1 of 2

অশ্বচরিত – ৪

চার

জল আনল গৌরমোহনের কোকিলা। রেকবিতে গোটা আটেক বাতাসা। শুধু ফুলচন্দন নেই, থাকলে পুজোর উপচার হয়ে যেত। দূরে বসেছে সে। ঢকঢক করে জল খেয়ে, বাতাসা চিবিয়ে দেহমন্দির শীতল হলো।

ডুবে শাড়ি, আগুন রঙের লাল ব্লাউজ, মাথা ভর্তি সিঁদুর, নাকে একবিন্দু নথ, হাতে কাচের চুড়ি, কোকিলা দূর থেকে জিজ্ঞেস করে বিত্তান্ত কী?

ভানু দেখল মদরঞ্জিওয়ালা মাটির দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমাচ্ছে পরিষ্কার। সে এবার ভালো করে দেখল কোকিলাকে, যুবতী জিজ্ঞেস করছে, ঘর কুথায় হলো?

নাই, ইখন দীঘা, আরও বলতে হয় যদি এই মীরগোদা, জাহাজঘাটা।

কোকিলা জিজ্ঞেস করে মদরঞ্জিওয়ালার সঙ্গে কতদিন চিনা?

ভানু মিথ্যে বলল, অনেকদিন, যতদিন জাহাজঘাটায় আসছি।

কতদিন আসছ?

ভানু বলল অনেক অনেকদিন, রাজপুত্র বিসজ্জন দিয়ে বিবাগী হয়েছি আমি আর কন্থক অশ্বটি।

কোকিলা বলল, বুঝলাম না, তবে বলি, এক একজনকে অমন মনে হয়, কতদিনির চিনা, কতকালের!

ভানু নিজেই জানে না তার বয়স কত। নিজেই জানে না তার নিজের বৃত্তান্ত। বাবা, মা, পরিবার, সব ভুলে গেছে। ভুলে গেছে মেশিন চালানোর কলাকৌশল। ভানু ভাবছিল বাবু শ্রীপতি মাইতিকে বলে কলকাতার দিকে গেলে হয় পক্ষিরাজকে খুঁজতে। উলুবেড়ে, হাওড়া পর্যন্ত গিয়ে ট্রেন থেকে নেমে গঙ্গা পার হয়ে বজবজ। বজবজ গিয়ে তার মিল মাইল চারেক। জুট মিল আবার যদি চালু হয়ে থাকে! কোকিলা আধো অন্ধকারে তার মনের ভিতরে বেগ তুলছিল। হাত বাড়িয়ে কথা বলে যখন তার হাতখানির রঙিন কাচের চুড়িতে হারিকেনের আলো পড়ে চোখের সামনে যেন রঙের বিচ্ছুরণ। হাঁটুর ওপরে থুতনি রেখে মদরঞ্জিওয়ালি যখন বড় বড় চোখে আধবুড়োটে, ঢ্যাঙা, ছিরিছাদহীন ভানুর দিকে তাকিয়ে থাকে তার মুখখানি বড় সুন্দর। যখন সে মাথার খোঁপা ভেঙে হাত ঘুরিয়ে বুক চিতিয়ে, বুকের আঁচল সরলে তা তুলে নিয়ে খোঁপা বাঁধে, তখন সে সুন্দর। যখন কোকিলা বসে থেকে থেকে একটু চঞ্চল হয়, সেই চঞ্চলতা ছড়িয়ে পড়ে সর্ব অঙ্গে, কী সুন্দর তা! ভানু যেন তৃষ্ণার্ত চোখে দেখে মদরঞ্জিওয়ালার নিকোনো ভিটে। যতই হোক ভিটেতে এখন অন্ধকার। কোথায় আছে কদমতলি, অকালেও বুঝি কদমফুলের বাস আসছিল ধীরে ধীরে। ভানুর মনে পড়ছিল লেবার কোয়ার্টার, তার বিবি তো বিবি, বিবির কোলে খোকা। ভানু মিস্ত্রির বউ দেশি নয়, বিহার ভোজপুর জেলার মেয়ে। ভোজপুর জেলা হবে কেন বজবজেই তার জন্ম। তার বাপ, মা ওই জেলার। রামবিলাস দাস হলো শ্বশুর, বিবি হলো ফুলরানি।

ঘরে কে আছে? মদরঞ্জিওয়ালি কোকিলা শুধায়।

ভানু মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, লোকটাকে ডাকো, ঘুমাই পড়ল।

ও ওর অভ্যেস, হাটবাজার ফিরে ঘুমাই নেয়।

কেনে?

এরপর বুনতে বসা হবে।

রাত্তিরে?

হ্যাঁ রাত্তিরে।

ভানু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, রাত্তিরে বুনা হয়?

হয়, আলো নিয়ে বসি দুজনায়।

আলো তো ওই হেরিকেন

কোকিলা খিলখিল করে হাসে, আসল বুনা তো মনে মনে, চোখ বুজেও বুনা হয়, তুমার মদরঞ্জিওয়ালা তো বলে আমি নাকি স্বপনেও বুনি।

কথাটা ঠিক ধরতে পারল না ভানু। আবার ধরতে পারলও। সন্ধেয় সমুদ্রপাখি হোটেলে মাইতিবাবুর নিজের ঘরে শুকনো নেশা হয়। আজ সে নেশা নেই। তবু ভানুর মনে হচ্ছিল কথাটা যেন বহুক্ষণ ধরে শুনছে সে। কোকিলা নাকি স্বপ্নেও মদরঞ্জি বোনে। সে যেন কোকিলার সামনে এক অনন্ত সন্ধ্যায় বসে আছে। সে বিড়বিড় করে, দুজনায় বোনো?

খিলখিল করে হাসে আবার কোকিলা বধূ, বলে, তবে কি একজনে ঘুমাবে, একজন জেগে থাকলে অন্যজন ঘুমাতে পারে?

ভানু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে তো এখানে, ওখানে গরমের দিনে সমুদ্র তীরে চিত হয়ে পড়ে থাকে। আকাশের তারা দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে। তারাগুলো জেগে থাকে, কিন্তু সে তো বেশ ঘুমায়। কেন ঘুমাবে না, আকাশের তারা তার কে? মিল বন্ধ। বন্ধ তো বন্ধ—তিনটে লোক মরল গলায় দড়ি দিয়ে ভানুর শ্বশুর রামবিলাস বলল, ভোজপুর জিলা, গাঁও ফিরি।

ভানুর শাশুড়ি বড় ঘোমটা টেনে বলল, ফুলরানি ভি চলুক, জামাই, কামকাজ হলে তার করে দিয়ো, হামি তুমার সংসার ফের পেতে দিয়ে যাব, লেড়কি আমার একটি, তারে রেখে আমি গাঁও ফিরতে পারব না।

ফুলরানি বলল, তুমি ভি হামাদের গাঁও চলো, খেতি কাম করে চলবে।

শ্বশুর বলল, তিন বিঘা জমিন আছে, ঠাকুর সাহাব আছে, তার জমিন লিয়ে ভাগচাষ করা চলবে, ই মুলুকে মিল ফ্যাকটিরি আর খুলবে না, ই মুলুকে জমিন নাই, মিল ভি নাই, কামকাজ বন্ধ, আদমি গলায় রশি বেঁধে ঝুলে পড়ছে, জামাই, মোর গাঁও চলো।

গেল না ভানু। ভোজপুর জিলার ট্রেনে সবাইকে তুলে দিয়ে হাওড়া থেকে বাসে চেপে বসল। ছেলের হাতে ঝুমঝুমি কিনে দিয়ে বাসে চেপে বসল। ফুলরানির চোখের জল দেখে সমুদ্রের দিকে রওনা হলো। সমুদ্র তার বড় প্রিয়। যখন বজবজের জুট মিল ছিল, হাতে হপ্তার টাকা ছিল, কত সমুদ্র সে দেখেছে! সাগরদ্বীপের সমুদ্র, বকখালির সমুদ্র। তখন বিয়ে হয়নি। ট্যুরিস্টপার্টির সঙ্গে তাদের কাজের লোক হয়ে কত সমুদ্রে গেছে! পুরীর সমুদ্র, কোভালম সমুদ্র, ওয়ালটেয়ারের সমুদ্র, চেন্নাই পর্যন্ত। সমুদ্র সে যত দেখে তত ভরন্ত হয়ে ওঠে মনে। আজ দেখল নতুন সমুদ্র। কোন সমুদ্রে জল নাই? ভানু মনে মনে বলল, মীরগোদার সমুদ্দুরে।

কোন জাহাজঘাটায় জাহাজ নাই?

মীরগোদার জাহাজঘাটায়। ভানু মনে মনে উচ্চারণ করে।

বন্দর আছে জাহাজ নাই?

মীরগোদার সমুদ্দুরে! বিড়বিড় করে বলল ভানু।

কোকিলা অবাক, কী বলছ গো?

ভানু বলল, বজবজ থেকে খিদিরপুর কাছে, সেখেনে পোর্ট মানে বন্দর, মানে জাহাজঘাটা, জাহাজ মাল খালাস করে দাঁড়িয়ে, সমুদ্দুর পার হওয়া জাহাজ, সেই ডক মানে পোর্ট, মানে জাহাজঘাটার বাজারটা কত বড়, বিলিতি মাল এসে নামে, আবার বিলেতে জাহাজ যায়, এখান থেকে জাহাজ যায় তো?

কোকিলা বলল, জাভা, সুমাতরা, বালিদ্বীপ।

ভানু হাসতে লাগল, বলল, মদরঞ্জি যায় জাভাদ্বীপ, মাইতিবাবু বলেছিল, তুমার বুনা ওই মদরঞ্জির অশ্ব যেন মোদের সেই ঘোড়া, অবিকল তাই, কোনো তফাত নাই।

কোকিলা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘোড়াটি বুনা হইছিল পুরো শুক্লপক্ষ ধরে, শেষ হলো পুন্নিমের জোছনায়।

জোছনায়! চমকে ওঠে ভানু, গায়ের রোম যেন সিধে হয়ে ওঠে, কাঁটা দেয় সর্ব অঙ্গে।

হ্যাঁ তাই, বোশেখী পুন্নিমের রাতি শেষ হলো, চাঁদের আলোয় বুনা হইছিল।

ভানু অবাক হয়ে দেখে মদরঞ্জিওয়ালার যুবতী বধূকে। কোকিলা বধূকে। তার চোখদুটি আঁধার সমুদ্রে নিমেষহীন। দূরে যেন জাহাজি আলো কিংবা নৌকোর সংকেত। কোকিলা বধূর চোখদুটি যেন ধ্রুবতারা। একটি নয় দুটি ধ্রুবতারা। সেই তারা জাহাজি মাল্লার মনে। সেই তারা দেখে জাহাজঘাটা চিনে ফেলছে তারা অকূল আঁধারে। ভানু দেখছে বধূর যৌবনে যেন ভরা কোটালের টান। আগুনরাঙা ব্লাউজের ভিতরে পূর্ণিমার চাঁদের মতো ভরন্ত বুকদুটি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে থইথই করছে। কোকিলার মুখখানি কী সুন্দর। তার ফুলরানি কি এমনই, এমন রূপ ছিল? আস্তে আস্তে ফুলরানির মুখখানি মনের ভিতর থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। ফুলরানির বাবা, মা, ফুলরানির কোলের খোকা, সবই কেমন ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে। শূন্য। যেন কোনো রং নেই। যেমন লায়কানখাসে ঘোড়াটাকে দেখা গিয়েছিল, কিন্তু তার কোনো বন্ন ছিল না। ভানুর মনে তো রং আছে। সেই রং কি ফুলরানির মতো থেকেও সরে যাচ্ছে? ভানু মাথা দোলাতে লাগল, কোনো বন্ন নেই, হাওয়া, হাওয়ার মতন।

কী বলো? জিজ্ঞেস করে কোকিলা বধূ।

ভানু বলল, কী যেন শুনলাম, জোছনায় বুনা হয়েছিল?

হ্যাঁ, চাঁদের আলোয়, চাঁদ একটু একটু করে বড় হয় শুক্লপক্ষে, চাঁদের আলো বাড়ে, পুন্নিমেয় চাঁদ উঠতে লাগল, চাঁদের আলোয় হলুদ হলুদ রং, তখন মদরঞ্জির বুক বুনা হলো, আমি বুনিনি, কে যেন বুনাল? ঘুড়ার চোখ, কেশর!

ভানু বলল, কী আশ্চর্য, সেদিনই তো মোর কন্থক হারাল, ভগবানের জন্মদিন!

কোকিলা বধূ বলল, দুজনায় ঠিক করেছিলাম পুন্নিমের জোছনায় বুনা শেষ হবে, দুফরে দুজনায় ঘুমায় আছি, মেঘ গুড়গুড় শোনা গেল।

কী আশ্চর্য, তাই তো!

আমি চোখ খুলতে দেখি জানালার ওপারে খর রোদ্দুর আর নেই, কী রোদ হয়েছিল গো! তুমার মদরঞ্জিওয়ালা ফিরল মাদুরকাঠি নে, তখন বেলা এগারোটা, রং মিলায়ে এনেছিল, আমি তখন ওই ঘোড়া আঁকি ওই উঠানে কদমতলের ছায়ায় বসে, শুনছ তুমি, ঘুড়ার গলা আঁকি, চোখ!

শুনছি, শুনছি।

আমি উঠানের ধুলায় আপনমনে একটা ঘুড়া আঁকি, ছুটছে ঘুড়া, সামনের দুই পা বাড়ায়ে ধরেছে যেন হুই জাহাজঘাটার দিকে, পিছনের দুই পা ভাঙছে, গলা তুলেছে, কেশর ফুলাচ্ছে সেই ঘুড়া।

সকালে আঁকলে তো?

হ্যাঁ, বেলা এগারোটা, বললাম তো।

ভানু বলে, কেন আঁকলে ধুলায়?

তা তো জানিনে, একা বসে আছি, মনে হলো আঁকি। কে যেন মোরে দিয়ে আঁকাল ঘুড়াটা, তা দেখে তুমার মদরঞ্জিয়লা বলল ওই ঘুড়া মদরঞ্জিতে তুলা হচ্ছে, হলুদ জমিনে শাদা ঘুড়া, তা শুনে আমি বলি পুন্নিমে রাত, জোছনায় আঁকা শেষ হবে সমস্ত রাত্তির ধরে, তো দুফরে ছায়া হলো, মেঘ হলো, ঠাণ্ডা বাতাস দিল…

ভানু শুনছে সব। মিলে যাচ্ছে। কী রোদ আর কী রোদ! বাতাসে শনশনে আগুনের শলাকা। বালি আগুন। তারপর! দুপুরে যে ছায়া ঘনাইল বনে বনে। ঝাউবনের মাথা কালো হয়ে গেল। মেঘ গুড়গুড় করতে লাগল। কোকিলা বধূ যা বলছে সব যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। বোশেখী পুন্নিমের দুপুরের কথা ভালো মনে আছে তার। ওই দিন রাতেই তো দড়ি ছিঁড়ে, খুঁটো উপড়ে পালাল কন্থক, রাজপুত্রের ঘোড়া। কোকিলা বলছে, মেঘের গুড়গুড় শুনতে শুনতে দুজনে আবার ঘুমোয়। সে আর গৌরমোহন। তারপর এলো বৃষ্টি। বৃষ্টিতেও ঘুমের ঘোরে থাকে যেন দুজনে। বৃষ্টির ছাঁট জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরে। তারপর! যখন গুম ভাঙল, বুঝল সবটাই যেন স্বপ্ন। গোধূলির আলোর রং হলুদ হয়ে গেছে গো। সে আলোকে নাকি বলে কনে দেখা আলো। আমি আর ওই লোক উঠোনে দাঁড়ালাম। বালিমাটি দেখে ধরাই যায় না বৃষ্টি হয়ে গেছে। শুকনো বালি সব জল শুষে নিয়েছে।

ভানু শুনছিল, তখন সেই কনে দেখা আলোয় বসে উঠোনে আবার ঘোড়া আঁকল কোকিলা। কী যে হয়েছিল তার, শুধু ঘোড়া এঁকে যাচ্ছিল। উঠোনে বসল তারা দুজনে। চাঁদ উঠতে লাগল। বুনতে লাগল মাদুর! আকাশ ঝকঝকে নীল চাঁদের হলুদ আলোয় ধীরে ধীরে ফরসা হয়ে উঠতে লাগল চাদ্দিক, এই উঠোন ভরে গেল সাদা আলোয়।

শুনতে শুনতে ভানুর বুক ধকধক করছিল। সে খুঁটিয়ে দেখছিল কোকিলা বধূকে। এ-ই তো হরণ করেছে রাজপুত্রের অশ্ব। নিশীথে কি এর ডাক শুনছিল ঘোড়াটি? না হলে এমন মিলে যায় কী করে? হারিকেনের নরম আলোয় যুবতী বধূ তাকে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছিল। প্রতিটি অঙ্গের রেখায় তার চোখ পড়ে যাচ্ছে। কী সুন্দর বসেছে বধূ। কোমরে ভাঁজ পড়েছে একটি। কোমরের নিচের অংশটি ভারী। ছড়িয়ে পড়েছে এমনভাবে যেন বড় নাওয়ের তলদেশ। জলে ভেসেছে নাওখানি। এ যদি ডাকে কে না এসে পারে?

ভানু আচমকা বলল, তুমি কে বলো দেখি?

ঘাড় ঘুরিয়েছে এমনভাবে সে যেন সাপিনী সাড়া পেয়েছে বিপদের, চোখ ঝিকিয়ে উঠেছে তার, বলল, ও কথা কেনে?

তুমি আসলে কে, পরিচয় কী?

কোকিলা বলল, এ কথার মানে কী?

ভানু বলে ওঠে, কুহকিনী, তুমিই তাহলে সে? হায় কন্থক, কুহকিনীর মায়ায় ছন্দককে ভুললে তুমি!

কার কথা বলো?

জাদু করে, কুহক করে, নিশির ডাকে, তুমিই ডেকেছিলে তারে?

ঝট করে উঠে দাঁড়ায় কোকিলা, স্বামীকে ডাকে, ওগো ওঠো, ওঠো।

ভানু দেখল চোখ মেলেছে গৌরমোহন। তার দিকে চেয়ে হাসল, লজ্জিত মুখ, সন্ধেবেলায় ঘুমানো অভ্যেস হয়ে গেছে।

কোকিলা বলে, ঘরে অতিথি, তখন থেকে মানুষটা চুপ করে বসে আছে, আমি কত কথা বলব মেয়েমানুষ, ওঠো।

তারপর? কোকিলা ভাত রাঁধল। ভাত দিল। সে-রাতে আর তারা বুনতে বসল না মাদুর। গৌরমোহনের সঙ্গে এটা ওটা আলাপ হতে লাগল। ভানুর বিছানা পড়ল দাওয়ায়। ভানুর ঘুম হলো না। ভানু টের পেয়েছে কেন পালিয়েছে কন্থক। সে বোধহয় বন্দি হয়ে গেছে। সকালের আলো ফুটতে না ফুটতে সে ধাঁ। ফিরে এলো দীঘায় দীর্ঘ পথ হেঁটে। শ্রীপতি মাইতিকে পথেই পেল। প্রায় দৌড়ে গেল ভানু, বাবু কি বেরোলেন?

মাইতি বলল, অশ্বর খোঁজ পেলি?

ভানু ঘাড় কাত করল, পেরায়, ধরা যাচ্ছে কিছুটা।

মাইতি ফিরল। মাইতিকে ফিরতে দেখে হোটেলের রাঁধুনি ঠাকুরের বউঠাকুরানি যেন পথ রোধ করে দাঁড়াল, কী হলো বাবু, ফিরে এলেন যে, যাবেন না?

কোথায় যাব? শ্রীপতি মাইতির ভ্রু কুঁচকে গেল।

যেখেনে যাচ্ছিলেন। ঠাকুরানি হাসল, ওই মর্কটটা না মীরগোদা গিয়েছিল! ভানু বলল, তাতে তুমার কী হে?

ঠাকুরানির সাদা দাঁতগুলো দেখা গেল, বলল, ঘুড়া খুঁজার নামে শুধু চরকিবাজি আর বাবুর কাছ থেকে টাকা আদায়!

লেগে যাচ্ছিল। ঠাকুর এসে পড়ায় রক্ষে। ধমকে দিল ঠাকুরানিকে, তোর কী রে, যা যা, তরকারিগুলো কোট, মিল বিশটা হবে, বাবু ইলিশ আনলে হতো, দশটা ইলিশের খদ্দের আছে।

কতদিন ভেবেছে শ্রীপতি সামনের এই টালির চাল, কিচেন কাম ডাইনিংটা ভেঙে দেবে। ঠাকুর ঠাকুরানিকেও বিদায় দেবে। কিন্তু হচ্ছে না। সময় কই? পক্ষিরাজ পালিয়ে তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে। ইলিশের কথা মানে ঠাকুরকে টাকা দাও। মিল বেচে লাভের মুখ দেখাই যায় না। বিশটা না তিরিশটা সে খোঁজ রাখবে কে? এখন যে পথে পথেই কাটছে তার। ঠাকুরের হাতে একটা একশ, একটা পঞ্চাশের নোট দিয়ে ঘরে এসে উঠল শ্রীপতি। তর সইছে না। কী খবর আনল ভানু? তাহলে সেই মাথা কামানো লোকের কথা সত্যি?

ভানু হাঁক মারল, ঠাকুরানি জল আনো দেখি, চা আনো।

শ্রীপতি বলল, কী দেখলি ভানু, কোথায় পঙ্খিরাজ?

ভানু বলল, মদরঞ্জিতে বেঁধে ফেলেছে তারে এক কুহকিনী, জাদুকরী, শুনুন বাবু, কোকিলা বধূর কথা শুনুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *