1 of 2

অশ্বচরিত – ১

এক

ভানুচরণ মানুষটি বড় অদ্ভুত। আসতে আসতে কী মনে হলো ভেড়িবাঁধ থেকে নেমে ঝাউবনের দিকে চলে গেল, যেন ঝাউবনে তার কন্থক রয়েছে। ছিল পক্ষিরাজ, হয়ে গেল কন্থক। ছিল ভানুচরণ, ভানু দাস হয়ে গেল ছন্দক। ঘোড়া হারিয়ে সে আরও উদাস হয়ে গেছে। না হলে ঘোড়াটাকে খুঁজতে বেরিয়ে আপন মনে অন্য দিকে চলে যায়! বলে কিনা, ওই দিকে যাই, আপনি বাবু দেখে আসুন লায়কানখাস। সেই থেকে শ্রীপতি একা। একেবারে একা।

ভেড়িবাঁধের বাঁদিকে ঝাউবন। ঝাউবনের ওপারে সিংহসমুদ্র। হাজার সিংহ এক সঙ্গে গজরাচ্ছে। সিংহর কথা বলেছিল কে? ফরাসি সায়েব ফ্রেদরিক। লায়ন লায়ন! শ্রীপতিরও তাই মনে হয়। সিংহই বটে। তবে গর্জন যখন থাকে না, শুধু ঢেউ ভাঙে অন্ধকারে, পারের কাছে সফেন সমুদ্র বারবার মাথা কোটে, তখন মনে হয় সিংহ নয়, ও তার কেশর ফোলানো সাদা পক্ষিরাজ। পালাতে গিয়ে সাগরে গিয়ে পড়েছে। বারবার মাথা তুলছে নোনা জলের বিপুলতা থেকে। ঘোড়াটা কাঁদছে।

হ্যাঁ, এই স্বপ্ন দেখেছে শ্রীপতি কদিন আগে। ইদানীং কত রকম স্বপ্ন যে দেখে হারানো ঘোড়া নিয়ে! ভারতীকে নিয়ে। তার বউ মধুমিতা আর ভারতীকে নিয়ে। আবার ওই পক্ষিরাজকে নিয়ে। সব দুঃস্বপ্ন। দেখতে দেখতে গলা শুকিয়ে আসে। মনে হয় নোনাজলে ডুবে যাচ্ছে সে। নোনাজলের নীলে শুধু তার পক্ষিরাজের কেশর দেখা যাচ্ছে। সমুদ্র কাঁদছে সারারাত।

শ্রীপতি ঘাড় ঘুরোয়। রাতভর যে সমুদ্রের কান্না শোনা যায়, সেই সমুদ্র আর এই নীল জলধি এক নয়। মাটিতে আছড়ে মাটি যেন খেয়ে ফেলতে চাইছে বঙ্গোপসাগর। ভেড়িবাঁধের দক্ষিণ দিকে অনেক নিচুতে ধানী জমি, মাঠ। মাঠ আর মাঠ, তারপর এগিয়ে গাছ-গাছালির ছায়া। নুনমারাদের গ্রাম নুনের খালারিগুলোকে পিছনে ফেলে এসেছে শ্রীপতি। এখন বিকেল, রোদ পড়ে গেছে। আর একটা দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শ্ৰীপতি দেখছে তাকে ঘিরে ছায়া নামার আয়োজন।

ভানু কোথায় গেল কে জানে? ঘোড়া খুঁজেই বেড়াচ্ছে। খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। তবু যাচ্ছে। ঘোড়াটা যেন ভানুর। ভানুই ওই ঘোড়ার মালিক, এমনই তার উদ্বেগ। মনে পড়ে শ্রীপতির, লোকটা যেদিন কাজ নিল তার হোটেলে, মানে তার পোষ্য হলো, তার আশ্রিত হলো, ঘোড়া দেখে বলল, ঘোড়ার কাজ কত কাল ধরে করে, ঘোড়া চেনে সে নিজেকে চেনার মতো করে, শুনুন বাবু, আমি যদি হই ছন্দক, ও হলো কান্হা, কন্থক।

তারা কারা? শ্রীপতি অবাক হয়েছিল।

মনে নেই বাবু, কে রাজপুত্রকে পৌঁছে দিল তপোবন ধারে? রাজপুত্ৰ সাধু হয়ে গেল রাজপুত্র হলো ভগবান বুদ্ধ, তার ঘোড়া আর সারথি মাথা হেঁট করে ফিরল, সেই ঘোড়া হলো আপনার ঘোড়া।

হলে ক্ষতি কী শ্রীপতির? তবে কিনা পক্ষিরাজটি বোঝা যায়, কন্থক নাম শুনে সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। এ কেমন নাম? আর ভানু দাস সে কখন কী বলে, সংস্কৃত ভাষা বলে, ভুগোল বলে, ইতিহাস বলে, বলে কপিলাবস্তুর রাজপুত্রের কথা! তার কতটা সত্যি, কতটা মিথ্যে, কতটা বানানো তা কে ধরবে?

গায়ের ঘাম শুকোনোর মুখে। দক্ষিণের নোনা বাতাস হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ছে শ্রীপতির গায়ে। আজ জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা। জ্যৈষ্ঠ মাসটিও শেষ হতে গেল প্রায়। আকাশে মেঘ আসছে আর যাচ্ছে। রোদের তাত কমছে না। জ্যোৎস্নাও যেন গরম হয়ে উঠেছে, প্রকৃতি এমনই। এখন মেঘের ভিতরে চাঁদ এবং সমুদ্র একসঙ্গে জেগে উঠেছে উন্মাদের মতো। হাওয়ায় হাওয়ায় যেন টাল খাচ্ছে চাঁদও। ঠিক একটি মাস ভানুচরণের কন্তুক—শ্রীপতির ঘোড়া পক্ষিরাজ নিরুদ্দেশ। এ বড় আশ্চর্য ঘটনা। তার হোটেল থেকে বোশেখী পূর্ণিমার রাতেই পালিয়ে গেছে ঘোড়াটা। সেই ঘোড়া খুঁজতে সে দুপুর দুপুর বেরিয়েছিল লায়কানখাসের দিকে। সেখানে নাকি একটা ঘোড়াকে চরতে দেখা গেছে গত পরশু। দেখেছিল অনন্ত সার। সে ওই লায়কানখাসে নুনের খালারি করেছে। সেখানে তার বউ মেয়ে সারাদিন খাটে। অনন্ত লবণ নিয়ে আসে দীঘায়। এখানে পাইকার থাকে, কিনে নেয়। দরকারে সেও কাগজ পেতে বসে পড়ে। মোটা দানা লালচে নুন বেড়াতে আসা ট্যুরিস্টদের জন্য নয়। আশপাশের গাঁয়ের গরিব লোক এসে কিনে নিয়ে যায়।

অনন্ত সার দেখেছিল লায়কানখাসে একটি ঘোড়া চরছে। দেখেইছিল শুধু, এর বেশি কিছু নয়। ঘোড়ায় তার কোনো কৌতূহল নেই। ঘোড়া থাকে তাদের যারা ঘোড়ায় চাপতে পারে। বড় মানুষের বাহন ওটি। কিন্তু তাকে তখন জিজ্ঞেস করছিল ঘোড়ার রক্ষক ভানু, সে অবাক। ঘোড়া তো দেখেছে লায়কানখাসে।

দেখেছ, সত্যি দেখেছ, বাবুর অশ্ব, আমার কান্হা? ভানু প্রায় উদ্বাহু হয়ে ছুটে এসেছিল শ্রীপতির কাছে, পাওয়া গেল, ঘোড়া আছে।

গেল পাওয়া? শ্রীপতি তখন হোটেলের ঠাকুরের কাছে খোঁজ নিচ্ছিল তার বউ মধুমিতা এসে কোনো খোঁজ নিয়ে গেছে কি না ঠাকুরের কাছে। নার্স ভারতী চৌধুরী নিয়ে কতটা, কীরকম খোঁজখবর করেছে, আর কী জবাব দিয়েছে ঠাকুর। ভানুর কথা শুনে সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিল তাকে, উত্তেজনায় দপদপ করছে ভানুর সর্ব অঙ্গ।

আঁজ্ঞে লায়কানখাসে নাকি একটা ঘোড়া…। ভানু কথা শেষ করেনি।

কোন ঘোড়া, আমার পক্ষিরাজ?

আঁজ্ঞে ঘোড়া একটা, কন্থক হতে পারে, নাও হতে পারে।

ফের কন্থক, ওটি আমার পক্ষিরাজ।

আপনার নাম আপনার থাকুক, আসলে তো অন্য ব্যাপার, শুনুন বাবু, খবরটা দিল নুনমারা অনন্ত, একটা ঘোড়া চরতে দেখেছে সে লায়কানখাসে।

ডাক অনন্তকে।

আঁজ্ঞে, সে আর কোথায়, বলে চলে গেছে, ঘোড়াটা নিয়ে আসুন আপনি।

তুমি যাবে না ছন্দকমশায়?

আমি! আমি তো অন্য দিকে যাব, সব দিকে তো খোঁজ করতে হবে।

যদি লায়কানখাসে মেলে তো অন্য দিকে যাবে কেন?

তা ঠিক। ভানু মাথা চুলকেছে, যদি না হয় বাবু, সে তো কতদিন রয়েছে আমার সঙ্গে, পালিয়ে এত কাছে কি থাকবে?

তাহলে আমি যাব না?

তা কেন, খবর যখন মিলেছে, যেতে আপনাকে হবেই।

খবর দিয়ে ভানু চলে গিয়েছিল। ঠাকুর আটকেছিল শ্রীপতিকে, বিশ্রাম নিয়ে যান বাবু, ঘোড়া যদি থাকে, ঠিক পাবেন, ভালো ঘাস পেলে ওরা নড়ে না, কিন্তু লায়কানখাসে কি ভালো ঘাস হয়, ও তো বালি জমি, ওখানে ঘোড়া যাবে কেন?

তাহলে যাব না? শ্রীপতি দ্বিধায় পড়েছিল।

না আঁজ্ঞে, যেতে তো হবেই। খবর যখন এয়েচে, ঘোড়া বলে কথা, ঘোড়া হারালে মানুষের যে কী হয়, তা যার হয় সে জানে।

একটু বাদে বেরিয়েছিল শ্রীপতি। বেরিয়ে পুরনো কাফেটোরিয়ার কাছে ভানুর সঙ্গে দেখা। ছুটে এসেছিল সে, বাবু আমি কি যাব, যাই কিছুটা, আপনাকে এগিয়ে দিই, হ্যাঁ, অনন্ত সার বলল একখান অশ্ব দেখেছিল লায়কানখাসের বালির ওধারে যে চরজমি ঘাসের, সেখানে, ঘাস খাচ্ছে, আমার অবশ্য কেমন লাগল শুনে।

কী রং সে ঘোড়ার?

ভানু থমকায়, তারপর বলেছে, আঁজ্ঞে ওই কথাই তো আমি জিজ্ঞেস করলাম অনন্ত সারকে, ঠিক আপনি যেমন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এক্কেবারে এক কথা।

তা বলল কী সে?

কী বলল? ভানু মাথা চুলকোচ্ছিল, সাদা না কালো, কালো না বাদামি! কোনটা? আঁজ্ঞে বাবু, সে তো ঘোড়া দেখেছে রং দ্যাখেনি—সে আমাদের কন্থক কি হবে?

রং দেখেনি অনন্ত সার। তখন তার লবণ ঝেঁটিয়ে তোলার সময়। সারাদিন যে জল শুকিয়েছিল রোদ্দুরের তাপে, তা থেকে যে মোটা মোটা স্ফটিক দানা বেরিয়ে আসে, তা ঝেঁটিয়ে বস্তায় ভরছিল সে। বিকেল হয়ে গিয়েছিল। সূর্য ওই সময় কোনাকুনি পশ্চিমে তালসারির দিকে, ওড়িশার উপকূলে নেমে যায়। দূরে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে যে ঝাউবন চলে গেছে পশ্চিমে তার ভেতর টুপ করে পড়ে গেছে রক্তবলয়। ছায়ায় ছায়ায় অনন্ত, তার বউ আর মেয়ে দেখল একটি ঘোড়া যেন ঘাসের চরে দাঁড়িয়ে দুলছে। বেলা পড়ে এলে অতবড় মরুভূমির মতো বালুচর কেমন ঝাপসা ঝাপসা হয়ে আসে। চোখে ধন্ধ লাগায়। আর তাই-ই বোধহয় লেগেছিল। তারপর তারা লায়কানখাস ছেড়ে অলঙ্কারপুরের দিকে যখন এগোচ্ছে, তখনও আর একবার দেখা গেল ঘোড়াটাকে, অনন্তর কচি মেয়েটা আপনমনে বলে উঠেছিল, হা, দিখ অশ্ব।

হ্যাঁ, তারা সকলে দেখেছে ঘাসের জমি ছেড়ে ঘোড়াটা বালির ওপর এসে দাঁড়িয়েছিল। হাঁ করে চেয়েছিল সমুদ্রের দিকে। এতটা পর্যন্ত ঠিক বলে গেল অনন্ত একটু আগে লায়কানখাসে দাঁড়িয়ে। তারপর সব শূন্য। সব দেখেছে তবু রং দেখেনি। দেখার হলে বলত ঠিক। রংটাই বাদ গেছে বোধহয়। যদি জানত এতে শ্রীপতিবাবুর উপকার হবে তাহলে রংটা মনে রাখত ঠিক। একেবারে সামনে গিয়ে পরখ করে রাখত রংখানি। কী ভুলই যে করেছে। শ্রীপতিবাবু যে ইনামও ঘোষণা করে রেখেছে তাও কি জানত তারা? আজই অনন্ত সারকে বলেছে ভানু।

আশ্চর্য ব্যাপার! জগতে কত বিস্ময়ই না আছে! দুপুরে কিছু সময়ের জন্য কী রোদ্দুর না ছিল! এই সব মেঘ তখন সমুদ্রে গা ডুবিয়ে ছিল বোধহয়। রোদে লায়কানখাস—বালির চর একেবারে মরুভূমি। মরুভূমির ওপারে যে ঝাউজঙ্গল, তার গায়েই ঘাসের জমি। কিন্তু সেই অঞ্চলে নুনমারারা ছাড়া আর কেউ ছিল না। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, শ্রীপতি গিয়ে লায়কানখাসে দাঁড়াতেই সমুদ্রে ডোবা মেঘ আবার আকাশে। ছায়া ঘনাইল বনে বনে।

শ্রীপতি বলল, কী রোদ!

নুনমারা অনন্ত সার বলল, রোদ কোথায় বাবু, সকাল থেকে মেঘলা, নুন শুকোচ্ছে না।

আর সব খালারির লোক কোথায়?

এই মেঘে কাজ হয় বাবু! সব এখন অন্য কাজে লেগে গেছে। এই দেখুন না, একটুও জল শুকোয়নি। বলতে বলতে পলিথিনের সিট, কলসি, বস্তা, কোদাল গুছিয়ে নিচ্ছিল অনন্ত সার, বিড়বিড় করছিল, বছরের মতো নুনের কাজ শেষ।

ঘোড়ার খোঁজ পেল না শ্রীপতি। অনন্ত সারের মেয়েটা বলল সেও দেখেছে। এই তো পরশু দিন। সেদিন খুব চড়া রোদ্দুর হয়েছিল, নুনও বেরিয়েছিল অনেকটা। হ্যাঁ অশ্বই বটে! কিন্তু রং! তা তো দেখেনি।

শ্রীপতি বলল, ঘোড়াটা দেখলি আর রং দেখিসনি! এ কীরকম হলো! তাহলে কী দেখলি?

তার কথা শুনে হাঁ করে চেয়ে থাকে মেয়েটা। বয়স কত হবে! বছর পনেরো। সারাদিন রোদ্দুরে নুন মেরেও চোখমুখে ক্লান্তির ছাপ নেই। কেমন ফুটফুটে ভাব। মুখে সর্বক্ষণ হাসি। বরং অনন্ত আর তার বউটা যেন নুয়ে পড়েছে। তাদের চোখমুখে রাজ্যের ক্লান্তি আর বিরক্তি। তারা বারবার আকাশের মেঘ দেখছিল।

অনন্তর মেয়ে বলল, কেনে অশ্বই তো দিখলাম।

রং ছাড়া কি বস্তু হয়! রং না থাকলে দেখবি কী?

আসলে শ্রীপতি বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। ওরা দেখেছে সন্ধেয়। তাও অন্যমনস্ক ছিল। খেয়াল করেনি কী রঙের। এখন এদের কাছ থেকে আর কিছু জানা যাবে না।

অনন্ত সারের মেয়েটা অল্প বয়সী। গায়ের রংও ফরসা। চোখমুখে শ্রী আছে। আর সময়টা তো জোয়ারের। ভরা কোটাল। ফুলে ফেঁপে উঠেছে মেয়েটা। একেই বলে যৌবনের দীপ্তি। সেই দীপ্তি নিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠেছে মেয়েটা। দাঁতে আঁচলের খুট চেপে ধরে বলে, কী জানি বাবা ত্যাখন মনে হয়নি তাই রং দেখিনি, কী ধলা কী কালা!

এখন নুনমারাদের দিন শেষ। গত ছটা মাস শুকিয়ে শুকিয়ে জলবিন্দু লালচে শাদা স্ফটিকের দানা হয়ে গেছে। এই ছটা মাসে ঐ লবণের গলে জল হয়ে যাওয়ার সময়। অনন্ত সার বিরক্ত। আসলে দিনের পরিশ্রমটা মাঠে মারা গেছে। তাই এখন কিছু ভালো লাগে না।

শ্রীপতি আশা নিয়ে গিয়েছিল বোধহয় খোঁজ পাবে অশ্বের। কিন্তু পরশু বিকেলের পর তাকে আর কেউ দেখেনি। ফেরার সময় এখন তাই মেজাজটা ভালো নেই। অনন্ত সারের ফুটফুটে মেয়ে কুন্তির হাসি বেজে উঠছে চারপাশে। মন খারাপের ভিতর মেয়েটার কথাই ভালো। সমুদ্রের লোনা হাওয়া, তার ভিতরে সেই কথা, অশ্বর বন্ন দেখার কী আছে, অশ্ব অশ্বই, হাঁ বন্ন ছিলনি।

বর্ণ ছিল না মানে, বর্ণ ছাড়া কিছু বোঝা যায়?

শ্রীপতির কথায় মেয়েটা থমকেছে, তারপর জবাব দিয়েছে, কেনে ই বাতাস। ইর বন্ন কী, অথচ বুঝছোনি বাতাস আছে।

তাহলে ঘোড়াটা কি তখন বাতাসের দেহ নিয়ে ঘুরছিল লায়কানি চরে? বাতাসের দেহ পেলে জীবের জোর বাড়ে। হুড়মুড়িয়ে তছনছ করে দিতে পারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। সেই বাতাসের দেহ নিয়ে বর্ণহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তার পক্ষিরাজ। ভাবতেই শ্রীপতির মুখে যেন আবছা-হাসি ফোটে।

অনেকটা চলে এসেছে। বামে ঠিক নিচেই বড় খালটার একটা মুখ। সেখানে অকেজো লঞ্চ বাঁধা রয়েছে। মস্ত উঁচু ভেড়িবাঁধে হাঁটতে হাঁটতে শ্রীপতি দেখল সাঁই সাঁই করে বেলা মরে গিয়ে অন্ধকার নামছে। তার আবার মনে হলো, বর্ণহীন ঘোড়া…।

বর্ণহীন ঘোড়া কেমন দেখতে? কী তার রং! গায়ের রং, মাথার রং, কপালের রং, পুচ্ছের রং! লেজটা কি সাদায় বাদামিতে মেশানো? পুরো দেহটা কি সাদা ধবধবে দুধের রঙে ভরা? নাকি পেটের দুপাশের পাঁজরের হাড় বেরিয়ে যাওয়ার কারণে সাদা রংটা কালচে মেরে গেছে। পোড়া পোড়া লোমে যেন পুরো দেহটা আচ্ছাদিত। কপালের ওপর সাদা আর বাদামিতে মেশানো রং। তিনটে টিপ। চোখটা নীল আর কালোয় ভাসা। মানে ঠিক সমুদ্দুর থেকে তুলে আনা খাবলা রং। জিভটার রং ফ্যাকাশে রক্তহীন লাল। ঘোড়াটা সন্ধেবেলায় যখন বেলাভূমি থেকে উঠে আসে, তখন শক্ত বাঁধানো পাড়ে, পিচ আঁটা রাস্তায় গম্ভীর শব্দ ওঠে ঠকঠক- ঠকঠক। ডুপ ডুপ ডুপ ডুপ…।

বিকেলে বেলাভূমিতে যখন ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে থাকে, তখন ওর সাদা গায়ে পশ্চিম দেশের রোদ পড়লে সেই সাদা রঙের একটু পরিবর্তন হয় নিশ্চয়ই। ঘোড়ার পিঠে যে ঝালর, তার রং লাল। লাল সাটিনের কিনারায় কিনারায় থাকবে জরির কাজ। ঘোড়ার পিঠে যে উঠে বসবে সে নিশ্চয়ই খুব ফুটফুটে একটা বাচ্চা। নীল সমুদ্র, সাজানো পক্ষিরাজ! কেমন দেখায়? সমুদ্র হলো পক্ষিরাজের চালচিত্র।

পরশু সমুদ্রের বদলে ছিল লায়কানখাস। মানে ধু ধু বালির তরঙ্গে ঢাকা পৃথিবীর মাটি। আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় বালির দিকে তাকালে। আর রাতেও সেই বালি সাদা দেখায়। দূরে সমুদ্রের গর্জন থাকে, চেহারা দেখা যায় না। ঝাউ আর ইউক্যালিপটাস জঙ্গলের আড়ালে কেশর ফুলিয়ে গর্জন করছে লায়কান দেবীর শিকল ছাড়া সিংহের দল। ঘোড়া শুধু ঢেউ ভাঙার শব্দ শুনছে। সমুদ্রের বদলে আবছা সাদা মরুভূমির ভিতর দাঁড়িয়ে।

অনন্ত সারের মেয়েটা বলেছে ঘোড়ার রং ছিল না। তাহলে! সমুদ্র বেলাভূমি, অন্ধকার ঝাউবন, ঘুমে ভরা পৃথিবী-এর কত রং! তার ভিতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পক্ষিরাজ। রঙে আরও প্রলেপ পড়ল। বর্ণহীন অশ্বের এত বর্ণ! শ্ৰীপতি সেই ভেড়িবাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে হো হো করে হেসে ওঠে।

টুপ করে অন্ধকার নামে। দেখা যাচ্ছে দীঘার আলো। কাছেই অত মানুষের মেলা। অথচ এখানে! পৃথিবীই নেই এমন মনে হয়। সাদা ঘোড়াটার রং সমুদ্র থেকে লায়কানখাসে গিয়ে আস্তে আস্তে উবে গেছে ঠিক। বাতাসে সাদা বাদামি সব রং উবে গিয়ে যেমন হয়েছে ঠিক তেমন দেখেছে কুন্তি। শ্রীপতির বুকটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। ভয় ভয় করে। হাওয়া শুধু হাওয়া। শ্রীপতি বিড়বিড় করতে থাকে, না, না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *