1 of 2

অশ্বচরিত – ৪০

চল্লিশ

এবার আশ্বিনের আরম্ভে পুজো। পুজোর মুখে আকাশ আবার গম্ভীর। যে আকাশে পুজোর কথাটি মনে পড়ে সেই আকাশই ছিল না। তবু তো পুজো। ঢাক বাজল। ঢাকের শব্দ উড়ে এলো শূন্য প্রান্তর বেয়ে, উড়ে গেল লায়কানখাস পার হয়ে দূরে, শূন্য পৃথিবীর দিকে। উঠোনে দাঁড়িয়ে ঢাকের শব্দ শুনে মেয়েটির কথা মনে পড়ল সরস্বতীর। অনন্ত তার জন্য রঙিন শাড়ি এনেছিল। সেই শাড়ি বুকে চেপে সে কাঁদল খানিক। কত আর কাঁদবে? কেঁদেই চলেছে সে। অনন্ত বোঝাচ্ছে মেয়েটা সুখেই আছে। থানা পুলিশ করা যায়, কিন্তু তাতে মেয়ের কি ভালো হবে? হয়তো কুকুর দিয়ে…। শেষের কথাটা অনন্ত বলতে পারে না, কিন্তু মনে তো ঘোরে ফেরে! সে না বললেও বোঝে না কি সরস্বতী? বোঝে।

পুজোর পর আকাশের আসল রূপটি ফুটল। ঘন নীল আস্তরণ, তার ভিতরে সাদা মেঘের ঢেউ। ঢেউ চলেছে সমুদ্রের দিকে। ওই আকাশে তাকিয়ে আবার মেয়েটির কথা মনে পড়ল। কাঁদল সরস্বতী। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বসে রইল উঠোনে। কিন্তু পারল না বেশি সময়। রোদের কী তেজ! আগুন নামছে যেন আকাশের থেকে। খাঁটি মেঘলাভাঙা ভাদ্র মাসের রোদের মতো। সরস্বতী ঘরে ঢুকে মস্ত একটা পলিথিন টেনে বের করে। নুনের জিনিস। এতে লায়কানখাসে মারা নুন শুকোয়। পলিথিনটা উঠোনে বিছিয়ে দিয়ে ঘরের ভিতর থেকে লেপ কাঁথা বের করতে লাগল কুন্তির মা। তিনটে কাঁথা, একটিতে লাল পাড়ের সুতোয় নকশা করা। একটি তোশকও বের করে, একটি কম্বল। অনন্ত কম্বলটি পেয়েছিল রামনগরে। কোনো বড়লোক তার নাতি হতে দান করেছিল অনেক। তোশক, কম্বল, কাঁথা ডাঁই করে পলিথিনে ফেলল সরস্বতী। উবু হয়ে বসল আবার রোদের ভিতরে। নাক টানতে লাগল। সবগুলোতে মেয়ের গন্ধ রয়েছে।

লাল সুতোর নকশি কাঁথাটি টেনে বুকে চেপে ধরে সরস্বতী। ঠিক যেন শিশু কুন্তিকে বুকে ধরেছে সে। কাঁথার প্রতিটি সুতোয় কুন্তির গন্ধ, তার চুলের গন্ধ, মুখের গন্ধ, গায়ের গন্ধ। কাঁথা ফেলে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে আবার কাঁদল সে। কাঁদতে কাঁদতে টের পেল রোদ সহ্য করা যাচ্ছে না। উঠে গিয়ে বসে থাকল দাওয়ার ছায়ায়। কয়েক হাত দূরে রোদে গরম হতে লাগল কাঁথা, কম্বল, তোশক। নিঝুম হয়ে বসে বসে ঝিমোতে লাগল সরস্বতী। ঘুমিয়েই পড়ল। ঘুমিয়ে দেখল কুন্তি এসে দাঁড়িয়েছে উঠোনে, গায়ে নকশি কাঁথাটি। কাঁথার ফুলগুলো কী সুন্দর লাগছে! নীল সাগরের জলে ভেসে আছে তার মেয়েটা। তা হলেও জায়গাটা উঠোন নয়, সাগর। সে কোথায় আছে, নৌকোয় না লঞ্চে? কুন্তি হাসছিল। কুন্তির দিকে চেয়ে সে কাঁদছিল। কিন্তু কাঁদতে পারল না বেশি সময়। মেয়েটা হেসেই যাচ্ছে। কী সুন্দর হাসি। ঠোঁটের দুকোণ থেকে হাসির বিন্দু সাদা মেঘ হয়ে সাগরের ওপর ছড়িয়ে পড়ছে। হাসতে আরম্ভ করল সরস্বতীও। মা-মেয়ে পরস্পরের দিকে চেয়ে হাসছে। হেসে যাচ্ছে। তন্দ্রার ঘোরে হাসছিল অনন্তর বউ। অনন্ত বাড়ি ফিরল, ডাকল বউকে, কী হলো তোর, এই সরস্বতী?

চোখ খুলল সরস্বতী, দেখল লাল নকশি কাঁথাটি তার দিকে তাকিয়ে। ওটি গায়ে দিয়ে শুয়ে ছিল যেন কেউ, ফেলে রেখে উঠে গেছে এখনই।

অনন্ত বলল, কালীপুজোর আগের দিন দোকান বসাবে।

সরস্বতী এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে বিভ্রান্ত হয়ে। দাওয়ার একধারে মাটির কলসি গোটাকয়, ঝাঁটা, আরও দুটো পলিথিন। এসব নুনের কাজের। রোদ যা হয়েছে, এমন চললে নুনের কাজ এখনই আরম্ভ করা যায়। কিন্তু কষ্টটা হবে, হাতে ধরা কেউ নেই। মেয়েটা কম কাজ তো করত না।

হাসছিলি চোখ বুজে? জিজ্ঞেস করল অনন্ত।

চোখ বুজলিই মেয়্যাটারে দেখি।

অনন্তর মুখ অন্ধকার। সে দীঘা রামনগর রাস্তার ধারে, অলঙ্কারপুর বাসস্টপে, একটা গুমটি করছে। টাকা তো রয়েছে। টাকাটা কাজে না লাগিয়ে ভেঙে খেলে ফুরিয়ে যাবে। সরস্বতী উঠোনে নেমে লাল সুতোয় নকশিকাটা কাঁথাটা তুলে বুকে চাপল, হু হু করে কেঁদে ফেলল, বলল, ইবার নুনের কাজ কে করবে, তুমার মেয়্যাই তো নাই, কী যে হবে?

কী হবে?

খালারিতে বসে থাকবে কে দিনভর?

অনন্ত বলল, নুনের কাজ আর করবনি।

করবানি তো ভাত ফুটবে কী করে?

গুমটিটা বানাতে দিলাম।

ওই টঙ্কা ভাঙছ?

হাঁ, টঙ্কা রেখে দিয়ে কী লাভ?

উটা মোর কুন্তিরে ফিরাতে লাগবে। কাঁথাটা ফেলে দিয়ে আবার দাওয়ায় এসে ওঠে সরস্বতী, রোদে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। কুন্তির গায়ের গন্ধ নিয়েও রোদে শরীর দাঁড়াচ্ছে না। হাঁটু মুড়ে আবার বসে সে দাওয়ায়। অনন্ত গায়ের জামাটি খুলে হাওয়া খায়, বলল, কুন্তিরে ফিরাতি টঙ্কা লাগবেনি, মেয়্যাটা কাম করছে, উয়ার বেতন নাই?

কুন্তি বলল, কালীপুজোর পর ভানুদাদাকে নিয়ে যাবে?

যাব, অঘ্রান মাসেই নিয়ে আসব।

অঘ্রান তো দেরি আছে, কার্তিক মাসেই আনবা?

যাব, বলছি কি পান, বিড়ি, লজেন্স, বিস্কুট, পাউরুটি, বড় একখান গুমটি করব, কথা পাকা, দীঘায় গিয়ে মহাজনের সঙ্গে কথা বলে এয়েছি।

মেয়্যাটা নাই, ইসবে কী হবে?

অনন্ত বিরক্ত হলো, মেয়্যারে তো বিয়াও দেয়, মেয়্যা চিরকাল ঘরে থাকে? মনে করো না বিয়া দিইছি, রামনগরের যোগেন কুণ্ডুর মেয়্যার বিয়া হলো দিল্লি, পাঁচ বছর দিল্লি গেল, খুঁজ নাই, তুই তো মেয়্যা কুথায় রহিছে তা জানিস, যাবি, বাড়িটা আবার দেখে আসি না হয়।

মেয়্যারে দেখা হবেনি?

যদি দারোয়ান ঢুকতি দেয়, হবে।

মোর মেয়্যা, দারোয়ান ঢুকতি দিবেনি কেনে?

অনন্ত বিরক্ত হয়, সে কি তুই জানিসনে?

কপালে আঘাত করে সরস্বতী। কাঁদল না, থমথমে মুখে বসে থাকল। অনন্ত আবার তার সম্ভাব্য দোকানের কথা বলতে থাকে। মহাজন বলেছে অলঙ্কারপুরে বড় হোটেল হচ্ছে। অলঙ্কারপুর পর্যন্ত এগিয়ে আসবে দীঘা। তা যদি হয়, দোকান করে লাল হয়ে যাবে অনন্ত। এখনই তো সিজন। অলঙ্কারপুরে লোকে ঘর ভাড়া দেয় ট্যুরিস্টদের কাছে। ছোট করে আরম্ভ করবে অনন্ত, তারপর বড়তে যাবে, সঙ্গে যদি চায়ের পাট রাখে, টাকায় টাকা লাভ। তবে হ্যাঁ, দীঘাতেও খুঁজছে জায়গা। পার্টির লোককে ধরেছে সে, পেলে তো গুমটি তুলে নিয়ে সেখানে বসিয়ে দেবে। আর দীঘায় একটা গুমটি থেকে ছোট খাওয়ার হোটেল পর্যন্ত করে ফেলেছে জগন্নাথ জানা। খাওয়ার হোটেল থেকে থাকার হোটেল করে ফেলবে খুব শিগগির। অনন্ত এবার আর ছাড়ছে না। লোকের দরজায় দরজায় ঘুরবে না। ভিখিরির দশা হয়ে গিয়েছিল না!

সরস্বতীর কানেই যায় কথাগুলো। ভিতরে প্রবেশ করে কথার আয়ু শেষ হয়ে যায়। কিন্তু কথাগুলো তো একদিন বলে ক্ষান্ত হয় না অনন্ত। প্রতিদিনই বলে। কালীপুজোর আগের দিন বিকেলে নিয়ে এলো ভানুকে সঙ্গে করে। ভানু একটু নিস্তেজ হয়ে গেছে। শ্রীপতি মাইতি তাকে বারবার মীরগোদা নিয়ে যেতে চাইছে। ভানু এড়াবে কতবার, কত মিথ্যে বলবে? সে ধরতে পারছে শ্রীপতি এই রকম করতে করতে একদিন অসন্তুষ্ট হবে খুব, তাকে আর পছন্দ করবে না, পছন্দ না করার কারণে বিদায় দেবে হোটেল থেকে। ভানু আর কতদিন বিনা কাজে পোষ্য হয়ে থাকবে মাইতিবাবু হোটেলিয়ার? কথাটা ঠাকুরানির। ঠাকুরানির গলার জোর বেড়েছে ঠাকুর ফিরে আসায়। ঠাকুর যেন মেঘমুক্ত আকাশ। কিছুই জানে না, কিছুই হয়নি। অনন্তকে কত পরামর্শ দিচ্ছে টাকাটাকে কীভাবে সদ্ব্যবহার করতে পারে সে। অনন্ত অবশ্য সব কথা বাড়ি ফিরে বলে না বউকে। পঞ্চম ঠাকুর যে ফিরেছে তাও বলে না।

ভানু এলে তাকে দেখে সরস্বতী কেঁদে ফেলল, ভানুদাদা!

অনন্ত বলে, লোকটাকে বসতে দে, পুজোর পরে এলো।

ভানু বলল, তুমি চোদ্দো পিদিম দেবে না ঘরে?

সরস্বতী বিনবিন করে, সব তো সে করত।

নেই যখন পিদিম তো জ্বালাবে।

কেনে জ্বালাব, ফুঁসে ওঠে সরস্বতী, কেনে জ্বালাব ভানুদাদা, কী হবে জ্বালায়ে, মোর ভিটে আন্ধার ইঁই গেছে, উ তো বাপ, বাপের তো পেটে ধরতি হয় না, ও কুন্তি তোরে কীভাবে পেটে লিয়ে ঘুরতাম মা।

ভানু বলল, যদি পিদিম না দাও, তার অকল্যাণ হবে।

কার, মেয়্যার?

হ্যাঁ, বাপ-মা যা করে সব তো ছেলেমেয়ের জন্য।

মেয়্যা নাই তো তার কল্যাণ কীসের?

ভানু আচমকা গর্জে ওঠে, নাই মানে, বেঁচে নাই?

কথাটায় কুঁকড়ে গেল সরস্বতী। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে ভানুর মুখের দিকে। মুখখানি দেখে ভানুর কষ্ট হয় খুব। বুক ভেঙে যায় যেন। মনে হয় এখনই ফিরে গিয়ে পঞ্চম ঠাকুরকে টেনে নিয়ে যায় থানায়। পঞ্চম ঠাকুরকে দাঁড় করায় দীঘা বাজারে। সর্বসমক্ষে তার কীর্তি ফাঁস করে দেয়। লোকে ক্ষেপে উঠে পঞ্চম ঠাকুরকে মেরেই ফেলুক। সরস্বতীর শূন্য চোখদুটি থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে। ভানু বোঝে কথাটা ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। সে শূন্য আকাশের দিকে তাকায়। এরই ভিতরে আকাশ থেকে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। হেমন্তের গোধূলি, হিমহিম ভাব জাগতে আরম্ভ করেছে সবে। সরস্বতী উঠে গেছে। তার স্বামী প্রদীপ এনে রেখেছিল, সলতে পাকিয়েছে সে দুপুরে বসে। তেলের দাম খুব, তবু তো এনেছে কুন্তির বাবা। প্রদীপগুলো একটি একটি করে বাইরে নিয়ে এলো সরস্বতী। উঠোন, দাওয়ার কোণে, দুয়ারে সাজিয়ে রাখতে লাগল নিঃশব্দে।

অনন্ত বলল, নুনের কারবার শেষ, আর করবনি।

কেডা করবে, যে খাটত সে নাই। প্রদীপের মুখে দেশলাই ঠুকতে ঠুকতে বলল সরস্বতী। প্রদীপটি জ্বলল, পৃথিবী আলোকময়ী হলো। জ্বলন্ত প্রদীপ হাতে সরস্বতী অন্য প্রদীপগুলোর কাছে গেল। একটি একটি করে জ্বালাল। চোদ্দোটি প্রদীপ জ্বলল পর পর। হাতের প্রদীপটি নিয়ে সরস্বতী তুলসীমঞ্চে রাখল। গলায় আঁচল টেনে গড় করে প্রণাম করল, মোর মেয়্যাটি যেন ভালো থাকে, কল্যাণ হয় যেন উয়ার।

ভানু দাস দেখল প্রদীপের আলোয় গৃহখানিতে যেন গ্রহতারার শোভা লেগেছে। তাকে অনন্ত জল বাতাসা দিল। ভানু ঘুরে ঘুরে দেখছিল, গৃহখানিতে যেন লক্ষ্মীশ্ৰী এসেছে। এর আগে, সেই কলকাতা থেকে ফিরে কদিন যখন ছিল, কী দশাই না ছিল এ ভিটের। ভানু দেখল কুন্তির মায়ের অঙ্গে নতুন বস্ত্র। ভানু দেখল চুলেও তেল।

অনন্ত বলল, চা করবা?

সরস্বতী ঘর থেকে নতুন হারিকেন বের করে। হারিকেনের পলতেতে আগুন দিয়ে চিমনি লাগিয়ে দিতেই উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ে। ভানু দেখল হারিকেনের চিমনি ঝকঝক করে মোছা। সরস্বতী নিঃশব্দে হারিকেন হাতে রান্নাশালে ঢোকে। ভিতর থেকে একটি স্টোভ বের করে।

কত নিল স্টোভটা? ভানু জিজ্ঞেস করে।

অনন্ত বলে, দেড়শ টঙ্কা, দুটা মানুষ, ই স্টোপে হই যায়।

ভানু দেখল স্টোভ জ্বালিয়ে নীল আগুনের ওপর সসপ্যান বসায় সরস্বতী। ভানু দাওয়া থেকে উঠোনে নামে। আকাশে তাকায়। সেই আকাশ! যে আকাশ ছিল বোশেখে, ফাল্গুনে, শুধু বদল হয়েছে কিছু নক্ষত্রের। তারা জায়গা বদলেছে। উত্তর আকাশের ধ্রুবতারাটিকে চোখে পড়ে। জ্বলজ্বল করছে। আকাশময় তারার মেলা। সব তারা ফোটেনি। তবু কম নয়। ভানু দুহাত আকাশে তোলে?

সরস্বতী ডাকে, রহি যাবু তো ভানুদাদা?

ভানু থাকবে। ভানু দেখছিল আগেরবারের চেয়ে এ সংসারের হাল এবার যখন ভালো, রাতে থাকতে কোনো অসুবিধে হবে না। চা করে কাপ প্লেট সাজিয়ে সামনে রেখে সরস্বতী স্টোভ নিভিয়ে অন্ধকারে নামল। ভানু দাস দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনল, গভীর, দেহের গভীর, গভীর থেকে উঠে আসা। ভানুর মনে হলো অন্ধকারে পৃথিবী নিঃশ্বাস ফেলল। ভানু আকাশে তাকায়, তারাগুলো জলবিন্দুর মতো ফুটে আছে আকাশের ঘন নীল চালচিত্রে। ভানুর মনে পড়ল মেয়েটির কথা। এমন শান্ত সংসার মেয়েটি দেখেনি। সে যখন ছিল এই ভিটে বাড়ি, এই সংসার, সংসারের মানুষজন, অনন্ত আর সরস্বতী ছিল হতশ্রী। ভিখিরির দশা ছিল লোকটার। মেয়েটি কখনো দেখেনি তার মায়ের চুলে তেল, মায়ের গায়ে নতুন বস্ত্র, ঘরে নতুন হারিকেন, নতুন স্টোভ।

ভানু দাস দেখছিল চোদ্দোটি প্রদীপ যেন আকাশ থেকে নেমে আসা চোদ্দোটি তারা। প্রদীপের আলো কাঁপছে মৃদুমন্দ বাতাসে, আলো দুলছে উঠোনে। ভানু চায়ের কাপ রেখে উঠোনে নামল, বলল, দোকানটা লাগায়ে দাও ভালো করে চেষ্টা করো দীঘায় জায়গা নিতে, নতুন দীঘাতেও যদি পাও, তাতেও খুব লাভ।

অনন্ত বলল, হ্যাঁ, দোকানটার নাম দেব, কী নাম দেব কহ দেখি ভানুবাবু?

ভানু বলল, পরে ভেবো।

সাইনবোড তো লাগাব।

পরে ভাবা যাবে। ভানু এড়িয়ে যেতে চাইছিল, কেননা সে টের পাচ্ছিল অনন্ত তার মুখ দিয়ে মেয়েটার নাম শুনতে চাইছিল। মেয়ের নাম লিখবে সাইনবোর্ডে। ভানু মাথা দুলিয়ে বলল, আগে দোকান চালু হোক, পরে ওসব ভাবা যাবে।

সরস্বতী বলল, ভানুদাদা, কলকাতা যাবে?

কেন? ভানু ঘরে তাকায়, এবার সে বুঝতে পারে ভিটেতে শান্ত ভাব, লক্ষ্মীশ্ৰী ফিরলেও যে চাপা বেদনাটি রয়েছে তার ভার বড় বেশি। কী করে থাকবে ভানু এখানে? ভানুর মনে পড়ছিল কুন্তির কথা। হতশ্রী মেয়েটি, চুলে তেল নেই, রোদে পুড়ে মুখ কালিবর্ণ, মেয়েটি যেন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দেখছে তার মা-বাবাকে।

সরস্বতী বলল, বাড়িটা দেখে আসি আবার।

কী হবে, মেয়ে তো ফিরবে।

কী কহিলে? প্রায় ছুটে এলো সরস্বতী তার সামনে।

হ্যাঁ, ফিরবে তো। ভানু দাস ঢোক গেলে।

কবে ফিরবে ও ভানুদাদা?

ভানু বলল, ফিরবে, দীঘার সমুদ্র ও লোকের খুব ভালো লাগে।

হতাশ হলো সরস্বতী, বলল, একবার যাই, দারোয়ানকেও তো জিগাস করা যাবে মেয়্যা কেমন আছে, জ্বালাব যে প’দীপ, কেনে জ্বালাব কহ দেখি ভানুদাদা, মেয়্যারে যদি না দেখি মনে আনন্দ থাকে?

ভানু চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে ঘাড় উঁচু করে। সরস্বতী অন্ধকারে বিনবিনিয়ে বলে যাচ্ছিল বুকের কথাগুলো। ভানুর চোখ এতক্ষণে ছলছল করে উঠল। মেয়েটি নেই এ বাড়িতে, কিন্তু যেন বিপুল অন্ধকারের মতো ছেয়ে আছে চারপাশে সমস্ত বিন্দুগুলো। অন্ধকারে বিষাদে ভরা মুখখানি দেখতে পায় ভানু। ভানু টের পায় না নিজের অজান্তে তার চোখ থেকে জল জড়িয়ে ভিজে যাচ্ছে বুক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *