1 of 2

অশ্বচরিত – ৪৫

পঁয়তাল্লিশ

একটু আগে এই ঘরে প্রলয় হয়ে গেছে। চিৎকার, কান্না, গর্জন সব মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। এখন সব নিঝুম। ভারতী মেঝের ওপর দেয়ালের কোণে বসে আছে।

শ্রীপতি বাইরে গেছে। আবার এসেছে আবার গেছে। এখন রাত কম হল না। সমুদ্র ছাড়া সব অতল ঘুমে তলিয়ে। শ্রীপতি চুপচাপ বসে ছিল, ভারতীর চোখে চোখ রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে ভারতী তার মনের কথা পড়তে পারছে। কী ভাবছে শ্রীপতি তা টের পাচ্ছে ভারতী। শ্রীপতির মন যে উড়ু উড়ু হয়েছে তা জেনে ফেলেছে ভারতী।

আর ভারতী! কোটরে ঢোকা চোখ নিয়ে হাঁ করে শ্রীপতির দিকে চেয়ে আছে। চোখের পলক পড়ে না। সে কিছুই ধরতে পারছে না। শ্রীপতি যে তার থাকবে না তা কল্পনাতেও আসে না। শ্রীপতি তার অবলম্বন। শ্রীপতিকে খড়কুটোর মতো ধরে রাখতে চাইছে ভারতী।

কাল থেকে আজ। ঝড়ের মতো কেটে যাচ্ছে। কিছু শ্রীপতির লক্ষে, কিছু অলক্ষে। সব কথা কেউ জানে না। একজন দুজন একটু আধটু। কাল দুপুরে মা আর বউ যে হাসপাতালে গেছে এ খবর সে পাবে কোত্থেকে? তখন তো শ্ৰীপতি বালিসাই। ভানু কোথায় জানে না। শ্রীপতি মীরগোদা যাবে যাবে করে বালিসাই গিয়েছিল রামনগর পার হয়ে।

সেই সময় মধুমিতা আর তার শাশুড়ি হাসপাতালে ডাক্তারকে ধরে পড়েছে। কী ব্যাপার? ভারতী, ওই নার্স, ও শ্রীপতি জানাকে তুক করেছে, সিস্টার, যিনি দেবীর প্রতিমূর্তি হবেন, তিনি একটা পরপুরুষের রক্ষিতা হয়ে যান কী করে?

হ্যাঁ, হতে পারে, মেয়েমানুষটা তো বেজন্মা, বংশপরিচয় নেই, আদাড়ে- বাদাড়ে কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চা, তাই—।

ডাক্তার দুহাতে বাধা দিয়েছে শ্রীপতির মায়ের মুখকে, প্লিজ ওসব কথা বলবেন না, খুব খারাপ, খুব খারাপ।

বয়স্ক মানুষটা সদাশয়। ভালো মানুষ। তিনি এই সব কথায় বিপন্ন বোধ করেছেন। বাস্টার্ড! হতে পারে কেন তাই-ই, সত্যিকারের জন্মসূত্রহীন। হারানো মেয়ে হতে পারে। বুড়ো মানুষটি বারবার রিকোয়েস্ট করেছেন, এসব আমাকে বলবেন না, এসব আমার এখতিয়ারে নেই, পার্সোনাল ব্যাপার।

কিন্তু শ্রীপতির বউ আর মা হাল ছাড়েনি। মধুমিতার চোখ ছলছল করে ওঠে, সে ডাক্তারের হাত ধরে ফেলেছে, আপনি না দেখলে আমরা যে মরে যাব, আমার স্বামী, বাচ্চা সব যাবে, পুরুষমানুষ খেয়ালে মেয়েমানুষ পুষুক, তা পুষতে পারে, সেটা ভয়ের নয় ডাক্তারবাবু, ওখেনে মন মজে না, ফুর্তি হয়। কিন্তু মেয়েমানুষ যদি পুরুষ রাখে, সে পুরুষের আর বেরোবার উপায় নেই, ডাইন তুক করেছে, আপনার ভারতী নার্স ডাইনি।

ডাক্তার পায়চারি করছেন তখন। শেষ অবধি তিনি আর পারেননি, বলেছেন, ঠিক আছে, মিস চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে দেখব আমি, ঠিকই তো, বউ বাচ্চা সব আছে, তবু কেন মিস চৌধুরীর ওখানে পড়ে থাকবে? খুব খারাপ খুব খারাপ, ভারতীর সরে আসা দরকার।

শ্রীপতির মা মাত্রা যোগ করেছে, নার্সের যদি স্বভাব এমন ধারা হয়, তবে হাসপাতালে রুগি আসে কী করে? বেটাছেলে রুগি হলেই ভেড়া হয়ে যাওয়ার ভয়, নার্স মাগি তুক করে নেবে।

এই কথাই গতকাল রাতে ডাক্তার সান্যাল ভারতীকে বলেছে। ভারতীর নাইট ডিউটি ছিল। ডাক্তার সান্যাল বললেন, তুমি যদি ট্রান্সফার চাও আমি চেষ্টা করতে পারি, ব্যবস্থা করব, তোমার এই জায়গা থেকে চলে যাওয়া উচিত, তোমার নামে খারাপ কথা আমি শুনতে পারব না।

ভারতী নিশ্চুপ হয়ে গেছে।

সান্যাল জিজ্ঞেস করেছেন, তোমার লাইফ হিস্টোরি সব্বাইকে বললে কেন?

ভারতী জবাব দেয়নি। নীরবে তার কাজ করেছে। মাঝ রাতে ঘরে চলে এসেছে। এসে ঘুমিয়েছে কি চুপ করে থম মেরে বসে ছিল তা ভারতী চৌধুরীই জানে। আজ ডিউটিতে যায়নি ভারতী। সকাল থেকে ঘর বার করেছে। না ঘুমনো চোখদুটোয় লালচে আভা, চঞ্চলতা বেড়েছে।

ঠিক বিকেলে শ্রীপতি কেন সব্বাইকে একসঙ্গে পেয়ে যায় সে। শ্রীপতি যাচ্ছিল হোটেলে, ওর মা আর বউ আসছিল এদিকে। ভারতী দুইয়ের মাঝখানে গিয়ে পড়েছে।

ও মা আমার এখানে একটু আসবে, কথা আছে।

ও মধুমিতা আমার এখানে একটু আসবে, কথা আছে।

ও মা তোমার ছেলেকে নিয়ে এসো।

ওরা তিনজনেই চমকে গেছে। কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন। শ্রীপতি থাকতে চাইছিল না। বউকে সামনে রেখে ও ভারতীর সঙ্গে সহজ হয়ে কথা বলতে পারবে না। আর কথারই বা কী আছে, সে ভারতীকে ছাড়তে চায়। অনেক হয়েছে, আর না, মা বউ ডাক্তারের কাছে গিয়ে তার কাজটাই করে দিয়েছে। এ সুযোগ শ্রীপতি ছাড়বে কেন? মায়ের কাছে শুনেছে সে, সে এড়াতে চায়, কাজ আছে, পরে হবে।

শ্রীপতির মা বলে, না বাছা সময় নেই।

কিন্তু ভারতী ছাড়ে না, এসো না তোমরা, এসো।

রাস্তার ভিতরে গোলমাল পাকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ভারতীর পিছনে পিছনে এসে উঠেছে তার কোয়ার্টারে। মধুমিতা দাঁতে দাঁত চেপে আছে। ঠোঁট কামড়ে ধরছে বারবার। শ্রীপতি গোলমালের ভয় করছিল। শ্রীপতির মা খুব শক্ত, বলছে, বাছা, কী বলার তাড়াতাড়ি বলো, মন্দিরে যাব।

মধুমিতা হিসহিস করেছে, এলে কেন মা? বাজারি মেয়েমানুষের ডাকে আসতে হবে?

আহা। শ্রীপতি থামাতে চায় বউকে।

কথাগুলো ভারতীর কানে গেছে কি না ধরা গেল না। সে খুব শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, ও মা, তোমরা কী বলে এসেছ? সে কথার ভারে যেন বারবার নুয়ে পড়ে।

মধুমিতা চুপ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শ্রীপতির মা বুঝে গেছেন ব্যাপারটা। বৃদ্ধা বলে ওঠেন, ভুল কিছু নয়। তুমি আমার ছেলেকে ছাড়ো মা, সংসার তো হয়নি তোমার, লোকেরটা ভাঙো কেনে?

ভারতী থমকে যায়, তারপর আবার বলে, মা তোমরা, ওই কথা বলে আসতে পারলে! তোমাকে মা বলে ডেকেছিলাম।

ছেঁদো কথা ছাড়ো। তুমি লোকটাকে তুক করেছ, চলে যাও এখেন থেকে, চলে যাও। আবার হিসহিস করে ওঠে মধুমিতা।

এত সব কথার ভিতরে শ্রীপতি চুপচাপ।

ওগো তুমি কিছু বলবে না? আমার নামে কীসব বলে এসেছেন এঁরা, ডাক্তারবাবু বললেন।

শ্রীপতি কী বলতে গিয়ে চুপ করে যায়। কিন্তু মধুমিতা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে, এগিয়ে এসে এক থাপ্পড়ে প্রায় শুইয়ে দিয়েছে ভারতীকে, লজ্জা করে না। বাজারি মেয়েমানুষ তো বাজারে যা, মোর সোয়ামিকে টানিস কেনে? লাইনে গে দাঁড়া…!

ভারতী পড়তে পড়তে টাল সামলায়। তারপর তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে, তুমি আমাকে মারলে! সে ঘুরে শ্রীপতির দিকে তাকিয়েছে। শ্রীপতি তখন মাকে আর বউকে বলছে, চলে যাও, চলে যাও, এটা ভালো হচ্ছে না, ভদ্রলোকের মতো হচ্ছে না।

মা ফুঁসে উঠেছে, আজ একটা কিছু হয়ে যাক।

ভারতী একবার শ্রীপতির দিকে তাকায়, একবার মধুমিতার দিকে, বিড়বিড় করে বলে, আমাকে মারলে, ওগো তুমি কিছু বলবে না? তুমি কিছু বলো। বলতে বলতে দুহাতে কান চাপে ভারতী।

তুমি আমার ছেলেকে ছাড়ো, তারপর কথা, না ছাড়বে তো থানায় যাব আমি, মন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে তোর চাকরি খাব, নার্সগিরি করিস না কী করিস তা জানাব। শ্রীপতির মা বলল।

ঘটনা অনেকক্ষণ গড়ায়। শেষ অবধি মধুমিতা আর শ্রীপতির মা টানতে টানতে শ্রীপতিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ভারতী ওখেনে বসে থাকে। বহুক্ষণ বাদে শ্রীপতি আবার ঘুরে আসে। শ্রীপতির ঘুরে আসার কারণ আছে। ভারতীকে বুঝিয়ে যদি বদলি নেয়ানো যায়। ব্যাপারটা দশকান হওয়া তো শ্রীপতি মাইতি হোটেলওয়ালার পক্ষেও ভালো না। দিন দিন এসব নিয়ে গোলমাল হলে তার ব্যবসাও মার খাবে। ভারতী যদি নিজে থেকে সম্পর্ক শেষ করে চলে যায় তো শ্রীপতি বাঁচে। এক মেয়েমানুষে কতদিন রুচি থাকে। আর এ তো পাগলির মতো হয়ে যাচ্ছে দিন দিন!

ভারতী আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করেছে, সব সম্পর্ক শেষ। শ্রীপতি ভারতীকে চুপ করে থাকতে বলে, রেস্ট নাও।

ভারতী বারবার জানালার কাছে গিয়ে মেঘ দেখে, আস্তে আস্তে বলে, আমাকে সবাই একঘরে করে রেখেছে। কেউ কথা বলে না। দোকানপাট বাজারঘাটে সব মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। লোকে কী করে জানল আমি পড়ে পাওয়া মেয়ে। জন্মের ঠিক নেই। তোমার মা বউ বলে বেড়াচ্ছে এসব, কীরকম অদ্ভুত চোখে লোকে তাকায়।

শ্রীপতি চুপচাপ। ভারতীর জীবনের কথা শুনে ও কষ্ট পেয়ে মাকে বলেছিল। তখন সম্পর্কটা সকলের ভিতর সুন্দর। মা সবে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। মা কষ্ট পেয়েছিল। মায়ের চোখে জল ছিল। আহা, বড় দুঃখী ওই নার্সটা। কী সেবাই না করল, ও আমার মেয়ের মতো। এখন মার মনে দুঃখ নেই। মা ঘেন্না করছে ভারতীকে তার ছেলেকে সরিয়ে আনার জন্য।

চাদ্দিকে শুধু ফিসফাস গুঞ্জন, আমার জন্মের ঠিক নেই, আর আমি তোমার কী যেন! বলতে পারছি না—তোমার বউ আমাকে চড় মারল। তুমি কিছু বললে না?

শুনতে পাচ্ছ হো হো ফুর্তির শব্দ। একটা মানুষকে ঘিরে কত মজা! ওগো তুমি কিছু বললে না, তোমার বউটা আমাকে -?

শ্রীপতির কিছু বলার নেই। ভারতী মেঝেতে বসে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাথাটা চেপে ধরছে। মাথায় রাশি রাশি চুলের ভিতরে ওর ছোটখাটো মুখখানি ঢেকে গেছে।

তুমিও খুব মজা পেয়েছিলে তাই না! বেজন্মা, জন্মের ঠিক নেই যার। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই, একা মেয়েমানুষ, তার সঙ্গে অনায়াসে মেশা যায়। তার মান অপমানের দায় থাকে না তোমার।

শ্রীপতির মুখ কালো হয়ে যায়, বলে, চুপ করে থাকো, বড় বেশি বাড়াবাড়ি করছ! কণ্ঠস্বরে একটু ঝাঁজ।

ভারতী হাঁ করে শ্রীপতির দিকে চেয়ে থাকে। তারপর হাসে। হাসতে হাসতে একেবারে স্বাভাবিক হয়ে যায়, ঠিকই তো, আর আমারই অন্যায় হয়েছে! আমি চলে যাব, তাই-ই ভালো, কী বলো?

শ্রীপতি বলে, অনেক দিন হলো তো, আমি তো তোমার জন্য মা বউ ত্যাগ করতে পারব না, বরং তুমি বদলি নিয়ে চলে যাও, জীবনে এরকম হয়।

হয়! ভারতী শান্ত, কত কিছু হয় তাই না।

শ্রীপতি মাইতি দেখছিল কী শান্ত হয়ে বসে আছে ভারতী। চেহারার জেল্লাটা এখন একটু ঝরে গেছে। যখন দেখেছিল প্রথম এই মেয়েকে, তখন আকর্ষণ ছিল শরীরে। কী মায়াবতী, স্নিগ্ধ চোখদুটি! মুখখানিতে ঢলোঢলো ভাব ছিল। শরীরখানি ছিল কী সুন্দর! শ্রীপতি সহজেই ঝুঁকে পড়েছিল। এখন মনে মনে কোকিলার কথা ভাবছে। যেদিন দেখেছে কোকিলাকে, শ্রীপতির সব টান ছিঁড়ে গেছে এখান থেকে।

শ্রীপতি দেখছিল, কেমন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ভারতী, কোথাও কোনো কম্পন নেই যেন। ভারতীর পুরনো চোখদুটিই আছে, সেই রকম, সেই মায়া, সেই চোরা চাহনি! শ্ৰীপতিকে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়। না হলে ওই চোখের মায়ায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ওই চোখই তো সব্বোনাশ করেছিল তার। সব্বোনাশ কেন হবে? ভারতী নিজেকে কী সহজেই না নিবেদন করেছিল শ্রীপতির কাছে। কী আশ্চর্য! অত সহজেই যে পেয়ে যাবে তা ভাবেনি শ্রীপতি। কী মোহময় দুপুর ছিল সেটি। শ্রীপতি প্রায় সবটাই ভুলে গেছে। আবছা মনে পড়ে।

ভারতী ফিসফিসিয়ে বলল, তাহলে আমি চলে যাব?

আমি তো নিজের সংসার ভাঙতে পারব না। বলতে বলতে শ্রীপতি বোঝে এসব ছেঁদো যুক্তি। তার সংসার ভাঙছে কই? ভাঙবে না। কোনো দিন ভাঙবে না। ভেঙে মধুমিতা যাবে কোথায়? পুরুষমানুষ এসব করে। মধুমিতা যে ভারতীকে অপমান করে যেতে পারে, ভারতীর গায়ে হাত তুলতে পারে তা তো তারই প্রশ্রয়ে। শ্রীপতি যদি রুখে দাঁড়ায় মধুমিতার সাহসই হবে না ভারতীর সামনে দাঁড়ানোর। শ্রীপতি যেমন চায় তেমনই করবে মধুমিতা। মধুমিতা টের পেয়েছে শ্রীপতির মন ঘুরছে, এতদিনের ক্ষোভ মধুমিতা উগড়ে দিচ্ছে। এতদিনের অপমান, হীনম্মন্যতার শোধ নিচ্ছে মধুমিতা এইভাবে ভারতীকে অপমান করে। শ্রীপতির মনে হয় আর এক- দু’দিন মধুমিতা যদি ঢোকে এর কোয়ার্টারে, ভারতী এই সমুদ্রতীর ছেড়ে পালাবে। শ্রীপতির হাসতে ইচ্ছে করছে। মধুমিতা কি ভেবেছে শ্রীপতি আর পত্নীঅন্ত প্রাণ হবে? হা হা হা…কী করে হবে শ্রীপতি পত্নীঅন্ত? তার যে মনই নেই মধুমিতায়। মধুমিতা যদি পারে ভারতীর সঙ্গে চুলোচুলি করে ওকে তাড়াক।

ভারতী নিশ্চুপ জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রীপতি ভাবছিল উঠে যাবে কি না। কিন্তু কৌতূহলে বসেই আছে।

বাইরে এখন মহা অন্ধকারের পৃথিবী। কার্তিকের হিমেল রাত। ভারতী দুটো হাত বাড়িয়ে বাতাস নিয়ে আসে তার মুখের কাছে। ওর মাথার ভিতরটা ঝনঝন করে বেজে উঠছে। সেই যে মেয়েটা মীনাক্ষী। মীনাক্ষীই তো। উঁহু সে তো এই ভারতীই! বসে বসে রোগা হয়ে গেল। গাল ভেঙে গেল, চোখ বসে গেল! আর সেই ছেলেটা, যাকে একদিন কয়েক ঘণ্টা অন্ধকার দেখছিল সে! কী নাম যেন? দীপক! হাওয়া উঠছে! আহ্! কত বাতাস। জানালা দরজা হাট আলগা হয়ে বাতাস তুমুল হয়ে উঠেছে। ফুলপাহাড়ির বাঁধের ওধারে একটা মস্ত শিমুলগাছ ছিল। হাওয়ায় হাওয়ায় তুলো উড়ে আসত না! মেয়েগুলো ছাতে লুটোপুটি হয়ে সেই তুলো ধরত। কে বেশি ধরতে পারে!

তারপর আমাকে পুলিশ হোমে ফেরত দিল। সিঁদুর পরেছিলাম! ঘষে ঘষে সিঁদুর তুললাম। আবার কতকাল বাদে! ঠিক সেই বাতাস এলো যেন। লাল, হলুদ, নীল, সবুজ, আকাশটা ফেটে সেই সব রং বেরোতে লাগল! শিমুল তুলোগুলো আকাশে উঠে মেঘ হয়ে গেছে। নীলের ওপরে তুলো উড়ছে। আমি আসল পৃথিবীতে এলাম। সমুদ্রতীর, পুরুষমানুষ, আত্মীয়। আকাশে ফেটে ফেটে রং পড়ছে! মীনাক্ষী! নামটা যেন বড় ভুল!

হাসতে হাসতে শক্ত হয়ে যায় ভারতী। শিরা ধমনি আর চামড়ায় ঘেরা দেহটা কাঁপতে কাঁপতে উলটে পড়ে মেঝেতে। মাথাটা ঠুকে যায়। শ্রীপতি লাফিয়ে ওঠে, কী হলো?

ঘরে অল্প ওয়াটের বাল্ব। গুমোট ভাব, ধুলোর গন্ধ। শ্রীপতি কী করবে ভেবে না পেয়ে, জলের কুঁজোটা নিয়ে এসে গড়িয়ে দেয় জল। ভারতী ভক ভক করে বাতাস নিচ্ছে। মুখ গহ্বর হাঁ হয়ে গেছে। আলজিব পর্যন্ত দেখা যায়।

শ্রীপতি বিপন্ন হলো। এখন তো ডাক্তার ডাকতে হয়। সে দ্রুত স্নান ঘরে ঢুকে মগ ভর্তি জল এনে ভারতীর মুখে ছিটোতে থাকে। জ্ঞান না ফিরিয়ে সে যায় কীভাবে? কোনো মায়া আর নেই ভারতীর ওপর, তা সত্ত্বেও গোপন কোনো টান তো রয়ে গেছে এখনও। যে চোখের মায়ায় সে এগিয়ে গিয়েছিল এই নারীর দিকে, সেই চোখদুটিই এখন যেন ভয় দেখাচ্ছে তাকে। চোখের পাতা বুজিয়ে দিতে চায় শ্রীপতি। মরামাছের মতো ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে আছে ভারতী। শ্রীপতির নিজেকে অসহায় মনে হতে থাকে। সে ভারতীর পাশে উবু হয়ে বসে তার শ্বাস-প্রশ্বাস লক্ষ করতে থাকে। চোখ ধীরে ধীরে খুঁজে যায়। ঘুমিয়ে পড়ছে যেন ভারতী। শ্রীপতি এবার যাবে। কিন্তু না ডেকে যায় কীভাবে? দরজা খোলা রেখে তো যাওয়া যায় না। ভারতীকে অস্ফুটস্বরে ডাকতে থাকে সে। চোখদুটি বহুক্ষণ বাদে যেন খুলে যেতে থাকে।

ভারতী ঘুমঘোরে সাড়া দেয়, কী বলছ?

আমি এবার যাব।

না থাকো, আর একটু।

কাজ আছে।

কোনো কাজ নেই। ভারতী তার দিকে পাশ ফিরে শোয়, কীরকম অদ্ভুত চোখে তাকায়, তাকে দেখতে থাকে। অচেনা মানুষ দেখলে যেমন চোখের ভাব হয় তেমনি ভাব ফুটে ওঠে যেন—শ্রীপতির মনে হয় তাই। শ্রীপতিরও যেন অচেনা মনে হয় ওই দৃষ্টি, সে ডাকল, ভারতী!

ভারতী ডাক শোনে না, নিস্পন্দ হয়ে গেছে চোখদুটি। শ্রীপতির আচমকা মনে হয় চোখ চেয়েই ঘুমোচ্ছে যেন ভারতী। নাকি জেগে আছে? সে ভারতীর গায়ে হাত ছোঁয়ায়। কোনো সাড়া নেই। আবার ডাকে অনুচ্চ গলায়।

শ্রীপতি কোনো জবাব না পেয়ে থম মেরে বসে থাকে। একবার ভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দেবে ভারতীকে। কিন্তু পারে না। এই যে চেয়ে আছে ভারতী। এখন তো মনে হচ্ছে আগের মতোই জেগেই আছে। জেগে আছে, তার কথা শুনতে পাচ্ছে না। শ্রীপতি আবার ডাকে। এবারও সাড়া পায় না। সাড়া না পেয়ে বসে থাকে।

সেই সময় ভারতীর চোখে স্পন্দন আসে। চক্ষুমণি যেন নড়ে উঠল। কালো মণিটি চোখের কোণে প্রায় লুকিয়ে গিয়েছিল, ধীরে ধীরে তা আঁখি গহ্বরের মধ্যখানে স্থিত হয়। শ্রীপতির মনে হলো ঘুম ভাঙছে, অথবা জ্ঞান ফিরছে ভারতীর। শ্রীপতি অপেক্ষা করতে থাকে। ভারতী উঠুক, উঠে দরজা বন্ধ করুক। সে চিরকালের মতো ভারতীকে ছেড়ে যাবে। চিরকালের মতো ছেড়ে যাবে বলে শ্রীপতি একটু সময় দিচ্ছে ভারতীকে। চিরকাল অনেক, অনেক সময়, অনেক বছর, অনেক ঘণ্টা, অনেক দিন। বিপুল সময়পুঞ্জ। আর এই অপেক্ষাটা তার তুলনায় সামান্য, গণনায় আসে না এমন ক্ষুদ্র এই সময়। এটুকু ভারতীর জন্য ব্যয় করতেই পারে শ্রীপতি। আর ভারতীও যেন তা জেনে সময়টিকে দীর্ঘ করতে চাইছে জাগরণে, অজাগরণে, জ্ঞানে, অজ্ঞানে, চেয়ে থাকায়, না চেয়ে থাকায়। কী আশ্চর্য! চক্ষুমণিটি আঁখি গহ্বরের মধ্যস্থলে এসে আবার নিশ্চল হয়েছে। শ্রীপতির ওপরে নিবদ্ধ সেই দৃষ্টিরেখা। শ্রীপতি এমনভাবে দেখছে যেন কোনো মৃতের চোখ। মৃতের চোখ সচল হলে যে বিস্ময় অধিকার করে জীবিতকে সেই বিস্ময় শ্রীপতিকে গ্রাস করছে একটু একটু করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *