1 of 2

অশ্বচরিত – ২৫

পঁচিশ

ভানু জানে সিন্ধি মানে সিন্ধু দেশের মানুষ। সিন্ধু দেশ হলো সিন্ধু নদীর পারে। সেই দেশ এখন আর এ দেশে নেই। সিন্ধিরা ওপার থেকে এপারে চলে এসেছে। সিন্ধু নদী পার হয়ে তারা ইনডিয়ায় ঢুকে পড়ে ছড়িয়ে গেছে উত্তর, দক্ষিণ, পুব, পশ্চিমে। রাজস্থানি, বিহারি, বাঙালি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, তামিল, তেলেঙ্গি সব জাতির ভিতরে সিন্ধিরা মিশে গেছে। তার বজবজে পেরুমল বাজাজের ইটখোলা ছিল। পেরুমল সিন্ধি ছিল। পেরুমল বজবজে মস্ত দালান হাঁকিয়ে দই ভাত খায়। পেরুমল বলত, পার্টিশন হলো, বাঙালির বাংলা আছে, পাঞ্জাবির পাঞ্জাব আছে, সিন্ধির দেশ নেই। সিন্ধুপারেই রয়ে গেছে তা। সিন্ধির দেশ এখন গোটা ভারত।

অনন্ত বলল, হাজার টাকা আগাম দিল মদনানি সায়েব।

ভানু চাপা গলায় বলে, কত বুড়ো!

খুব বুড়ো! অনন্তর চোখ চকচক করে ওঠে

হ্যাঁ, পাঁচশ বছর, হাজার বছর। ভানু বিড়বিড় করে।

অনন্ত বলল, তোমার নেশা হয়ে গেছে ভানুবাবু?

ভানু বলল, মহেঞ্জোদরো থেকে উঠে এয়েচে লোকটা। কী বলো?

ঠিক বলি, মহেঞ্জোদরো বুঝিস?

না!

ভানু বলল, মড়া চাপা থাকা ঢিবি।

তার মানে?

ঢিবির নিচে কঙ্কাল।

তুমি কী বলো ভানুবাবু?

যা বলি ঠিক বলি, ভানু উঠে দাঁড়ায়, মদনানি বুড়ো জানে ঠিক।

কী জানে?

অশ্বের খবর।

জানে! অনন্তর দুচোখ বিস্ফারিত, কী জানে?

মদনানি সায়েবের গায়ে ধুলোর গন্ধ।

আমি তো দেখিইনি লোকটাকে।

ভানু বলে, গুমোট গন্ধ, মাটির তলায় ছিল তো।

কী জানি!

ভানু বলে, জাহাজ আছে, কিন্তু কোন সাগরে?

তার মানে?

কোন সাগরে জাহাজ চলে?

হি হি করে হাসে অনন্ত, মীরগোদা, শালার বহুত টঙ্কা।

ভানু বলে, তুই বস, আমি তোর মেয়েকে দেখে আসি।

বলেই ভানু সি-বিচ ধরে হাঁটতে আরম্ভ করে। সেই কতদিন আগের কথা। পেরুমল বাজাজ কীরকম হা হা করে হাসত। গঙ্গার পাশে ইটখোলা, গঙ্গার দিকে তাকিয়ে একদিন তার চোখে জল, হামি সিন্ধু দেখি নাই!

সেই কতদিন আগের কথা এসব! হাজার, দুহাজার বছর আগের। মহেঞ্জোদরো যখন বেঁচে ছিল, তখনকার কথা। প্রেম মদনানি এত বুড়ো যেন সেই মহেঞ্জোদরোর গন্ধ নিয়ে হাজির।

ভানু উঠে গেছে ওপরে। নিঃঝুম অন্ধকারে ভানু নিজের পায়ের শব্দ শোনে। বারান্দায় নীল আলো। ভানু বারান্দায় পৌঁছে দেখে বুড়ো মদনানি বসে আছে, তুম কৌন, কৌন হায়?

সায়েব আমি ভানু।

পঞ্চম ঠাকুর, কেয়া?

সায়েব মেয়েটা?

মেয়েটা, দ্যাট গার্ল, সিন্ধু?

সিন্ধু!

অন্ধকারে ভানু শোনে, সিন্ধু রিভার মিল গিয়া, সমঝতা?

ভানু চাপা গলায় বলে, মেয়েটা কই?

শি ইজ স্লিপিং।

ঘুমায় কেন সন্ধেবেলা?

বুড়ো বিড়বিড় করে, সন্ধেবেলায় নদী ঘুমায়, হামার সিন্ধু, ফ্রেশ ফ্রম দ্য হেভেন, ঘুমায়, অন্ধকার তো! অন্ধকারে নদী ঘুমায়, রুপয়া মাংতা?

নেহি সাহেব।

মোন-জো-দরো মালুম?

মালুম।

হামি মোনজোদরোর আদমি আছে, ম্যান ফ্রম দ্য ওলডেস্ট সিভিলাইজেশন।

জানি সায়েব, কুন্তিরে দেখাও না।

রুপয়া মাংতা?

নেহি সায়েব, লেড়কির বাবা পাঠাল।

বুড়ো খিক খিক করে হাসে, হামি আরিয়া আছে, আরিয়া সমঝতা?

নেহি সায়েব।

আর্য, আরিয়া ফ্রম দ্য ভ্যালি অব ব্ল্যাক সি, কাস্পিয়ান লেক, টল অ্যান্ড স্টাউট, লাইক গড ফ্রম দ্য হেভেন!

ভানু বলল, সায়েব কুন্তির সঙ্গে কথা বলব।

রুপয়া তো মিলা, আভি হোবে না, তুম কৌন হ্যায়? ম্যায় আরিয়া হু, মোন- জো-দরো সিভিলাইজেশনের আদমি আছে, সিন্ধু নদী হামার নদী আছে, হামি হামার নদী পেয়ে গেছি, আভি নিকালো, রুপয়া সকালে পাবে, কিতনা রুপয়া মাংতা, হামি এখন সিন্ধু নদীর ধারে বসে হামার অ্যানসেস্টরদের মনে করব, সমঝতা? তুম তো ইডিয়ট আছে ঠাকুর, তুমি সিন্ধু জানে না, আরিয়া জানে না, তুমি মোন-জো-দরো জানে না, সিন্ধু দেশ জানে না।

জানি সাহেব, কিন্তু মেয়েটারে একবার চোখে দেখব।

হাম কেয়া বোলা, এ সুগ্রীব, কাঁহা গিয়া?

ভানু বসে পড়েছে, সায়েব আমি চলে যাচ্ছি।

হাঁ, যাও, সানডাউনের পর আর আসবে না।

ভানু বসে আছে। সায়েব ঝিমোচ্ছে। ভানুর মাথাটা ভার লাগছে। মাথার ওপর ঘন মেঘে ঢাকা আকাশ। ভানু তাকিয়ে আছে বুড়ো সায়েবের দিকে। সায়েব বিড়বিড় করছে। কী যে বলছে ঝিমোতে ঝিমোতে তা ভানু বুঝতে পারে না।

একটু বাদে ভানুর চটকা ভাঙে, শুকনো নেশা আসলে সব ভুল করিয়ে দেয়। ভানুর মনে হয় সকাল থেকে বসে আছে যেন। মনে হয় যখন আঁধার নামল তখন থেকে বসে আছে। আর আঁধার নেমেছে যেন এক যুগ আগে। ভানুর মনে হয় অনন্তকাল ধরে বসে আছে সায়েবের পায়ের কাছে।

প্রেম মদনানি ডাকে, এ পঞ্চম ঠাকুর।

আমি ভানু।

নেহি তুম পঞ্চম, তুমহারা লেড়কি আচ্ছি হ্যায়।

ভানু বলে, তুমি কেডা সায়েব, কহ দেখি। মতলব?

তুমি মেঘ দেখতে আসো?

হাঁ, তুমার অবজেকশন আছে?

নেহি সায়েব, সায়েব তুমি মোন-জো-দরো…কবে যেন বলছিলে?

সায়েব বলে, এ পঞ্চম ঠাকুর, তুম আভি নিকালো, রুপয়া তো লে লিয়া।

ভানু বলল, এ সায়েব, তুমার জাহাজখানা খুব বড়?

হাঁ, তুমি জাহাজে চাপবে?

না সায়েব, মেয়েটারে দেখাও।

শি ইজ স্লিপিং।

সকালে স্লিপিং, বিকেলে স্লিপিং, ও জাহাজবাবু, এত ঘুম ঘুমায় কেনে কুন্তি, তুমি উয়ারে দেখাও।

তখন সায়েব বলল, এ পঞ্চম ঠাকুর, এ লেড়কি হামি লিয়ে যাবে।

কোথায়?

হামার সিন্ধু রিভার যেখানে আছে।

সায়েব, মা-বাপ কাঁদবে।

লেড়কি ভালো থাকবে, পানশো রুপয়া সালারি পাবে, হামি আকেলা আদমি আছে, এক বেটা মুম্বই, এক বেটা চেন্নাই, হামার দেখভাল করবে তুমার লেড়কি।

ভানু বলল, ডর খাবে।

মতলব?

ডর লাগবে সায়েব।

কিঁউ?

তুমি হলে কবর থেকে উঠা মানুষ, ও লেড়কি ছোট মেয়ে, চোদ্দ বছর, ওনলি ফরটিন, সায়েবরে ও ভয় পাবে।

প্রেম মদনানি বলল, পঞ্চম ঠাকুর, তুমি চুক্তি করেছ।

কী চুক্তি?

লেড়কি হামি লিয়ে যাবে।

সায়েব আমি ভানু।

এতক্ষণে সায়েবের যেন খেয়াল হয়, ঝুঁকে পড়ে ভানুর ওপর, একশ পাওয়ারের বাল্বে আলো নেই তেমন, লো ভোল্টেজ। সায়েব তার প্রাচীন চক্ষু নিয়ে দেখতে দেখতে বলে, কৌন ভানু?

ঘোড়ার সহিস।

কৌন ঘোড়া?

শ্রীপতিবাবুর ঘোড়া, আমার ঘোড়া।

কৌন শ্ৰীপতি?

শ্রীপতি মাইতি।

উ কৌন হায়?

হোটেলকা মালিক।

কৌন হোটেল?

সমুদ্র পাখি।

কৌন সমুদ্র?

বে-অব-বেঙ্গল।

কৌন পাখি?

ভানু হ্যা হ্যা করে হাসে, এ কেমন কথা, ব্যাঙের মাথা।

কৌন ব্যাঙ?

সোনা ব্যাঙ?

কৌন সোনা?

হলুদ সোনা।

কৌন হলুদ?

গায়ে হলুদ, জাহাজবাবু, কুন্তির মা কাঁদবে, কুন্তির বাপ কাঁদবে, মেয়ের গায়ে হলুদ হবে, সেই মেয়ে কিনা তোমার সঙ্গে যাবে?

প্রেম মদনানি বলল, শুন বেটা, পঞ্চম ঠাকুর তো বলেছে লিয়ে যেতে।

টঙ্কা নিল পঞ্চম ঠাকুর? উঠে এসেছে অনন্ত সার। অন্ধকারে অন্ধকারে, ঘোরাল চোখে খুঁজে খুঁজে ঠিক উঠে এসেছে জাহাজবাবুর গেস্ট হাউসে।

প্রেম মদনানি বলে, তুম কৌন?

লেড়কির বাপ হুজুর।

কৌন লেড়কি?

কুন্তি লেড়কি। বলল ভানু

লেড়কির কটা বাপ আছে? প্রেম মদনানি খ্যা খ্যা করে হেসে ওঠে, পঞ্চম ঠাকুর বলে, সে লেড়কির বাপ, আবার এ ঘোড়েকা সহিস বলে লেড়কির বাপ, তুম ভি বোলো, হাম কেয়া করে?

ভানু বলল, হুজুর, মা-বাপ, তুমি হুজুর জাহাজের মালিক, মেয়ের গায়ে হলুদ হবে, মেয়ের বিয়া হবে, তুমি কেন নিয়ে যাবে?

কবে হবে? অনন্ত ঘুরে জিজ্ঞেস করে ভানুকে।

একদিন হবে।

ধুস শালা, পেটে ভাত হয় না তো মেয়ের বিয়ে, হুজুর কি কাজে নেবেন?

হাঁ।

ঝিগিরি করবে হুজুরের বাড়ি?

হাঁ, হাঁ, সুখ পাবে।

কত বেতন?

পানশো রূপয়া।

বেশি হয় না হুজুর?

আচ্ছা আটশ পাবি।

হাজার হয় না হুজুর?

লেড়কি দে, তবে হাজার পাবি।

অনন্ত বলল, দিল তো দুহাজার বাকিটা মেরেছে, হুজুর মা-বাপ, জাহাজে কাজ হবে হুজুর, মা-বেটি দুজনায় খাটবে।

মাস মাস হাজার পাবে, ফির কিঁউ?

হুজুর তুমি আমার মেয়েটারে লাও, মুখে ভাত দিতে পারিনে।

ভানু এত সময় চুপ করে ছিল, আচমকা ক্ষেপে ওঠে, এই শুয়ার, তুই কী বলিস, তোর মেয়ে লিয়ে যাবে, মেয়ে দিয়ে দিবি?

দেব তো কামে, কাজ করবে, পেটে ভাত জোটবে।

না।

না কেন রে? আচমকা অনন্ত ঝাঁপিয়ে পড়ে ভানুর ওপর, ঘোড়াটা তুমার ছেল, তুমি খুঁজতে যাও, আমারে একবার টঙ্কা দিলে, মেয়েটা আমার, মেয়েটা যাক, আমি খুঁজি আনব, তখন শালা তুই যেতি পারবিনি।

ভানু বলল, অনন্ত, তোর নেশা হয়ে গেছে।

নেহি, ও জাহাজ বাপ, জাহাজ ভর্তি টঙ্কা থাকে শুনেছি, মেয়ের বাপরে এখন কুছু দাও, এক হাজার দাও, দুহাজার দাও, তিন চার…।

মেয়েরে দেখবিনে অনন্ত? ভানু বলে।

না, সকালে দেখে যাব।

মেয়ে তোর ঘুমায়।

ঘুমাক, কতদিন ঘুমায়নি কচিটা।

অনন্ত, তোর আর ছেলেমেয়ে নাই।

চোপ! অনন্ত আবার ঝাঁপাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছাদের ওপর। পড়েই থাকে। প্রেম মদনানি! কই সে তো নেই। দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যালকনি থেকে লম্বা প্যাসেজ, তারপর সব দরজা বন্ধ। নিথর নিস্তব্ধ। আচমকা বারান্দার আলোটাও নিভে গেল। অনন্ত ডাকল, ভানুবাবু।

ভানু সাড়া দেয়, সে নেই।

কে?

মদনানি, কবরে গিয়ে ঢুকেছে, হতো আমার পেরুমল বাজাজ, কীর’ম দয়ালু মানুষ, পঞ্চম ঠাকুর এ কারে দেখাল অনন্ত?

অনন্ত বলে, কুন্তিরে ডাক।

ঘুমায়।

তবু ডাক।

কেন মেয়ে তো ওর হয়ে গেছে।

না, মেয়ে আমার।

ভানু বলল, লোকটা ভালো না অনন্ত, কুন্তির খুব বিপদ।

লোকটা খারাপ?

মড়া! মড়া উঠে এয়েচে টের পাসনি নুনওয়ালা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *