1 of 2

অশ্বচরিত – ২০

কুড়ি

ভানুর ফিরতে ফিরতে সন্ধে। যত ফিরেছে দীঘার কাছাকাছি, ততই বিষণ্নতা, বিষাদ, অবসাদ তাকে গিলে খেয়েছে। কাঁথিতে নেমে অনেক সময় পায়চারি করছিল। ভাবছিল চলে যায় মীরগোদা, খোঁজ নিয়ে আসে কোকিলা বধূ আর গৌরমোহনের। কতটা হলো সেই মদরঞ্জি? দেখলে যেন প্রাণ ঠাণ্ডা হবে। কী সুন্দর আঁকে তারা! জীবন্ত ঘোড়াটিকে যেন এঁকে ফেলবে মদরঞ্জির ওপরে, শুনহে কোকিলা বধূ, আর একটা ব্যাপার বলতে পারি, যদি আঁকো মদরঞ্জির ওপরে, তোমরা আঁকলে তো জেনে যাবে কত মানুষ।

কাঁথিতে কতক্ষণ এলোমেলো কাটাল সে। একবার ভাবল ঘুরে আসে সেই বুড়ির বাড়ি। সাতমহলা পুরীতে বুড়ি একা থাকে। ঘোড়াটাকে পাচার করে দিয়েছে কলকাতা শহরে। বুড়ি না শুনেছিল সমস্ত রাত ধরে ঘোড়াটা ঘরের ভিতর দাপাদাপি করছে। শেষ পর্যন্ত সে এলো দীঘায়। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। দীঘায় নেমে মনে হলো কতকাল বাদে ফিরল সে। তিন দিন ছিল ভীমাপুর-বালিমুণ্ডায়, মনে হচ্ছে তিন বছর কাটিয়ে এসেছে। কতকালের চেনা জায়গা সব! কত জন্মের পরিচিত! কী ছিল ওই সব জায়গা তা ভানু কল্পনা করতে পারে। কী হয়েছে তা স্বচক্ষে দেখে এসেছে সে। চাঁদবালি, দে-পাল, কুসমাড়, মহাপাত্রপুর, ভীমাপুর!

বাস থেকে নেমে ভানু সমুদ্রতীরে চলে এসেছে। এখন অন্ধকার। বৃষ্টি নেই, কিন্তু আকাশ ভর্তি মেঘ। এই সময়ে দীঘায় ট্যুরিস্ট কম। হোটেল ব্যবসায়ে মন্দা। আবার এই সময়টাই ভানুর সবচেয়ে ভালো লাগে। সমুদ্রের ধারে হাত-পা ছড়িয়ে বসা যায়। বিচে একা একা হাঁটা যায়। দিনমান এই সময়ে গভীর বিস্ময় ছড়ায়। দিগন্ত থেকে মেঘ ওঠে। সেই মেঘ ব্যাপ্ত হয়ে যায় সমুদ্রের ওপরে, আকাশে। জল আর মেঘ একাকার হয়ে যায়। জলকে মেঘ মনে হয়। মেঘ দেখে মনে হয় সমুদ্রই উঠে এসেছে আকাশে।

সৈকত নিঝুম। এখন ভাটা চলছে। সমুদ্র সরে গেছে অনেকটা দূরে। কিন্তু শ্রাবণের ভরা সমুদ্রের গর্জন কি তাতে কমেছে? ঢেউ ভাঙছে অনেকটা দূরে। ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাস জ্বলছে। ভানু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয় ভিজে সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে। নত হয়ে প্রণাম করে সমুদ্রকে। তখন তার কাঁধে হাত, ভানু, ভানু টুমি?

অন্ধকারে সায়েব ঠিক তাকে খুঁজে বের করেছে। সায়েবও একা হাঁটছে সমুদ্রতীরে। জিজ্ঞেস করল, ভানু, টুমি কুনথে গিয়াছিলাম?

ভানু হাসে, বলে চান্দবালি, দে-পাল, কুসমাড়, বালিমুণ্ডা।

হোয়াট?

ভানু আবার জায়গায়গুলোর নাম বলে যায় গড়গড়িয়ে, তারপর অন্ধকারে পশ্চিমে তর্জনী তোলে, দ্যাট সাইড সায়েব, অ্যানাদার সি সাইড।

দিজ বে-অব-বেঙ্গল?

ইয়াস সায়েব, মাইতিবাবু’জ জমিনদারি, সী সাইড, চান্দবালি।

সায়েব কী বুঝল কে জানে, জিজ্ঞেস করে, বিউটিফুল?

নো সায়েব, নট বিউটিফুল, বিউটিফুল ছিল, নট নাউ!

দেন? বেটিং চলিবে? সায়েব জুয়োর কথা বলল।

ভানু বলে, ভেরি ব্যাড সায়েব, এসব নিয়ে জুয়ো হয় না।

উসকা মতলব, হোয়াই ব্যাড?

ভানু বিড়বিড় করে, ও সায়েব, তোমাকে আমি কী করে বুঝাই।

গানজা হায় ভানু?

নেহি সায়েব।

আই ওয়ান্ট গানজা। সায়েব বিড়বিড় করে।

ভানু জবাব দেয় না। সমুদ্রসৈকত ধরে পুবদিকে হেঁটে যায়। সায়েব তার কাঁধে হাত দেয়, টুমি কি ফিশারম্যান এরিয়া যাইছিলাম?

নো সায়েব, আমি এমনি হাঁটছি।

টুমি কি বেঙ্গা ফিশারম্যান কাটেজ যাইছিলাম?

নো সায়েব, আমার হাঁটতে ভালো লাগছে।

সায়েব বলে, বেঙ্গাজ ওয়াইফ, মাই রাটিকা, উসকি সাথ বেঙ্গা কোয়ার্ল করতা, ঝগড়া চলিয়াছে।

বাহ্, বেশ! ঝগড়া চলিয়াছে।

বেঙ্গা ইজ আ ব্যাডম্যান।

কেন সায়েব, ওর বউয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে দিচ্ছে না?

সায়েব বলে, বেঙ্গা কত রুপয়া নিবে হামার নিকট?

ওফ সায়েব, তুমি যাও দেখি। ভানু বিরক্ত হয়ে বলে।

সায়েব তার কথাটা শোনেই না। অথবা শুনেছে, বোঝেনি। আবার এও হতে পারে বুঝেছে বলেই কথাটা কানে নিল না। ভানু ডাকে, এই ফ্রেদেরিক।

ফ্রেদরিক বলে, বেঙ্গাজ ওয়াইফ হামার, সহিত বেনারস যাবে।

তার মানে?

হামি কৃষ্ণা? উ রাঢিকা, হামারা লীলা করবে।

ওই জন্যে বেঙা ঝগড়া করছে?

নো, বেঙ্গা এভরিডে ঝগড়া চলিয়াছে।

কেন?

কেন সাসপেক্ট করে, লেকিন হামি তো রুপয়া দিবে বেঙ্গাকে, রুপয়া নিবে, ফির ওয়াইফের সহিত ঝগড়া চলিয়াছে, দিস ইজ নট ফেয়ার।

ভানু ঘরে দাঁড়িয়ে সায়েবকে ধরল, তোমরা তো লীলা করছ?

সায়েব হা হা করে হাসে, তার কাঁধ থেকে ভানুর হাত সরিয়ে দেয়, হোয়াট আর ইউ টেলিং…?

লীলা তো চলিয়াছে।

গুড! শি ইজ ভেরি সেক্সি, আ নাইস ওম্যান।

ওরে সায়েব, তুই বেঙার বউটারে ধরলি কেন?

সায়েব বলে, হেই ভান্‌নু, টুমি কি বেঙ্গাজ ওয়াইফ, রাঢাকে দেখিয়াছ, দ্যাট বিউটিফুল ওম্যান, শি ইজ ভোলাপচুয়াস।

কথাটার ভাব বুঝেছে ভানু, সে সায়েবকে ঠেলে দেয়, এই সায়েব যা দেখি আমার কাছ থেকে, শালা কী করতে এয়েছিস?

সায়েব হা হা করে হাসে, এ ভানু, ডু য়্যু ওয়ান্ট ওম্যান?

ভানু বলে, সায়েব আমারে একা থাকতে দে।

সায়েব বলে, বেঙ্গা বহুত পাজি আছে, বেঙ্গা হামাকে পেয়িং গেস্ট রাখিয়াছে, রাটিকে লাভস মি, ভানু সমঝতা?

ভানু বলল, সায়েব তুই যা দেখি, আমার খুব খারাপ লাগছে।

খারাপ, ব্যাড?

হ্যাঁ রে সায়েব। ভানু হনহন করে হাঁটতে থাকে। ভানু এবার পশ্চিমমুখো। অন্ধকারে তার পা ঠিক চিনে নিচ্ছে গন্তব্য। আসলে গন্তব্য তো অনির্দেশ্য। গন্তব্য এই সমুদ্রসৈকত। জলের ধার দিয়ে হাঁটছে ভানু। তাকে এসে আবার ধরেছে ফ্রেদরিক, এ ভান্‌নু, হু ইজ ব্যাড, হামি ব্যাড?

নো সায়েব, আমাকে একা থাকতে দে।

সায়েব বলল, বেঙ্গা ব্যাড, হিজ ওয়াইফ গুড, ভানু কাম, হুটেল মে চল ভান্‌নু, গানজা মিলিবে।

যা না তুই। ভানু ক্ষেপে ওঠে, হোটেলে তো বাবু আছে, মাইতিবাবু।

নো ভান্‌নু, বাবু সিপটি নেহি, কুহাককিনে গিয়াছিলাম সিপটি।

কী বলে সায়েব? কুহকিনী মানে কোকিলা বধূ? কোকিলা বধূর কাছে গেছে বাবু শ্রীপতি মাইতি? কী সব্বোনাশ! তাহলে বাবুর নার্স দিদিমণি! কী সব্বোনাশ, গৌরমোহন মদরঞ্জিওয়ালা! ভানু হাসল, বাবু গেলেই হবে? কোকিলা বধূ বাবুকে উঠোন থেকেই বিদায় করবে। কিন্তু পারবে কি সত্যি? মেঘ ছায়া ফেলে ভানুর মনে। বাবু তো হোটেলওয়ালা, পয়সাওয়ালা, আর কোকিলা তো মেয়েমানুষ। শুধু আঁকতে পারে ভালো, মনের মাধুরী ফুটিয়ে তুলতে পারে রঙে, সম্মোহন করতে পারে পক্ষিরাজকে। তা বাদে? তা বাদে তো সে মেয়েমানুষই। গৌরমোহনের বউ। মেয়েমানুষকে যদি কোনো বলবান পুরুষ চায়, ভীষণভাবে টানে, মেয়েমানুষের সাধ্য কি আটকায়? গৌরমোহনের জন্য প্রাণ কাঁদলেও পারবে না কোকিলা। পারেনি যেমন দে-পালের সুভদ্রাবউ। পুরুষমানুষ, তার স্বামীও ছিল। সে বেটা ঠেলে দিল তাকে বাঘের জঙ্গলে।

ভানু জিজ্ঞাসা করে, বাবু কবে গেল?

হামি জানে না।

তবে যে বললে বাবু গেছে মীরগোদা।

হোয়াট মীড়গোড়া, হাম বোলা কুহাককিনে

কুহাককিনে! তো সেখেনে গেল কবে? আই ডোন্ট নো।

তুমি হোটেলে কবে গেলে খোঁজ করতে? আই ডোন্ট নো।

ভাগ তো সাহেব, কীসব বলছিস।

ফ্রেদরিক বলে, টুমার বাবুর কুহাককিনে হায়, হামার কুহাককিনে হায়, বেঙ্গাজ ওয়াইফ, মাই রাঢিকে কুহাককিনে।

ভানু হাঁটতে থাকে। সায়েব একেবারে খালি মাথায় নেই। কিছুটা টেনেছে শুকনো নেশা। আরও চাইছে। ভানুকে ছাড়ছে না সায়েব। অথচ ভানু তো একা হবে। তার মন যে মেঘের ভারে ভারী হয়ে আছে। সুভদ্রাবউকে দেখলই না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সে চলে এসেছে নোটিশগুলো নিয়ে। বাবুকে দেখাতে হবে। রামচন্দ্র আসবে কদিন বাদে। সুভদ্রার খোঁজ না করে তো আসতে পারে না। ভানুর মন খুব খারাপ। চোখের সামনে গত রাতটি ছমছম করছে। দে-পাল মহাপাত্রপুর, চাঁদবালির আকাশ, সমুদ্র, ঝাউবন—হা হা করছে বুক। সে হাতজোড় করল, ও সায়েব, মুঝে আকেলা হোনা চাহিয়ে।

সায়েব বুঝল না হয়তো, আবার হাসল, বলল, চলো সিপটি, বেঙ্গাজ কাটেজ চলো, টুমি দেখিলে উহারা ঝগড়া চলিবে না, বেটিং চলিবে, হিলসাহ উঠিবে কি উঠিবে না।

ভানু হাঁটতে লাগল, সায়েব ছুটে এসে তার কাঁধ ধরল, হেই সিপটি।

ভানু বলল, আমি ভানু, সিপটি নই, জুয়োয় নেই আমি।

হেই ভান্‌নু, হোয়াট আ ডারকনেস! কী আন্ধার! ভানু সমুদ্দরে যাইবে?

ভানু বলল, সায়েব তুমি তো ভালোই নেশা করেছ।

নো সিপটি, আই ওয়ান্ট মোর গানজা, বেঙ্গা আজ নাইটট্রিপ নেহি করেগা,

কাটেজ মে রহেগা।

তো কী হলো?

হাম কেয়া করেগা? সায়েব অন্ধকারে দুহাতে ভানুকে জাপটে ধরতে চায়, হেই সিপটি, তুমহার কুহাককিনে?

আমি ভানু, শ্রীপতি নই।

ইয়াস ভান্‌নু, ভানু বেটিং কোরো, বেঙ্গা আজ ফিশিং যাবে কি না।

যা তো সায়েব, আমি জুয়োয় নেই। ভানু সায়েবকে ধাক্কা দেয়। অন্ধকারে সায়েব হা হা করে ওঠে, হেই ভান্‌নু, কী আন্ধার! লুক, লুক অ্যাট দ্য সি। সমুদ্দর দেখেছিলাম ভান্‌নু উসকা ভিতর কেয়া হায়?

ভানু ধীর পায়ে সরে দাঁড়ায়। অন্ধকার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। দূর দিগন্তে, আঁধারের উৎসে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে। এমনই কি দেখা যাচ্ছিল দে-পাল, মহাপাত্রপুর, কুসমাড়ের আকাশ? ভানু স্তব্ধ হয়ে ঘন গভীর গহন অন্ধকারে চেয়ে থাকে। নিশ্চল হয়ে যায়। ওই দূরে সায়েব তাকে খুঁজছে। সায়েব ডাকছে, হেই ভান্‌নু, হেই সিপটি, কাঁহা হায় তুম দোনো?

ভানু অন্ধকারে উবু হয়ে বসে পড়েছে সমুদ্রসৈকতে। এই সমুদ্র, ঝাউবন, চাষ জমি, গ্রাম, বাতাস সব উধাও। চাঁদবালির সমুদ্রতীর, দে-পাল কুসমাড়ের সমুদ্রতীর কেমন ছিল তা শুনেছে সুভদ্রাবউয়ের কাছে। তারপর? ভানু ধীরে ধীরে বসেই পড়েছে ভিজে বালিতে। সায়েব তাকে অন্ধকারে খুঁজছে, হেই সিপটি, হামার কুহাককিনে বহুত সেক্সি হায়, লেকিন উ বেঙ্গার সহিত ঝগড়া চালায়, উসি টায়েম হামি ডর লেগে যায়, হেই সিপটি, কাঁহা তু, আয়াম ফ্রেদরিক কলিং য়্যু, বেঙ্গা ফিশিং যাবে?

ভানু আসন পিড়ি হয়ে অন্ধকার পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারেরও রূপ কম নয়। যা দিয়ে ভগবান পৃথিবী গড়েছেন, তারই রূপ কত! গাছগাছালি বলো, আবার মরুভূমি বলো, আলো বলো, আঁধারই বলো, সবারই তো নিজস্ব রূপ আছে। মোহিনী রূপ! দুটি চোখ মেলে দিয়েছে ভানু। সমুদ্রগর্জন কানে আসছে। সমুদ্র আরও সরে যাচ্ছে। ভানু সৈকতভূমিতে হাত দিল। অন্ধকারে নিজের নামটি লিখল। সে লেখা দেখতেও পেল না নিজে। তবু ও তো নিজের লেখা। যেমন লেখে ভগবান। কখন সে লেখা মোছে, ভগবান নিজেও কি জানে?

ফ্রেদরিক অন্ধকার ধরে হাঁটছে, হেই সিপটি, টুমি তো ফ্রেন্ড আছে, টুম কাঁহা চলা গিয়া, টুমহারা কুহাককিনে কাঁহা, আই ওয়ান্ট টু সি হার, য়্যু ক্যান সি মাই রাটিকা, বেঙ্গাজ ওয়াইফ, সি ওয়ান্টস মি, সি নিডেড মি, আই লাভ হার, হেই সিপটি, গানজা হায়? টুমহারা ভানু কাঁহা, হেই ভান্‌নু, তুম কাঁহা গিয়া, আন্ধার মে হারা গিয়া?

ধীরে ধীরে ফেদরিক সায়েব দূরে সরে যায়। অন্ধকারে ভানু আর শ্রীপতিকে খুঁজতে খুঁজতে সায়েব অদৃশ্য হয়ে গেলে পড়ে থাকে এক প্রাচীন স্তব্ধতা। পড়ে থাকে ভানু। যে স্তব্ধতাকে ভেঙে চূর্ণ করেছিল ফ্রেদরিক সায়েব, এক ইউরোপীয় পুরুষ, থেঁতলে দিয়েছিল জেলেবউয়ের কথা বলতে বলতে, সেই স্তব্ধতা আবার ফিরে এলো ভানুর কাছে। স্নিগ্ধ হয়ে অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

ভানু তার পাদুটি ছড়িয়ে দিল ভিজে সৈকত ভূমির গায়ে। কাত হলো অন্ধকারের ওপর। এই যে কৃষ্ণপক্ষীয় রাত্রি, মেঘে ঘন অন্ধকার, এ যেন এক অবয়ব নিয়ে ঘিরে আছে ভানুর ভিতর ও বাহির। ভানু একে আঁকড়ে ধরে সমুদ্রসৈকতে শরীর এলিয়ে দেয়। চোখদুটি মেলে ধরল দক্ষিণ-পুবে, গহিন সামুদ্রিক অন্ধকারে। ধীরে ধীরে তার চোখও নিশ্চল হয়ে যায়। মুদে যায় চোখের পাতা। সে টেরও পায় না। চক্ষু মুদলে যে অন্ধকার, চক্ষু মেলে ধরলেও তাই, কোনো তফাত নেই। তার কানদুটিও নিথর হয়ে যায় ক্রমশ। সব শব্দ মুছে যায় শ্রবণ ইন্দ্রিয় থেকে। সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার শব্দ ম্রিয়মাণ হয়ে এসেছে অনেক। যেটুকু রয়েছে তা যেন সমুদ্রের ঢেউ ভাঙা—এসব তো জন্মলগ্ন থেকেই পৃথিবীর সঙ্গী। এই সব শব্দ যেন শব্দহীনতাকেই গভীর করে আরও।

ভানু শুয়ে পড়েছে ভিজে সৈকতভূমিতে। ভানুর গা হাত পা নিশ্চল হয়ে সমুদ্রসৈকতের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। বহু রাত্রে পূর্ব দিগন্তে চাঁদ ওঠে। সমুদ্র থেকে যেন আগুনের নৌকো ভেসে ওঠে ধীরে ধীরে। এত যে মেঘের ব্যাপ্তি, পূর্ব দিগন্তখানি মেঘহীন হয়েছিল। চাঁদের আলো আসে। সে আলো আচমকা যেন ভানুর চোখের ওপর ছড়িয়ে গেল। গাঢ়, আগুন বর্ণের হলুদ আলো ডেকে তুলল ভানুকে।

কী আশ্চর্য সমুদ্রতট! ভানুর সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে। বালিতে মাখামাখি। ভানু দেখছিল সমুদ্রতটে কী বিস্ময়। ভাটা শেষ হয়ে জোয়ার শুরু হয়েছে আবার। সমুদ্র এগিয়ে আসছে। যতক্ষণ সমুদ্র ছেড়ে গিয়েছিল এই বেলাভূমি, ততক্ষণে জল শুকোয়নি। ভিজে, জলের প্রলেপ মাখা সমুদ্রতটে হলুদ চাঁদের আলো গড়িয়ে যাচ্ছিল। ভানু উঠে দাঁড়ায়। ভিজে পুঁটুলিটা কাঁধে নিয়ে সে জলের দিকে এগোয়। জলের গর্জন বাড়ছে আবার। যে নীরবতার ভিতর সে ডুবে গিয়েছিল এতটা সময় সেই নীরবতা ভাঙছে যেন দূরের ডাকে। ভানু জলের ভিতর চাঁদের আলো দেখছিল। চাঁদ ধীরে ধীরে হলুদ বরণ হারাচ্ছে। উঠে আসছে ওপরে। এবারই মেঘে ঢাকবে। ভানু চাপা গলায় নিজেকে শোনায়, কী সুন্দর!

ভানু! ডাক শুনল সে। হোটেলের ঠাকুরের গলা। কে খবর দিল? সায়েব? শুধু ঠাকুর নয়, মাইতিবাবুও আছে যেন। ভানু ছুটে গেল টর্চের আলো লক্ষ করে, বাবু, মাইতিবাবু গো!

তাহলে তো সাহেব ঠিক বলেছে। ঠাকুর বলে ওঠে।

ভানু হা হা করে ওঠে, বাবু গো, মাইতিবাবু, এমন আর নাই, আমার চাঁদবালি আপনার বালিমুণ্ডা শেষ, শুধু ছাই, ছাইয়ে সব ঢাকা পড়ে গেছে বাবু, এখেনের মতন শোয়ার উপায় নাই, আকাশ মাটি সব শেষ, সব কাঁটাতারে আটকা পড়ে গেছে মাইতিবাবু, সে খোঁজ কি রাখেন আপনি? কী সব্বোনাশ না হয়েছে বাবু!

শ্রীপতি মাইতি বলল, কী বলছে কিছুই ধরা যাচ্ছে না, বেটা পাগল হয়ে গেল নাকি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *