1 of 2

অশ্বচরিত – ৩৬

ছত্রিশ

অনন্ত আর তার বউ ছাড়ছে না ভানুকে। সাত দিন হয়ে গেল, ভানুকে চোখের আড়ালে যেতে দিচ্ছে না। সেই রাতে শেষ বাসে নামার পর অনন্ত তাকে টেনে এনেছিল অলঙ্কারপুরে। ভানুরও মনে হয়েছিল যায়। শোকে আকুল অনন্ত আর তার বউকে একা ছেড়ে দিতে পারেনি সে অন্ধকারে।

একা ছেড়ে দিলে যে কী হতো! ওরা পৌঁছতেই পারত না বাড়িতে। সি-ডাইক থেকে গড়িয়ে পড়ে যেত নিচে। মারামারি করতে করতে মরত মেয়ে পুরুষ দুজন। সমস্ত পথ কাঁদতে কাঁদতে চলেছিল কুন্তির মা! ভেড়িবাঁধে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সে। মাটিতে আছারি পিছারি খাচ্ছিল অন্ধকারে। বুক চাপড়ে কাঁদছিল সরস্বতী। যত কান্না ছিল তার বুকে তা শেষ করেও কাঁদছিল সে। কান্নার নদী বয়ে যাচ্ছিল অন্ধকারে। তাকে প্রায় টেনেই বাড়ি এনেছিল অনন্ত আর ভানু। কাঁদতে কাঁদতে পাগলিনী অভিশাপ দিচ্ছিল স্বামীকে, তার স্বামীই বেচে দিয়েছে মেয়েটাকে। বাড়ি পৌঁছে অনন্ত আর উদ্‌গত কান্না রুখতে পারে না। ভানু বসে বসে স্বামী-স্ত্রীর কান্নার সাক্ষী হয়েছিল। সমস্ত রাত ঘুমোতে পারেনি সে।

সমস্ত রাত সে সরস্বতীর মুখে শুনেছিল মেয়েকে পেটে ধরার বৃত্তান্ত। মেয়েকে বড় করার বৃত্তান্ত। কাঁদতে কাঁদতে বিনবিনিয়ে সেই কথাই বলে যাচ্ছিল কুন্তির মা। অনন্ত কপাল ঠুকছিল মাটিতে। কী অন্ধকার না ছিল ভাদ্রের সেই রাতটিতে I আকাশে মেঘ ছিল। মেঘে ঢেকে ছিল সমস্ত তারা। কোথাও কোনো আলোর বিন্দু ছিল না।

ভোর ভোর পালাতে চেয়েছিল ভানু। তাকে আটকেছিল অনন্ত। রক্তবর্ণ দুচোখ, সমস্ত গালে নোনা দাগ, কাঁদতে কাঁদতে শরীরের সমস্ত নুন যেন খরচ করে ফেলেছিল সে একরাতে। অবসন্ন, রিক্ত নুনমারা অনন্ত সার বলেছিল, ভানু চলে গেলে সে গলায় দড়ি দেবে, সে নিজ হাতে মেয়েটাকে বিক্রি করে দিয়েছে, বউয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না।

ভানুর কী খেয়াল হয়েছিল, অনন্তকে নিয়ে গিয়েছিল কাঁথি। চেনা এক উকিলবাবু ছিল। তাকে খুলে বলেছিল সব। উকিলবাবু বলেছিল থানায় না যেতে। থানায় গেলে অনন্ত বিপদে পড়বে। অত টাকা নিয়েছে মেয়েকে কাজ করতে পাঠিয়ে, তার মানে তো মেয়েকে বেচেই দিয়েছে। ভীষণ অপরাধ। ছাড়বে না পুলিশ। টাকাটাও যাবে। তারা বিমর্ষ হয়ে ফিরে এসেছিল। দেখেছিল ঘরের দুয়ারে মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়ের মা। কাঁদতে কাঁদতে শিশু যেমন ঘুমোয়, তেমনি। অনন্ত ধরে ফেলেছিল ভানুর হাত, দাদা যেওনি, পাগলি হয়ে যাচ্ছে বউ, মু কী করি ভানুদাদা!

সেই থেকে ভানু আছে। ভানু আছে সান্ত্বনা দিতে। কুন্তির মা ভয় পাচ্ছে কুকুরে। কুকুরে ছিঁড়ে খাবে তার মেয়েকে। অনন্ত এরই ভিতরে বাজারে গেছে, বাজার এনেছে, নিজে রান্না করেছে, খেয়েছে, খাইয়েছে বউকে। ভানু বসে বসে দেখেছে। ভানুর অজ্ঞাতবাস শুরু হয়ে গেছে।

একদিন সকাল থেকে ঘন মেঘ। বৃষ্টি শুরু হলো। বাতাস। অনন্ত বলল, ভানুদাদা হে, মনটা পুড়ি যায়, মেয়্যা মোর কার হাতে পড়ল।

হাওয়া উঠছিল। আকাশ দেখে ভানু বলল, বিপদ।

অনন্ত বলে, আকাশ আর কত বিপদ আনবে, মোর যা হলো!

কিন্তু বিপদ তো। বেলা একটু বাড়তেই হাওয়ার তীব্রতা বাড়তে লাগল। বৃষ্টির জোর বাড়ছে। উঠোনে কাঠকুটো ভিজছিল, সরস্বতী এই প্রথম উঠোনে নামল কাঠকুটো তুলতে। চঞ্চল হয়ে উঠল অনেক দিন বাদে। মেঘ উঠেছে, দুর্যোগ নামবে বলে চিৎকার করতে লাগল। বউয়ের সঙ্গে অনন্তও হাত লাগাল কাঠকুটো তুলতে। সব ভিটের দাওয়াতেই ছিল। অনন্তই রোদে নামিয়েছিল কদিন, ভাদ্রের রোদে জ্বালানি শুকিয়ে জ্বলনের উপযোগী হয়ে উঠেছিল। অনন্ত কাঠ পাঁজা করে তুলতে তুলতে বলল, কুন্তি থাকলে ইসব দিখতে হতোনি, কুন্তিরই জুগাড় করা ইসব।

সরস্বতী স্বামীকে ডাকে, চালডাল নেই যে।

নাই তো, কী কঁইরে থাকবে?

লিয়ে আসো, হাঁ শুনো, যদি পারো ইলিশ আনবা।

সি তো দীঘায়।

যাওয়া যাবেনি? কদিন ধরে ভানুদাদা রইছে।

অনন্ত বলে, তা’লে যাই।

তেল, নুন পর্যন্ত নাই নুনমারার ঘরে।

নাই, কী করে থাকবু, খরিদ করা হলোনি।

লঙ্কা আনবা, প্যাজ, রসুন, আলুর দাম কমল?

কী জানি!

টঙ্কা লিয়ে যাও, লিয়ে আসো, পাকা বড় ইলিশ আনবা, হাঁ শুনো, পারো যদি একখানা বড় পেলাসটিক আনবা তো, রান্নাশালে জল পড়ে, জল খুব হবে মনে লয়।

হুঁ, খড় দিব আঘুন মাসে।

তখনকার কথা তখন, ইখন তো ঘর বাঁচাতি হবে, কত দাম হবে একখানা পেলাসটিকের, ও ভানুদাদা, বড় পেলাসটিক?

ভানু বলল, চল্লিশ, পঞ্চাশ।

যা লাগে দিয়ো, কী দুয্যোগ, ই আঘুন মাসেই ঘরের টালি বদলাতি হবে।

হুঁ, হাঁ করে যাচ্ছিল অনন্ত। ভানু আকাশ দেখছিল। দক্ষিণ-পুব থেকে উঠে আসছে ঘন মেঘ। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। কী সেই মেঘের রূপ! অনেককাল বাদে এমন মেঘ এলো আকাশে। এবার সব অদ্ভুত! বর্ষায় বৃষ্টি হলো না ভালো করে, জলের অভাবে ধান মরছে, অথচ বর্ষার আগে পর্যন্ত একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে গেছে। এই এখন জল নামল যেন ভালো করে। আকাশ ভারী হতে হতে ভেড়িবাঁধের ওপর নেমে এসেছে। ভিটেয় বসেই দূর সমুদ্রের গর্জন শোনা যেতে লাগল। বর্শার ফলার মতো বৃষ্টি বিদ্ধ করতে লাগল বহুদিন ধরে শুকিয়ে থাকা মাটি। বাতাসে দূরের ঝাউবন, নারকেলসারি দুলতে লেগেছে ভীষণ। বাতাস যেন সহস্র ঘোড়ায় চাপা সহস্ৰ সৈনিক হয়ে তছনছ করতে আসছে মাটির পৃথিবী। দিনমানে শীত করতে লাগল। সকাল থেকেই হালকা শীতের আবরণে ছেয়ে গেছে প্রকৃতি। ভেড়িবাঁধের জন্য অনন্তর ভিটের রেহাই। বাতাস আটকে যাচ্ছে। বাতাসের গর্জন তো কানে আসছে ভানুর।

ভানু বলল, এই দুর্যোগে বেরিও না।

না বেরোলে খাব কী?

এখেনে মিলবে না, অলঙ্কারপুরে?

চাল মিলবে, তেল মিলবে, কিন্তু আর সব তো মিলবেনি, পেলাসটিক তো চাই, একখানা না দুখানা, ঘরের টালিও গেছে একটা। অনন্ত বলে।

তাহলে বাসে যাও।

বাসেই তো যাব।

ভানু বলল, আমিও যাই।

তুমি যাবে কেনে, আমি ইলিশ আনব।

ভানু বলল, ঘুরে আসি।

বৃষ্টির ভিতরে দুজন বেরোয় একটি আধভাঙা ছাতা মাথায় দিয়ে। অনন্তর ভিটে থেকে বাসরাস্তা অনেকটা দূর। বাসরাস্তায় পৌঁছতেই ভিজে যায় ওরা। দীঘায় নেমে ভানু বলে, আমি আর যাব না।

যাবানি কেনে? ইলিশটা খাবে কে?

ভানু হাসে, তুমরা খাও, আমি মাইতিবাবুর নিকট যাই, দুর্যোগ বাড়ছে, সাগর কেমন ফুলছে, গতিক সুবিধের নয়, তুমি তাড়াতাড়ি ঘুরে যাও।

অনন্তকে ছেড়ে ভানু নিশ্চিন্ত হলো। হাঁপিয়ে উঠেছিল। অত শোকের ভিতরে থাকা যায় না! এই কদিন ধরে কান্নার ভিতরে ছিল যেন সে। কী বুক ফাটানো বিলাপ! ভানু হাঁটছে হাওয়া বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। আকাশ ডাকছে। মেঘে মেঘে লড়াই লেগেছে। আকাশ ভেঙে বাজ পড়ল কোথায়। ভানুর মাথায় মেঘ বৃষ্টির আকাশ, পৃথিবী। রাস্তা শূন্য। সে ভিজতে ভিজতে এগোয়! বাঁ দিকে সমুদ্রের বাঁধানো পাড় ধরে এগোতে থাকে। সমুদ্র পাগল হয়ে বোল্ডারে ধাক্কা মারছিল। বাতাসে ঘূর্ণী। সেই ঘূর্ণীতে জল ফুলছে। ভানুর ভয় করতে লাগল। সমুদ্রের এই চেহারা সে তেমন দেখেনি। বছর তিন আগে যখন সমুদ্র উঠে পড়েছিল ওপরে, তখন ভানু, ঠিক সেই সময়ে, ছিল না এখানে। পরে এসে দেখেছিল সমুদ্র দূরে স্তব্ধ হয়ে আছে। শাসিত হয়েছে যেন বুনো ঘোড়া। শান্ত হয়ে চরছে। আর দীঘা নগর ভেঙেচুরে একাকার। সমুদ্র খেয়ে ফেলেছিল অনেকটা। ভানুর মনে হচ্ছে সেই রকম ক্ষেপেছে সমুদ্র। বুনো ঘোড়ার রোষ জেগে উঠেছে তার ভিতরে। জল পাকিয়ে পাকিয়ে, ফেনায়িত হয়ে, ঘন মেঘপুঞ্জের মতো ওপরে উঠে, ভীষণ শব্দে ফেটে যাচ্ছে। মস্ত বড় বড় ঢেউ এসে ঘা মারছে বোল্ডারে বাঁধানো পাড়ে। বৃষ্টির ভিতর চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর জেগে উঠছে কোথাও। ভানু ছুটতে আরম্ভ করল। দিনের আলো এই সকালেই নিভে এসেছে। মেঘ অন্ধকার ব্যাপ্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আলো ক্রমশ শুষে নিচ্ছে মেঘ। মেঘ উঠেছে সমুদ্রের দিগন্ত থেকে। জল আর মেঘ একাকার হয়ে সমুদ্র এক বিপুল অন্ধকারের স্তূপ হয়ে উঠছে। ভানুর মনে হলো সমুদ্রের জল মেঘে ভর দিয়ে উঠে পড়েছে আকাশে। আকাশ থেকে জলরাশি নেমে এখনই ভাসিয়ে দেবে সব।

ছুটতে ছুটতে সে পৌঁছল সমুদ্রপাখি হোটেলে। হোটেলের সামনে কিচেনের বেঞ্চে বসে আছে ঠাকুর-ঠাকুরানি। ডিমভাজা দিয়ে চা খাচ্ছে। ভানুকে দেখেই ঠাকুর লাফ দিয়ে ওঠে, ছিলা কোনঠে, বাবু যে থানায় যাবে কইছিলা।

ভানু স্নান করে এসেছে। জামা খুলে নিঙড়োতে লাগল, চা দাও দেখি।

ঠাকুরানি শুকনো গামছা এনে দেয়, কুথা থেকে আসা হচ্ছে?

মাইতিবাবু আছে?

কেনে, ঘুড়ার খবর এলো? ঠাকুরানি হাসে।

ভানু বলে, শুকনো কাপড় দাও।

ঠাকুরানি ছুটে গিয়ে ঠাকুরের একটা লুঙ্গি নিয়ে আসে। ভানু কিচেনের ভিতর ঢুকে উনুনের আগুনে গা সেঁকে নেয়।

অনেকক্ষণ বাদে হোটেলের ঘরে বসে ভানু আর ঠাকুর কথা বলছিল। ঠাকুর ভালো মানুষটি হয়ে বসে আছে, বলল, সে কিছুই জানে না।

ভানু বলে, মদনানি সায়েবের সঙ্গে আলাপ করাল কে?

ঠাকুর হেসে বলে, আলাপ সেই করিয়েছিল, কিন্তু তাতে কী?

সমস্ত দুপুর ধরে ভানু ঘুমোয়। আহা! কতদিন বাদে সে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারল। এ ঘুমের ভিতরে কোনো কান্না ছিল না, শোক ছিল না। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির শব্দ আর ঝড়ের শোঁ শোঁ তার ঘুমের ভিতরে প্রবেশ করে ঘুম গভীর করে তোলে। সেই ঘুমের ভিতরে হাজির হয় পক্ষিরাজ! এমন স্বপ্ন তো দেখেনি কোনো দিন! ভানু দেখছিল বালির সমুদ্রে ছুটছে তার ঘোড়াটি। ছুটেই চলেছে সে। ক্ষুরের দাপানিতে বালি উড়ছে। উড়ছে শুধু। বালির ঝড়ে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে সমস্ত দিক। ভানু ডাক শুনছিল। বালির অন্তঃস্থল থেকে যেন ডাক উঠে আসছিল! ভানু হে!

ঘুম ভাঙতে সে দেখল মাইতিবাবু ডাকছে। সশব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ে ভানু, বাবু কখন এলেন?

তুই এলি কখন?

এই তো সকালা, বাবু, আছেন কেমন?

শ্রীপতি মাইতি বলল, আছি তো আছি, খোঁজ পেলি?

ভানু বাইরে গিয়ে চোখে জল দিল। বৃষ্টি একটু কমেছে কিন্তু বাতাস যেন বাড়ছে। আলো মরে এসেছে প্রায়। ভানু ঘরে এস মেঝেতে বসে দেয়ালে পিঠ দিয়ে, বলে, বাবু যেদিন অশ্বটি পলায়, ওদিন বুদ্ধ পূর্ণিমা ছিল মনে আছে?

আছে, কেন মনে থাকবে না?

ভানু বলল পোখরানের কথা। শুনে শ্রীপতির কোনো ভাবান্তর হয় না। বলল, ওসব ভেবে লাভ কী, ঘোড়া কতদূর গেল?

বাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করি।

কী কথা? শ্রীপতি সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দেয়।

এই যে মরুভূমি, সেখানে অত বালি কেন?

শ্রীপতি বলে, বালি না হলে মরুভূমিই তো হয় না।  জানি, কিন্তু মরুভূমি হলো কী করে?

জানিনে তো, সাগর শুকিয়ে হয়েছে নাকি!

ভানু বলল, ঠিক বলেছেন, মীরগোদার সমুদ্র, জাহাজঘাটা তো দেখেছেন, বালি আর বালি, মরুভূমি তো।

শ্রীপতি বলল, না জল আছে, মরুদ্যান বুঝিস?

বুঝি, মরুভূমির যেখেনে জল আর গাছ থাকে।

ঠিক, মীরগোদার মরুভূমিতে তা আছে।

ভানু টের পায় কী বলতে চায় শ্রীপতি মাইতি। সে প্রসঙ্গ ঘুরোতে চায়, থর মরুভূমিতে সমুদ্র ছিল কি না তা জিজ্ঞেস করে, তো শ্রীপতি বলে উঠল, কোকিলা বধূ, কুহকিনী।

ভানু চুপ করে থাকে। শ্রীপতি মাইতি তার মীরগোদা যাত্রার কথা বলে। ভানুর তো সব জানা। কিন্তু জানা ছিল না শ্রীপতি সেই জন্য তার আর এক প্রেমিকা, অনুরাগিণী ভারতী চৌধুরীর স্বত্ব ত্যাগ করার কথা বলবে। ভারতীর জন্য পরিবারে অশান্তি বাড়ছে, পরিবারে অশান্তি থাকলে কোনো কাজই ঠিকমতো করা যায় না। ভারতীকে সে বদলি করাবে এখান থেকে। উত্তর বাংলায় পাঠিয়ে দেবে। সাগর থেকে পাহাড়ে। সবই করবে, কিন্তু মরদঞ্জিওয়ালার বউটাকে যে মনে ধরেছে। অমন কুহকিনী, মায়াবিনী কেন মদরঞ্জিওয়ালার মায়ার থাকবে? ভানুকে ব্যবস্থা করতে হবে।

ভানু খোলা দরজার বাইরে ঘনায়মান অন্ধকার দেখে। বাতাসের উন্মত্ততা অনুভব করে। ভানুর মনে পড়ে মীরগোদা জাহাজঘাটায় বালিয়াড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা মায়াবিনীর কথা। শ্রীপতি ঈষৎ পান করে এসেছে। শ্রীপতির চোখের মণির ঘূর্ণন দেখে ভানু। সে কথা বদলায়, বলে, বাবু, সত্যি কি থর মরুভূমি সমুদ্র ছিল?

কী দরকার, জেনে কী হবে? সাহারা মরুভূমি?

ওসবে কী দরকার?

কালাহারি কোথায়, আফ্রিকায়?

এত মরুভূমি দিয়ে কী করবি?

সব কি সমুদ্রের ফেলে যাওয়া বালি?

হবে তা, মীরগোদাও তো তাই।

ভানু বলল, এই পৃথিবী সমুদ্রের তলায় ছিল?

ছিল বোধহয়।

আপনি জানেন আপনার ঘোড়া কারে ফেলে রেখে শূন্যপৃষ্ঠ নিয়ে ফিরে এসেছিল?

এক কথা কতবার বলবি?

ভানু বলল, তার সঙ্গে আর কে ছিল?

ওফ, চুপ করবি! বিরক্ত হয়ে ওঠে শ্রীপতি মাইতি, বলল, কোকিলারে আমার চাই, তুই ঘোড়া না আনতে পারিস এইটে করবি।

কী করব?

কোকিলার কাছে নিয়ে যাবি আমাকে?

ভানু বলল, ঘোড়া আঁকছে সে।

চাইনে, আমি মেয়েমানুষটারে চাই, হোটেলে ঘর দেব ওর জন্যে।

ভানু বলল, বাবু থামেন, আপনার নেশা হয়ে গেছে, আপনি টের পাচ্ছেন না, আপনারে সে কুহক করেছে, তার মায়ায় ভুলেছেন।

তার মানে?

মানে, এরপর আপনারে বন্দি করে রেখে দেবে।

কী হবে তাতে?

আপনাকে গাছ করে রেখে দেবে বনে, কেউ জানতেও পারবে না, ওই কোকিলার দিদিমা ছিল আরবি জাদুকরীর মেয়ে, কি বুঝলেন?

শ্রীপতি চোখ ডলে, এসব সত্যি?

সত্যি তো নিশ্চয়।

শ্রীপতি বিড়বিড় করে, আরবি জাদুকরী! কিন্তু মেয়েটা যে বড় টানছেরে ভানু, গাছ হই হব, কিন্তু আমি যে চাই তারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *