বাইশ
নেশায় এলিয়ে গিয়েছিল শ্রীপতি মাইতি। চোখ বুজে গিয়েছিল তার। সমস্ত শরীর নিথর হয়ে গিয়েছিল। আচমকা সব একসঙ্গে জেগে উঠল। ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠে শ্রীপতি দেখল ঘোর অন্ধকার। তার ঘুমের ব্যবস্থা পাকা করে গেছে ভানু! যেন জানে তার শরীর কখন কী চায়? শ্রীপতি অন্ধকারে বসে হাসে, এই শরীরটা তার নিজের, না ভানু দাসের? হাসতে হাসতেই চমকে উঠে সে জানালার দিকে তাকিয়ে। ওই যে তার ঘোড়া। ওই যে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে দাঁড়িয়ে থাকত। কী আশ্চর্য! কখন এলো? নিজে নিজে ফিরে এলো? নাকি ভানু দাসই খুঁজে আনল বালিমুণ্ডা থেকে? নাকি কুহকিনী কোকিলা মুক্ত করে দিয়েছে ওকে? আহারে, কুহকিনী তোকে নিংড়ে নিয়েছে! কুহকিনীর মায়ায় যে-পুরুষ ভোলে, সে, পুরুষ কি আর পুরুষ থাকে? তার সব নিঙড়ে ছিবড়ে করে ফেলে দেয় না! তবে হ্যাঁ, কোকিলা বড় সুন্দরী। কালোর ভেতরে অমন সুন্দর মেয়েমানুষ খুব বেশি দেখেনি শ্রীপতি। কেমন বুনো বুনো ভাব! কাছে গেলেই মনে হয় জঙ্গলে বৃষ্টি হয়ে গেছে। গন্ধ উঠছে মাটি থেকে। সেই গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে বনময়। ঠিক তাই! ভারতী, মধুমিতারা কেউ না কোকিলার কাছে। পারলে কোকিলাকে আলাদা ঘর বানিয়ে দেয় শ্রীপতি। পর্নকুটির বানিয়ে দেয়। সেখানে থাকুক কুহকিনী। তার কুহকে ভুলে শ্রীপতি ছুটে যাক। পারলে বালিমুণ্ডার চাষবাড়িতে রেখে দেয় শ্রীপতি কিন্তু সেই চাষবাড়ির আয়ুও যে ঘনিয়ে এসেছে। সরকার নিয়ে নিলে কোকিলা যাবে কোথায়? তাহলে বনে ছেড়ে দেবে। বনের পাখিকে খাঁচায় পুরেছে গৌরমোহন মদরঞ্জিওয়ালা। কোকিলাকে বনে ছেড়ে দিলেই আবার ফিরে আসবে কপালকুণ্ডলা। শ্রীপতির দুচোখ মায়ায় ভরে যায়। আহারে, তোরে কিনা গৌরমোহন তার ঘরে তুলল, আর সেই রাগে তুই আমার পক্ষিরাজকে কুহকে বন্দি করলি। আর সেই পক্ষিরাজ খুঁজতে খুঁজতে ভানু কিনা দেখে আসে চাঁদবালি পুড়ছে।
যাক! নিশ্চিন্ত হয়েছে শ্রীপতি। ছাড়া পেয়েছে পক্ষিরাজ। আহা, কত রোগা হয়ে গেছে। কুহকিনী তাকে যেন গিলে খেয়েছিল। অমন রূপবান ঘোড়া, তাকে নেবে ছাড়া কাকে নেবে? শ্রীপতি চাপা গলায় ডাকে, ফিরে এলি?
এলাম। ঘোড়া জবাব দেয়।
কুহকিনীর পাল্লায় পড়েছিলি?
ঘাড় কাত করে পক্ষিরাজ, হ্যাঁ।
ও আরব দেশের মেয়েমানুষ, সাবধান, আবার টানবে।
পক্ষিরাজ গা ঝাড়া দেয়, বলে, আমি কী করব?
কেন?
সবদিক খোলা, যেদিক দিয়ে পারে টানে।
শ্রীপতি বলল, কোথায় গিছিলি?
চোদ্দবেড়িয়া।
সে কোথায়?
যেখেনে সুবর্ণরেখা নদী মিশেছে সমুদ্রের সঙ্গে, চাঁদবালির কাছে, আশ্বিন মাসে সে জায়গা কী সুন্দর!
আশ্বিন কই, এ তো শ্রাবণ।
আমি বলছি আশ্বিনের কথা, মনে আছে?
শ্রীপতি বলল, আছে।
খুব বর্ষার পর সেই বর্ষা যখন থামল, আকাশ পরিষ্কার, যত মেঘ উঠেছিল সমুদ্দুর থেকে, সব বৃষ্টি হয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে পৃথিবী, মনে পড়ে?
পড়ে মনে। নিঃঝুম হয় শ্রীপতি। কোন নাম বলল যেন, চোদ্দবেড়িয়া? ভানু তো চোদ্দবেড়িয়া থেকে উদ্ধার করে এনেছে পক্ষিরাজকে ক’বার। আশ্বিন মাস, বর্ষা শেষে পৃথিবী সেজে উঠেছে। ধুলোময়লা সব বৃষ্টির জলে ধুয়ে সাফ। বাতাস ঠাণ্ডা, নরম। কমাস বৃষ্টির জন্য মাটির ভিতর থেকে কী যেন বেরোয় তখন? কী বেরোয়? না, হাজার হাজার সাদা ঘোড়া, পক্ষিরাজ। কাশফুলে চোদ্দবেড়িয়ার চরটা ছেয়ে যায়। আর সবুজ ঘাস! এত ঘাসের, এত সবুজের সমারোহ কেউ দেখেনি।
শ্রীপতি বলল, রোগা হয়ে গেছিস।
পক্ষিরাজ হাসল যেন, অন্ধকার মুখে হাসিটা যেন আরও অন্ধকার।
শ্রীপতি বলল, তোর খোঁজে ভানু কত দিক না যাচ্ছে।
পক্ষিরাজ ঘাড় কাত করে, জানি।
আছে এক মদরঞ্জিওয়ালা, নাম তার গৌরমোহন, তার মদরঞ্জিতে যত খাটুনি তত আয় নেই, সেও গেল তোরে খুঁজতে।
পক্ষিরাজ ঘাড় কাত করে, জানি।
ঘরে আছে কোকিলা বধূ একা।
তাও জানি।
একা বলে তোকে ছেড়ে দিল কুহকিনী?
কী জানি!
ছিলি কোথায়?
কী জানি?
ঘুমিয়ে ছিলি নাকি?
হয়তো তাই, মনে হয় যেন তাই।
কবে, সেই বৈশাখ মাসে গেলি, তারপর ঘুমিয়ে কাটালি?
বোধহয় তাই, কিছুই মনে নেই।
সত্যি! শ্ৰীপতি মাইতি ফিসফিস করল।
সত্যি।
কিছু মনে নেই?
না।
কোথায় ছিলি জানিসনে?
না।
শ্রীপতি বলল, কুহকে অমন হয়।
পক্ষিরাজ হাসে, কী হয়?
যেমন তোর হয়েছে।
কী হয়েছে মাইতিবাবু?
কী হয়েছে। শ্রীপতি মনে করতে চায় কী হয়েছে। মনে পড়ে তো অন্য কথা। সেই যে ভানু বলেছিল, সেই যে চোদ্দবেড়িয়া গেল পক্ষিরাজ। হেই, তোর কি মনে পড়ে চোদ্দবেড়িয়ার কথা, সেই যেখানে সুবর্ণরেখা নদী…। পক্ষিরাজ হাসে। স্পষ্ট হাসির শব্দ শুনল শ্রীপতি মাইতি, আমি ছাড়া কে চেনে চোদ্দবেড়িয়া?
শ্রীপতি বলল, তোর মনে পড়ে?
পক্ষিরাজ আবার হাসে, জিজ্ঞেস করে, তুমি জানো শ্রীপতিবাবু?
শ্রীপতি মগ্ন হয়। জানে সে। মনে পড়ে। মনের ভিতর ছেয়ে যায় চোদ্দবেড়িয়ার আকাশ। আকাশে বকের পালকের মতো মেঘ উড়ছে। চরের কাশফুল যেন হাজারটা ডানা মেলা বক। পাখা মেলে উড়ন্ত ভঙ্গি তাদের। আর পায়ের নিচে যে ঘাস…।
ঘাসের ভিতর গুটি গুটি লাল ভেলভেট রঙের লালবিবি পোকা ঘুরে বেড়ায়। সবুজে, সিঁদুরে ফোটায়, নীল ডোরায় ডোরায় চিত্র-বিচিত্র গঙ্গাফড়িং লাফ দিয়ে ঘাসের ওপরে খেলা করে। গুটি গুটি এগোয় সবুজ কাচপোকারা। তাদের সবার কী ফুর্তি! লালবিবির, গঙ্গা ফড়িংয়ের, কাচপোকার, সবার সঙ্গে সবার খেলা।
একবার ঘুরতে ঘুরতে ঘোড়াটা গিয়ে পড়েছিল তার ভিতরে। শ্রীপতি গেছে বালিমুণ্ডায় চাষবাড়িতে, ভানু ঘোড়ার পিঠে চেপে চলল চন্দনেশ্বর। ভানুর মাথায় নীল পাগড়ি, গায়ে সাদা জামা, নতুন ধুতি। ও যাচ্ছে চন্দনেশ্বর নয়, যেন জগৎ সফরে বেরিয়েছে।
ভানু গেল চন্দনেশ্বরে। শিবের পুজো দিল। মানতও ছিল ওর। তারপর চুল ফেলে ন্যাড়া হয়ে হত্যে দিল ভগবানের কাছে। আমি, পক্ষিরাজ, তখন দাঁড়িয়েছি হাটের কাছে একটা চালার ধারে। হাটের গন্ধ ভালো লাগছিল না।
এই সময় ন্যাড়া মাথায় ভানু ফিরল। মাথায় পাগড়ি। উঠে বসল আমার পিঠে। কোথায় যাবে, কোথায়? বাংলায় না ওড়িশায়? আমার ভিতরে তখন অন্য এক আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছে।
ঘোড়ার মুখে ফুটে উঠেছিল দুর্দমভাব। পৌরুষের চিহ্ন। ও গা ঝাড়া দিল। লেজ ঝাপটে নিল। ঘাড়টা ঘুরিয়ে নিল। হাঁ করে নিঃশ্বাস টানতে লাগল। কোথায় যেন যাবে? বৃষ্টির মেঘ উধাও হয়ে আকাশে কারা যেন ভেসেছে। সাদা পক্ষিরাজ। বাতাসে কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব।
ভানু ফিরতে চায় তখন। কোথায় ফিরবে? দীঘায়! আমি পক্ষিরাজ। আমি কন্থক। আমার দেহটা তখন ফুলছে। নাহ্, ওদিকে নয়। দৌড়াই পশ্চিমে। পশ্চিমে আর পশ্চিমে। নাকে টেনে নিচ্ছি পৃথিবীর ঘ্রাণ। চোখে যেন কী ভেসে উঠছে। মন কোনো দিকে যেন লাফ দিয়ে ছুটছে। সমুদ্র থাকল বাঁয়ে, দক্ষিণে। আমি যাই পশ্চিমে। কেয়াঝোপ, ঝাউবন, পিচরাস্তা, মেঠো রাস্তা, বালির স্তূপ, বালিয়াড়ি আর বালির দেশ পার হয়ে ঘণ্টা দেড়েকের ভিতর পৌঁছে গেছি স্বর্গে। স্বৰ্গ চোদ্দবেড়িয়া।
ভানু! না পিঠে নেই, উলটে পড়ে গেছে। কী বেগেই না ছুটেছিল পক্ষিরাজ! হাওয়ার মতো আছড়ে পড়েছে চোদ্দবেড়িয়ায়।
তারপর? শ্রীপতি জিজ্ঞেস করল।
সব তো জানো তুমি মাইতিবাবু।
কী হলো তখন? শ্রীপতি জিজ্ঞেস করে।
আমি তো তখন চোদ্দবেড়িয়ায় ঢুকে পড়েছি মাইতিবাবু। আহা, কী সে জায়গা, তুমি ভুলে গেলে সব!
মাথা নাড়ে শ্রীপতি, না, তবে আবার বলো।
পক্ষিরাজ ফিসফিস করে, কী আশ্চর্য! এখনও মনে পড়লে গা কাঁপে।
বলে যা। চাপা গলায় বলে শ্রীপতি।
হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এ আমি কোথায় এলাম? একটা নয়, দুটো নয়, কত কত ঘোড়া। কত রকমের চেহারা। মাদি, মদ্দা, ওরা সব এলো কোত্থেকে! আর এত সাদা কাশফুল! ঐ তো দূরে সমুদ্র। নীল, কী নীল! গর্জন শোনা যায়। আর এই নদী! এর নাম স্বর্ণরেখা! কত কত বড়! ফুলে ফেঁপে একাকার। টলমল করছে জল। নদী সমুদ্র মিশে নদীও নেই সমুদ্রও নেই, মহাসিন্ধু হয়ে গেছে। সবুজের মেলা এই চরে। ঘাস খেতে এসেছে আরও কত ঘোড়া। কে যেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। একটা ঘুড়ী, তাই না!
ঘর কোথায়? পক্ষিরাজ জিজ্ঞেস করে।
হিনাড়ি, গিরিমশায়ের বাড়ি।
কোত্থেকে আসা হলো? পক্ষিরাজ জিজ্ঞেস করে।
ভোগরাই। আর একটা ঘোড়া জবাব দেয়।
আর তুমি?
এলাম রানীশাহী থেকে।
হাসতে হাসতে সব লুটোপুটি খাচ্ছে। ডিগবাজি, আনন্দ ফুর্তি! ঘাস মুখে নিয়ে দৌড়চ্ছে। কাশের জঙ্গলে গিয়ে লাফ দিয়ে কাশফুল হয়ে যাচ্ছে। হামলে পড়ছে কেয়ার ঝোপে, সবুজ ঘাসে। এ ওর মুখে মুখে কথা বলছে, কানে কানে ফিসফাস। গান! আহা, বাতাসে লাফ দিয়ে উঠছে হিনাড়ির সেই রূপসী ঘুড়ীটা। একেবারে সাদা। গায়ে কোথাও কোনো অন্য রকম ছিটে নেই। শুধু কপালে একটা, দুটো, তিনটে, বাদামি ফোটা।
হ্যাঁ, হিনাড়ির সেই ঘুড়ীটাও পালিয়ে এসেছে। সব্বাই পালিয়ে এসেছে। তারা বছর বছর আসে এই চরে। এখানে পালিয়ে এসে কদিন খুব ফুর্তি করে। ফুর্তি করতে করতে দিন পার করে। আর এই আশ্বিনের দিন যে খুব ছোট। কত তাড়াতাড়ি তার আয়ু ফুরিয়ে বেলা নেমে যায়। তখন ঘোড়ারা চরের ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে সমদ্রের দিকে চেয়ে থাকে। পালতোলা মাছের নৌকো, লঞ্চের আলো, শব্দ, সমুদ্রের ঐ দূর কিনারায়। জাহাজের সার্চলাইটে সকলে চমকে ওঠে। আকাশের তুলতুলে মেঘে অবাক হয়ে যায়। তাতে আবার জ্যোৎস্না। চাঁদের আলোয় সেই রূপসী কেমন মায়াবতী হয়ে ওঠে।
শ্রীপতি বলল, তারা সব কুহকিনী।
ওরা কী সুন্দর! গুনগুন করে পক্ষিরাজ।
রূপবতী?
হ্যাঁ।
ওই রূপই সব্বোনাশী।
আহা, মনে পড়ে যে, খুউব মনে পড়ে। শুধু কি ওই রূপসী ঘুড়ী, আকাশে যে মেঘ ছিল!
বলো, বলে যাও। শ্রীপতি ফিসফিস করে।
সেই যে মেঘেরা! সোনালি মেঘ, সাদা মেঘেরা আসলে আমাদের দোসর নীল পক্ষিরাজের সাদা ডানা। ঝুপ করে নেমে পড়বে এখানে। আর নামতেই রাত ফুরিয়ে যাবে। তখন শুধু খেলা আর খেলা, আনন্দের ভিতরে চৌপাট হয়ে যাওয়া। এই রকম ভাবতে ভাবতে ঘোড়াদের চোখ জুড়িয়ে আসে। রাত বয়ে যায়।
তারপর কী হলো? শ্রীপতি জিজ্ঞেস করে।
সব তো তুমি জানো। পক্ষিরাজ বলে।
ভানু, ভানুকে জিজ্ঞেস করলে সব জানা যাবে, ভানু জানে। শ্রীপতি বলে।
ন্যাড়া মাথা ভানু যে কী করে খবর পেল আমি আছি চোদ্দবেড়িয়া, কে যে ওকে খবর দিয়েছিল ঘোড়ারা পালিয়ে যায় ওখানে।
কী অদ্ভুত! শ্ৰীপতি বলে।
হ্যাঁ, পালিয়ে যাওয়ার জায়গা, যার পালায় তারা ওখানে যায়, ওখান থেকে কেউ পালায় না।
কী হলো বলো। শ্রীপতি ডাকে।
ভানু গিয়ে হাজির হলো সেই চরে, আমাকে ঠিক চিনে ফেলল।
হিনাড়ির ঘুড়ীটা জিজ্ঞেস করল, কে?
মালিকের লোক।
নিতে এসেছে?
সেই রূপসী দূর থেকে দেখতে থাকে ভানুকে। তারপর বিড়বিড় করে বলে, প্রথম প্রথম এই রকম হয়, আমাদেরও হয়েছিল, বড় দড়ির ফাঁস দিয়ে আটকে ফেলেছিল আমাকে। এখন আর পারে না, বুঝেও গেছে একেবারে পালাচ্ছি না, ফিরে তো যাব।
ভানু কত ডাকল! ঘোড়াটা সাড়া দিল না। ভানু তখন ধরতে গেল। পারল না, আমি তখন পালিয়ে গেছি লাফ দিয়ে। এই মস্ত চরভূমিতে ভানু আমার সঙ্গে কতক্ষণ যুঝবে। পারে না। ফিরে যায়।
ভানু গেল দীঘায়। ততক্ষণে শ্রীপতি ফিরে এসেছে। শ্রীপতিকে নিয়ে আর একটা দশাসই লোক সঙ্গে ভানু চলল চোদ্দবেড়িয়া। কিন্তু চোদ্দবেড়িয়া যেতে হলো না।
তখন উত্তরের হাওয়া আসতে আরম্ভ করেছে। শুকনো ঠাণ্ডা বাতাস। গায়ের জল, ঘাসের রস, পৃথিবীর রস শুষে নিয়ে সেই বাতাস চলে যায় অনন্ত নীলের দিকে। সেই সময় ঘোড়ারা দেখে কাশবনের রং মরে যাচ্ছে, ঘাস আর ফুলের গায়ে পড়ছে পোড়া পোড়া ছোপ। গাছের পাতারা নড়ছে না। কেয়াঝোপে পুরু করে ময়লা জমতে শুরু করেছে। সেই সময়ে ঘোড়ারা চর ছাড়তে আরম্ভ করে। তৃপ্ত হয়েছে সকলে। তৃপ্তির চিহ্ন চোখেমুখে, এবার আবার লোকালয়ে।
তাহলে ও শুধু আশ্বিনের স্বর্গ?
হ্যাঁ।
পরে আর থাকা গেল না?
না।
আশ্বিনে ওখানে পালায়?
হ্যাঁ, তুমিও আসতে পারো মাইতিবাবু।
হিনাড়ির কুহকিনীর জন্য? হা হা করে হাসে শ্রীপতি, কোকিলা কি থাকবে ওখানে?
সে কে?
যে বন্দি করেছিল তোকে।
পক্ষিরাজ বলে, তারে তো চিনিনে। সে কি কোকিলার চেয়েও রূপসী?
কে?
হিনাড়ির ঘুড়ী।
কী জানি! কোকিলাকে তো দেখিনি।
বন্দি করেছিল তোরে?
মনে নেই।
কুহক করেছিল?
মনে নেই, পক্ষিরাজ বলে, মনে আছে, ভানুবাবুর সঙ্গে ফাঁস নিয়ে আসছে একটা ষণ্ডামার্কা লোক, কী স্বাস্থ্য! দেখলে ভয় করে।
ষণ্ডামতো লোকটা একটা শক্ত দড়ির ফাঁস নিয়ে যাচ্ছিল ভানু আর শ্রীপতির সঙ্গে, যেতে যেতে সে বলল, এ বড় বদ অভ্যেস, মাদি ঘোড়ার পাল্লায় পড়লে ও না ফিরতেও পারে।
শ্রীপতি ক্ষেপে গিয়ে বলল, সামাল দিতে পারিসনি!
ভানু তখন হেসে বলল, আমি জানি ওখানে এখন একটাও মাদি নেই, অশ্ব ঠিক ফিরবে, ফিরবে, না হয় থাকবে।
ঠিক এই সময়ে ওরা দেখল দূরের বালির পথ ধরে ঘোড়াটা আসছে। ঘাড় উঁচু করে দেখছে চারদিক।
ষণ্ডা লোকটা ফুঁসে উঠল, ফাঁসটা দুলিয়ে নিয়ে শ্রীপতিকে জিজ্ঞেস করল, ধরে ফেলব, আপনার অশ্ব তো বটে।
শ্রীপতি দেখল লোকটার দুই উরু ফুলে উঠেছে। দুই চোখ ঠেলে বেরোচ্ছে। লোকটা ছুটে যেতেই শ্রীপতি আটকাল, না, ও আসছে?
হ্যাঁ, ঘোড়াটা ফিরছে তাদের দিকে। চিনেও তো অন্য পথে যাচ্ছে না। খুব আস্তে আস্তে হাঁটছে। চাকচিক্য ফিরছে। আর সেই দুর্দম বেগ নেই। খ্যাপা স্বভাব নেই। তৃপ্তিতে শ্লথ।
খুব আস্তে আস্তে এসে ও ধরা দিল। কিন্তু পরের বছর ওই আশ্বিনের প্রথমেই আবার ছুটে গেল চোদ্দবেড়িয়ার আকাশ নামানো চরে, ঘাসের ভিতর, কাশফুলের ভিতর।
শ্রীপতি হাসে, আবার গেলি!
আশ্বিনে যে হিনাড়ির মেয়েছেলেটা ডাকে বাবু, সারা বছর মনে পড়ে না, ওই সময়ে মনে পড়ে।
এবার তো আশ্বিন ছিল না।
ছিল না! বিস্মিত হয় পক্ষিরাজ, তাহলে কী ছিল?
তুই জানিসনে?
না তো! কেঁদে ওঠে শ্রীপতি মাইতির ঘোড়া।
সে তো ছিল বৈশাখ মাস।
হ্যাঁ, হ্যাঁ বৈশাখ, ওইটাই তো ধন্দ বাবু, বৈশাখ মাসে কী করে পালায় সে! এগিয়ে এলো ভানু, আমার মাথায় কিছুতেই ঢোকে না।
শ্রীপতি বলল, সে কই?
কে, কার কথা জিজ্ঞেস করছেন?
পক্ষিরাজ।
আমিও তো সেই কথা জিজ্ঞেস করি, গেল কোথায় আমার কন্থক?
এই তো ছিল। বলল শ্ৰীপতি।
এই না, অনেক আগে ছিল বলতে পারেন।
তুই সর দেখি জানালা থেকে। শ্রীপতি ধমকে ওঠে।
ভানু বলল, একটা কথা বলতে এলাম।
কী কথা?
ভানু বলল, আজ রাতে আপনি কি হোটেলে থাকবেন বাবু?
কেন?
থাকুন না, আজ রাতটায় খুব দুর্যোগ। ভানু হাসতে থাকে।
শ্রীপতি মাথা নাড়ে, উঁহু, সরে যা জানালা থেকে।
ভানু সরে যেতে শ্রীপতি মাইতি দেখল বালি-স্তূপটা শূন্য। কেউ নেই। কে ছিল ওখানে? পক্ষিরাজ? শ্রীপতি দেখল আকাশ কালো হয়ে মেঘ নেমে এসেছে অনেক নিচে। অন্ধকার রাতটাই মেঘের মতন ছড়িয়ে আছে।
শ্রীপতি বলল, তুই দেখিসনি?
কী দেখব?
অশ্ব, পক্ষিরাজ, ছিল যে এখানে।
হা হা করে হাসে ভানু, আমারে দেখেছেন।
চোওপ! গর্জন করে ওঠে শ্রীপতি। ভানুটা খুব শয়তান। ভানুটা হাসছে। হেসেই যাচ্ছে। ঘোড়াটার জন্য মন যে খারাপ করবে সে, তার উপায়ও নেই। ভানু তার চোখ ঢেকে দিয়ে হা হা করছে।
শ্রীপতি গর্জন করতে চায়, সরে যা সামনে থেকে।
তখন তো কেউ থাকবে না, ঘোড়া না থাকুক ঘোড়াপালক ছন্দক আছে এখন।
চোওপ, ওসব কথা বলবিনে।
ভানু বলল, আমারে দেখে ঘোড়াটার কথা মনে পড়ে না বাবু?
তুই কে?
কন্থক আমার কাছেই তো রয়েছে এত যুগ।
তোর সব মিথ্যে।
তাহলে কন্থকও সত্যি নয়।
গর্জন করতে চায় শ্রীপতি আবার, সরে যা।
ভানু বলল, আমি ছাড়া তোমার ঘোড়া মিথ্যে বাবু, আমার ঘোড়া ছাড়া আমি মিথ্যে, কতকাল ধরে আছি, তখন আকাশে ফুটত সোনালি মেঘ, সে মেঘ আর তো ফুটতে দেখি না। আহা! কী দিন ছিল বাবু, নীল গগন, সোনালি মেঘ, রুপোলি রোদ, নরম বাতাস, দুধের মতো জোছনা। ও মশায়, তখন আকাশে বাতাসে ভগবান, রাজপুত্র মহামানব হয়ে গেছেন। তিনি ভালোবাসিতে কহিলেন, মোরা ভালোবাসিলাম, কন্থক আর ছন্দক, মনে পড়ে বাবু?
বাবু শ্রীপতি মাইতি তার জানালায় নেই।