1 of 2

অশ্বচরিত – ১৯

উনিশ

ভানু জানে না কী হয়েছিল। কখনো মনে হয় সত্য, কখনো মনে হয় দুঃস্বপ্ন। এক দুঃস্বপ্নের ঘোরে সে দেখেছিল সুভদ্রাকে। সমস্ত দিন খেপে খেপে সুভদ্রার কাহিনি শুনে, ঠিকাদার, পুলিশ, সরকারি লোকের সমুদ্র উপকূল দখলের বৃত্তান্ত শুনে, মাথা ভার হয়েছিল সত্যি। তারপর যে কী হলো!

দরজায় টোকা পড়েছিল মধ্য রাতে। ক’প্রহর কেটেছিল সে জানে না। ঘুমোলে সে শুধুই ঘুমায়। জাগে না। শিয়ালের ডাকেও ঘুম ভাঙে না, নৈঃশব্দ্য চিরে ভেসে আসা বিস্ফোরণের শব্দেও ঘুম ভাঙে না। আবার জাগলে সে সর্ব অঙ্গ নিয়েই জাগে। শুয়ে থাকে। ভানু আচমকা জেগে উঠে বসেছিল। দরজার ওপরে কেউ ছিল হয়তো, সে দরজা খুলে বাইরে এসেছিল। দেখেছিল বারান্দার অন্ধকারে সুভদ্রা। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠে এসেছে আকাশে!

সুভদ্রা ডাকে, ভানুবাবু, চলি যাবু?

যাব।

ভানুবাবু, মোর কথা তুমি কহিবে?

কারে কহিব?

সুভদ্রা বলে, ভানুবাবু, আমাদের শেষ করি দিইছে, মোরে পুড়াচ্ছে, ভানুবাবু, তুমি কি মোর কথা কহিবেনি?

কী কহিব?

মোরে কীভাবে…! সুভদ্রা বিড়বিড় করে, ভানুবাবু, কেহ নাই, তুমি শুনিবা আরু কত কথা, নায়েব কত জানে, সবু জানেনি, আবার সবু জানা রহিলেও কহিতে পারেনি, পুরুষমানুষেরও সরম লাগে উ কহিতে।

ভানু আতঙ্কিত হয়েছিল। সুভদ্রা উঠোনে নেমে গিয়েছিল। বৃষ্টি নেই। কৃষ্ণাষ্টমীর চাঁদ আলো ঢালছিল বৃষ্টি ধোয়া চরাচরে। কী সুন্দর আকাশ প্রকৃতি। তার ঘুমের ভিতরেই পৃথিবী এমন সুন্দর হয়ে উঠেছিল। সুভদ্রা তাকে হাতছানি দিয়েছিল। ভানু নেমে গিয়েছিল ভিজে মাটিতে।

নায়েব কোথায়? ভানু জিজ্ঞেস করেছিল।

ঘুমালে উর সাড় থাকেনি।

তুমি ঘুমোওনি?

মাথা নেড়েছিল সুভদ্রা, নিদ আসিবেনি ভানুবাবু, নিদ মোর আঁখি হিতে চলি গিইছে, আসো।

কোথায়?

ভিটার পিছনে।

বালি মাটি। বৃষ্টিতে ভিজে সে মাটি ঠাণ্ডা। সে মাটির কোথাও কোথাও ছোপ ছোপ জল? স্থির হয়ে আছে জলখণ্ড। সেই জলে চাঁদের আলো পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল যেন। ডিঙি নৌকোর মতো চাঁদখানি মাটিতে ধরা সেই সামান্য জলে ভাসছিল।

ভানুবাবু, তুমার সবু জানা দরকার।

ভানু বলল, জেনে কী করব আমি?

তবু জানা দরকার।

ভানু চুপ করে থাকল। কেমন হিমেল ভাব প্রকৃতিতে। ঘরের ভিতরে ঘেমে যাচ্ছিল। ভানু আকাশ দেখল। কালো মেঘের দল সমুদ্র থেকে আসছিল স্থলভূমিতে। চাঁদের কাছাকাছি নেই, কিন্তু চাঁদের আলোয় ভাসছে জলভরা ভারী মেঘ। গাভিন মহিষের মতো শ্লথ গতির মেঘ। আকাশের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল ভানু, সুভদ্রা তখন ডাকে, ভানুবাবু, শুনো।

ভানু চোখ নামায়, ডাকলে কেনে বউ?

সুভদ্রা বলে, তুমি তো দে-পাল, মহাপাতরপুর দিখতে যাচ্ছিলে?

ভানু বলে, সমুদ্দুরটা আমার ভালো লাগে।

সমুদ্দুর তো সব এক।

তাই কি হয় বউ? কোনো সাগরের সঙ্গে কোনো সাগরের মিল নাই।

তাই কহ?

হ্যাঁ, সমুদ্দুর তো শুধু জল নিয়ে হয় না, সমুদ্দুরের পাড়, পাড়ের মাটি, সমুদ্দুরের ধারের গাছগাছালি, মানুষ…।

আশ্চর্য!

ভানু বলে, হ্যাঁ, কত জায়গায় সমুদ্দুর দেখেছি।

বলতে বলতে ভানু দুটি হাত দুই দিকে প্রসারিত করে দেয়। প্রসারণে যেন সমুদ্র দর্শনের ব্যাপ্তি বোঝাতে চায়। চেনাতে চায় সমুদ্র, আকাশ, উপকূল। ফিসফিসিয়ে বলে ভানু, আমি তো হা-ঘরে, চালচুলা নাই বউ, সংসার ভাসি গিইছে, সেসব অনেক কথা, বলার কোনো মানে হয় না।

তবে মোর কথা কেনে শুনতে চাহ?

ভানু বলে, তুমি যদি বলো শুনব, না বললে শুনব না। যদি কহি?

শুনব, আসলে কথাটা তো শুধু তুমার নয় সুভদ্রা বউ, কথাটা এই সমুদ্দুরেরও বটে, দে-পাল, মহাপাত্রপুরেরও বটে।

সুভদ্রা দাঁতে আঁচল চেপে আছে। মাথায় ঘোমটাটি থাকায় নরম চাঁদের আলোয় তাকে দেখাচ্ছে সুন্দর। তাকিয়ে থাকতে হয়। সুভদ্রা তার মাথার ঘোমটা ঈষৎ টেনে জিজ্ঞেস করে, তুমি শুনিলে কী হিবে?

আরও পাঁচজন শুনবে।

তাতেই বা কী হিবে?

ভানু বলে, অনেক লোক জেনে যাবে, দেশের অনেক লোক জেনে যাবে।

তাতেই বা কী হিবে, পোতিকার হিবে?

ভানু বলে, তা আমি কী করে বলি?

তুমি কুছু করিতে পারবনি ভানুবাবু?

ভানু বলে, না, আমি কী করব, দশজনকে জানাতে পারি।

তাতে কী হিবে?

কিছুই না, আবার অনেক লোকে জানলে অনেকটা কাজ হবে, লোকে জানুক এইভাবে গ্রাম উচ্ছেদ হয়।

সুভদ্রা বলল, মোর কথাও কহি দিবি?

দেব তো নিশ্চয়, তুমি কিছু লুকিয়ো না বউ।

সুভদ্রা বলে, ডর লাগে।

কেনে?

পুলুশ কহিছিলা কুছু না কহিতে।

না বললে তো সবাই জানবে না।

কুছু লকে তো জানে।

সবটা জানে?

যেটুকুন জানে তা নিয়েও কুছু তো কহিলনি।

ভানু বলে, কহিছে কি না তুমি বুঝছ কী করে?

দুজনে চুপচাপ। ভানু আকাশে তাকায়। আকাশটা দেখতে ভালো লাগছে। অষ্টমীর চাঁদ, কিন্তু প্রকৃতি এত ধোয়া যে আলোয় ঢেকে গেছে চারপাশ। ঘুম না ভাঙলে এই আকাশ দেখা হতো না।

সুভদ্রা ডাকে, উপরে তাকায়ে তুমি কী বুঝিবা ভানুবাবু?

ভানু ওপরে তাকিয়েই বলে, তুমি বলে যাও।

শুনি কী বুঝিবা ভানুবাবু! কেঁদে উঠল যেন সুভদ্রা, মোর ই অবস্থার কথা কেডা জানে, কেহ লয়, নায়েব টুকুন জানে, ভানুবাবু এই দ্যাখো।

ভানু কৌতূহলে মাথা নামায় আকাশ থেকে। আকাশে অত নরম, স্নিগ্ধ ভাব, মাটির পৃথিবী সম্পূর্ণ বিপরীত। ভানুর দুটি চোখ যেন ঝলসে যায়। দৃষ্টি কুঁকড়ে যায়। হা ভগবান, অন্ধ করে দাও। মনে করলেই কি অন্ধ হওয়া যায়? ভানুকে যে দেখতেই হয়। আবরণহীন নারী দেখতে হয়। আবরণ খুলে ফেলেছে ওই নারী; ওই প্রকৃতি। ক্রমশ সরিয়ে ফেলছে সব যা ঢেকে রেখেছিল তার বুক, পেট, তলপেট, ঊরু, কোমর, নিতম্ব, পিঠ। ঘুরছে নারী। ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে তার পোড়া শরীর। পোড়া বুক, পোড়া পেট, পোড়া চামড়া, পোড়া ঊরু, কোমর, নিতম্ব, পিঠ। ঘুরছে সুভদ্রা, ডাকছে, দিখো হে ভানুবাবু, তুমার গরমিনে কী করিছে।

ভানু চোখ ঘুরিয়ে নেয়, কে করল?

কারে দোষ দিই, সবু লকে।

ভানু অন্য দিকে ফেরে, তুমি নিজেরে ঢাকো বউ।

কেনে, মোরে বেলজ্জে, সরমহীন লাগে?

না বউ লুকাও, আমার গা পুড়ে যাচ্ছে, কী তাপ! বলতে বলতে ভানু ঘুরে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে চেয়ে শ্বাস নেয়। সে ভাবতে পারেনি এমন হতে পারে। অমন সুন্দর শরীরখানিতে অমন কলঙ্ক রেখা এঁকে দিতে পারে কেউ। আগুনের হলকা টের পাচ্ছিল ভানু। না দেখলে ভানু জানত কীভাবে? শুনে বুঝতে পারত না কতটা কী হয়েছে। ভানু মাথা নামায়, ডাকল সুভদ্রাকে, ও বউ, কেউ জানে না তো এসব, লোকে তো শুধু জানে মানুষ উচ্ছেদ হয়েছে।

নৈঃশব্দ্য ভারী হয়ে উঠেছে। ভানু দেখল সামনের জায়গাটি শূন্য। কেউ নেই। চাঁদ বোধহয় ওপরে ঢাকল মেঘে। জ্যোৎস্না হারিয়ে গেল। ভানু চাপা গলায় ডাকল, ও সুভদ্রাবউ, তুমি কই?

জবাব পেল না ভানু। তার মনে হলো কেউ নেই যেন আশপাশে। কেউ ছিল কি? যা দেখেছে তা কি সত্যি? ভানুর চোখে ঘোর লাগে। কই সেই জ্যোৎস্না, কৃষ্ণাষ্টমীর উজ্জ্বল চাঁদটি? ঘন মেঘ তাকে গিলে ফেলল কখন? নাকি ঘন মেঘেই আকাশ ঢেকে আছে সমস্ত দিন, সন্ধ্যাবেলা, প্রথম প্রহর। চাঁদের আলো যদি না ছিল তবে কোন আলোয় সে দেখল সুভদ্রাবউটিকে? সুভদ্রাবউকে দেখেছে, নাকি–! ভানুর গা ছমছম করে ওঠে। সে টের পেল অনেকদূর এসে গেছে। কতদূর সেই কাছারিবাড়ি! সে এলো কখন? কার ডাকে সে বেরিয়ে পড়েছ ঘর থেকে? চোখে এখনও ঘুম লেগে আছে। একটু আগে যা দেখেছে তা কি সত্য, না বিভ্রম? মনের ভুল! অথবা দুঃস্বপ্নের ঘোর! সে দেখল ঘোলাটে অন্ধকার তাকে ঘিরে ফেলেছে। না কোথাও নেই সুভদ্রাবউ। সে তবু চাপা গলায় ডাকল, সাড়া পায় না।

ভানু ধীর পায়ে কাছারিবাড়িতে ফিরতে লাগল। সে ঠিক ধরতে পারছে না কতটা সময় বাইরে রয়েছে। চাঁদের যে স্মৃতি রয়েছে, তাতে চাঁদ আকাশমণ্ডলে অনেকটা উঠেও এসেছে। ভানু টের পায় আবার বৃষ্টি এলো। ফিসফিসে জলকণা উড়ছে। তার মাথা গা ভিজিয়ে দিচ্ছে।

সে কাছারিবাড়িতে ফিরে বসল বারান্দায়। কোথাও কোনো সাড়া নেই। কোনো মানুষের পায়ের শব্দ নেই, কণ্ঠস্বর নেই। অখণ্ড নীরবতায় ভার হয়ে আছে পৃথিবী। ভানু মনে করতে চাইছিল সমস্তটা দিন কী শুনেছে এই বারান্দায় বসে, কখনো ঘরে বসে। তারপর কী দেখেছে সে? যা শুনেছে, যা দেখেছে তা আর যাচাই করবে না সে। ভোরবেলা বেরিয়ে পড়বে দীঘার দিকে।

ঘুমিয়ে পড়েছিল সে বারান্দায় বসেই। তাকে ডেকেছে রামচন্দ্র, ও ভানুবাবু, ইখানে বসি কেনে?

ভানু উঠে দেখল সকাল হয়ে গেছে। দুর্যোগ আরও কঠিন হয়ে এসেছে। আকাশ আরও মেঘের ভারে ভার। সে উঠে বসে চোখ মুছতে লাগল, বলল, দেরি হয়ে গেল, আমি এখন যাব।

কোনথে যাবু?

দীঘা।

রামচন্দ্র বলল, যে কামে এলা তা হলোনি, চলি যাবু?

হয়েছে।

কী হয়েছে, অশ্ব তো খুঁজা হলোনি।

ভানু জবাব দিতে দিতে এদিক ওদিক দেখছিল। কোথায় সুভদ্রা? রামচন্দ্র বলে, মু তো দেখছিনি উয়াকে, সকাল থিকে নাই।

নাই মানে?

কোনথে গিছে।

কোথায় গেল, কখন গেল?

তা তো মু জানিনি ভানুবাবু, কহি তো যায়নি।

ভানু চুপ করে যায়। সমস্ত ঘটনা খুব ঘোলাটে লাগছে তার কাছে। সে বারান্দায় শুয়েছিল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তা খেয়াল নেই। সুভদ্রা কি তখন ফিরে এসেছিল কাছারি ঘরে, নাকি ওই পথ থেকেই চলে গেছে? ভানু বলল, তুমিও টের পাওনি?

না, উ তো ভোর ভোর উঠে।

এমন যায়?

কেমন কহিছ?

যেমন গেছে?

গিছে পাড়ার দিকে হয়তো।

ফিরবে?

হাঁ, ফিরবে নিচ্চয়। রামচন্দ্র বিড়বিড় করে, তারপর বলে, কিন্তু রান্নাশাল, উঠান সব পড়ি আছে, ঝাটপাট দেয় নাই, কী হলো উয়ার? শেষ কথাটা রামচন্দ্র যেন ভানুকেই জিজ্ঞেস করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *