পাঁচ তারার প্যাঁচ
মাধুরী
কবিতা বললে, ঠাকুরপো কী ভাবছ?
দোরগোড়া থেকেই দেখছিলাম, শিবনেত্র হয়ে রয়েছে ইন্দ্রনাথ রুদ্র। কড়িকাঠের দিকে চেয়ে রয়েছে। চাহনি কড়িকাঠ ভেদ করে উধ্বলোকে প্রস্থান করেছে।
অর্থাৎ ও ভাবছে। বড় সোফায় আড় হয়ে শুয়ে, কনুইয়ের ওপর চিবুক ন্যস্ত করে, চিন্তালোকে অবস্থান করছে।
ভাবমগ্ন ইন্দ্রনাথকে আমি কখনও ঘাটাই না। কবিতা কিন্তু অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। ঠিক এই মুহূর্তগুলোর মওকা পেলে ও কখনও ছাড়ে না। খোঁচা মারবেই। দেওর-বউদির এহেন সম্পর্ক ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে বঙ্গ যুবসমাজে। রাজনীতির উত্তাপে বোধহয় সব শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে।
ঊর্ধ্বলোক থেকে নেত্রযুগলের দৃষ্টিকে মর্তে টেনে নিয়ে এল ইন্দ্রনাথ। ধড়মড় করে উঠে বসল। আকৰ্ণ হেসে বললে, কি সৌভাগ্য! একেবারে হরগৌরী যে।
আমরা যেখানেই যাই, দুজনে মিলেই যাই। আমি বউকে ছেড়ে থাকতে পারি না, আবার বউও আমায় ছেড়ে থাকতে পারে না। এটা এখন বিশ্ববিদিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্ত্রৈণ বদনামও জুটেছে। জুটুক।
ইন্দ্রনাথের এই সুভাষ সরোবরের গাছপালায় ঘেবা নিবিড় নিকুঞ্জে ফি হপ্তায় দুজনে আসি। ব্যাচেলর বন্ধুকে সঙ্গে নিই, জানলা খুলে লেকের জল দেখি, মোলায়েম হাওয়া ভক্ষণ করি, কবিতা সেই ফাঁকে ব্যাচেলরের ঘরদোর গুছিয়ে দেয়, রান্নাঘরের অবস্থা দেখে নেয়, ভালোমন্দ বেঁধেও দেয়। কোথায় বালিগঞ্জ, আর কোথায় বেলেঘাটা ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস হয়ে যাওয়ার পর যাতায়াতের অসুবিধেটা ঘুচেছে।
প্রতি সপ্তাহে চৌকাঠ পেরোনোর পরেই ইন্দ্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টিটকিরিটা ছুঁড়ে মারে আমাদের লক্ষ্য করে। কিন্তু তখন যে হাসিটা ওর চোখমুখকে ভাসিয়ে দেয়, তা আনন্দের হাসি, ওর হীরে চোখ ঝিকমিক করে ওঠে, গলার আওয়াজে খুশি উপচে পড়ে। ওর নিঃসঙ্গ উষর জীবনে আমরা দুজনে যে দু-ফেঁটা বৃষ্টির জল।
সেই রবিবারের সকালেও আমি ওর টিটকিরি শুনলাম–এ কান দিয়ে ঢোকালাম, ও কান দিয়ে বের করে দিলাম।
কবিতা কিন্তু পায়ে-পায়ে ওর সামনে এসে দাঁড়াল। চোখে চোখ রেখে বললে, বুঝেছি, পরীর ধ্যান করা হচ্ছে।
কপট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ইন্দ্রনাথ বললে, নিখাদ উক্তি। হ্যাঁ, আমি একটা পরীর কথা ভাবছি।
মানুষ পরী? ওর পাশে বসে বললে কবিতা।
হ্যাঁ। দুটো ডানা কেবল নেই। কিন্তু কী রূপ, কী রূপ বউদি, দেখলে তোমার হিংসে হত।
রূপসী কবিতা তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। বললে সে কোথায় থাকে?
ব্যারাকপুরে।
কী করে?
টিউশানি। কিত বয়স?
চব্বিশ।
সে কেন তোমার কাছে আছে?
তার একটা প্রবলেম নিয়ে।
কী প্রবলেম?
বিয়ের।
কাকে বিয়ে করতে চায়?
ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে।
ম্যানেজারের মতলবটা কী?
সেইটাই ধোঁয়াটে।
মেয়েটিকে সে ভালোবাসে?
প্রাণ দিয়ে।
তবে আর প্রবলেমটা কোথায়?
সে আরও একটা মেয়ের সঙ্গে ঘোরাফেরা করছে।
সেকী! ঝাঁটা মারো, ঝাঁটা মার অমন ম্যানেজারকে। এনে দাও আমার সামনে–খেংড়ে বিষ ঝেড়ে দিচ্ছি।
ঝাঁটা চালানোর অস্ত্রবিদ্যা লুপ্ত হতে চলেছে বঙ্গদেশ থেকে। তোমার যদি এখনও জানা থাকে, তাহলে মেয়ে পুলিশদের শিখিয়ে দিও বউদি। কিন্তু এটা ঝাটার কেস নয়।
তবে?
ঘড়ি দেখল ইন্দ্রনাথ। সমকোণে কাটা দুটো দাঁড়িয়ে আছে নয় আর বারোর ঘরে।
বললে, এ কাহিনি রূপসি নায়িকাকে আসতে বলেছিলাম ঠিক নটায়। টাটকা রিপোর্ট নেওয়ার জন্যে। তোমাদের দেখানোর জন্যে। ত্রিভুজ প্রেমের গোলমালে মাথা গলাতে আমার ইচ্ছে নেই। তুমি গোয়েন্দা লেখকের বউ। অতএব, নিজেও গোয়েন্দানি। তাই তোমরা যখন আসবে, তাকে আসতে বলেছি। ইচ্ছে হলে, কেসটা তুমি টেক-আপ করতে পারো। আমি টায়ার্ড। কোনও পুরুষ যদি দুটো গার্ল ফ্রেন্ডকে খেলিয়ে যায়, তাতে আমার কী? বাজার যাচাই করে নেওয়ার অধিকার সবার আছে।
ছিঃ। নারী জাগরণের যুগে তুমি মেয়েদের পণ্যদ্রব্য মনে করতে পারলে? মেয়েরা কি আলু পটল মাছ-মাংস? যাচাই যে করতে চায়, খেংড়ে তার–
বিউদি সে এসেছে।
লোহার গেট খোলার আওয়াজ শুনলাম। চটির চটাস চটাস শব্দ হল। একটা সময় ছিল যখন, দূরায়ত নূপুরনিক্কণ শুনে চিত্ত চঞ্চল হত। মেয়েরাও জানত, সলাজ চরণধ্বনি শুনিয়ে বুক দুলিয়ে দেওয়ার কৌশল। জানত, অপাঙ্গ চাহনির ম্যাজিক। আজকালকার মেয়েরা বড় পুরুষালি হয়ে গেছে। ফুল আছে, ফুলের সুবাস নেই। এটা ওয়েস্টার্ন কালচারের প্রভাব। হিন্দি ফিল্মের ধাক্কা।
উঠোন পেরিয়ে, সিঁড়ির ওপর দিয়ে, চটাস-চটাস শব্দ এসে পৌঁছল দরজার সামনে। বুঝি এক টুকরো জ্যোত্মার আবির্ভাব ঘটল সেই মিষ্টি সকালে।
বাংলার মেয়েদের সম্বন্ধে একটু আগে আমি যা ভাবছিলাম, তার সংশোধন দরকার হয়ে পড়ল মেয়েটিকে দেখে। টাকাপয়সার চিন্তা নিয়ে যেদিন থেকে মেয়েরা পথে বেরিয়েছে সেদিন থেকেই পুরুষের সঙ্গে তাদের টক্কর লেগেছে। ফলে, নমনীয়তা কমনীয়তা লাবণ্য লজ্জা ইত্যাদি ভালো ভালো বিশেষণগুলো যেন মেয়েদের চেহারা থেকে উবে যাচ্ছে। রুক্ষ বাস্তব উবিয়ে দিচ্ছে Essential Essence গুলো।
কিন্তু এই মেয়েটি তার ব্যতিক্রম।
এর সারা শরীরের স্নিগ্ধতা যেন আরকের মতোই তাজা রয়েছে। পূর্ণিমার রাতে চাঁদের দিকে তাকালে মন যেমন জুড়িয়ে যায়, এর নরম চোখ দুটোর দিকে তাকালেও সেই রকম একটা আবেশ শরীরে মনে জড়িয়ে যায়। রং ফরসা হলেই সব মেয়ে সুন্দরী হয় না, কিন্তু এ মেয়েটি ফরসা বটে, সুন্দরীও বটে। অথচ প্রসাধনের বাহুল্য নেই। এমনকি কানে দুল পর্যন্ত নেই। কব্জিতে শুধু একটা সরু ঘড়ি। পরনে হালকা গোলাপি রঙের তাঁতের শাড়ি। ব্লাউজও সেই রঙের। কিন্তু কাটছাঁটের মধ্যে দরজির আধুনিকতা দেখা দেয়নি। পায়ে রবারের হাওয়াই স্লিপার–তাই এত চটাস-চটাস আওয়াজ হচ্ছিল।
সে নিশ্চয় আশা করেছিল, ঘরের মধ্যে শুধু ইন্দ্রনাথ থাকবে। তাই আরও দুটি প্রাণী তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে দেখে একটু থতমত খেয়ে গেল।
আকৃতিতে কিছুটা পল্লীবালার মতো হলেও আচরণে সে তা নয়। মুহূর্তেই দ্বিধা খসিয়ে ফেলে দুহাত তুলে নমস্কার করল আমাদের তিনজনকেই।
বললে নরম গলায়, আসব?
ইন্দ্রনাথ বললে, আসবেন না তো কি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন? আপনার কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ। বসুন ওইখানে। বউদি, এঁর কথাই তোমাকে বলছিলাম। মাধুরী ঘোষদস্তিদার। আর এই যে দুটি মূর্তিকে দেখছেন মিস ঘোষদস্তিদার, এঁদের একজন আমার সাহিত্যিক বন্ধু মৃগাঙ্ক রায়– আর একজন তার সারাজীবনের অপধর্মের সঙ্গিনী–ম্যাডাম কবিতা রায়।
কবিতা বললে, আহা কথার কী ছিরি। বসো ভাই, তোমার নামটা এক্ষুনি শুনলাম। বেশ নাম। এ নাম তোমাকে মানায়। তোমার প্রাইভেট লাইফের প্রবলেম একটু জেনে ফেলেছি বলে লজ্জায় পড়ে যেও না। আমাদের এই তিনজনের মধ্যে কোনও কথাই চাপা থাকে না। প্রত্যেকে প্রত্যেককে কনসাল্ট করি, অ্যাডভাইসও দিই। তোমার ভাবী বর নাকি আর একটা মেয়ের সঙ্গে লটঘট করে বেড়াচ্ছে?
একটু রাঙা হল মাধুরীর ফরসা গাল। দেখে বেশ লাগল। আজকালকার মেয়েরা লজ্জায় রাঙা হতে ভুলে গেছে। রাঙা হওয়াটা মেয়েদের একটা প্লাস পয়েন্ট। মাধুরী তা জানে।
চোখ নামিয়ে নিয়ে সেকেন্ড কয়েক পরে সে বললে, হ্যাঁ।
ঠাকুরপোর সামনে যা বলতে পারোনি, তা আমার সামনে বলো। দরকার হলে চলো পাশের ঘরে যাই–
তা দরকার হবে না, মাধুরী এবার চোখ তুলেছে।
এতটুকু নার্ভাস নয় সে। দু-হাত রেখেছে দু-হাঁটুর ওপর। আঙুলে আঁচল পাকাচ্ছে না। বরং মেরুদণ্ড সোজা। সরল চোখ সোজা তাকিয়ে রয়েছে কবিতার দিকে, কোনও অন্যায় তো করিনি যে আড়ালে কথা বলব।
এত সোজা কথা এত সরলভাবে যে বলতে পারে, তার মনে পাপ থাকতে পারে না।
কবিতা হেসে ফেলল, এত রূপ নিয়ে মনের মানুষকে একা দখলে রাখতে পারছ না? সে কি তোমার চেয়েও রূপসী?
একটু বুঝি অন্যমনস্ক হল মাধুরী–সে অনেক স্মার্ট। তা হোক। কাজের জায়গায় ছেলেদের মিশতেই হয় মেয়েদের সঙ্গে। তা নিয়ে আমি ভাবি না।
তবে ভাবছ কী নিয়ে?
অন্যমনস্ক ভাবটা সরে গেল চোখ থেকে। স্পষ্ট উচ্চারণে থেমে-থেমে মাধুরী বললে, রঞ্জন বেনামে হোটেলে ঘর নিয়েছে কেন? কেন অফিস থেকে বেরিয়ে সেই হোটেলে গিয়ে ওঠে? কেন সেখানে গেলে আর তাকে দেখা যায় না?
.
রঞ্জনের পুরো নাম কুমুদরঞ্জন ঘোষ। মাধুরী ওকে শুধু বলে, রঞ্জন। বলে, তুমি শুধু রং লাগিয়েই গেলে আমার মনে–তোমার মনেও কোনও রং নেই, শরীরে তো নেই-ই।
মানুষটাকে মাধুরী খুব ছোটবেলা থেকে দেখছে বলেই এত স্পষ্টাস্পষ্টি কথা বলতে পারে। প্রেমের প্রথম পর্যায়ে যে মেয়ে ভালোবাসার মানুষটাকে বলে বসে, ওগো তোমার শরীরে কোনও রং নেই–তার মতো মূর্খ মেয়ে ভূভারতেও আর নেই।
কিন্তু মাধুরী-রঞ্জনের প্রেম তো আজকের নয়। শরীরের রং যখন দুজনের কারোরই ছিল না–তখন থেকেই রং ধরেছে মনে। বড় পাকা রং, মলেও এ রং উঠবে না।
তাই রঞ্জনের শরীর নিয়ে অত ঠাট্টা করে মাধুরী।
ঠাট্টা করার মতো শরীরও বটে রঞ্জনের। শুধু তালপাতার সেপাই বললে কম বলা হয়। মুখের গড়ন লম্বাটে, চুলের কোনও বাহার নেই। নেই জামাকাপড়ের ছিরিছাঁদ। একটা ঢলঢলে সাদা বুশশার্ট, আর ততোধিক ঢলঢলে সাদা ফুলপ্যান্ট।
ওস্তাগর তার শ্রীহস্তের পরশ বোলালে তালপাতার সেপাইয়ের অঙ্গেও কিঞ্চিৎ সুষমা এনে দিতে পারত, কিন্তু রঞ্জন দরজির সঙ্গে আড়ি করেছে অনেকদিন। কোজামা আর প্যান্ট দেদার পাওয়া যায় এবং অনেক সস্তাতেও হয়–অতএব কেন বেশি খরচ করতে যাবে?
মাধুরী ওকে অনেক বলেছে, দ্যাখো, এটা দ্যাখন-এর যুগ। আগে বাইরেটা দেখাও, তবে তো লোক তোমার ভেতরটা দেখতে কাছে আসবে।
রঞ্জন ওর বিখ্যাত দাঁত বের করে হেসে-হেসে বলে, আরে রাখো তোমার মেয়েলি লজিক। আমি কি মেয়েছেলে যে নিজেকে সাইনবোর্ড করে রাখব? সোনার আংটি যদি বেঁকাও হয় কাঞ্চন শিল্পী তার কদর করে। যে করে না, সে সোনা চেনে না–তার কাছে আমি যেতেও চাই না।
চিরকালই এমনই ফটর-ফটর বুকনি ছেড়ে এসেছে রঞ্জন। মুখে কোনও কথা আটকায় না। লম্বাটে করোটি দেখে ছেলেবেলায় বাড়ির মেয়েরা হাসাহাসি করত কিন্তু চুপ মেরে যেত করোটির গ্রে সেল-দের কেরানি দেখলে। একরত্তি ছেলের জিভ তো নয় যেন শানানো ক্ষুর! ব্রেন তো নয়–যেন টগবগে লাভা। একটুও না রেগে এমন আঁতে ঘা মেরে কথা বলে যেত রঞ্জন–পাড়াপড়শি থ হয়ে যেত। গালে হাত দিয়ে বলত–এ ছেলে কিছু একটা হবে। বাব্বা, এত কথা শিখল কোত্থেকে?
কথায় রঞ্জনের সঙ্গে কেউ পেরে ওঠেনি–আজ পারে না। শুধু কথার ধোকড় নয়–বুদ্ধিতেও চৌকস। বীরভূমের ছেলেদের ধমনীতে বীর রস থাকবে–এটা স্বাভাবিক। শৌর্য বীর্য তাই কথাতেও ফুটে বেরোয় দুনিয়ার কারও সে ধার ধারে না–জিভ ছোটালেই সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়।
তার আগে নয়। তখন সে শান্তশিষ্ট, অমায়িক হাস্যবিশিষ্ট এক অতি সজ্জন পুরুষ।
কাঠি দিলেই কিন্তু সে অন্য পুরুষ। তখনও সে হাসে। হাসিতে তখন থাকে মিছরির ছুরি। বচনে থাকে লাভার ফুলকি।
শান্তিনিকেতনের হস্টেল লাইফে এই বচনের ক্ষুর চালিয়ে তছনছ করে ছেড়েছিল রঞ্জন। খোদ প্রধানমন্ত্রীও এক ঘরে এক মাদুরে সামনাসামনি থই পাননি। ভাঙা-ভাঙা বাংলায় ধমকেছেন। শেষে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীত্ব যাঁকে করতে হয়, তাকে সবসময়ে তো সোজা পথে চলানো যায় না
রঞ্জন কিন্তু সটান পথের পথিক। ওই তোমার লক্ষ্য–মারো গুলি উড়িয়ে দাও চঁদমারি।
কড়া বিবেকের শাসন তাই রঞ্জনকে বিপথে যেতে দেয়নি। কোনও লোভের ফাঁদে পা দিতে দেয়নি। বিবেক ছাড়া কাউকে গুরু বলে মানেনি মানবেও না।
শান্তিনিকেতনের ছেলে, বীরভূমের ছেলে রঞ্জন যখন বড় হল, পর-পর অনেক পরীক্ষার বেড়া টপাটপ টপকে এসে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়ে বসল–তখনও পালটাল না ওর স্বভাব আর চরিত্র, নীতিবোধ আর বিবেক।
মাধুরীও আর ছোট খুকিটি নেই। শুধু শরীরে নয়, রং ধরেছে তার গোটা মনেও। সিউড়ির বড় পরিবারের মেয়ে সে। বোলপুরের পথেঘাটে দেখা হতে-হতে কখন যে এই লিকলিকে শ্রীহীন কালো রঙের মানুষটাকে মন দিয়ে ফেলেছিল, তা সে নিজেই জানে না। শরীর যখন পল্লবিত হল, যখন জ্যোত্মারাতে মন হু-হুঁ করে উঠতে লাগল, যখন তালপাতার সেপাইকে দুদিন না দেখলেই মনের ভেতর অদ্ভুত এক মোচড়ানির আবির্ভাব ঘটতে লাগল, তখন…শুধু তখন সে বুঝল, এরই নাম প্রেম।
রঞ্জনও তা বুঝেছিল। কিন্তু এতই রসকষহীন যে দুটো প্রেমের কথাও গুছিয়ে বলতে পারত না। প্রেমের চিঠিও লিখতে পারত না। বিয়ের কথা উঠলেই খালি বলত, দাঁড়াও, একটু গুছিয়ে নিই।
আর কী গুছোবে? পাকা চাকরি, নামী ব্যাঙ্ক, মোটা মাইনে। এবার মালাটা বদল করে নাও গো। আর কত দিন মাস্টারি করব? আমারও কি ইচ্ছে যায় না সংসার করার?
এইরকম ভাবেই সোজা কথা সোজাভাবে বলে এসেছে মাধুরী। এত দুদিনের মন দেওয়া নেওয়া নয় যে হিসেব করে আলতো হাতে গিঁট দিতে হবে?
একবগ্না রঞ্জনকে কিন্তু কিছুতেই রাজি করাতে পারেননি। বিখ্যাত দাঁত বের করে হেসে হেসে বলত, কি বিয়ে পাগলি মেয়ে রে বাবা! দুটো দিনও তর সইছে না! দাঁড়াও, কিছু একটা করি।
রেগে যেত মাধুরী, তদ্দিনে আমার স্বর্গের সিঁড়ি তৈরি হয়ে যাবে।
ভালোই তো, দুজনে হাত ধরাধরি করে, সেই সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গে গিয়ে সেখানেই মালাটা বদল করে নেব। বিয়ের মন্ত্র কে পড়বে জানো? নারদ!
এইভাবেই চলছিল দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। দুজনে থাকে কলকাতার দুদিকের মফস্বলে। রঞ্জনের ডেরা বর্ধমানে মাধুরীর ব্যারাকপুরে। রঞ্জনকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতে হয় বলে শনি আর রোববার ছাড়া মাধুরীর সঙ্গে দেখা করতে পারে না। শনিবার মাধুরী চলে আসে কলকাতায় অফিস থেকে রঞ্জন বেরিয়ে ওকে নিয়ে চলে যায় গঙ্গার ঘাটে। রবিবারে রঞ্জন চলে যায় ব্যারাকপুরে। মাধুরীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে চলে যায় গান্ধীঘাটে।
গঙ্গা ওদের দুজনেরই প্রিয়। গঙ্গার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে দুজনেরই খুব ভালো লাগে।
কিন্তু মাস কয়েক ধরে যেন একটু বেশি চুপ মেরে থাকে রঞ্জন।
বেশি খোঁচালে শুধু বলে, দাঁড়াও, দাঁড়াও, শিগগিরই একটা নতুন নাম নিতে যাচ্ছি।
কী নাম গো?
এক্স রে?
হ্যাঁ।
এ নাম কেন?
আমি হব অদৃশ্য রশ্মি। অদৃশ্য আলো হয়ে ঢুকে যাব একদম ভেতরে–যেখানে রয়েছে। কংকালের বীভৎস হাড়গোড়।
কী বলছ?
বাইরের চাকচিক্য দেখে এ মিঞা কোনওদিন ভোলেনি–ভুলবে না রক্তমাংসের রূপের আড়ালে রয়েছে হাড়ের কাঠামো–আসল স্ট্রাকচার। অদৃশ্য রশ্মি দেখতে চায় কোথায় চিড় ধরেছে। সেই কাঠামোটায়।
এসব হেঁয়ালির ব্যাখ্যা আর হাজির করেনি রঞ্জন। স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। মাধুরী আর পাঁচটা মেয়ের মতো নাছোড়বান্দার মতো লেগেও থাকেনি। রঞ্জন কিছু বলতে চাইছে না–বেশ তো সময় হলেই বলবে। না বলে যাবে কোথায়? মন খুলে কথা বলার মানুষ একজনই–মাধুরী?
কিন্তু এহেন অটল প্রত্যয়ে চিড় ধরল অকস্মাৎ। সেইদিন থেকে ভয়ে কাটা হয়ে রয়েছে মাধুরী। ঘটনাটা ঘটল এইভাবে।
স্কুলের একটা কাজে বি-বি-ডি বাগ গেছিল মাধুরী। আগে থেকে বলা থাকলে প্রাণের মানুষটাকে বলে রাখা যেত। কাজ শেষ করে একটা আড্ডা টাড্ডা দেওয়া যেত। কিপটের পকেট বেশি ফাসানো যেত না কিন্তু চা আর কচুরি তো খাওয়া যেত।
কাজ শেষ হতেই পাঁচটা বেজে গেল। ব্যাঙ্কে গিয়ে আর লাভ নেই। রঞ্জন এতক্ষণে হাওড়ায় গিয়ে ট্রেনে চেপেছে। শিয়ালদার ট্রামে মানুষ ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে। বাকি মানুষ পিলপিল করে হাঁটছে বৌবাজারের স্ট্রিট ধরে। তাদের সঙ্গেই মিশে গেল মাধুরী। ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সামনে দিয়ে যখন কোলের বাজারের দিকে যাচ্ছে, তখন দেখল রঞ্জন হনহন করে ঢুকে গেল একটা তিনতলা বাড়িতে।
সে বাড়ির দোতলায় ঝুলছে পেল্লাই একটা সাইনবোর্ড। তাতে লেখা : বিনয় লজ।
হাঁ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল মাধুরী। তারপর ভাবল, নিশ্চয় অফিসের কাজে ঢুকেছে ভেতরে। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার তো। অনেকে ক্যাশ ক্রেডিট অ্যাকাউন্ট খোলে, হাইপোথিকেট করে। রঞ্জনকে এনকোয়ারি করতে যেতে হয় মাঝে-মাঝে। এসব গল্প গঙ্গার পাড়ে শুনেছে।
এখনও নিশ্চয় সেই কাজ নিয়ে এসেছে। ঢুকুক, মাধুরীরও ঢুকতে ক্ষতি নেই। ব্যারাকপুরের ট্রেন অনেক, পরের ট্রেনটা ধরলেই হবে। একটু দেখা করে গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।
বিনয় লজ-এর সিঁড়িতে পা দিয়েছিল মাধুরী। তিন ধাপ ওপরেই একটা ঘর। সেখানে পালিশওঠা কাঠের কাউন্টারে বসে একজন বুড়ো বিড়ি টানছিল। পাঞ্জাবির যা চেহারা, ম্যানেজার বলেও তো মনে হয় না।
বুড়ো তোক আর ছোঁড়া হোক–সুন্দরী দেখলেই একটু বেশি খাতির করে। মাধুরীকে দেখেই বিড়ি নামিয়ে বুড়ো চেয়ে রইল।
মাধুরী বললে, এইমাত্র যিনি এলেন ওঁর সঙ্গে একটু দেখা করে যাব!
কাঞ্চনবাবু? যান, ওপরে চলে যান, দোতলায় বাঁদিকের বারান্দার শেষের ঘর–তিন নম্বর…তিন নম্বর!
যেন ভূতের রাজা বর দিচ্ছে, এমনিভাবে তিন নম্বর তিন নম্বর শব্দদুটো আউড়ে গেছিল বুড়ো। হাসি চেপে সামনের চটাওঠা কানাভাঙা সিমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে দোতলার তিন নম্বর ঘরের সামনে গিয়ে মাধুরী দেখেছিল, দরজায় তালা ঝুলছে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আকাশপাতাল ভেবেছিল মাধুরী। রঞ্জন তাহলে এখানে কাজে আসেনি, তিন নম্বর ঘরে এসেছে। কেন? কেন সে কাঞ্চন নামে পরিচিত?
নিচে নেমে এসে বুড়োকে জিগ্যেস করেছিল, কই, দেখলাম না তো। দরজায় তালা ঝুলছে।
তাহলে বেরিয়েছে। আশ্চর্য লোক, মা। ঠিক এই সময়ে রোজ আসে, পেছনের সিঁড়ি বেয়ে বেরিয়ে যায়। কিছু বলতে হবে?
না, না, আমি ব্যাঙ্কে দেখা করে নেব। হঠাৎ দেখলাম, তাই ভাবলাম একটু মুখটা দেখিয়ে যাই।
তাই করো। আমার সঙ্গে দেখাও হয় না। এখানে তো বসি না।
নেমে এসেছিল মাধুরী। রঞ্জনের অদ্ভুত রুটিন শুনে অবাক হয়েছিল। ও যে বর্ধমানে রাতে থাকে না কলকাতায় হোটেলে ওঠে, তাতো বলেনি। নাম ভাড়িয়েছে, তাও বলেনি। রাত কাটায় কোথায়, তাও তো বলেনি।
পরের দিন ঠিক ওই সময়ে বিনয় লজ-এর উলটোদিকের ফুটপাতে হিন্দু মহাসভার বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে রইল মাধুরী।
বি.বি.ডি. বাগ এর দিক থেকে এল তালপাতার সেপাই। রঞ্জন চিরকাল মাথা হেঁট করে হাঁটে–যেন একটা গণ্ডার। এদিক-ওদিক তাকায় না। সেদিনও গণ্ডার-হাঁটা হেঁটে বিনয় লজে ঢুকে গেল…
এবং বেরিয়ে এল পেছনের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে।
পেছনের সিঁড়িটা আগেই দেখে নিয়েছিল মাধুরী। তিনতলার ছাদ থেকে ঘুরে-ঘুরে, সব তলার বারান্দার প্রান্ত ছুঁয়ে নেমে এসেছে একতলায়। সেখানে রিক্সওলাদের মালিকের আড্ডা। টিনের শেড। এখান দিয়েই বেরিয়ে এল রঞ্জন।
কিন্তু এত ফিটফাট হয়ে এল কেন? এ যে একেবারে সাহেব। টাই কোট বুট ঝকঝক করছে। কেনা সুট নয়–বানানো। দারুণ মানিয়েছে। ছিপছিপে মানুষটাকে এখন ভোলা কৃপাণ বলেই মনে হচ্ছে।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরল রঞ্জন।
চোখ কপালে উঠে গেছিল সেদিন। কিপটের রাজা রঞ্জন ট্যাক্সি চড়ছে অম্লান বদনে। চা খাওয়াতে গিয়ে যে কিনা বুকপকেট থেকে পাঁচ টাকার নোট বেরিয়ে গেলে মুখ বেঁকিয়ে ফের ঢুকিয়ে রাখে। বলে, আমার পাঁচখানা পাঁজর।
হতভম্ব মাধুরীর সামনে দিয়ে হু-উ-স করে ট্যাক্সি বেরিয়ে যেতেই সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল সে। কপাল ভালো ফুটপাতের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল আর একটা ট্যাক্সি, উঠে বসেছিল পেছনে।
মিটার ডাউন করে ট্যাক্সি ড্রাইভার জিগ্যেস করেছিল, কোথায় যাবেন?
উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে দূরের ট্যাক্সি দেখিয়ে মাধুরী বলেছিল, ওই ট্যাক্সি যেখানে যায়।
আড়চোখে মাধুরীর দিকে একবার শুধু তাকিয়েছিল ড্রাইভার। তারপর আর কথা বলেনি। আজকাল মেয়েরাও গোয়েন্দা হচ্ছেড্রাইভার তা জানে।
চৌরঙ্গীর ওপর ট্যাক্সি ছেড়ে দিল রঞ্জন। ছেড়ে দিল মাধুরীও।
পাঁচতলা হোটেলের গাড়িবারান্দার তলায় দাঁড়িয়েছিল সুবেশা একটি মেয়ে। সুবেশা ছাড়া তাকে সুন্দরী আখ্যা দেওয়া যায় না। মেজেঘষে শরীরটাকে চলনসই করে রেখেছে, মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে তো বটেই। চেহারায় তার ছাপ রয়েছে।
রঞ্জন তাকে নিয়ে ঢুকে গেল পাঁচতারা হোটেলে।
ঘণ্টাখানেক এদিক-ওদিক করেছিল মাধুরী। কিন্তু জায়গাটা খারাপ। সুন্দরী মেয়ে একলা ঘুরঘুর করছে দেখে চারপাশ থেকে ঘিরে-ধরা, উঁকিঝুঁকি মারা, এমনকি চলুন না ঘুরে আসি আপ্যায়নও শোনা হয়ে গেল।
মাধুরী আর দাঁড়ায়নি। দাঁড়াতে পারেনি। মাথা ঘুরছিল। চোখের জল চাপতে গিয়ে চোখে ঝাপসা দেখছিল। কোনওমতে ধর্মতলার মুখে এসে ট্রামে চেপে চলে এসেছিল শিয়ালদা।
পরের শনিবার যায়নি ব্যাঙ্কে। রবিবার কিন্তু রঞ্জন যথারীতি ব্যারাকপুরে এসে ওকে নিয়ে গেছিল গান্ধীঘাটে। শুধু জিগ্যেস করেছিল, শনিবার এলে না কেন? তার বেশি কিছু না। মাধুরী যে অপকর্ম দেখেছে–তা নিশ্চয় জানতে পারেনি রঞ্জন। কিছু জিগ্যেস করেনি।
তবে…আগের চাইতেও বেশি অন্যমনস্ক মনে হয়েছে তাকে।
মাধুরীর কথা যখন শেষ হল, তখন জলের ধারা নেমেছে ওর দুগাল বেয়ে।
কবিতা শুধু চাইল ইন্দ্রনাথের দিকে।
ইন্দ্রনাথ বললে, ঠিক আছে, আমি দেখছি।
.
মাঝের নাটক
পরের রবিবার নাটক দেখিয়ে দিল ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
সকালে আমি আর কবিতা যখন পৌঁছলাম, মাধুরী তার আগেই এসে গেছে। ইন্দ্রনাথ পাশের ঘরে যোগব্যায়াম করছিল। কবিতা ওকে হিড়হিড় করে টানতে লাগল।
অসভ্যতার একটা সীমা আছে ঠাকুরপো। মেয়েটা এসে একলা বসে রয়েছে, আর তুমি শূন্যে ঠ্যাং তুলে ঘোড়ার ডিমের আসন করছ?
এটা ঘোড়ার ডিমের আসন হল? গায়ে গেঞ্জি চড়াতে-চড়াতে প্রতিবাদ করেছিল ইন্দ্রনাথ, জানো এই আসন জহরলাল নেহরু করতেন। তাই অত শার্প ছিল ব্রেন।
মেয়েটাকে একা বসিয়ে রেখে?
একলাই তো থাকবে এখন। তোমার মতো বেরসিক আমি নই।
তার মানে?
রা আসছে, ঘড়ি দেখল ইন্দ্রনাথ, সময় হয়েছে নিকট, এখন বাঁধন পরাতে হবে।
*
ছিলেছেঁড়া ধনুকের মতো ঝট করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল মাধুরী। মুখ থেকে নেমে গেছে সমস্ত রক্ত। একে তো হাতির দাঁতের মতো ফরসা গায়ের রং–আচমকা নিরক্ত হয়ে যাওয়ায় এখন তা কাগজের মতো সাদা।
খোলা দরজা দিয়ে ঢুকছে এক তালপাতার সেপাই।
ঢলঢলে শার্ট, প্যান্ট আর কালো গাত্রবর্ণ দেখলেই বোঝা হয়ে গেল, সে কে।
কুমুদরঞ্জন ঘোষ।
পেছন-পেছন এল যে মেয়েটি, তাকেও চিনতে দেরি হল না! এরকম সুবেশা কিন্তু সুরূপা নয় একজনই হতে পারে। পাঁচতলা হোটেলের সেই রহস্যময়ী।
খুব আওয়াজ করে নস্যি নিয়ে ইন্দ্রনাথ বলেছিল, ব্যস, এবার শুরু হোক শেষ অঙ্ক। মাধুরী ঘোষদস্তিদার, ওরকম কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে পেশি টেনে ধরবে–তখন ওই কুমুদরঞ্জন ঘোষকে দিয়েই পা টেপাতে হবে। যেখান থেকে দাঁড়িয়েছেন, ওখানেই টুপ করে বসে পড়ুন। শ্ৰীযুক্ত কুমুদরঞ্জন ঘোষ, আপনার রঞ্জনরশ্মির আশ্চর্য কাহিনি শুনব সব শেষে। বসুন, বসুন, মাধুরীর পাশে বসুন। ফাইন। এইবার শেফালিকা নন্দী। আপনিই যত নষ্টের গোড়া। আপনার কাহিনি শুরু হোক সবার আগে। স্টার্ট।
.
শেফালিকা
নন্দী টাইটেলটা এখনও নিয়ে রেখেছি, রাখবও চিরকাল। কিন্তু ছাদনাতলায় দাঁড়িয়ে যে লোকটা আমার পদবী আর গোত্র পালটে দিয়ে গেল, সে যদি থাকত, আমার মতো সুখী মানুষ দুনিয়ায় আর কেউ থাকত না।
জন্মেছিলাম শেফালিকা দত্ত হয়ে। অনেক আশা আর আনন্দ নিয়ে বিয়ে করেছিলাম ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে। কুবেরদের বাজারদর অনেক।
রমাপতি নিজেও তো ছিল ছোটখাট এক কুবের। নন্দী পদবী শুনেই বুঝছেন? সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের চাপা টাকার খবর অনেকেই রাখে না। কলকাতায় এখনও কত প্রপার্টি ধরে রেখে দিয়েছে, তাও ঢাক পিটিয়ে কাউকে জানায় না।
কুবেরের বিষয়-আশয় পেয়েই বোধহয় এত নির্লোভ আর এত নীতিবাগীশ ছিল রমাপতি। সোনার খাটে গা আর রূপোর খাটে পা দিয়ে যে লোকটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারত–সে এসেছিল লাইনে–খেটে রোজগার করতে। বলত বাপঠাকুরদা বাগানবাড়ি বানিয়ে আর মেয়েছেলে রেখে যত পাপ করেছে, তার প্রায়শ্চিত্ত করছি।
সেইটুকু করলেই তো হত। কেন ও দৌড়ল কালো টাকা লুটেরাদের পেছনে। কেন তাদের মুখোশ খসানোর জন্যে কোমর বেঁধে লাগতে গেল। কুচক্রের অচলায়তন ভাঙার ক্ষমতা ওর ছিল না–টলানো তো দূরের কথা।
কিন্তু পায়ের তলায় যারা ঘাস গজাতে দেয় না তারা পায়ের তলায় কাঁটার খোঁচা কখনও সয়?
তাই একদিন কসবার খোলা হাইড্রেনের মধ্যে একটা লাশ পাওয়া গেল।
শেষ হয়ে গেল রমাপতি নন্দী। শেষ হয়ে গেল পুলিশি তদন্ত। অপরাধী রয়ে গেল অন্ধকারে।
আর রইল আমার বৈধব্য। থাকবে সারাজীবন।
সেই সময়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল এক আদর্শ মানুষ। এই কুমুদরঞ্জন ঘোষ।
আমাকে বললে,–আমি সব জানি। সন্দেহ আমারও হয়েছে। আমি কিন্তু সাবধানে এগোচ্ছি। এই কুচক্র আমি ভাঙব, রমাপতির অপঘাত মৃত্যুর বদলা নেব, দেশের জন্যে একটা অদ্ভুত ভালো কাজ করে যাব–তাতে আমারও মৃত্যু হয় তোক।
.
রঞ্জন
হ্যাঁ, একথা আমি বলেছিলাম শেফালিকাকে। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম বদলা আমি নেবই।
সেইদিন থেকে কুমুদরঞ্জন ঘোষ হয়ে গেছিল রঞ্জনরশ্মি ঘোষ। মাধুরীকে এর বেশি আর বলিনি। বিয়েটা শুধু আটকে রেখেছিলাম। বিধবা থাকার চেয়ে আইবুড়ো থাকা অনেক ভালো।
দেশসুদ্ধ লোক এখন জেনে গেছে স্ক্যাম নামে শব্দটা। তিন হাজার কোটি টাকা উধাও হওয়ার চাঞ্চল্যকর অপব্যবস্থা। Scam শব্দটা কিন্তু ব্রিটিশ ডিক্সনারিতে খুঁজে পাবেন না। এটা একটা আমেরিকান স্ল্যাং। নিশ্চয় সেদেশেও এইরকম ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারি হয়।
দেশজুড়ে এই হইচই পড়ার অনেক আগে থেকেই টাকা সরে যাচ্ছিল ব্যাঙ্ক থেকে। কোটি কোটি টাকা। চোখের সামনে দিয়ে টাকার এই রকম উড়ে যাওয়া দেখার পর মানুষের মতো মানুষরা চুপ করে বসে থাকতে পারে না। রমাপতিও পারেনি। ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু ধমক খেয়েছিল। শাস্তির হুমকি শুনেছিল। বেপরোয়া রমাপতি তখন একা এগিয়ে গেছিল। তাই ওর লাশ পড়েছিল। যেখানে কোটি-কোটি টাকার খেলা চলে, সেখানে দু-দশ হাজারেই একটা মানুষ খুন করিয়ে দেওয়া যায়, নিখুঁতভাবে কোথাও কোনও সূত্র না রেখে। রমাপতি কিন্তু একটু সূত্র রেখে গেছিল আমার কাছে, মরার আগে। অন্য ম্যানেজারদের সঙ্গে ওর তেমন দহরম-মহরম ছিল না। আমার সঙ্গে ওর মনের মিল ছিল অনেকগুলো বোকামির জন্য। আমরা সৎ, আমরা ঘুষ নিই না, আমরা মুখ বুজে অন্যায় বরদাস্ত করি না। অতএব আমরা মূর্খ।
টাকা জমা রেখে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলিয়ে দেওয়ার বা তুলিয়ে নেওয়ার অনেকগুলো অপব্যবস্থা আছে। এদের নাম ও রিফান্ড অর্ডার, ডিবেঞ্চার ইন্টারেস্ট, ডিভিডেন্ড ওয়ারেন্ট, ইন্টারেস্ট ওয়ারেন্ট, কমিশন ওয়ারেন্ট ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় আরও অনেক পেমেন্ট।
এজন্যে ডেসিগনেটেড অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। এগ্রিমেন্ট করতে হয় ওয়ারেন্ট ইস্যু করার আগে। তারপর টাকা জমা দিতে হয়। তখন ব্যাঙ্ক হেড অফিস সার্কুলার ইসু করে দেয়। কোম্পানি তখন ওয়ারেন্ট বা পোস্ট-ডেটেড ওয়ারেন্ট বাজারে ছেড়ে দেয়। সার্কুলার অনুযায়ী ব্যাঙ্ক ম্যানেজাররা টাকা দিয়ে যেতে থাকে।
আমার প্রথম সন্দেহ দেখা দেয় একটা পাঁচতারা হোটেলের অ্যাকাউন্ট নিয়ে। নামটা বলব না। অফিসিয়াল সিক্রেসি।
প্রথমেই যে টাকা জমা দেওয়া উচিত, এই হোটেল কোম্পানি তা না জমা দিয়ে অর্ডিনারি অ্যাকাউন্টের মতোই আস্তে-আস্তে টাকা জমা দিয়ে যাচ্ছিল। অপরেটিং ব্রাঞ্চের ম্যানেজার আমি। কিছু নিয়ম আমাকে মেনে চলতে হয়। আর তখনি আমার সন্দেহ হয় এত কম টাকা জমা পড়ছে। কেন?
কৌতূহলের শুরু তখন থেকেই।
তখন আমি ধাপে-ধাপে এগোতে লাগলাম। ছাত্রজীবনে সংগঠন করেছি, আন্দোলন চালিয়েছি, অন্যায়ের প্রতিকার করেছি। কিন্তু হঠকারিতা কখনও করিনি। এটাই আমার ছাত্র জীবনের শিক্ষা।
প্রথম ধাপেই ওয়াকিবহাল করলাম ওপরওলাদের। তাদের জানিয়ে দিলাম, কী ধরনের বেআইনি কাণ্ড চলছে আমার নাকের ডগায়। যে রিকুইজিট ফান্ড জমা দেওয়ার কথা–এই পাঁচতারা হোটেলটি তা না দিয়ে বাজার থেকে কোটি-কোটি টাকা তুলিয়ে নিচ্ছে।
রমাপতির কপালে যা ঘটেছিল, আমার কপালে ঘটল ঠিক তাই। ধমক আর শাস্তির হুমকি।
আমি যে ভুল সন্দেহ করিনি, এই হল তার প্রমাণ। চক্রান্ত একটা রয়েছে। হাতে হাত মিলিয়ে রয়েছে ব্যাঙ্কের উধ্বর্তম ম্যানেজমেন্ট আর পাঁচতারা হোটেল। নিচুতলার ম্যানেজাররা নাক গলালেই নাক উড়ে যাবে। যেমন গেছে রমাপতির।
আমি তখন অপারেশন শুরু করলাম সম্পূর্ণ নিজের ঝুঁকিতে কারও সাহায্য না নিয়ে চাকরির পরোয়া না রেখে। একেবারে নিজের মনগড়া নিয়মে।
ব্যাঙ্ক-নিয়ম অনুযায়ী পাঁচতারা হোটেল কোম্পানির উচিত, বাজারে চলতি ইসুগুলোর যোগফল-টাকা ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া।
কিন্তু তা তারা করছে না। ডেলিডেবিটেড টাকার চাইতে মাত্র দশ-বিশ হাজার টাকার বেশি করে জমা দিচ্ছে।
আমি ঠিক করলাম, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাব পাঁচতারার প্যাঁচ।
কোম্পানির গড়পরতা যত সংখ্যক চেক ডেবিট হত, তা করে, নামমাত্র দু-একটা চেক ডেবিট করে, বাকি চেকের আলাদাভাবে হিসেব তৈরি করে রেগুলার যোগ দিয়ে রাখতে শুরু করলাম।
এ হিসেব গোপনে রাখলাম নিজের কাছে।
ফলে, পাঁচতারা কোম্পানি সন্দেহও করতে পারল না, কত টাকার সত্যিকার চেক ব্যাঙ্কে জমা হয়ে গেছে। শুধু জানল, অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট ব্যালান্স রয়েছে। অডিটিং-এর নিয়ম অনুসারে তাই তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাঁচতারার অফিসার নিয়মিত পজিশন দেখে খুশি হয়ে চলে যায়– জানতেও পারে না আসল পজিশনটা।
সে হিসেব তো আমার কাছে।
এইভাবে একটু-একটু করে পাঁচতারাকে টেনে নিলাম আমার পাতা ফাঁদে।
তারপর গেলাম দ্বিতীয় ধাপে।
তিন-চারদিনের টানা ছুটি ব্যাঙ্কে প্রায়ই থাকে। তক্কেতক্কে রইলাম এইরকম একটা ছুটির। ছুটির ঠিক আগের দিন দুম করে একদিনেই ২৪ কোটি ৯৮ লক্ষ টাকা ডেবিট করে দিলাম।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষদের তোষামোদ করার লোকের অভাব নেই কোনও ব্যাঙ্কেই। অভাব ছিল না আমার ব্রাঞ্চেও। ঝড়ের বেগে খবর চলে গেল সেখানে।
চাপ এসে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। কাজটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। যা করছ, কোম্পানিকে জানিয়ে করো।
আমার বয়ে গেছে জানাতে, ছুটি তো পড়ে গেছে। এই কদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ। ২৪ কোটি ৯৮ লক্ষ জমা দেওয়ার সুযোগ তো পাচ্ছে না পাঁচতারা কোম্পানি।
এ টাকা খাতাকলমে ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিলে ব্যাঙ্ককে দিতে হত বেশি করেও শতকরা ২৫ সুদ। কিন্তু কলমানি মার্কেটে খাঁটিয়ে পাঁচতারা কোম্পানি লুটে নিচ্ছে শতকরা ৩০ থেকে ৫০ সুদ।
কর্তৃপক্ষ তা জানে। জেনেশুনেও পাঁচতারাকে দিয়ে যাচ্ছে টাকা। রমাপতি বলতে গেছিল, তাকে লিখে জানিয়েছিল বকেয়া টাকার জন্যে কোনও সুদ নিতে পারবে না। কেন?
আরে, ওই পরিমাণ টাকা তো ওরা অন্য জায়গায় রেখেছে। তোমার বাগড়া দেওয়ার কী দরকার।
বোকা রমাপতি তা সত্ত্বেও বাগড়া দিতে গিয়ে মরেই গেল।
আমি কিন্তু মরলাম না–যদিও যে-কোনওদিন বডি পড়তে পারে। মাধুরী ভয় পাবে বলেই এতদিন এসব বলিনি। কিন্তু কঁহাতক আর সহ্য করা যায়? আমরা যারা খেটে খাই, সভাবে খেয়ে পরে বাঁচতে চাই আমরা চাকরি পাচ্ছি না কিন্তু কালো টাকার মালিকরা ব্যাঙ্কের টপমোস্ট ম্যানেজমেন্টদের নিয়ে ফুর্তির ফোয়ারা ছুটিয়ে যাচ্ছে পাঁচতারার ঘরে-ঘরে। কত মধ্যবিত্তের মেয়ে কৌমার্য বলি দিচ্ছে সেখানে কেউ তার খবরও রাখে না। যে পাপাচার কল্পনাতেও জানা যায় না–তাই চলছে অবাধে কারণ সর্ষের মধ্যেই ঢুকে রয়েছে ভূত। রক্ষক যে, সেই হয়েছে ভক্ষক। পাবলিক তা জানবে কী করে?
ভাগ্যিস আমি ব্যাঙ্ক ম্যানেজার হয়েছিলাম। তাইতো জানতে পারলাম। জানতে যখন পেরেছি, বিহিত না করলে আমি কি মানুষ পদবাচ্য?
যাক, যা বলছিলাম, ছুটির ঠিক আগের দিন আমার ওই কীর্তির ফলে পাঁচতারা কোম্পানির বেআইনি দাদন লেখা হয়ে গেল ২৪ কোটি ৯৮ লক্ষ টাকা। ব্যাঙ্কের ভাষায় যাকে বলে, Clean Advance–সিকিউরিটি ছাড়াই।
আনন্দে ডগমগ হয়ে আমি চলে গেলাম ছুটিতে। রমাপতির আত্মা বোধহয় সেদিন কিছুটা শান্তি পেয়েছিল।
ছুটি কাটিয়ে ফিরে এসে শুনলাম, ব্যাঙ্কের শিরায়-উপশিরায় রটে গেছে সেই খবর। কুমুদরঞ্জন ঘোষ ঘায়েল করেছে পাঁচতারাকে। পালটা প্যাঁচে ধরাশায়ী কোম্পানি পাগলের মতো ধর্না দিয়েছে টপমোস্ট ম্যানেজমেন্টের কাছে।
মুখরক্ষা করার জন্যে ম্যানেজমেন্ট চিঠি দিয়েছে পাঁচতারাকে–কিন্তু তুলোধোনা করছে বেঁড়ে ব্যাটাদের নিয়ে। পাচ্ছে না কেবল এই পাতি অফিসারকে।
অনেক চিঠির ঝড় বয়ে গেল দুই তরফে। পাতি অফিসারের সুবাদে প্রায় দশ লক্ষ টাকারও বেশি সুদ আদায় পেয়ে গেল ব্যাঙ্ক।
লাভ হল ব্যাঙ্কের।
আমার লাভও হল না, ক্ষতিও হল না। মাইনে তো পেলাম। মাইনে পাওয়ার কর্তব্য করে গেলাম–যা আর কেউ করতে সাহস পায় না।
কিন্তু ক্ষতি হয়ে গেল পাঁচতারা আর টপমোস্ট ম্যানেজমেন্টের। দশ লাখ কি কম কথা। কত বখরা থাকত ম্যানেজমেন্টের?
ফলে, মিটিং-এর পর মিটিং হয়ে গেল আমাকে নিয়ে আমাকে ঠান্ডা করার জন্যে নরমে গরমে কতভাবেই না বোঝানো হল আমাকে আর বেড়ো না–যা হচ্ছে তোক।
কিন্তু তাই কি হয়! কতরকম টোপ যে পড়েছিল আমাকে কজায় আনার জন্যে–তা বললে মাধুরী হয়তো মূৰ্ছা যাবে। কতরকম ঘেরাটোপ যে রচনা হয়েছিল আমার হাত-পা বেঁধে ঠুটো বানিয়ে রাখার জন্যে–তার বিশদ বর্ণনাও আর দিতে চাই না।
আমি শুধু চালিয়ে গেলাম। কে তখন রোখে আমায়। উচ্চিংড়ের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে যেখানে ফাঁক পেলাম, সেখানেই প্যাঁচ কষে গেলাম। কুকাজ ফঁস করে দিলাম। যা কিছু পাওনা, আদায় করে গেলাম।
ফল হল ভয়ানক।
আমাকে বদলি করে দেওয়া হল।
পাঁচতারাকে প্যাঁচ কষবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হল। তাতে কিন্তু ব্যাঙ্কের ক্ষতিই হল। কিন্তু তাতে কার কী এসে যায়? ওই ব্রাঞ্চে যদি আরও দশ থেকে পনেরো বছর আমি থাকতাম, ব্যাঙ্কের মুনাফা বা লভ্যাংশ হিসেবে কম করেও ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা ব্যাঙ্ককে হাতেকলমে পাইয়ে দিতামকাগুঁজে হিসেব নয়কড়কড়ে টাকায়। ভাবতে পারেন? একটা ব্যাঙ্কের একটা শাখায় একজন মাত্র অফিসার যদি এই লভ্যাংশ এনে দিতে পারে, তাহলে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত কনজার্ভেটিভ হিসেবে শতকরা দশটা শাখায় এই পরিমাণ লাভ এলে প্রতি বছরে আমাদের দেশের একটা করে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কার্যকর করা যায়। চরম অসংযমী ন্যায় নীতিহীন মুনাফাখোরদের হাতে পড়ে আপামর জনসাধারণের ভোগান্তি কোন পর্যায় পৌঁছেছে, তাও কি ব্যাখ্যা করে দিতে হবে?
না। কক্ষনও না। আজও গায়ের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে সেই নাটকীয় মিটিং-এর কথা মনে পড়লেই। ২৪ কোটি ৯৮ লক্ষ টাকার ভাউচার নিয়ে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল আমাকে। ভাউচার লিখেছিলাম আমি–সই করেছিলাম আমি। পাঁচতারার ওপরতলায় বসেছিল জরুরি অধিবেশন। মিটিং তো নয়–কাঠগড়া। সেখানে হাজির হয়েছিলেন পাঁচতারার চিফ সেক্রেটারি, ফিন্যান্স ডিরেক্টর, জয়েন্ট সেক্রেটারি, কমপিউটার অপারেশন-এর ডিরেক্টর আর ডিলিং অফিসার।
ব্যাঙ্কের তরফ থেকে হাজির হয়েছিলেন জেনারেল ম্যানেজার, একজন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার, একজন ডেপুটি ম্যানেজার আর এই পাতি অফিসার।
কত গুরুত্বপূর্ণ সেই মিটিং আন্দাজ করতে পারছেন? পাপচক্রের অংশীদার কারা, তা কি আর খুলে বলার দরকার আছে? ব্যাঙ্কের লাভকে এঁরাই এতদিন ভাগ করে নিয়েছেন–আমি বাগড়া দিয়েছি বলে আমাকে কাঠগড়ায় তুলেছেন।
রমাপতি মরেছে, আমিও না হয় মরব, কিন্তু মেরে মরব।
চিফ সেক্রেটারি ভদ্রলোককে এমনিতেই একটা ভদ্র বাঘ বললেই চলে। না…না..ভদ্র সিংহ। সিংহের মতোই তো কেশর, আলমগিরের মতো দাড়ি। চোখ দুটোয় সুমেরুকুমেরুর জমাট বরফ।
কনকনে চোখে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্রেফ তুলোধোনা করে গেলেন চোস্ত ইংরেজিতে। ভাগ্যিস ভাষাটায় দখল ছিল। তাই রক্ষে। ভদ্র সিংহ আমার চেহারা দেখে বোধহয় ভেবেছিলেন–কিংস ইংলিশ শুনলেই নিশ্চয় প্যান্ট নষ্ট করে ফেলব।
ধোপা, নাপিত, কুলি, মজুরকেও এভাবে আমরা গালাগাল দিই না।
আমি চুপ করে রইলাম।
ব্যাঙ্কের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার আমাকে একটু স্নেহ করতেন। আমার হাড়মজ্জার খবর রাখতেন। কিন্তু আমি যে রঞ্জনরশ্মি হয়ে গিয়ে তাঁদেরও হাড়মজ্জার খবর রাখতে শুরু করেছিলাম, তা জানতেন না।
এই ভদ্রলোকই আমার হেনস্থা দেখে নরম গলায় আমার সেন্স অফ ডিউটি সম্বন্ধে দু-চারটে ভালো-ভালো কথা সেদিন বলেছিলেন।
ভদ্র সিংহ কনকনে চোখে তাকিয়েই রইলেন আমার দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, কুমুদরঞ্জন ঘোষ!
সবিনয়ে আমি বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, অধীনের নাম কুমুদরঞ্জন ঘোষ। ওরফে কে আর ঘোষ। সংক্ষেপে রঞ্জন ঘোষ। আরও একটা নাম আছে আমার। রঞ্জনরশ্মি ঘোষ।
হোয়াট?
মানে, এক্স-রে ঘোষ। আপনার কোম্পানির ভেতর পর্যন্ত দেখে ফেলেছি তো।
ইউ পেটি অফিসার।
ও ইয়েস, আই অ্যাম এ ভেরি-ভেরি পেটি অফিসার। কিন্তু আপনার কোম্পানির সব অফিসার ঠিক আছে তো?
অ্যাকাউন্ট কীভাবে রাখতে হয়, শিখে নিন আমার কাছ থেকে।
আপনার কাছ থেকে? সরি, স্যার। আপনার কোম্পানির অ্যাকাউন্ট শিখে আমার কী লাভ?
ইউর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট—
সেটাও আপনার কাছ থেকে শিখব না।
ইউ ব্লাইটার।
ল্যাঙ্গুয়েজ প্লিজ। আপনার কোম্পানি-অ্যাকাউন্ট ঠিক আছে তো?
মানে?
যে টাকা রেখে যে টাকা তোলার কথা–তা কি হচ্ছে?
হু দ্য হেল ইউ আর টু কোশ্চন মি?
কত টাকা ব্যাঙ্কে রেখে, কত টাকার চেক ছেড়েছেন বা কত টাকা তুলিয়ে নিয়েছেন– তা তো আপনাকে জানাতে হবে–এখুনি।
আপনার সাহস তো কম নয়। আপনার ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানও আমাদের Credential নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না। আপনার কি অথরিটি আছে?
আছে, আছে। তাছাড়া, এটা তো আপনার কোম্পানির Credential-এর প্রশ্ন নয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের প্রশ্ন। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রিকনসাইল করতে গেলে এ প্রশ্নের সদুত্তর তো চাই।
সবেগে মাথা ঘুরিয়ে ফিন্যান্স ডিরেক্টরের দিকে তাকালেন ভদ্র সিংহ। বললেন, এর সঙ্গে আপনি কথা বলুন।
ফিন্যান্স ডিরেক্টর একটি অমায়িক পশু বিশেষ। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন পাশের কামরায়। জামাই আদরে একটা দামি সোফায় বসালেন। হুইস্কি রেডি ছিল। অফার করলেন। আমি সেদিকে না তাকিয়ে বললাম, কী বলতে চান, বলে নিন।
উনি জবাব না দিয়ে মস্ত টেবিল প্রদক্ষিণ করে পিঠ-উঁচু চেয়ারে বসলেন। তখন আমার খেয়াল হল, আমাকে ডেকে এনেছেন নিজের চেম্বারে। ড্রয়ার টেনে ডানহাতে কী যেন নাড়াচাড়া করতে করতে আমার দিকে হাসি-হাসি মুখে চেয়ে রইলেন। এসব লোকেরা হাসিমুখেই খুন করে। তাই আমি সতর্ক হলাম।
উনি বললেন, চিফ সেক্রেটারির সঙ্গে এভাবে কথা বলতে আপনার ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানও সাহস পায় না।
আমি চেয়ারম্যান নই, বললাম আমি।
আপনি একটু বুঝেসুঝে কথা বলুন।
কী বলতে চান, প্রাঞ্জল করুন।
এভাবে, এইসব কথা না বললেই ভালো করতেন। এবার দেখলাম ফিন্যান্স ডিরেক্টর তোতলাচ্ছেন।
আমি চালিয়ে গেলাম, আমি নিরুপায়। আপনার কোম্পানির অফিসার আমি নই। কাজেই আপনার চিফ সেক্রেটারির মন জুগিয়ে কথা বলার দরকার আমার নেই।
মিঃ ঘোষ–
কেন উনি আমাকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পাঠালেন, সেটা বলুন। যদি কিছু বলার না থাকে, এখানে সময় নষ্ট করার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।
আপনার যা প্রশ্ন সেটা আমাকে করুন।
প্রশ্ন তো একটাই ও আপনার কোম্পানির অ্যাকাউন্ট ঠিক আছে কি?
ফিন্যান্স ডিরেক্টর জবাব না দিয়ে ড্রয়ারটার দিকে চাইলেন। ডানহাতে যা নাড়াচাড়া করছিলেন, এবার তা বের করে এনে টেবিলের ওপর রাখলেন। একতাড়া নোট।
পাঁচশো টাকার একশোটা নোট। নতুন নোট। নগদ পঞ্চাশ হাজার।
উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, চলুন, আপনার কথা শোনা হয়ে গেছে।
অমায়িক পশু বিশেষের মতোই ফিন্যান্স ডিরেক্টর আমাকে নিয়ে মিটিং রুমে ফিরে এলেন। চিফ সেক্রেটারিকে বললেন, স্যার, ইনি শুধু জানতে চাইছেন, আমাদের কোম্পানি অ্যাকাউন্ট ঠিক আছে কিনা।
চিফ সেক্রেটারি চোখের পাতা না ফেলে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন ফিন্যান্স ডিরেক্টরের দিকে। কথা হয়ে গেল চোখে-চোখে, তাকালেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের দিকে।
বললেন, তাহলে তো আপনাদের সঙ্গে একটা সিটিং দিতে হয়।
জেনারেল ম্যানেজারের জবাব যেন তৈরি ছিল। সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, তাহলে এখন যাই। ব্যাঙ্কের মিটিং ডাকছি–আপনারাও আসুন সেখানে।
মিটিং কিন্তু আজও ডাকা হয়নি। যে তথ্য জানতে চেয়েছিলাম, আজও তা ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানতে পারেনি। জানতে চায়ও না। জানলে তো আর পাঁচতারার ঘরে-ঘরে মধুযামিনী করা চলবে না।
শুধু বদলি করা হয়েছে আমাকে।
তার আগে অবশ্য জেনারেল ম্যানেজার তলব করেছিলেন আমাকে তার চেম্বারে।
বলেছিলেন রুষ্ট গলায়, তোমার এসব খোঁজখবরে দরকার কী, ঘোষ?
আপনি বলছেন, দরকার নেই? বলেছিলাম বেঁকা সুরে, ভবিষ্যতে তাহলে আর কৈফিয়ৎ চাইবেন না কোনও কাজে গাফিলতির জন্যে।
ঘোষ–
আগে কথা দিন, কৈফিয়ৎ চেয়ে বিরক্ত করবেন না—
ওভাবে ব্যাপারটা নিচ্ছ কেন?
তাহলে কীভাবে নেব?
এরা তো খুব বড় কোম্পানি। এদের ব্যাপারে একটু রয়েসয়ে চারদিক ওজন করে কথা বলা দরকার।
মানতে পারলাম না স্যার, আমার কাছে সব অ্যাকাউন্ট হোল্ডারই সমান–কার বড় কোম্পানি, কার ছোট কোম্পানি–এ বিচার করি না ক্লায়েন্ট হ্যান্ডল করার সময়ে। সবাই খদ্দের, সবাই লক্ষ্মী।
তা তো বুঝলাম–
না স্যার, আপনি বোঝেননি। বুঝলে এই উপদেশ আমাকে দিতে আসতেন না। এই কোম্পানি আপনার আমার পেটের ভাত মেরে দিচ্ছে–চাকরির সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। এদের কাছ থেকে কে কত পেয়েছে জানি না আমি তো কিছু পাইনি।
দুম করে রেগে গেলেন জেনারেল ম্যানেজার। ভদ্রলোক এমনিতেই খুব কম কথা বলেন। যমের মতো সবাই ভয় পায়। আমি কিন্তু মরার ভয় কাটিয়ে উঠেছিলাম বলে যা-যা বলবার, কটাকট বলে যাচ্ছিলাম। রাগ তো হবেই।
কড়া গলায় বললেন, কী বলতে চাইছ?
রেগে গেলে তো চলবে না। যা ঘটবার ঘটে গেছে কজনের চাকরি খাবেন, তাই ভাবুন। তার বাইরেও বড় ভাবনা হয়তো আপনার মাথায় ঘুরছে–আপনার নিজের চাকরিটাই না যায়, কারণ একটাই : এই যে টাকা তোলার হুলিয়া–এতে তো সই দিয়েছেন আপনি। এই হুলিয়ার ফলেই তো পাঁচতারা কোম্পানি গড়পরতা দশ লাখ টাকারও কম রেখে আজ পর্যন্ত ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় পঁচিশ কোটি টাকা তুলিয়ে দিয়েছে। আপনার দায়িত্ব আপনি অস্বীকার করতে পারেন, আমি যে ভাউচার লিখেছি সেটা ঘুরিয়ে দিয়ে আপনি লিখতে পারেন? পারলে লিখুন না।
যাও, যাও, পরে ডাকছি।
আমি কিন্তু যাইনি। জবাব না দিয়ে উঠব না ভান করেছিলাম। চোখ রাঙানিতেও ওষুধ ধরল না দেখে হাঁকডাক করে পারসোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকেছিলেন জেনারেল ম্যানেজার, এটা করো ওটা করো–আবোলতাবোল হুকুম ছেড়ে গেছিলেন। বেশ বুঝলাম, বিলক্ষণ ঘাবড়ে গেছেন– সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
আমি তখন উঠে চলে এসেছিলাম। আসবার সময়ে বলে এসেছিলাম, পরে ডাকবেন স্যার।
স্যার আর ডাকেননি শুধু বদলির হুকুম জারি করেছিলেন। তারপর থেকেই আমি হুশিয়ার হয়েছি। রমাপতির কপালে কী ঘটেছিল, তা ভুলিনি। বর্ধমানে আমি একা থাকি পৈতৃক ভিটেতে। কেউ তো নেই। পাড়ার ছেলেদের দিয়ে খবর নিয়ে জানলাম বাড়ির ওপর কেউ বা কারা নজর রাখছে।
বুঝলাম। রাতেই সাবাড় করার মতলব। একবার খতম হয়ে গেলে কে আর দেখছে।
বাড়ি যাওয়া বন্ধ করলাম। বিনয় লজে ঘরভাড়া নিলাম। সেখানে অনেক লোকজন। খুনখারাপি এত সোজা নয়।
দুদিনেই টের পেলাম, অফিস থেকে বেরোলেই পেছনে ফেউ লাগছে।
তখন থেকেই বিনয় লজে এ দরজা দিয়ে ঢুকে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া আরম্ভ করলাম। রাত কাটানোর জন্যে মুচিপাড়ার এক বস্তিঘর ভাড়া নিলাম। বিনয় লজ থেকে বেরিয়ে কিছুটা সময় নিরাপদে কাটানোর জন্যে ঢুকতাম খোদ সিংহের গহ্বরে–পাঁচতারা হোটেলে। কেউ অন্তত সেখানে আমাকে খুঁজবে না। ওপরতলার বড় সাহেবরাও তো নিচে নামে না। রেস্তোরাঁয় ঢোকে না।
সঙ্গে নিয়ে যেতাম শেফালিকাকে। তাতে সন্দেহটা কম থাকে। ওসব জায়গায় একলা গেলেই তো সন্দেহ বাড়ে। শেফালিকা আমার প্ল্যানে সাহায্য করেছে। বৈধব্য বেশ ঘুচিয়ে সেজেগুজে হাজির থাকতে কষ্ট অবশ্য হয়েছে। মাধুরী কিন্তু ভুল ভেবেছে।
বেশ বুঝেছিলাম, এভাবে বেশিদিন চলবে না। মাধুরী যদি টিকি ধরে ফেলতে পারে–ওরাও ধরবে।
খবরটা পেলাম ইন্দ্রনাথবাবুর কাছে। মাধুরী আমাকে ফলো করেছে জেনে প্রথমে খুব হাসলাম। তারপর বুঝলাম খেল খতম হতে আর দেরি নেই।
কী করব জানি না। ইনি বললেন এখানে আসতে, তাই এলাম, এরপর?
.
শেষের নাটক
কবিতা বললে, আপনি আমার এই ঠাকুরপোটাকে চেনেন না। ও যদি মনে করে…সত্যিই যদি মনে করে…তাহলে পৃথিবীর কোনও শক্তিকে আপনার মাথার চুল ছুঁতে দেবে না। বলে, চাইল ইন্দ্রনাথের দিকে।
ইন্দ্রনাথ সশব্দে এক-টিপ নস্যি নিয়ে বললে, তাই হবে।
তাই হয়েছে। ইন্দ্র ওর মন্ত্রগুপ্তি খাঁটিয়েছে। কুমুদরঞ্জনের কেশাগ্র কেউ স্পর্শ করতে পারেনি পারবেও না।
মাধুরীর গলায় মালা দেওয়ার সময়ে নারদকে ডাকতে হয়নি। খুব খেয়েছিলাম সেদিন। কঞ্জুষ দুর্নাম ঘুচিয়েছিল কুমুদ–একদিনের জন্যে।
সবচেয়ে বড় কথা, আজও সত্যিকারের দেশপ্রেম দেখিয়ে যাচ্ছে কুমুদরঞ্জন–অন্য এক ব্রাঞ্চে বসে।
* প্রসাদ পত্রিকায় প্রকাশিত। (শারদীয় সংখ্যা, ১৯৯২)