1 of 2

লাল চুনি পেকে হলুদ

লাল চুনি পেকে হলুদ

লেডি ফেবার বললেন, সোজা ব্যাপারটা শুনুন। চোরদের আপ্যায়ন চলছে এখানে। খানাপিনা করাচ্ছি তস্করদের। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! ভাবতও গা শিরশির করছে আমার। তাকাতে পারছি না অতিথিদের মুখের দিকে। কী লজ্জা! খাতির করে যাদের ডেকে এনেছি, চোর রয়েছে কি না তাদের মধ্যে!

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছে ভদ্রমহিলার পোর্টম্যান স্কোয়ারের বাড়িতে গাছপালা রাখবার ঘরে। ঝকমকে নাচঘরটা দেখা যাচ্ছে সামনেই। কত রঙের বাহার সেখানে। ঝলমল করছে অসংখ্য জহরতের জৌলুসে। একপাশে আমাকে নিয়ে গিয়ে লেডি ফেবার আমাকে দেখাচ্ছেন বিখ্যাত চুনির মালা। মালা থেকে উধাও হয়েছে একটা পেনড্যান্ট। খুবই সূক্ষ্ম কারুকাজ করা পেনড্যান্ট। উধাও হওয়া মানে কোথাও খসে পড়েনি–চুরি হয়েছে। দুর্ঘটনা নয়–লোপাট হওয়া।

বেশ কিছুদিন ধরেই এমনি বিস্ময়কর জহরত চুরি চলছে লন্ডনে। লন্ডন শহর হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে এক-একটা ঘটনার পর। ১৮৯৩ সালের মরশুমে যেন মণিমাণিক্য চুরির হিড়িক পড়ে গেছে শহর জুড়ে।

লেডি ফেবারের বাড়িতে এসেছি মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে। এর মধ্যেই বেশ কয়েকজনের ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে হল। জহরত চুরি গেলে এত নাকি কান্নাও কাঁদতে পারে মেয়েগুলো! হ্যাঃ হ্যাঃ!

ডানহোমের কাউন্টেসের একটা হিরের ব্রোচ চুরি গেছে। পোশাক আটকে রাখার দামি পিন। দেখতে আধখানা চাঁদের মতো।

মিসেস কেনিংহাম-হার্ডি হারিয়েছেন মুক্তো আর নীলকান্ত মণির কণ্ঠহার।

পান্নার লকেট খুইয়েছেন লেডি হ্যাঁলিংহাম। নেকলেস থেকে লকেটটা হয়তো চাকরানিও সরিয়ে থাকতে পারে, এমন একটা বাঁকা সন্দেহও প্রকাশ করতে ছাড়েননি ভদ্রমহিলা।

তারপরেই শুনলাম লেডি ফেবারের পেনড্যান্ট চুরির কাহিনি। বেশ বুঝলাম, আজকের এই নাচের আসর জমবে ভালোই নাচের জন্যে নয়–জহরত হাওয়া হয়ে যাওয়ার বহু ঘটনার জন্যে।

সাত পাঁচ ভাবছি আর লেডি ফেবারের পেনড্যান্টহীন রত্নমালা উলটেপালটে দেখছি। জিনিসটা নিসন্দেহে মূল্যবান। পেনড্যান্টটা মুচড়ে বার করে নেওয়া হয়েছে অপূর্ব এই রত্নমালা থেকে। যেই নিক, তার যে সৌন্দর্যপিপাসা আছে বিলক্ষণ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ভালো জিনিসই নিয়েছে। তবে লেডি ফেবার এমন কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন যে মুখ ফুটে চোরের রুচির প্রশংসা করতে পারছি না।

তাই চোখে-চোখে না তাকিয়ে রত্নহারের দিকে চোখ রেখে বললাম, কাটা জায়গাটা দেখেছেন? কঁচি দিয়ে সোনার চেন কাটা হয়েছে। তারপর ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। যিনি নিয়েছেন, তার নাম যখন জানা নেই, তখন তাকে পকেটমার বলতে দ্বিধা নেই। কেননা, কাটার জায়গা দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে, কঁচিটা পকেটমারদের কঁচি।

মুখ-টুখ লাল হয়ে গেল লেডি ফেবারের, বলেন কী! তাহলে একজন পকেটমারকেও খাতির করে খানাপিনা করাচ্ছি!

পকেটমার না হলেও পকেটে হয়তো পকেটমারদের কঁচি রেখে দিয়েছেন–ভয়ে ভয়ে বললাম আমি।

কী ভীষণ! কী ভীষণ! আর্ত চিৎকার করে উঠলেন লেডি ফেবার। আমার যা গেল তা তো গেলই। কিন্তু অভ্যাগতদের অবস্থাটা এখন কী হবে বলুন তো। কে যে কখন কপাল চাপড়াবে… জানেন তো এ হপ্তায় এই নিয়ে তিন-তিনটে নাচের আসরে জহরত চুরি হয়ে গেল। এর শেষ কোথায়?

পুলিশ ডাকুন, শেষ দেখতে পাবেন। দ্বিধা ঝেড়ে ফেলুন। অভ্যাগতদের সার্চ করতে দেবেন, তাদের অপমান করবেন না–এই মনোভাব নিয়ে থাকলে তস্কর মহাশয় মনের সুখে চুরি চালিয়ে যাবেন। বুঝতেই তো পারছেন পাইকারি হারে চুরি চলছে–ডাকাতিও বলতে পারেন–সমাজে মিশে গিয়ে সামাজিকতা রক্ষে করার ফাঁকে-ফাঁকে চুরিতে হাত পাকিয়ে চলেছেন একজন। ধরতে তাকে হবেই। ডাকুন পুলিশ।

জুল-জুল করে তাকালেন লেডি ফেবার, খুব হালকাভাবে কথাটা বললেন বটে, কিন্তু…পেনড্যান্টের প্রত্যেকটা চুনির দাম কত জানেন? আমার স্বামীর হিসেবে আটশ পাউন্ড–প্রত্যেকটার।

তা তো হবেই। দেখতেও অপূর্ব। অবিকল বর্ণনা শোনাতে পারবেন? প্রত্যেকটা চুনিকে দেখতে কীরকম?

শুনে কী করবেন? খুঁজে পেতে কি সুবিধে হবে?

এমনও তো হতে পারে, চোরাই চুনি বিক্রির জন্যে আমার কাছেই এল? তখন যদি বর্ণনা মতো মিলিয়ে নিতে পারি, আপনার হারানিধি আপনাকেই ফিরিয়ে দিয়ে যাব। লেডি ফেবার, এ সংসারে অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।

ঝঙ্কার দিলেন লেডি ফেবার, আমি চাই চোরকে আপনি ধরুন।

আমিও তাই চাই। কেন না, এইভাবে যদি চুরি চলতে থাকে, লন্ডনের কোনও ভদ্রমহিলা আর আসল রত্ন গায়ে চাপাবেন না। ফলে, লোকসান তো আমারই।

দেখুন মশাই, আমার অতিথি অভ্যাগতদের চুলটি ছুঁতে দেব না আপনাকে। যা করবেন, বাইরে করুন। নাচঘরে বা বাড়ির মধ্যে ঝামেলা করতে যাবেন না।

ঠিক, ঠিক। মাথা ঠান্ডা করেই কাজ করা উচিত এখন। কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একজন নয়, একটা গোটা দল রয়েছে এই চুরির পেছনে। কাজেই আপনার বাড়ির মধ্যে কোনও হামলাই আমি করব না। থাক সেকথা। এখন বলুন, আপনার হারানো চুনিদের দেখতে কীরকম।

গোটা পেনড্যান্টটাই গোলাপ ফুলের মতো দেখতে। কণ্ঠমালাটা লর্ড ফেবার এনেছিলেন। বর্মা থেকে। আংটির আকারে সাজানো সারি-সারি লাল চুনি ছাড়াও পেনড্যান্টের মধ্যে আছে চারটে হলদে চুনি, লোকে বলে, লাল চুনি নাকি পেকে হলুদ হয়ে আসছিল। কুসংস্কার ছাড়া অবিশ্যি কিছুই নয়। তবে কি জানেন, হলদে চুনিগুলোকে দেখলে মনে হয় যেন আগুনে ঠাসা, হিরের মতো ঝলমলে। চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়।

মণিরত্ন আমিও চিনি, লেডি ফেবার। বার্মিজরা নানা রঙের চুনি বেচে, সে খবরও রাখি। তবে কি জানেন, নীল চুনি বলে যেটাকে চালায়, সেটা আসলে নীলকান্তমণি। যাক সে কথা, কতক্ষণ আগে হারিয়েছেন আপনার পেনড্যান্ট?

দশ মিনিট আগে।

তাহলে এইমাত্র যার সঙ্গে নেচে এলেন, চোর হয়তো সে-ই!

অ্যাঁ!

–আজ্ঞে হ্যাঁ। নাচের আসর আজকাল বড়লোক হওয়ার সবচেয়ে সোজা পথ।

দেখুন মশায়, তেড়ে উঠলেন লেডি ফেবার। এইমাত্র যার সঙ্গে নেচে এলাম, তিনি আমার স্বামী। দয়া করে এসব কথা তাকে বলতে যাবেন না। চুনি হারানোর শোকে পাগল তো হবেনই, আমাকেও আর দু-চক্ষে দেখতে পারবেন না।

বলেই সাঁই সাঁই করে চলে গেলেন লেডি ফেবার। কী আর করি, গুটিগুটি গিয়ে দাঁড়ালাম সিঁড়ির গোড়ায়। আমি তো এখানে এসেছি সাম্প্রতিক জহরত চুরি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে– কানাঘুসোয় যদি কিছু শুনতে পাওয়া যায়–এই আশায়। চুরিগুলো মামুলি চুরি নয় রীতিমতো বিস্ময় জাগানো। সুতরাং টনক নড়েছে আমার।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম নাচঘরের দৃশ্য। লন্ডন শহরে এরকম নাচঘর আরও অনেক আছে। চেহারায় আর চরিত্রে প্রায় একইরকম–একটু যা উনিশ বিশ। ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ি নেচেকুঁদে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন ঢঙে। সবাই চায় শরীরের তৎপরতা দেখাতে। রহস্যময় এই কক্ষে কোনও ব্যক্তি হাতসাফাইয়ের ফন্দি এঁটে চলেছেন, তা বোঝা মুশকিল। অথচ এ চুরি থামানো দরকার। নইলে লন্ডনের জহরত বিক্রির ব্যাবসা দারুণ চোট খাবে। আমার কারবারেও মন্দা দেখা দেবে।

জীবনে অনেক চাঞ্চল্যকর অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। খাতায় সব লেখা আছে। তা থেকে দু একটা ইন্টারেস্টিং কেস পাঠকপাঠিকাদের সামনে হাজির করেছি। যারা পড়েছেন, তারা জানেন, নিজেকে কোনওদিন ডিটেকটিভ বলে জাহির করতে যাইনি। ডিটেকটিভদের যে যোগ্যতা আছে, আমার তার কিছুই নেই। তাদের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হল দূরদৃষ্টি, আমার তা মোটেই নেই। অনেক কেসে নাক গলিয়েছি ঠিকই, মাথাও ঘামিয়েছি কিন্তু তা গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে নয় কারুর না কারুর উপকার করার জন্যে–যাতে তার উপকার আমি পরে পেতে পারি। আর অস্ত্রশস্ত্রের কথা যদি বলেন তো ও সবের ধারকাছ দিয়েও আমি যাইনি কোনওদিন। হাতিয়ার আমার একটাই– কমনসেন্স। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দৈব আমার সহায় হয়েছে; দৈবাৎ মোক্ষম সূত্র হাতে এসে গেছে। স্রেফ কপাল জোরে সোজা পথের সন্ধান পেয়েছি রহস্যের গোলকধাঁধায় ঘুরে মরতে হয়নি।

এইরকম একটা আশা নিয়েই এসেছিলাম লেডি ফেবারের প্রাসাদে। অচেনা কোনও মুখের দর্শন পেলেও পেতে পারি, মুখ ফসকে কেউ কোনও কথা বলে ফেলতে পারে, অথবা নিছক ঝেকের মাথায় এমন পথে পা দিতে পারি যা গত কয়েক হপ্তাব্যাপী অন্ধকারময় প্রহেলিকার মধ্যে আলোর সন্ধান দিতে পারে।

তা সত্ত্বেও নাচঘরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাই সার হল। সমস্ত প্রচেষ্টাটাই মনে হল বৃথা গেল। আশেপাশে সন্দেহভাজন কোনও মুখ দেখলাম না, সন্দেহজনক কোনও কথা কানে ভেসে এল না। মেজাজ গেল খিঁচড়ে। নাচঘর ছেড়ে এসে দাঁড়ালাম গাছপালা রাখার ঘরে। সবুজ পাতাগুলোর দুলুনি দেখে অনেক শান্ত হল মনটা।

এ ঘরে এখন লোকজন বেশি নেই। টেবিল ভরতি খাবার নিয়ে গব-গব করে গিলে চলেছেন জেনারেল শারার্ড। এই এক লোক! খেতেই আসেন এবং খেয়ে যান। যতক্ষণ না ডিনার টেবিলে খাবার সাজানো হচ্ছে, ততক্ষণ রিফ্রেশমেন্ট টেবিলে বসেই খেয়ে যাবেন। সব ভোজসভায় তাঁকে দেখি ঠিক এইভাবেই খেয়ে যেতে। সেন্ট পিটার্স গির্জের সহকারী যাজক রেভারেন্ড আর্থার মেলব্যাঙ্ককে দেখলাম চুকচুক করে চায়ে চুমুক দিতে। রোগা প্যাকাটি এক তরুণ স্কুলের বাচ্চাছেলের মতো সুগন্ধী বরফ খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। আর দেখলাম সিবাইল ক্যাভানাগ নামের সেই মহিলাকে, যাকে দেখা যায় লন্ডনের সব নাচের আসরে। ভদ্রমহিলা খুব মিশুকে–আসর জমাতে পারেন। সমাজের মাথাদের সঙ্গে যোগাযোগও নিশ্চয় আছে, নইলে সবকটা নাচের আসরে এসে জোটেন কী করে। দেখতে শুনতেও মন্দ নয়। আমি কিন্তু ভদ্রমহিলার বকবকানি সইতে পারি না বলে দেখা হলেই এড়িয়ে চলি।

সেদিন কিন্তু এড়াতে পারলাম না। হঠাৎ মুখোমুখি হতেই সোল্লাসে এমন চিৎকার করে উঠলেন যে পালাবার পথ খুঁজে পেলাম না।

চা আনান, চা আনান, এক কাপ চা আনান আমার জন্যে। কর্নেল হার্নারকে চেনেন তো? তেষ্টার দেশ থেকে এসে দশ মিনিট কথা বলে গেলেন আমার সঙ্গে–সেই থেকে তেষ্টায় মরে যাচ্ছি।

মরে যাইরে। কী আহ্লাদ! ওঁর চা-তেষ্টা পাবে বকর-বকর করে, আর আমাকে চা বয়ে এনে দিতে হবে তার জন্যে!

কী আর করা যায়! ভদ্রতার খাতিরে এনে দিলাম এক কাপ চা। সেইসঙ্গে অমায়িক হেসে একটু জ্ঞানদান করতেও ছাড়লাম না–নার্ভের বারোটা বাজিয়ে বসবেন দেখছি। শেষকালে খানাপিনাই বাদ যায়।

নার্ভ কি আর আছে আমার–চায়ের স্বাদ নিতে নিতে বললেন সিবাইল ক্যাভানাগ–দুধে দাঁত যেদিন বিসর্জন দিয়েছিলাম, আমার তো মনে হয় সেইদিন থেকেই নার্ভ জিনিসটাও ছেড়ে গেছে আমাকে। যাক সে কথা–খবর শুনেছেন তো? ভয়ানক ব্যাপার, তাই না?

চোখমুখ ভয়ানক করুণ করে কথাগুলো বললেন সিবাইল ক্যাভানাগ। প্রথমটা বুঝতে পারিনি কী বলতে চাইছেন, তারপরেই খেয়াল হল, নিশ্চয় লেডি ফেবারের চুনি খোয়ানোর ব্যাপারটা শুনে ফেলেছেন।

তালে তাল ঠুকে তাই বলতেই হল, তা যা বলেছেন। ভয়ানক রহস্যই বটে।

রহস্যের জট ছাড়াতে পেরেছেন কি? সন্দেহ হয় কাউকে? আহা, সময় কাটানোর জন্যে না হয় একজনকে সন্দেহই করা গেল!

কথার ধরন দেখে গা-পিত্তি জ্বলে গেল। তা সত্ত্বেও মুখে হাসি টেনে এনে বললাম, আপনার কাউকে সন্দেহ হচ্ছে নাকি? বলেই ফেলুন না–কিছুটা সময় তো কাটবে।

ফিক ফিক করে হেসে বললেন, সিবাইল ক্যাভানাগ–সেরকম কাউকে তো দেখছি না এঘরে। যাজক মশায়ের পকেট সার্চ করা কি ঠিক হবে? পাবেন তো ধর্মোপদেশ–চুনির বদলে!

আজকের কেসটাকেও ধর্মোপদেশ বলতে পারেন। দামি পাথরের ধর্মোপদেশ। আচ্ছা, আপনি আস্তিনের মধ্যে চুনিগুলো লুকিয়ে রাখেননি তো?

কী যে বলেন! আস্তিনের মধ্যে লুকোতে যাব কেন?

সবার চোখে ধুলো দিয়ে পালাবেন বলে।

আচ্ছা মানুষ তো আপনি! ঘর ছেড়ে নড়লামই না–পালালাম কোথায়? তাছাড়া আপনি জানেন না, এই সেদিন হেইস-এর নাচের আসরে দামি পাথরের একটা ব্রোচ হারিয়েছি। হারিয়েছি মানে চুরি গেছে। কিন্তু আমার স্বামী তা বিশ্বাস করে না। রোজই গজগজ করে চলেছেন ভিড়ের মধ্যে কোথায় ফেলে দিয়েছি–দোষ চাপাচ্ছি চোরের ঘাড়ে।

আপনার নিজের কী মনে হয়?

চুরি, চুরি, নির্ঘাত চুরি। অত কাঁচা কাজ আমি করি না। ব্রোচ পাছে খুলে পড়ে যায় তাই কষে পিন দিয়ে এঁটে রাখি। কিন্তু যে লোকটি নিয়েছে, তার হাতের জাদুর তারিফ করতে হয়। ঠিক যেভাবে লেডি ফেবারের পেনড্যান্ট খুলে নিয়েছে সোনার চেন থেকে চক্ষের নিমেষে, অবিকল সেইভাবে আমার ব্রোচও খুলে নিয়েছে পিন আলগা করে দিয়ে। ভাবতেও গা শিরশির করছে। একটা চোরকে নিয়ে প্রত্যেক পার্টিতে ঘোরাফেরা করা…ছিঃ ছিঃ ছিঃ!

শুরু হয়ে গেল বকবকানি। গয়না চুরি গেলে মেয়েরা এত বকতেও পারে। বাধা দিয়ে কোনও লাভ হবে না জেনে হাসি-হাসি মুখে শুনে গেলাম ভদ্রমহিলার বাক্যস্রোত।

হাই হাউ করে বেশ কিছুক্ষণ আলতু ফালতু বকবার পর আচমকা ভদ্রমহিলা বললেন, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কাউকে সন্দেহ করিনি আমরা করাটা কিন্তু খুবই দরকার। তাই নয় কি? যাজকমশায়কে যদি ধর্তব্যের মধ্যে না আনা যায়, তাহলে ওই হ্যাংলাপানা ছোকরাটাকে সন্দেহ করলে ক্ষতি কী বলুন?

মুখটা দেখেছেন? খাই-খাই ভাব রয়েছে না?

এন্তার খেয়ে যাচ্ছে বলেই ছোকরাকে ক্রিমিন্যাল শ্রেণির মধ্যে ফেলা যায় না। দেখতেই তো পাচ্ছেন, খাবারের লোভই ওর বেশি–অন্য কোনও লোভ আছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া, হিরে-মণি-মুক্তোর দিকে যার নজর থাকবে, সে এখানে দাঁড়িয়ে সুগন্ধী বরফ গিলবে কেন? নাচঘরে ঘুরঘুর করলেই পারত? মণিমুক্তো যেখানে রয়েছে?

তা যা বলেছেন। নাচঘরের সবাইকে অবশ্য এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। ওই যে দেখছেন তালঢ্যাঙা লোকটা মাঝে-মাঝে সারস পাখির মতো ঘাড় লম্বা করে এদিক-ওদিক তাকিয়েই বুটের দিকে তাকাচ্ছে…বুট দেখছে, না, অন্য কিছু দেখছে?

হয়তো অন্য কিছুই দেখছে। তবে মানুষের মাথা দেখে তো আর সিদ্ধান্ত খাড়া করা যায় না।

হেসেই গড়িয়ে পড়লেন সিবাইল ক্যাভানাগ–সত্যি! কত কম জানেন আপনি! আরে মশাই, মাথাই তো মানুষের চরিত্র! ধরুন একজন বুড়ো লোকের ব্রহ্মতালু। খুঁটিয়ে যদি দেখেন তো এত খবর পাবেন তাজ্জব হয়ে যাবেন। বেশ তো ওই যে চকচকে ছাদের মতো টেকোমাথা লোকটাকে দেখছেন–টাক দেখেই কি বুঝছেন না টাকার কুমির হলেও অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি? আমি অবশ্য আমার শত্রুর মাথাতেও অমন টাক পছন্দ করব না।

বলতে বলতে আবার খিলখিল করে হাসতে হাসতে কিলবিল করে কেঁপে উঠলেন ভদ্রমহিলা। মেজাজটাকে কোনওমতে সামলে রেখে শুধোলাম,আপনারও শত্রু আছে নাকি?

আছে কি নেই সবাইকে জিগ্যেস করেই দেখুন না।

চলুন–মুখ দিয়ে কথাটা বার করতে না করতেই নাচঘর থেকে একটা বিরাট দল হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল এই ঘরে। সিবাইল ক্যাভানাগ আর আমি দুজনেই কোণঠাসা হয়ে গেলাম সিঁড়ির রেলিংয়ের পাশে। কিছুক্ষণ পরেই হই-হই করতে করতে দলটা বেরিয়ে যেতেই সিঁড়ির দিক থেকে সরে আসতে গেলেন সিবাইল ক্যাভানাগ। গাউনের তলার দিকটা যে রেলিংয়ের লোহার পেরেকে আটকে গেছে, খেয়াল করেননি। টানের চোটে ছিঁড়ে গেল ভেতরকার সিল্কের পটি। পটির তলা বরাবর ফাঁকা জায়গাটায় দেখলাম সেলাই করা রয়েছে একটা অতীব সুন্দর হিরের ব্রোচ–দেখতে আধখানা চাঁদের মতো।

ভদ্রমহিলার তখনও খেয়াল নেই যে গাউন ছিঁড়েছে। আরও একটু টান দিতেই বেশ খানিকটা সিল্ক-পটি ছিঁড়ে নিয়ে ঝুলতেই ঠেকল পায়ে। চকিতে নিচের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রবেগে গাউন সামলে নিলেন সিবাইল ক্যাভানাগলুকিয়ে ফেললেন ছেঁড়া অংশসমেত হিরের ব্রোচ।

রক্তিম মুখে আড়চোখে তাকালেন আমার দিকে–ভাবখানা, আমি কি দেখে ফেলেছি লুকোনো ঐশ্বর্য?

আমি কিন্তু সেরকম কোনও ভাবই চোখেমুখে প্রকাশ করলাম না। ডিটেকটিভ হই আর না হই, একটু-আধটু অ্যাকটিং করতে হয় আমাদের সবাইকেই।

ভীষণ আক্ষেপের সুরে তখন বললেন ভদ্রমহিলা, কী কাণ্ড বলুন তো! ছিঁড়ে ফেললাম গাউনটা!

তাই নাকি? গাউন ছিঁড়েছে? সামনে, না পেছনে?

কী কষ্টে যে কণ্ঠস্বর সংযত রেখে কথা কটা বলেছিলাম, তা শুধু আমিই জানি। বিস্ময়ের বন্যায় তখন আমার বুক ধড়াশ-ধড়াশ করছে; বিরাট এই আবিষ্কারের ফলে যে এ বছরের সেরা গল্প হাতের মুঠোয় এসে গেল, তা সমস্ত সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করছি; তা সত্ত্বেও চোখমুখ নির্বিকার রেখে ছেঁড়া গাউন দেখার অভিনয় চালিয়ে যেতে হল। একটু ভুল হলেই গল্প মাঠে মারা যাবে জেনে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হল।

তারপর হেসে-হেসে বলতে হল, ছেঁড়া গাউন কাউকে না দেখিয়ে বরং ওপরে চলে যান। কেউ না কেউ আছে, ছেঁড়া জায়গা সেলাই করে দেবে। তারপর নীচে নামবেন।

আকাশের চাঁদ যেন হাতে পেলেন ভদ্রমহিলা। তড়বড় করে উঠে গেলেন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায়–অদৃশ্য হয়ে গেলেন একটা শোওয়ার ঘরে।

চোখের আড়াল হতেই ফিরে এলাম গাছপালার ঘরে। তারিয়ে-তারিয়ে এককাপ কড়া চা খেলাম। চিন্তাশক্তি উদ্দীপ্ত করতে চায়ের জুড়ি হয় না–এ অভিজ্ঞতা আমার অনেক দিনের। তারপর ঝাড়া দশ মিনিট ধরে পুরো ব্যাপারটাকে মনের মধ্যে তোলাপাড়া করলাম। কে এই মিসেস সিবাইল ক্যাভানাগ? গাউনের ভেতরকার প্যানেলে হিরের ব্রোচ সেলাই করে রেখে দিয়েছেন কেন? এমনভাবে লুকিয়ে রেখেছেন যেন টেমস নদীর জলে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে হাজার চেষ্টা করলেও আশপাশের কারুর চোখে পড়বে না।

প্রশ্নগুলোর উত্তর যে-কোনও শিশুই দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই শিশুর চোখ এড়িয়ে যেতে পারে–এতবড় একটা সিদ্ধান্তের মূলে পৌঁছতে হলে প্রত্যেকটা ঘটনার অবদান নেহাত কম নয়।

যেমন ধরা যাক, এইমাত্র যে অপরূপ ব্রোচটা দেখে নয়ন সার্থক করলাম, লেডি ডানহোমের চুরি যাওয়া ব্রোচের সঙ্গে তা দিব্বি মিলে যায়। অথচ ঠিক এই ধরনের ব্রোচ শখানেক মহিলা গয়না হিসেবে ব্যবহার করেন।

কিন্তু আমি যদি এখন লেডি ফেবারের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলি–শুনুন, শুনুন, চোরকে পাওয়া গেছে–নাম তার মিসেস সিবাইল ক্যাভানাগ, তাহলেই মারাত্মক ভুল করে বসব কেলেঙ্কারিই সার হবে।

অথচ আমি জানি, একশ পাউন্ড পকেট থেকে বার করে দিয়ে যদি ভদ্রমহিলার গাউনের প্যানেল তল্লাশি করার অনুমতিলাভ করি, তাহলে চুনির পেনড্যান্ট ওই প্যানেলের মধ্যেই পাব, পুরস্কার হিসেবে তখুনি ফিরে পাব একশ পাউন্ড, সেইসঙ্গে বাড়তি কিছু।

পেনড্যান্ট পাওয়া নিছক একটা সূত্র। ওই ক্ল ধরে এগোলেই পরের পর জহরত চুরি রহস্যের সমাধান ঘটবেই, বছরের সবচেয়ে জটিল প্রহেলিকায় অবসান ঘটবে।

কিন্তু ভদ্রমহিলা এখন ওপরতলায়। সেখানে লুকিয়ে রাখার জায়গার অভাব নেই। যা লুকোতে চান, এতক্ষণে তা লুকনোও হয়ে গেছে। কাজেই আচমকা গাউনের পটি তল্লাশি করা আহাম্মকি হবে–চোরকে বামাল ধরা যাবে না।

আর এক কাপ চা পান করতেই মাথাটা আরও একটু পরিষ্কার হয়ে গেল। স্পষ্ট বুঝলাম, ভদ্রমহিলা আদৌ চোর নন, কিন্তু চুরির মাল কাছে রাখেন। লেডি ফেবারের রত্নমালার কঁচি চালিয়ে পেনড্যান্ট সরানো হয়েছে; সিবাইল ক্যাভানাগের পক্ষে ওভাবে কাঁচি চালানো সম্ভব নয়। দক্ষ কোনও পুরুষ এই কর্মটি করেছে। কিন্তু কে সেই ব্যক্তি? একজন, না বহুজন? কপাল জোরে একটা জুটির আভাস পাচ্ছি; এমনও তো হতে পারে, আরও অনেকের হাত রয়েছে রত্নচুরির পেছনে? তাদের খোঁজখবর নেওয়াটা আগে দরকার। তা না করে যদি ওই ভদ্রমহিলাকে শাস্তি দেওয়া যায়, ব্যাপকভাবে যে ষড়যন্ত্র চলছে, তা বন্ধ হবে না। ভদ্রমহিলার গাউনের পটি থেকে হিরের ব্রোচ পাওয়া গেলেও বিরাট কিছু একটা প্রমাণ করতে পারব না। কেন না, প্রায় ওই ধরনের হিরের ব্রোচ কেনশিংটন থেকে টেম্পল বার পর্যন্ত সমস্ত জড়োয়া গয়নার দোকানেই পাওয়া যায়। সুতরাং ভদ্রমহিলাকে ফট করে চোর বলে বসলে লোকে আমাকেই পাগল ঠাওরাবে।

আর একটা কাজ করতে পারি। ছ্যাকড়াগাড়ি ডেকে এখুনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে চলে যেতে পারি। এইমাত্র যা দেখলাম, তা বলতে পারিও। অদ্ভুত এই কেসের কাহিনি যদি লিখতেই হয়, তা আমিই লিখব এবং আর একটুও সময় নষ্ট করা উচিত নয়।

পুরো ব্যাপারটাকে মাথার মধ্যে সাজিয়ে নেওয়ার ফলে অনেকটা ধাতস্থ হয়েই ফের ঢুকলাম নাচঘরে। একটু পরে দেখলাম মিসেস সিবাইল ক্যাভানাগও এসে গেছেন। চোখমুখ নির্বিকার। আগের মতোই হাসছেন খিলখিলিয়ে। আমাকে দেখেও হাসির ফোয়ারা ছোটালেন। বেশ বুঝলাম, ওঁর বিশ্বাস, গাউনের পটিতে লুকনো হিরের ব্রোচ আমি দেখতে পাইনি।

কিছুক্ষণ পরেই অভ্যাগতরা ঢুকলেন ডাইনিং রুমে। আমি দেখে নিলাম মিসেস সিবাইল ক্যাভানাগ কী কী গয়না পরে আছেন।

তারপর সবার অলক্ষিতে বেরিয়ে এলাম সামনের দরজা দিয়ে বাড়ির বাইরে। ডাকলাম একটা ঘোড়ার গাড়ি। সোজা চলে এলাম বন্ড স্ট্রিটে আমার আস্তানায়।

ঘণ্টা বাজাতে দরজা খুলে দিল দ্বাররক্ষক। চেয়ে রইল অবাক চোখে। সোজা গেলাম আমার জুয়েল কেসগুলোর সামনে। বিশেষ একটা কেসে থাকে যত রাজ্যের সস্তা জড়োয়া গয়না। তুলে নিলাম একটা হিরের ব্রোচ। গেঁথে রাখলাম আমার কোটের ভেতর দিকে। তারপর দ্বাররক্ষককে ওপরে পাঠিয়ে ঘুম ভাঙালাম চাকর অ্যাবেল-এর। পাঁচ মিনিটেই পাশে এসে দাঁড়াল অ্যাবেল– পরনে শুধু ট্রাউজার্স আর শার্ট।

বললাম সুসংবাদ, অ্যাবেল। যে দলটার খোঁজ করছিলাম, তাদের সন্ধান পেয়েছি।

সোল্লাসে বললে অ্যাবেল, গুড গুড স্যার!

লেডি ফেবারের নাচের আসরে আজ রাতে সিবাইল ক্যাভানাগ নামে এক ভদ্রমহিলা হাজির আছেন। লেডি ফেবারের পেনড্যান্ট তার কাছে আছে, আছে আর একটা হিরের ব্রোচ। ব্রোচটা আমি দেখেছি। পেনড্যান্টটাও যদি ভদ্রমহিলার কাছে পাওয়া যায়, তাহলে কেস কমপ্লিট হয়ে গেল।

উল্লাসে বিকট মুখভঙ্গি করে অ্যাবেল বললে, হুই! জানতাম মেয়েরা আছে এর মধ্যে। পাকা চোর এই সিবাইল ক্যাভানাগ, তাই না?

পাকা কি কঁচা, কদ্দিন ধরে এ লাইনে নেমেছেন, সব জানতে পারব শিগগিরই। এখুনি আবার যাচ্ছি পোর্টম্যান স্কোয়ারে। ছ্যাকড়াগাড়ি নিয়ে এসো পেছন-পেছন। বাড়ির সামনে গিয়ে বসে থাকবে আমার ব্রুম গাড়ির মধ্যে। আমি না আসা পর্যন্ত নড়বে না। তার আগে একটা কাজ সেরে নেবে। মার্লবরো স্ট্রিট পুলিশ স্টেশনে যাবে। জিগ্যেস করবে, কালকে এই সময় থেকে ভোর ছটার মধ্যে জনা দশ-বারো লোককে দিতে পারবে কিনা বেজওয়াটারে একটা বাড়িতে হানা দেওয়ার জন্যে।

ভদ্রমহিলার পেছন নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করবেন নাকি?

ঠিক তাই করব। লেডি ফেবারের বাড়ি থেকে ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলে ওঁর বাড়িতেই আমি অতিথি হব মিনিট দশেকের জন্যে। মার্লবরো স্ট্রিট অথবা হ্যাঁরো রোড পুলিশ স্টেশন থেকে লোক তুমি পাবেই। ওরাও তো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে গয়না চুরির নালিশ শুনতে-শুনতে। মাথা হেঁট হয়েছে। পাবলিকের কাছে।

খাঁটি কথাই বলেছেন। কালকেই কিং বলছিল, ঝটপট এ ঝামেলার সুরাহা না হলে আত্মহত্যা করবে। পুরো ঠিকানাটা কিন্তু দেননি, স্যার।

পাইনি বলে দিইনি। শুধু জানি ভদ্রমহিলা থাকেন সেন্ট স্টিফেন গির্জের কাছাকাছি কোথাও– কোনও এক যাজকের ওপরতলায় বা নীচের তলায়। ওঁর কোচোয়ানের পেট থেকে ঠিকানা যদি বার করতে পারো, খুব ভালো। কিন্তু আর দেরি নয়। জামাকাপড় পরে পোর্টম্যান স্কোয়ারে হাজির হও যত তাড়াতাড়ি পারো।

রাত তখন প্রায় একটা। অৰ্চাৰ্ড স্ট্রিটের গির্জের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ঢং করে ঘণ্টা বাজল গিঞ্জের ঘড়িতে। স্কোয়ারে পৌঁছে দেখি আমার কোচোয়ান দাঁড়িয়ে আছে ব্রহাম গাড়ি নিয়ে বেকার স্ট্রিটের মোড়ে। বাড়িতে ঢোকবার আগে বলে গেলাম অ্যাবেলের জন্যে অপেক্ষা করতে। ভুল করেও যেন লেডি ফেবারের বাড়ির সামনে গাড়ি নিয়ে না যায়।

গুটিগুটি এগোলাম নাচঘরের দিকে। দেখতে পেলাম মিসেস ক্যাভানাগকে। বর্শা ছোঁড়ার খেলায় মেতে রয়েছেন। বেশ বুঝলাম, আসরে যতক্ষণ একটি লোকও থাকবে, উনিও থাকবেন।

ঢুকলাম খাওয়ার ঘরে। বসলাম দরজার কাছে, যাতে পাশ দিয়ে যে-ই যাক না কেন, তার বদনখানা দেখতে পাই।

যৎসামান্য আহার করছি পেটের আগুন নেভানোর জন্যে দশ মিনিটও হয়নি–আচম্বিতে আমাকে অবাক করে দিয়ে হলঘরে এসে ঢুকলেন মিসেস ক্যাভানাগ। একা। শাল জড়ানো সারাগায়ে। হনহন করে বেরিয়ে গেলেন আমার ঠিক পাশ দিয়ে–অথচ খেয়াল করলেন না আমি বসে আছি খাবার নিয়ে।

বসেই রইলাম চুপচাপ। হলঘরের দরজা বন্ধ হল, নিমেষে উঠে দাঁড়ালাম।

বেশিরভাগ অভ্যাগতই ততক্ষণে বিদায় নিয়েছেন। খানকয়েক বাড়ির গাড়ি আর ছ্যাকড়া গাড়ি দাঁড়িয়ে পার্কের পাশে। লেডি ফেবারের মাইনে করা একজন লোক একে-ওকে গাড়ি এনে দিচ্ছে।

দ্রুত ভাবলাম, ভদ্রমহিলার ঠিকানা অ্যাবেল জোগাড় করতে পেরেছে কিনা জানি না। এই লোকটাকে ঠিকানা জিগ্যেস করা যাক।

এই যে ভদ্রমহিলা এখুনি চলে গেলেন, উনি কি বাড়ির গাড়িতে গেলেন, না, ভাড়াটে গাড়িতে?

মিসেস…মিসেস কেভেনারের কথা বলছেন?

কেভেনার? হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই হবে, সঠিক নামটা বলার সময় তখন নেই।

উনি ভাড়াটে গাড়ি নিলেন। ১৯২ নম্বর ওয়েস্টবোর্ন পার্কে যাবেন।

থ্যাংকিউ। ভদ্রমহিলার বাড়ি যেতে হবে এখুনি। একটা জড়োয়া গয়না ফেলে গেছেন হলঘরে। যাই, নিজে গিয়ে ফিরিয়ে দিই।

লোকটা হাঁ হয়ে গেল। জন্মে এমন কথা শোনেনি। লন্ডন শহরে নাচের আসরে জড়োয়া গয়না ফেলে গেলে বাড়ি ধাওয়া করে ফিরিয়ে দিয়ে আসার ঘটনা এই প্রথম বইকি।

দৌড়ে গিয়ে উঠলাম আমার গাড়িতে। সামনের সিটের নীচে গুঁড়ি মেরে বসেছিল অ্যাবেল। করুণ কণ্ঠে জানাল, ভদ্রমহিলার কোচোয়ানকে পায়নি, ঠিকানাও জোগাড় করতে পারেনি।

গাড়ি ততক্ষণে ছুটতে শুরু করে দিয়েছে। বললাম, অত মুষড়ে পড়তে হবে না। পুলিশ স্টেশনে কী শুনে এলে বলো।

ওরা তো থানার লোক ঝেটিয়ে এনে বাড়ির সব্বাইকে অ্যারেস্ট করার জন্যে তড়পনি শুরু করে দিয়েছিল। অতি কষ্টে আটকেছি। ঠিক হয়েছে, হ্যাঁরো রোড পুলিশ স্টেশনে এক ডজন লোক মোতায়েন থাকবে আপনার হুকুমের অপেক্ষায় সকাল পর্যন্ত। স্যার, আপনার ওপর ওদের অগাধ আস্থা।

আস্থাটা নিজেদের ওপর রাখলে আরও ভালো হত। যাক গে, অ্যাবেল, কপাল ভালোই আমাদের। ভদ্রমহিলার ঠিকানা, ১৯২ নম্বর ওয়েস্টবোর্ন পার্ক। জায়গাটা চৌকোনা বলেই তো মনে পড়ছে।

চৌকোনা ঠিকই, কিন্তু অনেকটা ডিমের মতো। ডারহ্যামের দিকে পড়বে একশো বিরানব্বই নম্বর বাড়িটা। গাছপালার আড়াল থেকে অনায়াসেই নজর রাখা যাবে।

দশ মিনিট পরেই পৌঁছে গেলাম ওয়েস্টবোর্ন পার্কে। অ্যাবেল ঠিকই বলেছে। নামেই স্কোয়ার, আসলে তেকোনা পার্ক। একশো বিরানব্বই নম্বর বাড়িটা বেশ বড়। বাইরের রং জ্বলে গেছে। দোতলা আর তিনতলার ঘরে আলো জ্বলছে। কিন্তু খড়খড়ি নামানো থাকার ফলে দেখতে পাচ্ছি না বসবার ঘরে ঘোরাঘুরি করছে কারা।

দুটো গাছ যেখানে জটলা পাকিয়েছে, অ্যাবেলকে নিয়ে ঘাঁটি গাড়লাম সেখানে। বীটের কনস্টেবল আমাকে চেনে। তাই অবাক হল ওই অবস্থায় বসে থাকতে দেখে।

খুশিও হল বিলক্ষণ। খুশি-খুশি মুখেই বললে–আগেই আঁচ করেছিলাম। সুবিধের নয় বাড়ির হালচাল। সারারাত ধরে ছোকরাদের আনাগোনা। ওই তো…ওই দেখুন…একজন এসে গেছে।

গাছের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। এ যে সেই ছোকরা, নাচের আসরে না গিয়ে গাছপালার ঘরে দাঁড়িয়ে যে সুগন্ধী বরফ গিলছিল–মিসেস ক্যাভানাগ রঙ্গচ্ছলে যাকে চোর ঠাউরেছিলেন। এমন ভান করেছিলেন, কস্মিনকালে দেখেননি ছোকরাকে।

বুঝলাম, সময় হয়েছে নিকট।

বললাম–অ্যাবেল, এবার যাও। থানার লোকদের বলবে সঙ্গে করে একটা ছোট মই যেন নিয়ে আসে। আমার সঙ্কেত না পাওয়া পর্যন্ত বাড়ির ধারেকাছেও যাবে না–তারপর মই লাগিয়ে উঠতে হবে বারান্দায়। টেবিলের ওপর কাঁচের ল্যাম্পটা দেখতে পাচ্ছ? ওই ল্যাম্প গুঁড়িয়ে গেলেই জানবে সঙ্কেত দিলাম। পিস্তল এনেছ?

ও ভুল কখনও আমার হয় না, স্যার। দুটো পিস্তলই এনেছি–দুটোই দরকার হতে পারে। অবস্থা দেখছেন তো!

হলেও হতে পারে তবে সেটা নির্ভর করছে তোমার ওপর। যাও, এখুনি যাও। লোকজন নিয়ে এস। সঙ্কেত না পেলে টু শব্দ করবে না। কু কমপ্লিট না হওয়া পর্যন্ত সঙ্কেত দেব না– খেয়াল থাকে যেন।

নিঃশব্দে উধাও হয়ে গেল অ্যাবেল গাড়ির দিকে। আমি কিন্তু সোজা গেলাম বাড়ির দিকে। জোরে কড়া নাড়লাম সদর দরজায়। সঙ্গে-সঙ্গে খুলে গেল পাল্লা। এত চট করে খুলবে, ভাবতে পারিনি। উর্দিপরা গাঁট্টাগোট্টা একটা লোক দাঁড়িয়ে সামনে। মোটেই অবাক হয়নি আমাকে দেখে। বরঞ্চ বললে অমায়িক স্বরে, ওপরে সবাই আপনিও যান।

তা তো যাবই। পথ দেখাও।

দ্বিধায় পড়ল লোকটা।

বলল, ভুল করেছি মনে হচ্ছে। একটু দাঁড়ান, মিসেস ক্যাভানাগকে জিগ্যেস করে আসি।

আমার জবাবের জন্যে না দাঁড়িয়েই লোকটা তিনতলা উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে; আমিও আঠার মতো লেগে রইলাম পেছনে। চাতালে উঠেই দেখতে পেলাম সামনের বসবার ঘরের ভেতর পর্যন্ত। মিসেস ক্যাভানাগ তো রয়েছেনই, রয়েছে একজন খর্বকায় বুড়োটে লোক–গালে লম্বা কালো জুলপি। সুগন্ধী বরফ প্রিয় সেই ছোকরাকেও দেখলাম। বসবার ঘরের লাগোয়া ঘরটায়, কিন্তু আলো জ্বলছে না–এ ঘরের আলোয় ফোল্ডিং দরজার ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে সে ঘর ফাঁকা।

এত কিছু দেখলাম চকিতের মধ্যে। গাঁটাগোট্টা লোকটা মিসেস ক্যাভানাগের কানে কানে ফিসফিস করতেই ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে সোজা হয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা, ছোকরাটাকে ঠেলে বার করে দিলেন বারান্দায়, ঝড়ের বেগে চলে এলেন চাতালে দাঁড়ালেন আমার মুখোমুখি।

তার আগে অবশ্য বসবার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিতে ভুললেন না।

আরে! মিস্টার সাটন যে! কী সৌভাগ্য! কিন্তু আমি যে এখুনি শুতে যাচ্ছি। কী নিপুণ অভিনয়ই জানে এই মেয়েরা। চোখেমুখে আনন্দ যেন উপচে পড়ল। সুপার ফাইন আকটিং!

যতদূর সম্ভব মোলায়েম হাসলাম। হেসে-হেসে বললাম, আমি তো ভেবেছিলাম, এতক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছেন। কিন্তু না এসে যে পারলাম না। লেডি ফেবারের নাচঘরে একটা হিরের ব্রোচ কুড়িয়ে পেয়েছি। আপনি চলে আসার পরেই। দারোয়ানও বললে, নিশ্চয় আপনারই হবে। তাই ছুটতে ছুটতে চলে এলাম কাল সকালেই আবার বাইরে যেতে হচ্ছে তো।

কথা বলতে-বলতে হিরের ব্রোচ বার করে দিলাম ভদ্রমহিলার হাতে। এই সেই অলঙ্কার যা আমি একটু আগেই নিয়ে এসেছি বন্ড স্ট্রিটের আমার রত্ন বাক্স থেকে। ব্রোচটা হাতে নিয়েই চকিতের জন্যে আমার পানে ঝকমকে চাহনি নিক্ষেপ করলেন মিসেস ক্যাভানাগ। ঈষৎ কঠিন হল দুটো ঠোঁট। পরমুহূর্তেই হেসে ফেলে ব্রোচ ফিরিয়ে দিলেন আমার হাতে।

কষ্ট করে এসেছেন–কৃতজ্ঞ রইলাম। কিন্তু এ জিনিস আমার নয়। আমার ব্রোচ এইমাত্র খুলে রাখলাম জড়োয়া বাক্সে।

হতাশ হওয়ার ভঙ্গিমায় বললাম, আপনার নয়? শুধু-শুধু কষ্ট দিলাম এত রাতে।

কষ্ট তো আমিই দিলাম আপনাকে। আসুন না, এককাপ কফি খেয়ে যান।

না, থাক। আর ঝামেলা বাড়াতে চাই না। গুডনাইট।

করমর্দন করে যেন নিশ্চিন্ত হলেন মিসেস ক্যাভানাগ। সিঁড়ির ধাপে পা দিলাম আমি, উনিও ঘুরে গিয়ে ঢুকলেন বসবার ঘরে নিশ্চয় বারান্দায় লুকিয়ে থাকা ছোকরাকে ডাকতে।

গাঁট্টাগোট্টা লোকটা হলঘরে দাঁড়িয়েছিল দরজা খুলে আমাকে বিদেয় করার জন্যে। আমি কিন্তু নিচে নামছিলাম শামুকের মতো আস্তে-আস্তে। বেজায় দমে গিয়েই। পা যেন আর চলছে না। পুরো প্ল্যানটাই ভণ্ডুল হয়ে গেল। সেই মুহূর্তে নতুন কোনও মতলব মাথায় আসছে না।

এ বাড়িতে এসেছিলাম আচমকা ভদ্রমহিলার সামনে গিয়ে তাকে চমকে দেব বলে, দলবলের হদিশ জেনে নেব, সুযোগ পেলে গ্রেপ্তারও করব। কিন্তু মূল যোগসূত্রটাই এখনও আঁধারে বিলীন অচিরে সন্ধান পাব বলেও মনে হয় না।

চিন্তা করতে হল তাই দশ সেকেন্ডের মধ্যে–এখুনি, না কালকে?

এক হয়, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই চুপচাপ। নিশ্চিন্ত মনে এরা আবার হানা দিক আর এক নাচের আসরে। তখন দলশুদ্ধ পাকড়াও করা যাবেখন।

নাকি, এখুনি যা করবার শেষ করে যাব?

শেষের পন্থাটা মনে ধরল আমার।

কেন না, কালকে এরা কে কোথায় থাকবে, তার কি ঠিক আছে? কেউ হয়তো সটকান দেবে প্যারিসে, কেউ বেলজিয়ামে। চুনি-পেনড্যান্টের মতো এরকম মোক্ষম সূত্র হাতে আর নাও আসতে পারে। যে দলটাকে দীর্ঘদিন গরু খোঁজার মতো খুঁজছি, তাদের জনা তিন-চারকে একই বাড়িতে একসঙ্গে পাওয়ার সুযোগ আর নাও পেতে পারি। শেষের এই কথাটা ভাবতেই গোটা প্ল্যানটা নিমেষমধ্যে ঝলসে উঠল মাথার মধ্যে। নিঃশব্দে, ঝড়ের বেগে, কাজ করে গেলাম প্ল্যানমাফিক। আজও অবাক হই, সেই মুহূর্তে চিন্তায় ভাবনায় কাজেকর্মে অত বিদ্যুৎগতি ক্ষিপ্রতা পেয়েছিলাম কীভাবে?

গাঁট্টাগোট্টা লোকটা তখন হলঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে–আমিও পৌঁছেছি চৌকাঠের সামনে। লোকটার পানে এক ঝলক সন্ধানী চাহনি বুলিয়ে নিয়েই বুঝলাম, প্ল্যান সফল হবেই একে দিয়ে কাজ শুরু করলে। লোকটা গায়ে গতরে ভারী হলেও বিনীতসততাও আছে বলে মনে হল। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আচমকা হাত থেকে দরজার হাতল ছিনিয়ে নিয়ে দড়াম করে বন্ধ করে দিলাম কপাট–দুজনেই রইলাম কিন্তু হলঘরের মধ্যেই।

পরক্ষণেই পিস্তল ঠেকালাম হেল্কার মাথায় (জানি না এই অপকর্মটির জন্যে জজসাহেব আমাকে মাসখানেক শ্রীঘর দর্শন করিয়ে ছাড়বেন কিনা), কানে কানে বললাম ফিসফিস করে, পুলিশ ঘিরে ফেলেছে বাড়ি। একদম চুপ। দোতলার ভদ্রমহিলা গ্রেপ্তার হবেন এখুনি। যা বলব, তা না করলে তোমাকে ওঁর সাগরেদ বলে চালান দেব জেলে। আমি বেরিয়ে গেছি কিনা জানতে চাইলে চেঁচিয়ে বলে দেবে, হ্যাঁ। ওপরে ডাকলে ওপরেই যাবে। ঠিক যা বললাম, তাই বলবে। তারপর ফিরে আসবে আমার কাছে। নইলে জেলখানা আছে কপালে।

শুনেই কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল বেচারা। কাঁপতে লাগল ঠকঠক করে।

বললে অবরুদ্ধ স্বরে–যা বললেন, তাই হবে হুজুর। এই নাক কান মলছি, আর এদের গোলামি করব না।

ঠিক আছে। ওদিকের ঘরটা বেশ অন্ধকার–ওখানেই লুকোচ্ছি। তুমি বরং ওপরেই যাও গিয়ে বলে এসো, আমি বিদেয় হয়েছি।

পাশের ঘরটা সকালে প্রাতরাশ খাওয়ার ঘর। ডাইনিং টেবিলের তলায় ঢুকে পড়ে দেখলাম, সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত দিব্বি দেখা যায়। হেক্কা লোকটা যেই প্রথম ধাপে পা দিয়েছে ওপরে যাবে বলে, মিসেস ক্যাভানায় নিজেই নেমে এলেন বিদেয় হয়েছেন ভদ্রলোক?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আর আমাকে না জিগ্যেস করে কক্ষনো আর অচেনা কাউকে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেবে না। কাজ শেষ হলে সটান শুয়ে পড়। মাথায় ঢুকেছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

গজগজ করতে করতে ওপরে চলে গেলেন মিসেস ক্যাভানাগ। হোঁৎকা লোকটা অমনি ছুটে এল আমার কাছে।

স্যার, বলুন এখন কী করব। আপনি যা বলবেন, তাই হবে। বিশ বছরের ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দিয়েছেন লর্ড ওয়ালি। আপনি স্যার একটু বলে দেবেন। আগে জানলে কে আসে এখানে–

ঠিক আছে, ঠিক আছে, যা বলবার আমি বলে দেব। আর কেউ আসবে?

সেই ক্যাপ্টেন আর একজন পুরুতমশায়। দুজনেই নিশ্চয় একই কারবার করে, তাই না, স্যার?

তোমাকে তা ভাবতে হবে না। এলেই ঢুকিয়ে নাও। তারপর ওপরে গিয়ে আলোটা নিভিয়ে দেবে এমন ভাবে যেন হাত লেগে হঠাৎ নিভে গেল। তারপর যাবে শোওয়ার ঘরে।

পুলিশগুলো কোথায়, হুজুর?

সব জায়গায়। ছাদে, রাস্তায়, বারান্দায়। বাধা পেলেই তছনছ করে ছাড়বে গোটা বাড়ি।

ঠিক এই সময়ে কড়া নড়ে উঠল দরজার। পরপর দুজন লোক ঢুকল ভেতরে। একজনের পরনে যাজকের পোশাক। আর একজনের গায়ে নিউমার্কেট কোট–ভীষণ শক্তিশালী বপু।

দ্রুত চরণে দুজনেই উঠে গেল ওপরে–পেছন-পেছন হোল্কা বাটলার। সেকেন্ড কয়েক পরেই নিভে গেল সিঁড়ির গ্যাসবাতি। বসবার ঘরে কথাবার্তার ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি ছাড়া বাড়ি নিস্তব্ধ।

রাতের খেল দেখানোর সময় এবার হয়েছে। বুটজোড়া খুলে ফেললাম পা থেকে। পিস্তলের ঘোড়া অর্ধেক তুলে রাখলাম। বেড়ালের মতো পা-টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে বসবার ঘরের পেছন দিকের ঘরে ঢুকলাম।

এ ঘরের ফোল্ডিং দরজার একটা পাল্লা খোলা। একটু জোরে পা ফেললে বা হোঁচট খেলেই খাঁচাছাড়া হবে প্রাণটা। পুলিশ কোথায় এখন কে জানে। রাস্তায় আছে কি থানায় বসে আছে, তা তো জানি না।

তবে আমার কপাল ভালো। ঘরের লোক কজন বেশ জোর গলায় কথা বলে চলেছে। মনে হল যেন ঝগড়া লেগেছে।

খোলা পাল্লার ফাঁক দিয়ে প্রথমেই দেখে নিলাম, মিসেস ক্যাভানাগ ঘরে নেই। চার সাগরেদ রয়েছে ঘরের মধ্যে। ল্যাম্পের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনজন। কালো জুলপিওলা বেঁটে বুড়ো লোকটা বসে রয়েছে হাতলওলা চেয়ারে।

সবচেয়ে খুশি হলাম টেবিলের ওপর একটা বস্তু দেখে।

বনাত পাতা রয়েছে টেবিলে। ব্রোচ, লকেট, হিরের হার ছড়ানো রয়েছে বনাতে। আলোয় ঝলমল করছে রত্নরাশি।

সবচাইতে ঝলমল করছে লেডি ফেবারের চুনির পেনড্যান্ট!

যাক, সূত্র তাহলে পাওয়া গেল, কিন্তু কাজে লাগাই কী করে মোক্ষম এই ক্লু-কে?

চারজনের কেউই নিশ্চয় নিরস্ত্র নয়। ঘরে ঢুকলেই গুলি চালাবে। পুলিশ এসে পড়ার আগেই আমি তো অক্কা পাবই–এরাও সটকান দেবে।

মিনিট পাঁচ দশ দাঁড়িয়ে যাব? উঁকি মেরে রাস্তায় দেখব, অ্যাবেল পুলিশ নিয়ে এল কিনা?

আচমকা আলো দেখলাম সিঁড়ির ডগায়। পরমুহূর্তেই দরজায় হাজির হলেন মিসেস ক্যাভানাগ স্বয়ং। সবিস্ময়ে চেয়ে রইলেন আমার দিকে সেকেন্ড কয়েক।

তারপরেই গলার শির তুলে সে কী চিৎকার! আমিও তাই চাইছিলাম। প্রভঞ্জনের বেগে পিস্তল উঁচিয়ে ঢুকে গেলাম বসবার ঘরে এবং চক্ষের নিমেষে এক গুলিতে উড়িয়ে দিলাম কাঁচের ল্যাম্প।

লক্ষ্যভেদী পিস্তলবাজ হিসেবে আমার সুনাম আছে বিলক্ষণ। চরম মুহূর্তে সে সুনাম রাখতে পেরেছিলাম বলেই কাঁচের ফানুস খানখান হয়ে ছিটকে গেল ঘরময়। চিলের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে ওপর তলায় শোওয়ার ঘরের দিকে দৌড়োলেন মিসেস ক্যাভানাগ। লোক চারটে কিন্তু বিকট গর্জন ছেড়ে বাঘের মতো লাফ দিয়ে তেড়ে এল আমাকে যেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল ঠিক সেই দিকে।

চার মূর্তিমানকে ওইভাবে শার্দুলবিক্রমে ধেয়ে আসতে দেখেই মনে পড়ল অ্যাবেলের কথা। আহারে! ঠিক এই সময়ে হতভাগাকে যদি পেতাম পাশে…

আচম্বিতে ঝনঝন করে বারান্দার দিকের জানলার কাঁচ ভেঙে ঠিকরে বেরিয়ে এল ভেতর দিকে। নিমেষ মধ্যে পুলিশ গিজগিজ করতে লাগল ঘরময়। অ্যাবেল চলে এল আমার পাশে সবার আগে।

আদালত থেকে কী শাস্তি দেওয়া হয়েছিল বিরাট এই দলটাকে, আজ আর তা হুবহু মনে নেই। পুলিশের ইতিহাসে কুখ্যাত এই তস্কর বাহিনীর যে নাম লেখা আছে, সেটা অবশ্য মনে আছে– ওয়েস্টবোর্ন পার্ক গ্যাং।

জড়োয়া চুরিতে সিদ্ধহস্ত দলের প্রত্যেকেই। পালের গোদা ছিল মিসেস ক্যাভানাগের স্বামী সেই বেঁটে বুড়ো কালো জুলপিওলা লোকটা। হুইটি তার নাম। জেমস থর্নর্ডাইক কোম্পানির ম্যানেজার ছিল এককালে। টটেনহ্যাম কোর্টে এদের অফিস। দুনিয়ায় যা কিছু বস্তু সরবরাহ করা ছিল বিশেষ এই কোম্পানির কাজ। মাল সাপ্লাই করতে গিয়ে হুইটি দেখলে কারবারটা তো মন্দ নয়; লন্ডনের নাচের আসরগুলোয় নিমন্ত্রিতদের ছদ্মবেশে চোর সাপ্লাই করলে কেমন হয়?

চাকরি ছেড়ে দিয়ে লোভনীয় এই ব্যবসা ফেঁদে বসল হুইটি। তেইশজন পুরুষ আর আটজন মহিলাকে দিয়ে নানারকম চোরাই মাল এনে ফেলতে লাগল নিজের ডেরায়। সবই জড়োয়া গয়না। দাম যা হত তার এক তৃতীয়াংশ পেত চোর বা চোরনী। সিংহ বখরা ঝেড়ে দিত নিজে।

হুইটি এখন পোর্টল্যান্ড জেলের হাওয়া খাচ্ছে বলেই শুনেছি। তরুণ-তরুণী সাগরেদগুলো পাথর ভেঙে মরছে। বউটা শুনেছি আমার নাম শুনলেই দাঁত কিড়মিড় করে।

(ম্যাক্স পেমবারটন-এর গল্প অবলম্বনে)
*কিশোর মন পত্রিকায় প্রকাশিত। ১৬.৪.৮৬ অরিখের সংখ্যা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *