1 of 2

অশ্বচরিত – ৬

ছয়

ফ্রেদরিক মাস তিনেক আগে এসে আরও পাঁচজন হরি প্রেমিককে নিয়ে সমুদ্রপাখি হোটেলে উঠেছিল। সঙ্গে দুই যুবতী মেমও ছিল। তারপর দিন পনেরো বাদে তারা চলে গেছে ভারত তীর্থে। বেনারস কেদারবদ্রী গঙ্গোত্রী যমুনোত্রী সব দেখবে। শেষে পুরী হয়ে ফিরে আসবে এখানে। ফ্রেদরিক যায়নি। মাস খানেক শ্রীপতির হোটেলে ছিল, শেষে পয়সাকড়িতে টান পড়ায় জেলেপাড়ায় গিয়ে উঠেছে। ওখানে থাকে। কখনো গেরুয়া, কখনো সাদা, কখনো বা এক্কেবারে প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায় এদিক সেদিক। আর ইচ্ছে হলে কৃষ্ণ নাম করে। আর একটা গুণ আছে সায়েবের। কথায় কথায় বাজি ধরে। সায়েব যে পক্ষে বাজি ধরে, সেই পক্ষেই তার বাজি মিলে যায়। এই হোটেলে যখন ছিল সায়েবের সঙ্গে বাজি ধরে কতবার যে হেরেছে শ্রীপতি

দূর ফরাসি দেশের এক গ্রাম থেকে যে যুবকটি কৃষ্ণ নাম করতে এ দেশে এসেছ, তাকে দেখে শ্রীপতির এখন বিস্ময় লাগে না। এটা ফ্রেদরিকের দ্বিতীয়বার দীঘায় আসা। আর কোথায় কোথায় ঘুরেছে তা সে জানে না। জানে ফ্রেদরিকের কাছে কাঁচা টাকা আছে, তার লোভে ওর পিছনে পিছনে এখানের অনেকে ঘোরে!

শ্রীপতি নেশায় চুরচুর হয়ে জিজ্ঞেস করে, হ্যালো ফ্রেদরিক, হাউ ডু ইউ ডু?

গুড গুড, টুমিহ কিমন আছে?

বাংলাটা অল্প অল্প শিখেছে সাহেব, জেলেপট্টিতে ওই আধো আধো বাংলা দিয়ে কাজ চালায়। শ্রীপতি বোঝে ফ্রেদরিক এখন শুকনো নেশায় আছে।

সিপটি, দিজ সি, লর্ড কৃষ্ণা কালার, ভাস্টনেস ইজ লর্ড কৃষ্ণা। হরে কৃষ্ণা হরে কৃষ্ণা সিপটি টুমি কী সার্চ করিছে?

মাই হর্স, দ্যাট হোয়াইট হর্স লস্ট।

সায়েব হো হো করে হেসে ওঠে, ওহ আই হ্যাভ সিন দ্যাট।

শ্রীপতি ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথায়?

ইন দিজ ওয়ালর্ড, এ-ই পিঠিবীটে। সায়েব বুঁদ হয়ে বলে, ইন ইয়োর হোটেল।

শ্রীপতি বিড়বিড় করে, সায়েব, দ্যাট হর্স হ্যাজ বিন টোকন বাই এ কুহকিনী, সায়েব, কুহকিনী বোঝো, এ লেডি।

সায়েব খুব কষ্ট করে উচ্চারণ করে, কু-কু-হা–

কুহা না, কুহ কুহকিনী। ভানু বলে ওঠে।

কুহাকিনে, মিনস্?

ভানু বলল, মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষ বোঝে তো সায়েব?

শ্রীপতি বিরক্ত হলো, চুপ করবি, যা তো এখন।

ভানুও আর বসতে চাইছিল না মনে মনে। মাথার ভিতরে অনন্ত সমুদ্র ঢুকে যাচ্ছে যেন। কতদূর সমুদ্র? কত সময় ধরে ঢেউ ভাঙছে। ভাঙছে তো ভাঙছে। সে উঠে পড়ল। এখন ঝাউবনের ছায়ায় বসে সমুদ্র দেখবে। সমুদ্র তীরে বসে কন্থকের কথা ভাববে। কবে যে কে তাকে বলেছিল রাজপুত্র গৌতমের ঘোড়া আর সারথি ছন্দকের কথা, ভুলে গেছে, কিন্তু কথাটি গেঁথে আছে মনে। কন্থকের পালক সে ছন্দক। আহা সমুদ্র তীরে বসে সে কোকিলা বধূর মুখখানি মনে করার চেষ্টা করবে। কোকিলা বধূর মুখখানি দেখে ফুলরানির কথা মনে পড়ছে তার। ফুলরানির মুখখানি কেমন? সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে তাও যেন ফিরে আসবে মনে!

ভানু চলে যেতে সায়েবও নিশ্চিন্ত হলো, বলল, হোয়াট ডু য়্যু মিন বাই দ্যাট কুহাকইনে কুহাক-ক-ইন্-এ?

শ্রীপতি বলে, কুহকিনী, এ লেডি সায়েব, ম্যাজিসিয়ান লেডি, ম্যাজিক করে, নিশির ডাক বোঝো সায়েব?

সায়েব আন্দাজ করেছে, বলল, লেডি ম্যাজিসিয়ান, কুহাকই-ন্-নে।

জাদু করে নিয়ে গেছে সায়েব, ম্যাজিক করেছে।

ব্ল্যাক ম্যাজিক।

ইয়েস সায়েব।

কুহাক-ক-ইন্‌-নে ইজ আ উইচ? ওলড লেডি, আগলি অ্যান্ড ওল্ড?

নো সায়েব ইয়াং অ্যান্ড বিউটিফুল।

উইচ, ইয়াং লেডি উইচ?

উইচ কি না বলি কী করে সায়েব, তবে ইয়াং অ্যান্ড বিউটিফুল লেডি, ভানু টোলড দ্যাট, ভানু স্পোক উইথ দ্য জাদুকরী, কুহকিনী।

সায়েব বলল, দ্যাটস হোয়াই, আই লাভ দিস কানট্রি, ব্ল্যাক ম্যাজিকের দেশ হচ্ছে ইন্ডিয়া, আই ওয়ান্ট টু সি কুহাক কিন-এ, দ্যাট লেডি উইথ আ ম্যাজিক ওয়ান্ড, ওহ্ নাইস, উইচ-এর সাথে হামি ডেটিং করেগা?

শ্রীপতি বলে, করো সায়েব, তবে বেশির ভাগ মেয়েমানুষ কুহকিনীই হয়, কী বলো?

ইয়েস, দ্যাটস রাইট।

দ্যাট লেডি কলড মাই হর্স অ্যাট দ্যাট ফুল মুন নাইট, রাত্তিরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে ফেলেছে সায়েব, হি হ্যাজ বিন পজেসড বাই কুহকিনী, সাহেব তুমি কপালকুণ্ডলা জানো?

সায়েব বলল, জানিব সিপটি।

সায়েব তোমার মেয়েমানুষ ভালো লাগে, ডু য়্যু লাইক ওম্যান?

সায়েব বিড়বিড় করছে, হরে কৃষ্ণা, হরে কৃষ্ণা!

তারপরেই সায়েব হঠাৎ বলে, টুমার সহিট ডরকার আছে, টুমি সি-সাইড যাব?

কেন এখেনে হবে না?

হবে, হিয়ার সিপটি, হামাকে অ্যাডভাইস ডিবে টুমি।

মানে পরামর্শ। কীসের পরামর্শ? আবার পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করবে নাকি? তার হোটেলে যখন সাহেব থাকত তখন রাস্তায় একবার থানার বড়বাবু ওকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করেছিল, বাড়ি কোন দেশে, কী করা হয়, কতদিন থাকবে, কেন থাকবে। হাই কমিশন জানে কি না, ফরেনার বলে কথা। সব প্রশ্নেই ফ্রেদরিক ফুহ ফুহ করে নির্লিপ্ত থেকেছে। শেষে বলেছে ইন্ডিয়া ওর দেশ। লর্ড কৃষ্ণার দেশ।

হেই সিপটি, আই ফেল ইন লভ। পরেম।

শ্রীপতি চমকে উঠে, বলে কী! দেশে তো ওর অবিবাহিত জার্মান ওয়াইফ আছে। তিনটে বাচ্চা নিয়ে কানট্রিসাইডে টিচারি করে।

ডু য়্যু নো দ্যাট ফিশার ম্যান বেঙা, আই লিভ ইন বেঙাজ কটেজ।

শ্রীপতি ঘাড় হেলায়, জানে।

সায়েব একটু চুপ করে বলে, ডু য়্যু নো বেঙাজ ওয়াইফ?

খেয়াল করেনি শ্রীপতি কে, বেঙা জেলের বউ।

সায়েব বিড়বিড় করে বলে, সি ইজ মাই লাভার, প্রেম ই-কা! বলে নিজের মনে হাসতে থাকে, বেঙা রাট্টিরে ফিশিং-এ যাবে, ওনেক ডুর, ইন দ্য ডিপ সি, হিজ ওয়াইফ কামস টু মাই রুম!

বেঙা সমুদ্রে যায় মাছ ধরতে। সে সরকারের লঞ্চে কাজ করে। রাতে ঐ সময় তার বউ সায়েবের ঘরে ঢোকে। সায়েব বেঙার হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছে, পেয়িং গেস্ট হয়ে আছে তো! অনেক টাকা!

শ্রীপতি বলে, কুহকিনীর ফাঁদে পড়লে সায়েব, এবার বুঝছ কুহকিনী কারে বলে?

ফ্রেদরিক হাসে, কুহাকিন্-এ বাট সি ইজ বিউটিফুল সিপটি, নাইস ওম্যান, আই লাভ হার, ইফ য়্যু সি হার, য়্যু ক্যান ফিল হার বিউটি।

শ্রীপতি বলল, য়্যু আর ইন ট্র্যাপ সায়েব। য়্যু হ্যাভ বিন ট্র্যাপড।

ট্র্যাপড! নো সিপটি, য়্যু সি হার, সি ইজ মাই রাঢিকা, আই ওয়ান্ট আ ফুট, সি টোলড মি টু ব্রিং আ বনশি।

হা হা করে হাসে শ্রীপতি, বংশী, বংশী কোথায় পাবে? আমি মীরগোদা যাব, টু সি দ্যাট কুহকিনী, জাদুকরী। চলো সায়েব সি-সাইড যাই, আই অ্যাম ইন ডিপ সরো সায়েব, কষ্টে আছি সায়েব।

সায়েব আর শ্রীপতি বেরোয়। ঈষৎ স্খলিত চরণ। আকাশে পাতলা মেঘ। বেশ ছায়া হয়েছে চারদিকে। শ্রীপতির মনে হচ্ছে তাকে মীরগোদা গিয়ে খোঁজ নিতে হবে ঘটনাটা সত্যি কি না। নাকি ভানু শুকনো নেশা করে সমস্ত রাত জাহাজঘাটায় শুয়ে স্বপ্ন দেখেছে।

দুজনে ছায়ার পৃথিবী ধরে সমুদ্রতীরে নেমে এলো ঝাউবনের ভিতর দিয়ে। এখন ভাটার সময়। জল বহুদূরে সরে গেছে। জলের ওপর মেঘের ছায়ায় জল হয়ে উঠেছে ধূসর। ফ্রেদরিক জলের দিকে চেয়ে হাতজোড় করে কৃষ্ণ নাম জপছে, হরে কিরিষনা, হরে কিরিষনা, হেই সিপিটি প্রে হিয়ার, য়্যু উইল গেট ইয়োর হর্স ব্যাক, হরে কিরিষনা হরে কিরিষনা।

শ্রীপতি হাসে, সামোয়ান থেপট মাই হর্স, দ্যাট কুহকিনী জাদুকরী, সাহেব, বেঙার বউ তোমাকে কুহক করেছে না তুমি তারে করেছ?

সায়েব শ্রীপতির কথার শেষ দিকটার মর্মার্থ ধরতে পারে না। সে তাকিয়ে ছিল পুবের দিকে। ওই দিকে জেলে বস্তি, আবার ওই দিক থেকেই আসছে যে মানুষটি তাকে ভালো চেনে সায়েব। ওই যে বেঙা, বেঙা আসছে। সমুদ্র থেকে ফিরেছে বেঙা। তাহলে এদিকে কেন, ঘরে যাবে তো? সায়েব বিড়বিড় করে ওঠে, বেঙা ইজ কামিং, বেঙা দ্য ফিশারম্যান, হেই সিপটি, মাই লাভারস হাজব্যান্ড ইজ কামিং, ইয়ান ঘোষ! দ্য হাজব্যান্ড অব রাঢিকা, হেই বেঙা, হেই ফিশারম্যান।

শ্রীপতি দেখল চার ফুট দশ ইঞ্চির বেঙা প্রায় দৌড়তে আরম্ভ করেছে সায়েবকে দেখে। কী হলো? সে কি জানতে পেরে গেছে সায়েবের কীর্তি? রোগা ডিগডিগে বেঙা জেলের শরীরের তুলনায় মাথাটি বড়। মাথা নাচছে, মাথার চুল নাচছে। বেঙার গায়ের রং আর সমুদ্রের রং এখন এক। তাই কখনো কোনো মুহূর্তে বেঙা তার ধূসর গাত্রবর্ণ নিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। শ্রীপতির তেমনই মনে হচ্ছে। তখন বেঙা আর তার চোখের সামনে দৃশ্য থাকছে না। এই রকম বার দুয়েক হলো। মাথা ঝাঁকিয়ে নিল শ্রীপতি। বেঙা আবার সমুদ্র থেকে আলাদা হয়ে গেল।

বেঙা হাজির। হাঁপাচ্ছে। হাড় সর্বস্ব জীর্ণ দেহ শ্বাস-প্রশ্বাসে কাঁপছে। বুক উঠছে নামছে। কোমরে কপনি ব্যতীত বেঙার শরীরে আর কোনো সুতো নেই। কিন্তু সমুদ্রের জল শুকিয়ে নুনের আস্তরণ। ঘোলাটে দুই চোখ গহ্বরে।

বেঙা বলল, সায়েব কুথায় গিসলি তুই, হিলশা এনেচি দুইখান, বরফকল খারাপ হই গেছে, মাছ আজ সস্তা হবে মাইতিবাবু, আড়তে বিশ টাকা হই গেছে, বেলায় আরও কমবে, তারপরে বালির নিচয় মাছ পুঁতে ফেলতি হবে, পচ ধরবে।

মাছ উঠল কেমন?

বহুত! বেঙা দুই হাত দুদিকে প্রসারিত করে মাছের পরিমাণ দেখাতে দেখাতে তার হলুদ দাঁত বের করে ফেলে, কিন্তু গেল সব, রং খসতে আরম্ভ করেচে, এরপর পচতে আরম্ভ করবে, এই সায়েব ঘরে চলো।

কবে বেরিয়েছিলি? শ্রীপতি জিজ্ঞেস করে।

পরশু, বহু ভিতরে চলে গিসলাম। হি হি করে হাসে বেঙা, সায়েব সেই কালাপানির কাছে পেরায়, কাম সাহেব, কাম টু হিলশা, তোর খোঁজ করতি বলল পরী, সষসে তেল লাগবে, অয়েল, সষসে অয়েল। বেঙা মাছ ভাজার মুদ্রা ফোটায় ডান হাতে, হ্যা হ্যা করে হাসে, হিলশা মাছ ভাজা হবে কীসে সায়েব?

সায়েব বুঝল। পকেট থেকে গোটা কয়েক দশ টাকার নোট বের করে বেঙার হাতে দিল। তারপর শ্রীপতির দিকে হাত তুলে হাসল, বাই সিপটি, হামি যাচ্ছে।

যাও ঘরে যাও, চ্যান করে লাও, তার হয়েচে মহাজ্বালা, ভবঘুরে সায়েব এসে তার ঘাড়ে চেপে বসেছে, কুথায় কখন যায় ঠিক নাই। বলতে বলতে বেঙা বিচ ধরে উলটো দিকে হাঁটে। সঙ্গে শ্রীপতি মাইতি।

বেঙা বলল, ঘুড়া পাওয়া গেল বাবু।

নাহ্, খোঁজ করা হচ্ছে।

আমার এখন ইলিশের মরসুম, নাহলি আমিও খুঁজতাম।

শ্রীপতি জিজ্ঞেস করল, তোর বউয়ের নাম পরী?

হ্যাঁ। বেঙা দাঁত বের করে হাসে, সায়েবটা পরীর রান্না খুব পছন্দ করে, সায়েবটা এটটু আলাভুলা, হেলদেল নাই, সায়েব তো বটে, সব্বক্ষণ হরে কিষনো হরে কিষনো করতেছে, তাই দেখে পরীও বলে ও হলো কেষ্ট ঠাকুর, ভগোয়ান ওরে পাঠাইচে, কত দেনা বলেন, মহাজনের সেই সুতলি জালের ট্যাকা এখনও শোধ করতি পারলামনি, জালটা থাকলি এত অভাব থাকতনি।

জানে শ্রীপতি। তখন বেঙা তার হোটেলে ট্যুরিস্ট ধরে আনত। আসলে তো ও খালে-বিলে খেপলা জাল ফেলা জেলে। ওর বাপকে চিনত শ্রীপতি, সে ছিল ঢেঙা। ঢেঙার ছেলে এইটুকুন কী করে হয় তাও বড় বিস্ময়ের। ঢেঙার বউ আবার ছিল এইটুকুন। মায়ের মতো হয়েছে বেঙা। ওর মা বুড়ি, চুনো মাছ বেচতে আসত দীঘায়। তখন ঢেঙা জেলে ফাইলেরিয়ায় কাবু। সেই সময়েই বেঙা খেপলা জাল ফেলে রেখে আর পাঁচজনের সঙ্গে মস্ত এক সারণি জাল নিয়ে প্রথম নামল সমুদ্রে। বিশ হাজার টাকার জাল। এক মাসের ভিতরে সেই জালে এক হাঙর চেপে বসে কুটি কুটি করে দিল দাঁতে।

বাজার পার হয়ে যাচ্ছে দেখে শ্রীপতি বলল, তেল কিনবি না?

বেঙা হাসে, বোতল কই?

তবে! শ্ৰীপতি অবাক, বোতল চেয়ে নিয়ে যা দোকান থেকে।

বেঙা বলে, থাক, ইলিশ ভাজা হয়ে গেল এতক্ষণে।

তার মানে?

ওই না বললি সায়েব টঙ্কা খসাবে? বাবু, এখন আমি তুমার হোটেলে মিল খেয়ে বারান্দায় ঘুমাব।

হোটেলে মিল খাবি, পয়সা?

ন্যাও যদি নেবা, আর না ন্যাও যদি না নেবা, একটু শুকনোও খাব, গা ম্যাজ ম্যাজ করতেছে, শালা সায়েব ঘরে শুধু কেত্তন করে, এখন গে দ্যাখো, হরে কিষনো লাগায়ছে ঠিক, পরীর গালাগালিতে ও ঠাণ্ডা। দিনটা খারাপ, এত মাছ ধরা হলো, সব বেকার বরফকলে বরফ জমতেছে না।

আজ বেরোবিনে জলে?

নাহ্, সব দিন গাঙে থাকতি ভালো লাগে! মজরির টাকা পরী নেছে, আমারে সায়েব চল্লিশ রুপিয়া দিল, চিন্তা নাই, মিল খাব, ঘুমাব, শুকনো খাব, ভিডিও দ্যাখপো, সায়েব মরুগগে, হারামির বাচ্চা।

শ্রীপতি ঘুরে তাকায়, তুই তো শালা নেমকহারাম, টঙ্কা নিলি, আবার খিস্তি করছিস সায়েবকে।

বেঙা বলল, টঙ্কাও নেব, খিস্তিও করব, তবে সায়েব ঠাণ্ডা, নাহলি মাল অন্য দিকে ফুটে যাবে, আচ্ছা মাইতিবাবু, ও কি পলায়ে এয়েচে?

পলায়ে আসবে কেন?

দেশ ছেড়ে এখেনে কেনে এলো সায়েব?

এমনি, ইচ্ছে হয়েচে তাই। শ্রীপতি বলে।

ইচ্ছে হলো কেনে?

তা তো জানিনে, তবে ও খুব রইস আদমি, ধনীর ছেলে।

পরীরে বলেচি টঙ্কা খিচে লিতে, মা’জনের ধার তো শোধ করতি হবে, পরীরে ও নামকেত্তন করতি বলে, পাগলা!

শ্রীপতি তার হোটেলে পৌঁছে গেছে, হাঁক দিল ঠাকুরকে, বেঙা মিল খাবে, ইলিশ এনেচ, শস্তা হয়েচে নাকি?

ঠাকুর জবাব দেয় না। কিচেন থেকে বেরোয় না। কেন বেরোয় না তা বুঝল শ্রীপতি। ইলিশে ভালো পয়সা মেরেছে ঠাকুর। বেঙা বারান্দার মেঝেতে বসে পড়ল পা ছড়িয়ে, মাথা দোলাতে থাকে, নাহ্, সায়েবটা ভালোই, আমার চোদ্দপুরুষির ভাগ্য ভালো সায়েব এসে উঠেছে মোর ঝুপড়িতে।

যা চান করে আয়। শ্ৰীপতি বলে।

বেঙা হাঁক মারল, ঠাকরানি তেল দ্যাও এটটুখানি, ঠাকরানি হে, বাবু, ক’টা ঘর খালি আছে?

গোটা তিনেক। বলল শ্ৰীপতি।

বিকেলে আমি ঢুকায়ে দেব যদি পাই, মিলের দাম ওতে শোধবোধ।

যা যা, তোরে আর পার্টি আনতে হবে না।

বেঙা উঠল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল টালির চালে ঢাকা কিচেনের ভিতরে। নাক টেনে গলা তুলে বলল, ভালো ইলিশ এনেচে বাবু, খুব বাস ছেড়েচে। ঠাকরানির হাতের রান্না অমিত্তো, ঠাকরানি গো।

ঠাকুর বেরিয়ে এলো, যা ভাগ, তোর ঘর নেই, এখেনে এলি মিল খেতি?

বেঙা কান থেকে বিড়ি বের করে ঠাকুরের হাতে ধরিয়ে দেয়, তুমার জন্যি যত্ন করে এনিচি ঠাকুর, রাগো কেন, তুমার ঠাকরানির রান্না খেতি এয়েচি, এদিকি আর কোনো হুটেল আছে যে এমুন অমিত্তো রাঁধবে, সি-হক বলো, ট্যুরিস লজ বলো, কুথায় আছে এমন রাঁধনি, কে তুমার দাম দেবে?

ঠাকুরের মুখে হাসি ফোটে, বাবুরে বোঝা দেখি, বেতন বাড়াচ্চে না, শালা ঘোড়াটা পালিয়ে হয়েচে যত সব্বোনাশ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *