অশ্বচরিত – ৫১

একান্ন

ঘোড়াটা হাঁটছিল। সে বুঝতে পারছিল আশ্বিন আসেনি, আকাশ নীল হয়নি, কাশফুল ফোটেনি, বাতাস ঠাণ্ডা হয়নি, সমুদ্র শান্ত হয়নি—সব তার ভুল। সে বুঝতে পারছিল বর্ষা আসেইনি তো বর্ষার অবসান হবে কী করে? যে বৈশাখের ভিতরে ছিল সে, সাঁতরাপুর থেকে যে বৈশাখের পথে হেঁটে এলো মালিক শ্ৰীপতি মাইতিকে পিঠে চাপিয়ে কঠিন রোদে ধুঁকতে ধুঁকতে, সেই বৈশাখই রয়ে গেছে। কালবৈশাখীর মেঘ জমেছিল, সেই মেঘে বৃষ্টি হয়েছিল, সেই বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে, বর্ষার মেঘ এখন সমুদ্রের অতলে, তাদের ঘুম ভাঙেনি।

ঘোড়াটা বুঝতে পারছিল বড় ভুল হয়ে গেছে। আশ্বিনকে যেন সে স্বপ্নের ভিতরে দেখেছিল। আকাশ তাকে ঘোর মায়ায়, বিভ্রমে ফেলেছিল সেই পূর্ণিমার রাতে। সে এবার অনুভব করছিল যে বৈশাখ তাকে ঘিরে আছে তা আরও নিদয়া, কঠিন। যে পৃথিবীর পথে সে চলেছে সে যেন এক আগুনের পৃথিবী। ঘোড়াটা ছায়া চাইছিল, ছায়া পেলে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ, অনেক সময়, অনেক মাস। সে পথ খুঁজছিল। কোন পথে গেলে পেয়ে যাবে চন্দনেশ্বর মন্দির, তারপর নতুন দীঘা, তারপর শ্রীপতি মাইতির হোটেল? সে মালিকের কাছে ফিরতে চাইছিল। এখন, এই এত শত বছর ধরে তার অভ্যাস বদলে গেছে, যদিও কখনো কখনো রাজপুত্রের স্মৃতি, সারথি ছন্দকের স্মৃতি, নদীতীরের স্মৃতি, বনভূমির স্মৃতি ফিরে আসে আচমকা, কিন্তু তা যে তাকে নদীতীরে, বনভূমিতে, অশ্বযূথে নিয়ে যাবে না, বুনো ঘোড়ার পালে ফিরিয়ে দেবে না, সে কি তার অজানা? এই তো খুঁজে বেড়াচ্ছে হিনাড়ির গিরিমশায়ের পালিতা কন্যাটিকে, সেই রূপসীকে, যাকে সে সন্তান দিয়েছিল, আবার দেবে, সেই কামনায় না বাতাসের বেগে ছুটে এসেছিল চোদ্দবেড়িয়ার চরে। মনের বেগে ছুটে এসেছিল বুনো ঘোড়ার পালের দিকে। আশ্বিনে যখন চোদ্দবেড়িয়ার চর চারপাশের নানা ঘোড়ার ডাকে, নানা ঘোড়ার ফুর্তিতে প্রাণময় হয়ে ওঠে, তখন তাদের ভিতরে হারানো স্মৃতি ফিরে আসে। অতীতের শৌর্য, বীর্য প্রাণময়তা জেগে ওঠে। এখন সে নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গ ঘোড়াটির কিছুই মনে পড়ে না। মাথার ভিতরে কিছুই থাকে না আর। সে শ্রীপতি মাইতির হোটেলের কথাও যেন ভুলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে সব। যেমন পথ হারিয়েছিল সে, তেমনিভাবে হারিয়ে যাচ্ছিল পথের চিহ্নগুলো, চেনা পথ অচেনা পথের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল। সে বিষণ্ন হয়ে এদিক-সেদিক দেখছিল। যদি সখীদের কাউকে দেখা যায়। ভোগরাই, রানিশাহী, হিনাড়ি, দেউলপোতা, কত জায়গার ঘোড়ারা সব আসত। সেই সব ঘোড়ারা কই? কোথায় তারা? ঘোড়াটা ডেকে উঠল, চিঁহি চিঁহি করে ডাকছিল, ভোগরাই, রানিশাহীর পক্ষিরাজের দল, তোমরা কোথায়, তোমাদের টানে ছুটে এলাম, তোমরা কেউ নেই, সবুজ চরখানি বালি ধূসর। বাতাসে বালি উড়ছে। ঘূর্ণী হচ্ছে। তপ্ত বাতাসে চোখের ভিতরটা জ্বালা জ্বালা করছে। ঘোড়াটা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল এক গাঁয়ে। গাঁ মানে কটা ঘর। পথের ধারে শিশুরা খেলছিল। কত সময়, কত দিন, কত বছর, কত যুগ বাদে মানুষের মুখ দেখল সে। দেখে তার আশা জাগল, মানুষ যখন তাকে চিনিয়ে দেবে মালিকের বাড়ির পথ। হয় সাঁতরাপুর, না হয় দীঘা। হয় দীঘা, না হয় হিনাড়ি, গিরিমশায়ের বাড়ি, রূপসী ঘুড়ীটা আছে সেখানে, যে তাকে ডাক দিয়েছিল পূর্ণিমার রাতে। ছেলেপুলেদের দেখে শীর্ণকায় কন্থক ডেকে ওঠে, হিনাড়ি কোন দিকে? গিরিমশায়ের বাড়ি?

ছেলেরা হইহই করে ওঠে, ঘোড়া, ঘোড়া, কোথাকার ঘোড়া?

কন্থক তার পরিচয় দিল আকাশের দিকে ঘাড় উঁচিয়ে। তা শুনে ছেলেরা চিৎকার করতে লাগল খেলা ভুলে, বলতে লাগল, ঘোড়া ঘোড়া, রাজপুত্রের ঘোড়া মানে অশ্বমেধের ঘোড়া!

ধর ঘোড়া, ধর ঘোড়া, অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া ছেড়েছে রাজা!

ঘোড়া, ঘোড়া, ঘোড়া! রব উঠতেই নিঝুম গ্রামখানি জেগে উঠতে লাগল। ঘোড়াটি দাঁড়িয়ে ছিল একটি সাঁইবাবুলের ছায়ার নিচে কোনো রকমে। ছায়াটা বড় ছোট, সূর্য মাথায় উঠেছে, ছায়া আরও ছোট হয়ে আসছে। ঘোড়াটা শুনছিল অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা। ঘোড়াটা শুনছিল রাজার কথা। তাকে নাকি ছেড়েছে রাজা পৃথিবী পরিক্রমায়। সেই জন্ম যেন রাজপুত্র গৌতমের জন্মের বহু আগে, হিংসায় ভরা পৃথিবী তখন। যজ্ঞের ঘোড়া ধরলেই যুদ্ধ লাগবে। ঘোড়াটা অলস দৃষ্টিতে ছেলেপুলেদের দেখছিল। রাজার ঘোড়া বলতে তার ভিতরে ঈষৎ তেজিভাব জেগেছে। তার যেন মনে পড়ে যাচ্ছিল অশ্বমেধ যজ্ঞটির কথা। কবে কোন কালে, কোন পুরাণের পৃথিবীতে সে বেরিয়েছিল যজ্ঞের ঘোড়া হয়ে। সেই স্মৃতি ফিরে আসছিল। সেই স্মৃতি শৌর্যের এবং বেদনার। মনে পড়ে সব, কত প্রাচীন দিনের কথা তা, সে ছিল রাজার ঘোড়া। অতি সুলক্ষণযুক্ত ঘোড়াটির গায়ের রং মেঘের মতো। মেঘবরণ ঘোড়াটির মুখখানি সোনালি হলুদ, দুই পাশের দুই পাঁজরে অষ্টমী তিথির দুই চাঁদ যেন ভেসে আছে! তার সমস্ত শরীর বিদ্যুৎপ্রভ, পেটের রং কুন্দফুলের মতো সাদা, চরণ হরিৎ বর্ণ, কানদুটি সিঁদুর রাঙা, তার জিহ্বা যখন দেখা যায়, মনে হয় প্রজ্বলিত অগ্নি বুঝিবা। দুটি চোখ সূর্যের মতো তেজময়, তার সর্ব অঙ্গে সুগন্ধ। সে ছিল অতি বেগবান। তার কপালে জয়পত্র বাঁধা। তার পিছনে পিছনে চলেছে রাজার সৈন্য। যে রাজ্যে ঢুকবে ঘোড়া, সেই রাজ্য যজ্ঞাধিপতি রাজার অধীন হয়ে যাবে।

এ তো একা এসেছে, সৈন্যসামন্ত কই? কে যেন বলে ওঠে

হা হা করে হাসে কে যেন, বলল, লুকিয়ে আছে, ঘোড়াটাকে ধর।

যজ্ঞের ঘোড়া সত্যি?

যজ্ঞের ঘোড়া, যজ্ঞের ঘোড়া। রব উঠল। বালকদের চিৎকারে নিঝুম গ্রামখানি জেগে উঠতে লাগল। কারা যেন ছুটে এলো কোথা থেকে। তাদের পাকানো গোঁফ, রক্তাভ চোখ, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, দেহখানি দানবের মতো। ঘোড়াটিকে দেখে তারাও চিৎকার করে ওঠে, অশ্বমেধের ঘোড়া, না হলে ঘোড়া আসবে কেন, এবার যুদ্ধ লাগবে।

: যুদ্ধের জন্য তো আমরা বসে আছি।

: যুদ্ধ না হলে দাঙ্গা হবে।

: দাঙ্গার জন্য বসে আছি কতকাল।

: যুদ্ধ হবে, যুদ্ধ হবে, অনেক দিন সহ্য করা হয়েছে, আর সহ্য করা হবে না, যুদ্ধ, যুদ্ধ, ঘোড়াটিকে ধর, যুদ্ধ হবে।

: মানুষ মরবে যে।

: মরুক, কতদিন মানুষ মরেনি, কতদিন আনন্দ হয়নি! আটকাও ঘোড়াটাকে, রায়ট লাগাও ঘোড়া আটকে।

কিন্তু এ কি সত্যিই অশ্বমেধের ঘোড়া? এ তো শাস্ত্রমতে সুলক্ষণযুক্ত নয়। এ তো মেঘবরণ নয়, সোনাবরণ মুখ নেই, চন্দ্র চিহ্ন নেই শরীরে। পেটে ঘা। অলক্ষুনে ঘোড়া, এ ঘোড়া পাঠাল কে?

হা হা করে হাসে একটা লোক, যবনের ঘোড়া, যবন মালিক হতে পারে ওর।

ধর ঘোড়াটাকে, আটকা। বলে ধেয়ে আসতে লাগল লোকগুলো। এখন টের পেল কন্থক বিপদ সামনে। তার শরীরে বেগ এলো। ঝিমিয়ে পড়া শরীর বিপদের ভয়ে টানটান হলো। ছুটল সে। সে ছুটতেই পিছনে ছুটে আসতে লাগল লোকগুলো, অশ্বমেধের ঘোড়া, মার, মার, ধর, ধর, যুদ্ধ লেগে যাবে, যুদ্ধ।

যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধ না হলেও যুদ্ধ! রব উঠতে লাগল। সেই রব পরিব্যাপ্ত হলো চতুর্দিকে। চারদিকে কথা উঠতে লাগল, অশ্বমেধের ঘোড়া ঢুকেছে, যুদ্ধ লাগল বলে। অশ্বমেধের না হলে যবনের ঘোড়া, তাহলেও যুদ্ধ। যুদ্ধ না হোক যুদ্ধের বাতাস বইবে। ঢিল মারতে মারতে ঘোড়াটার পিছনে ছুটে আসছিল মানুষজন। তারা সবাই ঘোড়াটাকে মেরে ফেলতে চায়। কতদিন মানুষ মারা হয়নি, ঘোড়াটাকে মেরে সেই মানুষ মারার যজ্ঞ আরম্ভ হোক। ঘোড়াটা ছুটছিল, বেগবান হয়ে উঠছিল ক্রমশ।

ঘোড়াটা বুঝতে পারছিল যদি ধরা পড়ে, মৃত্যু অনিবার্য। তার মৃত্যুর পরেই লেগে যাবে দাঙ্গা। দাঙ্গার একটা সূত্র চাই। যে কোনো সূত্র। দাঙ্গার কোনো যুক্তি চাই না, আরম্ভের কোনো একটা উপায় চাই। সেই উপায়টা হলো তার প্রাণ। সে যবনের ঘোড়া, না যজ্ঞের ঘোড়া এই নিয়ে কথা উঠল বলে। এরই ভিতর রব উঠেছে, যবনের ঘোড়া, যজ্ঞের ঘোড়া। যবন…! যজ্ঞ…!

সে তো কন্থক। এখন না হয় অশক্ত হয়েছে, কিন্তু সে তো সেই ঘোড়া যার রক্তে আছে অরণ্য, নদীতীর, আমুদরিয়া, সিরদরিয়া নামে দুই নদীর বাতাস, তৃণভূমির সুঘ্রাণ। সে ছিল রাজপুত্রের প্রিয়তম অশ্ব। সে কৃষ্ণবর্ণের না হোক, তার শরীরে, তলপেটের কাছে সোনালি একটি চিহ্ন তো রয়েছে। সরু চাঁদের মতো। সেই চিহ্নই তো বলে দেয়, তার স্মৃতিতে অশ্বমেধ যজ্ঞ আছে। কোনো এক পুরাণদিনে সে ছিল মেঘবর্ণ, বিদ্যুৎপ্রভাযুক্ত বেগবান অশ্ব। সে রাজার মহিমা, শৌর্য প্রচারে বেরিয়ে পড়েছিল জগৎ পরিক্রমায়। তার রাজা হবেন সসাগরা পৃথিবীর অধিপতি। এর চেয়ে আনন্দ কী হতে পারে? রাজা করেছেন নিরানব্বইটি যজ্ঞ, শততম যজ্ঞের কথা শোনাতে শোনাতে সে পার হয়ে যাচ্ছে নদী, পাহাড়, অরণ্য, শস্যভূমি, গ্রাম, নগর, রাজ্য, রাজধানী। একটি বৎসরকাল গেল পরিক্রমায়। ফিরে এলো সে বৎসর অতিক্রান্ত হলে।

সে ছুটছিল। ছুটতে ছুটতে পার হয়ে যাচ্ছিল কত গ্রাম! কত শস্যহীন শস্যক্ষেত্র। কত ঊষরভূমি, বালুকাময় প্রান্তর। মনে পড়ে যাচ্ছিল সে ফিরল রাজধানীতে। বিজয়ী অশ্বকে বরণ করল পুরনারীরা। সে ফিরল দেশজয়ের খবর নিয়ে। বিজয়ী অশ্বকে যজ্ঞস্থলে নিয়ে গেল পুরোহিতরা। তারপর!

ঘোড়াটি দেখল সে কোনো এক অরণ্যে ঢুকেছে। কোন অরণ্য জানে না। সে হাঁপাচ্ছিল। জিভ বেরিয়ে এসেছিল। প্রজ্জ্বলিত অগ্নির মতো ছিল যে জিহ্বা, তা এত করুণ হতে পারে জানা ছিল না। লালা ঝরছিল একনাগাড়ে। লালায় ভিজে যাচ্ছিল বালি, মাটি।

সে টের পাচ্ছিল যে বালিতে সে অভ্যস্থ, সেই বালি নেই পায়ের নিচে। যে অরণ্য তার স্মৃতিতে আছে যুগযুগান্ত ধরে, সেই অরণ্যের সঙ্গে এই অরণ্যের মিল নেই। সে দেখছিল চারপাশে কাঁটাগাছ ফণিমনসার ঝাড়। এত বড় বড় কাঁটাগাছের ঝোপ সে আগে দেখেনি। তার মাথায় ঘোলাটে রোদ। আকাশ হয়ে উঠেছিল ধূম্রবর্ণ। সে দেখছিল দূরে কোথাও যেন মেঘ উঠছে। লোকজনকে দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর কানে জেগে ছিল। যুদ্ধ না হয় দাঙ্গা, দাঙ্গা না হয় যুদ্ধ। অশ্বমেঘের ঘোড়াটি গেল কোথায়? লোকজন হইহই করছিল, ওই যে আবার। আকাশ কালো হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ লেগে গেল! যুদ্ধের জন্য মানুষ অধীর হয়ে উঠেছে।

ঘোড়াটি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে যে ভেবেছিল অরণ্যে ঢুকেছে, আসলে তা নয়। তার মনে অরণ্যের ভাব জেগেছিল। মনে মনে অরণ্যকে আকাঙ্ক্ষা করেছিল সে। অরণ্যই তাকে বাঁচাতে পারে। সে লুকিয়ে পড়তে পারে অরণ্যে। সে দূরের ধূম্রবর্ণ আকাশের দিকে চেয়ে ছিল। আহা! মেঘ থেকে যদি বৃষ্টি নামে সে বেঁচে যেতে পারে। কিন্তু সে যদি সত্যিই অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য প্রদত্ত হয়ে থাকে, তবে!

রাজার ঘোড়ার অধিকার নিলেন যজ্ঞের পুরোহিত। তার মনে পড়ে যাচ্ছিল সব। তাকে স্নান করানো হলো, তাকে শুদ্ধ করে যজ্ঞের যূপকাষ্ঠের দিকে নিয়ে যাচ্ছে পুরোহিতের দল। পুরোহিত ঘোষণা করছেন, রাজা হয়েছেন রাজ চক্রবর্তী, পৃথিবীর অধীশ্বর। রাজা নিবেদন করছেন এই বেগবান অশ্বকে দিগ্বিজয়ী ইন্দ্রের প্রতি। তারপর! তার আর মনে নেই, সে দেখেছিল এক ভীষণ খড়্গগ। সূর্যের আলোয় সেই খড়্গগ জ্বলে উঠেছিল অগ্নির ন্যায়। সেই স্বর্ণাভ খড়্গগখানি রক্তের লোভে নেমে আসছে তার ওপর। সে কেঁদে উঠেছিল ভয়ে। এইটুকু!

কী হয়েছিল তারপর? সে শুনেছিল হয়তো, নাকি জেনেছিল অন্য কোনো জন্মে। মৃত অশ্বটিকে নিয়ে বসে আছেন রাজমহিষীরা। অশ্বের বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করে হৃদয়খানি তুলে এনে যজ্ঞে দগ্ধ করতেন পুরোহিত। সেই দগ্ধ হৃদয়ের ঘ্রাণ নিতেন রাজা। রাজমহিষীরা গোপনে হয়তো চোখের জল ফেলতেন। অশ্বের মৃত শরীর নিয়ে সমস্ত রাত বসে আছেন তাঁরা। এক মহিষী অন্যজনকে বলছেন বেগবান অশ্বের শৌর্যের কথা। কথাগুলো।

ঘোড়াটির ভয় হচ্ছিল। সে ডাকছিল আকাশের মেঘকে। মেঘ এসে তার পৃথিবীকে শীতল করতে পারে। তার পায়ের নিচে আগুন, মাথার ওপরে আগুন, তার চতুর্দিকের অগ্নিবলয় তাকে অধিকার করেছিল ক্রমশ। তার ভিতরে মানুষের কণ্ঠস্বরগুলো ঢুকে পড়ছিল দ্রুত। ঘোড়াটিকে ধরতে যারা এসেছিল তারা তাকে খুঁজে বের করতে চাইছিল। ঘোড়াটিও মানুষগুলোকে খুঁজে না পেয়ে অবাক হচ্ছিল। তাকে যারা মারতে এসেছে, তারা কোথায়? তারা কি পিছনে, সামনে, দক্ষিণে, বামে? কোনো দিকেই তাদের না দেখে যখন সে নিশ্চিন্ত হচ্ছিল সে শব্দের বিভ্রমে পড়েছে, তখন আবার গর্জন শুনতে পেল, কোথায় সেই যবন ঘোড়া?

কোথায় সেই যজ্ঞের ঘোড়া?

সে জানে এক মহামানবকে আলোর পথে সে নিয়ে গিয়েছিল। ফিরেছিল শূন্য হয়ে। সে জানে না সে যজ্ঞের ঘোড়া কি না। সে জানে না সে যবনের ঘোড়া কি না। অথচ মানুষের গর্জনে তার মনে হচ্ছিল সে হয় যজ্ঞের ঘোড়া, না হয় যবনের ঘোড়া। যজ্ঞের ঘোড়াকে মরতে হবে, পুরোহিত তাকে বধ করবে, তার দেহ নিয়ে রাজমহিষীরা চোখের জল ফেলবে, আর যবনের ঘোড়া হলে তাকে খণ্ড খণ্ড করে ছড়িয়ে রেখে যাবে হত্যাকারীর দল! মরতে তাকে হবেই। তার পিছনে ঘাতকরা জোট বেঁধেছে, না মেরে তাকে ছাড়বে না। সে উত্তাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য ধূমাবতী আকাশের দিকে ধেয়ে যেতে চায়। কী গভীর কালো ওই বর্ণ। মেঘের চেয়েও কালো এই ধূম্রবর্ণ। আর পারছিল না ঘোড়াটি।

সে টলছিল। তার পা বসে যাচ্ছিল বালিতে। এত বালি এলো কোথা থেকে? এ কি সমুদ্র শুকিয়ে যাওয়া বালুকারাশি? এত বালি, এত গভীর বালুকাসমুদ্র সে আগে দেখেনি। এত উত্তাপও যেন আগে কখনো অনুভব করেনি। বালির প্রতিটি কণা যেন অগ্নিকণার মতো পুড়িয়ে দিচ্ছে তার দেহ। আগুনের স্রোতে তার গায়ের চামড়া যেন ঝলসে যাচ্ছিল। সে আকাশে ঘাড় উঁচিয়ে মেঘ দেখতে চায়। বালির সমুদ্র ছেয়ে যাচ্ছিল মেঘে। মেঘ যেমন দিগন্ত থেকে ওঠে জলসমুদ্রে, এও তো তেমনই। মেঘের ছায়া যেমন জলে পড়ে, এও তো তেমনই। বালির রং বদলে কালো হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু উত্তাপ বাড়ছিল ক্রমশ। আরও তাপ, আরও তাপ লোহা গলে যাওয়ার মতো তাপ উঠছিল ধরিত্রী-গর্ভ থেকে, পৃথিবী গলে যাচ্ছিল হয়তো ধরিত্রী-গর্ভে। সেই সময় আবার গর্জন উঠল, যজ্ঞের ঘোড়া, না যবনের ঘোড়া? সে থরথর করে কাঁপছিল। তার মনে পড়ছিল…

আমি কোথায়? কেঁদে উঠল সে। এই কি আমার পৃথিবী? নদী, পর্বত, সমুদ্র, মেঘ, বৃষ্টি, বাতাস! আলোর পৃথিবী কি এই? হে রাজপুত্র, আমাদের বিসর্জন দিয়ে তুমি সর্বস্বত্যাগী হলে। এই পৃথিবী হিংসায় পূর্ণ-দুঃখের সমুদ্র, ব্যাধির ফেনায় বিকীর্ণ, জরার তরঙ্গে উদ্বেল, মৃত্যুর উগ্রতায় ভয়ংকর। তুমি সেই হিংসার পৃথিবীতে রেখে গেছ ছন্দক আর কন্থককে। হে কুমার, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না আমার পায়ের নিচে তপ্ত বালুকাসমুদ্র, মাথার ওপরে ধূমাবতী আকাশ, আমার পিছনে হত্যাকারীর দল। হে গৌতম শাক্য সিংহ, এ আমি কোথায় এলাম? আমার যে শুধু তোমার কথা মনে পড়ে, সারথির কথা মনে পড়ে, তুমি কি ভুলে গেছ সব? এই যে আকাশে ফুটত সোনালি রঙের মেঘ, তার নিচে সারথি আর তুমি, হে সারথি ছন্দক!

কে যেন আবার হাঁকল যবনের ঘোড়া। কে যেন ডাকল যজ্ঞের ঘোড়া। তোমাকে বধ করে তোমার ঝলসানো হৃদয়ের ঘ্রাণে রাজা পৃথিবীর অধীশ্বর হবেন। যবনের ঘোড়া, তুমিই বা কোথায়? তোমাকে হত্যা করেও রাজা হবেন দিগ্বিজয়ী। যবনের ঘোড়ার রক্তে শুদ্ধ হবেন রাজ চক্রবর্তী। কন্থক ছুটল। কালো মেঘের দিকে ছুটল। সে মেঘের দিকে এগোতেই বর্ষণ শুরু হলো। কালো বৃষ্টি ঝরে পড়তে লাগল মেঘ থেকে। এই সেই বৃষ্টি যা হিরোশিমা ভাসিয়ে দিয়েছিল বহু বর্ষ আগে এই সেই মেঘ যে মেঘ হিরোশিমার আকাশ ছেয়ে ফেলেছিল অভিশপ্ত দিনটিতে, যে মেঘ এখনও মাথার ভিতরে বহন করে চলেছে মানুষ, হিরোশিমার মানুষ। কৃষ্ণবর্ষণ চারদিক অন্ধকার করে দিল। কৃষ্ণজলধারা নেমে আসছিল বালুকাসমুদ্রের ওপর। ঘোড়াটি অন্ধ হয়ে গেল। তার গায়ের রোম খসে খসে যেতে লাগল। তার কেশর ঝরে যেতে লাগল, পুচ্ছ ঝরে যেতে লাগল। সে ছুটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। নাকমুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলো। রক্তের লাল রং বাইরে বেরিয়েই কালো হয়ে গেল। ঘোড়াটি উঠতে চাইছিল। তার জিভ বেরিয়ে আসে। জিভ তেজস্ক্রিয় বাতাসে খসে যেতে থাকে। সে ধরতে পারে কালো আগুনের সমুদ্রে সে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঋতু বদল হয়নি, শুধু সে ভুল করেছিল। ভুল তো হয়েই থাকে। প্রকৃতির এমন জাদু আছে বলেই প্রাণ আছে। প্রাণ থাকে। কিন্তু সেই ভুল কোথায় নিয়ে এলো যে তাকে!

শেষবারের মতো দৌড়তে গিয়ে ঘোড়াটা উলটে পড়ে যায়। আবার ওঠে। আবার পড়ে। বালির সমুদ্রে সে ডুবছিল আর উঠছিল। বালিতে, আগুনে স্নান করতে থাকে সে। অন্ধ চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল বেরোতে থাকে। ওই জল ব্যতীত আর কোথাও জলের চিহ্ন নেই এই হিরোশিমায়। চোদ্দবেড়িয়া মুছে গেছে, কপিলাবস্তু মুছে গেছে, সমুদ্ৰ মুছে গেছে, মুছে গেছে জ্যোৎস্না রাত্রি I

অন্ধ ঘোড়াটি তবু উঠে দাঁড়ায়। তার কেশর পুড়ে গেছে, পুচ্ছ পুড়ে গেছে, গায়ের চামড়া পুড়ে গেছে, সব রোম ঝরে গেছে। তাকে আর চেনা যাচ্ছিল না যজ্ঞের ঘোড়া বলে, যবনের ঘোড়া বলে।

অন্ধ ঘোড়াটি হাঁটছিল। বালিতে ডুবে ডুবে মুখ তুলছিল। তার মনে পড়ছিল আশ্বিনের কথা। কাশফুলের কথা। মেঘের কথা। জ্যোৎস্নার কথা। গিরিমশায়ের ঘুড়ীটির কথা। রাত্রি হয়ে এলো। আকাশ কালো। একটিও তারা নেই, চাঁদ নেই। কোথাও কোনো আলো নেই। শুধু তার মাথার ভিতরে বুদ্ধদেবের মতো প্রেমময় চাঁদ ছিল। আলো ছিল। চাঁদ আর আলোর স্মৃতি ছিল। সমুদ্র ছিল, বাতাস ছিল, সবুজ তৃণভূমি ছিল। ছিল সেই রাজপুত্র যার মাথায় মাথায় চলত সোনালি রঙের মেঘ, শ্বেতকবুতর উড়ত যে মেঘে, সেই মেঘের দিনগুলো স্মৃতিতে আছে। কন্থক মরে যেতে যেতে উঠে দাঁড়াতে চাইছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *