1 of 2

অশ্বচরিত – ২

দুই

সমুদ্র এদের বাঁচায়। সমুদ্র না থাকলে অনন্ত সার মরে যেত। লবণ ছাড়া আছে কী! সমুদ্রের জল শীতের সময় লবণে ভারী হয়। বড় বড় জোয়ারে জল চলে আসে লায়কানখাস অবধি। বড় জোয়ার মানে পূর্ণিমা অমাবস্যায়। সেই জল ধরে রাখা হয় মস্ত মস্ত গর্তে। জোয়ার সরে গেলে গর্তগুলো নোনাজলে ভর্তি হয়ে যায়। আর মাটিতেও মিশে যায় নুন। তারপর সেই জল রোদ্দুরে ঘন করে, পরিশ্রুত করে ঢেলে দেয়া হয় বড় বড় পলিথিনের সিটের ওপর। জল শুকিয়ে শুকিয়ে নুন ফুটে ওঠে। অনন্ত সারের বাপ ঠাকুরদা নুন মারত জমি চষত। এখন জমি নেই, নুন বেঁচে আছে।

আচমকা মেঘ এসেছে খুব ঘন করে। বছরের মতো নুনমারা শেষ। শ্রীপতি লায়কানখাস থেকে চলে আসার সময় অনন্ত বলেছে, বাবু কাজকর্ম হবে?

লোক তো রয়েছে আমার।

তবু।

ট্যুরিস্ট ধরে আনিস বখশিশ পাবি।

যতদিন মেঘ থাকবে আকাশে ততদিন কষ্ট। মেঘ কেটে গিয়ে কবে মৌসীর মাস—অঘ্রান আসবে, এখন সেই অপেক্ষায় আছে অনন্ত। অলঙ্কারপুরের লবণমারাদের কারও কারও জমি আছে, লবণটা অতিরিক্ত আয়। অনন্ত সারের অতিরিক্ত আয় নেই।

লবণ মানে শ্রম। সারাদিন রোদে পুড়ে পুড়ে সমুদ্রের লবণ বার করে আনা, সেই লবণের সঙ্গে নিজের দেহের লবণও মিশিয়ে দিতে হবে। কথায় বলে, নুন না দিলি নুন পাবিনি।

নুন দেয়া মানে শ্রম দেয়া। কপালের ঘাম পায়ে ফেলে ফেলে বিন্দু বিন্দু ধবধবে স্ফটিকের সন্ধান করা।

একদিন এদেশে লবণ নিয়ে বড় যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে এ তল্লাটের মানুষ সামিল হয়েছিল। তখন অনন্তর জন্ম হয়নি। লোকের কাছ শুনেছে সব।

লায়কানি বা নায়কানি অর্থে নৌকালি। নৌকালি সমুদ্রে থাকেন। সমুদ্র পাহারা দেন নৌকোয়। লায়কানি বুড়ির চেহারা যে দেখেছে সে ভোলেনি। রূপ কী! দেবীকে পুজো করে সমুদ্রে নেমে যাও, ভয় নেই। আর যদি দেবী অসন্তুষ্ট হন? একেবারে নৌকো সমেত মানুষকে বাতাস করে দেবেন। হাড়গোড় মাংস সমেত মানুষটা বাতাসে মিশে যাবে। সেই বাতাস হু-হু করে দৌড়ে আসবে সমুদ্দুর থেকে মাটির দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলবে বারবার।

এই সব কথা নুনমারাদের জানা। লায়কানি এসেছিল জাহাজে চেপে। সাত ভউনি সাত জাহাজে চেপে সমুদ্দুরে সাত জায়গায় নামল। সেই সাত ভউনির একজন এই বন লায়কান। ঐ চরভূমিতে তাঁর কত কালের জীর্ণ মন্দির। আগের কালে লায়কানির সিংহ ঝিঁঝির দিয়ে বাঁধা থাকত ঘনজঙ্গলের ভিতর এক আজানগাছে। এসব শোনা কথা, অনন্ত সার জানে, সক্কলে জানে। আজানগাছ দেখা সাধারণ মানুষের সাধ্য নয়।

রাতে লায়কানির চোখে আলো জ্বলে। তিনি সমুদ্রের পথে হেঁটে যান মস্ত এলোচুল নিয়ে। সেই ১৩৪৯-এর ঝড়ের আগে জঙ্গলে শুধু একটা মন্দিরই ছিল। আকাশছোঁয়া ঝাউয়ের ভিতরে আলো ঢুকতে পারত না। জঙ্গলের শৃঙ্খলে আঁটা সিংহটা মাঝেমধ্যে গর্জন করে উঠত বোধহয়। সিংহকে কেউ দেখেনি, গর্জন শুনেছে।

তখন এই এলাকা জুড়ে নুনমারাদের ওপর পড়ে গেছে সায়েবদের নিষেধাজ্ঞা। হীরাপুরে ছিল মিলিটারি ঘাঁটি। তারা গাঁয়ের পর গাঁ জ্বালাতে জ্বালাতে চলে যাচ্ছে রাণীসাই, চন্দরপুর থেকে মীরগোদা অবধি। দিশি নুন থাকলেই পুলিশের লাঠি গুলি, ঘরে ঘরে আগুন। দুই পুলিশ, দুফা আর গুঁফার কথা এখনও কেউ না কেউ বলে। বলবে আরও বহুদিন।

লায়কানির কাহিনির মতোই এ কাহিনিও লোকমুখে ঘোরে। দেবী মাহাত্ম্য আর মানুষের যুদ্ধ এক হয়ে যায়। নুনমারাদের খুঁজতে খুঁজতে পুলিশ তখন গাঁয়ের পর গাঁ জ্বালাচ্ছে, সেই সময় লায়কান বুড়ি জঙ্গলে হেঁটে গিয়ে সেই সিংহের শিকল খুলে দিলেন। সমুদ্র ফুঁসে উঠল।

লায়কানখাসে তখন বড় বড় ঝাউ তেঁতুল। সেই সব গাছের কোনো একটায় এসে দেবী আশ্রয় নিয়েছিলেন। গাছ ফুঁড়ে বেরিয়ে সিংহের শিকল খুলে দেবী পানসি নিয়ে সমুদ্রে নামলেন। এলোচুলে পানসির ওপর বসে আছেন লায়কানি। ক্রমাগত চুল আঁচড়ে যাচ্ছেন তিনি। চুলের ভিতর দিয়ে মেঘ বেরিয়ে বেরিয়ে আকাশ ছেয়ে ফেলল, ঘোর বিপর্যয় শুরু হলো।

দুর্দম ঢেউয়ে ঢেউয়ে সিপাই সান্ত্রী সব উধাও। ভাসিয়ে নিয়ে গেল সব। সমুদ্র ভেড়িবাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়ল পুলিশ মিলিটারি ব্যারাকে। সায়েবদের হাত থেকে নুনমারারা বাঁচল।

জন্ম হলো লায়কানখাসের। আকাশছোঁয়া বৃক্ষেরা সব মাটিতে শুয়ে পড়ল। খা খা করতে লাগল সব। দূরে সমুদ্র নীল। আস্তে আস্তে বালি গরম হয়। গাছগাছালি পরিষ্কার হয়। লায়কানখাস মরুভূমি হয়ে গেল। নুনমারাদের ডাকলেন দেবী।

সিপাই সান্ত্রীরা গেল কোথায়? না হাওয়া হয়ে গেল। লায়কানি হাওয়া করে দিলেন সব্বাইকে। তারা বর্ণহীন হয়ে বাতাসে ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে আছড়ে পড়ল ঝাউয়ের মাথায় মাথায়। একবার দক্ষিণ থেকে তারা উত্তরে যায়, আর উত্তর থেকে হাওয়া আসে দক্ষিণে। লায়কানি হাওয়াদের পাঠান তাঁর আর সব বোনেদের কাছে। ঐ ওড়িশার ফুলবনি খাসে আছেন ফুলেশ্বরী, উত্তরে পানিপারুল বারঙ্গতে আছেন লঙ্কেশ্বরী…এই রকম সবাই হাওয়াদের নিয়ে খেলা করেন। সিপাই সান্ত্রীদের নিয়ে খেলা করেন।

অনন্ত সার ফিরতে ফিরতে মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, মনে নাই বন্ন?

মেয়েটা মাথা ঝাঁকাতে থাকে, উ হুঁ।

বন্ন দেখিস নাই তো কী দেখলি? অনন্ত জিজ্ঞেস করে।

অশ্ব!

অশ্ব! বন্ন নাই! মানে বাতাস!

অনন্ত সারের ভেতরটা কেমন ছমছম করে ওঠে। মানে লায়কানির অভিশাপ দেখল নাকি কচি মেয়েটা?

ফিরতে ফিরতে অনন্ত বলে, ছিপতিবাবুর অশ্ব চাপা কি আজকের! ওই একটা জন্তু বটে পিঠে চাপলেই রাজা। ওর বাপ চাপত, পিতাম’ চাপত, তার বাপ চাপত, নায়েবের বংশ কিনা।

কুন্তি বিড়বিড় করে, কী জানি কী বন্ন, হাঁ বাপ, সাদা হবে কি?

খেয়াল হয় নাই।

আমি তো ছিপতিবাবুর অশ্ব দেকিচি, দুধসাদা, সমুদ্দুর ধারে ট্যুরিস চাপে না উ ঘোড়ার উপরে, পিঠে লাল ঝালর, জরি দিয়া।

হাঁ তা তো জানি।

তবে তো সি অশ্ব সাদাই হবে, ভানুবাবু উয়ারে নিয়া ঘুরে, যেন তারই ঘোড়া।

কোনটা?

যেটা দেকিচি পরশু দিন।

মনে পড়ছে তোর? কুন্তির মা সরস্বতী জিজ্ঞেস করে।

বাহ্, তুমি দ্যাখো নাই ছিপতিবাবুর অশ্ব?

হাঁ দিখেছি তো। বলল মা, সাদাই বটে।

তবে তো পরশু সাদা ঘোড়াই না দেখলাম। বলল কুন্তি।

সত্যি! অনন্ত জিজ্ঞেস করে।

তাই তো হবে, ছিপতিবাবুর অশ্ব হলে তার বন্ন তো সাদাই বটে। কুন্তি যুক্তি সাজায়।

অনন্ত সার থই পায় না মেয়ের কথায়। তিনজনে মাঠ পেরিয়ে একটা খাল পায়। খালে জোয়ারের জল ঢুকেছে। কুন্তি পুবে তাকাল পিছন ফিরে। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় সিধে। একটু ওপরে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে চাঁদের অংশ। জ্যোৎস্না ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে বালিভাসা মাঠে। গড়িয়ে যাচ্ছিল চাঁদের আলো বালির ওপর। কুন্তি আবার ঘোড়াটাকে দেখতে চাইছিল দুদিন বাদে। তার মনের ভিতরে ঘোড়াটাই ছিল এখন, এই দিনরাত্রির সন্ধিক্ষণে। না, কিছুই চোখে পড়ে না।

অনন্ত বলল, সাবধানে পার হ, সোতের টান আছে।

তিনজন ছপছপ করে জল পেরিয়ে ভেড়িবাঁধে উঠতে থাকে। উঠে কিছুটা উত্তরে এগিয়ে নেমে যাবে বাঁধ থেকে পশ্চিমে। বাঁধে উঠে অনন্তর বউ সরস্বতী বলল, কামের কুছু বলল ছিপতিবাবু?

ও তো এয়েছিল অশ্বের খোঁজে।

না, অশ্বের বন্ন কীর’ম তা জানতে। বলল কুন্তি।

তার মানে অশ্বর খোঁজই লিয়া, বন্ন জানলে তো বুঝা যাবে সেইটাই কি না। বলে অনন্ত।

কোনটা? জিজ্ঞেস করে তার বউ।

যিটা হারাইছে। বলে অনন্ত।

তিনজনে নিশ্চুপ হয়ে গেল আচমকা। হাঁটছে ধীর পায়ে। একটু বাদে অনন্তর বউ বলে, দীঘায় কামকাজ হবে না, বলো না ছিপতিবাবুরে, হোটেলে কাজ নাই?

দালালি করতে হবে ট্যুরিসের।

তাই করো।

হাসে অনন্ত, এ মাসে নুন যেমন নাই, ট্যুরিসও নাই, বর্ষাকালে কে আসে!

তবে হীরাপুর যাও শতপথীবাবুর বাড়ি। কথাটা আচমকা বলল কুন্তি।

অনন্ত চমকে ওঠে। হীরাপুরের রজনী শতপথীর ঘর ছেড়ে সে এখন অলঙ্কারপুর নিবাসী। এখন সে আর শতপথীবাবুর বাগাল নয়, শতপথীবাবুর মুনিষ নয়। কতদিন ছেড়েছে হীরাপুর! এই মেয়ের বয়স যতদিন হলো তারও বছর দুই আগে। যতদিন ছেড়েছে হীরাপুর, সেই ষোলো-সতেরো বছর, তার আগের ষোলো- সতেরো বছর সে হীরাপুরের শতপথীবাবুর বাগাল, বাঁধা মুনিষ। শতপথীবাবু জমিদার না হয়েও জমিদার মানুষ। এদিকে, বাংলায় যত জমি, তার কম নয় ওড়িশায়। ওড়িশায় তাঁর চাষবাড়িতে কতদিন কাটিয়েছে অনন্ত! সেই সব কথা শোনায় বউকে। শতপথীবাবুর মন জুগিয়ে থাকতে পারলে আজ কি বউ-মেয়ে নিয়ে নুনের খালারি করে পথে পথে ঘুরতে হতো? অলঙ্কারপুরের ভিটে তো সরকারি খাস জমিতে। শতপথীবাবুর বাড়ির শানের মেঝের সুখ গেছে সেই বর্গার লোভে। শতপথীবাবুর পিছনে ছাতা ধরে হেঁটে যার পেটে ভাত জুটত সে কিনা বলল, বাবুর জমিনে আমি ভাগচাষা।

কুন্তি বলল, লিয়ে যাবা একবার হীরাপুর?

কেনে?

শতপথীবাবুর দালানকোঠা দিখে আসি।

কী হবে?

এমনি! দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুন্তি যেন তার মায়ের মতো হয়ে যায়।

অনন্ত বিড়বিড় করে, যাবার মুখ নাই, বাবুর আমি বাঁধা মুনিষ, খাওয়া পরার অভাব নাই, বাবু যাবে তালসারি, অন্ত চ, বাবু যাবে চাষবাড়ি—সেই চন্ননেশ্বর ছাড়ায়ে, বালিমুণ্ডা ছাড়ায়ে ঈশ্বরপুর, অ’ন্ত চ…।

বিড়বিড় করতে করতে থেকে গেল অনন্ত। ঈশ্বরপুর চাষবাড়িতে যখন ধান উঠত মৌসীর মাস, আঘুনে, তখন মুনিষ অনন্তই তো বাবু। বিঘায় দশ মণ হলে ছ’মণ বাবু, চার মণ চাষা। ও জায়গা এ জায়গার মতো নয় যে চাষা ধান বেশি নেবে আর মালিক পাবে কম, চাষা নেবে বারো আনা, মালিক চার আনা। ও জায়গায় যদি বাবু বলত নেবে পনেরো আনা, চাষা নেবে এক আনা, তবে তাই হতো। বছর বছর চাষি পালটাত শতপথীবাবু। বোশেখ মাস পড়লেই ওই রোদে আবার ঈশ্বরপুরে চাষবাড়িতে হাজির শতপথীবাবু আর তার মাথায় ছাতা ধরা বাঁধা মুনিষ অনন্ত। জমি বিলি হবে একশ বিঘে, দু’শ লোক হাজির। কেউ কথা বলে না বাবুর সামনে। মাথা নামিয়ে বিড়বিড় করে, চাষড়া দাও দেখি বাবু।

তখন বাবুর কী মেজাজ! বাবুর সঙ্গে মুনিষেরও। বাবু যদি বলে ধরে আনতে, সে বেঁধে আনে প্রায়। সন্ধেবেলায় থানার দারোগা এলো, আর কারা কারা এলো, অনন্ত মুরগি ছাড়ায় একটা, দুটো, তিনটে পর্যন্ত। দারোগার সঙ্গে বসে বাবুর মেহফিল চলে কত রাত্তির পর্যন্ত, সেই মেহফিলে কটকের মেয়েমানুষ পর্যন্ত আসত। সব কথা কুন্তির মা জানে। কুন্তির মাকে সব বলেছিল বিয়ের পর। কুন্তি শুনেছে তার মায়ের কাছে। সরস্বতী এখনও দুঃখ করে, একটা ভুলের কারণে চরম সব্বোনাশটা হয়ে গেছে তার স্বামীর, না হলে ওড়িশার চাষবাড়িতে মেয়ে বউ নিয়ে থাকতে পারত অনন্ত। বাঁধা মুনিষ ভাগ লেখানোর কথা ভাববে কেন? মনে পাপ ঢুকেছিল অনন্তর।

অনন্ত বলল, মুই তিন বিঘা চাষ করতাম তো বটে।

কামের কাম করতে, বাবু তুমারে ভালোবাসত তো? মেয়ে জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ। ঘাড় কাত করে অনন্ত।

কুন্তি বিড়বিড় করল, হীরাপুর লিয়ে যাবা?

একই প্রশ্ন, একই জবাব। বাঁধা মুনিষ ভাগ লেখায় না। লেখানো ঠিক না। ওসব চিন্তা মাথায় ঢুকলে অধম্মো হয়। সেটেলমেন্ট জরিপকালে – বিনাশ কালে তার বুদ্ধি নাশ হলো। বাবু গিয়েছিল কটকে। বাবুর বেটা কাঁথিতে মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে এবেলা যাচ্ছে ওবেলা ফিরছে। পার্টির লোক বর্গা লেখাচ্ছে জরিপে। সেটেলমেন্ট আমিন পান খাচ্ছে আর তদন্ত করছে। রজনী শতপথীর বাঁধা মুনিষকে ধরল পার্টিবাবু নির্মল করণ, বর্গা লিখাবি?

আঁজ্ঞে?

জমি চষিস তো?

মোর তিন বিঘা আছে।

ধান কে লেয়?

বাবু নেয়, সবটাই নেয়, খরচা দেয়।

তুই?

আমি বাবুর মুনিষ।

আমিন খ্যা খ্যা করে হাসতে হাসতে বলল, ভাগ অর্ধেক অর্ধেক হবে, কী নাম, কত দাগ?

নির্মল করণ বলল, দে, সব বলে দে।

কুন্তি বিড়বিড় করল, বলে দিলে সব?

না, বাবুর জন্যি বসে থাকলাম তিন দিন, তিন দিন পরে কটক থেকে ফিরল বাবু, বলল, অ’ন্ত চ, বালিমুণ্ডা ঈশ্বরপুর চাষবাড়ি।

অনন্ত বউকে বলল, তোরা ফের, মু দীঘা ঘুরে আসি I

ইখন গে কী হবে, আঁধার রাত।

আঁধার কই, জোছনা রয়েছে এর’ম।

কুন্তি বলল, হাঁ হাঁ যাও, মাইতিবাবুকে বলে এসো অশ্বের বন্ন ধলা।

ধলা অশ্বই তো ছিল মাইতিবাবুর। বলল সরস্বতী।

সে কি মাইতিবাবু জানেনি? অনন্ত বলে।

জানবেনি কেনে, কিন্তু উনি তা’লে কেনে অশ্বের বন্ন খুঁজল মোদের কাছে?

আশ্চর্য তো! অনন্ত দেখল হলুদ চাঁদের আলো পড়েছে মেয়ের মুখে। মেয়েটা তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে, দক্ষিণ-পুবে, ঝাউবনের মাথায়! কথাটা তো মিথ্যে বলেনি কুন্তি। মাইতিবাবু হোটেলিয়ার কি মাথা খারাপ হলো? আপন অশ্বের বন্ন ভুলি গিলা! বিড়বিড় করে অনন্ত। শ্রীপতি মাইতির মাথা কি তার মতো খারাপ হলো? সে ছ’বছরে এসেছিল শতপথী বাড়ি। ছয় থেকে ষোলো, ষোলো থেকে তেইশ। তাগড়া শরীর হলো তার। এক কিলো চালের ভাত সাবাড় করে। দশটা তরমুজ একা মেরে দিতে পারে। বাবু তাকে স্নেহ করে। গা হাত পা টেপায়। বলে, এবার তার বিয়ে দেয়াবে। বিয়ের নাম শুনে গা গরম হয়ে ওঠে তার। বালিমুণ্ডা, ঈশ্বরপুর যাচ্ছে আঘুন মাসে। ট্রেকার থেকে নেমে দুমাইল হাঁটা। চাষবাড়িতে গিয়ে দেখল ফুটফুটে ধলা একটি মেয়েমানুষ। ঈশ্বরপুরের চাষবাড়িতে থাকত অবনী, অবনী পাতর, সে বলল, বাবুর রাখনি, কটক থেকে নিজে নিজেই চলে এসেছে। কটকী মেয়ে বাবুর রাখনি। হাঁ করে বাবুর দিকে তাকিয়ে আছে অনন্ত। সেই সন্ধেয় কথাটা বলে ফেলল, বাবু শুনছেন।

বাবু বলে, কটকী কোনঠে গেল?

অনন্ত বলে, বর্গাটা নাকি মানষের ভালোর জন্যি?

বাবু বলে, অন্ত তুই যা, কটকীরে ডাক দে, হাত-পা টিপুক ও, রান্না তো অবনী করছে, উ তার ভিতরে ঢুকি গিলা কেনে?

অনন্ত বলে, বাবু বর্গা যে লিখানো হচ্ছে—

বাবু বলে, খুব জাড়, মেয়্যাছিলাডা কোনঠে?

তিনবারের বার শোনে রজনী শতপথী। চমকে ওঠে। কী বলে অনন্ত? সিধে হয়ে বসে শতপথীবাবু, কী বলিস?

তখন কটকী মেয়েমানুষ হাজির। অন্ধকারে দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকে, বাবু!

অনন্ত বলে, বাবু ডাকে, আপনি কানে শুনো না?

কী মিহি কণ্ঠস্বর তার। যেন বাঁশি বাজে অন্ধকারে, বলে, অবনীরে রান্নাটা দিখাইছিলাম!

বাবু ভুলে গেল তার কথাটা, ডাকল তাকে, রাধে ইদিক আয়, যা অন্ত।

কুন্তি বলল, মাইতিবাবু তার অশ্ব ধলা না কালা ভুলি গিইছে।

নাকি মাইতিবাবু তার অশ্বটা কি না তা জানতে এয়েছিল।

তবে বন্ন কেনে? কুন্তি জিজ্ঞেস করে।

বন্নেই তো অশ্ব চিনা যায়। বলল কুন্তির মা।

অশ্ব খোঁজে না বন্ন খোঁজে মাইতিবাবু হোটেলিয়া? জিজ্ঞেস করে কুন্তি।

অশ্বই তো মনে হয়। বলল কুন্তির মা।

না, বন্ন বুধ’য়। বিড়বিড় করে কুন্তি।

অনন্ত বলে, আমি তা’লে যাই।

মা মেয়ে ডান দিকে নেমে গেল অলঙ্কারপুরের দিকে। অনন্ত সার চলল ভেড়িবাঁধ ধরে দীঘা নগরীর আলোর দিকে। বেশ জোরেই পা চালায় সে। গিয়ে শ্রীপতি মাইতিকে ধরতে হবে গাঁজায় দম মারার আগে। এখন শ্রীপতির নানান কাজ। যদি গাঁজা টেনে বসে থাকে তো একরকম। আর যদি হাসপাতালের নার্স দিদিমণির কোয়ার্টারে গিয়ে বসে থাকে, সে আর একরকম। তাহলে কথাটা বলা দুঃসাধ্য হবে। গাঁজায় চুর হয়ে থাকলে তবু কথাটা বলা যাবে। শ্রীপতিবাবু হয়তো বুঝবে, হয়তো বুঝবে না। না বুঝলেও দু-চার টাকা পাওয়া যেতে পারে। শ্রীপতি বলে গেছে অশ্বের কোনো রকম খোঁজ পাওয়া গেলেই পয়সা মিলবে। এও তো একরকম খোঁজ দেয়াই হলো। বাবু, আপনের অশ্বের বন্ন ছিল ধলা। সেই ধলা অশ্বই লায়কানখাসে সন্ধেবেলায় দাঁড়াল এসে। কুন্তি ঠিক দেখেছে। মেয়ের বুদ্ধি আছে। বুদ্ধি শুধু তার ছিল না। ছিল না বলেই পরদিন সেই কটকী মেয়ে, বাবুর রাখনি রাধের সঙ্গে বলল কথাটা। আসলে সে তো কটকী নয়, চন্দনেশ্বরে শ্বশুরঘর, বাপের ঘর মোহনপুর। মোহনপুর ওড়িশায় নয়, বাংলায়। শ্বশুরঘর থেকে তাকে খেদিয়েছে। সে গিয়েছিল কটক, এক বাড়ির কাজের লোক হয়ে। স্বামী খেদানো মেয়েমানুষের কাজ তো ওই। সেখানে বাবু দেখে তাকে। বাবু টাকাপয়সা দিয়ে, পথনির্দেশ দিয়ে চলে এসেছিল। সেও ঠিক চলে এসেছে। রাখনিকে তো জমিও দেয় বাবুরা। ঈশ্বরপুরে বাবুর এত জমিন। তাকে তো দিতেও পারে যদি সে খুশি করতে পারে বাবুকে। স্বামীর ঘর সুখের হয়নি। হাউহাউ করে কেঁদেই ফেলল সে। বুড়া স্বামী, তার রং ছিল এক দোকানিয়ার ছেলের সঙ্গে। কী করবে সে? মন যে অমন হলো।

অনন্ত সেই যুবতীকে ডাকল, যার যেমন কপাল মা।

মা শুনে ফুঁসে উঠল রাধা, তুমি কেমন বেটাছেল্যা গো!

অনন্ত বলে, বাবুর রাখনি, তাই তো হবে।

রাধা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, আশীব্বাদ করো বাবুর সেবা করে যেন জীবনটা যায়। দোকানিয়ার ছেল্যা আমারই বয়সী হবে, তার কথা মু ভুলি নাই, কিন্তু সে মোর সব্বোনাশ করল শউর ঘরে ধাওয়া করে।

অনন্ত বলল, বর্গা জানো?

বর্গাদারি, মোর বাপ বর্গাদারি করে।

মু যদি বাবুর পাঁচ বিঘায় বর্গাদারি করি, ভাগচাষির নাম লিখাই।

হলো সব্বোনাশ। সন্ধেয় বাবু ডাকল তাকে আচমকা। ঘরে বাবুর রাখনি বাবুর ডানদিকে বসে আছে। তার বুকের আঁচল ফেলা, পক্ক বিল্বফলের মতো দুই বুক প্রায় উদ্ভাসিত, ঊরু পর্যন্ত কাপড় তোলা, বাবুর পেটে তার হাত। জলপাত্র, মদ, মাংস রয়েছে বাবুর সামনে। অন্ধকারে সে টের পেল বাবুর চোখ লাল। বাবু তাকে দেখে সিধে হতেই বাবুর মস্ত ছায়া দেয়ালে টলমল করতে লাগল। সে দরজায় দাঁড়িয়ে। বাবু ডাকল, রাধিকে।

রাধিকে খিলখিল করে হাসে, কী বলো মোহন বাঁশি?

বাবু সেই মেয়েমানুষের বুকে হাত মেলে দিল, বলল, দলামলা কর।

একাজ ছিল তার। এই কাজে তার সঙ্গে বাবুর অনেক কথা হতো। কথা তার যত না বাবুর তত বেশি। ঈশ্বরপুরে এসে বাবু সন্ধেবেলায় তাকে ডাকত, অন্তা।

অনন্ত বলত, রামাই পাতর, উটা বলে মোর দেশের মতো ভাগ দিবে।

কত ভাগ?

ও লিবে তিন ভাগ, আমরা পাব এক ভাগ, রামাই গোল উঠাচ্ছে, উটাকে ইবার খেদান বাবু।

রামাই দূর হলো। ওই এলাকায় কত জমি প্রত্যাশী মানুষ হামলে পড়ত বাবু গেলে। বাবু তো বছর বছর চাষা বদলাবে, অন্তত এক জমি দুবছর চষতে দেবে না কাউকে। একই জমি যদি চষে চাষা, তবে নাকি সেই জমির ওপর মায়া বসে যায়। ছাড়তে চায় না। তখন গোলমাল শুরু হয়। চাষা মনে করে জমি তার নিজের।

বাবু বলল, রাধেরে তুই কী বলিচিস?

রাধিকা বাবুর গালে গাল ঘষল, আরও গা ঘেঁষে এলো। বাবুর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, ও কথা ইখন বলেন কেনে বাবু, ইখন আপনার লিশার সময়।

সাতকাহন করে বলেছিল রাধিকা। যতটা সে বলেছিল, তার চেয়ে বেশি। সতেরো বছরের সম্পর্কে সন্দেহ ঢুকল। সেই মোহনপুরের মেয়ে, চন্দনেশ্বরের বউ, কটকের রাখনি ঈশ্বরপুরে এসে তিন দিন ধরে কী বিজবিজ করল বাবুর কানে, বাবু গেল ক্ষেপে। রাধিকা বলল, ও আপনের সব সম্পত্তি নেবে, বর্গাদারি করাবে।

অনন্ত সার সমুদ্রের কাছে এসে পৌঁছেছে। সি-ডাইক বাঁ দিকে ঘুরে গেছে। সে নেমে পড়ল বাঁধ থেকে। তারপর বেলাভূমি ধরে এগোতে থাকে। পূর্ণিমার জোয়ার এখনই ছুঁয়ে ফেলবে তার পা। সে দ্রুত হাঁটতে লাগল। উঠে এলো বেলাভূমি থেকে ওপরে, পাথুরে গার্ডওয়ালের সিঁড়ি ধরে। কদিন আগেও এই সমুদ্র নগরী, সৈকত শহর গমগম করছিল। এখন একেবারে নিঝুম। আরও নিঝুম হবে বর্ষা নেমে গেলে। তবে শনি, রবিবার তো চাপ থাকেই। লোক আসে। বাস থেকে দু-পাঁচজন অচেনা মানুষ নামে। শ্রীপতিবাবুকে ধরে হোটেলে একটা কাজ পেলে হয়। দেবে না শ্রীপতি? অশ্বের বর্ণের খবর নিয়ে এলো সে। কেমন বর্ণ? না ওই যে ঢেউ ভাঙছে, সমুদ্র ফুলে উঠে ভেঙে পড়ছে জলের ফেনা, ওই রকম সাদা। বাবু, সে অশ্বের বন্ন আছে, ভুল বলিছিলাম।

হোটেল সমুদ্রপাখি কাফেটোরিয়ার উলটো দিকে শিব মন্দির যাওয়ার পথে। শিবতলা রোড। এ হোটেল বছর দেড়েক দোতলা হয়েছে। আগেও তো সে এসেছে এখানে। অন্ধকার হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁকল, ছিপতিবাবু, বাবু আছেন নাকি?

হোটেলের সামনের চালাঘর থেকে বেরিয়ে এলো মধ্য বয়সী ঠাকুর, কী চাই?

অনন্ত বলল, বাবু নাই?

বাবুরে কী হবে, মোরে বল।

অনন্ত বলে, বাবুর অশ্ব।

অশ্ব! হা হা করে হাসল ঠাকুর, অশ্ব কই?

ধলা বন্ন তো?

হ্যাঁ ধলা বন্ন, কী হয়েছে?

অনন্ত চুপ করে থাকল। ঠাকুর লোকটি বড় পাটোয়ারি। ঠাকুর ঠাকুরানিই যেন হোটেলের মালিক। দোতলা বিল্ডিং, কিন্তু সামনে টালির চালা, কিচেন। অনন্ত বিড়বিড় করে, ধলা বন্ন তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ, ধলাও হতে পারে, কালাও। ঠাকুর পকেট থেকে বিড়ি বের করে ধরায়, তোর মেয়ে না ওই কুন্তি, নুন বেচতে আসে বাজারে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *