1 of 2

অশ্বচরিত – ৩৮

আটত্রিশ

বেঙা বেঁচে আছে না মরে গেছে, সায়েব পুবে গেছে না পশ্চিমে, এই সব গুঞ্জনে গুঞ্জনে, আরও কজন নিরুদ্দিষ্টের শোকে শোকে দিন কাবার হয়ে যায়। দিন যত ফুরিয়ে আসে মানুষ ক্লান্ত হয় শোকে। কাঁদতে কাঁদতে মুখ থুবড়ে পড়ে। সমস্ত জেলেপাড়ার এখানে ওখানে দু-দশজন করে মানুষ চাক বেঁধে আছে। তারা নিজেদের ভিতরে নানা রকম আলাপে শোক এবং উত্তেজনা জিইয়ে রাখছে। দুদফা পুলিশ এসে ঘুরে গেছে। পুলিশকে কে না ভয় পায়! যে লোক সমুদ্রে ডুবে মাছের খাদ্য হতে হতে তীরে ফেরত এসেছে, সেই মরা ভোলা পর্যন্ত পুলিশের নামে কুঁকড়ে যায় তো জ্যান্ত মানুষ। ডাঙায় পুলিশ, আর জলে? জলে কালাপানি, সমুদ্রে কালাপানি—দুই-ই ভয়ংকর। পুলিশ টেনে তুলেছিল বেঙার বউকে। তাকে জেরা করে গেছে বড়বাবু নিজে। গেল কোথায় শাদা কেষ্ট ঠাকুর? কী করে জানবে বেঙার বউ, সে তো শেষ রাত থেকে মূর্ছা যাচ্ছে, যখন কটা লোক অন্য ট্রলারে ফিরল ঝড়জলের ভিতরে, যখন লঞ্চডুবির খবর হলো।

জেলেপাড়ায় আজ অরন্ধন গেছে। সকাল থেকে কোনো ঘরে চুলো জ্বলেনি। এখন সন্ধে নামছে। শোকের ওপর কালো ছায়া পড়ছে। অন্ধকার আবৃত করছে শোকাকুল মানুষজনকে। ভানু দাস সমস্ত দিন জেলেপাড়া, থানা, আবার জেলেপাড়া, আবার সমুদ্রতীর—এই করে বেড়িয়েছে। ভানু ভাবছিল এবার ফেরে। কিন্তু ফিরতে হবে তো হোটেলে। ফেরা মানে শ্রীপতি মাইতির মুখে আবার সেই কথা শোনা। ভানু বসেই আছে জেলেদের ভিতরে। বসে পুলিশের কথা, পুলিশের কথা থেকে কালাপানির কথা শুনছে। কালাপানিতে না পড়লে লঞ্চ ডুবতে পারে না। কালাপানি কী? কালাপানিতে জাহাজ, নৌকো, লঞ্চ একবার গিয়ে পড়লে রক্ষা নেই। জোড় ভেঙে ভেঙে মস্ত জাহাজও টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। লোহার পেরেকও আটকাতে পারবে না এক কাঠের সঙ্গে আর এক কাঠের জোড়, গলে যাবে লোহা কালাপানিতে পড়লে।

জল কি সত্যিই কালো? কালো তো বটে, ঘোর কালো। আসলে হলো গিয়ে কালাপানিতে মরাজাহাজি, নাবিক, মাছমারা জেলে, নৌকোর মাঝিদের প্রেত থাকে। প্রেত শরীর তো কালো অন্ধকারে গড়া। সেই অন্ধকার নিয়ে তারা নাকি জলে ভেসে থাকে, তাই জল হলো কালো। এ একটা কথা বটে, কিন্তু আসল কথা হলো সমুদ্রের রংই ওখানে গিয়ে বদলে গেছে। বুড়ো জেলে বলছিল কালাপানির কথা। তাকে কালাপানি চিনিয়েছিল তার বাবা সাধুরাম। সাধুরামের ছেলে কুঁড়োরাম বলে তার জলজীবনের কথা। বলছিল তার দীর্ঘ এক জলযাত্রার কথা। বাবা ছিল সঙ্গে। বাবা দেখাতে লাগল সমুদ্রের অথই নীলকে কখনো কালো মনে হয় কীভাবে। জলের রং ঘন হতে লাগল, নীল সমুদ্র ঘন হতে হতে, নীল রং গাঢ় হতে কালো হয়ে যেতে লাগল। বুড়ো বলে, সমুদ্র তো নীলই। আকাশ নীল হলে সমুদ্র নীল। আকাশটাকে সম্পূর্ণ ধরে তো সমুদ্র তার বুকে। নীল সমুদ্রের রং যদি ক্রমশ আরও নীল হয়ে যেতে থাকে তবে কিন্তু সম্ভাবনা জেগে উঠে কালো জল এগিয়ে আসছে। কালো জলের দিকে চলেছে নাবিক। তবে কিনা চোখে তো মায়া লাগে। ভুল হয়। নীলকে কখনো কখনো কালো বলে মনে হয়, আবার কালোকেও নীল। কালো যদি নীল হয়ে ডাকে, তখন কে ধরতে পারবে সর্বনাশী ডেকে নিচ্ছে তাকে। কালো জল সীসার মতো ভারী, সে জল জল নয়, অন্য কিছু। হয়তো তা ছায়াই শুধু। কালো ছায়া। সেই ছায়াই জমে আছে সেখানে। অনেক অনেক বছরের পুরনো ছায়া তো। আবার এও তো হয় কালো জল দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেছে যখন মাছমারা, তখন দেখেছে, রং বদলে যাচ্ছে। নীল হয়ে যাচ্ছে জল। নীলকে সে কালো দেখেছিল।

কুঁড়োরাম বলে, জল, আকাশ আর রোদ, তিনে মিলে সমস্ত দিন সমস্ত রাত সমুদ্রে খেলা চলে। জলের রং ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। এই দেখলে নীল, পরক্ষণেই দেখলে তা ঘোলাটে হয়ে গেছে। আবার নীলটা কোথাও সবুজ ভাব নিয়ে পড়ে আছে জলের ওপর। তা দেখতে চোখে ঘোর এলো, দেখলে নীলের ওপর বাদামি আবরণ ছেয়ে গেছে। আবার দেখলে নীলটাই নেই, জল একেবারে জলের মতো, বর্ণহীন। জল একেবারে কাচের মতো, চকচকে, সমুদ্রের অতল তল পর্যন্ত দেখা যায়। এই সব দেখতে যদি চোখে পড়ে নীল আলো উঠে আসছে অতল থেকে, তা ছড়িয়ে পড়ছে জলে, জলের ওপারে জলে, আরও দূর জলে, সমুদ্রের অন্দরে, শ্যাওলা, নুড়ি পাথর, বালি, প্রবালের ভিতরে, অতল থেকে অতলে, তারপর সেই আলো উঠে এসে জলে ছড়িয়ে গেল, জল নীল হয়ে গেল, ঘন নীল, এত গাঢ় নীল যে কালো বলে ভুল হতে পারে, তারপর সেই নীল জল ছেড়ে উঠে গেল, চরাচর ঢাকতে লাগল, তা হতেই পারে। সব ঢেকে নিল তার রঙে। তখন কোনটা সমুদ্র, কোনটা আকাশ, কোনটা শূন্য জগৎ কিছুই ধরা যাবে না।

তুমি দেখেছ এমন?

বুড়ো বলতে থাকে, দেখেছে, আবার দেখেওনি। দেখেছে মনে হয় যেমন, তেমনি মনে হয় এসব তার দেখা নয়, তার বাবা সাধুরামের দেখা। সাধুরাম তাকে সমুদ্র চিনিয়েছিল। সাধুরাম বলেছিল যখন নীল মায়া লাগবে চোখে, শরীর সিধে করে, কান খাড়া করে, পা ঘষতে হবে নৌকার পাটাতনে। নীল ঘন হতেই কালো হয়ে যায়। কখন যে কালো হবে তা কেউ টেরই পাবে না। কালো হলো মরণ। মরণকে কে চেনে? কোন রূপে কখন এসে দাঁড়াবে চোখের সামনে ধরতেই পারবে না। যখন তাকে চেনা যাবে তখন আর ফেরার উপায় নেই। সমুদ্র হলো মস্ত কুহকিনী। রঙে রঙে ভোলায়। নীল মায়াই কালো জলে নিয়ে ফেলবে জাহাজ, নৌকো, লঞ্চগুলোকে। বাবা সাধুরাম ছিল সমুদ্রের মাছের মতো। সমুদ্র চিনত খুব ভালো। জলের সব চেহারা তার জানা ছিল। নিজের নখে সে সমুদ্র দেখত। সমুদ্র দেখা মানে তো জল দেখা নয়, বাতাস দেখা, রোদ দেখা, মেঘ দেখা, অন্ধকার দেখা, আকাশের তারা দেখা—সব। বাবা সাধুরাম দিনের ঝলমলে আলোয় দাঁড়িয়ে টের পেত বিকেলবেলায় কী হতে পারে, কোন দিক থেকে মেঘ উঠতে পারে। আকাশের কোন বিন্দুতে মেঘ ওঠার চিহ্ন রয়েছে তা আকাশ পর্যবেক্ষণ করেই ধরতে পারত সাধুরাম। গায়ে কতটা ঘাম, ঘাম কতটা ঝরে যাচ্ছে নৌকোর ওপর, তা দেখে সে বুঝত আকাশের ঈশেনকোণ কী বলতে চায়, বায়ুকোণ, অগ্নিকোণের ভাবটি কীরকম! বাবা সাধুরাম নাকি ছিল সমুদ্রপাখির মতো। পাখিদের মতোই সে সব চিনত, বরং বেশি চিনত আরও।

কিন্তু কালো জলের কী হলো?

বুড়ো জেলে বলে কালো জল না হোক, সমুদ্রকে কালো হতে দেখেছিল সে প্রথম যাত্রায়। বাবা সাধুরাম দুপুরেই বলেছিল লক্ষণ ভালো নয়, বিকেলে সমুদ্র কালো হবে। কেন কালো হবে, না আকাশ কালো হবে। আকাশও এক সমুদ্র, বায়ু সমুদ্র, এ হলো জলসমুদ্র। দুই সমুদ্র প্রকৃতিতে আলাদা হলে কী হবে, একটি কালো হলে অন্যটি নীল থাকে না।

সে তো ঝড়ের কথা বলছ, ঝড়ের সময় সমুদ্র অন্ধকার হয়।

সেই অন্ধকারে বাতাস খুব ছোটে। তখন শক্ত করে হাল না ধরলে উপায় নেই, কালো জলে গিয়ে পড়বে নৌকো, লঞ্চ, বেঙার নৌকোর তাই হয়েছিল হয়তো।

ঝড়ে ডুবেছে তাহলে?

ঝড়ে ডোবে আবার ভেসেও ওঠে। কিন্তু নৌকো যদি কালো জলে গিয়ে পড়ে, তবে তো খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল। আর মেঘের রং জলে গুলে গেলে তাই-ই হয়। বাবা সাধুরাম কত ঝড় জলে নৌকো সোজা রেখেছে। প্রথম জলযাত্রায় জলের নীল চিনতে চিনতে কতদূর চলে গিয়েছিল তারা! নৌকোর মাথায় যে সাদা হাঁসেরা উড়তে উড়তে আসছিল, তারাও আর এলো না, ভাবল বুঝি সাধুরাম অন্য দেশে যাচ্ছে। নিরুদ্দেশে যাচ্ছে। হাঁসেরা, সমুদ্রপাখিরা নেই তাদের মাথার ওপর, চারদিকটা গোল। চারদিকটা যখন একরকম, কোনো দিকে যখন কোনো ব্যত্যয় নেই, তখন সাধুরাম বলল, এখন কোন দিকে যাব তা ভেবে দেখতে হবে, জলের রং দেখে চিনতে হবে।

কালাপানিতে গিয়ে পড়লে?

না পড়লাম না, কিন্তু কালাপানি যেন দেখা গেল।

দেখা গেল, কোথায়?

কেনে উত্তর-পশ্চিমে, বাবা সাধুরাম দেখাল, হুই দ্যাখ বেটা…।

কী দেখলে? না জলের রং ধূমাবতী। জল যেন মেঘ ধরে আছে। জলের রং থেকেই আকাশের রং বদলে যেতে লাগল। নাকি আকাশের রং থেকে জলের তা ধরা যাচ্ছিল না। আকাশ সমুদ্র একাকার। কী আশ্চর্য! একটা জেলে-নৌকো দেখতে পেয়েছিল তারা, আকাশে উঠে গেছে। কালো জল কি তাহলে আকাশ পর্যন্ত ধেয়ে গিয়েছিল? আকাশে উঠেই নৌকোটা মিলিয়ে গেল!

কুঁড়োরাম একই কথা বলতে থাকে। একই কথা শুনতে থাকে তাকে ঘিরে থাকা লোকজন। কালাপানির ওপরে যদি উড়ে যায় সাদা পাখি, সিগাল— সমুদ্রপাখি, তবে তা মুহূর্তেই কালো হয়ে যায়, তার ডানার প্রতিটি পালক হয়ে যায় ধোঁয়ার মতো কালো, তারপর সে পাখি টুপ করে আকাশ থেকে খসে পড়ে। ভারী কালো জলে পড়ে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে মরে যায়। কালাপানি টের পাওয়া যায় যদি দেখা যায় মরা সমুদ্রপাখি ভাসতে ভাসতে আসছে, মরা হাঙর, মরা মাছ ভাসতে ভাসতে আসছে।

তোমরা দেখেছিলে?

কুঁড়োরাম বলে, দেখেছিলাম, তবে আমি একা, বাবা নেই, বিশ-পঁচিশ বছর আগে, কত পাখি, যেন পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে, ভাসতে ভাসতে এলো নীল জলে, তা দেখে মনে পড়ে গেল বাবা সাধুরামের কথা।

কত বছর? ভানু জিজ্ঞেস করে।

হিসাব মনে নাই।

ভানু বলল, সেদিন কি পূর্ণিমা ছিল?

চমকে ওঠে বুড়ো, ঠিকই তো কহিছ।

মনে পড়ে তুমার? ভানু নিবিড়তা আনে তার কণ্ঠস্বরে!

হাঁ, পুন্নিমাই বটে, চান্দ উঠা দেখলাম বসে, কতখানি বড়, সুনার থালার মতো চান্দ, আগুনের মতো রং সে চান্দের, যতবার দেখি ততবার চোখ ফিরাতে পারি না, কেনে ইমন হয়?

ভানু বলে, মায়া জাগে, দিনটা কেমন ছিল, কুয়াশা ছিল সে রাত্তিরে?

কুয়াশা হবে কেন, বোশেখ মাস।

ভানুর দম আটকে আসে প্রায়, বোশেখী পূর্ণিমা?

তাই হবে হয়তো। চান্দ আকাশে উঠতে লাগল, চান্দের আলো সোনালি থেকে রুপোলি হয়ে যেতে লাগল। আহা! বোশেখ মাসের পুন্নিমের রাতে জলে, গাঙে, সাগরে যে না গিঁইছে সে কুথাও যায় নাই, এ জগতের কুছুই দ্যাখে নাই সে, জগৎ, সমুদ্দুর, আকাশ যে কত মধুর তা তার জানা হলোনি।

ভানু বলল, হাঁ ঠিকই, তবে এমনটি মাটির ওপরেও হয়।

হয়! কীরকম হয়?

ভানু বলল, মাঠের ভিতরে দাঁড়াও, পুন্নিমা রাতে, নদীর ধারে দাঁড়াও।

বুড়ো কুঁড়োরাম বলে, আমি অমন দেখি নাই, কিন্তু যা দেখিছি তা যে কী! কী করে বলি তুমাদের, দেখি নীল জল জোছনায় সাদা হুঁই গেল, চান্দ এক্কেবারে মাথায় মাথায়, জল তখন রুপোলি, আবার নীলও বলা যায়, আবার তা বলাও যায় না, জল অন্ধকার, তার শুধু শব্দ আছে, রং নাই, তার শুধু টান আছে আর কুছু নাই, জলের ওপর চান্দের আলো দুলছে, খেলা করছে আলো, জলে তাকালে দেখা যাবে কতশত চান্দ ঢেউয়ের ওপর দুলছে, মোর তখন মনে পড়ি গেল মঙ্গলা বউটির কথা।

সে কে?

সে ইখন নাই, তখন সে ভরা পুয়াতি, মু যদি গাঙে যেতাম, সে গাঙ-ধারে গিয়া বসি থাকত, তাকায়ে থাকত জলের দিকে, সোয়ামি গেছে জলে, জলকে সে সন্তুষ্ট করত, জেগে জলের দেবতার নিকট মাথা ঠুকত, ইসব তো মোর জানা, প্রাণ আনচান করতি লাগল মঙ্গলা বউটির জন্য, জলের উপর জোছনা, জোছনায় মু তাহারে দেখি, ভরা পুয়াতি মেয়্যামানুষ, কুনো সন্তানই তার বাঁচেনি, মরা সন্তান বিয়োয় বছর বছর, তার হয়ে ভগবানের নিকট পারথনা করব ভাবি, ভগবানকে বলি ইবারেরটায় পরান রাখো, অতবড় গাঙ, সাগর, যাহার কুনো দিকে কূল নাই, শুধু পানি আর আকাশ, আর জোছনা, জোছনা রাতে সমুদ্দুরকে ভগবান ছাড়া আর কুছুই মনে হয় না, তো সেই সময় জলে ভেসে এলো পুড়া ভস্মর মতো ক’টি পাখি, পষ্ট দেখলাম, সে পাখি নেশ্চয় কালাপানির উপর দিয়া উড়ার সময় জলের ভিতরে পড়ি গিঁইছিল।

ভানু অবাক হয়ে শুনছে। যত শুনছে তত অবাক হচ্ছে। যে পূর্ণিমার রাতের কথা বলছে, সেই রাতটি কি চব্বিশ বছর আগের? সেই বিস্ফোরণের পর ওই সাগর শুকোনো পোখরান, খেতলাই মরুদেশে কত মানুষ রোগে পড়েছে, মরেছে একটু একটু করে মারণ বাতাসে, পাখিগুলো কি তেজস্ক্রিয় বাতাসে মরেছিল? মরুভূমির পাখিই পালাতে পালাতে ডানা ভেঙে পড়ল সাগরের ওপর? তেজস্ক্রিয়তায় তার রঙিন পালক, সাদা পালক ছাইবর্ণ ধরেছিল নাকি?

শুনে বুড়ো বলল, মরুভূমি কী?

সাগর শুকায়ে যা হয়, শুধু বালি, জল নাই, গাছ নাই, বিষ্টি নাই।

একজনের মনে পড়ল, বলল, যেখেনে শত্রুরে ভয় দিখাতে বোমা ফাটানো হলো, সেই জায়গাই হলো গে মরুভূমি।

সেখেনে পাখি থাকে?

মানুষ থাকে, পাখি থাকবে না?

কুঁড়োরাম বলে, পাখিগুলান ছিল অচেনা, অমন পাখি দেখি নাই ইদিকে।

তাহলে মরুভূমির পাখিই হবে।

কেনে হবে?

পালায়ে আসছিল মরুভূমি থেকে।

কেনে পালাচ্ছিল?

নিশ্চয় ভয় পেয়েছিল?

সেদিন ছিল বুদ্ধ পূর্ণিমা বোশেখ মাসের পূর্ণিমা।

তো কী হলো, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভয় পেয়েছিল?

ভানু চুপ করে থাকে। ভাবে কী বলবে? চব্বিশ বছর আগে যে বোমা ফেটেছিল মরুভূমিতে তার কথা কি মনে রেখেছে কেউ? ভানু তখন বলে, বুদ্ধ পূর্ণিমায় আমাদের মরুভূমি খুব ভয়ের, এ বছর দ্যাখো না।

কী দেখব? অন্ধকার থেকে প্রশ্ন উড়ে এলো।

ভানু বলল, মরুভূমিতে ওই দিন বাতাসে মরণ ঢুকে গেল।

কীসব বলছ তুমি, মরুভূমি দেখেছ কোনো দিন?

ভানু মাথা নাড়ে, তবে বোঝাতে চেষ্টা করে, শুধু বালি আর পাথর, গাছপালা নাই, ধু ধু করে আগুনে বাতাস।

গাছপালা নাই তো পাখি কোথায় থাকে?

যেখেনে গাছ আছে সেখেনে থাকে। ভানু জবাব দেয়।

মরুভূমির জাহাজ জান। কে একজন জিজ্ঞেস করল।

জানি না, মাথা কাত করে ভানু, কুঁড়োরামকে বলে, মরুভূমির পাখিই তো?

কুঁড়োরাম বলে, আমি তো বলেছি, না ওটা গাঙের পাখি।

গাঙের পাখি তবু অচেনা লাগল?

কত বড় গাঙ, কত সব দেশ উহার ধারে ধারে, সব কি চিনি আমি, একবার একটা মাছ ধরার লঞ্চ ধরা পড়ল, তার জেলেরা সব কীর’ম যেন, ভিন দেশের জেলে মোদের সমুদ্দুরে মাছ মারতে এয়েছিল, তো সেই জেলেদের থানায় নিল পুলিশ, তাদের কথা কিছুই ধরা যায় না, কীর’ম সব ভাষা, বলে ‘শ্যামদেশ”, সে দেশ কুথায় কে জানে, এইর’ম কত দেশ আছে।

আচ্ছা ওটা যে জলের পাখি তা বুঝলে কী করে?

জলের পাখি তো চিনা যায়, হাঁসের মতো পা ছিল জোড়া জোড়া, হাঁ, আর একটা কথা ওটা ছিল চৈতি পুন্নিমা, বোশাখী পুন্নিমা লয়।

তাহলে তো মিটে গেল, এখন যা হচ্ছে সব ওই বোশেখী পুন্নিমার ঘাড়ে, মরুভূমির ওপর চাপাচ্ছে কিছু লোক। অন্ধকারে এক বৃদ্ধ গরগর করে ওঠে, তারা সব দেশদ্রোহী, মানে দেশের বিপক্ষে, অন্য দেশের চর।

ভানু থমকে যায়। চেষ্টা করে কে কথাটা বলেছে তার মুখ দেখতে। কিন্তু সব মুখই যে এক রকম। ভাবলেশহীন, চোখ ঘোলাটে। ভানু দমে না, বলে, তুমি বোশাখী পুন্নিমাটা চৈতি পুন্নিমা করে দিলে?

বোশাখ মাসে ফিশিং বন্ধ ছিল, খুব ঢেউ, কহিতে ভুল হই গিছিল। বুড়ো কুঁড়োরাম বলে লজ্জিত স্বরে, তারপর অন্ধকারে যেন ঘোষণা করে, সে পাখি কালো জলেই মরেছিল।

ভানু বলে, যদি মরুভূমির বাতাস দূষিত বলে মরে থাকে?

এত দূরে আসবে কেন?

ভানু তখন বোঝাতে থাকে। বাতাসে বিষ। শ্বাস-প্রশ্বাসে বিষ-বাতাস। সে বাতাস এমন যে মানুষের গায়ে ঘা হয়ে যায়, হাড়ে ঘুণ ধরে যায়, চোখ অন্ধ হয়ে যায়, রক্তবমি হয়, বহু দূরে, ওই পুব দিকে জাপান দেশে কী হয়েছিল জানো?

অত শুনব না, কোনো কথাই শুনব না, পাখিটা কালো জলে মরেছে।

ভানু মাথা নাড়ে, পালিয়ে আসছিল মরুভূমি থেকে, বিষ লেগেছিল তাই উড়তে উড়তে তার চোখ অন্ধ, অন্ধ পাখির ওড়ার কোনো দিক নেই, তাই সমুদ্রে এসে পড়েছিল একা, সমুদ্র দিয়ে উড়তে উড়তে, বসার কোনো জায়াগ নেই, ডানা ভেঙে পড়ল জলে, এই রকম হতে পারে।

তুমি থামবা। অন্ধকারে একটা জোয়ানমতো ছেলে চিৎকার করে ওঠে, অলক্ষুণে কথা বলছ কেনে, পাখির মরণ আমাদের পক্ষে ভালোনি।

তা আমি জানি।

পাখি মোদের মাঝ সমুদ্দুর থিকে মাটি দেখায়ে নিয়ে আসে কূল পানে, সেই পাখি যদি অন্ধ হয়, তবে নৌকো কোন দিকে লিয়ে যাবে ঠিক নাই।

ভানু বলল, জানি।

জানি তো বলছ কেন?

পাখিগুলো যে অন্ধ হয়ে গিছিল বাতাসের বিষে।

বুড়ো কুঁড়োরাম বলে, তার কোনো প্রমাণ নেই ভানুবাবু।

মানুষ যদি অন্ধ হয়, পাখি হবে না?

তা হবে, কে যেন বলল অন্ধকারে, ঝড়েই কত পাখি মরে তো বাতাস বিষিয়ে গেলে মরবে না? মরবে নিশ্চয়, অন্ধও হবে।

বুড়ো কুঁড়োরাম বলে, বলছ অন্ধ ছিল পাখিরা?

হাঁ, অন্ধ ছিল, অন্ধ বলে জলের ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে দিক খুঁজে পেল না। বলতে থাকে ভানু।

তখন জেলেবস্তির চার-পাঁচজন, নাকি পাঁচ, সাত, দশ, বারোজন কেঁদে ওঠে অন্ধকারে। কেউ ভাবল পাখি অন্ধ হয়ে গেছে এই খবরে কাঁদল তারা আবার কেউ ভাবল জলে ডুবে মরা কোনো দেহ সমুদ্র ফিরিয়ে দিয়েছে আধখানা খেয়ে, সেই খবর পেয়ে কাঁদল তারা। অন্ধকারে শোক বাড়তে লাগল। সেই শোক আরও বাড়ল যখন ভানুর মনে হলো একটা জেলে-নৌকো একা ফিরে এসেছে ঢেউয়ে দুলতে দুলতে। কেউ নেই তার ভিতরে। শূন্য নৌকো, আরোহী যেন জল দিয়ে হেঁটে চলে গেছে দূর দক্ষিণে, যেমন গিয়েছিল কন্থকের প্রভু। যেমন ফিরেছিল কন্থক। ভানুর বুক ভার হয়ে গেল, সে আতগলায় কন্থককে ডাকতে ডাকতে উঠে দাঁড়াল। বুড়ো জেলে জিজ্ঞেস করে, সে আবার কে? সেও কি জলে ডুবে গেল?

ভানু বলল, হ্যাঁ, তার নৌকোটা একা ফিরছে ঢেউয়ে দুলে দুলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *