1 of 2

অশ্বচরিত – ৩০

তিরিশ

বারান্দায় মাদুরে বসেছিল ভাইবোন। গৌরমোহন আর ঊষা। ভানু আগে, তার পিছনে শিবরাম ঢুকল ভিতরের উঠোনে। ভানু দেখল ভাইবোনের মুখ ষাট পাওয়ারের আলোর নিচে রক্তহীন হয়ে গেল আচমকা। ভানুর মনে হলো শিবরামের কথা যেন ওরা দুজনে বেশ ভালোভাবেই শুনেছে। কী যেন আলাপ করছিল ভাইবোনে, কথা বন্ধ হয়ে গেল। মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকে যায় শিবরাম। শিবরাম ভিতরে ঢুকতে ঊষাও ঢুকল। ভানু বসল গৌরমোহন মদরঞ্জিওয়ালার পাশে। চুপচাপ। বারান্দায় কোনো কথা নেই। কথা ভিতরেও নেই। নীরবতা থমথম করতে লাগল। এত স্তব্ধ চারপাশ যে দূরের নদীর ছলচ্ছল যেন টের পেতে লাগল ভানু। ঘাড় তেরচা করে আকাশে তাকিয়ে আছে সে। ধ্যানমগ্ন হয়েছে যেন গৌরমোহন। ভানু অনন্ত এক নৈঃশব্দ্যকে অনুভব করছিল যেন। আকাশ থেকে লম্বা করে পুব হতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একটি আলোর টুকরো ছুটে যেতে দেখা গেল। ওদিকে, দূর অন্ধকারে সমুদ্র আছে কোথাও। সমুদ্রে পড়েছে উলকা! ভানু যেন সেই

পতনের শব্দ শুনতে পায়।

বহুক্ষণ বাদে গৌরমোহন বলে, ঘোড়াটা মিলল না?

ভানু চমকে ওঠে, মিলবে না?

কী জানি! গৌরমোহন বিড়ি ধরায়। ধোঁয়া উড়িয়ে দেয় বারান্দার বাইরের অন্ধকারে। উঠল। উঠে বারান্দার আলোটি নিভিয়ে দিয়ে এলো। ঘন অন্ধকার ব্যাপ্ত হলো সর্বত্র। কী অন্ধকার! ভানু বলল, ওই দিন মরুভূমির নিচে অ্যাটম বোমা ফেলেছিল, জানো কি?

তাই তো! গৌরমোহন বলল, মনে তো ছিল না, তুমি সেই পূর্ণিমার কথা বলছ তো, কী আশ্চর্য! মিঠাই বিলি হলো, পরদিন আবির মাখাল আমাকে।

ভানু তখন সুরেন কুণ্ডুর কথাটি বলল। শুনে গৌরমোহন বলল, তাহলে তো নতুন করে খুঁজতে হয় ভানুবাবু।

হুঁ, আর একটা কথা কি জানো?

কী?

কথাটা বলেছিল সুভদ্ৰা বউ।

কার বউ?

ভানু বলল, ও বলেছিল ওই দিন দুপুরে চাঁদবালির আকাশ পুড়িয়ে সমুদ্রে কী যেন ছুটে গিয়েছিল, আকাশ কালো হয়ে গেল, জ্বলে গেল যেন।

কোন দিন?

সেই বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন।

কী ওটা?

রকেট।

সে কী?

ক্ষেপণাস্ত্র বলে, কথাটা ভুলেই গিছলাম, তখন কিছু মনেই হয়নি, এমনকি সুরেন কুণ্ডু বলার পরও মনে পড়েনি, এখন মনে পড়ল।

কেন মনে পড়ল?

আকাশ দিয়ে তারা খসে যাচ্ছে দেখে মনে হলো কথাটা।

এ সময় তারা খসে যায়, কিন্তু সুভদ্রা কে?

সে অনেক বলতে হবে, পরে শুনো, কিন্তু ঘোড়াটা যদি না এসে থাকে এদিকে, অবনী মৃধা লোকটা বলল কেন?

কোনো কোনো লোক অমন থাকে।

কীরকম থাকে? ভানু জিজ্ঞেস করে।

গৌরমোহন চুপ করে থাকে। ভানুর মনে হয় অবনী মৃধা লোকটি ইচ্ছে করেই তাকে ওই রসুলপুরের নদীর দিকে পাঠিয়েছে। লোকটা কে? লোকটা কী বলতে চায়? লোকটা কি বলতে চায় তার কন্থক এই শান্ত দৌলতপুর, দরিয়াপুর, রসুলপুরের নদী, খোলা আকাশ, নরম বাতাসে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। বিশ্রাম নিচ্ছে ক্লান্ত ঘোড়াটি? এই জায়গা তো বিশ্রামের উপযোগী। আহা, কী স্নিগ্ধতা জড়িয়ে রয়েছে এর অন্ধকারে, এর নীল জ্যোৎস্নায়! জ্যোৎস্নায় ভুঁইয়ের ওপর পড়ে থাকা গাছের ছায়াটি কী সুন্দর! ভানু কিছুটা দেখে, কিছুটা কল্পনা করে। সে বলে, মদরঞ্জিওয়ালা, কাপালকুণ্ডলা বইটা কি আছে এ বাড়িতে?

কেন?

এখানে বসে পড়তাম, পড়ে শোনাতাম।

কে শুনত?

ভানু বলল, অন্ধকার, আর অন্ধকারে সে।

সে কে? গৌরমোহনের গলার স্বর কেঁপে যায়।

তোমার কোকিলা।

তুমি যাও না তার নিকট, সে তোমাকে খুব মানে, ঘোড়াওয়ালা বলে হি হি করে হাসে।

ভানু বলল, খুব গুণী কইন্যা তোমার কোকিলা, চাও না কপালকুণ্ডলা বইটা। তাহলে তো আলো জ্বালাতে হয় আবার।

ভানু বুঝল তাও তো সত্যি। আলো ছাড়া পড়া হবে কী করে? আর আলো জ্বললে বারান্দার এই অন্ধকার, আকাশের এক কোণে শীর্ণ চাঁদের আবছা হলুদ আলোর বিভা, সব মুছে যাবে। বারান্দা থেকে, উঠোন থেকে বেরিয়ে তারা নদীর দিকে চলে যাবে।

ভানু বলল, আমরা রাতে আলো জ্বালাই কেন?

আমরা মানে? গৌরমোহন হকচকিয়ে যায়।

মানুষ কেন সন্ধে হলে পাখির মতো কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে না, ও মদরঞ্জিওয়ালা?

গৌরমোহন বলল, তা’লে কী হতো?

ভানু বলল, ঘোড়াটা পালাত না. ওকে হারিয়ে আমি যে কী করি!

কে বলল, এসব?

মনে হলো তাই বললাম। হাসল ভানু।

আলোটা জ্বলে ওঠে। ভানু ভাবছিল জ্বলবে। তার কথাটি কি ভেতরে যায়নি? ঊষা কিংবা শিবরাম শোনেনি? ঊষা দাঁড়িয়ে আছে হাতে একটি বাঁধানো বই নিয়ে। বইটি মাদুরে রেখে দূরে গিয়ে বসল, মদরঞ্জিওয়ালার বোন।

ভানু বইটি হাতে নেয়। জীর্ণ হয়েছে, কত পুরনো! বহুবার পাতা খোলা হয়েছে, বহুবার বহু হাতে ঘুরেছে বইটি। ভানু বইটি চোখের সামনে মেলে ধরল। শিবরাম দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে এবার বলল, আমি পড়ি?

ভানু বলল, পড়ো তাহলে আমি অন্ধকার পাই দুচোখ বুজে।

শিবরাম বইটি নিতে ঊষা উঠল। ভিতরে চলে গেল। গৌরমোহন দেখল তা, বলল, ও ভিতরে বসে শুনবে।

শিবরাম আরম্ভ করল :

‘প্রায় দুইশত পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে একদিন মাঘ মাসের রাত্রি শেষে একখানি যাত্রীর নৌকা গঙ্গাসাগর হইতে প্রত্যাগমন করিতেছিল…।’

ভানু চোখ বুজতে বুজতে দেখল গৌরমোহন তাকিয়ে আছে শিবরামের মুখের দিকে। শিবরাম মগ্ন স্বরে এক একটি বাক্য শোনাচ্ছে। গৌরমোহন কি শুনছে না? মনে হচ্ছে শিবরামের মুখের দিকে তাকিয়ে গৌরমোহন অন্য কথা ভাবছে। কার? কোকিলার? গৌরমোহন কি জানে শিবরাম মনে মনে কোকিলাকে শোনাচ্ছে। শিবরাম কি কল্পনায় কোকিলা বধূকে অনুভব করছে দূরের অন্ধকারে, বিজনে? শিবরামের কণ্ঠস্বর শ্রুতিগোচর হয়। শুনতে শুনতে ভানু দাসের দুই চক্ষু মুদে আসে। তখন ‘শিশিরাকাশে নক্ষত্রমণ্ডলী নীরবে ফুটিতে লাগিল, যেমন নবকুমারের স্বদেশে ফুটিতে থাকে, তেমনি ফুটিতে লাগিল। অন্ধকার সর্বত্র জনহীন;–আকাশ, প্রান্তর, সমুদ্র, সর্বত্র নীরব, কেবল অবিরল কল্লোলিত সমুদ্র- গর্জন আর কদাচিৎ বন্য পশুর রব। তথাপি নবকুমার সেই অন্ধকারে, হিমবর্ষী আকাশ, আকাশতলে বালুকা স্তূপের চতুর্পার্শ্বে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। কখনো উপত্যকায়, কখনো অধিত্যকায়, কখনো স্তূপতলে, কখনো স্তূপশিখরে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন।…

ভানু দাস যেন তন্দ্রার ঘোরে সব দেখতে পায়। কতদিন বাদে তারা ফোটার মতো করে তার সম্মুখে ফুটে উঠছিল সম্মোহনি শব্দের আলোকবিন্দু। কতকাল বাদে, যেন কত যুগ বাদে উচ্চারিত মন্ত্রের মতো শব্দরাজি তার কানের ভিতরে প্রবেশ করে সমস্ত শরীর স্তব্ধ করে দিচ্ছিল। ভানুর মাথা হেলে পড়ে। ভানু স্পষ্ট দেখে সেই অরণ্যময়, সৈকতময়, সমুদ্র উপকূল। সূর্যাস্ত হয়ে এলো প্রায়। বালিয়াড়ির ধবল শিখরমালায় ধীরে ধীরে ছায়া বিস্তৃত হচ্ছিল। একটু বাদে সব বিলীন হয়ে যাবে। সমুদ্র, জলরাশি, সৈকতভূমি, অরণ্য সব একই অন্ধকারে শূন্য হয়ে যাবে। শুধু রয়ে যাবে কলকল্লোল। রয়ে যাবে তরঙ্গভঙ্গ প্রক্ষিপ্ত ফেনার রেখা। শ্বেতপুষ্পে গ্রথিত মালার ন্যায় ধবল ফেনারেখা নীল অন্ধকারে নীল জলমণ্ডলে একমাত্র দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। ভানু দেখতে পায় অস্তগামী দিনমণির সুবর্ণ আলোকরশ্মি নীল জলের একাংশে রক্তরাগ মণির বিভায় ফুটে উঠেছে। শ্রীপতি মাইতির ঘোড়াটি বেরিয়ে এলো অরণ্য থেকে। বালিয়াড়ির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে সে। ভানু দেখতে পেল প্রদোষকাল সন্নিকটে। দিবাবসান আসন্ন। নীলাম্বুরাশি প্রবল হয়ে উঠছে ক্রমশ। সমুদ্র-গর্জন আর সমস্ত শব্দকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছিল। ভানু ঘাড় ঘুরিয়েছে কী এক দীর্ঘশ্বাসে। তারপর! ‘ফিরিবামাত্র দেখিলেন অপূর্ব মূর্তি! সেই গম্ভীরনাদি বারিধি তীরে সৈকতভূমে অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকে দাঁড়াইয়া অপূর্ব রমণী মূৰ্তি!”

কে, কোকিলা বধূ ঐ?

কোকিলাই। আধো তন্দ্রার ঘোরে শিবরামের কপালকুণ্ডলা পাঠ কানে আসছিল। তন্দ্রাচ্ছন্নতায় সেই অপূর্ব রমণীকে দর্শন করে ভানু বলে, ঘোড়াটি কোথায় গেল কিছু খোঁজ হলো না, সেদিন ছিল বুদ্ধ পূর্ণিমা, কুমারের জন্মদিন কন্তুকের মনে ছিল!

উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ জ্বলে উঠল। সহস্র সূর্যের আলোয় আকাশ যেন ঝলসে পুড়ে গেল। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল আকাশ সমুদ্র। তেজস্ক্রিয় ধূমরাশি, নিকষকালো ধূম, জলতল, সৈকতভূমি থেকে মাথার আকাশ পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়ে গেল। আকাশের যত তারা নিবে গেল সব। বিস্ফোরণে ছুটতে আরম্ভ করল কন্থক। তার সর্বাঙ্গ গলে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে, পুচ্ছ কেশর রক্তাভ আগুনের গ্রাসে পড়ে মুছে যাচ্ছিল ক্রমশ। ভানু ডাকল, কোকিলা হে, আমার কন্থক? ভানু কোকিলার দিকে চেয়ে আছে।

‘অনন্তর সমুদ্রের জনহীন তীরে, এইরূপে বহুক্ষণ দুইজনে চাহিয়া রহিলেন। অনেকক্ষণ পরে তরুণীর কণ্ঠস্বর শুনা গেল। তিনি অতি মৃদু স্বরে কহিলেন, “পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?”

ভানুর ঘাড় আরও কাত হয়ে গেল। গৌরমোহন অস্ফুট স্বরে বলল, ঘুমিয়ে পড়েছে।

তাহলে বন্ধ করি? শিবরাম বইখানি কপালে ঠেকায়।

পরদিন সকালে গৌরমোহন ট্রেকারে তুলে দিল ভানুকে, বলল, মীরগোদা ঘুরে যেও।

কাঁথি, রুপশ্রী সিনেমা হলের কাছে ঘুরঘুর করতে করতে ভানু ঠিক করতে পারছিল না মীরগোদা যাবে কি না। গৌরমোহন নেই, কোকিলা, যুবতী বধূ একা ঘরে রয়েছে ওই নির্জন, প্রাচীন মরুভূমি প্রায় সাগরকূলে, তার যাওয়া কি ঠিক হবে? গৌরমোহন কেমন মানুষ, বউ ফেলে রেখে ভগ্নীর ঘরে গিয়ে বসে আছে। কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না। হয়তো আছে শিবরামের বউ গৌরমোহনের ভগ্নীর ডাকে গৌরমোহন গেছে। শিবরামের মনের বাসনা কি ঊষা জানে? জানে হয়তো, তাই তাকে পাঠাল নাকি গৌরমোহন মীরগোদায়? নানা রকম ভাবনাচিন্তায় ঘুরপাক খেতে খেতে ভানু কাঁথি থেকে বাস ধরে দীঘার পথে রামনগর নামল, তারপর সেখান থেকে ভ্যান রিকশায় উঠে চলল মীরগোদা হাটে। হাটবার নয়, তাই শূন্য চালা, ঘুমন্ত কুকুর আর তাস খেলায় মগ্ন জনাকয় অলস ব্যাপারী ছিল। ভানুকে তারা দেখল, কোনো কৌতূহল প্রকাশ করল না। ভানুকে হয়তো চেনে। দীঘায় যাদের যাওয়া-আসা, তারা চিনবে না কেন। ভানু চলল মদরঞ্জিওয়ালার কুটীরে। ডান ধারে বালির স্তূপ, ঝাউ জঙ্গল, বালির ঢেউ রেখে, প্রাচীন সমুদ্রচিহ্ন রেখে দিয়ে পৌঁছল গৌরমোহনের বাড়ি। আছ নাকি কোকিলা বধূ, আছ, আমি ঘোড়াওয়ালা ভানু দাস এলাম।

ঘুমোচ্ছিল কোকিলা। ঘরের আগল বন্ধ ছিল। দরজা খুলে ঘুমভাঙা চোখ ডলতে ডলতে, গায়ের আঁচল তুলতে তুলতে বেরোল দাওয়ায়। ভানুকে দেখে সে ভাবলেশহীন, দাওয়ার কোণ থেকে মাদুর টেনে দিতে দিতে বলল, জানতাম, তোমারে পাঠাবে জানতাম, তা দেরি হলো কেনে?

জানতে! ভানু তো অবাক। বসল মাদুরে।

মনে হচ্ছিল কদিন ধরে, তুমার আসার দিন হয়ে গেছে।

সে কী কথা, আমি তো নিজেই জানতাম না আসব।

খুব জানতে! কোকিলা বলে, ঘোড়াটারে কি খুঁজে পেলে হে?

না, কিন্তু একজন খবর দিল…। ভানুর মনে পড়ল অবনী মৃধার কথা। অবনী মৃধা খবর দিল তাই না সে দৌলতপুরের দিকে গেল। গেল বলেই না গৌরমোহনের সঙ্গে দেখা হলো। দেখা হলো বলে শিবরামকে চিনল সে। রসুলপুরের নদী, শিবরামের আত্মউন্মোচন, সব হলো। কিন্তু অবনী মৃধা লোকটা কে? কেন তাকে মিথ্যে বলে দৌলতপুরে পাঠিয়েছিল? উদ্দেশ্যটা কী? চেনে নাকি তাকে কোকিলা? অমন নাম শুনেছে কখনো? গায়ে পড়ে আলাপ করল ভানুর সঙ্গে। বুদ্ধ পূর্ণিমার রাতে ঘোড়াটা উধাও হয়েছে শুনে, আর ঐদিনেই পোখরানের বালির নিচে…।

কোকিলা শুনে অবাক, কী বলছ ঘুড়াওয়ালা?

ভানু বলল, এই সত্যটি জানা ছিল না, জানলাম তো বজবজে গিয়ে।

কোকিলা বলে, কী আশ্চর্য! আমি তো জানি, মোর তো সব জানা ভানুদাদা, পরদিন হাট ছিল, কুনোদিন যে লক পেপার আনেনি, লিয়ে এলো একখানা, আর তার মাথায় সবুজ রঙের আবির, মিঠাই লিয়ে এলো গৌরদাদা।

বলল না তো আমারে।

স্মরণ করায়ে দিয়েছ বোমা ফাটানোর কথা?

হ্যাঁ, বলেছি তো।

কী বলল?

শুনল শুধু, কিছুই তো বলল না।

মনের দুঃখে আছে মদরঞ্জিওয়ালা।

দুঃখটা কী? জিজ্ঞেস করে ভানু।

তা সে জানে, তুমি যদি দেখতে, কী আনন্দ লকটার সেদিন, পেপারটা রয়েছে ভিতরে, আমি ছবি দেখলাম, ও কিছু কিছু পড়ে শুনাল।

ভানু ঠোঁট কামড়ায়, তুমি পড়তে পারো না?

না। বিষণ্ন মুখে জানায় কোকিলা।

তুমি এত সুন্দর আঁকতে পারো পড়তে জানো না?

আঁকা তো শিখিনি, দেখে হয়েছে।

কী করে?

বাহ্, এই যে আশমান, বনজঙ্গল, নদী, সমুদ্দুর, মাঠ গাছপালা ইসব চিনতে তো লক লাগেনি ভানুদাদা, এই যে আলো, রোদ্দুর, মেঘ, বিষ্টি, সন্ধে ইসব চিনতে তো লক দরকার হয়নি ঘুড়াওয়ালা, এই যে লাল, নীল, হলদে, সবুজ, বেগুনি, কমলা, তুঁতে নীল রং, রামধনুকের সাত রং, ইসব তো আপনাআপনি চিনা হয় ভানুদাদা, কিন্তু ‘ক’ বলতে গেলেও লক লাগে, জুছনা চিনি বটে, নীল জল চিনি, নীল জুছনা চিনি, কিন্তু ‘ক’ কাগজে তা লিখা থাকলি চিনতা পারবনি, আর গৌরদাদা তো শিখাল না।

তুমি শিখবে বলেছিলে?

বলি নাই, কিন্তু সে তো জানে মু ‘ক’ চিনিনি, ‘খ’ চিনিনি।

ভানু দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর হেসে কোকিলার বিমর্ষ ভাবটি উধাও করে দেয়, তুমি তো আসলটাই চেনো, রং চেনো, আমি রং কানা।

তুমি রং কানা, বিশ্বাস করি না।

তাই তো বটে, রঙের নাম জানি, রঙের চেহারাটি জানি, ভিতরটা অন্তরটা কি জানি? রঙের রূপ জানি না, রং কেমন কথা বলে তা জানি না।

কোকিলা বধূ বলে, থাক উসব কথা, বলি সেই কার কথা যেন বলছিলে, অবনী মিরধা না কেডা, কী হলো বলো।

সে কেন মিথ্যে বলে পাঠাল আমারে দৌলতপুর?

কথাটা তো সত্যিও হতে পারে। বলল কোকিলা, সে হয়তো দেখেছিল তুমার ঘুড়াটারে, দিখতেও তো পারে।

ভানু চুপ করে থাকে। ভানু দুচোখ বন্ধ করে। কোকিলা বধূ, তুমি কি বুঝবে শূন্যপৃষ্ঠ অশ্ব কন্থককে নিয়ে আমি ফিরেছিলাম কপিলাবস্তু নগরে। অশ্বটির সব ছিল, ভূষণ ছিল, শ্রী ছিল না। যে পথ আমরা এক রাত্রে পার হয়েছিলাম কুমারকে নিয়ে, কপিলাবস্তুর রাজপুত্রকে নিয়ে, সেই পথে ফিরেছিলাম আট দিন ধরে। শ্রীহীন পৃথিবী, জীর্ণ, বলহীন হয়ে গিয়েছিল আমার ঘোড়া। তবু তো সেই ঘোড়াটি ভগবানের স্মৃতি। তাকে নিয়ে বাঁচতাম। কন্থক আমাকে ছেড়ে গেল তো আমি কী করে বাঁচি!

কী বলো তুমি ভানুদাদা?

ভানু বিড়বিড় করে, কন্থকের হ্রেষারব শুনে তুমি তো ভাবলে রাজপুত্র ফিরে এসেছে, আসলে কেউ ফেরেনি!

কী বলো তুমি?

ছন্দক মাথা নত করে দাঁড়াল, কন্থকও, রাজপুত্রের মহানিষ্ক্রমণ হয়েছে।

এসবের মানে কী?

ভানু হাসল, তারপর আচমকা জিজ্ঞেস করে, শিবরাম কেন কোকিলার কথা জিজ্ঞেস করে বারবার?

কোকিলা চমকে ওঠে, ভানু শোনে, সে যেন বলে, কী কহ তুমি ছন্দক?

ঠিকই কহি।

কোকিলা বলে, তবে শুনে রাখো মদরঞ্জিওয়ালা ব্যতীত মোর কেহ নাই, কেহ নাই।

তা আমি জানি।

তবে যে কহ লকটার কথা?

সে লোক যে কথা বলেছে আমারে তা যদি শুনতে!

কী কথা?

ভানু বলল, থাক, সে যদি তোমারে না বলে, আমি কেন বলি?

সে কি আসবে? গলার স্বরে বেদনা ও আর্তি ফুটে ওঠে।

তা তো আমি জানিনে।

যদি দেখা হয়, না আসিতে কহি দিয়ো ভানুদাদা, আমার আঁকা টাঁকা সব নষ্ট করি দিবে অই শিবরাম।

তুমি বলছ?

হ্যাঁ, তুমি ঘুড়াটার কথা বলো, কী যেন বলছিলে, সিটাই কহ, ঘুড়াটা তুমার কী ছিল, ঘুড়ার মালিক তো হুটেলওয়ালা।

আমি যে ওর সঙ্গী, সেই কতকাল আগে থেকে।

কতকাল?

ভানু বলে, যেদিন আমাদের ত্যাগ করে রাজপুত্র জন্ম-মৃত্যু খুঁজতে বেরিয়ে গেল, সেদিন থেকে, মনে আছে তোমার কোকিলা বধূ?

কোকিলার চোখে জল এলো। কেন এই অশ্রুবিন্দু তা কি কোকিলা জানে? এখন সে মদরঞ্জিওয়ালার বউ, পেটে ভাত, গায়ে কাপড় জোটে না, কিন্তু এমন কি ছিল বহু বহু বর্ষ আগে, সেই রাজ অন্তঃপুরে? রাজদাসী হলেও তো ছিল সেই কুমারের দাসী, ভগবানের পা ধুইয়ে দিত সে, মনে পড়ে তা?

কোকিলা কাঁদছিল। কিছুই বুঝতে পারছিল না ছন্দকই বা কে, কাকেই বা ফেলে রেখে এলো ঘোড়াটা? শূন্যপৃষ্ঠ নিয়ে গেলই বা কোথায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *