1 of 2

ব্ল্যাকমেল

ব্ল্যাকমেল

বলুন, আমি ইন্দ্রনাথ রুদ্র বলছি।

নমস্কার। আমার নামটা টেলিফোনে বলতে চাই না। কিন্তু দেখলেই চিনবেন।

দেখা করতে চান?

হ্যাঁ। আজ রাত দশটায়। যখন আপনি একা থাকবেন। বিষয়টা অত্যন্ত গোপনীয়। আমার কেস যদি টেক-আপ না-ও করেন, আপনি ছাড়া কেউ আর তা জানবে না–এই শর্তে যদি রাজি থাকেন, তাহলে আসব।

আসুন।

আমি নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে যাব। সাদা অ্যামবাসাডর। সব কাঁচ তোলা থাকবে। আপনি কাইন্ডলি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন। আশপাশে যখন কেউ থাকবে না, আমি গাড়ি থেকে নেমে আপনার বাড়ি ঢুকব।

তাই হবে।

লাস্ট রিকোয়েস্ট। অফেন্ডেড হবেন না। আপনার প্রফেশনাল ইথি-এর ওপর আমার বিশ্বাস আছে বলেই আপনার শরণাপন্ন হচ্ছি।

বুঝেছি। ঘরে টেপ রেকর্ডার জাতীয় কোনও বাগিং ডিভাইস যেন না থাকে–এই তো?

অস্ফুট হাসি ভেসে এল তারের মধ্যে দিয়ে। তারপরেই রিসিভার নামিয়ে রাখার আওয়াজ।

রাত ঠিক দশটায় সাদা অ্যামবাসাডর ব্রেক কষল সুভাষ সরোবরের পাশে একতলা বাড়ির সামনে। গাড়ির সব কাঁচ তোলা। ধোঁয়াটে ফিল্ম লাগানো বলে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না চালককে।

ইন্দ্রনাথ ডাইনে-বাঁয়ে দেখে নিল। কেউ নেই। এ সময়ে সুভাষ সরোবর বলতে গেলে ফাঁকাই থাকে। এগিয়ে গেল গাড়ির দরজার সামনে।

খুলে গেল দরজা। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা মধ্যবয়স্ক নাতিদীর্ঘ ভদ্রলোক নেমে এসেই ইন্দ্রনাথের পাশ দিয়ে গেট পেরিয়ে দাওয়ায় উঠে, ঢুকে গেলেন ঘরের মধ্যে।

গেট বন্ধ করে দিয়ে ইন্দ্রনাথ ঢুকল তারপর। দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল রাতের অতিথির দিকে।

মাথার ওপর ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছে। ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক তার নিচে। মাথায় বড় জোর পাঁচ ফুট। না-রোগা না-মোটা। বয়স পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্নর মধ্যে। সে অনুপাতে মাথার চুল বেশ পেকেছে। কপালের ওপর থেকে চুল উঠে গেছে। উঁচু চওড়া কপাল আরও চওড়া হয়েছে। বাঁদিকে সিঁথি। বেশি পেকেছে জুলপির চুল এবং অস্বাভাবিকভাবে চোয়ালের হাড় চাপা দিয়ে ঝুলছে ঘাড় পর্যন্ত। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। ভুরুর লম্বা-লম্বা চুল কখনও উঁচিয়ে রয়েছে, কখনও ঝুলে পড়েছে। নাক সিধে আর শক্ত। ঠোঁট চাপা আর কঠিন। লম্বা জুলপির আড়ালে চোয়ালের হাড়ও যে বিলক্ষণ কঠোর, তা আন্দাজ করে নেওয়া যায় গ্রানাইট মুখাবয়ব আর প্রদীপ্ত চোখ দেখলে। এঁর এই চোখ আর এই জুলপি কার্টুনিস্টদের কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে। ছোটখাট মানুষটার শক্ত ধাতকে ফুটিয়ে তুলতে বেগ পেতে হয় না। পার্লামেন্টে অথবা জনসভায় ইনি যখন উঠে দাঁড়ান থমথমে নৈঃশব্দ্য নেমে আসে চারপাশে। এমনই এঁর ব্যক্তিত্ব আর বাগ্মিতা। প্রজ্ঞা আর পাণ্ডিত্য।

কিংবদন্তিসম সেই সম্মোহনী চাহনি ইন্দ্রনাথের ওপর নিবদ্ধ, রেশমমসৃণ কণ্ঠস্বরে তিনি বললেন, ইন্দ্ৰনাথবাবু, আমি যে বিপদে পড়েছি, তার সমাধান আমার ব্ল্যাককোট কমান্ডোরা করতে পারবে না। কারণ আমাকে ব্ল্যাকমেল করছে একটি মেয়ে যাকে নিয়ে এক সময়ে আমি মাতামাতি করেছিলাম–একটু বেশিমাত্রায় করেছিলাম–বুঝতেই পারছেন কী বলতে চাইছি–এর বেশি বলা সমীচীন নয়–আজ আমি নিষ্কলঙ্ক চরিত্র বলেই ইন্ডিয়ার হাল ধরতে পেরেছি–আমার ইন্টারন্যাশনাল ইমেজ অতিশয় উজ্জ্বল–গোটা ইন্ডিয়ার ফিউচার নির্ভর করছে আমার নীতি নির্ধারণের ওপর। কিন্তু এই মেয়েটি যদি তার স্মৃতিচারণ ছেপে বের করে দেয়, তাহলে সবাই জানবে, আমার ভেতরেও দুর্নীতি আছে, আমি চরিত্রহীন, দেশের ভার আমার হাতে রেখে দেওয়া নিরাপদ নয়। আমি তো ডুববই, নেক্সট ইলেকশনে আমার পার্টিও মুছে যেতে পারে।

ইন্দ্রনাথ বললে, বসুন। পা

শাপাশি বসল দুজনে। একই সোফায়।

ভদ্রলোক বললেন, আমি ডিকেটটিভ গল্প পড়তে ভালোবাসি ছেলেবেলা থেকেই। আপনার কাহিনি অনেক পড়েছি। অনেক উঁচুতে উঠে গেছি বলে, আর দরকার হয়নি বলে, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়নি। আজ আমি হাতে অনেক সময় নিয়ে এসেছি কাল ভোরের ফ্লাইটে দিল্লি ফিরে যাব। দরকার হলে সারারাত আপনার সঙ্গে গল্প করব। তাতে আমার টেনশন কাটবে। টেনশনের শিখরে যাঁরা বসে থাকেন, টেনশন তাঁদের চোখেমুখে প্রকাশ পায় না। কণ্ঠস্বরে তো নয়ই। কণ্ঠস্বরে তো নয়ই। ইন্দ্ৰনাথ শুধু চেয়ে রইল।

তিনি বললেন, কোনান ডয়ালের চার্লস অগাস্টাস মিলভারটন আপনি পড়েছেন, আমিও পড়েছি। ব্ল্যাকমেলার মিলভারটন-এর গল্পটা প্রথম ছেপে বেরয় কোলিয়ার্স ম্যাগাজিনে–১৯০৪ সালে। জানেন? তারিখটা ইন্টারেস্টিং। কেননা, ব্ল্যাকমেলাররা তাদের ক্রাইম অবাধে চালিয়ে গেছে। সমাজে–সবই ধামাচাপা পড়েছে। শার্লক হোমস ওয়াটসনকে বলেছিলেন, চিড়িয়াখানার মাপের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে কিলবিলে, হড়হড়ে, পিচ্ছিল, ক্লেদাক্ত প্রাণীগুলোর কালো মৃত্যুর মতো চকচকে চোখ আর কুটিল, চ্যাপ্টা মুখের দিকে তাকালে তোমার গা শিরশির করে না? আপাদমস্তক রি রি করে ওঠে না অপরিসীম ঘৃণায়? সারাজীবনে পঞ্চাশজন খুনির সঙ্গে বুদ্ধির পাঞ্জা লড়েছি আমি, কিন্তু ওদের মধ্যে সবচেয়ে বদ লোকটার নাম শুনলেও আমার এতটা ঘৃণা আর বিদ্বেষ জাগে না, যতটা হয়, এই লোকটার নাম শুনলে। ওর ছায়া মাড়াবার প্রবৃত্তিও আমার নেই। ইন্দ্রনাথবাবু, শার্লক হোমসের কথার প্রতিধ্বনি করে বলতে ইচ্ছে করছে, এই মেয়েটার হাতে লেখা চিঠি দেখলেও আমার গা শিরশির করে ওঠে।

ইন্দ্র বলে, চিঠিতে ব্ল্যাকমেল করছে?

হ্যাঁ। এক্সিকিউটিভ বন্ড পেপারের মোটা সাদা খাম দেখলেই আজকাল আমার গা ঘিনঘিন করতে থাকে। বিশেষ করে সেই খামে যখন সবুজ কালি দিয়ে লেখা থাকে আমার নাম–অতিশয় চেনা হাতের লেখা–একটা সময় যখন এই হাতের লেখা দেখবার জন্যে পাগল হয়ে থাকতাম আর এখন? বুক গুড়গুড় করে।

আপনার?

হাসলেন ভদ্রলোক। সীমিত হাস্য। যান্ত্রিক হাসিও বলা যায়। মনের হালকা রসকে প্রকাশ করবার এই ক্ষমতা ঈশ্বর দিয়েছেন শুধু মানুষকে। কিন্তু এই মানুষটার সেন্টিমিটার দিয়ে মাপা ক্ষীণ হাসিতে হালকা রস প্রকাশ পেল না–নিঃসীম তিক্ততা ছাড়া সেখানে কিছুই নেই।

বললেন, আমি অকুতোভয় সব্বাই তা জানে। কিন্তু আমার মনেও ভয়ের সঞ্চার করতে পেরেছে কন্যাকুমারিকা।

তার নাম?

হ্যাঁ। ইন্দ্রনাথবাবু, আমার অতীত পাঁচজনকে বলবার মতোন নয়। কামারপুকুরের পাশে বিশ বিঘে জমির মালিক ছিলেন আমার দাদু। ভট্টচাজ্যি বামুন। যজমান ছিল, গরু-লাঙ্গলও ছিল। আমার ছয় পিসি, বাবারা চার ভাই। আমার বাবা সবচেয়ে বড়। তিনি কলকাতার একটা জুটমিলে ক্যান্টিন সুপারভাইজার ছিলেন। দুই ছেলে থাকত তার কাছে কলকাতায়। আমি আর আমার মেজোভাই থাকতাম দাদু-দিদিমার কাছে। বাবা মাসে-মাসে টাকা পাঠিয়ে দিতেন। দাদু-দিদিমা তখন খুব ভালোবাসতেন আমাকে। জুটমিল বন্ধ হয়ে যেতেই বাবা আর মা দুই ভাইকে নিয়ে চলে গেলেন দেশে। অত্যাচার শুরু হল আমার ওপর। দশটা গরু দেখতে হবে, যজমানদের দেখতে হবে, বাড়ির ঠাকুরঘরগুলোর দেখাশুনো করতে হবে–তারপর যদি সময় থাকে স্কুলের পড়াশুনো করতে পারব। তাই করেছিলাম রাত তিনটেয় উঠে সব কাজ সেরে পড়তে যেতাম। অঙ্ক পরীক্ষার আগে তিনদিন একটু বেশি তৈরি হতে চেয়েছিলাম। ছোটকাকা কোনও কাজ করত না। তাকে বলেছিলাম–এই তিনটে দিন তুমি সামলাও। সে আমাকে যাচ্ছেতাই বলে বেরিয়ে গেল বাজারে আড্ডা মারতে। দাদু আর দিদিমাকে বলতে গেলাম–তেনারা রেগে গেলেন। সব শেষের কথা, কাজ না করলে বাড়ি থেকে বিদেয় হও–পড়াশুনো গোল্লায় যাক।

ইন্দ্রনাথবাবু, পরের দিন ভোর ছটা পাঁচের ট্রেনে কলকাতা রওনা হলাম। শিয়াখালায় টিকিট চাইতেই স্টেশনে নেমে পড়লাম। তখন মনে পড়ল, এখানে একজন কালীসাধক জ্যোতিষী থাকেন। তিনি শুধু মুখ দেখে ভবিষ্যৎ বলে যান। চলে গেলাম তার ডেরায়। তিনি মন্দির থেকে পুজো শেষ করে বেরচ্ছিলেন। চৌকাঠে পা রেখেই আমাকে দেখলেন। দেখেই বললেন, যা, যা, তুই অনেক বড় হবি। শিগগিরই একটা মেয়ের পাল্লায় পড়বি–সে তোকে অনেকদূর নিয়ে যাবে।

সেই মেয়েই এই কন্যাকুমারিকা। জ্যোতিষীর ওখান থেকে শিয়াখালা স্টেশনে চলে এসেছিলাম। আমার দূর-সম্পর্কের এক দাদু দাঁড়িয়েছিলেন কলকাতায় যাবেন বলে। তিনিই আমাকে নিয়ে এসে ফেললেন এই বেলেঘাটায়। তখন এই অঞ্চলের এত রমরমা ছিল না। সুভাষ সরোবর ছিল না। বাইপাস ছিল না। শুধু ভেড়ি আর জঙ্গল। জোড়ামন্দিরের উলটোদিকে মসজিদের সামনেও এত দোকান ছিল না। ওইখানে একটা রঙের কারখানায় দারোয়ানের কাজ পেলাম। একটা বিরাট বাগানঘেরা পাথরের মূর্তি দিয়ে সাজানো চারতলা বাড়িতে রঙের কাজ চলছিল। তখনকার আমলে চারতলা বাড়ি যাদের থাকত, তারা কত বড়লোক হত বুঝতেই পারছেন। এদের ছিল ভেড়ির কারবার। এই বাড়িতে রং নিয়ে যেতাম। মিস্ত্রিদের কাজের তদারকি করতাম। আলাপ হল কন্যাকুমারিকার সঙ্গে। বাড়ির একমাত্র মেয়ে। একমাত্র সন্তানও বটে। বড় আদুরে। খামখেয়ালি। দাদুর চোখের মণি। তার ইচ্ছেতেই চলে এলাম বড় বাড়িতে। তার ইচ্ছেতেই মাস্টারের কাছে নতুন করে পড়াশুনা শুরু করলাম। এক অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে ধাপে-ধাপে তুলে নিয়ে গেল শিক্ষাদীক্ষার শিখরে। আজকের রাম ভট্টাচার্য তাই চিরকাল ঋণী থাকবে কন্যাকুমারিকার কাছে।

বাড়ির পেছনে তিন বিঘে বাগানে পুকুর ছিল, বড়-বড় গাছ ছিল। আমরা সেখানে খেলা করেছি। তখনি অনেক বাড়াবাড়ি করেছিলাম। বড় বাড়িতে যা হয়। কিন্তু সবই গোপনে।

কন্যাকুমারিকার চাপেই বিলেত গেছিলাম। ফিরে এলাম ব্যারিস্টার হয়ে, শুরু করলাম রাজনীতি। কলকাতার পাট চুকে গেছিল–দিল্লিতেই ঘাঁটি গাড়তে হয়েছিল। বিবেকানন্দই আমার জীবনে প্রথম আদর্শ। তাই সারা ভারতকে নিজের দেশ বলে ভেবেছিলাম। তাই ভারতের সবাই আমাকে নিজের লোক মনে করেন। আপনি তা জানেন।

কন্যাকুমারিকা সেই কারণেই বলেছিল, কলকাতায় এলে তুমি আর এ-বাড়িতে উঠবে না। বালিগঞ্জে তোমাদের ডেরায় থাকবে। মাঝে-মাঝে সঙ্গ দিয়ে যাবে আমাকে।

কন্যাকুমারিকা বিয়ে করেনি। আমারই মতোন। বিয়ে-থার কথাও কোনওদিন আমাকে বলেনি। বললেও রাজি হতাম না। কারণ, ওই বন্ধন আমাকে মানায় না। সময় কম, কাজ বেশি। সবই দেশের কাজ। স্ত্রী-র জন্যে সময় আমার নেই।

কন্যাকুমারিকার মা-বাবা ছেলেবেলাতেই মারা গেছিলেন। দাদু মারা যান আমি বিলেতে থাকবার সময়ে। বিষয়সম্পত্তির চাপে কন্যাকুমারিকা সংসারী হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে দেয়। সবই আমাকে চিঠি লিখে জানাত। যা জানায়নি, তা জেনেছি অনেক পরে।

কৈশোরেই যে শরীর নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে পারে, যৌবনে সে সন্ন্যাসিনী হয়ে যাবে না– এটা আমার ভাবা উচিত ছিল। যার হাতে টাকা, তার পারিষদবর্গের অভাব হয় না। কন্যাকুমারিকা একাধারে হয়েছিল চরিত্রহীনা আর উড়নচণ্ড। কলকাতায় এসে মাঝে-মাঝে যখন তাকে সঙ্গ দিয়ে যেতাম, স্বাভাবিকভাবেই সে মেয়েলি কৌতূহলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার গোপনতম কথাও জেনেছে। কৈশোরের সেই চাপল্য আর দেখায়নি। আমি তার এই পরিবর্তন দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম। ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারিনি সে দেউলে হতে বসেছে। দেনা যত বেড়েছে, রূপ আর যৌবনকে ততই উজাড় করে দিয়েছে কলকাতার ধনীদের পায়ে। সংক্ষেপে, সে ভদ্র-বারবনিতা হয়ে গেছে।

রাষ্ট্রের বহু সিক্রেট কন্যাকুমারিকার কাছে বলেছিলাম। আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, জাপান, জার্মানি কার সঙ্গে কখন কী কথা বলেছি রঙ্গচ্ছলে গল্প করে যেতাম। আমার জীবনে একমাত্র সঙ্গিনী সে, আমার জীবনকে গড়ে দিয়েছে–তাকে ছাড়া বলব কাকে? যদিও সেসব গুহ্য কথা কারও জানবার কথা নয়। সে কিন্তু অনেকদিন ধরেই লিখতে শুরু করেছিল তার আত্মজীবনী। কলকাতায় এসে তাকে সঙ্গ দিতে গিয়ে দেখেছিলাম তাকে লেখার নেশায় ধরেছে। সবুজ কালির দোয়াতে কলম ডুবিয়ে লিখত, আর গালে হাত দিয়ে জানলা দিয়ে বাগানের গাছপালার দিকে চেয়ে থাকত–যে বাগানে কেটেছে আমাদের দুজনের কৈশোর। চিঠির পর চিঠি লিখত–ডাকটিকিটে জিভ বুলিয়ে খামে সাঁটত বরাবরের অভ্যেস। আমি ঠাট্টা করে ইদানীং বলতাম, তুমি কি তসলিমা নাসরিন হওয়ার স্বপ্ন দেখছ?–ও হেসে বলত, তুমি যদি দেশের জন্যে জীবন দিতে পারো, আমি কেন পারব না?

স্মৃতিচারণ লেখা যে তখন থেকেই শুরু করেছিল, আমার জানা ছিল না। পরপর কয়েকটা কাজে ইন্ডিয়ার বাইরে কাটিয়ে দিল্লি ফিরেই ওর তিনটে চিঠি পেলাম। মাথা ঘুরে গেল। কন্যাকুমারিকা আমার কাছে একশো কোটি টাকা চেয়েছে।

কলকাতায় এলাম। শুনলাম ওর সর্বস্বান্ত হওয়ার কথা। ভেড়ি লুঠ হওয়ার পর থেকেই কপাল পুড়তে থাকে। বিষয়জ্ঞান না থাকার ফলে প্রতারকদের খপ্পড়ে পড়ে অস্থাবর সম্পত্তি সবই বাঁধা পড়েছে। চিট ফান্ড করে টাকা তুলতে গিয়ে পুলিশকে দোরগোড়ায় এনে ফেলেছে। একশো কোটি পেলে সবদিক বাঁচবে।

একশো কোটি কেন, একশো টাকারও এদিক-ওদিকে করেনি রাম ভট্টাচার্য–সেটাই সেদিন তাকে জানিয়েছিলাম। অন্য কীভাবে তার সমস্যা মিটোনো যায়, তাই নিয়ে ভাবতে বলেছিলাম। ও গোঁ ছাড়েনি। সব শেষে জানিয়েছে, যে স্মৃতিচারণটা লিখে রেখে দিয়েছে সেটা কিনে নিতে চেয়েছে। এক পাবলিশার বাংলা থেকে হিন্দি আর ইংরেজি তর্জমাও তারা করে নেবে। তারা হয়তো লাখ কয়েক টাকার মুনাফা লুটবে কিন্তু রাম ভট্টাচার্যর হাজার-হাজার কোটি টাকার মসনদ ধুলোয় গড়িয়ে যাবেরাম ভট্টাচার্য যে নিখাদ সোনা নয়–এই বই হবে তার ডকুমেন্ট।

লেখবার টেবিলে বসেই কন্যাকুমারিকা হেসে-হেসে বলে গেল সব কথা। একটা চিঠি সাদা খামের মধ্যে ভরা ছিল। জিভ বুলিয়ে তার মুখ জুড়ে এক টাকার ডাকটিকিটও লাগাল জিভে ঠেকিয়ে। বললে–পাবলিশারকে জানিয়ে দিলাম, আর এক মাসের মধ্যে রেডি হবে পাণ্ডুলিপি। পাবলিশারের নামটা দেখে রাখো।

গোটা পৃথিবী জুড়ে ব্যবসা রয়েছে বিশেষ সেই প্রকাশকের।

বুঝলাম, ঠিক এক মাস সময় পেলাম। একশো কোটি টাকা বের করে দিতে হবে আমাকে। অসৎ পথে নামতেই হবে।

দিল্লি ফিরে যাওয়ার পথে প্লেনে বসে খটকা লাগল–এ ধরনের অসৎ পরিকল্পনা কন্যাকুমারিকার মাথায় এল কী করে? এ তো সাংঘাতিক সফিসটিকেটেড ব্ল্যাকমেল। কাকপক্ষীও জানবে না এত বড় একটা ক্রাইমের খবর। অথচ রাষ্ট্রশক্তি দুর্বল হবে, দেশের লোক প্রতারিত হবে। হর্ষৎ মেটার সঙ্গে আমার কোনও প্রভেদ থাকবে না।

ইনটেলিজেন্স খবর এনে দিল লাইটনিং স্পিডে। কন্যাকুমারিকা যে কুপথগামিনী হয়েছে, রাতের অভিসারিকা হয়েছে, রাষ্ট্রের শত্রুদের অঙ্কশায়িনী হয়েছে তা জানলাম এই সার্ভিসের মারফৎ।

তাই এসেছি আপনার কাছে। ব্ল্যাকমেলারকে আমি ভালোবাসিতার ক্ষতি করতে চাই না–অথচ নিজে বাঁচতে চাই, দেশকে বাঁচাতে চাই। ইন্দ্রনাথবাবু, কী করব?

ইন্দ্রনাথ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে, রাত ঠিক বারোটা। চরিত্রহীনা কন্যাকুমারিকা নিশ্চয়ই এখন জেগে আছেন। ফোন করুন।

রাম ভট্টাচার্যর মুখ শক্ত হয়ে গেল–না।

নাম্বারটা বলুন। আমি করছি।

কেন?

পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে, কথায় সব হয়। আমি তার সঙ্গে কথা বলব। দরকার হলে আজ রাতেই দেখা করব। কূটনীতিতে আপনার কাছে আমি শিশু। কিন্তু একটা সহজ কৌশল বারেবারে কাজ দিয়েছে–সেই কৌশলটা প্রয়োগ করব।

কী কৌশল?

টু ক্রিয়েট এ বিগার প্রবলেম। আপনার সামনে যে প্রবলেম তুলে ধরেছেন কন্যাকুমারিকা– তার চাইতেও বড় প্রবলেম তৈরি করব কন্যাকুমারিকার জীবনে।

সেটা কী প্রবলেম?

এই প্রথম আপনার চোখের পাতা কাঁপতে দেখলাম। কারণ, আপনি তাকে ভালোবাসেন, ঘৃণাও করেন। আর শুনতে চাইবেন না। আমার ওপর ছেড়ে দিন। নাম্বারটা কী?

থ্রি ফাইভ জিরো…।

ডায়াল করল ইন্দ্রনাথ। রিং হয়ে গেল। বার বার তিনবার। উঠে দাঁড়াল সোফা ছেড়ে। বললে, চলুন।

কোথায়?

কন্যাকুমারিকার বাড়ি।

আমি যাব? এত রাতে?

আপনার মুখ দেখিয়ে দরজা খোলাব–আমি গেলে সেটা হবে না। চলুন।

লোহার ফটক ধরে নাড়া দিতেই গুমটি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল দারোয়ান। রাম ভট্টাচার্যকে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে বলেছিল, কী হল দাদাবাবু?

দিদিমণি ঘুমোচ্ছে নাকি?

নাতো। সেই যে দুপুরে আপনি চলে গেলেন–ঘর বন্ধ করে বসে রয়েছে। কত ডাকলাম– সাড়া দিল না। খাবার ঢাকা দিয়ে রেখেছি।

ইন্দ্রনাথ বললে, নিয়ে চলো সেই ঘরে।

.

চারতলা। বাগানের দিকের ঘরটার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দারোয়ানের ডাকে সাড়া মিলল না। রাম ভট্টাচার্যের অনুরোধও বিফলে গেল।

ইন্দ্র বললে, সাবেকি বাড়ি। ভেতরে নিশ্চয়ই খিল অথবা ছিটকিনি তোলা রয়েছে। চাড় মারলেই ভেঙে যাবে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দু-হাট হয়ে গেল দরজা।

ঘর অন্ধকার। করিডরের আলো পৌঁছচ্ছে না ঘরের ভেতরে।

ইন্দ্রনাথ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল দারোয়ানকে, টর্চ বা হ্যারিকেন–যা হয় কিছু নিয়ে এসো।

সুইচ টিপব? ঘরেই তো আলো আছে। বললে দারোয়ান।

যা বলছি তাই করো।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল দারোয়ান।

ইন্দ্র বললে, ওকে সরিয়ে দিলাম। ঘরে ঢোকবার আগে, আলো জ্বলবার আগে একটা জিনিস জেনে নিই। আপনি এখানে এসেছিলেন আমার কাছে যাওয়ার আগে?

দুপুরে এসেছিলাম। ফিরে যাই বালিগঞ্জে। সেখান থেকে গেছি আপনার কাছে।

ঠিক। দুপুর থেকেই দরজা বন্ধ করে বসে আছেন কন্যাকুমারিকা। দিনের আলোয় আলো জ্বালানোর দরকার হয়নি। এখনও আমাদের ডাকে আলো জ্বালাননি-দরজা ভেঙে কথা বলে যাচ্ছি, উঠেও এলেন না। মানে বুঝছেন?

রাম ভট্টাচার্যর গ্রানাইট মুখাবয়বে ভাবান্তর নেই কিন্তু বুঝি ঈষৎ নিষ্প্রদীপ হল সদাপ্রদীপ্ত দুই চক্ষু।

আর কথা না বলে অন্ধকার ঘরে দেওয়াল হাতড়ে সুইচ টিপে দিল ইন্দ্রনাথ।

ঘরে এখন আলো ঝলমল করছে। টেবিলে মাথা রেখে বসে রয়েছে কন্যাকুমারিকা। অস্বাভাবিকভাবে একটা হাত ঝুলছে চেয়ারের পাশে। লাল টেলিফোন রয়েছে ভাঁজ করা বাঁহাতের কাছে।

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ইন্দ্রনাথ। ছিটকিনি ভেঙেছে, কিন্তু খিল অটুট রয়েছে। তুলে দিল খিল।

টেবিলের ওপর কন্যাকুমারিকার মাথার কাছে একটা সাদা খাম। ওপরে সবুজ কালিতে লেখা বিখ্যাত এক প্রকাশকের নাম আর ঠিকানা।

খামের কোণ ধরে তুলে ঘুরিয়ে পেছন দিক দেখল ইন্দ্রনাথ। নামিয়ে রেখে টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিল এক টাকার বেশ কয়েকটা ডাকটিকিট। গান্ধীজির ছবি ছাপা ডাকটিকিট।

বললে, ছিল কুড়িটা ডাকটিকিট–এখন রয়েছে উনিশটা। একটা নিশ্চয় ছিঁড়েছিলেন কন্যাকুমারিকা। কিন্তু খামে লাগাননি! হেঁট হয়ে দেখল মেঝে, কুড়িয়ে নিল একটা ডাকটিকিট। এইটা ছিঁড়েছিলেন, খামে লাগাবেন বলেই। তার আগেই মন ঘুরে গেল সুইসাইড করলেন।

সুইসাইড! মৃদুস্বরে বললেন রাম ভট্টাচার্য, আমার সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পরেই?

হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পরেই। ছিটকিনি তুলে দিয়ে চিঠি লিখলেন। খামের মুখ বন্ধ করলেন। ডাকটিকিট ছিড়লেন। তার পরেই সুইসাইড করলেন–ডাকটিকিট খসে পড়ল মেঝেতে। স্ট্রেঞ্জ!

স্ট্রেঞ্জ কেন বলছেন?

ওঁর অভ্যেস তো জিভ বুলিয়ে ডাকটিকিট ভিজোনো। তাই না?

হ্যাঁ।

ডাকটিকিটে নিশ্চয় জিভ বুলিয়েছিলেন?

মনে তো হয়।

হা বুলিয়েছিলেন। এই দেখুন পেছনটা। আঠা-ভাবটা তেমন নেই–যেন জল লেগেছিল। ফোরেনসিক রিপোর্টেই জানা যাবে, জিভের লালা কন্যাকুমারিকার।জানা যাবে আর একটা জিনিস, বলতে-বলতে উনিশটা ডাকটিকিটের পাত তুলে নিল ইন্দ্রনাথ।–চোখ কুঁচকে দেখল পেছনের আঠার দিক।

বললে, বাদামি রঙের কী যেন লেগে রয়েছে, তাই না?

তাই তো দেখছি।

এই উনিশটা ডাকটিকিট আর এই খসে-পড়া ডাকটিকিট কি আমি নিয়ে যাব?

কোথায়?

ফোরেনসিক টেস্ট করার জন্যে।

কেন?

আমার অনুমান, এতে লাগানো রয়েছে পটাসিয়াম সায়ানাইড।

কন্যাকুমারিকা–

না, তিনি লাগাননি। ডাকটিকিটে জিভ বুলোনার অভ্যেস আছে কন্যাকুমারিকার, একথা যিনি জানতেন, তিনি লাগিয়ে রেখে গেছিলেন আজ দুপুরবেলা। তার অপূর্ব বাগ্মিতা দিয়ে খেপিয়ে দিয়ে গেছিলেন যাতে তিনি চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে প্রকাশককে চিঠি লিখতে বসেন কন্যাকুমারিকা। কিন্তু বিরাট এই প্রতিভা আমার মতোন ক্ষুদ্র ব্রেনের শরণ নিলেন কেন, সেটা বুঝলাম না।

ইন্দ্রনাথবাবু, আপনি যে এত লাইটনিং স্পিডে অ্যাকশন নেন, আমার তা জানা ছিল না। মন্দ্রমন্থর কণ্ঠস্বরে বলে গেলেন রাম ভট্টাচার্যরাত দশটায় আপনার কাছে যাওয়ার কারণ একটা– যাতে আপনার অ্যাকশন শুরু হয় পরের দিন সকালে আমি তখন দিল্লির পথে–আকাশে। আজ আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে কন্যাকুমারিকার এই ঘরে আসতাম কারণ আমি জানতাম, সে আর বেঁচে নেই আপনার বাড়ি যাওয়ার আগে ফোন করেছি কন্যাকুমারিকা বেঁচে থাকলে টেলিফোন ধরত–তাই নিশ্চিন্ত হয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম। এ ঘরে এসে দরজা ভেঙে আগে ডাকটিকিটগুলো সরাতাম–তারপর দারোয়ানকে দিয়ে পুলিশে খবর দেওয়াতাম–তাকে শিখিয়ে যেতাম–আমি যে এত রাতে এসেছি কাউকে যেন না বলে। কাল সকালে শুরু হত তদন্ত। সরকারি তদন্ত একটু এগিয়েই ধামাচাপা পড়ে যেত। নিছক আত্মহত্যা–পটাসিয়াম সায়ানাইডের জন্যে। তখন আপনার টনক নড়লেও আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারতেন না–ষড়যন্ত্রের চাপে এরকম আত্মহত্যা অনেকেই করে।–যাক সে কথা, আগেই কথা দিয়েছেন, এ-কেস যদি টেক-আপ নাও করেন–মুখ খুলবেন না।

আপনার শরণ নিয়েছিলাম কেন? পাপ চেপে রাখবার ক্ষমতা নেই বলে। হালকা হয়েছিলাম আপনার কাছে গিয়ে। আপনি সব জেনেও অপরাধী কে, তা জানতে পারতেন না। কিন্তু জেনেই যখন ফেলেছেন, তখন ডাকটিকিটগুলো ফিরিয়ে দিন। ওদের কাজ ফুরিয়েছে। দেশ রক্ষে পেয়েছে।

নিন। কিন্তু স্মৃতিচারণের পাণ্ডুলিপি?

যে ব্যাঙ্কলকারে আছে, তা সীজ করা হবে। তারপর…।

বুঝেছি। দারোয়ানকে বলে দিন, পুলিশে খবর দিতে কিন্তু পুলিশকে যেন না বলে যে আমরা দুজন এসেছিলাম আজ রাতে।

বলে দিচ্ছি। ইন্দ্রনাথবাবু, একটা অনুরোধ করব? স্ব

চ্ছন্দে।

আপনি মুক্তপুরুষ। দিল্লিতে একটা বিশেষ দপ্তরের ভার গ্রহণ করবেন?

মাপ করবেন। আমি মুক্ত-ই থাকতে চাই।

* কোলফিল্ড টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত। (শারদীয় সংখ্যা, ১৯৯৪)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *