1 of 2

অশ্বচরিত – ২৮

আটাশ

বৃষ্টি যেমন নামল আচমকা, থেমেও গেল ধীরে ধীরে। কেমন একটা মায়াবি আলো জেগে উঠল চারপাশে। চোখদুটি সেই আলোয় আরাম পায় যেন। কী সুন্দর রং হলো চারদিকের! নরম, যেন ছোঁয়া যায়, ছুঁয়ে ফেললে সে রং হাতে লেগে যায় চোখের পাতায় লেগে যায় রঙের গুঁড়ো।

চা-দোকানি বলল, ঐদিন না আমরা বোমা ফাটিয়েছিলাম।

অ্যাটম বোমার কথা বলছ তো?

হ্যাঁ, ঐদিন মরুভূমির নিচে বোমা ফাটল না?

তাই তো, সেদিন বুদ্ধ পূর্ণিমাই ছিল বটে। ভানু বলতে বলতে বিস্মিত হয়, আশ্চর্য! এই যোগসূত্রটা মনে রাখেনি সে!

ঠিক ঐদিনই পালিয়েছিল ঘোড়া?

তাই তো জানি। ভানুর যেন ধন্ধ হয়, ঐদিনই তো!

তাহলে বলো দেখি কেন পলাল ঘোড়াটি?

ভানু অবাক। রাজপুত্রের জন্মদিন, পূর্ণিমা, পোখরানের মরুভূমিতে বিস্ফোরণ, ঘোড়ার পালানো—এসবে কি যোগাযোগ আছে? একটার জন্য আর একটা হয়েছে? বোমা না ফাটলে কি থাকত? কিন্তু ঘোড়াকে খবরটা দিল কে? ভানু মাথা ঝাঁকায়, বাতাসে খবর এসেছে। তেজস্ক্রিয় বাতাস! সেই বাতাস কি এতদূর আসবে? মরুভূমির বাতাস! বাতাসে খবর পেয়ে পক্ষিরাজ কি পোখরানের দিকে ছুটে গেল? কী থেকে যে কী হয় তা কে বলতে পারে? তবে মিলে তো গেছে। অন্যদিন তো পালায়নি, পালাল সেই পূর্ণিমার রাতে। মরুভূমি কেমন? ভানু তো মরুভূমি দেখেনি। তা কি মীরগোদার সমুদ্র? মরুভূমি কি আগে সমুদ্র ছিল? সমুদ্র মরে গিয়ে অত বালি! কে জানে? তবে এটা তো সত্য, যেদিন বোমা ফাটল সেদিন তার কন্থক উধাও, কী করে হয়?

ভানু বলল, বোমার সঙ্গে ঘোড়া পালাবে কেন?

বোমার খবরে ভয় পেয়ে উধাও হয়ে গেল।

কিন্তু উধাও হয়ে যাবে কোথায়?

চা-দোকানি বিজ্ঞের মতো বলে, পোখরান, বুদ্ধ পূর্ণিমায় বোমা ফাটল, তারপর পোখরানে যাবে না?

সত্যি, সত্যি ঘোড়াটা পালিয়ে গেল কোথায়?

বলছি তো মরুভূমিতে, ওফ কী গরম সেই বালি!

ভানু বিড়বিড় করে, কী করে গেল, সে যে অনেক অনেক দূর!

আবার বৃষ্টি আসছিল। গঙ্গার ওপর থেকে ডাকতে ডাকতে মেঘ আসছিল এদিকে। আবার মেঘ গর্জন শুরু হলো। বৃষ্টি নামল প্রবল ধারায়। ভানুর পিঠে এসে নামল বৃষ্টির পারদ রেখা! পিঠ ভিজতে লাগল।

চা-দোকানি ডাকল, আমার পাশে এসে বসুন।

না, বেশ তো রয়েছি, একটু ভিজি।

চা-দোকানি বলল, আর তো বোমা ফাটাচ্ছে না?

কী হবে ফাটিয়ে?

কিছু তো হবে, কিছুই যে হয় না।

কেন, বেশ তো রোদ উঠেছে, মেঘ করছে, বৃষ্টি হচ্ছে, ঠাণ্ডা বাতাস…।

চা-দোকানি খুকখুক করে হাসে, এসব কী হবে, সমস্ত দিন কত আয় জানেন ভানুবাবু, আচ্ছা মশায়, কী বলছিলেন যদি কাউকে চেনা মনে হয়, সে আগের জন্মের হতে পারে?

পারে। ভানু বলল, বাজাজ তো এলো না।

না আসতেও পারে।

কেন?

এমনি, সবকিছুর কি কেন হয়, হয়তো মনে হলো এখেনে না এলেও চলবে।

চলবে না কেন? ভানু পালটা জিজ্ঞেস করে।

কথাটা যেন শোনে না চা-দোকানি, বলল, একটু যুদ্ধ লাগুক, লাগছে না কেন?

কী হবে?

ভালো লাগে না, বিক্রিবাটা নেই, জিনিসপত্তর আগুন, তার ওপর এই যে আলো কুম্পানি, থাম্মাল পাওয়ার কাঁঠালবেড়ে ধ্বংস করে দিল, শোনা যাচ্ছে রাস্তার এপারও নেবে, এই দোকানটাও তুলে দেবে।

তার মানে?

সবটা ওদের হয়ে যাবে, দুপারে পাঁচিল, মধ্যিখানে পিচরাস্তা শুধু চলাচলের জন্য, পরে এ রাস্তাও বন্ধ করে দেবে।

কেন?

ইচ্ছে, এই জন্য আমি বলি যুদ্ধ হোক, যা হয় হোক।

ভানুর কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, কিন্তু চা-দোকানি বকবক করছিল। তার একটা খদ্দেরও নেই। তার মানে ভানু না এলে দোকানটা ফাঁকা থাকত এতটা দীর্ঘ সময়। বৃষ্টি আবার কমে এলো। আকাশের মেঘ এখনও গর্জে যাচ্ছে। কিন্তু কাছে পিঠে নেই সে। দূরে সরে যাচ্ছে। গঙ্গার ওপরে ভেসে যাচ্ছে। আবার সেই আলো ফুটল। বৃষ্টিধোয়া শূন্য প্রকৃতিকে হলুদ একটা আলো জড়িয়ে সবকিছু সুন্দর করে তুলেছে। ভানু দাস ঘাড় উঁচু করে চিমনির মাথা দেখছিল। কত উঁচু। আকাশের ভিতর ঢুকে গেছে যেন থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের চিমনিটা। তার গায়েও হলুদ আলোটা জড়িয়ে গেছে। বাতাস মোলায়েম, খুব নরম, ঠাণ্ডা। এদিকটা আগে আরও সুন্দর ছিল। কত গাছ, কত রকম পাখি, সব গেল কোথায়?

শুনে দোকানি হাসে, যাবে কোথায়, নেই আর, উড়ে গেছে।

কোন দিকে উড়ে গেল?

দিন রাত ছাই উড়ছে, তারা নদী পার হয়ে চলে গেল, আচ্ছা, বাজাজ লোকটা কি পাগলা?

কেন? ভানু ঝুঁকে পড়ে দোকানির দিকে।

বলে এ জায়গাটায় না এলে তার ঘুম হয় না।

সাধু মানুষ!

বলে, নদী দেখে ওর তেষ্টা মেটে না।

হ্যাঁ, সাধুর মতোই কথা।

বলে, সে নাকি পাঁচ-সাতশ নদী দেখেছে, রিফুজি তো, ভাসতে ভাসতে এসেছে।

ভানু বলল, তুমি কটা দেখেছ সুরেনবাবু?

লোকটা চমকে ওঠে, কী করে জানলেন আমার নাম?

বাজাজ বলেছিল।

কী বলেছিল?

তোমার কাছে খোঁজ করতে, মনে পড়ে গেল নামটা, এতক্ষণ মনে করতে পারছিলাম না।

নাকি, তুমি আমাকে চেনো? চা-দোকানি ঝুঁকে পড়ল, তুমি করেই বলি।

বলো, কিন্তু আমি কী করে চিনব তোমাকে?

ওই যে বললে আগের জন্মের চেনা।

আমি তো তোমাকে চিনতে পারছি না। ভানু বলে।

তবে নামটা মনে করলে কী করে ভানুবাবু? চা-দোকানি বলতে বলতে হাসে, তোমাকে খুব চেনা মনে হয়, চশমা খুললেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

কী দেখছ?

আলো।

কী আলো?

একরকম আলো, তোমার মুখখানাতে আলো মশায়, সত্যি কি তোমার ঘোড়া পালিয়েছে?

হ্যাঁ।

তারে খুঁজতে এলে এত দূরে?

হ্যাঁ।

আচ্ছা, বাজাজ অত নদী দেখেছে, আমি একটা মাত্তর, এইটা, কিন্তু মনে হয় কত দেখেছি, আগের জন্মে!

ভানু বলল, হতে পারে, বাজাজ তাহলে আসবে না?

না এলে ওর ঘুম হয় না, আচ্ছা এত যে আলো দেখি, মেঘ, রোদ, এত দেখেও আবার দেখতে ইচ্ছে হয় কেন?

কী জানি।

চা-দোকানি সুরেন কুণ্ডু বলল, দিনভর একা, এই সমস্ত মনে হয়, বাজাজ এলেও তো এখেনে বসে না, নদীর পারে চলে যায়, প্রত্যেক দিন দেখেও ওর আশ মেটে না, কেন?

সে তো বাজাজই জানবে। ভানু উঠে পড়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে।

চা-দোকানিও দোকান খালি রেখে ভানুর পিছনে পিছনে আসে। ভানু হাঁটতে হাঁটতে নদীর দিকে যায়। চা-দোকানি বলল, পার হয়ে যাবে?

না তো, কেন? ভানু ঘুরে তাকায়। চা-দোকানির মাথায় সাদায় কালোয় অবিন্যস্ত চুল, গাল ভর্তি না কাটা দাড়ি, চশমার কাচে ঢাকা ঘোলাটে চোখ, শীর্ণ শরীর, একটু বাঁকা দেহ। লোকটাকে চিনত ভানু, কিন্তু ভুলেই গিয়েছিল। কম দিনের কথা তো নয়। লোকটা মানে সুরেন কুণ্ডু আর তার চায়ের দোকানের কথা ভুলেই গিয়েছিল সে। ভুলেই গিয়েছিল সুরেন কুণ্ডু বলে কোনো মানুষ আছে এ পৃথিবীতে। তার চায়ের দোকানটা দেখার পরও সুরেন কুণ্ডুর কথা মনে পড়েনি। দোকানটাকে মনে পড়েছিল। দোকানটা ছিল, দোকান থাকলে তার মালিকও থাকবে, ছিল মনে হয়েছিল, এই পর্যন্ত। তারপর তো পূর্বজন্মের কথা মনে পড়তে লাগল। এমন চেহারা তো ছিল না, ছিল তাগড়াই যুবক। কবছরে দুমড়েমুচড়ে একাকার।

তোমার এমন চেহারা হলো কেন? ভানু জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারে ধরা পড়ে যাচ্ছে। মুখ ফসকে আসল কথাটি বের হয়ে গেছে।

দোকানি বলল, আরও হবে।

কী হবে? ভাঙবে।

কেন?

সুরেন কুণ্ডু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কবছরে কী হলো যে, দ্যাখো না ধোঁয়ায় শুধু ছাই, বুঝতে পারিনে দেহে ছাই পড়ে যায়, ঘরে যাও পুরু ছাই, আর বাতাস এক এক সময় এমন গরম! তুমি পার হবে কি না বললে না তো?

ভানু বলে, পার হব কেন?

তাহলে কি এমনি উঠে এলে গঙ্গার ধারে?

হ্যাঁ, নদীটা দেখলে বুক জুড়ায়।

বাজাজ এমন বলে, কিন্তু কতবার আর দেখবে নদী?

অবাক হয়ে ভানু বলে, যত ইচ্ছে।

শহরের চেয়ে নদী ভালো?

এ কীর’ম কথা?

থাম্মাল পাওয়ার প্রকল্পের চেয়ে নদী ভালো?

ভানু বলল, এ কথার মানে কী?

এই আলো কুম্পানি কে তৈরি করল? মানুষ তৈরি করল!

কলকাতা শহর?

মানুষ করল।

বজবজ শহর?

মানুষ করল। ভানু অবাক হয়ে যাচ্ছিল উত্তর দিতে দিতে।

মানুষ যা করে তাতে কি মানুষ সুখে থাকে না?

কী বলো তুমি সুরেন কুণ্ডু?

থাম্মালের বড় বড় অফিসার আছে, সাঁই সায়েব, নিয়োগি সায়েব, তারা নদীর ধারে এসে দাঁড়ায়ে যায় কিছুক্ষণ, কেন দাঁড়ায়?

কী জানি! ভানু দেখছিল ভরা গঙ্গা। পূর্ণ জোয়ার চলছে। মাঝ নদীতে উড়ন্ত পাখির মতো ইলিশের নৌকো। হলুদ আলো ঘন হয়ে ঝরে পড়ছে জলের ওপর। বুক আলগা করে শ্বাস নিল সে।

কেন দাঁড়ায় তা তো জানো না ভানুবাবু, বাজাজ জানে, সে বলে মানুষ যা করেছে সবেরই বিপক্ষে হয়ে যায় মানুষ।

কীরকম? কৌতূহলে ভানু জিজ্ঞেস করে।

দ্যাখো না ভানুবাবু, এত যে কলকারখানা গড়ে মানুষ, তা কেউ দেখতে যায়?

যায় না?

তুমি যাও, না তোমার ঘোড়া যায়?

যায় না?

না যায় না, যায় সেই সমুদ্দুর, পাহাড়, জঙ্গলে, মরুভূমিতে, যা ভগবানের দেয়া, নদী পর্যন্ত দেখতে আসে, কিন্তু কলকারখানা, শহর কিছুই দ্যাখে না, পালিয়ে আসে বিরক্ত হয়ে।

তুমি দেখছি জানো অনেক। ভানু বলল।

বাজাজ বলে, পরে আমি ভেবে দেখলাম সবই সত্যি।

সত্যিই তো। ভানু গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ভাবল, ভগবান কী দিয়ে গড়ে এই সব? কোন মায়া, কোন কুহক জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে, যে বারবার মানুষ ছুটে যায়! নদী না দেখলে, সমুদ্র না দেখলে, পাহাড়, জঙ্গল না দেখলে মানুষের চলে না। কেন চলে না? অথচ সেই নদী পাহাড়, সমুদ্র উপকূল নষ্ট করতে মানুষের কত উৎসাহ। বাতাস, রোদ, মেঘ, ছায়া, গাছপালা, ফুল এসবের মায়ায় মানুষ ছুটে যায় কতদূর, অথচ এসব কী করে বাঁচবে তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। ভানুর চোখের সামনে ভেসে উঠল চাঁদবালি, দে-পাল, কুসমাড়, দীর্ঘ সমুদ্রতীর। মোটা দানার বালি, শক্ত সৈকত, নীল জল আছড়ে পড়ছে সমস্ত দিন, সমস্ত রাত। যখন জ্যোৎস্না পড়ে! ভানুর মনে পড়ে জ্যোৎস্নায় গড়াগড়ি দিয়েছিল সে নেশালাগা প্রাণীর মতো। আনন্দ প্রকাশের ওর চেয়ে বড় ভাষা ছিল না তার। আহা, কী আনন্দ! বালির দানা জ্যোৎস্নার বিন্দু ধরে ঝলমল করে উঠেছিল যেন। একবিন্দু জলে, বালির দানায় যখন জ্যোৎস্নার এক বিন্দু পড়ে কীরকম হয়ে ওঠে সব! চাঁদবালির সমুদ্র! আহা সে কেমন সুন্দরী ছিল! এখন ছাই ঝরছে দে-পাল, কুসমাড়, মহাপাত্রপুরের সৈকতভূমিতে। ভীমাপুরের ভুবন বিস্তৃত ধানখেতও চলে যাবে। আর নায়েব রামচন্দ্র? তার কাজও শেষ হবে। সমস্ত রাত চাঁদবালি, বালিমুণ্ডার আকাশে আগুন ঝরে যাবে। ভানু দুটি হাত জোড় করে বিস্তৃত গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আছে, নদীর কি নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা নেই, গাছের, পাহাড়ের, সমুদ্রের, সৈকতের? মানুষ এক জায়গার বন কেটে দূরে যায় বন দেখতে। সে নিজে ভাবে এক, তার আত্মা ভাবে আর এক।

বাজাজ বোধহয় এলো না। বলল সুরেন কুণ্ডু।

ভানু বলল, কী ছিল এ জায়গা আর কী হলো!

করতে তো হবে, থাম্মাল না হলেই বা কী করে হবে?

ভানু বসে পড়ল মাটিতে, জানিনে, কিন্তু মানুষ দিন দিন অন্ধ হয়ে যাচ্ছে সুরেনবাবু, সাগর, মরুভূমি কিছুই রাখবে না।

সুরেন কুণ্ডু বলল, ভগবান কি শোধ নেবে না ভানুবাবু! মানুষ কি জানে না আকাশ, মাটি, সমুদ্র, নদী, জঙ্গল, মাঠ, ফসল সবই ভগবানের অংশ?

বসে বসে এই ভাবো?

কথাটা কি সত্যি নয়, পাহাড়, সমুদ্দুর, জঙ্গল, মরুভূমি, নদী, গাছপালা মাঠ, আলো বাতাস, এসব কি ভগবান না, যা দেখি তাই যেন ভগবান মনে হয়, সেই ভগবান চলে যাচ্ছে আমাদের সামনে থেকে তা টের পাও?

কী জানি, হয়তো। ভানু মগ্ন স্বরে বলল।

হয়তো মানে, তোমার ঘোড়াটা কি ভগবান ছিল না?

কী করে বুঝলে! ভানু চমকে ওঠে সুরেনের কথায়।

বাহ্! তারে দেখে আহ্লাদ হতো না?

হতো তো! ভানুর বুক ঝমঝম করতে থাকে ওই কথায়। আহা, কী সুন্দর ছিল রাজপুত্রের ঘোড়া কন্থক। সমুদ্রসৈকত দিয়ে ভাটার সময় যখন দৌড়ত কেশর ফুলিয়ে, লেজ তুলে, মনে হতো সে-ই যেন সব। সে আর নীল সাগর। মনে হতো নীল সাগর থেকে উঠে এসেছে সে, জীবন সাগরে মিলিয়ে যাবে। এই পৃথিবীতে সেই ঘোড়ার চেয়ে সুন্দর আর কে তখন? মনে পড়ে ভানুর, সেই চৌদ্দবেড়িয়া যত সুন্দর, কন্থক তত সুন্দর। চোদ্দবেড়িয়া ভগবান, কন্থকও ভগবান। ভানুর দীর্ঘনিঃশ্বাস অন্ধকারে ছড়িয়ে যায়।

সুরেন কুণ্ডু বলল, মনে হয় কি জানো ভানুবাবু, যা দেখে শান্তি হয়, তাই-ই ভগবান।

হবে তাই, তবে ঘোড়াটারে পেলে মনে শান্তি হতো, জন্ম-জন্মান্তরে একসঙ্গে আছি।

তার মানে ঘোড়াটা ভগবান, সে উধাও হয়ে গেল সেই দিন, যেদিন বোমা ফাটল পোখরানে, তাই তো? জন্ম-জন্মান্তর আছ মানে যেমন আছে নদী পাহাড় আর মানুষ তেমনি?

ঠিকই বলেছ।

যদি বলি সে টের পেয়েছিল বোমার খবর।

হতে পারে, সেও তো জন্ম-জন্মান্তর আছে।

শুনে যেন তাই মনে হলো।

তবে তারে কুহক করেছিল।

কুহক, সে কী!

মায়ায় ভুলাল।

কেডা করল তা, কোন মায়াবিনী?

ভানু বলল, তারেই তো খুঁজে বেড়াচ্ছি, আমি এবার যাব।

থাকবা না?

না।

কেন?

হোটেলওয়ালারে বলতে হবে কী জানলাম তা।

কী জানলে?

যেদিন বোমা, সেদিন ঘোড়াটা, তুমি যা বলেছ সুরেনবাবু, সব বলতে হবে, আমি যাই, মনে বড় কষ্ট হচ্ছে।

কেন?

যা ছিল এখেনে তার কিছুই নেই।

বললাম তো ভগবান সরে যাচ্ছে জগৎ থেকে, তোমার ঘোড়াটা ভগবানই ছিল, ভগবান বুদ্ধর জন্মদিনে সে পালাল।

ভানু নদীঘাটের দিকে এগোয়। কন্থক যে ভগবানের অংশ তা কে না জানে? আর সে তো সেই ভগবানেরই সাথী। ভানুর যেন মনে পড়তে থাকে কপিলাবস্তু, রাজপুত্র, কন্থক, ছন্দক। আকাশে সোনালি মেঘ! সেই মেঘের কী আশ্চর্য রূপ! তার বিভায় রাজপুত্রের মুখখানি করুণায় পরিপূর্ণ। ঘোড়াটির গায়ে কী স্নেহের হাত রাখেন রাজপুত্র! আর ঘোড়া যখন তাঁকে সওয়ার করে, রাজপুত্র যেন পালকের মতো হালকা হয়ে যান। রাজপুত্রকে নিয়ে ছুটছে কন্থক। হায়! ভোর হয়ে যখন এলো, আকাশে ফুটল সোনালি মেঘ। রাজপুত্র গেছেন মানুষের মুক্তির পথ জেনে নিতে। আকাশ তাই মলিন হয়নি। সোনালি মেঘের ভোরে রাজপুত্র হেঁটেছেন পৃথিবীর পথে। তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে সারথি ছন্দক আর তাঁর ঘোড়া কন্থক। ভানুর চোখে জল এলো। এতকাল বাদে কন্থক যখন ছেড়েছে সাথীকে, পালককে, পৃথিবী কি আর আগের মতো আছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *