1 of 2

অশ্বচরিত – ৩২

বত্রিশ

কদিন আগে থেকে পোখরানের মরু প্রান্তর, নিকটবর্তী খেতলাইয়ের দখল নিয়ে নিয়েছিল আমাদের সেনাবাহিনী। জওয়ানরা কাঁটাতারে ঘিরে ফেলেছিল মরুদেশ। ওই দিন সকাল থেকে খেতলাইয়ের মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিল। ঘর থেকে তাদের বেরোতে দেয়া হচ্ছিল না। মানুষজন সন্দেহ করছিল। চব্বিশ বছর আগের স্মৃতি কি ফিরে আসছিল তখন? সেও তো ছিল এমনই এক দিন; বুদ্ধ পূর্ণিমা। দুপুর গেল চিরাচরিত উষ্ণতায়। বেলা পড়তে শুরু করল। চারটে নাগাদ পোখরানের মরুভূমি দুলে ওঠে। খেতলাই গ্রাম দোলে। মাটির অনেক নিচে, তিন থেকে চারশ মিটার গভীর শিলাস্তরে ফেটেছে পরপর তিনটি পরমাণু বোমা। পোখরানের ধরিত্রীগর্ভ ফেটেফুটে, ছিন্নভিন্ন হয়ে আকাশে উঠে গেল বালির ঝড়, বালির ধোঁয়া।

কোকিলা জিজ্ঞেস করে, ভুঁই দুলল?

হ্যাঁ পাকা ঘর ফেটে গেল, আরও কী কী হলো, রাত্রে খবরে জানা গেল বোমা ফেটেছে মাটির নিচে। বালি তারপর মাটি, তারপর পাথর, মরুভূমি ছিল সমুদ্র। সমুদ্রের নিচে পাহাড়, সেই পাহাড় গলে গেল মাটির নিচেই, এমন তাপ যে সব গলে পুড়ে ধোয়া হয়ে উড়ে যায় আকাশে, তারপর আকাশ থেকে ভস্ম নামে।

তুমি এসব জানলে কী করে?

এ তো কাগজে লিখেছে

থাক আর না।

কেন?

ভয় লাগে ভানুদাদা, আচ্ছা সেদিন রাতে চাঁদ উঠল?

উঠল।

এখেনের মতো?

হ্যাঁ, ভগবান বুদ্ধের মতো শান্ত, স্নিগ্ধ।

তুমি মরুভূমি দেখেছ?

না, সমুদ্র দেখেছি।

সে তো আমিও দেখেছি।

ভানু বলল, চাঁদের আলোয় মরুভূমিকে সমুদ্রের মতো লাগে।

কে বলল?

মনে হয় তাই যেন, এই দ্যাখো মরুভূমির ছবি।

কোকিলা দেখল। তাকিয়ে থাকল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, সেদিন জোছনায় কী যেন ছিল! কাজ করতে করতে এদিক তাকাই, ওদিক তাকাই, আকাশ দেখি, মাটি দেখি, অদ্ভুত রাত্তির ছিল সেটি! কোকিলা বিড়বিড় করে, ওই বোমা ফাটলে বাতাসে মরণ ঘোরে, সেদিনের বাতাসে কি ছিল তাই?

ছিল তো বটে, মাটি, আলো, বাতাসে বিষ ঢুকে যায়।

এতদূরে, এদিকেও আসবে বিষ?

কত আর দূর, তবে দূর তো বটে, কিন্তু আকাশে আকাশে কতটা আর, আর পোখরান যে দেশে, মীরগোদা সেই দেশে, ইন্ডিয়া, পোখরানে মাটির নিচে বোমা ফাটালে এখেনে তো আনন্দ হয়, আবির খেলা হয়, মিঠাই বিলি হয়, ইন্ডিয়ার শক্তি বাড়া মানে লোকে বলে তারও শক্তি বাড়া।

বুঝিনে।

আমিও বুঝিনে কী করে শক্তি বাড়ে, পেটে ভাত না থাকলেও কী করে শক্তি বাড়ে ধরতেই পারিনে।

আমি কিছুই জানিনে, লেখাপড়া শিখিনি, অবোধ, কিন্তু বিষটা এখেনে আছে কি না সেইটা বলো।

না হলে মিঠাই বিলি হবে কেন?

বিষের জন্য মিঠাই?

না হলে কী জন্যে, সবাই তো জানে ওই বিষ জন্ম-জন্মান্তরেও মরে না, একবার দেহে ঢুকলে তিনপুরুষ চারপুরুষ বিষ থেকে যাবে।

কী কহ? শিহরিত হয় কোকিলা।

এই তো পেপারে লিখেছে, হিরোশিমার মানুষ এখনও ভুগছে, পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে।

এখেনে তা হবে? কোকিলা ভয় পায়।

ভানু চুপ করে থাকে। তার আর কথা বাড়াতে ভালো লাগছিল না। সে ভাবছিল পক্ষিরাজ কি বিষের ভয়ে অন্যদিকে ছুটে গেল? তার কন্থক কি টের পেয়েছিল আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে তেজস্ক্রিয় ভস্ম? সে কি বুঝতে পেরেছিল বুদ্ধ পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় বিষ আছে? একই চাঁদের আলো তো সেদিন পোখরানের মরুভূমিতে ছিল। মরুভূমির আকাশ তখন তেজস্ক্রিয়তায় ছেয়ে আছে, মরুভূমির বালিতে তেজস্ক্রিয় ভস্ম। চাঁদের আলোয় সেই তেজস্ক্রিয়তা মিশে গিয়েছিল হয়তো। সেই চাঁদের আলোই তো মীরগোদায়, দীঘায়, চাঁদবালিতে সেদিন সমস্ত রাত জেগে ছিল। চাঁদের আলো কি বয়ে এনেছিল পোখরানের মরুভূমির খবর? চাঁদের আলোতে কি ভেসে এসেছিল মরুভূমির তেজস্ক্রিয়তা? মানুষ যত না টের পায়, মনুষ্যেতর প্রাণীরা তো ধরতে পারে প্রকৃতিতে কোথায় কী হচ্ছে। ভূমিকম্পের খবর যেমন মাটির নিচের প্রাণী, পিঁপড়ে, ইঁদুর, সাপ, ব্যাঙ, জলের মাছেরা আগে টের পেয়ে যায়, তেমনি কি টের পেয়েছিল তার ঘোড়াটা? আগে নয়-পরে, তবে কেউ জানবার আগেই কি ঘোড়াটা জ্যোৎস্না দেখে বুঝতে পেরেছিল বাতাসে বিষ, চাঁদের আলোয় বিষ। আর সেই বিষ থেকে বাঁচতে সে পালাল দীঘা ছেড়ে। তাঁকে তো বাঁচতে হবে। কী আশ্চর্য, সেই সময় কিনা এই কোকিলা বধূর মনে কন্থকের রূপটিই ভেসে উঠল! কোকিলা বধূর সামনে এসে দুপা দাপাতে লাগল শ্রীপতির ঘোড়া। ঘোড়াটা কি কোকিলাকে জানাতে চাইল দূর মরুভূমির আকাশে যে তেজস্ক্রিয় বিষ, সেই বিষ চাঁদের আলোয় আলোয় এসে পৌঁছেছে মীরগোদায়? তাই তো হলো, না হলে পরদিন মিঠাই আনবে কেন গৌরমোহন? কোকিলা তখন ঘোড়াটিকে আঁকতে লাগল। ভানু যা ভেবেছে এতদিন, তা না হয়ে যদি উলটোটি হয়, কোকিলা কুহক করেনি, ঘোড়াটিই কুহক করেছিল কোকিলাকে। কোকিলা বধূকে আচ্ছন্ন করে ঘোড়াটি তাকে দিয়ে নিজেকে আঁকিয়ে নিয়েছে মদরঞ্জির ওপর, নিজের বেগবান রূপটি প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে মদরঞ্জির ওপর, যাতে তা দেখে কেউ না কেউ ধরতে পারে ঘোড়াটা পালাচ্ছে। সে পালাচ্ছে কেননা বিষ তাকে ছুঁয়ে ফেলতে চাইছে! হায় চাঁদের আলো, নরম ঘুম ঘুম বাতাস, হায় জল, মাটি—সব কিনা ছেয়ে যাবে তেজস্ক্রিয় ভস্মে! ওই যে অনন্ত আকাশ, আকাশের মেঘ, সব কিনা ভরে যাবে তেজস্ক্রিয় বিষকণিকায়। পৃথিবীর আকাশ, মাটি, নদী, সাগর, অন্ধকার, জ্যোৎস্না যা কিছু ভগবান দিয়েছিল ঘোড়াটির জন্য, বেগবান ঘোড়াটির জন্য, সব গেল বিষময় হয়ে! ঘোড়াটি তাই পালাচ্ছে। পালাচ্ছে কিন্তু তার সূত্রটি রেখে যাচ্ছে কোকিলা বধূর কাছে। হায় গৌরমোহন! তুমি কি দ্যাখোনি, তোমার গুণবতী বধূ কী এঁকেছিল বুদ্ধ পূর্ণিমার রাতে? সে এক বেগবান অশ্ব। আদিকাল থেকে সে ছুটছে। কেশর ফুলে উঠছে, পুচ্ছ ফুলে উঠছে, চারটি পায়ের পেশি দপদপ করছে। সাদা ঘোড়া সেই পৃথিবীর জন্ম থেকে বেগবান। তার পিঠে চেপে মানুষ দেশের পর দেশে গেছে, নদী পার হয়েছে, অরণ্য পার হয়েছে, পাহাড় পার হয়েছে, মরুভূমির বালি উড়িয়ে চলে গেছে সেইখানে যেখানে চাঁদের আলো, বাতাস, জল, সবই ভালোবাসে মানুষকে। মানুষকে বাঁচায়, মানুষকে দেখায় দূর আরও দূরের পথ। একে একে পৃথিবীর সব কোণে পৌঁছে যায় মানুষ। বসতি গড়ে তোলে বিজন অরণ্যেও। সেখানে ঢুকে পড়ছে তেজস্ক্রিয় বাতাস।

চাঁদের গায়ে নীল ছিল, জ্যোৎস্না নীল ছিল, কিন্তু এ নীল সেই নীল নয় যে নীলের ভিতরে এত লক্ষ, কোটি বছর মানুষ ঘুমিয়েছে নিশ্চিন্তে, জেগেছে নিশ্চিন্তে, ভালোবেসেছে, শোকে আনন্দে বিহ্বল হয়েছে, কিন্তু বিপন্ন হয়নি কোনো দিন। আমি দেখলাম নীলের রং বদলে যাচ্ছে। চাঁদ উঠল বটে, কিন্তু চাঁদের আলোটিতে যেন বিষের নীল, গাঢ়, গাঢ় থেকে গাঢ়তর। নীল ঘন হতে হতে কালো হয়ে গিয়েছিল প্রায়। নাক টানলাম, কীসের যেন গন্ধ! জ্যোৎস্নায় যেন মৃত্যুর গন্ধ ছিল। হায়! আমি তো কত মৃত্যুই না দেখেছি, কিন্তু তার তো এমন গন্ধ ছিল না। আমার তখন কী যেন মনে পড়ে যাচ্ছিল। চাঁদের আলোর দিকে তাকিয়ে আমি টের পাচ্ছিলাম যেদিন সেই দূর হিরোশিমার প্রতিটি বিন্দু দগ্ধ হয়ে গিয়েছিল, তারপর আকাশ থেকে কালো বৃষ্টি ঝরে পড়ছিল। মনে পড়ে গেল সব। কবে যেন শুনেছিলাম, দেখেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম মারণ জ্যোৎস্নায় ঢেকে যাচ্ছে সমস্ত পৃথিবী। নীল জ্যোৎস্নায় বিষ ভেসে আসছে উত্তর-পশ্চিম থেকে। সেদিকে পাহাড় আছে, মরুভূমি আছে। মরুভূমির জ্যোৎস্না ছড়িয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। টের পেলাম সামনের ওই সাগর শুকিয়ে যাবে, গাছপালাও মরে যাবে, মাটি বালি হয়ে যাবে, আমি আর দৌড়তে পারব না। আমি পঙ্গু হয়ে যাব। তখন আর দাঁড়ালাম না। দড়ি ছিঁড়ে দৌড়েছি। দৌড়, দৌড়, দৌড়! নদী পার হয়ে, অরণ্য ভেদ করে, পাহাড় পার হয়ে আমি ছুটেছি, আমার পিছনে ধেয়ে আসছে মরণ। মানুষ যেন মরণের সখা হয়ে হাসছে। মাটি চৌচির করে দিচ্ছে। ওই যে পিছনে পুড়ছে নদী, মাটি, সাগর। আমি পিছনে ফিরছি না। ফিরছি না, ফিরছি না।

কোকিলা ডাকল, তুমি কি ফিরবে ভানুদাদা?

চমকে ওঠে ভানু, হ্যাঁ, ফিরতে তো হবে।

থাকো না কেনে?

উহুঁ, আমার মন বসে না আর, ঘোড়া ছাড়া আমি কে?

সেই জন্যই তো বলি, থাকো।

ভালো দেখায় না থাকা।

কোকিলা হেসে ওঠে, কী ভালো দেখায়, মাটির তল ফাটায়ে সব নষ্ট করি দিয়া, ভানুদাদা পাঁচটা লোক যদি এসে আমারে শেষ করি যায়, তখন কি তা ভালো হবে?

মদরঞ্জিওয়ালা আসবে না?

কী জানি, কাল রাতে ডর লেগেছিল।

কেন?

কী জানি, ঘুড়াটারে আঁকতে বসেছিলাম।

হেরিকেনের আলোয়?

দিনভর চেষ্টা করলাম হলোনি।

রাতে কি হলো?

কোকিলা বলল, হলোনি, কিন্তু মনে হচ্ছিল উঠানে আছে সে, নিঃশ্বাস ফেলছে, ঘুড়ারে তো নিঃশ্বাসে চিনা যায়, যায় কি না?

ভানু উঠল। কোকিলার ক্ষমতা আছে নিজেকে রক্ষা করার। যুবতী বধূ, তার থাকা ঠিক হবে না। মদরঞ্জিওয়ালা এসে গেলে কী হবে? তার মনে আর এক অন্ধকার ঢুকে যাবে। হায় মদরঞ্জিওয়ালা! মনে অন্ধকার নিতে তুমি যাও শিবরামের ঘরে, কেন যাও? না গেলে কী হয়? শিবরাম যা ভাবুক, তোমার কোকিলা তো কিছুই ভাবে না। তোমারেই ভালোবেসে বেঁচে আছে।

ভানু ফিরছিল। ক্লান্ত, অবসন্ন ঘোড়াওয়ালা ঘোড়াটি না খুঁজে পেয়ে ফিরছিল ঝুঁকে ঝুঁকে। সে আন্দাজ করছিল ঘোড়াটি কেন পালাল। তার বোধে সে নিশ্চিত। হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছয় জাহাজঘাটার ধু ধু বালিয়াড়ি, বালির ঢেউ, ঝাউবনে I ভানু ফিরছিল। ফিরতে ফিরতে আকাশে তাকিয়ে জগৎ দেখে। কী মায়া এই পৃথিবীতে! যে অন্ধকার প্রতিদিনই নামে, সেই অন্ধকার দেখে সাধ মেটে না, যতবার জ্যোৎস্না দেখো, ততবার বুক ভরে যাবে। সাধ মেটে না আর মেটে না। নদী, পাহাড় কেন মাঠঘাট, ঘাস, মাটি, পোকামাকড়, রাতের জোনাকি, রাতের তারা, চাঁদ, সূর্য, মেঘ, বৃষ্টি, রোদ্দুর, যা দেখো প্রাণ ভরে যায়। ভরে যায় বলেই না মানুষ জন্মান্তর চায়। জন্ম-জন্মান্তরে ফিরে আসতে চায় এই জগতে। যত দেখো, তত সাধ বাড়ে। সেই জগৎ থেকে কিনা পালিয়ে যাচ্ছে সাদা পক্ষিরাজটি। কোথায় আছে সেই দেশ, যেখেনে ঘাসে ঘাসে বিষহীন শিশিরবিন্দু, চেটে খেয়ে নেবে সে।

ভানু চলতে লাগল অন্ধকারে। হাঁটতে হাঁটতে হাটে এলো। হাটের সবই তো নিঝুম। মানুষজন যেন পালিয়েছে। ভানু দেখছিল ছোট কদম গাছটির পাতার আড়ালে জোনাকিরা দপদপ করছে। ভানু দেখছিল জোনাকির দল উড়ছে। আলো দপদপ করতে করতে অন্ধকারে পাড়ি দিচ্ছে। ভ্যান রিকশায় উঠে বসল সে। জোনাকির দল তার মাথায় মাথায় চলতে লাগল। মীরগোদার মরুভূমি ছেড়ে তারা চলে যাচ্ছে বোধহয়। টের পেয়েছে কিছু। ভানুর পিছনে পড়ে থাকল সাগর শুকোনো মরুভূমি, বাঁ দিকে ধ্রুবতারা জ্বলজ্বল করতে লাগল উত্তর আকাশে। পুবের দিকে ভেসে যেতে লাগল ভানু। যেতে যেতে ঘোড়াটির কথা ভেবে দুচোখ সজল হয়ে ওঠে। মদরঞ্জিওয়ালার কথা ভেবে বুক ভরে গেল। মদরঞ্জিওয়ালা কি কোকিলা বধূকে ছেড়ে গেল? তা কেন হবে? এসব কী ভাবছে? তার মনে কি বিষ ঢুকেছে? হায় কোকিলা! ভানু টের পায় আলো জ্বলেনি ভিটেয়, কোকিলা একা অন্ধকারে বসে আছে দাওয়ায়। সন্ধেবেলায় তার চুল খোলা। খোলা চুল বেয়ে ভর সন্ধেয় যে পাপ বাসা বাঁধে মনে তা কি সে জানে না? মদরঞ্জিওয়ালা কখন ফিরবে? আশ্চর্য লোক তো গৌরমোহন!

অন্ধকার রাত্রিতে ভানু নামল পুরনো দীঘায়। সমুদ্রতীরে। লোডশেডিং চলছিল। আলো এলো এই মাত্তর। আলো জ্বলতেই একটা চাপা আনন্দ যেন ধ্বনিত হলো চারদিকে। ভানু বাস থেকে নামতেই ছুটে এলো অনন্ত আর তার বউ, ভানুদাদা!

কী হয়েছে? ভানু দেখল সরস্বতীর দুচোখ জলে ছলছল। আঁচলে চোখ মুছছে কুন্তির মা। অনন্তর মুখখানি যেন পুড়ে গেছে তেজস্ক্রিয় আগুনে।

ভানু বলল, মেয়েটারে দিয়ে দিলে নাকি?

তুমি জানো তা?

অনুমান, ভাবছিলাম তাই।

তুমি থাকল এটি হতোনি ভানুদাদা! কেঁদে পড়ল সরস্বতী, মেয়্যাটারে নিয়ে গেল!

অনন্ত বিড়বিড় করে, কাজে গিঁইছে, না গেলে খাবে কী ইখেনে?

সরস্বতী মাথা ঝাঁকায়, উপাস করত, পঞ্চম ঠাকুর উয়ারে বিচে দিল গো ভানুদাদা, কাজটাজ ছল।

অনন্ত ধমকে ওঠে, থাম!

ভানু ভয় পেল। বুঝতে পারছিল সর্বনাশের বাকি নেই বোধহয়। অনন্ত সার মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভানু হাত ধরল অনন্তর, চলো।

কোথায়?

পঞ্চম ঠাকুরের নিকট।

সে দেশে গিঁইছে।

কবে গেল?

সেদিন দুফরেই।

থানায় চল, থানায় যাসনি?

অনন্ত ঝুঁকে পড়ল, টঙ্কা দি গিছে অনেক।

কুন্তির মা কেঁদে পড়ল, কেনে অত টঙ্কা দিল? এ ভানুদাদা, মোর আর কেহ নাই, তুমার জন্যি পথে দাঁড়ায়ে আছি কদিন ধরে।

ভানু চলতে লাগল হোটেলের দিকে। তার পিছনে পিছনে অনন্ত আর কুন্তির মা আসতে লাগল। হোটেল সমুদ্রপাখি নিস্তব্ধ। ঠাকুরানি বসে আছে বারান্দায়, কপালে হাত, মাইতিবাবু নেই।

ঠাকুরানি বলল, ঠাকুর নাই, কয়েছি তো নাই উ লক, কেনে বারবার আসছ, যদি তেমন হয় তো যাও থানায়, পুলুশ সব টঙ্কা খেয়ে লিবে।

ভানু তার কাঁধের ঝোলা রাখল বারান্দার কোণে রাখা টেবিলে। তার দিকে চেয়ে হাসে ঠাকুরানি, ঘুড়া পাওয়া গেল?

কেন?

আছ ভালো, ঘুড়াটারে তুমি সরায়ে দিঁইছ কিনা কে জানে!

কী বলো?

ঠিকই বলি, ঘুড়া খুঁজতে কম টঙ্কা নিলে হুটেল থিকে?

ভানু থামায় হাত তুলে, বলে, থাক, কথাটা আমাকে না বলে বাবুরে বলো, এদের মেয়ে পাচার হয়ে গেছে, পঞ্চম ঠাকুর পালাল কেন?

কে পলাইছে, উয়ার মার অসুখ। উঠে পড়ল ঠাকুরানি, টঙ্কা দেয় নাই উয়াদের, এমনি মেয়্যাটারে নিয়ে গেল?

ভানু বলল, পঞ্চম ঠাকুর জেল খাটবে।

কেনে? ঠাকুরানির মুখ অন্ধকার।

ওকে ডেকে আনো, কোথায় নিয়ে গেছে মেয়েটারে, ঠিকানা চাই, আমার সেদিনই সন্দেহ হয়েছিল, মেয়েরে ঘুম পাড়ায়ে রাখল কেন জাহাজওয়ালা?

ঠাকুরানি মাথায় কাপড় টেনে দ্রুত নেমে যায় বারান্দা থেকে। কিচেনে গিয়ে ঢোকে। ভানু বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে বলে, কী হলো বলো?

ঠিকানা দিই গেছে মদনানি সায়েব। বলল অনন্ত।

এত টঙ্কা দিল কেনে! কুন্তির মা অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে।

নিলে কেন? ধমকে ওঠে ভানু, কান্না থামাও, কী হলো বলো।

মেয়্যাটারে নি গেল।

এমনি নিয়ে গেল, তুমারে বলে নিয়ে যায়নি?

হ্যাঁ, টঙ্কা ধরাই দিল পঞ্চম ঠাকুর, কী যে ইঁই গেল ভানুবাবু, কুন্তির মা আসার আগে ব্যাগ ভরে টঙ্কা দিল মোর হাতে।

মেয়েরে দেখেছিলে?

হ্যাঁ, তারে দুদিনেই চিনা যায়নি। হা হা করে ওঠে অনন্ত সার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *