1 of 2

অশ্বচরিত – ৫০

পঞ্চাশ

ভানু ভাবছিল সে এবার যাবে। এখান থেকে হাওড়া, হাওড়া থেকে ট্রেনে ভোজপুরের দিকে। ভানু ভাবছিল যাবে, রামনগর, কাঁথি হয়ে বাসে উঠবে মোহনপুর দিয়ে বালিমুণ্ডা। বালিমুণ্ডা থেকে ভীমাপুর। ভানু ভাবছিল যাবে মীরগোদা, প্রাচীন জাহাজঘাটায়, মরা সমুদ্রের বালিয়াড়ি ভেঙে গৌরমোহন মদরঞ্জিওয়ালার ভিটেয়। সে ভাবছিল কাঁথি থেকে ট্রেকারে চেপে দৌলতপুর, দরিয়াপুর যাবে মদরঞ্জিওয়ালার বোনের বাড়ি, শিবরামকে নিয়ে রসুলপুরের নদীতীরে অন্ধকারে। ভানু ভাবছিল চলে যাবে বজবজ, সুরেন কুণ্ডুর চা-দোকানে, যাবে হিনাড়ি, গিরিমশায়ের ভিটেয়। এবার গিয়ে খুঁজবে ঘুড়ীটার কবর। ভানু এই রকম, নানা রকম ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল। অঘ্রান পড়ে পড়ে, আজই অথবা কাল। ভানুর আর মন নেই এখানে, এই সমুদ্র উপকূলে। ভানু ভাবছিল চলে যাবে পিছনে। এক বছর, দুবছর করে হাজার বছর পিছনে। দুহাজার, তিন হাজার, চার হাজার, পাঁচ হাজার বছর পিছনে আমুদরিয়া নদীর তীরে, অশ্বযূথে গিয়ে খুঁজবে তার কন্থককে। ভানু ভাবছিল চলে যাবে তপোবনের দিকে, কন্থক তপোবনের দিকে ধেয়ে গেছে কি না কে জানে। কন্থকের কি রাজপুত্রের কথা মনে পড়েছিল? তিনি তো সর্বস্বত্যাগী মহামানব হয়েছিলেন, জানে না কন্থক? ভাবতে ভাবতে ভানু অনন্ত সারের ভিটেয় এলো।

তুমি বড় যাও না অনন্ত?

নতুন কারবার, ছাড়ি যাবা যায়নি, থেকে যাবা তো ভানুবাবু?

ভানু তো এসেছেই সন্ধে পার করে, বলল, থাকব, কিন্তু ঘোড়াটাকে কি দেখেছ, মাইতিবাবুর পঙ্খিরাজ? আমার কন্থক, শূন্যপৃষ্ঠ কন্থক।

না তো দেখিনি, সেটি কি আবার পলাইছে?

ভানু হাসল মনে মনে। অনন্ত ধরে নিয়েছে ঘোড়াটাকে পাওয়া গিয়েছিল। ঘোড়াটা ফিরেছিল। কবে ফিরেছে তা জিজ্ঞেসও করল না। অনন্তর মনে তা নিয়ে কোনো প্রশ্নও জাগেনি। পালায়, আবার ফেরে, সেই নিয়মেই যেন ফিরেছিল মাইতিবাবুর ঘোড়াটি। সেই কবে কার্তিক শেষ হয়েছে। কার্তিকের প্রথমেই তো ফিরে আসে পক্ষিরাজ, কে না জানে তা। কার্তিকে হিম পড়ে, কাশফুল ঝরে যায়, গাছের পাতায় ধুলো জমে, কেয়াবন কুশী হয়ে যায়, তাই ঘোড়াটা আর থাকে না বাইরে। এ তো প্রকৃতির নিয়ম। অনন্ত ধরে নিয়েছে সেই নিয়মের কোনো ব্যতায় হয়নি। অনন্তর মুখোমুখি অন্ধকারে বসে আছে ভানু উঠোনতলে। হিমে শরীর ঠাণ্ডা হচ্ছে। ভানু অন্ধকারেই অনুভব করছিল ঘরখানি কী শান্ত! গৃহস্থের সংসার শ্রীময়ী হয়েছে। ভানু আকাশে তাকায়। তারায় তারায় আকাশখানি ঝলমলে। তবু সেই আকাশ থেকে হিম বিন্দু তার চোখের কোণে এসে পড়ল।

ভানু জিজ্ঞেস করল, ঘোড়াটিরে চেনো তো?

হাঁ, রংটি কী?

ভুলে যাওয়ারই তো কথা। পঞ্চাশজনকে জিজ্ঞেস করলে ঠিক ওই প্রশ্নটিই করবে। ঘোড়াটি বাদামি ছিল, না সাদা, নাকি মিশেল ছিল সাদায় বাদামিতে? কালোয় সাদায়? কতবার দেখেছে তারা ঘোড়াটিকে, কিন্তু মনে রাখার কী আছে?

ভানু বলল, ঘোড়াটির রং নাই।

দেখলে খপর দিব। বলল অনন্ত, তারপর আচমকা ভানুর হাত ধরে ফেলে, একটু ফাঁকে যাবা, কটা কথা বলি, শুনো ভানুবাবু, একটা খপর আছে।

ভানু জিজ্ঞেস করে, তোমার বউ কই?

রান্নাশালে, চা কঁইরছে তুমার জন্যি। বলতে বলতে উঠে ভানুর হাত ধরে টানে অনন্ত, উঠোনের প্রান্তে চলে যায়, বলে, পরশু দীঘা গেলাম দুজনায়, তুমারে খপর দিব ভেবেছিলাম, ‘মনি অডারে’ টঙ্কা আসিছিলা।

ভানু চুপ করে থাকে। কী বলবে? ভানু অনুভব করে টাকাটা পেয়ে আরও খুশি হয়েছে অনন্ত। টাকা কত তা নিয়ে কোনো কৌতূহল নেই তার। অনন্ত বলল, কেনে দীঘা গেলাম কহ দেখি, জানো কি ভানুবাবু?

মাথা নাড়ে, না তো, কেন?

অনন্ত চাপা গলায় খবরটা দেয়। দুজনে হাসপাতালে গিয়েছিল তারা। এখন তো যেতে হবে প্রায়ই, শুনছ ভানুবাবু, মোরা বাদ দিয়ে খপরটা তুমিই জানলে পেথম।

ভানু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অনন্তর মুখের দিকে। তারার আলোয় মুখখানি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে যেন। ভানু দেখল আলো রাখল সরস্বতী বারান্দায়। রান্নাঘরে ঢুকে গেল। চায়ের কাপ নিয়ে বেরিয়ে এলো। ধীর গমনা। ভানু ফিরে এলো আগের জায়গায়। বসল দড়ির খাটিয়ায়। চা নিয়ে পায়ের কাছে মাটিতে রাখল। সরস্বতী ঢুকে গেছে রান্নাঘরে। অনন্ত চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, কুনো অভাব থাকছেনি, আষাঢ়ে হবে।

ভানু অনেকক্ষণ বাদে উঠল, যাব।

যাবে কেন,

থাকবেনি?

না, কাজ আছে।

অন্ধকারে, এত রাতে!

যেতে পারব। ভানু হাঁটতে আরম্ভ করল।

ভেড়িবাঁধ দিয়ে হাঁটছে ভানু। যেন শূন্যের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তার মাথার ওপরে আকাশে আকাশে তাকে অনুসরণ করছে নক্ষত্রদল। ভানু হেঁটেই চলে। বালিমুণ্ডা, হিনাড়ি, মীরগোদা, বজবজ, ভোজপুর, দরিয়াপুর, দৌলতপুর হেঁটে চলে সে। যাবে চোদ্দবেড়িয়া, সেখানে সুবর্ণরেখা নদী, নদী মিশেছে সমুদ্রের সঙ্গে। সেই মোহনায় এক চর আছে। আশ্বিনে সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকে। তখন সেখানে কত বন্ধু! কত! কত! হাঁটতে হাঁটতে ভানু ঘুরে তাকায়। ওই দেখা যায় কুটিরখানি। আলো জ্বলছে। অন্ধকারে আকাশ থেকে একটি তারা বোধহয় নেমে গেছে ওই কুটিরের উঠোনতলে। ঈশ্বর আবার মুখ তুলে চেয়েছেন ওই সংসারে। ওখানে আবার ঈশ্বর ছুঁয়ে দিয়েছেন তাঁর নরম হাতখানি। তিনিই পারেন। কুন্তির মা আবার পেটে ধরেছে। ভরা পেটে বসে আছে উঠোনে। তারার আলোয় তার মুখখানি সহাস্য। ভানু হাঁটছে। চোদ্দবেড়িয়া…চৌদ্দবেড়িয়া…চোদ্দবেড়িয়ায় আসে গিরিমশায়ের ঘুড়ীটি। রূপসী ঘুড়ী। বাদামি আর সাদায় মেশানো রং, কপালে পরপর তিনখানা সাদা টিপ। কীভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। ফোঁস ফোঁস করে। কীরকম চাহনি ফোটে রূপসীর দুই চোখে। দুই চোখ দিয়ে কীরকম ডাকে! আমি চললাম। শরৎকাল এসে গেছে। চললাম। নীল আকাশ, সাদা মেঘের ভেলা, জ্যোৎস্না, ঠাণ্ডা বাতাস—আমি চললাম।

মনে পড়ে কি দুপুরটার কথা, হে সারথি ছন্দক?

ভানু বলল, পড়ে মনে।

মনে পড়ে সে আমার কতকালের সাথী। কুমার বিসর্জন দিলেন আমাদের, আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে অশ্রুপাত করেছিলাম। হায়, এ সংসার দুঃখের সমুদ্র, তখন বুঝিনি, এখন অনুভব করছি।

মনে পড়ে আবার ভুলেও যাই। কত দিন হারিয়ে গেছে! কত কাল! কত যুগ! সেই উরাল হ্রদের তীর থেকে হারিয়ে গেল, আমুদরিয়া, সিরদরিয়া নদীর কূল থেকে হারিয়ে গেল, হারিয়ে গেল গিরিপথের অন্ধকার থেকে। হারিয়ে গেল এই সমুদ্রতীর থেকে। উধাও হয়ে গেল। নায়কান বুড়ি তাকে বাতাস করে দিল।

মনে পড়ে যায় সব। সেই দুপুরের কথা। ধারালো রোদের কথা। রোদ বোধহয় অত গরম আমার জীবদ্দশায় হয়নি। আগুনের ভিতর দিয়ে হেঁটে এলাম। হাঁটতে হাঁটতে পা বেঁকে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল পড়ে যাব।

আমি কন্থক, ছিলাম রাজপুত্রের ঘোড়া, রোদ্দুরে ধুঁকতে ধুঁকতে এলাম ছায়ায়। একা একা দাঁড়িয়ে আছি। চোখ বুজে এসেছে। গায়ে যেন ঠাণ্ডা হাওয়া লাগল। ঘাড় তুলে ওপরে তাকালাম। মেঘের পুঞ্জ। কালো চুল এলিয়ে দিয়েছে কে যেন! বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মেঘের ছায়ায় বালি ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ছায়া ঘনাইল বনে বনে। ছায়া এলো মনের ভিতরে। বৃষ্টি আসবে কি? এসো বৃষ্টি, এসো। প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে এসো। চোখের কাজল হয়ে এসো। বৃষ্টিতে দুটো চোখ ভিজুক।

ভিজে মাটির গন্ধ উড়তে লাগল। ঘুমের ঘোরে ছিল শ্রীপতি। পাশে ভারতী শুয়ে গল্প করছিল একটু আগে। কী গল্প। অনাথ আশ্রমের। শ্রীপতি বুকে চেপে ধরেছিল অনাথিনীকে। বড় মায়ায় ফেলেছে, তাকে সর্বস্ব নিবেদন করেছে। রতিক্লান্ত নারীও ঘুমোচ্ছিল। শ্রীপতি ঘুমের ঘোরে মেঘের ডাক শুনছিল।

পৃথিবীটা সত্যিই সুখের। আগুন নিমেষে উধাও। প্রবল ধারার বৃষ্টি সব ভিজিয়ে দিল। আমাকেও। আমার গা ভিজল। ঝটকা মেরে মেরে জল ছাড়াতে ভালো লাগছিল গায়ের রোম থেকে। পেটের কাছে একটা ঘা। ঘায়ে একটাও মাছি নেই। আমি লেজটা দিয়ে বারবার জল ছড়াচ্ছিলাম।

কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি! আকাশ ভেঙে পড়তে লাগল। মেঘ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়তে লাগল। অন্ধকার নেমে এসেছে দুপুরেই। বাতাস বইছিল খুব। বাতাসে দিশাহীন হয়ে বৃষ্টি যেন ঢুকে পড়ছিল শরীরের ভিতরে। রক্তের ভিতরে প্রবেশ করছিল মেঘ। আমি দুটো পা তুলে বৃষ্টিকে ডাকছিলাম। কী আনন্দ! শরীর জুড়োল জগতের। আমারও। তারপর! বৃষ্টি আস্তে আস্তে কমতে লাগল। ফিসফিসে হয়ে একেবারে থেমে গেল। আমি দাঁড়িয়ে আছি। তারপর মেঘের নীল রংটা ছড়াতে লাগল পৃথিবীতে। অন্ধকার হয়ে এলো। অন্ধকারের পৃথিবীতে চাঁদ ওঠে। চাঁদ উঠল। সুবর্ণ বলয়। চাঁদ ভাসতে ভাসতে এলো আকাশের মাথায়। তখন আমি চমকে গেছি সত্যি!

চাঁদের আলো পড়েছে এখানে সেখানে জমে থাকা জলের ওপর। ওপরের আকাশে সেই কালো মেঘ আর একটুও নেই। আমি দেখছি চাঁদের পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে সাদা দলাদলা মেঘ। মাটিতে জমে থাকা জলে প্রতিবিম্বিত জ্যোৎস্না ভেসে যাচ্ছে হাওয়ায়।

মিলে যাচ্ছে। সব মিলে যাচ্ছে। ঋতু বদল হয়ে গেছে। গ্রীষ্মের পর বর্ষা, বর্ষা গিয়ে শরৎকাল এসে গেছে। গন্ধ পাচ্ছি শরৎকালের। আশ্বিনের। ঋতু ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীময়। আমার কান খাড়া হয়ে উঠল। নাক তীক্ষ্ণ। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। বাতাসে বাতাসে খবর আসছে—ঋতু বদলে গেছে, তৈরি হও। জোট বাঁধো, তৈরি হও।

তৈরি হও, আকাশের নীলে সাদা ফেনার মতো মেঘ ভেসেছে। ঐ তো ভরা নদী সুবর্ণরেখা, আর দূরে সমুদ্র। আলগা আলগা দখিনা বাতাস। চরভূমি ভরে গেছে সবুজ ঘাসে। কাশফুলে কাশফুলে নেমে এসেছে গিরিবাবুর বাড়ির সেই রূপসীটা। আছে ভোগরাই, রানীশাহী, চাঁদবালি, দেউলি সব জায়গার পালিয়ে আসা ঘোড়ারা। ছুটেছে চর বেয়ে। ঘাসে মুখ দিচ্ছে, ফুর্তিতে হইহই করে উঠছে।

ভালোবাসা হয়ে গেছে কারও সঙ্গে কারও। মনে পড়ছে না তারা কারা? কোত্থেকে এসেছে। ফুর্তিতে ফুর্তিতে সবাই আদিম। আদিম থেকে আদিমতর। ভিতরে জেগে উঠেছে বুনো ঘোড়ার তেজ। বুনো ঘোড়ার ফুর্তি। বুনো ঘোড়ার স্বপ্ন। বনের স্বপ্ন, প্রান্তরের স্বপ্ন, নদীতীরের স্বপ্ন। মনে পড়ে যাচ্ছে আমুদরিয়া নদীর কথা, উরাল হ্রদটির কথা। পুরুষপুর, সিন্ধুনদ, গিরিপথ যত। তারপর কপিলাবস্তু। রাত অন্ধকারে দুধঢালা জ্যোৎস্নায় ভিজে ভিজে হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন স্মৃতির সামনে দাঁড়িয়ে তারা যেন ফিরে যায়, বারবার ফিরে যায় সেই দিনে। কতকাল আগে! জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছে পাল বেঁধে। সব জঙ্গল, সমস্ত পৃথিবীই তাদের। এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি বুনো ঘোড়ারা পৃথিবীর বুক ফুঁড়ে চলে যায় কোথায় কোথায়। বাধা নেই ভালোবাসায়, বাধা সেই জীবনে।

আমার ভিতরটা ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। কোন ফাঁকে এই রাতে ঋতু বদল হয়ে গেছে। চন্দনেশ্বর, হিনাড়ির গিরিবাবুর ঘরে বড় হাওয়া সেই রূপসী, চকচকে বাদামি রং, কপালে তিনটি দুধসাদা টিপ, গায়ে কোথও সাদা আঁচড়। সে ফুর্তিতে টলমল হয়ে হাঁটছে জ্যোৎস্নার ভিতরে। নীল জ্যোৎস্নায় মিশে গেছে তার দেহ। শুধু তার ডাক শুনে তাকে চিনতে হবে। সে এমনভাবে ডাকে, রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে সর্ব অঙ্গ। ডাক শুনলাম যেন তার, প্রিয়তম, প্রিয়তম হে, এসো, আকাশ বদলে গেছে, বাতাস বদলে গেছে, চর ভরে গেছে কুচিকুচি ঘাসে, সবুজ মখমলে।

আমি আর পারি না। ডাক এলো। যাই যাই করে ছুটে যাই। যাই হে প্ৰিয়তমা, যাই আমি, দাঁড়াও, আসছি, আসছি করে ছুটে যাই সেই রাতে। হাওয়ায় উড়ে উড়ে ভেসে ভেসে পার হয়ে যাই ঘুমন্ত পৃথিবী। স্বর্গের দিকে ছুটে যাচ্ছি। প্রিয়তমা, রূপসী—আমি আসছিই!

তারপর একসময় বেগ কমতে থাকে। বুঝতে পারি এসে গেছি সেই চরে। সব নিঝুম। ঐ তো দূরে নদী, আর ঐ দক্ষিণে সমুদ্র। চাঁদটা আবার মেঘে ঢাকে, মেঘ থেকে বেরোয়। জ্যোৎস্না ছড়িয়ে যায় আবার। জ্যোৎস্না নীল হয়ে যায়। নীল জ্যোৎস্নায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

শরৎকাল এসে গেছে। আবার মেঘ কেন? আমার বুক ছ্যাৎ করে ওঠে। সারা রাত সমুদ্রের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আসবে অন্য ঘোড়ারা। এসে গেছে। আমাকে দেখে লুকিয়েছে বোধহয়। এও এক খেলা। নাকি আমিই এলাম প্রথম। স্বপ্নের ভিতরে ডাক শুনেছি রূপসী ঘুড়ীটার, সেই ডাকে ছুটে এসে দেখি সে আসেনি এখনও। তাই কি? তাই বা হয় কী করে? আমি লাফ দিলাম I

সবদিকে লাফিয়ে গেলাম। কেউ নেই। তাহলে কি ওরা এসে পৌঁছয়নি? আমি সারা রাত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকি। ঐ যে ফেনার মতো স্তূপ স্তূপ মেঘ উড়ছে। ওরাই তো লাফ দিয়ে মাটিতে নামবে। নেমে হয়ে যাবে গিরিমশায়ের রূপসী ঘুড়ী। তারপর! কী খেলা আর কী খেলা!

তারপর আরও পশ্চিমে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে পোড়া চাঁদ, আগুনরঙা চাঁদ ডুবে যায়। রাত শেষ হলো। ওরা এখনও তো এলো না। আমি তো ঋতু বদলের গন্ধে গন্ধে পালিয়ে এসেছি। ওরা এলো না কেন? আশ্বিন যে এসে গেছে! আশ্বিনের খবর কি পৌঁছয়নি ওদের কাছে?

সূর্য উঠল। আমি এ কী দেখছি! সব নিঝুম। ছুটে যাই ঝাউ জঙ্গলের দিকে। কেউ নেই। ছুটে যাই কেয়াবনের দিকে। কাউকে পেলাম না। রোদ উঠছে। রোদ ছড়িয়ে পড়ল। আমি অবাক হয়ে চারদিক দেখছি। স্তব্ধতা আমাকে ঘিরে আছে।

ওরা আসছে নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই আসবে। কিন্তু রোদ আগুন হয়ে যাচ্ছে। কাশফুল কোথায়? কাল রাতে লক্ষ করিনি। নাকি ছিল, দেখেছিলাম। এখন নেই। কাল রাতে যা যা ছিল এই চরে এখন তা নেই। এখন দেখতে পাচ্ছি, কাশফুল নেই, চর ঘাসে ছেয়ে নেই; তাহলে!

রোদ চচ্চড়িয়ে বেড়ে যাচ্ছে। এমন হচ্ছে কেন? এমন তো হওয়ার কথা নয়। এ যে সেই রোদ। আমার গাটা পুড়িয়ে দিতে লাগল। আগুনের কণারা লাফ দিয়ে নামছ। এ যে ভীষণ গ্রীষ্মের সেই রোদ। রোদ বাড়ছে। রোদ ঘন হচ্ছে। আগুনের স্রোত বইতে আরম্ভ করেছে।

বাতাসে বালি উড়ছে। এ কোথায় এলাম? আমি পলাতে চাই আবার। কিছু মিলছে না। শুধু আগুন আর আগুন। ভুল করে চলে এলাম নাকি!

গিরিমশায়ের রূপসী ঘুড়ী, তুমি কোথায়? কথা ছিল যে আসার। ঋতুর গন্ধে গন্ধে উড়ে এসেছি আমি। একি! বালিতে আমার পা বসে যাচ্ছে কেন? হাওয়ায় ঘূর্ণী বালি উড়ছে! তাতা বালি আমার গা-হাত-পা পুড়িয়ে দিচ্ছে। আমার চোখে বালি এসে ঢুকে যাচ্ছে।

কোথাও একটু ঘাস নেই। কাল রাতের ভিজে বালি একটু রোদ্দুরে শুকনো হয়ে উড়তে আরম্ভ করেছে। আমার পা সেই বালির ভিতরে ডুবে যাচ্ছে।

চারদিকে ধু ধু মরুভূমি। ঘোড়াটা তার ভিতরে পালাবার চেষ্টা করে। দৌড়তে পারে না। বালিতে পা চলে না। রোদ্দুরে ঘুরপাক খায়। চোখে সব যেন আঁধার করে আসে।

একটা নয়, দুটো নয়, কটা ডাঁশ, পেটের ঘায়ে এসে বসেছে। কোত্থেকে তারা যে খবর পেয়েছে! আমি লেজ আছড়াই, শরীর কাঁপাই। তারা সরে না। ঘাটা জ্বলে যাচ্ছে।

ঘোড়াটা আর দাঁড়ায় না। ছুটতে আরম্ভ করে। ভয় পেয়ে যায় ভীষণ। এখানে সে এলো কীভাবে? কখন এলো? এখানে এমন সময়ে তো আসার কথা নয়। বাতাস ঠাণ্ডা নেই। রোদ ধারালো। মাটিতে একবিন্দু সবুজ নেই। কেয়াবনে সবুজ নেই। এ সে এলো কোথায়? এ তো চোদ্দবেড়িয়া, কিন্তু চোদ্দবেড়িয়া এমন নয়। ঘোড়াটা ছুটছে। ছুটতে ছুটতে তার জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে। দাঁড়াচ্ছে। ছায়া খুঁজছে। ছায়া খুঁজে খুঁজে পা বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে ঘোড়াটা হাঁটছে! পেটের ঘা থেকে রক্ত বের করে ফেলেছে ডাঁশে। ঘোড়াটার চোখে ঘোর। কোন পথে কোন দিকে হাঁটছে খেয়াল নেই। এমন তো কখনো হয়নি। এ জীবনে এমন হয়নি। এমন পৃথিবীও তো সে দেখেনি। এ কোন দেশ? কোথাও কোনো ছায়া নেই। ঘোড়াটা হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়ায়। তার ছায়া তার গায়েই মিলিয়ে গেছে। ঘোড়াটা ভয় পাচ্ছিল। এই রোদ, ছায়াবিহীন এই পৃথিবীই যদি তার নিয়তি হয়, সে ভীষণ ভয়ের। সে ধুঁকতে ধুঁকতে হেঁটে যাচ্ছিল নিরুদ্দেশের পথে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *