1 of 2

অশ্বচরিত – ৫

পাঁচ

কোকিলা বধূ, গৌরমোহনের মদরঞ্জি, শুক্লপক্ষ ধরে ঘোড়াটি মাদুরে বুনে তোলা, বৈশাখী পূর্ণিমার সকালে উঠোনে ধুলোর ওপরে আঙুল দিয়ে টেনে টেনে ঘোড়াটিকে এঁকে ফেলা—সব শুনতে শুনতে শ্রীপতির মাথা ঝনঝন করতে লাগল। ভানু সব বানাচ্ছে, না সত্যি দেখে এসেছে কোকিলা বধূ, জাদুকরীকে? শুনতে শুনতে শ্রীপতি ডাকল ঠাকুরানিকে, কলকে সাজা, ভানু মাথায় করে কী খবর এনেছে তার কন্তুকের!

ভানু খুব খুশি, বুঝতে পারছে মাইতিবাবুর মনে ঢেউ উঠেছে। তার কথা বিশ্বাস করছে শ্রীপতি মাইতি। বিশ্বাস যখন করছে তখন আবার পলাতকের সন্ধানে যেতে পারবে সে। এখানে, এই সমুদ্র তীরে পৃথিবীর তিনটি দিক। দক্ষিণে জলের সাম্রাজ্য, দক্ষিণে যেতে হলে নৌকো লাগবে। শ্রীপতির কলকের প্রসাদ পেয়ে ভানু ভাবল দক্ষিণেই বা যাবে না কেন? কন্থক কি উড়ে যেতে পারে না? সেই জাভা, সুমাত্রা, বালিদ্বীপ! কী হয়েছে ধরা যাচ্ছে না। তার ঘোড়ার একটু বারমুখো মন আছে। আবার ফিরে আসার অভ্যেসও তো আছে। ভানু এখেনে আছে বছর পাঁচ। আগের খবর সে জানে না, তবে ঘোড়ার পালানোর খবরও শোনেনি। ওই ঘোড়া প্রথম পালানো ভানুর হাত থেকেই। চন্দনেশ্বর থেকে চোদ্দবেড়িয়া সুবর্ণরেখার চরে। যায় আবার ফিরেও আসে। আর যায় তো আশ্বিনে। সেবার পুজোর আগে ঘোড়াটাকে নিয়ে ভানু গিয়েছিল চন্দনেশ্বর মন্দিরে মাথা কামিয়ে চুল দিতে। বাবু শ্রীপতি মাইতি তখন দীঘায় ছিল না, গিয়েছিল বালিমুণ্ডা, চাঁদবালি। ওদিকে শ্রীপতির কিছু সম্পত্তি আছে, মাতুল সম্পত্তি ও পেয়েছে একশ বিঘের মতো। কিছুটা সেই সম্পত্তির টানে, আর কিছুটা অন্য ধান্ধায় গিয়েছিল শ্রীপতি ওদিকে। বাবু নেই, ঘোড়া আছে। ভানু ঘোড়ায় চেপে চলে গেল চন্দনেশ্বর। ফেরার সময় তাকে ফেলে ঘোড়া ছুটে গেল দক্ষিণ-পশ্চিমে। সেই তার প্রথম পালানো। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। ভানু খুঁজতে খুঁজতে, গাঁয়ের মানুষকে জিজ্ঞেস করতে করতে তাকে পেয়েছিল চোদ্দবেড়িয়ায়, সুবর্ণরেখা আর সমুদ্রের মোহনার কাছে এক মস্ত ঘাসের চরে। তাদের ঘোড়া একা ছিল না সেখানে। ছিল আরও কয়েকটি ঘোড়া। কিন্তু তাদের ধরবে কে? লাফ দিচ্ছে সবুজ ঘাসে, আনন্দে চিঁহি চিঁহি ডেকে উঠেছে নীল আকাশে পালক মেঘের দিকে তাকিয়ে, সমুদ্রের দিকে গলা বাড়িয়ে। ধরা তো যায়নি। এক মাদী ঘোড়ার নেশায় পড়েছিল কন্থক। মাদি ঘোড়া যার, সেই লোক ও হাজির। গিরিমশায় চন্দনেশ্বর, হিনাড়ির লোক। তাকে ভানু ধরেছিল, এটা কি ঠিক হচ্ছে বাবু, ফিরিতে পেটে বাচ্চা লিয়ে চলে যাবে আপনের ঘুড়ী, এসব এমনি এমনি হয়? এ ঘোড়ার জাত জানেন, রাজপুত্র গৌতমকে বিসজ্জন দিয়ে শূন্য পৃষ্ঠে এই ঘোড়া আমাকে নিয়ে কপিলাবস্তু ফিরেছিল, মনে পড়ে বাবু? আমি ছন্দক সাথী। কিছু ছাড়ুন, না হলে আমি আমার বাবুরে দি কেস করাব, ফোকটে পাল খাওয়াবেন, অমন একখান তেজি ঘোড়া পেটে ধরবে আপনের ঘুড়ী!

একটা নয়, তিনটে ঘুড়ীর সঙ্গে ফুর্তি করে ফিরে এসেছিল মাইতিবাবুর পঙ্খিরাজ। তিনটে ঘুড়ীর পেটে বীজ দিয়ে ক্লান্তও হয়েছিল যেন। আর ভানু তিন ঘুড়ীর মালিকের কাছ থেকে পঞ্চাশ করে দেড়শ নিয়ে আবার ঘোড়ার পিঠে চেপেই পাঁচ দিন বাদে ফিরল দীঘা। দেড়শ টাকা ছাড়াও ঘুড়ীর মালিকরা তাকে ওই কদিন পেট পুরে খাইয়েছিল। গিরিমশায় খুব আদর করেছিলেন। অন্যদের বাড়ি অনেক দূর।

কিন্তু কপাল ওই একবারই খুলেছিল। পরের বছর আবার যখন আশ্বিনে ঘোড়া ছুটল চোদ্দবেড়িয়া, আরও ঘোড়া ছিল সেখানে, মাদি, মদ্দা, কিন্তু তাদের মালিকরা ছিল না। ভানু গাঁয়ে খোঁজ করল কাদের মাদি? খোঁজ না পেয়ে আবার যখন চোদ্দবেড়িয়া ফিরল, তার ঘোড়া নিজের মনেই রওনা দিয়ে দিয়েছে দীঘার উদ্দেশে। একাই ফিরে এলো। এবার ঘোড়া চোদ্দবেড়িয়া যায়নি।

শ্রীপতি বলল, তা’লে বলছিস জাদুকরীর পাল্লায় পড়েছে?

হ্যাঁ বাবু, কী তার যৌবন, দেখলে মাথা ঘুরে যাবে, সে হলো জাদুকরী, কুহকিনী, কী না পারে, মানুষকে ঘোড়া বানাতে পারে, আবার ঘোড়াকে মানুষ।

ঘোড়া মানুষ হয়ে যায়?

হ্যাঁ বাবু, সে হলো লাল জাদুকরী, অন্ধকারে লাল বেলাউজ, পক্ক বিল্ব ফলের মতো বক্ষদেশ, কী জানি বুঝতে পারলাম না ওই গৌরমোহনই মোদের ঘোড়াটি কি না।

খ্যা খ্যা করে হেসে উঠল শ্রীপতি মাইতি, মদরঞ্জিওয়ালা?

ভানু কলকের প্রসাদ নিয়ে জোরসে টান দিয়ে মাথাটি ঝাঁকিয়ে নিল, কলকব্জাগুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে সেট করে নিল, বলল, হাসির কথা না, অনুমান মাত্র, তবে না হওয়ার পনেরো আনা সম্ভাবনা, কিন্তু এটা পরিষ্কার যে ওই জাদুকরীর জাদুতে রাজপুত্রের জন্মদিনে সে মোদের ঘর ছেড়ে বেরোল।

শ্রীপতি বলল, খুঁজে বের করতেই হবে ঘোড়াটিকে।

ভানু বলল, হ্যাঁ, মোর সমস্ত জীবন যদি চলে যায়, খুঁজে বেড়াব, কিন্তু কুহকিনীর কী হবে? একটা মদরঞ্জি কিনলে পারেন, ঘোড়া তার ভিতরে বন্দি হয়ে আছে বাবু, ঠিক যেন বন্দি অশ্ব, অশ্ব যে বন্দি হয় কে জানত?

শ্রীপতি বলল, ওটা কি অনুমান?

হ্যাঁ বাবু অনুমান মাত্র, এক আনা হলেও সত্যি হতে পারে মোর কথা, তবে আমি খুঁজে বেড়াব সেটাও ঠিক, এবার বরং পুব দিকটা দেখে আসি, হিজলী মসলন্দি, রসুলপুরের দিকটা দেখা দরকার, কী বলেন?

কপালকুণ্ডলা! কপালকুণ্ডলা! হায় কপালকুণ্ডলে! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো শ্রীপতির আর্তনাদে, বিড়বিড় করে, ওদিকে নবকুমার পথ হারিয়েছিল কাষ্ঠ আহরণে গিয়ে, কপালকুণ্ডলা তো কোনো মা-বাপের হারানো কন্যা, রসুলপুরের নদী, গঙ্গাসাগর মেলার আর কতদিন?

ভানু অবাক! থই পাচ্ছে না শ্রীপতির কথায়। সাগর মেলায় যদি খুঁজতে হয় ঘোড়া তবে সে যাবে। শ্রীপতির অত কষ্ট করার দরকার নেই। ঘরে বসে ঘোড়া পেয়ে গেলেই তো হলো। হিজলী, মসলন্দি, রসুলপুর দেখে সে আরও পুবে চলে যাবে, নন্দীগ্রাম চণ্ডীপুর হয়ে নরঘাট ব্রিজ পার হয়ে নন্দকুমার, তারপর তমলুক, মেচেদা, উলুবেড়ে। গঙ্গা পার হয়ে বজবজ, ফ্রি ইন্ডিয়া জুট মিল। সব দেখে আসবে। বাবু যদি বলে হাওড়া ইস্টিশন থেকে ট্রেনে চেপে ভোজপুর চলে যাবে।

একমুহূর্ত আগে হাসছিল শ্রীপতি। এখন গুম মেরে আছে। সে ভানুর কথা শুনছিল না। তার মন খারাপ হয়ে গেছে হঠাৎ। কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, কুহকিনীর মায়ায় বন্দি হয়ে গিয়ে থাকে? কুহকিনী যদি তাকে মানুষ করে পোষে? কতকালের সম্পর্ক তার ঘোড়ার সঙ্গে। সে কেন, তার পিতৃপিতামহের সম্পর্ক ছিল এই পক্ষিরাজের পিতৃপিতামহের সঙ্গে। সব ছিল মাইতি বাড়িতে বাঁধা। এই ঘোড়ার মা ঘুড়ীটা ছিল বড় তেজময়ী, মনে আছে শ্রীপতির। একে পেটে ধরেছে তার মা। শ্রীপতির তখন বয়স কম। গর্ভিণীর ওপর সওয়ার হয়ে সে এসেছে সমুদ্রের দিকে। অর্থাৎ জন্মাবার আগে থেকেই শ্রীপতিকে পিঠে চাপিয়ে ঘুরিয়েছে তার পক্ষিরাজ।

ঘোড়াটা এই সমুদ্রপাখি হোটেলের একটা বাড়তি সৌন্দর্য, এ কথা অস্বীকার করবে কে? ট্যুরিস্টরা অবাক হয়ে দেখে হোটেলের গায়ে ঘাস জমিতে জ্যোৎস্নায়, অন্ধকারে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে একটি ঘোড়া।

ভানু প্রায়ই ওকে রাজপুত্রের ঘোড়ার মতো সাজিয়ে নিজে মাথায় পাগড়ি বেঁধে মোচ পাকিয়ে লাগাম ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেত সি বিচে। সমুদ্রের তীরে তখন কত মানুষ। রং-বেরঙের মানুষকে ডাকে ভানু, কানহা কন্থক, রাজপুত্রের ঘোড়া পঙ্খিরাজ, পাঁচ রুপইয়া, পাঁচ টঙ্কা!

রাজাবাদশার বাচ্চারা ঘোড়ার ওপর চেপে বসত। ভানু জলের কাছাকাছি দিয়ে ওকে টেনে নিয়ে যেত মন্থর গতিতে। ঘোড়াটা ট্যুরিস্টদের মতোই অলস পায়ে অপরাহ্ণ শেষের দিকে এগিয়ে যেত। হয় পশ্চিমে, নয় পুবে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকার নামাত।

ঠিক হারিয়ে যাওয়ার আগে ওর পিঠে রাজাবাদশার বাচ্চারা চাপেনি। শ্রীপতিই ওকে ব্যবহার করেছে নিজে। সেদিন ভোর থেকেই অশ্বারোহী শ্রীপতি মাইতি ইচ্ছেমতো চলাফেরা করেছে। ভোরে গেছে পুবদিকে ইলিশের আড়তে, সেই মোহনায়। সেখান থেকে ফিরে গেছে সাঁতরাপুর। সাঁতরাপুরে শ্রীপতির বাড়ি। অনেক কালের বাস। বউ ছেলেমেয়ে, মা আর একটি ছোট ভাই সেখানে থাকে। শ্রীপতি যখন সাঁতরাপুর থেকে বেরোয় তখন সূর্য ঠিক মাথায় মাথায়। রোদে মানুষ আর জন্তু উভয়েরই কষ্ট। বালির রাস্তা। বালিয়াড়ি ঝাউবন পেরিয়ে পক্ষিরাজ আস্তে আস্তে এগোয়। হাঁটতে হাঁটতে ওর রোগা রোগা হাড় জিরজিরে চারখানি পা বেঁকে যাচ্ছিল। এরই ভিতর মাঝেমধ্যে গা ঝাড়া দিয়ে উঠছিল জীবটা, মানুষের ভার বইতে পারছে না স্পষ্ট। রোদ্দুরে শ্রীপতিরও কষ্ট হচ্ছিল। মিশকালো দেহ, টকটকে লাল ফুলো ফুলো চোখ আগুনে বালি আর বাতাসে নিভে আসছিল যেন। তার দুই হাঁটু ঘোড়াটার পাঁজরের হাড়ের ছোঁয়া পাচ্ছিল। শ্রীপতি বুঝতে পারছে ঘোড়াটা রোগা, দুবলা হয়ে গেছে। কী জানি তা নয় হয়তো। জানোয়ারটাই বেগড়বাই করছে বোধহয়। শ্রীপতি তখন গোড়ালি দিয়ে গোত্তা মারে। ঘোড়সওয়ারের হঠাৎ বুঝি ভয় হয়, মুখ থুবড়ে পড়বে না তো পক্ষিরাজ!

হোটেলে পৌঁছে ঘোড়া থেকে নামতেই ভানু বলল, বাবু, মাথায় একটা ছাতা দিয়ে এলে ভালো করতেন। কী রোদ্দুর কী রোদ্দুর! নিদেনপক্ষে পাগড়িও বাঁধতে পারতেন মাথায়।

ভানু আবার বলেছিল, ছাতা থাকলে ঘোড়া একটুকুন ছায়া পেত।

বলতে বলতে ভানু ঘোড়াটাকে ছায়ায় দাঁড় করিয়ে রাখে। শ্রীপতি তারপর রেজিস্টার দেখে ট্যুরিস্টদের সুযোগসুবিধের ব্যবস্থা করতে যায় ভারতী চৌধুরীর কোয়ার্টারের দিকে। হসপিটালের ডিউটি নিশ্চয় এতক্ষণে শেষ হয়েছে। দুপুরে ওখেনে খেয়ে ওখেনেই কাটাবে। ভারতী তার জন্য অপেক্ষা কাছে ঠিক। ঘোড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে ছায়ায়। বাতাসে আগুন ছুটছে।

তারপর সেই দুপুরে অন্ধকার ঘরে শুয়ে সে আর ভারতী শোনে প্রবল মেঘের কড়কড়ানি। মেঘের ছায়ায় সব অন্ধকার হয়ে এসেছে। এত মেঘ ছিল কোথায়? এলো কখন, কোন পথে?

বৃষ্টির ভিতরে কখন যে ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙতে ঘড়িতে দেখে পাঁচটা। বৃষ্টি নেই। চাদ্দিকটা কেমন ঠাণ্ডা হয়েছে। সে ভারতীর ওখান থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফিরে দেখে নিথর হয়ে ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে। হয় ওটি কোনো মূর্তি নতুবা ছবি। ওর মাথায় যে আকাশ তাতে আর মেঘের চিহ্ন নেই।

পরদিন ভোরে আর দেখেনি পক্ষিরাজকে। খুঁটো উপড়ে চলে গেছে। কেউ নিয়ে গেল নাকি? তা তো নয়। তাহলে ওর চিঁহি চিঁহি চিৎকার শোনা যেত। আর রাত এগারোটাতেও তো ওকে দেখেছে তার দুনম্বর রুমের ট্যুরিস্ট বুড়োটা। সেই যে উধাও হলো, আর পাত্তা নেই। শ্রীপতি ভেবে পায় না গেল কোথায়। এটা তো আশ্বিন নয়, তবে!

বাবু আছেন নাকি, মাইতিবাবু, সায়েব এয়েচে। ডাক শুনল শ্রীপতি। বহুক্ষণ ধরে কে যেন ডেকে যাচ্ছে, বাইরে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখল দরজায় অনন্ত সার। তার পিছনে সোনালি চুল, খাটো ধুতি, পাঞ্জাবি পরা, নগ্নপদ সায়েব ফ্রেদরিক।

ভানু উঠে দাঁড়িয়েছে। গুড মর্নিং সায়েব, গুড মর্নিং, বাবু হেয়ার, কাম ইন।

অনন্ত সারের সঙ্গে ফরাসি সায়েব ফ্রেদরিক ঢুকে গেল। সায়েবকে যত দেখে মুগ্ধ হয় শ্রীপতি। লাল টুকটুকে আপেলের মতো গায়ের রং, নীলকান্তমণির মতো চোখ দুটি, ঘাড় ছোঁয়া সোনালি চুল, ছবিতে দেখা যিশু খ্রিস্ট যেন বা। ভানু বলে, কেষ্ট ঠাকুর। কিন্তু কেষ্ট ঠাকুরের গায়ের রং তো কৃষ্ণবর্ণ। এ তো সায়েব কেষ্ট। ফরাসি হিপি। উদ্ভ্রান্ত ফরাসি যুবক। দলবল ওকে ফেলে বেনারস চলে গেছে। সায়েবের বড় ভালো লেগে গেছে এই সৈকত নগরী। শ্রীপতির সঙ্গে তার খুব বন্ধুতা। সায়েব বসেছে খাটের কোণে, অনন্ত দাঁড়িয়ে।

অনন্ত জিজ্ঞেস করে, বাবু, অশ্ব মিলিল?

না, তবে মিলে যাবে। বলল ভানু।

অনন্ত বলল, বাবু আমি খুঁজে দেখি।

হাঁ হাঁ, খুঁজে নিয়ে আয়। শ্রীপতি হাসে।

সায়েব একবার শ্রীপতি, একবার ভানু আর অনন্তর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ঠিক ধরতে পারছে না কী বলছে তিনজনে। শ্রীপতি সায়েবের দিকে চেয়ে হাসে, মাই লস্ট হর্স, অ্যাম ভেরি ম্যাচ স্যরি সায়েব, মাই পেট হর্স, দ্যাট পক্ষিরাজ!

সায়েব হাসল, ওহো, দ্যাট হর্স, সিপটি, আই প্রে ফর দ্যাট, য়্যু উইল গেট দ্যাট, সিপটি গানজা হায়?

ভানু বলল, হায় হায়, গানজা হায়, টেক সায়েব।

অনন্ত ডাকল, বাবু আমি চৌদ্দবেড়িয়া ঘুরে আসব?

ওখেনে নেই, ভানু বলল, খোঁজা হয়েছে।

তবে অন্যদিকে যাই।

যা, ঘোড়াটা আনলে পাঁচশ টাকা পুরস্কার। বলল শ্রীপতি

এখন, রাহা খরচা তো চাই বাবু।

ভানু টের পায় ঘোড়া খোঁজার ছুঁতোয় অনন্ত টাকা হাতাতে এসেছে। কিন্তু সে কিছু বলল না। টাকা যদি দু-দশটা পায় তার কী? ঠিক সময়েই এসেছে অনন্ত। ভানু তাকে ইঙ্গিত করে, বসে পড়।

শ্রীপতি বলল, রাহা খরচ, যাবি কোথায়?

যেদিকে বলেন।

আগে খোঁজ নে, কোন দিকে আছে সে।

ভানু হি হি করে হাসে, না বাবু, আগে খোঁজ নিক কোথায় কোথায় নেই।

তার মানে? শ্রীপতি অবাক।

ভানু বলে, যেখেনে যেখেনে নেই জানা যাবে, সেখেনে সেখেনে আর যেতি হবে না, কতদিক ঘুরবে বলুন লোকে।

ইয়েস ইয়েস। ফ্রেদরিক সায়েব কী বোঝে ধরা যায় না, শ্রীপতির হাত থেকে কলকে নিয়ে জোর টান মেরে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, রাইট ভানু, রাইট!

ভানু বলে, তবে আগে খোঁজ নিয়ে আয় কোথায় কোথায় নেই।

অনন্তর মুখখানি অন্ধকার হয়ে গেছে। ঠিক ধরতে পারছে না ভানু তার পক্ষে না বিপক্ষে। যেখানে যেখানে নেই, সেই সব জায়গায় না গেলে খোঁজ পাবে কী করে সেখানে নেই। আর খোঁজ নিতে গেলে রাহা খরচ কি দেবে শ্রীপতিবাবু?

শ্রীপতি বলে, যা বিশ টাকা নিয়ে যা ঠাকুরানির কাছে থেকে।

দরজায় পাটোয়ারি ঠাকুরানি, কালো কোলো মোটাসোটা, ঠিক যেন বড় বাড়ির বিড়ালটির মতো। খেয়েদেয়ে মোটা হয়েছে, মুখের কোণে দুধের চিহ্ন, খ্যা খ্যা করে ওঠে, ট্যাকা নাই, দেবেন তো আপনি দেন, ঘুড়ার ঠিক নাই, ট্যাকা যাচ্ছে, ওই ট্যাকায় ঘুড়া কিনা হয়ে যাবে।

শ্রীপতি চুপসে যায়, ভানুকে বলল, তুই দিয়ে দে।

আমি কোথায় পাব?

দে আমি পরে দিচ্ছি।

ভানুর কী মনে হলো, পকেট থেকে বের করে পঞ্চাশ টাকাটিই দিয়ে দিল অনন্তকে, যা ভাগ তো, বাবু পঞ্চাশ দিলাম।

যা দিয়েছিস বেশ করেছিস, যা খোঁজ নিয়ে আয় কোথায় কোথায় নেই, আর কোথায় কোথায় আছে।

অনন্তর মুখখানি হাসিতে ভরে উঠল। টাকা নিয়ে আর দাঁড়ায় না সে। তা দেখে ঠাকুরানি খুব রেগে গেছে। গজগজ করতে করতে বারান্দার আর এক ধারে চলে গিয়ে চিৎকার করল, রাজার ধনও ফুরায়ে যায় ইভাবে, আমরা ইখেনে থাকবনি, না কিছুতেই না, কবে থেকে বলছি বেতন বাড়াও…

ভানু গুম মেরে গেছে। কী হলো ধরা যাচ্ছে না। যে টাকা নিয়ে সে মীরগোদায় গিয়ে কুহকিনী দেখে এলো, খোঁজ নিয়ে এলো বন্দি ঘোড়ার, সেই টাকা নিয়ে চলে গেল অনন্ত। যাক, এসব পরে হবে। সে সায়েবের দিকে তাকিয়ে বলল, হেলো সায়েব; ইউ আর মাই ফেরেন্ড, ফেরেন্ড তো, হর্স লস্ট, তুমি সাক্ষী, আমি দিলাম পঞ্চাশ রুপিয়া, আই গেভ সায়েব, আই গেভ! তুমি সাক্ষী, সায়েব কুহকিনী বোঝো, জাদুকরী, ম্যাজিক গাল, ইয়াং গাল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *