক্লাইডের ভাই বাক আর ভ্রাতৃবধূ ব্ল্যাঞ্চি। পাড়াপড়শিদের কিন্তু সন্দেহ হয়েছিল। প্রত্যেকেই অভিজাত শ্রেণির মানুষ। প্রকৃতই খানদানী। নতুন ভাড়াটেদের হাবভাব দেখে তাই ঘাবড়ে যায় একজন প্রতিবেশী। পুলিশকে সে-ই খবর দিয়েছিল। বলেছিল–এ আবার কীরকম ভাড়াটে? তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো ভয়েভয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকে আর বেরোয়?

টনক নড়েছিল পুলিশের। দু-গাড়ি বোঝাই সশস্ত্র আদমি এসেছিল তদন্ত করতে। গুলির ঝড় বয়ে গেছিল পরমুহূর্তেই। তারই মধ্যে উধাও হয়ে গেছিল পুরো দলটা বুলেটের চোট অবশ্য এড়োতে পারেনি ক্লাইড আর জোন্স। সামান্য জখম হয়েছিল দুজনেই। কিন্তু জানে খতম হয়ে গেছিল দুজন পুলিশ আর একজন আহত হয়েছিল মারাত্মকভাবে।

পরের মাসেই পলাতকদের খবর পাওয়া গেল লুই সিয়ানা, ওকলাহোমা, মিনেসোটা আর আয়োয়া-র গোটা কয়েক অঞ্চল থেকে। ডাকাতি হয়ে গেছে প্রতিটি অঞ্চলেই। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে। ফলে গা ঝাড়া দিয়েছে পুলিশ। হন্যে হয়ে খুঁজছে খুনে ডাকাতদের।

টুরিস্ট ক্যাম্পে থাকা যে আর নিরাপদ নয় বুঝল বনি আর ক্লাইড। অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকা আরও বিপজ্জনক। তাই নিশাযাপন করত চুরি করা গাড়ির মধ্যে। এক গাড়ি ফেলে চুরি করত আর একটা গাড়ি! রাতের পর রাত এইভাবে কাটিয়েছে চোরাই গাড়ির মধ্যে।

ঘুমোনোর কষ্ট গায়ে মাখেনি দুজনের কেউই। যত চিন্তা পোশাক নিয়ে। নোংরা পোশাক পরে থাকা তো সম্ভব নয়! গায়ে কাদা ময়লা থাকলেও চলবে না। ফিটফাট থাকতে গেলে যেটুকু ঝুঁকি নিতে হয়–তা নিতে হয়েছে বইকি। জামাকাপড় কাঁচতে দিয়ে গেছে ছোট শহরের কোনও ধোপার কাছে। নিয়ে গেছে দিন কয়েক পরে। জোন্স আর ক্লাইড চুলকাটা আর দাড়ি কামানোর জন্যে নাপিতের কাছে গেছে ঠিক এইভাবে। একজন গুলিভরা রিভলভার নিয়ে পাহারা দিয়েছে। গাড়িতে বসে–আর একজন তখন গাল আর মাথা পেতে দিয়েছে নাপিতের ক্ষুর আর কঁচির কাছে।

বেশ কিছুদিন এইভাবেই স্রেফ কপাল জোরে মরতে মরতে বেঁচে গেছে পুরো দলটা। বনি কিন্তু বুঝেছিল, চিরকাল ভাগ্য সহায় হবে না। একদিন বলেও ফেলেছিল,–মরবার আগে মাকে আর একবার দেখতে চাই। কিন্তু সে সুযোগ এসেছিল প্রায় এক বছর পরে। রক্তাক্ত শেষ বিদায় নিয়ে এসেছিল বনি আর ক্লাইড মায়েদের কাছ থেকে।

ইতিমধ্যে একটা দুর্ঘটনা বাঁধিয়ে বসেছিল ক্লাইড। গাড়ি চালাচ্ছিল ঘণ্টায় সত্তর মাইল গতিবেগে। টেস্কাসের ওয়েলিংটনে খাদের ওপর ব্রিজটা যে ধসে পড়েছে, তা নজরে আনেনি। শূন্যে দুবার ঘুরপাক খেয়ে গাড়ি গেঁথে গেল খাদের তলদেশে আগুন লেগে গেল তৎক্ষণাৎ। শূন্যপথেই ক্লাইড ছিটকে বেরিয়ে গেছিল অবশ্য তার আগেই। বনি চাপা পড়েছিল জ্বলন্ত গাড়ির তলায়।

.

মৃত্যুর সামনে

অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গিয়ে ক্লাইড দৌড়ে এসেছিল প্রাণপ্রিয়দের প্রাণে বাঁচাতে। জোন্সকে টেনে বের করেছিল ভেতর থেকে–সেই সঙ্গে উদ্ধার করেছিল অতীব মূল্যবান অস্ত্রাগার বেশ কিছু মেশিনগান আর রিভলভার। এদিকে তারস্বরে চেঁচিয়ে গেছে বনি–ক্লাইড, প্লীজ! টেনে বার করতে না পারলে গুলি করো আমাকে!

একা ক্লাইড কোনওদিনই উদ্ধার করতে পারত না বনিকে যদি না সাহায্য করত একজন চাষা আর খেত মজুর। দুর্ঘটনার আগাগোড়া তারা দেখেছে ছুটেও এসেছিল। হাতাহাতি করে আধপোড়া বনিকে এরাই টেনে বের করেছিল অনল-পরিবৃত যন্ত্রযানের তলা থেকে। ঠাই দিয়েছিল খামার বাড়িতে। কিন্তু তারপরেই সন্দেহ করে বসে অতিথিদের। গোপনে খবর পাঠায় পুলিশকে। কিন্তু চুলের ডগাও ছুঁতে পারল না তিন মূর্তির। বন্দুকবাজি করে হাওয়া হয়ে গেল বনি, ক্লাইড আর জোন্স।

ভাই আর ভ্রাতৃবধু, বাক আর ব্লাঞ্চির সঙ্গে যোগাযোগ করে আরকানসাসের ফোর্ট স্মিথের কাছে ট্যুরিস্ট ক্যাম্পের একটা ডবল কেবিন ভাড়া নিল ক্লাইড। বনি তখন প্রলাপ বকছে মৃত্যুর বুঝি আর দেরি নেই। মুখে-মুখে রাশিরাশি মিথ্যে বলে গেল ক্লাইড। স্টোভ ফেটে যাওয়ায় নাকি পুড়ে গেছে বনি। চিকিৎসার জন্যে ডাক্তার জোগাড় করেছে। যদিও পুরো তল্লাট জুড়ে তখন পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে ভয়াল ভয়ঙ্কর ত্রয়ীকে ক্লাইড নিরুদ্বেগে ট্যুরিস্টদের বোকা বানিয়েছে, ডাক্তারকে ধোঁকা দিয়েছে তাঁর উপদেশমতো বনিকে হাসপাতালে পাঠানো সম্ভব নয় বলে তাকে দিয়েই ট্যুরিস্ট কেবিনে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে নার্স মোতায়েন করেছে।

খুবই কড়া স্নায়ু থাকলে এত কাণ্ড করা সম্ভব হয়। কিন্তু শুধু নার্ভের জোর থাকলেই তো চলবে না টাকার জোরও যে দরকার। কাজেই নিতান্তই নিরুপায় হয়ে হাতের কাছের একটা ব্যাঙ্ক আর দুটো মণিহারি দোকানও লুঠ করেছে। এই কর্ম করতে গিয়ে গণ্যমান্য এক ব্যক্তিকে গুলি করে পরলোকে পাঠিয়েছে এবং তারই গাড়ি হাঁকিয়ে অকুস্থল থেকে চম্পট দিয়েছে। পরিশেষে ট্যুরিস্ট ক্যাম্প থেকেও।

জুলাই মাসে গাড়ি হাঁকিয়ে গেছে আয়োয়া-র মধ্যে দিয়ে এবং খুন জখম লুঠপাট করে গেছে টাকার ঘাটতি দেখা দিলেই। শেষে ঠাঁই নিয়েছে মিসৌরির একটা ট্যুরিস্ট ক্যাম্পে।

কিন্তু জিরেন পায়নি। কেবিন থেকে চুপিসাড়ে বেরোনো আর ঢোকা, জানলা দরজায় অষ্টপ্রহর পরদা টেনে রাখা–এইসব দেখেই সন্দেহ ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। ডবল কেবিনকে ঘিরে ফেলে পুলিশ। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পুলিশের বেড়াজাল ভেদ করে বেরিয়ে আসে পুরো দলটা। ভয়াল ভয়ঙ্কর ত্রয়ীর গায়ে আঁচড় না লাগলেও মাথায় তিন-তিনটে বুলিটের ক্ষত বহন করতে হয়েছে বাক-কে। আর ব্লাঞ্চি সাময়িকভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিল জানলার ভাঙা কাঁচের টুকরো চোখে-মুখে আছড়ে পড়ায়।

.

চিকেন খানা

দলের প্রত্যেকেই তখন মরিয়া। খিদে আর তেষ্টায় কাহিল তো বটেই; বাক মরতে বসেছে; বনি আর ব্ল্যাঞ্চি দুজনেই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। খাদ্য, পানীয়, ডাক্তার, ওষুধ দরকার এখুনি। তাই একজন গেল সরাইখানা থেকে পাঁচটা চিকেন রোস্ট কিনতে বাকি সবাই লুকিয়ে রইল আয়োয়ার ডেক্সটারে–একটা নদীর ধারে জঙ্গলের মধ্যে।

গ্রামে-গঞ্জে তখন সাড়া ফেলেছে বারো গ্যাং। কাজেই পাঁচটা চিকেন খানা একসঙ্গে বিক্রি হতেই খবর চলে গেল পুলিশের কাছে। দুশো পুলিশ এসে ঘিরে ফেলল পাঁচজনকে।

আবার গুলিবিদ্ধ হল বাক-এবার উরুতে, কাঁধে আর পিঠে। ব্ল্যাঞ্চি মুমূষু স্বামীর বুকের ওপর আছড়ে কেঁদে উঠল উন্মাদিনীর মতো–মারা যেও না..মারা যেও না…দোহাই তোমার…মারা যেও না! কিন্তু নেহাতই কপাল খারাপ বাক আর ব্লাঞ্চির।

ছদিন পর প্রলাপ বকতে-বকতে হাসপাতালে শেষ ঘুম ঘুমোল বাক। ব্ল্যাঞ্চি তখন পাশে নেই। রয়েছে জেলখানায়। সেখান থেকে আদালতে। দশ বছর জেলখাটার শাস্তি মাথা পেতে নিতে হয়েছিল সদ্য বিধবা হয়েও।

অব্যাহত ছিল কিন্তু বনি আর ক্লাইডের প্রলয়-অভিযান। বাক আর ব্ল্যাঞ্চিকে পুলিশ যখন পাকড়াও করছে, জোন্স, ক্লাইড আর বনি তখন গুলি বর্ষণের প্রলয় সৃষ্টি করছে। হেঁটে নদী পেরিয়েছে। ওপারে পৌঁছে আবার একটা গাড়ি চুরি করেছে। অজানার অভিযানে গা ভাসিয়েছে। লক্ষ্মীছাড়ার মতোই দুরন্ত গতিবেগে ধেয়ে চলেছে–কোথায়? তিনজনের কেউই তা জানে না।

দুশো পুলিশের ব্যুহ ভেদ করে আসা কম হিম্মতের কথা নয়। একেবারে অক্ষত অবস্থায় বেরোনো যায় না। জোন্সের মাথাতেও চোট লেগেছিল সামান্য ক্লাইডের একটা বাহুতেই বুলেট বিধেছিল চারবার। মাথার ক্ষত সেরে যেতেই ভেগে পড়েছিল জোন্স। বনি আর ক্লাইড ফিরে গেছিল ডালাসে। অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর আর জানুয়ারি–এই চার মাস ডালাসেই কাটিয়েছে। ঘুমিয়েছে। গাড়ির মধ্যে। আত্মীয়দের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেছে লুকিয়ে-চুরিয়ে নিরালা জায়গায়। বিরামবিহীনভাবে চুরি করেছে গাড়ি, লুঠ করেছে দোকানপাট আর পেট্রলপাম্প।

.

দুই স্বর্ণকেশী

এবারও ধরা পড়তে-পড়তে দুজনে বেঁচে গেছে স্রেফ বনির বুদ্ধির জোরে। সোনালি রঙের একটা পরচুলা জোগাড় করে ক্লাইডকে পরিয়ে দিয়েছিল বনি। সাজিয়ে দিয়েছিল মেয়েদের সাজে। বলেছিল–বোকা পুলিশগুলো খুঁজছে এমন দুজনকে যাদের একজন পুরুষ আর একজন স্বর্ণকেশী। দুজন স্বর্ণকেশীকে তো খুঁজছে না। ধোঁকাবাজিতে কাজ হয়েছিল। বোকা পুলিশদের নাকের ডগা দিয়ে প্রতিবার পগারপার হয়েছে ধুরন্ধর বেপরোয়া দুই খুনে ডাকাত যাদের নীতিজ্ঞানের বালাই নেই একেবারেই!

১৯৩৪-এর ১৬ই জানুয়ারি কাজের ছক পালটে নিল বনি আর ক্লাইড–রে হ্যামিলটনের ২৬৩ বছরের বন্দিদশা ঘুচিয়ে দিয়ে। দুঃসাহসের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত রেখে গেল হান্টসভিল কারাগারে। গাড়ি হাঁকাল বনি, কয়েদিদের কাজের জায়গায় ঝোঁপের মধ্যে অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্র লুকিয়ে রাখল ক্লাইড, নিজেও মেসিনগান চালিয়ে সাহায্য করল রে হ্যামিলটনকে পালিয়ে যেতে। গুলি খেয়ে প্রাণপাখি উড়ে গেল একজন ওয়ার্ডারের। রে হ্যামিলটনের সঙ্গে চম্পট দিল আরও চারজন কয়েদি।

অতি দ্রুত কাজে নেমে পড়ল হ্যামিলটন। হানা দিয়ে গেল একটার পর একটা ব্যাঙ্কে। অবশ্যই ক্লাইড নিয়েছিল বড় রকমের ভূমিকা–হ্যামিলটন যদিও তা স্বীকার করেনি পুলিশের কাছে। দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে যে কটা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে–প্রত্যেকটির পেছনে ছিল বনি আর ক্লাইড এ বিশ্বাস পুলিশের মাথায় এনে দিয়েছে অনেক প্রমাণ অনেক সাক্ষী।

পয়লা এপ্রিল রোববার ডালাসের কাছে গ্রেপআইনে দুজন হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে টক্কর লাগল বনি, ক্লাইড আর হ্যামিলটনের সঙ্গে পালিয়ে আসা একজন কয়েদির। নিমেষমধ্যে মেশিনগান চালিয়ে দুই অফিসারকেই খতম করে দিল তিন নরঘাতক। পাঁচ দিন পর ওকলাহোমা-র মিয়ামির কাছে একজন পুলিশকে সটান গুলি করে যমের দক্ষিণ দুয়ার দেখিয়ে দিল বনি। সে বেচারা গোপন খবর পেয়েই ছুটে এসেছিল এক স্বর্ণকেশীর সঙ্গে দুই পুরুষকে চোরাই ফোর্ড গাড়ির মধ্যে দেখতে!

বারো গ্যাংকে পরলোকের পথ দেখিয়ে দেওয়ার জন্যে তখন কিন্তু উঠে পড়ে লেগেছে ওকলাহোমা, লুইসিয়ানা আরকানসাস আর ক্যানসাসের সমস্ত পুলিশ। অনেকেই বলে নাকি পুলিশকে খবর দিয়েছিল মেথভিনের বাবা। মেথভিন সেই কয়েদির নাম যাকে হ্যামিলটনের সঙ্গে জেলের মাঠ থেকে উদ্ধার করেছিল বনি আর ক্লাইড। পুলিশে খবর দিয়ে মেথভিনকে বাঁচাতে চেয়েছিল পিতৃদেব! পুলিশের সঙ্গে এই চুক্তি না হলে নাকি সেবারেও নাজেহাল হতে হত আরক্ষাবাহিনীকে তাণ্ডব কাণ্ড ঘটিয়ে ফের উধাও হয়ে যেত দুই রুদ্রমূর্তি।

.

ভক্তদের প্রশস্তি

১৯৩৪-এর ২৩শে মে। লুইসানার গিবল্যান্ড থেকে আট মাইল দূরে রাস্তার ধারে ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে দুজন পুলিশ অফিসার।

ঘড়িতে তখন নটা বাজে। দূরে দেখা গেল ফোর্ড ফাইভ এইট সিডান গাড়িটা।

দেখা গেল বনি আর ক্লাইডকেও।

গর্জে উঠল পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্র। মোট ১৬৭টা গুলি বর্ষণ করা হয়েছিল। বনি আর ক্লাইড ভাগাভাগি করে নেয় পঞ্চাশটা। মারা যায় তৎক্ষণাৎ।

রক্তে ভেজা ন্যাকড়ার মতোই নাকি দেখতে হয়েছিল দুজনকে–গুলির নরক বানানোর পর বলেছিল একজন অফিসার।

কবর দেওয়ার জন্যে যুগল দেহকে নিয়ে যাওয়া হল ডালাসের বাড়িতে। অনেক কিংবদন্তীর সৃষ্টি হয়ে গেছিল এতদিনে। খবর ছড়িয়ে গেল আগুনের মতো। ভক্তরা ছুটে এসেছিল ফুলের তোড়া নিয়ে। গল্পে উপকথায় নাকি এমন নায়ক এমন নায়িকার কথা শোনা যায়। কফিন থেকে ফুলের পাপড়ি আর কফিনের অলঙ্করণ পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়ে গেছে অশ্রুসজল অনুরাগীরা। গোটা কবরখানায় এত লোক ভেঙে পড়েছিল যে ক্লাইডের সহোদরা কবরের চল্লিশ ফুটের মধ্যেও আসতে পারেনি।

ক্লাইডের বয়স তখন ২৫, বনির ২৩। দুজনার রোমাঞ্চকর কাহিনির ভাবাকুল পরিসমাপ্তির ভবিষ্যত্বাণী করে গেছিল, বনি নিজেই স্বরচিত একটি কবিতায়। কবিতাটির নাম দ্য স্টোরি অব বনি অ্যান্ড ক্লাইড। সুধী পাঠক-পাঠিকার কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যে মূল কবিতাটির প্রতিটি শব্দ মুদ্রিত হল নিচে :

Some day theyll go down together,
Theyll bury them side by side,
To a few itll be grief-to the law a relief–
But its death to Bonnie and Clyde.

* দক্ষিণী বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত। শারদীয় সংখ্যা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *