1 of 2

অশ্বচরিত – ২১

একুশ

শ্রীপতি মাইতির সন্দেহ সায়েব আর ভানু নেশা করেছিল। নেশা করে ভানু অন্ধকারে হারিয়ে যায়, সায়েব হোটেলে আবার নেশা করতে আসে। ভানু যে ফিরেছে বালিমুণ্ডা থেকে তা তো জানতই না শ্ৰীপতি।

পরদিন সন্ধ্যায় ভানুকে জিজ্ঞেস করে শ্রীপতি, ঘোড়ার কী হলো?

ভানু বলল, ওদিকে যায় নাই।

কে বলল?

সবাই বলল, যাবে কোথায় সব তো দখল করে নিচ্ছে গরমেন, এই নিন বাবু কাগজ, সরকারি লুটিশ, ভীমাপুরও গেল।

আশ্চর্য! কাগজটা ভালো করে পড়েও দেখে না শ্রীপতি, বুকপকেটে আরও অনেক কাগজের সঙ্গে রেখে দেয়। ভানু বলল, সত্যি বাবু, এই জায়গা শেষ হয়ে গেল, রাতভর আকাশে আগুন ছোটে, আকাশ থেকে শুধু ছাই ঝরে, এমন যে বর্ষাকাল, শাওন মাস, মেঘ জমতেই পারে না দে-পালের আকাশে।

কে বলল?

আমি দেখেছি।

কবে দেখলি?

ভানু বলল, পরশু রাতে বাবু, বেশ জোছনা ছিল।

কী দেখলি?

সব পুড়া পুড়া, আকাশ মাটি পুড়ে গেছে, অত যে ঝাউবন ছিল সমুদ্রের ধারে, কিছুই নাই, অত সুন্দর বিচ ছিল বাবু, তা নাই।

কে বলল এসব?

কেন, ছিল না ঝাউবন?

ছিল।

ছিল না বিচ?

ছিল।

ছিল না গাঁ ঘর, চাষ জমিন?

ছিল, কিন্তু তুই কি দেখেছিলি?

না, আমি আর গেলাম কবে?

চাঁদবালি গিছিলি?

একবার অনেক দিন আগে, তো চাঁদবালিরও ওই দশা বাবু।

কী দশা?

মাটিতে হাঁটা যায় না, আগুন শুধু, শাওন মাসেও কী গরম!

শ্রীপতি বলল, যাকগে গরমেন্ট যদি চায় তো জমি নেবে।

এরকমভাবে নেবে?

শ্রীপতি হা হা করে হাসে, তুই এমনভাবে কথা বলছিস যেন তোর জমি গেছে, তোকে কী কাজে পাঠানো হয়েছিল?

ভানু বলে, ঘোড়া খুঁজতে, কিন্তু বাবু, ওই যে বললেন আমার জমিন গেছে কি না, গেছে বাবু, সমুদ্রের তীরটা কার বাবু?

হকচকিয়ে যায় শ্রীপতি, কার বল দেখি? সমুদ্রই বা কার?

কার তো জানি না।

তার ওপরের নীল গগন?

বুকটা ধক করে ওঠে শ্রীপতি মাইতির। কীসব বলছে ভানু? এমন কথা কি আগে বলত? বালিমুণ্ডা ঘুরে এসে বদলে গেল। শুয়ে থাকল সি-বিচে, অন্ধকারে, ভিজে বালিতে একা একা। ভয় করল না একটুও? জোয়ারে যদি টেনে নিয়ে যেত?

শ্রীপতি বলল, এসব ভগবানের।

ভানু বলে, পৃথিবীটাই তো ভগবানের বাবু।

তা তো ঠিক।

তবে ভগবানের পৃথিবীটা এমনভাবে নষ্ট করছে কেন?

শ্রীপতি বলল, গরমেন্ট তোর আমার চেয়ে ভালো বোঝে।

ভানু বলল, না বোঝে না বাবু।

বোঝে না?

না, গরমেনের কোনো দয়ামায়া নেই।

শ্রীপতি বলে, গরমেন্টই ভগবান, সবের মালিক তো তারা।

ভানু বলে, ওসব কথার কথা, আসলে যা ভগবানের তা আমার, আপনি যে বললেন আমার জমিন গেছে কি না, গেছে, সি-বিচ, ঝাউবন, নীল গগন, গাছগাছালি, ঠাণ্ডা বাতাস, সব আমার নিজের ছিল বাবু।

শ্রীপতি হা হা করে হেসে ওঠে, ভালো দেখেছিস দেখছি।

ভানু বলল, বাবু, নোটিশটা নিয়ে ভুবনেশ্বর হাইকোর্টে গিয়ে কেস ঠুকে দেন, আপনার জমি যাতে না যায় তার জন্য আদেশ বের করেন।

শ্রীপতি বলে, কী হবে?

কী হবে মানে, জমি বাঁচবে।

বাঁচবে না, ওখেনে আর বেশি দিন রাখা যাবে না জমি, চাষারা এরপর নিয়ে নেবে, অনেক দিন তো হলো।

কতদিন হলো বাবু?

ঠাকুরদার বাপের আমল থেকে, তেনার নাম ত্র্যম্বক মাইতি, এসব জমিন ত্র্যম্বক মাইতির করা ছিল, তারপর তাঁর ছেলে, নাতি মানে আমার বাবা সুরপতি মাইতি, ভানু তুই কলকেটা সাজাবি।

ভানু কলকে সাজাতে সাজাতে কথা বলছিল। শ্রাবণ মাস, হোটেলের একটি ঘর বাদে সব খালি। একজোড়া ট্যুরিস্ট বিকেলেই দিয়েছে মাইতিবাবুকে। নতুন বিয়ে বোধহয়। বাস থেকে নেমে হকচকিয়ে গিয়েছিল। কত কম বয়স। মেয়েটা বড়জোর কুড়ি, ছেলেটা পঁচিশ। ভানুর মনে পড়ে গেল সুভদ্রাকে। রামচন্দ্র আর সুভদ্রার কথা বলবে নাকি বাবুকে? বাবু না বললে সুভদ্রাকে বিয়ে করতে পারবে না রামচন্দ্র। অথচ তারা একঘরে বাস করে। সাজানো কলকেটা বাবুর হাতে দেয় ভানু। শ্রীপতি তার নিজস্ব মুদ্রায় কলকেটি মুখের কাছে নেয়। ভানু দেশলাই ঠোকে কলকের মাথায়। শ্রীপতি দম ভরে টান দেয়। ধোঁয়া উগরে দিল শ্রীপতি। ঘর ম ম করতে লাগল আশ্চর্য এক সুরভিতে।

ভানু বলল, চাষারা যদি নেয়, ও জমি থেকে যাবে, খরচ করবে না।

তার মানে! ভানুর দিকে কলকে এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে শ্রীপতি, জমি কি খরচ হয়?

হয়।

হয় মানে, জমি কি টাকাপয়সা?

ভানু ধোঁয়া ছেড়ে বলল, গরমেন জমি খরচ করে।

কী করে করে?

যেভাবে করেছে দে-পাল, কুসমাড়, মহাপাত্রপুর, চাঁদবালিতে।

জমি তো আকাশে উঠে যায়নি।

তা যায়নি, কিন্তু মাটিতেও আর নেই জমিন, বাবু কোথায় ঝাউবন, নারকেল বন, ঘর গেরস্তালি, তরমুজ খেত, পানবরজ, কাজু বাদামের বাগান? সব শেষ, অমন যে সি-বিচ ছিল মোটা দানার বালি, কী শক্ত, আমি শুয়ে থেকেছি অন্ধকারে, চাঁদ আমারে ডেকে তুলেছে মাঝ রাত্তিরে, নাই, কিছুই নাই।

শ্রীপতি বলল, থাকবে না তো, মিলিটারির দরকার।

বাবু, অমন মিলিটারি আমার দরকার নেই।

তুই কে রে? শ্রীপতি আচমকা রেগে ওঠে, নেশা ভেঙে দিচ্ছিস।

ভানু বলল, তা’লে আমি যাই, তুমি একা নেশা করো।

না, যাবি কেন? শ্রীপতি টেনে বসায় ভানুকে, রামচন্দ্র কবে আসবে?

আসবে, তার আগে আমারে বলো তুমি হাইকোর্টে যাবে কি না।

গেলে কী হবে?

জমি বাঁচবে।

বাঁচবে না, কদিনের জন্য বাঁচবে, তারপর দিল্লির সুপ্রিম কোর্ট থেকে রায় নিয়ে আসবে গরমেন্ট।

তাহলে কী হবে?

জমি গেলে বহুত টাকা আসবে।

কিন্তু চাষারা?

চাষারা আমার কে?

তারা যে জমি চষেছে এতকাল।

শ্রীপতি বলে, ওসব ফালতু কথা ভাবতে তোকে আমি বালিমুণ্ডা পাঠালাম? তুই বহুত শয়তান আছিস।

আছি।

চাষাদের সঙ্গে সাট করে এসেছিস।

ভানু বলল, এসেছি।

কী করবি?

জমি নিতে দেব না গরমেনকে।

হা হা করে হাসে শ্রীপতি, পুলিশের প্যাদানি খেলে এসব কথা বলা বের করে দেবে, তোকে তো যাবজ্জীবন দেবে।

কোথায়?

শ্রীপতি বলল, ফাঁসি হবে তোর।

ভানু বলল, হোক, কিন্তু আমার নীল গগন, আমারই বাতাস তো বাবু নষ্ট হয়ে যাবে, আমি বসে বসে দেখব?

ভানু, পাগলামি থামা।

না বাবু, আমি অন্ধকারে একা একা কত সমুদ্দুরের ধারে শুয়ে থেকেছি, চাঁদবালি, দে-পাল, কুসমাড়, মহাপাত্রপুর, মেরিনা বিচ, কোভালম বিচ, ওয়ালটেয়ারের সমুদ্দুর, মীরগোদার সমুদ্দুর, আপনি যদি বলেন, জাভা, বালিদ্বীপ, ওই সব দেশের সমুদ্দুরের ধারে শুয়ে থেকেছি অন্ধকারে, চাঁদ যখন আলো ফেলেছে মুখে, জেগে উঠেছি আমি ছন্দক, আবার পূর্ণিমার সমস্ত রাতে গড়াগড়ি খেয়েছি বালির ওপর, শুনছ বাবু?

বাবু শ্রীপতি মাইতি বলে, পাগল!

পাগল কেন, ওসব নাম তো তুমিই বলেছ।

বলেছি, কিন্তু জাভা, বালিদ্বীপ গেলি কবে তুই?

ভানু হাসতে হাসতে বলে, আগের জন্মে।

আর মীরগোদা, সে তো তোর আগের জন্মেই শুকিয়ে গেছে।

ভানু বলে, তারও আগের জন্মে বাবু তখন আকাশে সোনালি মেঘ থাকত।

কতবার জন্মেছিস তুই?

অনেকবার, যতদিন পৃথিবী রয়েছে বাবু, ততদিন মরেছি আর জন্মেছি, যতবার মরেছি, ততবার জন্ম নিয়েছি, এক জন্মে ছিলাম তো ছন্দক, মনে নেই?

আগের জন্মের কথা মনে পড়ে?

পড়ে বাবু, সোনালি মেঘের নিচে কন্থক, আমি আর রাজপুত্র হাঁটতাম।

আর কী মনে পড়ে?

ভানু বলছে, মীরগোদার সমুদ্রতীরে, জাহাজঘাটায় এক জাদুকরীর সঙ্গে দেখা, লাল টকটকে পোশাক তার, রংখানি ঘোর কালো, অমাবস্যার রাতের মতো, মনে হয় সে আরব দেশের হবে।

শ্রীপতি হেসে ফেলে, আরব দেশের, কী করে বুঝলি?

ভানু বলল, ওই দেশেই তো জাদুকরীর বাস

আমার ঘোড়াটা কি ও নিল?

কী করে বলি বাবু, গৌরমোহনই হয়তো আপনার পক্ষিরাজ।

হে হে করে হাসতে থাকে শ্রীপতি, ভানুর পিঠ চাপড়ে দেয়, তুই পাগল হয়ে

ফিরেছিস বালিমুণ্ডা থেকে।

ভানু বলে, আপনি জমিন বাঁচান বাবু।

না বাঁচাব না।

অত চাষা মরে যাবে?

যাক, এরপরে জমি তো ওদের ভোগে যাবে।

ভানু বলল, তাহলে আর কী হবে, ক’টা টাকার জন্যে এসব করবেন?

শ্রীপতি বলে, তুই থাম দেখি, জাদুকরীর কথা বল।

ভানু বলল, কাল আমি মীরগোদা যাব।

কেন?

ঘোড়াটার খোঁজ নিতে হবে না?

শ্রীপতি বলে, গৌরমৌহন এসেছিল কাল সকালে।

কেন বাবু?

ও-ও চায় ঘোড়াটা খুঁজতে।

তার মানে?

তুই যেমন খুঁজিস পক্ষিরাজ অশ্বটিরে, ও-ও তেমন খুঁজে আনতে চায়, মদরঞ্জির বাজার নাই, দুঃখ করছিল।

ভানু বলল, ও খুঁজবে কোথায়, অশ্ব তো কোকিলা বধূর কুহকে ভুলেছে বাবু, আমি যেটা বলি তাই করুন, আপনি কেস করো বাবু, ভীমাপুরটা বাঁচাও, তখন সোনালি মেঘ যদি ফোটে, কন্তুক সেই মেঘ দেখে ফিরে আসবে বাবু।

নেশা যত বাড়ে, কথাবার্তার শৃঙ্খলা তত ভাঙে। সব এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। ভানুর মাথার ভিতরের ঘুমন্ত কোষগুলো তখন যেন জেগে উঠতে থাকে গহিন সাগর উপকূলে। শ্রীপতি মাইতি ক্রমশ এলিয়ে পড়ে। সেই সময় দরজায় এসে দাঁড়ায় অনন্ত সার।

ভানু তাকে দেখতে পেল, কী চাই?

বাবু কি ঘুমালেন?

হ্যাঁ, কেন?

অনন্ত বলে, অশ্ব তো মিলেনি, খুঁজি পাইছ ভানুবাবু?

ভানু মাথা নাড়ায়। নাড়াতেই থাকে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ঘরের আলোটা নিভিয়ে। বাইরে বারান্দা অন্ধকার। তার বাইরে পৃথিবী অন্ধকারময়ী। ভানু দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়ায়, তুই অশ্ব খুঁজতে গিছিলি?

না। মাথা নাড়ে অনন্ত, বাবুকে কও না, শাওন মাস, নুন তো নাই, মোর চাষও নাই।

খুঁজতে যাবি অশ্বটিরে?

হ্যাঁ, রাহা খরচ, খরচপাতি দিলে আমি একবার খুঁজি দেখি।

কোন দিকে যাবি?

অনন্ত বলে, যিদিকে বলবে সিদিকে যাব।

তুই বল না কোন দিকে যাবি।

অনন্ত ঘাবড়ে যায়, কোন দিকে পাওয়া যাবে কও দেখি?

তুই বল।

ভানু আর অনন্তর কথার মধ্যে অন্ধকারে হাজির হয় ঠাকুর। দপ করে বারান্দায় আলো জ্বালিয়ে দিয়ে ঠাকুর বলে, পরামর্শ হচ্ছিল?

হাঁ। ভানু বলে।

কী পরামর্শ রে অনন্ত?

আঁজ্ঞা! অনন্ত ভয় পায়, কামের খুঁজে আসছি, অশ্বটি যদি খুঁজতি যাই।

অশ্ব খুঁজতি। খ্যা খ্যা করে হাসে ঠাকুর, এবার আমিও যাব অশ্ব খুঁজতি, হুটেল বন্ধ হয়ে যাবে, যা ভাগ তো।

আঁজ্ঞা, ইখন বড় অভাব।

মেয়্যা তো ডাগর হলো? ঠাকুর জিজ্ঞেস করে।

হাঁ, অনন্ত ভয় পায়।

মেয়্যাটার কামে লাগা, ডাগর মেয়্যার কামের অভাব?

অনন্ত বলে, কচি ছানা।

কচি কদিন থাকবে? ঠাকুর ধমকে ওঠে।

ভানুর সহ্য হচ্ছিল না বারান্দার আলো। সে ধীরে ধীরে নেমে আসে বারান্দা থেকে নিচে। ঠাকুর আর অনন্ত কথা বলছে। বলুক। ভানু আস্তে আস্তে বাবুর ঘরের জানালার দিকে যায়। ওখানে বালিয়াড়ির গায়ে ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে থাকত। এখনও যেন বাতাসে ঘোড়াটির গন্ধ পাওয়া যায়। কতদিন দেখেছে ভানু, দাঁড়িয়ে আছে পক্ষিরাজ। গায়ে চাঁদের আলো। একেবারে জানালার গায়ে গিয়ে দাঁড়াত। কার্নিশের নিচে। এই তো সেই জানালা। ভানু চুপ করে জানালার দিকে চেয়ে থাকল। ধীরে ধীরে জানালার গ্রিলের ওপারে শ্রীপতি মাইতির মুখ ভেসে ওঠে। ভানু মাথা নাড়ল, গা ঝাড়া দিল, আকাশের অন্ধকারে ঝড় তুলল। নাকে বাতাস টানতে লাগল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলল। আবার গা ঝাড়া দিল। দেখল জানালার ওপারে চঞ্চল হয়ে উঠেছে শ্রীপতি। চঞ্চল হলো ভানুও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *