নয়
লখনউ থেকে বিদায়, ধূর্জটিবাবু ও ছায়ামাসির স্নেহসিক্ত শুভেচ্ছা নিয়ে ট্রেনে করে কলকাতা। কলকাতার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ উদ্দাম আড্ডা। বোধহয় জাহাজের টিকিট কাটতে আমার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল, মুম্বাই থেকে ইওরোপগামী জাহাজে জায়গা পেলাম না, কলম্বো ছুঁয়ে যাওয়া, ওরিয়েন্ট লাইনের ‘অট্রান্টো’ জাহাজে ব্যবস্থা হলো। কলকাতা থেকে বিমানে মাদ্রাজ, সেখানে উডল্যান্ড হোটেলে এক মস্ত সুইটে রাত্রিবাস। ঘরটি খাশা, আহার নিরামিষ হলেও উপাদেয়। মাদ্রাজ থেকে ফের বিমানে চেপে কলম্বো, কলম্বোর গ্র্যান্ড ওরিয়েন্টাল হোটেলে নিশিযাপন, পরদিন মধ্যঅপরাহ্ণ জাহাজ ছাড়লো। পথে নেপ্লসে নেমে পম্পেই দর্শন, মার্সেইতে নেমে লা কারবুয়েরের সৃষ্টি ও নির্মাণ অবলোকন, সতেরো-আঠেরো দিন বাদে টিলবেরি ডকে নেমে লন্ডনের প্রথম দর্শন। দু’-রাত কাটিয়ে ছোটো জাহাজে চেপে উত্তরসাগর পাড়ি দিয়ে হল্যান্ডের পোত, হুক-ভ্যান হল্যান্ড, সেখান থেকে ট্রেনে হেগ শহরে পৌঁছোনো। সদ্য সংস্কার হয়েছে, টাটকা প্রসাধনের গন্ধে ছাওয়া নর্ডেন্ডের রাজপ্রাসাদ, বিদ্যার্থীদের মধ্যে আমিই প্রথম সেখানে প্রবেশ করলাম।
ঢাকা ছিল অজ মফস্বল। ওখানে বাংলা ভাষার মধ্যবর্তিতায় স্কুলের পড়া শেষ করেছি। আই এ, বি এ, এম এ পড়াও ঢাকা ও কাশীর মতো প্রায় গ্রাম্য পরিবেশে, চলা-ফেরায় ও আচরণে গ্রাম্য গন্ধ। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও আমার কপাল ফিরলো না, অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ নয়, হার্ভার্ড-বার্কলে নয়, নেহাতই দীনদরিদ্র হেগ শহর, ওলন্দাজ ভাষায় বলে ‘দেন হাগ’, আরও একটু সংস্কৃত করে বলা হয় ‘স্ক্রাভেনহাখেন’। কী আর করা, মেনে নিতে হয়। আমার পক্ষে সান্ত্বনা ছিল, অধ্যাপক টিনবার্গেনের সঙ্গে কাজ করতে পারবো, তাঁর বক্তৃতা শুনতে পাবো, তাঁর কাছ থেকে শিখতে পারবো, এক মস্ত সৌভাগ্য! পৃথিবীর অন্যতম প্রধান অর্থনীতিবিদ, কিন্তু স্বভাবে-ব্যবহারে যথার্থই তৃণাদপি সুনীচেন। শহরের সর্বত্র সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়াতেন, আমাদের পড়াতে আসতেন, তা-ও সাইকেলে চেপে। অথচ তখন তিনি, অধ্যাপনার পাশাপাশি, ওদেশের পরিকল্পনা পরিষদের প্রধান, সরকারি যানবাহন তাঁর এমনিতেই প্রাপ্য। মজার ব্যাপার যিনি দেশের সংখ্যা পরিষদের অধ্যক্ষ, তিনিও আমাদের পড়াতে আসতেন, প্রতিদিন তাঁর আগমন শোফার-চালিত মস্ত মার্কিন গাড়ি চেপে, হয়তো প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই নামতেন অধ্যাপক টিনবার্গেন তাঁর বিনীত সাইকেল থেকে। আমাদের পড়াতেন ইংরেজি ভাষায়, কোনওরকম ভণিতা ছিল না, পরিস্বচ্ছ, অনাড়ম্বর বিশ্লেষণ, যুক্তির ধাপে-ধাপে মিনিটের পর মিনিট এগোনো, আবিষ্ট হয়ে শুনতাম, কখন ঘণ্টা অতিক্রান্ত হতো টেরও পেতাম না। ক’দিন বাদে ওঁর সঙ্গে আমার গবেষণার কাজ শুরু হয়ে গেল। প্রতি সপ্তাহে পরামর্শ দিতেন কী বই ঘাঁটবো, কী রিপোর্ট দেখবো, কোন-কোন রিগ্রেশন অঙ্ক কষে এনে তাঁকে পরের সপ্তাহে দেখাবো। নিয়মের কোনও বিচ্যুতি নেই, আমার সামর্থ্য ও মেধার মাপে তত্ত্বকথা রচনা করতে দিতেন, অঙ্ক কষবার কথাও বলতেন, পরের সপ্তাহে, আগে থেকেই সময় দেওয়া থাকতো, নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে দেখাতাম, ফের পরামর্শ, খানিকটা সংশোধন আমি যা করে নিয়ে এসেছি সেই কাজের, পরের সপ্তাহের করণীয় সম্পর্কে নম্র নির্দেশ। প্রায় পনেরো মাস ধরে আমার গবেষণার কাজ চলেছিল, কোনও সপ্তাহেই এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। যা ইতিপূর্বেই সম্ভবত একাধিকবার বলেছি, অর্থশাস্ত্রে আমার কোনওদিনই তেমন দুরন্ত আগ্রহ ছিল না, প্রথম পর্বে অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্তের, এবং এই পর্বে অধ্যাপক টিনবার্গেনের, অনুপ্রেরণায় বিষয়টিকে একটু-একটু করে যেন ভালোবাসতে শিখলাম।
টিনবার্গেনের সমাজতন্ত্রে নিবিড় বিশ্বাস, হল্যান্ডের সমাজতান্ত্রিক দলের তিনি অন্যতম প্রধান সদস্য, তার উপর কোয়েকার সম্প্রদায়ের সঙ্গেও তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। আদ্যন্ত সাধুপ্রকৃতির মানুষ, গলার স্বর সর্বদা অনুচ্চ, বাড়ির কাজে স্ত্রীকে অজস্র সাহায্য করেন, ভৃত্যহীন সংসার, এরই মধ্যে আমাদের মাঝে-মাঝে নৈশাহারে আমন্ত্রণও জানান। তাঁর সৌজন্যে আমরা বিব্রত। হয়তো একটি বিশেষ বিষয়, যা আমার গবেষণাকর্মের সঙ্গে সংপৃক্ত, তা নিয়ে উভয়ে আলোচনা করছি, আলোচনা তেমন এগোচ্ছে না, তিনি একটি তত্ত্ব কাগজে মকশো করছেন, পছন্দ না হওয়ায় কাটছেন, ফের মকশো করছেন, সম্ভবত মিনিট পাঁচ-দশ এমনি গেছে, হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে সাতিশয় বিনীত উচ্চারণে : ‘তোমার এত সময় নষ্ট করছি, আমি অত্যন্ত লজ্জিত’। বলা ভালো, অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হলে প্রথম বছরই টিনবার্গেন তা পেয়েছিলেন।
মহাবিদ্যালয়ের নাম, আগেই উল্লেখ করেছি, ইনস্টিটিউট অফ সোস্যাল স্টাডিজ। বহু দেশ থেকে ছাত্রছাত্রীর আগমন, ইওরোপ-এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা ঝেঁটিয়ে। প্রাসাদের দোতলায় লেকচারকক্ষ, বসার লাউঞ্জ, খাবার ঘর, লাইব্রেরি, ক্লাসঘর ইত্যাদি। সারা পৃথিবী থেকে খবরের কাগজ, পত্র-পত্রিকাদি, পড়ে ফুরোনো যায় না। অধিকাংশ বিদ্যার্থীর বয়স তিরিশের নিচে। তাঁদের কলকাকলি প্রাসাদকে কাঁপিয়ে তোলে, দিনে, রাত্রিবেলায়ও। দোতলার এক পাশে পড়তে-আসা মেয়েদের জন্য আবাসস্থান, আমরা ছেলেরা প্রাসাদের পুরো তেতলা জুড়ে থাকি। প্যান্ট্রিতে সারাক্ষণ কফির ব্যবস্থা, সেই সঙ্গে হল্যান্ডের বিখ্যাত বিয়ার, অথবা নানা ফলের নির্যাস। কফির সময় অধ্যাপকবৃন্দের, ছাত্রছাত্রী সমভিব্যহারে, লাউঞ্জে জড়ো হওয়া, লেকচারের রেশ তুলে ফের আলোচনা, বিরতি শেষ। কোনও ছাত্রীর কফি পান তখনও শেষ হয়নি, হঠাৎ দেখি অধ্যাপক টিনবার্গেন সেই ছাত্রীর পেয়ালাটি নিজে হাতে করে ক্লাস ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন, ছাত্রীটির লজ্জার শেষ নেই, আমাদেরও।
অর্থশাস্ত্রের বাইরে সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ও ওখানে পড়ানো হতো, অধ্যাপকরা হল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসতেন, যাঁরা একটু দূর থেকে আসতেন তাঁরা রাত্তিরটা আমাদের সঙ্গে কাটাতেন, মেলামেশা, আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের প্রচুর সুযোগ। সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক আইন এ-সব বিষয় তো ছিলই, পাশাপাশি বিভিন্ন ইওরোপীয় ভাষা শিক্ষারও ব্যবস্থা, যার যা অভিরুচি। প্রায়ই এখানে-ওখানে দল বেঁধে শিক্ষাসফরে গমন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া তো ছিলই। রটারডাম বন্দর পরিদর্শন, দেশের নিচু অঞ্চলে ডাইক-বাঁধ দেখতে যাওয়া, আইন্ডহোভেন শহরে গিয়ে ফিলিপস সংস্থার শাখাপ্রশাখা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিদর্শন। সব শেষে, যা বিশেষ করে বলতে হয়, চিত্র প্রদর্শনীগুলি চষে বেড়ানো: আমস্টারডাম, রটারডাম, হেগ, লাইডেন কোথায় নেই চিত্রের সমারোহ, দেখে আশ মেটে না। টিশিয়ান প্রমুখ ঘোর ধ্রুপদী শিল্পীদের শিল্পকর্ম ছেড়েই দিলাম, ভ্যানডাইকের কথাও না হয়, কিন্তু উজাড়-করা রেমব্রান্ট, উজাড় করা ভার্মিয়ার, উজাড়-করা ভ্যান গঘ্, গোটা দেশ জুড়ে ইমপ্রেশনিস্ট, উত্তর-ইমপ্রেশনিস্ট এবং পরবর্তী যুগের কিউবিস্ট বা বিকল্প কোনও বিমূর্ত-প্রাকরণিক-পদ্ধতিতে-অঙ্কন-দুরস্ত শিল্পীদের ছবিও চতুর্দিকে এন্তার ছড়ানো৷ যে-দেড় বছর-দু’বছর ওদেশে ছিলাম, যদি গবেষণার কাজে পুরো অবহেলাও করতাম, আমার মানসিক বিকাশে তবু কোনও খামতি ঘটতো না, যে-হাজার হাজার চিত্ৰসম্ভোগে ওই সময়টা অতিবাহিত করেছি তার নান্দনিক মূল্যের তুলনা হয় না। আন্তর্জাতিক পরিবেশের মধ্যে থাকা, নানা দেশের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেশা, তাদের সমাজের-রাজনীতির কথা জানা। শুনছি স্বাধীন দেশের, সদ্য-স্বাধীন-হওয়া দেশের, স্বাধীন হবো-হবো-করা দেশের, এখনও-পরাধীনতার-অন্ধকারাচ্ছন্নতায় লেপা-পোছা দেশের, সৌন্দর্য ও সমস্যার বিবরণ। প্রায়ই সান্ধ্য অনুষ্ঠান, বক্তৃতা, আবৃত্তি, কণ্ঠসংগীত, যন্ত্রসংগীত, টুকরো-টাকরা অভিনয়, হল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছেলেরা-মেয়েরা আসছে, আমরা তো আছিই। আমাদের থাকবার প্রথম বছর ছোটো দেশ বন্যার তোড়ে ভেসে গেল, কয়েকদিনের জন্য আমরাও গিয়ে ত্ৰাণকার্যে যোগ দিলাম, সাধ্য ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী।
একই প্রাসাদে ছেলেরা-মেয়েরা প্রায় একসঙ্গে থাকছে, মাত্র একটি তলার ব্যবধান। তাই আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না যে, এই দেশের মেয়ে ওই ভিন দেশের ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, ওই ভিন দেশের ছেলে এই দেশের মেয়ের প্রতি। এধরনের অনুরাগে-বিনিময়ে প্রচুর মাধুর্য অবশ্যই ছিল, তবে কোনও-কোনও ক্ষেত্রে অন্তিমে বিষাদকাহিনীও। একটু ভারসাম্যের অভাব ছিল, প্রথম বছর ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাধিক্য সামান্য দৃষ্টিকটু, তবে আস্তে-আস্তে সেই অস্বস্তি মিলিয়ে যায়।
আমার পক্ষে যা মস্ত ভাগ্যের ব্যাপার, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান, দু’দিক থেকে আসা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সমান সৌহার্দ্য অচিরেই গড়ে উঠলো। যা তখন থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছিল, এঁদের নিজেদের মধ্যে আড়াআড়ি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রছাত্রীদের একটু নাক-উঁচু ভাব, পূর্ব পাকিস্তানিরা এত পিছিয়ে-পড়া, লেখাপড়ায়-খেলাধুলায় সব ব্যাপারে, ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না, ওরা যেন পাকিস্তানের লজ্জা। অন্য পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের যে-ক’জন ছিলেন, অধিকাংশই তরুণ অধ্যাপক, কিংবা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনো বিদ্যার্থী-বিদ্যার্থিনী, তাদের পর্বত-প্রমাণ পুঞ্জীভূত ক্ষোভ: পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, আমরা যদিও সংখ্যায় ওদের চেয়ে অনেক বেশি, বিভিন্ন ব্যাপারে সমপরিমাণ সুযোগ পাচ্ছি না আমরা। এরই মধ্যে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এলো, গেল। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিশেবে চাই, এই দাবিতে সারা পূর্ব পাকিস্তান আলোড়িত, তার ঢেউ পৌঁছলো সাড়ে ছ-হাজার মাইল দুরে হল্যান্ডেও, পাকিস্তানের দুই তরফের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ভুলবোঝাবুঝির বোঝা আরও ভারি। আমার মতো কয়েকজন ভারতীয়কে মধ্যবর্তী হয়ে তাদের মধ্যে শালিসি করতে হতো৷ সম্ভবত আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম, এখানে এক সঙ্গে আছি, এক সঙ্গে থাকছি, পড়ছি, খেলছি, বেড়াচ্ছি, রাজনীতির কর্কশ প্রসঙ্গগুলি যেন খানিকটা চাপা দিয়ে রাখতে সবাই সচেষ্ট হই; একটু-আধটু পারস্পরিক রঙ্গ, চিমটি কাটা অবশ্যই চলতে পারে।
এরই মধ্যে একটি ব্যাপার ঘটলো। হঠাৎ বছরের শেষে পাকিস্তান থেকে তিন-চার জন উচ্চপদস্থ আমলা এসে আমাদের সঙ্গী হলেন, তাঁরা পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কিংবা ওধরনের কোনও পাঠক্রমে ভর্তি হয়ে ছ’ মাস থাকবেন। হবি তো হ, তাঁদের মধ্যে একজন ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, নাম, যদ্দুর মনে পড়ে, কুরেশি, তিনিই একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকায় গুলিচালনার আদেশ দিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রছাত্রীরা রাগে ফুঁসছে, কুরেশির সঙ্গে কথা তো বলবেই না, তাঁর সঙ্গে তারা নাকি এক টেবিলে বসে পানাহারও করবে না; যদি এ-ব্যাপারে ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ কোনও অন্যায় অনুরোধ জ্ঞাপন করেন, তা হলে তারা দল বেঁধে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতেও প্রস্তুত। এই সংকটে ওলন্দাজ কর্তাব্যক্তিরা আমাদের, ভারতীয় ছাত্রদের, শরণাপন্ন হলেন, আমরা যদি পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব দয়া করে মিটিয়ে দিই। উভয় পক্ষের সঙ্গেই কথা বলা হলো, বিদেশে নিজেদের কেলেঙ্কারি ফলাও করে প্রকাশ করলে তেমন একটা স্বাস্থ্যকর পরিণাম না হওয়ারই আশঙ্কা। দু’পক্ষই ক্রমশ ঠান্ডা হলো। রফা হলো, পূর্ব পাকিস্তানিরা কুরেশির সঙ্গে কথাবার্তা না বলুক; এক টেবিলে খেতে আপত্তি নেই, যদি একেবারে পাশাপাশি বসতে না হয়। শান্তি চুক্তি গোছের কিছু স্থাপিত হলো, তবে তখন থেকেই বুঝতে পারছিলাম যা জোড়া লাগবার নয়, তা জোড়া লাগবে না। এক দিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যুগ্র অহমিকা, অন্য দিকে পূর্ব পাকিস্তানিরা ততদিনে মাতৃভাষা বাংলার প্রেমনিগড়ে বাঁধা পড়ে গেছে, তারা ইতিমধ্যেই অনুদ্ধারণীয়।
সেই সময়টা জো ম্যাকার্থিরও অভ্যুদয়-পতনের যুগ। ইনস্টিটিউটে বেশ কয়েকজন মার্কিন ছাত্রছাত্রী ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও দুই ভাগ, কেউ-কেউ ঘোর কমিউনিস্ট-বিদ্বেষাকীর্ণ, ম্যাকার্থির অন্ধ ভক্ত; অন্য পক্ষ ইলিনর রোজভেল্টের আদর্শে দীক্ষিত, ম্যাকার্থিয় অনাচার তাঁদের কাছে অসহ্য। এঁদের মধ্যে এক দম্পতি, মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওয়েন ল্যাটিমোর, যাঁকে ম্যাকার্থি অন্যায়ভাবে নাস্তানাবুদ করেছিলেন, তাঁর অন্ধ ভক্ত। তাদের সঙ্গে অন্য পক্ষীয়দের প্রায়ই তর্ক-বিসংবাদ হতো, তবে তার তিক্ততা পাকিস্তানিদের অন্তর্কলহের স্তরে পৌঁছুতো না।
দীর্ঘ গ্রীষ্মাবকাশে এবং অন্য ছুটি-ছাঁটায় হল্যান্ড থেকে বেরিয়ে পড়তাম, ইওরোপ যতটা সম্ভব দেখে নেওয়া যায় সেই লক্ষ্যে। পাথেয় কম, টিপে-টিপে খরচ করতে হতো। এখান-ওখান থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে ভিন দেশের ভিন শহরে এঁর-ওঁর-তাঁর কাছে আতিথ্য মেলবার অন্বেষণ, কখনও-কখনও সে-অন্বেষা সফলও হতো।
এমনই একবার বেরিয়ে সপ্তাহ দুই প্যারিসে এক ঘোর বাঙালি আড্ডায় কাটিয়ে এসেছিলাম। আমার লখনউবাসের বন্ধু টোলন অধিকারী, সংখ্যাতত্ত্বে মস্ত পণ্ডিত, পরে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ হয়েছিল, তারই আতিথ্যে প্যারিসে বেশি সময় কাটানো। তখন কয়েক গণ্ডা কলকাত্তাই মানুষ প্যারিসে প্রবাসী, যাঁদের কথা মনে পড়ছে তাঁদের মধ্যে পরিতোষ সেন, হৈমন্তী সেন (পরে মজুমদার), কবি-ঔপন্যাসিক লোকনাথ ভট্টাচার্য, ফরাসী চলচ্চিত্রকৌশল শিখতে আসা গড়পাড়ের বারীন সাহা, আরও অনেকে। আমার বন্ধু শান্তি চৌধুরীর বোন অঞ্জুও ততদিনে গিয়ে পৌছেছিল কিনা মনে নেই। উন্মাদনায় ঠাসা ঋতু সেটা, ফরাসী দেশে কমিউনিস্ট পার্টি সবচেয়ে শক্তিশালী দল, তাদের শ্রমিক সংগঠন সি জি টি যে-কোনো মুহূর্তে পুরো দেশকে ধর্মঘটে স্তব্ধ করে দিতে পারে। ছাত্র-শিক্ষক-কবি-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা সবাই ঝাঁক বেঁধে কমিউনিস্ট পার্টিতে। জাঁ পল সার্ত্র পর্যন্ত ঘোষণা করেছেন, দর্শন বিচারে দলের সঙ্গে তাঁর যত মতভেদই থাক, তিনিও বিশ্বাস করেন ফ্রান্সের ভাগ্য, ইওরোপের ভাগ্য, গোটা পৃথিবীর ভাগ্য কমিউনিস্ট আন্দোলনের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। শান্তি আন্দোলন দেশে-দেশে দানা বেঁধেছে, ফ্রান্স তার কেন্দ্রবিন্দু, পিকাসোর আঁকা ঘুঘুপাখি রুমালে-ন্যাপকিনে-স্কার্ফে-পাতা চাদরের নক্সায়-খাবার টেবিলে-হাওয়ায় ওড়ানো বেলুনে শোভা পাচ্ছে। হেগ থেকে ট্রেনে চেপে যখন প্যারিসে রওনা হলাম, এক মার্কিন বান্ধবী উপহার হিশেবে একেবারে শেষ মুহুর্তে একটি বই হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। ট্রেনে বইটি খুলে দেখি ভিতরে একটি দশ ডলারের নোট, সঙ্গে ছোট্ট পিনে গাঁথা শাদা কাগজে দু’লাইনের পদ্য: ‘অশোক ডিয়ার/হ্যাভ এ বিয়ার’। আমার বিবেক এতটুকু কাঁপলো না, তখন দশ ডলারের ক্রয়মূল্য অনেক, কমিউনিস্ট পার্টির সদর দফতরে গিয়ে চল্লিশটি পিকাসোর ঘুঘু-আঁকা শান্তি রুমাল কিনে জনে-জনে বিলিয়েছিলাম, মার্কিন সাহায্যের এমন যথাযথ ব্যবহারের নিদর্শন আমাকে অতিক্রম করে বোধহয় আর কেউই দেখাতে পারেননি।
প্যারিসের বাঙালি আড্ডা কমিউনিস্ট ও কমিউনিস্ট সমর্থকে ঠাসা। বারীন সাহা তাদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা, এমনকি শান্তিনিকেতনের আট-দশ বছর মিহিন হাওয়া গায়ে-লাগানো ছেলে লোকনাথ, সে-ও ততদিনে বামে ঝুঁকেছে, পরিবেশের পাপ। তবে সেই মুহূর্তে লোকনাথ এত বেশি করে বান্ধবী ফ্রাঁসের প্রেমে মশগুল যে, সব সময় রাজনৈতিক স্লোগানে জোগান দেওয়ার মতো সময় বার করতে পারতো না।
প্যারিসের ক্ষণিক সাম্যবাদী বসন্ত, হল্যান্ডে ফেরা। তবে আমরাও পিছিয়ে রইলাম না। খুঁজে-পেতে হল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় ছাত্রদের হদিশ নিলাম, তাদের নেমন্তন্ন করে হেগ শহরে নিয়ে আসা হলো, সবাই মিলে হল্যান্ডের ভারতীয় ছাত্র সংসদের সম্মেলন উদ্যাপন করলাম, রাজপ্রাসাদে প্রচুর বামপন্থী অঙ্গীকার উচ্চারণ করে। হল্যান্ডের দু’-তিনটি বামপন্থী দল থেকে প্রতিনিধিরা এলেন, প্যারিস থেকে অনুরূপ প্রতিনিধি হয়ে এলো লোকনাথ। রাজস্থানের ছেলে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র, মুহম্মদ শফি আগোয়ানি, তখন আমাদের কথায় উঠতে-বসতো; নিজেরা আড়ালে থেকে তাকে সভাপতি নির্বাচিত করলাম। পরে অবশ্য সে বহুদূর ভ্রমণ করে: প্রথমে রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের, পরে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়, প্রাতিষ্ঠানিক হোমরাচোমড়াদের সঙ্গে এখন ভীষণ মিলেমিশে থাকে। হঠাৎ যদি আমার সঙ্গে এখানে-ওখানে দেখা হয়ে যায়, দৃশ্যত একটু ভীত, একটু বিচলিত বোধ করে। তবে এধরনের পুরনো পাপী পৃথিবীতে অগণিত।
হল্যান্ডে থাকাকালীন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম করাচি থেকে আসা একটি পঞ্জাবি মেয়ের সঙ্গে, নাম খুরশীদ হাসান। সে যখন প্রথম হেগে পৌঁছয়, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ. করে বেরিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইনের ধারাবলী নিয়ে গবেষণা করতে এসেছে। প্রথম-প্রথম রাস্তায় একা বেরোতে ভয় পেত, কী করে যেন আমার উপর অসম্ভব নির্ভরশীল হয়ে পড়লো, আমি দাদা, ও আমার ছোটো বোন, সমস্ত বুদ্ধিপরামর্শ আমার সঙ্গে। পড়াশুনোয় মেধাবী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্না, বিষয়গত আলোচনার মুহূর্তে চোখে-মুখে কথা বলে। তখনও শেখ আবদুল্লাহ্ কারাবন্দী হননি, আমাদের ভারতীয় ছাত্রদের তাই যথেষ্ট মনের জোর ছিল, খুরশীদের সঙ্গে কাশ্মীর নিয়ে তর্ক-রসিকতায় মাততাম। খুরশীদ খেপে যেত, খানিক বাদে আবার শান্ত হয়ে আসতো।
আমার কাছে খুরশীদের নিয়ত আব্দার, তবে মাঝে-মধ্যে তার চোটপাটও। একবার স্যাডলার্স ওয়েলস ব্যালে দল এসেছে, ময়রা শিয়েরার প্রধানা ব্যালেরিনা, সোয়ান লেক হবে। দেখতে যেতে খুরশীদের খুব শখ, অনেক টাকা খরচ করে একেবারে সম্মুখবর্তী সারিতে টিকিট কেনা হলো। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় ব্যালে শুরু হবার কথা, ট্যাক্সিতে যেতে অন্তত মিনিট পনেরো সময় লাগবে। সাড়ে পাঁচটা বাজলো, পৌনে ছ’টা, ছ’টা, সওয়া ছ’টা, মেয়েদের মহল থেকে খুরশীদ বেরোচ্ছে না, আমি উদ্ভ্রান্ত, বারবার খবর পাঠাচ্ছি, কিন্তু প্রসাধনরতা মহিলাকে কিছুতেই আর বাইরে আনতে পারছি না, অথচ দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। অবশেষে শ্ৰীমতী খুরশীদ দেখা দিলেন, শৌখিন ঝলমলে শাড়িতে নয়নমোহিনী, কেশচর্চাসমৃদ্ধা, সাড়ে ছ’টা পেরিয়ে গেছে, যখন অপেরা হাউজে পৌঁছুলাম, সন্ধ্যা সাতটা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি, বেশ কয়েকটি পিরুয়েত-পা-দ্য-দো সমাপ্ত। আমার মেজাজ একটু খিঁচড়ে গিয়েছিল, কিন্তু কিছুই যেন হয়নি, খুরশীদের এমন ভাব। বার কয়েক আমি অনুযোগ করাতে পুরো একমাস আমার সঙ্গে কথা বন্ধ রেখেছিল। হঠাৎ একদিন ফিক্ করে হেসে ফের সন্ধি স্থাপন।
পাকিস্তান থেকে একজন অতি উচ্চপদস্থ রাজপুরুষ, কী একটা কোর্সে যোগ দেবেন, তিন মাসের জন্য আমাদের সঙ্গে থাকতে এলেন। চমৎকার মানুষ, উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার হিশেবে খ্যাত, খুরশীদকে দেখে ও তার সঙ্গে আলাপ করে ভদ্রলোক মজে গেলেন, আমাকে বিপদে পড়তে হলো। খুরশীদকে মুখোমুখি বলবার সাহস ঠিক কুড়োতে পারছেন না, আমাকে খুরশীদ ‘দাদা’ বলে মান্য করে, সুতরাং আমি যদি অনুগ্রহ করে তাঁর প্রস্তাব তার কাছে পৌঁছে দিই, তিনি তার পাণিপ্রার্থী। কী আর করা, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ভূমিকা পালন না-করে তো উপায় নেই, খুরশীদকে গিয়ে বললাম, সে হেসে কুটিপাটি। আমাকে বোঝালো, এরকম বিবাহ হতেই পারে না, তারা—খুরশীদের পরিবার—খাঁটি সৈয়দ বংশীয়, মুসলমান সমাজে সর্বোত্তম, অন্য দিকে ওই ভদ্রলোকের বংশ পরিচয় ধারেকাছেও না। ভদ্রলোককে গিয়ে খুলে বললাম, তিনি ভেঙে পড়লেন। এই ঘটনার আগে আমার ধারণাই ছিল না যে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও জাতপাতের এত কড়াকড়ি।
আসল কারণটি বেশ কয়েক সপ্তাহ বাদে খুরশীদ আমার কাছে কবুল করেছিল। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সে এম.এ. ক্লাসের ছাত্রী; হার্ভার্ড থেকে অসম্ভব চৌকস, বিতর্কে সুনিপুণ, অতি সুদর্শন একটি ছাত্র কোনও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে করাচি আসে, সুচিত্রা ভট্টাচার্য-বর্ণিত ঊনিশ বছর বয়সের উতরোল বিন্দুতে অবস্থানরতা খুরশীদের হৃদয় কেড়ে নেয়। অথচ রক্ষণশীল গোঁড়া মুসলমান পরিবারের মেয়ে, খুরশীদ জানে এই প্রণয়ের কোনও ভবিষ্যৎ নেই, তাই সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে, কোনওদিন বিয়েই করবে না। শেষ পর্যন্ত এই প্রতিজ্ঞা অবশ্য সে রক্ষা করতে পারেনি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরবর্তী বছরগুলিতে হল্যান্ড চরম আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। উপার্জনের তাগিদে ফুল, মাছ, মাংস, ডিম, রেডিয়ো, যন্ত্রপাতি সব-কিছু পড়ি-কি-মরি রফতানি হচ্ছে। আমরা যদিও খুব শৌখিনভাবে ছিলাম, খাওয়ার টেবিলে আহার্য উপছে পড়ছে, তা হলেও সপ্তাহে ডিম মাত্র একটি করে বরাদ্দ। প্রতি রবিবার সকালে, অন্যরা প্রাতরাশ খেয়ে এখানে-ওখানে বিহারে যেতো, আমি না-খেয়ে অপেক্ষা করতাম খুরশীদের জন্য। সে রবিবার বেশ দেরিতে সকালে ঘুম থেকে উঠতো, আমি ধৈর্য ধরে থাকতাম। রবিবার ইনস্টিটিউটের পাচককুল ছুটিতে, প্রাতরাশ আমাদের নিজেদেরই তৈরি করতে হত। খুরশীদ এসে ডিম ফেটিয়ে-ফেটিয়ে মস্ত লম্বা পেট-মোটা অমলেট তৈরি করে দিত, সেজন্যই আমার প্রতীক্ষা। পরে সে অনেক কীর্তিমতী হয়েছে, তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বরাবর অক্ষুণ্ণ থেকেছে, তবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনী অত্যন্ত করুণ, আমার বলবার সুযোগ ঘটবে।
বিদেশে আরামে-আনন্দে দিন কাটাচ্ছি, কিন্তু হৃদয়ে বামপন্থী ঘোরের উন্মাদনা, পোড়া দেশের খবরের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে থাকি। ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কলকাতা শহর বিপ্লবের প্রায় প্রান্তসীমায়, লন্ডন টাইমসে প্রতিদিন খবর পড়ে অস্থির উত্তেজনা অনুভব করি। কেম্ব্রিজ-থেকে-আসা এক ইংরেজ ছোকরা, ফস্ করে মন্তব্য করলো: ‘লন্ডন হলে খবরকাগজে একখানা চিঠি পাঠালেই সমস্যা মিটে যেত’। মনে-মনে বললাম, কী কল তোমাদের সাহেব কোম্পানিরা আমাদের দেশে বানিয়ে এসেছে, তা যদি তোমরা জানতে, বুঝতে।
দিন কাটে, আমার আগ্রহ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থিসিস শেষ করে দেশে ফেরা। হল্যান্ডে তখন নিয়ম ছিল, তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক যদি মনে করেন থিসিসের কাজ সন্তোষজনকভাবে সমাপ্ত হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনের কতটা মেয়াদ পূর্ণ করলেন, তা হলে তা ধর্তব্য নয়। ইনস্টিটিউট অফ সোসাল স্টাডিজের ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না, প্রয়োজনানুগ আইন তখনও দেশের সংসদে গৃহীত হয়নি। আমাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, ওই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির জন্য প্রার্থী হবার আমরা অনুমতি পেয়েছিলাম। অধ্যাপক টিনবার্গেন রটারডম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থশাস্ত্র বিভাগের সঙ্গে যুক্ত, আমার তাই থিসিস দাখিল করবার কথা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে। থিসিসের কাজ প্রায় শেষ, শুধু লিখে ফেলাটা বাকি, টিনবার্গেন তিন মাসের জন্য মার্কিন মুলুকে পেনসিলভেনিয়া রাজ্যে হাভেরফোর্ড কলেজে পড়াতে গেলেন। ওঁর অনুমতি নিয়ে আমার সেই তিন মাস কেমব্রিজে প্রস্থান। এক ল্যান্ডলেডির কাছ থেকে ঘর ভাড়া করেছিলাম; অর্থনীতি বিভাগের গ্রন্থাগার মার্শাল লাইব্রেরিতে বসে থিসিসের অধ্যায়ের পর অধ্যায় লিখে ফেললাম। কেমব্রিজে কে ছাত্র কে অ-ছাত্র তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই, নিকি কাল্ডর, জোন রবিনসন, ডিক কাহ্ন, ডিক গুডউইন প্রমুখ সবাইকার ক্লাসে গিয়ে বসতাম; পরে এঁদের অনেকের সঙ্গেই নিবিড় সৌহার্দ্যসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মার্শাল লাইব্রেরিতেও নির্ঝঞ্জাট ব্যবস্থা, পাতার পর পাতা থিসিসের বয়ান লিখে যাচ্ছি, কেউ বিরক্ত করবার নেই। কিছু-কিছু ভারতীয় ছাত্র ফিসফিস আলাপ জমাতে আসতো, তাদের মধ্যে পরবর্তী কালে আমার অতি ঘনিষ্ঠ অজিত দাশগুপ্ত। অমর্ত্য সে-বছরই ট্রাইপোসে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে, ওর ছাতা হাতে বিনীত চেহারা নিয়ে বৃষ্টির-জলে-ছপ্ছপ্ রাস্তায় সতর্ক হেঁটে যাওয়ার স্মৃতি এখনও চোখে ভাসে। আর একজনের নাম করতে পারি, শৈলা আম্বেগাওকর, সুশী-শান্তি জুন্নরকরদের মামাতো বোন, এখন কানাডায় কোথায় হারিয়ে গেছে।
ইওরোপে থাকাকালীন পাগলের মতো ঘুরে চিত্র ও ভাস্কর্য অবশ্যই দেখেছি প্রচুর, সেই সঙ্গে থিয়েটার-ব্যালেও, কিছু-কিছু হেগ শহরেই, লন্ডন, প্যারিস, অন্যত্রও। যেটা যোগ করতে আমার মোটেও কুণ্ঠা বোধ নেই, কাতারে-কাতারে ইওরোপীয় ও মার্কিন চলচ্চিত্রও। ইনস্টিটিউটে নৈশাহার সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টাতেই সমাপ্ত, তারপর সপ্তাহে অন্তত দু’-তিন দিন বেরিয়ে পড়ে এখানে-ওখানে সিনেমা দেখা, এমন-এমন দিন গেছে দুপুর থেকেই সেই নেশায় বিহার শুরু, এক-একদিন তিন-চারটে করেও। এ যেন নিজের শৈশব-কৈশোরের উপর প্রতিশোধ নেওয়া: জমে-থাকা চলচ্চিত্র বুভুক্ষা এতদিনে তৃপ্তির আস্বাদ পেলো। ইতালিয় ও ফরাশি চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ সেটা, তা ছাড়া বৃটিশ-মার্কিন ছায়াছবির সম্ভার। সকালে ক্লাসরুমে গিয়ে অধ্যাপকদের বক্তৃতার নোট টুকছি, দুপুরে এই গ্রন্থাগার-ওই গ্রন্থাগার ঢুঁড়ে থিসিসের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ঘাঁটছি, ফাঁকে-ফাঁকে আড্ডা, হুল্লোড়, তর্ক, আলোচনা। এবং খেয়াল চাপলেই, শীতের রাত্রি হলে ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে, চলচ্চিত্ৰগৃহের দিকে ধাবমান হওয়া। চলচ্চিত্র নায়কদের মধ্যে তখন বিখ্যাততম ফরাশি জেরার ফিলিপ ও মার্কিন হামফ্রে বোগার্ট, নায়িকাদের মধ্যে রূপের ও গমকের জৌলুসে-চোখ-ধাঁধিয়ে-দেওয়া জিনা লোলোব্রিজিদা ও ইনগ্রিড বেয়ার্গম্যান। তখনও সুইডিশ ছবির উন্মাদনা শুরু হয়নি।
ওলন্দাজ মনীষীদের মধ্যে টিনবার্গেন-হফ্স্ট্রার নাম আগেই করেছি; ওদেশী আরও বহু ঐতিহাসিক-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী-দার্শনিক-সাহিত্যিক আমাদের ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। ছোটো দেশ, কৌতুককথন ছিল, বিমানে জানালার ধারে বসে হল্যান্ড ঢোকবার মুহূর্তে জুতোর ফিতে আঁটো করবার লক্ষ্যে ক্ষণিকের জন্য নিচু হওয়ার পর ফের উঠে বাইরে তাকাতেই আবিষ্কার, দেশটা পেরিয়ে আসা হয়েছে। দেশের মানুষদের বহির্বাণিজ্য থেকে প্রধানত জীবিকা সংগ্রহ করতে হয়, তাই ইংরেজি, ফরাশি ও জর্মানের মতো ভাষা জানা অত্যাবশ্যক। চিত্রশালা বিহার করতে, হল্যান্ডের বিখ্যাত ফুলের সমাহার দেখতে, নিচু জমিতে বাঁধ বাধার প্রকৌশলের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা পেতে, বছর ভরেই দলে-দলে ট্যুরিস্টদের ভিড়। ছোটো দেশ, প্রথম সারির রাষ্ট্র নয়। নিজেদের সম্বন্ধে অত্যধিক বিনয়, তা হলেও আন্তর্জাতিকতার স্পর্শ অষ্টপ্রহর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। হয়তো সেই কারণেই, আমাদের কারওরই তেমন ভালো করে ওলন্দাজ ভাষাটি শিখে ওঠা হলো না। পড়াশুনো থেকে শুরু করে সব ব্যাপারেই ভাষার জন্য কোনও-কিছু আটকাতো না, ইংরেজিতেই দিব্যি চালিয়ে যাওয়া যেত।
হল্যান্ড রাজারানীর দেশ, কিন্তু বিলিতি দেখানেপনা রাজ পরিবারে একেবারেই ছিল না। বেশ কয়েকদিন রানী জুলিয়ানা আমাদের সঙ্গে বসে লাঞ্চ বা ডিনার খেয়ে গেছেন, তাঁর কন্যা তিনজনও মাঝে-মাঝে আলাপ জমাতে আসতেন। দেশের মানুষগুলি দেখতে তেমন সুদর্শন নয়, তবে আন্তরিকতায় ভরপুর। আর ১৯৫২ সালে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মস্ত উত্তেজনা, ওলন্দাজ মেয়ে ব্লাঙ্কার্স কুন চার-চারটে সোনা জিতেছে, তাকে নিয়ে মাতামাতি। সেই তরুণীও একদিন খানিকক্ষণের জন্য দেখা দিয়ে গিয়েছিল আমাদের। মেয়ে-পুরুষ সবাই অসম্ভব পরিশ্রমী, ভোর রাত্রিতে উঠে মহিলাদের গৃহকার্য শুরু, মধ্য রাত্রির আগে তার বিরাম নেই। তার উপর বাইরে উপার্জনের জন্য খাটাখাটুনি তো আছেই, পুরুষদের সঙ্গে সমানে তাল রেখে। ফিলিপসের কারখানায়, ভাসা-ভাসা এখনও যা মনে পড়ে, শতকরা ষাট ভাগ কর্মীই মহিলা। দেশের খাবার জর্মান ঘেঁষা, একট স্নেহপদার্থপ্রাধান্য, স্বাদ ঈষৎ বৈচিত্র্যহীন। তবে প্রচুর বিদেশি রেস্তোরাঁ সর্বত্র ছড়ানো। সদ্য-ছেড়ে-আসা ইন্দোনেশিয় সাম্রাজ্যের রেশ তখনও। প্রচুর ইন্দোনেশীয় খাদ্যের সমারোহ, অনেক ওদেশীয় রেস্তোরাঁ, যেখানে বিখ্যাত খাদ্য রাইসটাফেল, প্রাচ্যপ্রথায় বত্রিশ কি চৌষট্টি উপচার সাজিয়ে পরিবেশন, ভারতীয় রূপকথায়-রাজকাহিনীতে যেমনধারা বর্ণনা ছিল, ঝাল-তিক্ত-কষায়-মধুর সমস্ত-কিছু স্বাদের সম্মিলিত সাজানো অর্ঘ্য।
আমাদের আবাসনে ভারতবর্ষ-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার ছাত্রছাত্রীর প্রাচুর্য হেতু কর্তৃপক্ষকে উপরোধের ঠেলায় অস্থির করে বাধ্য করা হয়েছিল, পরিবেশিত খাদ্যে প্রাচ্যের আস্বাদ আমদানি করতে। অবশ্য আমাদের সহপাঠিনী মেয়েরাও অনেকেই রন্ধনশিল্পে ওস্তাদ বিশেষ করে খুরশীদের নানা ধরনের মাংস রান্না করার অপূর্ব দক্ষতা। সুতরাং না-খেয়ে মারা যাইনি কেউই ওই দেড়-দু’বছর।
দিল্লি-কলকাতা-মুম্বইয়ের মতোই, ওলন্দাজ খবরের কাগজগুলিতে রাজনীতির আকাট প্রাধান্য। সকাল না হতেই লন্ডন-প্যারিস-বন-রোমের পত্রিকাদি পৌঁছে যেত, ওলন্দাজ খবরের কাগজের দিকে তাই বিশেষ তাকাতাম না। ওখানে রাজনীতির ধরনটাও একট অন্যরকম। শ্রমিক শ্রেণীর দল অবশ্যই একটি ছিল, এবং তার প্রাধান্য তুচ্ছ করবার মতো নয়, কিন্তু সেই সঙ্গে ধর্মের গন্ধ-ঘেঁষা একগাদা দল, ক্যাথলিক, মেথডিস্ট, প্রেসবাইটেরিয়ান ইত্যাদি। পালা করে প্রায় প্রত্যেক দলই, কিংবা বিভিন্ন দলের জোট, ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছে যেত, এখনও যায়। তবে ইতিমধ্যেই দেশ যথেষ্ট উন্নত, শিল্পের-কৃষির সাফল্যে উপচে-পড়া বৈভব, রপ্তানির দৌলতে সবাই-ই মোটামুটি ভালোভাবে খেয়ে-পরে আছে, সুতরাং দলীয় ধর্মান্ধতার গন্ধ ছিল না, পারস্পরিক সহিষ্ণুতাই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। একটি ছোট কমিউনিস্ট পার্টিও ছিল, অবশ্য কোনওদিনই তেমন দাগ কাটতে পারেনি। তার চাঁইরা মাঝে-মাঝে আমাদের সঙ্গে—ভারতীয়, পাকিস্তানি, ইন্দোনেশিয় ছাত্রদের সঙ্গে—আলাপ করে যেতে ভালোবাসতেন, আমরা বিশ্ববিপ্লবের অত্যাশু সম্ভাবনা নিয়ে বিভোর হতাম।
ইনস্টিটিউটে অন্যতম অধ্যাপক হ্বিলহেলম্ ভিটোভেইন, উদারনৈতিক দলের সদস্য, হঠাৎ ওদেশের অর্থমন্ত্রী বনে গেলেন। ভারি আড্ডাবাজ মানুষ, প্রায়ই সন্ধ্যার পর রটারডামে গিয়ে ওঁদের ফ্ল্যাটে ভিটোভেইন ও তাঁর হৃদয়বতী স্ত্রীর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আসতাম। পরে ইনি বছর পাঁচেকের জন্য ওয়াশিংটনস্থ আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের সর্বপ্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন। ভিটোভেইন নিজে যথেষ্ট রক্ষণশীল, কিন্তু চরিত্রঔদার্যে হ্রস্বতা ছিল না, আমাদের উগ্র বামপন্থী মতামত জানা সত্ত্বেও আলোচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন না, যেমন নিতেন না অধ্যাপক টিনবার্গেনও, তবে তিনি তো সব ক্ষেত্রেই আরও বেশি নমনীয়। টিনবার্গেনের জ্যেষ্ঠা কন্যা টিনেকে ও তাঁর যাজকবৃত্তি-গ্রহণ-করা অতি অমায়িক স্বামী প্রায়ই আমাদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে আসতো। টিনেকে পড়াশুনায় অসাধারণ প্রতিভাময়ী, প্রতি পরীক্ষায় প্রায় প্রতিটি বিষয়ে দশে দশ পেত, তাই তাঁর আদরের নামকরণ হয়েছিল ‘টিন টিনেকে’, ওলন্দাজ ভাষায় টিন মানে দশ।
পূর্ব ইওরোপের দেশে-দেশে ততদিনে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তো মজবুত হয়ে গিয়েইছিল, পশ্চিম ইওরোপের প্রধান দু’টি দেশ ফ্রান্স ও ইতালিতেও কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা ক্ষমতা ছুঁই-ছুঁই পরিস্থিতি। কী করে তাদের ঠেকিয়ে রাখা যায় তা নিয়ে বাকি দলগুলির, এবং অবশ্যই ন্যাটোর-উপর-কর্তালি-করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, অহর্নিশ চিন্তা। সারা পৃথিবী জুড়েই, অন্তত তখন তা মনে হতো, বামপন্থী আদর্শের অপ্রতিরোধ্য বিস্তার, মাঝে-মাঝে লাতিন সহপাঠীদের কাছে তাদের নানা দেশে যুগপৎ সামন্ততন্ত্র ও মার্কিন পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই কত জমজমাট হয়েছে, হচ্ছে, তার বিস্তৃত বৃত্তান্ত শুনতাম। ম্যাকার্থি-দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে ও ন্যাটোর জালবিস্তার প্রতিহত করতে পশ্চিম ইওরোপের প্রায় সব ক’টি দেশে চড়া মেজাজের আন্দোলন, যার ধাক্কা আমাদের রাজপ্রাসাদেও এসে ঠেকতো। আমরা যে ভারতীয় ছাত্রসংঘ গঠন করেছিলাম, তাতেও বামপন্থী উৎসাহের ঝোঁক। বিশ্ব শান্তি আন্দোলন, চার্লি চ্যাপলিনকে মার্কিন দেশ থেকে সপরিবার খেদিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে উত্তেজনা, ফরাশি কমিউনিস্ট শহিদ আঁরি মার্তাঁ-কে ঘিরে স্তবগান। তথাকথিত ঠান্ডা যুদ্ধ তখন তুঙ্গে, বেশ-কিছু উগ্র কমিউনিস্ট-বিরোধী পূর্ব ইওরোপ থেকে পালিয়ে পশ্চিমের দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছে, আমাদের ইনস্টিটিউটেও একজন-দু’জন পাঠচর্চা করছে। মজার ব্যাপার, অথচ স্বাভাবিকও যা, সর্বক্ষণ নিজের দেশের সরকারের মুণ্ডপাত করছে, কিন্তু ফুটবলে বিশ্ব কাপ দখল করা নিয়ে প্রতিযোগিতা, বেতারে ধারাবিবরণী, সেই মুহূর্তে পালিয়ে আসা মানুষগুলি স্বদেশের দলের অন্ধ সমর্থক।
কোনও গ্রীষ্মের ঋতুতে ইরাক থেকে এক মহিলা আমাদের প্রাসাদে কয়েক সপ্তাহের জন্য থাকতে এলেন। জানলাম, ইরাক সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মী, হল্যান্ডে একটি স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত পাঠক্রমে যোগ দিতে এসেছেন। একটু-আধটু আলাপের পর আমাদের খুব কাছাকাছি চলে এলেন। খানিক বাদে বোঝা গেল, মহিলা ইরাকে তখন-নিষিদ্ধ তুদেহ্ পার্টির সদস্য, গোঁড়া কমিউনিস্ট। হেগ শহরের সন্নিকট বনাঞ্চলে আমরা গ্রীষ্মের দীর্ঘ বিকেলে প্রায়ই বেড়াতে যেতাম। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের দশা ওঁকে বলতাম, উনি বলতেন ওঁর দেশে সাম্যবাদী আন্দোলন কতটা এগোচ্ছে, ছড়াচ্ছে, তা নিয়ে। কিছুদিন বাদে উনি হেগ ছেড়ে চলে গেলেন, আমাকে বলে গেলেন, ওঁর নামে সবুজ রঙের চৌকো খামে যে-সব চিঠিপত্র আসবে, সেগুলি সুইজারল্যান্ডের একটি বিশেষ ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে। কয়েক বছর পর, আমি ততদিনে দিল্লিতে স্থিত, খবর পড়লাম ইরাকে বিপ্লব, বামপন্থী পার্টি ক্ষমতা দখল করেছে, আমার পরিচিতা সেই মহিলা, মাদাম দুলেমি, শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন। দু’বছর বাদে ইরাকে প্রতিবিপ্লব, কমিউনিস্ট নায়কদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছে, ফের খবর পড়লাম, মাদাম দুলেমিও নিহত।
ভারতবর্ষ থেকেও অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি এসে আমাদের সঙ্গে নর্ডেন্ডে রাজপ্রাসাদে কাটিয়ে গেছেন। যাঁর কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, তিনি কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়। আন্তর্জাতিক থিয়েটার সংঘের সম্মেলন দু’সপ্তাহব্যাপী, সেই সূত্রে এসেছেন, পুরোটা সময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন। দেশের সমস্যা নিয়ে, বিদেশের ঘটনাবলী নিয়ে, সামাজিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক, সংগীত, নৃত্যকলা অজস্র বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা। আমাদের রাজনৈতিক ঝোঁকের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল না, কিন্তু ক্ষমাসুন্দর চোখে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতেন। আচার্য নরেন্দ্র দেবকে ভালো চিনি জেনে আমাকে একটু বেশি প্রশ্রয় দিতেন। অমন মৃদুভাষিণী অথচ শান্ত, দৃঢ়মনস্কা, জ্ঞানসমৃদ্ধা মহিলা খুব কম দেখেছি, তাঁকে ঘিরে যেন শান্তি পরিব্যাপ্ত ছিল, অথচ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প থেকে শুরু করে দেশের খুঁটিনাটি নানা ক্ষেত্রে তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ। ওই ক’টা দিন তার সাহচর্যের স্নিগ্ধতায় আপ্লুত হয়েছিলাম। পরে দেশে অনেকবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। এক সঙ্গে সরকারি বৈঠকাদি করেছি, নতুন দিল্লির ক্যানিং লেনে তাঁর বাড়িতেও গেছি, প্রতিবার স্নেহ ও প্রীতির কোমলতায় ভরিয়ে দিয়েছেন। যদি যথাস্থানে মনে পড়ে, এক দিশি রাজনৈতিক নেতা সম্পর্কে এক চমৎকার কাহিনী তিনি একদা আমাকে বলেছিলেন, সে ব্যাপারে বলবো।
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তখন দেশের উপরাষ্ট্রপতি। তিনিও একবার হল্যান্ড সফরে এলেন, অন্যান্য গণ্যমান্যদের মতো আমাদের সঙ্গে কিছু সময় অতিবাহিত করে গেলেন, অনায়াসে সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন ভারতের মহামহিম ঐতিহ্য নিয়ে। তা ছাপিয়ে আমাদের কাছে যা অধিকতর আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল, তা তাঁর, ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘রোভিং আই’: মেয়েদের দিকে একটু বিশেষ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকা, ঘুরে-ফিরে তাকিয়ে থাকা, তিনি চলে গেলে যা নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রচুর হাসি-ঠাট্টা।
টিনবার্গেন আমেরিকা থেকে ফিরলেন, আমি কেমব্রিজ থেকে, আমার পাণ্ডুলিপি পড়ে তিনি খুশি, সুতরাং দেড় বছরের মাথাতেই আমার ধনবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার উদ্যোগ শুরু হলো। ও দেশে, যেহেতু প্রথাগত ঐতিহ্য, সাধারণ মানুষের কাছে থিসিসের যা বক্তব্য তা বিলি করতে হবে, অন্তত পাঁচশো কপির প্রয়োজন, সুতরাং তড়িঘড়ি করে ছাপানোর ব্যবস্থা। মাত্র একানব্বই পৃষ্ঠার থিসিস, ধনবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ছোটো থিসিস, তবে পদার্থবিদ্যায় বা গণিত শাস্ত্রে এরকম হামেশাই হয়ে থাকে।
যেহেতু রটারডাম থেকে আমার ডিগ্রি পাওয়ার কথা, ওখানেই নির্দিষ্ট তারিখে দল বেঁধে ইনস্টিটিউট থেকে সবাই গেলাম। যা নিয়ম, থিসিসটি জনসাধারণের কাছে ব্যাখ্যা করে প্রার্থীকে বোঝাতে হয়, প্রথমে পরীক্ষকমণ্ডলী প্রশ্ন করবেন, তার জবাব দিতে হবে, পরে উপবিষ্ট জনগণের সঙ্গে সওয়াল-জবাবের পালা। আরও যা বিচিত্র নিয়ম, ডিগ্রিপ্রার্থীর সঙ্গে, তাঁকে ভরসা দেওয়ার জন্য, দুজন প্যারানিম্ফ থাকবেন, বাংলায় বলতে গেলে করে বলতে হয়, ডানা-কাটা পরী, তবে সাধারণত ছেলে পরীক্ষার্থীর সঙ্গে তার দুই সখাই প্যারানিম্ফ হিশেবে থেকে থাকে। এ ব্যাপারেও আমি ব্যতিক্রমী হলাম: আমার এক প্যারানিম্ফ খুরশীদ, অন্যজন আমার বন্ধু টোলন অধিকারীর বাগদত্তা কামিনী সাহনি, লখনউর সমাজতত্ত্ব বিভাগের বিখ্যাত ছাত্রী, হেগ শহরে এসেছে সমাজবিজ্ঞানে গবেষণা করবার লক্ষ্যে।
খেয়াল চাপায় ধুতি-পাঞ্জাবি-চাদর চাপিয়ে ডিগ্রি লভ্যার্থে গমন করেছিলাম। রাস্তায় লোক তাকিয়ে দেখলো, পরীক্ষামণ্ডপেও পরিবেশ স্বভাবতই হালকা হয়ে এলো। পরীক্ষকরা, যাঁদের মধ্যে টিনবার্গেন ও ভিটোভেইন দু’জনেই ছিলেন, মাত্র গুটিকয় প্রশ্ন করলেন, অতঃপর জনতার মধ্য থেকে কে যেন আমার সজ্জা নিয়ে কী এক কৌতূহল প্রকাশ করলেন, বিচারকমণ্ডলী তা নাকচ করে দিলেন, সভাভঙ্গ হলো। অর্থবিজ্ঞানে খেতাব লাভ করে নরডেন্ডে রাজপ্রাসাদে ফিরলাম, খানাপিনা হলো।
দিন কয়েক বাদে লন্ডন, টিলবেরি থেকে পি অ্যান্ড ও’র জাহাজ ধরা। সুয়েজে পৌঁছে দেখি নতুন দিল্লি থেকে পাঠানো এক তার অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জয়ন্তীলাল আঞ্জারিয়ার বার্তা, আমি যেন মুম্বই থেকে প্রথমে কলকাতা না গিয়ে সটান দিল্লি চলে আসি, তিনি আমার জন্য একটি কাজের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
কচি বয়স তখন, টেলিগ্রাম ইত্যাদিকে সম্মান করতাম। আঞ্জারিয়া সাহেবের তলব পেয়ে মুম্বই থেকে বিমানে দিল্লি, আমার পক্ষে তখন অকল্পনীয় বেশি মাইনেতে অর্থমন্ত্রকে কাজের প্রস্তাব। তা গ্রহণ করে লখনউতে ইস্তফা দিয়ে একবার কলকাতা ঘুরে সপ্তাহ দুই বাদে সরকারি যূপকাষ্ঠে গলা বাড়ানো। পরে অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্ত অনুযোগ করেছিলেন, যদি তাড়াহুড়ো না করে আরও কয়েকটি দিন অপেক্ষা করতাম, অর্থমন্ত্রকেই আমার উচ্চতর পদ জুটতো। কী আর করা, কোনও দিনই তো তেমন হিশেব কষতে শিখলাম না।