1 of 2

অশ্বচরিত – ৩

তিন

মীরগোদায় নাকি এককালে সমুদ্র ছিল। সেই সমুদ্র, যে সমুদ্র দীঘায় আছে, তালসারিতে আছে, জুনপুটে আছে, খেজুরির ওদিকে আছে। সেই সমুদ্র যে সমুদ্রে সাগরদ্বীপ আছে, ছত্রিশ ঘণ্টা নৌকায় ভাসলে যে দ্বীপে পৌঁছানো যায়, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা, কপিলমুনির আশ্রম।

মীরগোদা ওই সব সমুদ্র, বঙ্গোপসাগর থেকে অনেক উত্তরে, কিন্তু সেখানে বঙ্গোপসাগর ছিল। সমুদ্র কতদূর ছিল কে জানে? ভানু শুনেছে সব সমুদ্র থেকে ওঠা দেশ। মীরগোদায় নাকি জাহাজঘাটা ছিল। এখন সেসবের কোনো চিহ্ন নেই, জলই নেই, তো জাহাজ। কিন্তু জাহাজঘাটা আছে। ধু ধু বালির দেশ মীরগোদা, উঁচু উঁচু বালিয়াড়ি। তার কোলে কোলে ঝাউগাছ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ঝাউছায়ার ওপারে আর এক সমুদ্র, ঝাউবনের ওপারে। জাহাজঘাটায় একটা নদীখাতের মতো ঢাল আছে। সেখানে গঙ্গাপুজো হয় পৌষ সংক্রান্তিতে। গঙ্গাপুজো তো সত্যিকারের সমুদ্রে হয়; মীরগোদায় সমুদ্র নেই, কিন্তু গঙ্গাপুজো আছে। তার মানে সমুদ্র ছিল। সমুদ্র না হোক বড় নদী ছিল। সেই নদীতে জাহাজ ঢুকত। এখন এই গরমের দুপুরে ঝাউবন থিরথির করছে সব সময়। শোঁ শোঁ ডাকছে। মীরগোদা ডেকেছিল ভানুকে। মীরগোদায় জাহাজঘাটা, সমুদ্র চিহ্ন ডেকেছিল ভানুকে। ডেকেছিল শ্রীপতি মাইতির হারানো পক্ষিরাজ তার বেগবান রূপ নিয়ে। ডেকেছিল তার কান্হা, কন্থক শূন্য পৃষ্ঠ নিয়ে।

এই দক্ষিণ থেকে ওই উত্তরের পথের সবটাই বালি। রোদ্দুরের দিনে ঐ পথে হাঁটাই দুষ্কর। বর্ষার জল পড়লে বালি বসে গেলে, মাথায় মেঘ থাকলে তবে আরামে হাঁটা যায়। এখন বালির গরম, গরম বালিতে পা ডুবে যায়, মাথায় গনগনে রোদ। কাল সন্ধেতেও মেঘ ছিল, এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। বালি যা ভিজেছিল রোদ উঠতে উঠতে আবার শুকনো। ভানু মীরগোদা, জাহাজঘাটায় খোঁজ নিতে যাচ্ছে। কাল তাকে পঞ্চাশটি টাকা দিয়েছিল মাইতিবাবু, মীরগোদায় যদি ঘোড়াটার সন্ধান পাওয়া যায়। মীরগোদার দিকে যেতে পারে পক্ষিরাজ। সেই রকম খবরই না পাওয়া গেল দুদিন আগে। ভানুর এক টাকাও খরচ হবে না, পুরোটা আয়। হারানো ঘোড়া কি তার কপাল ফেরাচ্ছে? পলাতক পক্ষিরাজ যদি তার হাতে ধরা দেয়, মাইতিবাবু বলেছে একখানা পাঁচশ টাকার নোট দেবে। ভানু আশায় আছে। ঘোড়াটা তাকে চেনে। ঘোড়াটা তার অবস্থা জানে। পাঁচশ টাকা পেলে সে যে ভোজপুর ঘুরে আসতে পারে তা জানে শ্রীপতিবাবুর পক্ষিরাজ। ধরা কি দেবে না কন্থক?

মীরগোদার একটা মানুষ ক’দিন আগে চুল ফেলতে গিয়েছিল চন্দনেশ্বরের মন্দিরে। মানত ছিল। মাথা কামিয়ে সে দুপুরে এসে উঠেছিল শ্রীপতির সমুদ্রপাখি হোটেলে। খেয়ে দেয়ে রওনা হবে মীরগোদার দিকে। জাহাজঘাটার দিকে। বলল তাই, ঘর মীরগোদা, জাহাজঘাটা। আগে তো বলল জাহাজঘাটা। জাহাজঘাটা থেকে আসছে, দুপুরে মিল খেয়ে জাহাজঘাটা ফিরবে। যেন সে জাহাজঘাটা গিয়ে জাহাজ ধরবে। তারপর চলে যাবে জাভা, সুমাত্রা, বালি দ্বীপ। কথাটা বলতে বলতে হাসছিল শ্রীপতি মাইতি।

সেসব জায়গা কোন দিকে? লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। শ্ৰীপতি দক্ষিণে আঙুল তুলে দেখিয়েছিল, সমুদ্রপারে, দ্বীপ।

সাগরদ্বীপের নিকটে? জিজ্ঞেস করেছিল লোকটা।

শ্রীপতি হেসে মাথা নাড়িয়েছিল, নাহ্, অনেক, অনেক দূরে।

অচেনা লোক, সে যদি আশপাশের হয় তার কাছে খোঁজ নেয় শ্রীপতি তার পলাতক ঘোড়ার। মীরগোদা, জাহাজঘাটার দিকে কোনো ঘোড়াকে দেখেছে কি সে? ঘোড়া? অশ্ব! লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। সদ্য কামানো মাথায় হাত বুলিয়ে নিয়ে কী যেন ভেবেছিল, তারপর শ্রীপতিকে অবাক করে ঘাড় কাত করেছিল, হ্যাঁ দেখা গেছে।

দেখা গেছে! শ্ৰীপতি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, সত্যি?

হ্যাঁ, অশ্ব তো?

অশ্বই তো বটে, সাদা রঙের, সাদা ঘোড়া?

সাদা! সাদাই হবে হয়তো, সাদা না হলেও ঘোড়া যে তা ঠিক।

কোথায় দেখেছিলে?

আঁজ্ঞে জাহাজঘাটা ছেড়ে যাচ্ছিল।

ভানু বিষম খেয়েছে, জাহাজ ছেড়ে যাচ্ছিল!

না, ঘোড়া মানে অশ্ব যাচ্ছিল জাহাজঘাটা ছেড়ে।

ভানু মাথার চুল টেনে সাড় নিয়েছিল নিজের। শ্রীপতি মাইতির ঘোড়া হলো পক্ষিরাজ। যদি আকাশে ওড়ে তো মানা যায়, কিন্তু জাহাজঘাটা ছেড়ে যাবে কোথায়? আর কন্থক কি ওভাবে যাবে? ভানু কথাগুলো ধীরে ধীরে শুনছিল। শ্রীপতি তাকে ধমকে উঠেছিল, থাম দেখি। নেড়া মাথা লোকটা তার দিকে তাকিয়ে ছিল, সে কত সময় ধরে, কত দিন ধরে যেন! বিড়বিড় করছিল, জাহাজঘাটা থেকে সে যাচ্ছিল কাজু জঙ্গলের দিকে।

জঙ্গলের দিকে? শ্রীপতি জিজ্ঞেস করেছিল নিশ্চিত হওয়ার জন্য।

তাই তো বটে।

সাদা ঘোড়া?

তা জানে মোর ভাইপো।

ভাইপো! ভাইপো জানবে কেন?

লোকটা গালভরে হেসেছিল, দেখেছিল তো তার ভাইপো, সুতরাং সে-ই জানবে, আর সে ঘোড়া বাদামিও হতে পারে।

বাদামি কেনে? ভানু দুলে দুলে জিজ্ঞেস করেছিল, কান্হা তো সাদা বটে। বাদাম বনে ঢুকছিল তো, বাদামী হতে পারে তাই। বিড়বিড় করেছিল মুণ্ডিত মস্তক মীরগোদা জাহাজঘাটার লোক, বাদামিই হবে।

সাদা নয়? হতাশ হয়েছিল শ্রীপতি।

হতাশ শ্রীপতিকে দেখে লোকটা হাঁ করে উঠেছিল, হবে না কেনে, ঘোড়া তো সাদা হতিই পারে, মু তো দেখিনি নিজ চক্ষে, তবে কিনা ভাইপো বলল বাদাম বনে ঢুকছে, তাই বাদামি হতে পারে, ঘোড়া শুনলাম, ঘোড়ার আবার বন্ন কী, সাদা, কালো বাদামি হতিই পারে।

নিজ চোখে দ্যাখো নাই? ভানু তার নিজের মাথা দুহাতে ধরে জিজ্ঞেস করে। না, কানে শুনিচি।

কী শুনেচ?

ঘোড়া, কিন্তু খচ্চোরও হতি পারে।

শ্রীপতি সব শুনে ভানুকে পাঠাল মীরগোদায়। পঞ্চাশ টাকা নিয়ে ভানু এলো জাহাজঘাটা দেখতে। হারানো ঘোড়া খোঁজার চেয়ে কানের হারানো মাকড়ি খোঁজাও সহজ। ভানু অবাক হয়ে দেখল জাহাজঘাটায় বালি উড়ছে গরম বাতাসে। ঝাউবনের ভিতরে বসে থাকল সে বালির দিকে চেয়ে। যেন চেয়ে আছে সমুদ্দুরে, নাও আসছে, জাহাজও হতে পারে। খুব ক্লান্ত হয়েছিল ভানু। ঝাউবনের ছায়ায় তার ঘুম এসে গিয়েছিল। কেমন একটা তন্দ্রার ঘোর। তার ভিতরে স্বপ্ন দেখেছিল জলের ভিতর দিয়ে ফেনা উড়িয়ে ছুটে আসছে তার কন্থক। ঠিক টিভিতে যেমন দেখায়—টিভিতে কোনো একটা বিজ্ঞাপনে আছে যেমন, তেমন। ঘুমের চটকা ভেঙে যেতেই বালির ঘূর্ণী দেখল দূরে। চোখে ঘোর লেগেছিল। মনে হচ্ছিল ভগবান বুদ্ধের ঘোড়া যেন কেশর ফুলোচ্ছে, খুরে বালি ওড়াচ্ছে।

জাহাজঘাটা ছেড়ে সে গেল মীরগোদা হাটে। হাট খুব বড়। শুধু কাজুর পাহাড়। বড় বড় বাদাম ব্যাপারিরা আসে। তারা সব কিনে নিয়ে যায় বালিসাই, কাঁথি, মেদিনীপুর, কলকাতা, আবার বালেশ্বরেও। হাটখানি বৃত্তাকার। একদিকে যেমন বাদামের বেচাকেনা, অন্যদিকে আলু, পটল, ঝিঙে, ওল, আর একদিকে মাটির হাঁড়িপাতিল, এক জায়গায় শুধু গামছা, তারপর রঙিন মাদুর। মদরঞ্জি খুলে ব্যাপারি খদ্দের ডাকছিল। ভানু অবাক হয়ে দেখল সেই মদরঞ্জিতে ঘোড়ার ছবি। কেশর ফোলানো সাদা ঘোড়া। একেবারে সেই ঘোড়া। কী আশ্চর্য! ঘোড়া যেন উড়ছে। যেমন উড়ত শ্রীপতিবাবুর পক্ষিরাজ। আশ্বিনের নীল আকাশে তার ডানার পালক উড়তে দেখলে দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে সমুদ্রতীর ধরে পশ্চিমে পালাত। ভানু জিজ্ঞেস করল, এ যে দেখি পঙ্খিরাজ, এ কোন পঙ্খিরাজ, মাইতিবাবুর?

কোন মাইতিবাবু?

দীঘা, সমুদ্রপাখি হোটেল যাঁর।

ব্যাপারি বলল, জানা আছে, ও হুটেলে একবার মিল খাওয়া হলো।

ভানু বলল, এক্কেবারে আমার কন্থক, রাজপুত্রর অশ্ব।

ব্যাপারি হাসে, তা’লে নিয়ে যাও।

কত দাম?

দাম শুনে ভানু পিছিয়ে গেল। সাড়ে তিনশ বটে। ব্যাপারি বলল, খুব কমই বটে, এ মদরঞ্জি দীঘায় মিলবে পাঁচশ টাকায়, কলকাতা যাবে ছ’শ টাকায়।

ভানু আবার এগিয়ে এসে দেখছিল। কী সুন্দর এঁকেছে। যেন ছবিই তুলেছে মাইতিবাবুর ঘোড়ার। ব্যাপারি হেঁকে উঠল, আসল মদরঞ্জি, পঙ্খিরাজের মদরঞ্জি, বিলাত, আমেরিকা, বর্মা, সুমাতরা, জাভা যাচ্ছে মীরগোদার মদরঞ্জি, জাহাজ ছেড়ে গেল!

ভানু হাত বুলিয়েছে ঘোড়ার কেশরে। তলপেটে। পুষ্ট ঊরুতে। শিহরিত হয়েছে সে। কাঁপছিল যেন মাইতিবাবুর সাদা ঘোড়া। তো তখন একটা খদ্দের এসে গেল। এক মুশকো লোক, কলকাতার বাদাম ব্যাপারি। সে শুধু এটা না ওটা দেখতে লাগল। ভানু আর কথা বলতে পারে না। যখন গেল, মদরঞ্জিওয়ালা ক্লান্ত। বিক্রি হলো না, অথচ খাটনি গেল। এসবের মর্যাদা কি বাদাম ব্যাপারি দিতে পারে?

এদিকে কোনো অশ্ব দিখেছ?

মদরঞ্জিতে তো দিখা হলো।

না, না আসল অশ্ব, খাঁটি অশ্ব।

ও-ও তো খাঁটি অশ্ব।

না, না পরান আছে যার।

ওর ও তো পরান আছে, ওতে শুয়ে নিদরা যাও, মনে হবে অশ্বে সওয়ার হয়েচ।

আশ্চর্য কথা! মদরঞ্জির ব্যাপারি আধবুড়ো মানুষ, মাথার বাবরি চুল সব সাদা, ঠিক কন্তুকের কেশরের রং, গায়ের ঘন নীল জামাটি অথই সমুদ্র, আর লুঙ্গিটিতে বালির রং।

ভানু বলল, তুমিই খোঁজ রাখতি পারো, মাইতিবাবুর পঙ্খিরাজ পলাতক, তাহার নাম কন্তুক।

লোকটা বলল, দ্যাখো আছে কুথাও।

শুনা গেছে বাদাম বনে ঢুকেছে।

খুঁজ লাও।

কিন্তু সিটা নাকি বাদামি বন্নের।

হতিই তো পারে।

খচ্চোরের জাত।

খচ্চোর তো অমনই হয়।

তা’লে কী হলো? ভানু মাথা চুলকোতে চুলকোতে জিজ্ঞেস করে।

মদরঞ্জিওয়ালার কাছ থেকে সরে ভানু আবার হাট ঘুরতে লাগল। এক জায়গায় প্লাস্টিকের মগ, জগ, বালতি ভর্তি, এক জায়গায় মিঠাই। মিঠাই হলো গুড়ের লাড্ডু আর জিবে গজা। তারপর চালের পাহাড়, গমের পাহাড়। তারপর বড় বড় ফজলি আম। হাট গমগম করছে লোকের হাঁক ডাকে। গাছতলায় ভিখিরির দলও বসেছে। ভানু ঘুরতে ঘুরতে বাদাম ব্যাপারিদের কাছে যায়, জঙ্গলে অশ্ব দেখিছ?

কোন জঙ্গল? না, কাজু জঙ্গল। কাজু জঙ্গলে অশ্ব থাকে বলল কে? এক ব্যাপারি বলল, শিয়ালও নাই, খটাশ নাই, পোকামাকড় থাকতি পারে।

কিন্তু খবর আছে পলাতক ঘোড়া।

এমনি করে জিজ্ঞাসার পর সে আবার এসে দাঁড়িয়েছে মদরঞ্জিওয়ালার কাছে। মদরঞ্জিওয়ালা জিজ্ঞেস করল, পাওয়া গেল?

কী পাওয়া যাবে?

তুমার সাদা পঙ্খিরাজ।

কুথায় পাব?

কেনে এই হাটে। হি হি করে হাসতে লাগল ব্যাপারি। তার হাসিতে লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে। মদরঞ্জিওয়ালা ঘোষণা করে, হারানো অশ্ব যদি না মেলে হাটে তবে আসা কেন? এত গমগমে ভিড়, এত বেচাকেনা, এর ভিতরে যদি না থাকে সেই দুষ্ট পলাতক, তবে কী দেখল ভানু, মীরগোদার হাট? জাহাজঘাটার হাট?

এ হাটও কি জাহাজঘাটার? ভানুর জিজ্ঞাসায় মদরঞ্জি ব্যাপারি আবার হাসে, তাই তো বলে। বলে এ হাট নাকি সেই আমলের যে আমলে সমুদ্দুর ছিল এখেনে। হাটেই প্রমাণ হয় জাহাজঘাটা সত্যি। হাট নয় তো, এ হলো মীরগোদা বন্দরের কেনাবেচা, এখেন থেকে জাহাজ ভর্তি মাল চলে যেত জাভা, সুমাত্রা, বালি, তখন তো বিলেত, আমেরিকা ছিল না।

একেবারে মাইতিবাবুর কথা। তো মদরঞ্জিওয়ালাই বলল, তুমি থেকে যাও আজ। কোথায় থাকি?

মদরঞ্জিওয়ালা বলল, আমার কাছে থাকো, এখন আর যাবে কোথায়?

ভানু থেকে গেছে তার ঘরে। সেখানে যেতে হলো অন্ধকারে জাহাজঘাটা পার হয়ে। তখন ঝাউবনে অন্ধকার, অন্ধকারে লুপ্ত সমুদ্র যেন জেগে উঠেছে জাহাজঘাটায়। উত্তর আকাশে ধ্রুবতারা জ্বলজ্বল করছে। সেই ধ্রুবতারা দেখিয়ে মদরঞ্জিওয়ালা, গৌরমোহন তাকে উত্তরে নিয়ে গেল তার বাড়ির দিকে। পিছনে পড়ে থাকল প্রাচীন সমুদ্র-চিহ্ন। প্রাচীন মায়া।

অন্ধকারে তার হাত ধরে গৌরমোহন বলল, যে পালায় তাকে ফিরানো যায়?

ফেরে তো সব্বাই।

মদরঞ্জিওয়ালা বলে, এভাবে খুঁজে পাওয়া যায়? তবে কীভাবে?

মদরঞ্জিওয়ালা বলল, তুমি তারা চেনো?

না তো। চমকে উঠে ভানু আকাশে তাকায়।

তবে ঠিক জায়গায় কে লিয়ে যাবে তুমারে, আকাশ, তারা না চিনলে ওই অথই সমুদ্দুরে দিকহারা হয়ে কূল খুঁজে পাবে না, বুঝা গেল?

গেল, কিন্তু আমার কন্থক তো রাজপুত্রের সাথী ছিল, সে সব চেনে।

চিনলেও ফিরবে না, না চিনলেও ফিরবে না।

গৌরমোহন মদরঞ্জিওয়ালার বাড়িখানি মাঠের ধারে। সেই মাঠে ঘোর আঁধার। গৌরমোহনের কম বয়সের বউ আছে। তার নাম কোকিলা। কোকিলার রংটি চকচকে কালো, চোখদুটি যেন জোনাকির মতো জ্বলে নেভে। কচি মেয়েমানুষ। তাকে দেখিয়ে গৌরমোহন বলল, এই কোকিলার করা, ঘোড়াখানি ওর আঁকা।

কোকিলা মাথায় ঘোমটা টেনে হারিকেন পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে বলল, উনি আমার গুরু, ওঁর শিক্ষা।

গৌরমোহন বলল, বোসো ভানুবাবু, তুমার বাবুরে বোলো অমন একখান মদরঞ্জি নিতে, যদি তিনি চান অশ্বরে আশমানে উড়ায়ে দেব দুখান ডানা ফিট করে।

কোকিলা তখন বলল, সে পরে হবে, আপনি জলপানি কিছু খাবেন?

ভানু দেখল তার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে ঢুকে গেল ঘরের ভিতরে। ভানু আকাশে তাকিয়ে তারা দেখতে লাগল আর অপেক্ষা করতে লাগল কোকিলার জন্য। মীরগোদা-জাহাজঘাটার আকাশে, লুপ্ত সমুদ্রের ভিতর থেকে চাঁদ উঠছিল তখন। হলুদ আলোয় ঘুম এসে যাচ্ছিল মদরঞ্জিওয়ালার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *