পঁয়ত্রিশ
ভানু ঘুরছে। না ঘুরে করবে কী? প্রেম মদনানির কাছ থেকে ফিরে ভানু উধাও হয়ে গিয়েছিল আবার। ঘোড়ার খোঁজে, না অন্য কারণে তা ভানুই জানে, শ্রীপতি জানে না। শ্রীপতি মাইতি বিরক্ত হয়ে উঠেছে ক্রমশ। ঘোড়ার আশা ছেড়ে দিচ্ছে। সে যখন ‘ঘোড়া যায় যাক’ বলে গাঁজার কলকেতে টান মারে, তখন বেঙা মাথা নেড়েছে, তা হতে পারে না, ঘোড়া ঘাবে কেন, অশ্বটি হলো মাইতি বংশের সব, ওই অশ্বের বাপ ঠাকুরদার পিঠে চেপে মাইতিবাবুর বাপ নন্দকিশোর মাইতি কত পয়সা করেছিল দশ গাঁয়ের লোক তা জানে, ছেড়ে দেবে তাকে?
শ্রীপতি তখন একটু থমকেছে। ঠিক কথাই তো বলছে। নন্দকিশোর মাইতি তার যৌবনকালে অশ্বের ওপর থেকে নামত না। তখন সমুদ্র তো এখানে নয়। আরও দূরে, সেই যেখানে আসল দীঘা মৌজাটা জলের ভিতর ডুবে আছে, সায়েব বাংলোটা ভাটার সময় সমুদ্রের ভিতরে যেখান থেকে মাথা তুলত। তা মাইল দেড়েক ভিতরে হবে।
দীঘা নামটি রয়ে গেছে। মৌজাটা সমুদ্রের তলায়। এখন যাকে দীঘা বলে তা হলো গোবিন্দবসান, নয়াবসান আরও সব মৌজা। তখন হোটেলই বা কোথায়, ট্যুরিস্টই বা কোথায়? পৌষ সংক্রান্তি ছাড়া সমুদ্রে নামত কে? হ্যাঁ, চৈত্র সংক্রান্তিতে চন্দনেশ্বর যাবার পথে গা ঠাণ্ডা করে পুণ্য অর্জন করে যেত লোকে। ছিল শুধু ওই নাড়াজলের রাজার বাড়ি।
অনেককাল আগে শ্রীপতির বাবা নন্দকিশোর তার যৌবনকালে ঘোড়ার পিঠে চেপে কম উপার্জন করেছে! তার আগে নন্দকিশোরের বাবা কৃষ্ণকিশোর! এই ঝাউবন, বালিয়াড়ি, কেয়াঝোপ, খেজুরগাছ, তালবনের দেশে স্বাধীনতাই বা কী, ব্রিটিশ আমলই বা কী! পুলিশ! ব্রিটিশ আমলেও তো পুলিশ এ দেশীয় চাষার ছেলে। নন্দকিশোর, কৃষ্ণকিশোর ঘোড়ায় চেপে হাটে হাটে ঘুরত। শ্রীপতি শুনেছে তার বাবা ঘোড়ার পিঠ থেকে নামত না। ঘোড়ার পিঠে বসেই হাটে পৌঁছে হাঁক মারত, ভীমাচরণ, লবীন, কাত্তিক হে!
তারা ছিল খাতক, নন্দকিশোর মহাজন। নন্দকিশোর ঘুস আদায়ে হাটে যেত। লম্বা পাকানো গোঁফ, নীল পাগড়ি, চোগা চাপকান। তার বাবাকে দেখতে ছিল কী! ঘোড়ার পিঠে বসে হাঁক মারা, ঘোড়া থেকে না নামা, এই ধরনটা সে শিখেছিল সাহেবদিগের কাছ থেকে। কাঁথি থেকে প্রজা দমনে ম্যাজিস্ট্রেট সায়েব আসতেন ঘোড়ায় চেপে। কে কোথায় স্বদেশি করছে, নুন মারছে সেই খোঁজে। গরিব মানুষের ভাগ্য কী! যে মাটিতে তারা দাঁড়িয়ে আছে সে মাটিতে ম্যাজিস্ট্রেট সায়েব নেমে কথা বলেন কী করে? যতক্ষণ তিনি ঘোড়ায় ততক্ষণ তাঁর প্রতাপ। অশ্ব যেন মানুষের অতিরিক্ত শক্তি দেয়। ঘোড়ার গুণই এই। পিঠে উঠলেই রাজার মেজাজ।
আর ঘোড়াবেচা মাঠ! সাঁতরাপুরের পনেরো বিঘে জমি তো এসেছিল একটা ঘোড়ার বিনিময়ে। শোনা কথা। শ্রীপতির তখন জন্ম হয়নি। তার ঠাকুরদা কৃষ্ণকিশোর একটা সাদা ঘোড়ায় চাপতেন। সেই ঘোড়া দেখে পাহাড়িবাবুদের পছন্দ হয়। ফলে সেই ঘোড়া ওঁদের দিয়ে বিনিময়ে পনেরো বিঘে ধানজমি পান কৃষ্ণকিশোর। সেই মাঠ গোড়াবেচা মাঠ নামে চিহ্নিত। ঘোড়াবেচা মাঠের সবটাই প্রায় বেচা হয়ে গেছে, আছে একটুখানি। ওটা থাকুক। শ্রীপতি বেচবে না।
বেঙা বলে, মোকেও কুছু দেন ছিপতিবাবু, মু যাই অশ্ব খুঁজতা।
একা যাবি?
না, সায়েবকে লিয়ে যাব না হয়।
তোর বউ?
উকেও লিয়ে যাব না হয়।
শ্রীপতি হাসে, মোকেও লিয়ে চ তাহলে, ঘোড়া খুঁজবে ভানু, ভানু দাস।
কেনে আমরা পারি না? বেঙা বলে।
না পারিস না, ভানু হলো যে ঘোড়াওয়ালা ছন্দক, কি বুঝলি? কিন্তু ভানু গেল কোথায়?
কী জানি বাবু! বেঙা মাথা নাড়ে, বাবু, সায়েব যে যাবে না বলে।
যাবে না মানে?
বলে, এ জীবনের মতো ইখেনে থাকি যাবে।
উ সব এমনি বলে, ভানুটা গেল কোথায়?
বেঙা বলে, সায়েবের মায়া পড়ি গিঁইছে ই জায়গায়।
পড়ুক, ভানু কোন দিকে গেল ঘোড়া খুঁজতে বল দেখি?
বেঙা হাসে, পুব দিকে, যেদিকে সূয্যি ওঠে।
এই ঘরের কোন দিকটা পুব? মাথা ঝিমঝিমে শ্রীপতি জিজ্ঞেস করে।
বেঙা হাসে, সকালে বলা যাবে।
কেন?
সূয্যি যেদিকে ওঠে ওইটা পুব হবে, বলে বেঙা দোলে, ইখন অন্ধকারে সায়েবও কহি পারবেনি।
শ্রীপতি মাথা নাড়ে। কথাটা ঠিক। যেদিকে সূর্য ওঠে সেইটা পুব, রাতে তো সূর্য ওঠে না। তা হোক, ভানু গেছে নাকি পুব দিকে, অন্তত বেঙা তাই বলছে। পুব দিকে কী আছে? বেঙা কি জানে? জানে বেঙা। হিজলি, মসলন্দি, দৌলতপুর, দরিয়াপুর, রসুলপুর, বেগমশাহী। জানল কী করে বেঙা? ওদিক থেকেও নৌকো আসে মাছ ধরতে। তখন হাঁক মেরে মেরে জানা যায় কোন গাঁ থেকে কে এলো।
বেঙা আবার বলে, মাইতিমোশায় মোরে টঙ্কা দেন, অশ্বর খপর লিয়ে আসি।
শ্রীপতি হাসে, ওটা ভানু ছাড়া কেউ পারবে না।
বেঙা বলে, উটার খুঁজে যদি বাহির হই, মন শান্ত থাকে, সায়েব বোষ্টম মোর ঘর দখল করি নিইছে, মু কুথায় যাই?
সত্যিই থেকে গেল সায়েব? শ্রীপতির মাথা ঝিমঝিম করে। কী সব্বোনাশ! কোথাকার সায়েব কোথায় এসে থেকে যাবে! তার পক্ষিরাজও কি এমনি কোথাও রয়ে গেছে? সায়েব এখানে আছে, নিজের দেশে নেই। সেখান থেকে উধাও হয়ে গেছে। তাকেও তো খুঁজে বেড়াচ্ছে কেউ না কেউ। শ্রীপতি উঠে দাঁড়ায়। ভালো লাগছে না। ভানু এসেছিল শোনা যাচ্ছে। কাল রাতে নেমেছে দীঘায়। সঙ্গে নুনমারা অনন্ত আর তার বউ ছিল। কথাটা শ্রীপতি বাজারের সিগারেটওয়ালার কাছে শুনেছে। সেই ভানু গেল কোথায়? শুধু ভানু কেন, নুনমারার মেয়ে কুন্তি! তার কথা তো বলেনি গুমটিওয়ালা। কুন্তি ছিল না তো গেল কোথায়? আহা, মেয়েটি বেশ! বলে বর্ণহীন ঘোড়া। বেশ মনে আছে শ্রীপতির। ভানু পাগল নাকি? সারা দিন দেখা নাই। তাহলে কি পক্ষিরাজের খোঁজ পেল?
বেঙা তুই যা, আমি বেরোব।
তুমার সাথে যাই মোশায়।
না, তুই যা, ভানুকে খুঁজে আন।
ভানু! ভানুদাদারে খুঁজতি হবে?
হ্যাঁ।
ঘোড়া খুঁজা হবেনি?
ভানুদাদা ঘোড়া খুঁজছে, তুই ভানুদাদারে খোঁজ। শ্রীপতি ঘর থেকে বেরোয়। তার পিছনে পিছনে বেঙা আসে, তাহলে কটা টঙ্কা দাও।
টঙ্কা লাগবে?
না হলে খুঁজব কী করি কহ মোশায়।
শ্রীপতি পকেট থেকে একটা নোট বের করে আনে অন্ধকারে। শুকনো নেশায় সব ভোলেভালে হয়ে যায়। দশ, না পঞ্চাশ, না একশ বোঝা যায় না। বেঙার হাতে নোটটা গছিয়ে শ্রীপতি হনহন করে বেরিয়ে পড়ে।
শ্রীপতি যায় কোথায়? না, সিগারেট গুমটিওয়ালার কাছে গিয়ে শুনবে ঠিক কারা কারা নেমেছিল শেষ বাসে, সেই রাত বারোটা নাগাদ। ভানু, নুনমারা অনন্ত আর তার বউ। মেয়েটা কোথায়? শ্রীপতি এখন মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে চায়। সেদিন গেল মীরগোদা। বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফেরত এলো। কোকিলা দাসী কোথায় গিয়েছিল কে জানে? অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে শ্রীপতি যখন বাজারের প্রায় মুখে, তাকে ধরে ফেলেছে ভারতী, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
কেন? শ্রীপতি দাঁড়িয়েছে।
ভারতীর মুখটা কালো হয়ে যায়। সে বিড়বিড় করে, জিজ্ঞেস করব না? না মানে, শ্রীপতি অপ্রতিভ হয়। রাস্তায় লোক কম, কেউ দাঁড়াচ্ছে না।
তুমি এর একটা বিহিত করো।
কীসের?
তোমার মা-বউ…, তুমি জানো না?
শ্রীপতি দমে যায়। আবার কী হলো? সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
কী হয়েছে তুমি শোনোনি? বলতে বলতে ভারতী তার কোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শ্রীপতি হতভম্ব হয়ে পিছনে পিছনে এগোয়। এখানে দাঁড়িয়ে এই রকম কথা বলা যায় না! কণ্ঠস্বর চড়ে গেলে লোকজন মজা দেখতে দাঁড়িয়ে পড়বে।
ঘরে ঢুকেই ভারতী শ্রীপতির জন্য অপেক্ষা করে, শ্রীপতি আসা মাত্রই দরজটা বন্ধ করে দেয়। তারপরে দুটো হাতে মুখ ঢেকে নিশ্চুপ তক্তপোশের ওপর বসে পড়ে।
কী হয়েছে?
বলে কী হবে! তোমার মা-বউ আমাকে যে অপমানটা করে গেল, তুমি জানো না?
কই না, আবার কী হলো! ওদের সঙ্গে তোমার দেখা হলো কবে?
তুমি কিচ্ছু জানো না? ভারতী ফোঁপায়।
সত্যিই না, কীসের অপমান?
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম কোয়ার্টারের সামনে, সেই সকালে…।
শ্রীপতি বুকের ওপর আড়াআড়ি দুহাত রেখে সব শুনতে থাকে। ভারতীর কথা ধীরে ধীরে শ্রীপতিকে অবসন্ন করে দেয়। সে নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ সকালে ভারতী দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার মুখে। কয়েক দিন শ্রীপতিকে দেখেনি। ওর ভয় হচ্ছিল, অসুখবিসুখ হলো নাকি! তখন শ্রীপতির মা আর বউ যাচ্ছিল চন্দনেশ্বরের মন্দিরে বোধহয়। হাতে পুজো দেয়ার ডালা। ভারতী ওদের দেখে হেসেছে, এগিয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করেছে মা কেমন আছেন? মিতা তুমি! মন্দিরে যাচ্ছ? আমার ডিউটি না থাকলে যেতাম, মানত আছে একটা।
তখন ক্ষেপে উঠছে শ্রীপতির বউ। হঠাৎই ক্ষেপে উঠল, তুমি গেলে তো পুণ্য হবে না, পাপ হবে।
ভারতী হাঁ করে চেয়ে ছিল শ্রীপতির মায়ের দিকে। ঠিক বুঝতে পারেনি। সে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করেছে, মা তোমার ছেলে ভালো আছে?
সে খবর তুমি জানো, কী গুণতুক করছে, শিকড়-বাকড় খাইয়েছ, ভালো কি থাকার জো আছে!
ভারতী কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করেছে, এ কথা কেন?
বলব না, লোকটাকে যে খেয়ে ফেলেছিস তুই! চট করে শ্রীপতির বউ তুই- তোকারিতে নেমে গেছে।
ভারতীর মুখটা কালো হয়ে গেছে, সে সেই অবস্থায় আবার বলেছ, কী বলছ তুমি মধুমিতা?
ভারতী বিড়বিড় করছে, তোমার বউ শেষ অবধি আমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, আমার তো কোনো দোষ নেই, ভিড় জমে গেছে তখন রাস্তায়, সব্বাই দেখল, আমি কী করেছি বলো?
ভারতী থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। ওর গলার স্বর বসে গেছে। ফোঁপাচ্ছে। ভেঙে ভেঙে বলছে, তোমার বউ বেশ্যা বলে চিৎকার করতে লাগল!
তুমি জিজ্ঞেস করতে গেলে কেন?
তুমি যে আসছ না, আমার ভয় করছিল, ভাবলাম অসুখবিসুখ হলো কি না, তুমি এর একটা বিহিত করবে না?
শ্রীপতি নিঝুম বসে থাকে। ভারতী নিজের মনে কথা বলে, চুপ করে যায়, আবার বলে। বিনবিন করতে থাকে। এইভাবে সময় যায়। শ্রীপতি মেঝেতে হাঁটু দুমড়ে বসে আছে।
নেশাটা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠেছে। ভারতীর কথা সে ধরতেই পারছে না যেন। কত সময়, কতকাল ধরে একই কথা বলে যাচ্ছে ভারতী। শ্রীপতির এখন আর ভারতীকে ভালো লাগে না। কোকিলা বধূ রয়েছে। আর নুনমারার মেয়েটা! আহা, কী সুন্দর! কিন্তু এসব কি ভারতীকে বলতে পারবে সে? পারবে না। ভারতীর কথাই তাকে শুনে যেতে হবে।
অনেকক্ষণ বাদে ভারতীর একটা কথা কানে যায়, তুমি কি থাকবে?
শ্রীপতি ঘাড় হেলায়। ভারতী ভাত বাড়ে। শ্রীপতি মুখ নিচু করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খায়। ভারতী বারবার জল খেয়ে উঠে পড়ে। শ্রীপতি কিছু বলতে পারে না। কী বলবে? ভারতীও আর কথা বলে না ওই বিষয়ে। শ্রীপতির চোখ ভেঙে আসছিল। সে আস্তে আস্তে ঢলে পড়ে।
ভারতী তখনও জেগে, শ্রীপতির পাশে কুঁকড়ে মুকড়ে শুয়ে বিড়বিড় করছে,…যদি এমন হয় তো দুজনের দেখা না হওয়া বোধহয় ভালো।
তন্দ্রাচ্ছন্ন ভারতীর মাথাটা ঝুলে গেছে একধারে। চোখদুটো কোটরে। মুখময় বিষাদ, অপমানের কালি। বাইরে সেই সময় দুরন্ত বৃষ্টি ছুটে এলো সমুদ্র থেকে। বৃষ্টির ভিতরে ঘুমের ঘোরে ভারতী যেন কথা বলে। বৃষ্টির ফোঁটার মতো ভারতীর কথা ঝরে পড়ে।
ভারতীর কথা শ্রীপতি শোনে। শ্রীপতিকে ভারতী বোঝে না। দুজনে দুজনের কাছে এই আধো জাগরণে কখনো অস্বচ্ছ, কখনো স্বচ্ছ হয়ে থাকে। শ্রীপতির কানে ভারতীর কথাগুলো প্রবেশ করছিল ধীরে ধীরে। তারপর সেই কথা তার ঘুমের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। কথা উঠছে যেন মাটির গভীর থেকে। ভারতীর মুখের রেখায় বহুকালের বহু বৎসরের শ্রম ঘাম অসম্মান জড়িয়ে। ঘুমন্ত মানুষের ঠোঁট থেকে কী এক শব্দ যেন উঠে আসছিল।
ভারতী : আমার মা-বাবা দুজনেই তো ছিলেন। আমি তাঁদের ভালোবাসার সন্তান নই বোধহয়। কেউ কেউ আন্দাজে বলত আমার মা সুন্দর, কেউ বলত বাবা। আমার চেহারা দেখে বাবা-মার চেহারা আবিষ্কার করার চেষ্টা করত।
শ্রীপতি : আমার ঠাকুরদার বাবা লেঠেল ছিল। লেঠেল নয় জলদস্যু। সমুদ্র নদীতে সওদাগরি নৌকো ঘিরে ফেলত। সেই লেঠেল ধরে এনেছিল এক বাগদি মেয়েকে। সব্বাই তা জানে। খুব ঠাণ্ডা আর সুন্দরী মেয়েটা। সে আমার ঠাকুরদার বাবার রাখনি হলো। আমরা এককালে যা ইচ্ছে করতাম। যা ইচ্ছে…যা ইচ্ছে। কেউ বলে আমি খুব ভালো। খুব দয়া। কেউ বলে আমি ঠাকুরদার বাবা, তার বাবার মতো। যা ইচ্ছে তাই করব। এক মেয়েমানুষ বেশি দিন পোষায় না।
ভারতী : তেরো বছর বয়সে একবার খারাপ কথা বলেছিলাম, শিখিয়ে দিয়েছিল উঁচু ক্লাসের মেয়ে, পুরুষলোকের সঙ্গে মেয়েলোকের সম্পর্ক নিয়ে। তারপর! সুপারিনটেনডেন্ট সুলতা দত্ত তাই শুনে আমাকে সব মেয়ের সামনে জামাকাপড় খুলিয়ে চাবুক…চাবুক। আহ-আহ, আমাকে বেশ্যা বলেছে, আমি তো শুধু তোমার সঙ্গে থাকতে চাই।
শ্রীপতি : আমাদের বাড়িতে একটা ছেলে আসত। তার নাম কেষ্ট। পুতুল বেচত। কুমারপাড়ার মেয়ে, কেষ্টর মা চঞ্চলা খুব সুন্দরী ছিল। কেষ্টকে আমার বাবার মতো দেখতে ছিল। তাতে কী হয়েছে? চঞ্চলা বাবার মেয়েমানুষ। কোকিলা বধূকে যদি নিজের মেয়েমানুষ করতে পারতাম! তোমাকে আমার ভালো লাগে না এখন।
ভারতী : আমি শুধু তোমার সঙ্গে থাকতে চাই।
শ্রীপতি : এমনি এমনি মানুষ থাকতে পারে? পরিচয় চাই, তুমি মধুমিতা হবে কী করে?
ভারতী : মানুষের কাছে মানুষ থাকবে, আমার বড় ভয় করে, পিছনটা অন্ধকার। বাবা অন্ধকার, মা অন্ধকার। আমি থাকব তোমার কাছে। একা একা থাকতে পারি না। ভয় করে, ভীষণ ভয়!
শ্রীপতি : পরিচয় ছাড়া মানুষকে কেউ থাকতে দেবে না জগতে।
দুজনে খুব স্পষ্ট কথা বলছিল। দুজনে দুজনের কথা ঘুমের ঘোরে শুনতে পাচ্ছিল। শ্রীপতি কামনা করছিল কোকিলা বধূকে। ভারতী আশ্রয় চাইছিল। শ্রীপতি বলছিল, ভারতী বরং বদলি নিয়ে যাক। ভারতী তার কাছে পুরনো হয়ে গেছে! পুরনো মেয়েমানুষ ভালো লাগবে কী করে?
ভারতী বলে, তোমার পক্ষিরাজ কি অন্য মালিক পেয়েছে?
কেন?
তবে সে পালাল কেন?
শ্রীপতি : হারিয়ে গেছে ঘোড়াটা।
ভারতী : কেন হারাল?
শ্রীপতি : জানিনে।
ভারতী : পুরোন মালিক ভালো লাগে না তাই পালাল?
শ্ৰীপতি : না।
ভারতী : হ্যাঁ, নতুন মেয়েমানুষের মতো নতুন মালিক খুঁজে নিয়েছে?
শ্ৰীপতি : না।
ভারতী : তাহলে গেল কোথায়? চোদ্দবেড়িয়ায় যায়নি, কোথাও যায়নি তো গেল কোথায়?
শ্রীপতি : কোকিলার কাছে।
ভারতী : কোকিলা কে?
শ্রীপতিকে এবার বলতে হবে কোকিলার কথা। সেই মেয়েমানুষটাকে যে করে হোক সে খুঁজে আনবে। না হলে নুনমারার মেয়ে। ভারতী সব জানুক। না জানলে বদলি নেবে কেন?
ভারতী জিজ্ঞেস করে, তোমার ঘোড়াটাকে দেখত যে সে কেমন?
কেন?
তোমার কি সন্দেহ হয়?
হয় না, ও ঘোড়া অন্তঃপ্রাণ, ঘোড়া পাগলা, কী সব বলে, বোঝা যায় না।
কন্থক বলে তোমার পক্ষিরাজকে, কন্থক! কী অদ্ভুত না!
ভানুই অদ্ভুত, বলে কিনা ও ছন্দকের স্বপ্ন দ্যাখে।
সেটা কী?
স্বপ্ন দেখেছিল ঘোড়ার পিঠে রাজপুত্র যাচ্ছে, পাশে ও হাঁটছে। ওই যেন সেই ছন্দক, কথাটা আমি জানতামই না, ও বলেছে, রাজপুত্রই হলো গৌতম, সংসার ত্যাগ করে ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিলেন।
কী আশ্চর্য! ও কি সত্যি বলে? না বললে আমি কি বানাচ্ছি?
কী যেন বলছিলে, কোকিলা না কী?
আর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না শ্রীপতির। ভানুর কথা তুলে ভারতী পরিবেশটা বদল করে দিল। আচ্ছা, পরজন্ম কি সত্যি? কী মনে হয়, সত্যি?
আমি তো জানি না। বলল ভারতী।
ও কি অনেক জন্ম আগে সেই সারথি ছিল, কন্থককে দেখত তো ছন্দক।
হাসে ভারতী, পাগলার কথা তুমি দেখছি বিশ্বাস করে ফেলেছ।
শ্রীপতি মাথা ঝাঁকায়। কিছুই বুঝতে পারছে না যে কেন পালাল ঘোড়াটা।