1 of 2

অশ্বচরিত – ২৯

ঊনত্রিশ

আগের রাতে ছিল বজবজে। সে ঘাটে গিয়ে নৌকোয় উঠতে যাবে তো চা-দোকানি সুরেন কুণ্ডু তাকে আটকে দিল, রাতটা থেকে যাও ভানুবাবু, তোমারে আমি চিনেছি।

কী চিনেছ?

তুমি জুট মিলের লোক ছিলে, মনে পড়ে, বাজাজের ইটখোলায় আসতে, তোমার মিলের খোঁজ নিতে এয়েছিলে?

হ্যাঁ, ভানুর চোখ ছলছল করে উঠেছিল ধরা পড়ে গিয়ে।

মিলের জমিই বিক্রি হয়ে যাওয়ার জোগাড়, থাকো ভানুবাবু, আমি টের পাচ্ছি এ জীবনে আর কখনো আসবা না তুমি।

না, কী করতে আসব?

তবে থেকে যাও, আমি একা মানুষ, একেবারে একা, কেউ নাই।

সত্যি?

হ্যাঁ, একা থাকি, স্বপাকে খাই, এই দোকানেই থাকি, থেকে যাও ভানুবাবু, অনেক রাত পর্যন্ত নদীধারে বসে কথা বলব।

ভানু থেকে গিয়েছিল। এমন ডাকছিল সুরেন কুণ্ডু, সে না থেকে পারেনি। তারপর অন্ধকারে নদীর কূলে বসে কত রাত অবধি কথা বলেছিল তারা। সুরেনের কেউ নেই। বউ মরে গিয়েছিল যে কবে তা তার মনেই নেই যেন। ভুলেই গেছে বউকে। আর ছিল একটা মেয়ে। সেও একটা খারাপ লোকের হাতে পড়ে যে কোথায় চলে গেছে, তা জানে না সুরেন। থানায় যাতায়াত করেছিল, কিন্তু চা- দোকানি কতটা কী করতে পারে? ভানুর চোখে জল এসেছিল। কী সুন্দর কথা বলছিল লোকটা। বলছিল, মাঝেমধ্যে একে ওকে হাতে-পায়ে ধরে আটকে দেয়। একসঙ্গে রাত্রি কাটায়। কী আর আছে এ জীবনে? এই নদী, আলো, অন্ধকার, বাতাস, মেঘ, বৃষ্টি সবই তো ভগবানের মতো। সেই ভগবানকে ধরে আছে সে। মানুষ যতই ত্যাগ করুক ভগবানকে, যতই ধ্বংস করুক ভাগবানের অংশকে, এত বড় তিনি, কতটা কী করতে পারে মানুষ?

ভানু বলেছিল, সুরেনবাবু, ঘোড়াটার কী হলো?

সুরেন বলেছিল, খুঁজলে পেয়ে যাবে।

সকালে নদী পার হয়ে ফুলেশ্বর থেকে ট্রেন ধরেছিল ভানু। তারপর মেচেদা থেকে বাস। বাসেই আর একটা লোকের সঙ্গে দেখা। চেনা মনে হচ্ছিল। দীঘায় দেখা হয়েছিল হয়তো। দীঘায় কে না যায়? সেই লোকটা তার পাশে এসে বসে যখন কুশল নিয়ে জিজ্ঞেস করল ঘোড়ার খবর, ভানু অবাক, কী করে জানলে?

যাই হোক, সে বলল, ভানুবাবু কি দৌলতপুরের দিকে গেছেন?

কেন?

ওই দিকে একটা ঘোড়া…।

ঠিক জানেন?

জানি তো, আমার শ্বশুরঘর তো দৌলতপুরেই।

ভানু জিজ্ঞেস করেছে, আপনার নাম?

অবনী মৃধা।

ঘোড়া কি আপনি দেখেছেন?

না, আমার শালা।

কাঁথি নেমে দৌলতপুর যাওয়ার ট্রেকার ধরেছিল ভানু। দৌলতপুর, দরিয়াপুর তো ছিল রসুলপুরের নদীর কাছে। ওখানেই বিসর্জিত হয়েছিল নবকুমার। ভানুর মনে হয় সব সত্যি। কী আশ্চর্য! সেই ট্রেকারেই কিনা বসে আছে গৌরমোহন মদরঞ্জিওয়ালা। কোথায় যাচ্ছে সে? না, ওই রসুলপুরেই। বোনাই ঘরে। মানুষের কত শিকড় যে কত দিকে ছড়ানো! খুঁজে বের করতে পারলে দেখা যাবে সব মানুষ যেন একই গাছের ফুল। মদরঞ্জিওয়ালা খবর দিল যে কোকিলা আঁকছে। আঁকা শেষ হলে তারা দুজনে মিলেই দীঘায় যাবে মাইতিবাবুর কাছে, ঘোড়াটার কী হলো, শেষ পর্যন্ত মিলল কি?

ভানু যাচ্ছে ঘোড়াটার খোঁজ করতে, তা শুনে মদরঞ্জিওয়ালা গৌরমোহন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করে ঘাড় দোলায়, হতেও পারে।

তার মানে?

ঘোড়া যে এদিকে আসবে না তার গ্যারান্টি নেই।

হ্যাঁ। ভানু তাকে সমর্থন করে, খবর যখন পাওয়া গেছে—।

কিন্তু তারা দুজনে যত বলুক, দৌলতপুরের কোনো মানুষই জানে না কোনো ঘোড়ার কথা। না, মদরঞ্জিওয়ালার বোনাইও জানে না। তারা তো অবাক, ঘোড়া! ঘোড়া আসবে কেন দৌলতপুরে, কী কারণে?

ভানু বলল, রসুলপুরের নদীতীরেই না নবকুমারকে ফেলে রেখে গিয়েছিল তার লোকেরা, এই দৌলতপুরের কাছে।

সে তো উপন্যাস! বলছে গৌরমোহনের বোনাই।

তাতে কী হলো, ওরকম তো হয়েছিল বটে। ভানু বলেছিল।

কী করে বুঝলে হয়েছিল?

আহা, কপালকুণ্ডলা বনচারিণী!

তাতে কী হলো?

ঘোড়াটা আসতে পারে।

ঘোড়া ওই জন্য আসবে, হাসলে ভানুবাবু! বলছে গৌরমোহন।

ভানু মাথা নাড়ল, না ওই দিন দুপুরে বোমা ফাটানো হলো।

তার জন্য ঘোড়া এদিকে আসবে?

অবনী মৃধা যে বলল এয়েচে এদিকে।

কে অবনী মৃধা?

দৌলতপুরের জামাই।

মিথ্যে বলেছে। গৌরমোহনের বোনাই শিবরাম বলল, আপনারে ঠকিয়েছে লোকটা।

ঠকাল কই?

মিথ্যে বলে এত হয়রানি করাল যে।

হয়রানি কী, ঘোড়াটা আসতেও তো পারে, হয়তো আপনার জানা নেই, অন্য লোক জানে।

কে জানে?

ভানু বলল, আমি জানি।

হি হি করে হাসল শিবরাম, এখেনের লোক সবাই ঘোড়াই দ্যাখেনি, এমন লোক আছে ঘোড়া কেমন তা বলতে পারবে না।

তাতে কি ঘোড়া আসবে না এদিকে?

আসতে পারে, তবে ও ঘোড়া আসেনি, ঘোড়া কেন, গাধা, খচ্চোর কিছুই আসেনি এ গাঁয়ে 1

কিন্তু অবনী মৃধা যে রকমভাবে বলল!

শিবরাম বলল, পুরো ফলস দিয়েছে, ওই নামে এ গাঁয়ে কোনো জামাই নেই, আর ঘোড়া খামোকা কেন আসতে যাবে?

বিকেল হয়েছিল। আকাশে বেশ মেঘ। ঠাণ্ডা বাতাস উঠছিল দক্ষিণ দিক থেকে। মাঝসাগরে বৃষ্টি হয়েছে হয়তো। ভানু বলল, রসুলপুরের গাঙ কোন দিকে?

যাবেন নাকি? গৌরমোহন জিজ্ঞেস করে।

এতদূর এলাম, যাব না? দেখে আসি।

ওদিকে ঘোড়া যাবে কী করে? গৌরমোহনের বোনাই শিবরাম হাসে।

ভানু বলল, দেখে আসি কোন পথে নৌকো এসেছিল সাগর থেকে।

ও তো উপন্যাস। গৌরমোহন প্রতিধ্বনি করল তার শ্যালকের কথায়।

ভানু বলল, হোক, কপালকুণ্ডলা কি ছিল না গৌরবাবু?

গৌরমোহন চুপ করে থাকে। ভানু বিড়বিড় করে, বনে বনে ঘোরে অনাথিনী, কাপালিকের হাতে মানুষ, দেখে আসি চলেন।

এখেন থেকে তিন মাইল মাঠে মাঠে যেতে হবে, অন্ধকার হয়ে যাবে।

আর কী হবে? ভানু জিজ্ঞেস করে।

কী হবে আবার? গৌরমোহনের বোনাই শিবরাম অবাক এই ঘোড়াসন্ধানী মানুষটাকে দেখে। ঘোড়া যে হারাতে পারে সে বিষয়ে কোনো ধারণাই ছিল না তার। আর তা খুঁজতে আসতে পারে কেউ তাও ছিল ধারণার বাইরে। আর তার শ্যালক গৌরমোহন মদরঞ্জিওয়ালাই কিনা নিয়ে এলো এমন একটা লোককে। গৌরমোহন যে মেয়েমানুষটা নিয়ে আছে সেই-ই তো প্রায় কপালকুণ্ডলা। শিবরামের বউ তাকে যেতে দেয় না মীরগোদা। ভাই বউ যেন এ বাড়িতে না ঢোকে সে কথাও বলে দিয়েছে সে তার বড় ভাইকে। সংসার জ্বালাতে এসেছে নাকি কোকিলা? শিবরামের মনে পড়েছে কোকিলা বধূর কথা, সে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ কোকিলা?

গৌরমোহন বলে, তোমারে যেতে বলেছে।

আমারে? গৌরমোহনের কথায় ভানু এবং শিবরাম দুজনে বুকে হাত দিল। আর তা দেখে গৌরমোহন ঘাড় কাত করে, হ্যাঁ।

কপালকুণ্ডলা পড়েছেন? নীরবতা ভেঙে একটু বাদে জিজ্ঞেস করে শিবরামকে। মাথা নাড়ে শিবরাম, হাসে, সময় পেলাম কই?

গৌরবাবু?

গৌরমোহনও মাথা নাড়ে, না তো!

তবে কী করে জানলেন কপালকুণ্ডলার কথা?

শিবরাম বলে, ঠাকমা বলেছিল।

ঠাকমা পড়েছিল?

পড়তেই জানত না ঠাকমা।

তবে কী করে জেনেছিল?

কী জানি, বই না পড়লেও সব জানি ভানুবাবু, আমাদের গাঁয়ে দশটা ছেলের নাম নবকুমার।

আর মৃন্ময়ী।

শিবরাম অস্ফুট গলায় বলে, সেও আছে!

ভানু দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তাহলে গাঙ দেখতে যাওয়া যাবে না?

না, অন্ধকার হয়ে এসেছে।

অন্ধকার নামছিল ধীরে ধীরে। ভানু অনেকক্ষণ বাদে একা পেল গৌরমোহনকে। শিবরাম গেছে ভিতরে। ভানুকে এত সময় একা পেয়ে কোকিলার স্বামী বলল, কথা আছে ভানুবাবু, কোকিলার কী যেন হয়েচে।

কী হয়েছে?

আঁকতেই চায় না।

চায় না কেন?

কী জানি ভানুবাবু, অথচ তার আঁকার জন্যেই না আমার মদরঞ্জির এত কদর।

ভানু চুপ করে আছে।

গৌরমোহন বলল, তুমি যাবা একবার?

কেন?

ঘুরে যাও না কেনে ভানুবাবু।

সে কি আমারে যেতে বলেছিল?

গৌরমোহন চুপ করে। ভানুর দম বন্ধ হয়ে আছে। কী জবাব দেয় মদরঞ্জিওয়ালা। ভানুর মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই সন্ধ্যাটির কথা। মীরগোদার বালিয়াড়ির আকাশে ধ্রুবতারা। সমুদ্র সরে গেছে। ধ্রুবতারা রয়েছে। মদরঞ্জিওয়ালা ভর সন্ধেতেই ঝিমোতে ঝিমোতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে আর কোকিলা মুখোমুখি।

ভানু বলল, আমি যাব?

যাও ভানুবাবু।

তুমি যাবে না সঙ্গে?

আমার দুদিন লাগবে যেতে।

কেন?

বুন আমারে ছাড়বে না।

কোকিলা একা থাকবে?

গৌরমোহন চুপ করে থাকে। ভানু আর কিছু বলে না। রসুলপুরের নদী দেখতে চলল অন্ধকারে। শিবরামই হঠাৎ তাকে বলল, দেখিয়ে আনি চলুন।

রাতে, এখন যাবেন?

হ্যাঁ, গৌরদাদার বোন বলল তাই, যেটা দেখতে এয়েচেন সেটা না দেখে যদি চলে যান, হয়তো এ জীবনে আর দেখাই হবে না, সুযোগ এয়েচে যখন ছাড়া ঠিক না।

ভানু গেল না। ভানুকে নিয়েই বরং গেল শিবরাম। অন্ধকারে ছয় সেলের বড় টর্চ হাতে চলল শিবরাম। মাথার আকাশের ভিতরে পরিষ্কার আকাশের তারাগুলো ভানু আর শিবরামের মাথায় মাথায় ভেসে যেতে লাগল। দূর থেকে নদী-গর্জন শোনা যেতে লাগল। নদী-বাঁধে উঠতে উঠতে ভানুর মনে হলো, আকাশে তারাদের কাছে উঠে যাচ্ছে সে। উঠতে উঠতে আচমকা দাঁড়ায় শিবরাম, ভানুবাবু, তুমি কবে থেকে চিনলে ওদের?

কাদের?

কোকিলারে, কোকিলা সুন্দরীরে?

ভানু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, বহুকাল, বহু বছর।

কত বছর?

হাজার বছর।

এ কথার কোনো মানে হয় না, বলো না সত্যি কথা।

ভানু বলল, মনে হয় ওই রকম, পূর্বজন্মের চেনা।

কী বলো তুমি, আমি ওই কথা জানতে তোমারে নিয়ে এলাম এখানে?

ভানু বলল, নদীর মুখোমুখি গিয়ে বলি।

নদী নয়তো সাগর। দূরে, মাঝ নদীতে নয়, আরও এপাশে সার সার ইলিশের নৌকো। নদী ছলছল করে ধাক্কা মারছিল বেলাভূমিতে। নদী-বাঁধে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে নদীর দিকে তাকিয়ে ভানু বলল, তুমি কতদিন চেনো?

আমারও তাই মনে হয় ভানুবাবু।

আগের জন্মের?

হ্যাঁ, মৃন্ময়ী বলে ডাকি আমি ওরে।

কারে? শিহরিত হয়ে ওঠে ভানু, কী বলছ তুমি?

সত্যি কথা বলছি।

কোকিলারে মৃন্ময়ী বলো?

হ্যাঁ বলি, কেউ জানে না, শুধু সে আর আমি।

তুমি কপালকুণ্ডলা তো পড়োনি, জানো মৃন্ময়ী নামটা কে কারে দিয়েছিল?

জানি, আমি কাঁথি, দৌলতপুরের লোক, জানব না?

ভানু অন্ধকারের নদীর দিকে চেয়ে থাকল। অন্ধকার থেকে চোখ আরও দূর, বহুদূর, সাগরে চলে যেতে লাগল। সাগরে গিয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল দৃষ্টি। শিবরাম তার কানের কাছে ফিসফিস করছিল, আমি ওরে ভালোবাসি ভানুবাবু, কথাটা কতবার বলতে চেয়েছি, পারিনি, কারে বলি, আমি অন্ধকারে কথাটা তোমারে বললাম ভানুবাবু।

ভানু বলল, গৌরমোহনের বোনের কী হবে?

কিছুই হবে না ভানুবাবু, আমি কোকিলারে ভালোবেসে ফেলেছি, উপায় নাই, কোনো উপায় নাই আমার, তা বলে গৌরদাদার বোনরে আমি কষ্ট দেব না, তুমি এটা জানলে।

ভানু চূর্ণ হচ্ছিল, সে নিজেকে সামলে নেয় অন্ধকার আঁকড়ে ধরে, বলল, ঘরে চলো, আমারে কী করতে বলো?

কিছুই বলিনে।

আমি কি কোকিলারে গিয়ে বলব?

শিবরাম বলে, না।

না কেন, তার তো জানা উচিত।

শিবরাম বলে, না।

তবে আমারে বললে কেন?

তুমি যাতে জানো তাই।

আমি জানলে কী হবে, আমি কোকিলার কাছে যাব না? ভানু হিসহিস করে ওঠে।

শিবরাম নুয়ে পড়ে, যতবার পড়ি ও জায়গাটা, শুনবে ভানুবাবু…সেই গম্ভীরনাদী বারিধি তীরে, সৈকতভূমে অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকে দাঁড়াইয়া অপূর্ব রমণীমূর্তি! কেশভার অবেণী সম্বন্ধ, সংসর্পিত, রাশিকৃত আগুলফ লম্বিত কেশভার; তদগ্রে দেহরত্ন, যেন চিত্রপটের ওপর চিত্র দেখা যাইতেছে…। মনে পড়ে ভানুবাবু?

তুমি বললে যে পড়োনি? ভানু অন্ধকারের নদীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।

না পড়লে কোকিলারে টের পাই কী করে বুকের ভিতরে?

ভানু বলল, বাড়ি চলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *