আপিলা-চাপিলা – ৩৮

আটতিরিশ

আরেকবার বলি, জীবনের নিয়ম এটা, একদা যাঁরা কাছে ছিলেন, তাঁরা দূরে সরে যান, একদা-দূরবর্তীরা কখনও-কখনও কাছে আসেন। হয়তো আর্থিক সংস্কারজড়িত মতদ্বৈধতার কারণে, হয়তো কোনও ব্যক্তিগত ক্ষোভের পরিণামে, এক অর্থনীতিবিদ বন্ধু, জীবনের প্রথম পর্যায়ে যিনি আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছিলেন, আজ অনেক দূরের মানুষ, আমার সম্পর্কে সম্প্রতি প্রকাশ্যে গভীর বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছেন। তাঁর প্রতি আমার কিন্তু কোনও অভিমান নেই; বহু বছর ধরে তাঁর কাছ থেকে যে-ঔদার্য আমার প্রতি বর্ষিত হয়েছে, তার জন্য আমৃত্যু কৃতজ্ঞ থাকবো।

অমর্ত্যর কথা নানা জায়গায় খুচরো-খাচরা উল্লেখ করেছি, মনে হয় আরও কিছু, অনেক কিছু বলা প্রয়োজন। আসলে এত দীর্ঘ সময় অমর্ত্য-নবনীতা নাম দু’টি এক সঙ্গে উচ্চারণ করেছি, তাদের বিশ্লিষ্ট করে ভাবা খুব কঠিন। অথচ বাস্তবতা থেকে তো মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া চলে না। তাদের বিবাহসম্পর্ক তিরিশ বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। যখন তাদের মানসিক বিভাজনের শুরু, অনেক চেষ্টা করেছিলাম তাদের ফের মিলিয়ে দেওয়ার জন্য। যা মনে হতো অতি নিটোল সুন্দর একটি নীড়, তা ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই যেন বরদাস্ত করতে পারছিলাম না। তবে শেষ কথা রবীন্দ্রনাথই বলে গেছেন, ফুরায় যা দে রে ফুরাতে, আমার ভাবাপ্লুততা তো অপরাপরের জীবনের নিয়ামক হতে পারে না। এখন তারা উভয়েই নিজ-নিজ বৃত্তে পূর্ণ বিভাসিত। অমর্ত্যর তো বিশ্বজোড়া নাম, নবনীতার সাহিত্যসৃষ্টি-কুশলতাও তুচ্ছনীয় নয়; দু’জনেই আমার দিনযাপনের গণ্ডির বাইরে আস্তে-আস্তে সরে গেছে। তা হলেও উভয়ের কাছ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে যত উপকার ও প্রীতিস্নেহসম্ভার হাত পেতে গ্রহণ করেছি, জাগতিক হিশেবের বাইরে তা। তাদের দুই কন্যা— পিকো, অন্তরা, ও টুম্পা, নন্দনা— স্বতঃসিদ্ধতার মতো নিজেদের পছন্দ-করা বৃত্তির মধ্যবিন্দুতে এখন উপনীত। এ এক অদ্ভুত কৌতুক, পিকো হঠাৎ-হঠাৎ হাজির হলে আমি সঙ্গে-সঙ্গে চলে যাই তার অতিবালিকা বয়সে, যখন ‘সহজ পাঠ’ থেকে নামতা পড়ার মতো আউড়ে, অথবা আউড়াবার ভাণ করে, তাঁকে খ্যাপাতাম: ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে ঘুষি মারে আকাশে’। যে মুহূর্তে ‘ঘুষি মারে আকাশে’ উচ্চারিত হতে শুনতো, পিকো রাগে ঝাপিয়ে পড়তো আমার উপর, শান্তিনিকেতনের সাক্ষাৎ নাতনি সে, রবীন্দ্র-বিকৃতি তার সইবে কেন। টুম্পাকে নিয়ে অনুরূপ একটি তিরিশ-বছর-পিছনে-যাওয়া টুকরো স্মৃতি: দেড়-দু’বছরের টুম্পা,নতুন দিল্লিতে গাড়িতে পাশে বসা, গাড়ি চালাচ্ছি আমি, আওরঙ্গজেব রোড-মানসিং রোড-শাজাহান রোড-পৃথ্বীরাজ রোডের সংযোগস্থলে কেয়ারি-করা বাগান, তাতে জলের শুঁড়-তোলা কয়েকটি ঝরনা, চোখে পড়া মাত্র, যতবারই ওখান দিয়ে গেছি, টুম্পার উচ্ছ্বসিত কলকাকলি: ‘ফয়লা, ফয়লা’, সেই সঙ্গে ফুর্তিতে স্টিয়ারিংয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া।

অমর্ত্যর সঙ্গে ইদানীং একেবারেই দেখা হয় না, যে সংগোপন অভিমত তাঁর সম্বন্ধে বরাবর পোষণ করে আসছি, তা না হয় এই সুযোগে ব্যক্ত করি। আমার বিবেচনায় অমর্ত্য ধ্রুপদী অর্থে আদর্শ অর্থনীতিবিদ; চিন্তাকে তত্ত্বের খোলস পরাতে তার জুড়ি নেই: তত্ত্বকে তথ্যের কষ্টিপাথরে পরিশোধন করে নিতেও সে সুপারঙ্গম; তথ্য ও তত্ত্বের মিশেল খাটিয়ে আশ্চর্য যুক্তিপ্রয়োগ-দক্ষতা সমভিব্যহারে নীতির মোহানায় পৌঁছুতে তার জুড়ি নেই। সেই নীতি জনসমক্ষে প্রাঞ্জল করে ব্যাখ্যা করার প্রতিভাও তার তুলনাহীন। যেটা দুঃখের, স্বদেশ-স্বভূমি তার মনীষা-পাণ্ডিত্য-বিচক্ষণতা থেকে উপকৃত হওয়ার তেমন সুযোগ পেল না। বছরে একবার-দু’বার একদিন-দু’দিনের জন্য অমর্ত্য দেশে আসে, নগরে-বন্দরে চরকিবাজি করে, কিছু-কিছু উপদেশ-পরামর্শ বিলোয়, তাতে আখেরে ছোটো-বড়ো যে-কোনো জাতীয় সমস্যারই তেমন সুরাহা হয় বলে মনে হয় না। মানছি, তার যা দিনযাপনের নির্ঘণ্ট, এমনধারা দৌড়ঝাঁপ ছাড়া তার উপায় নেই, বিশ্বলোক তার সামনে উন্মুক্ত-উন্মোচিত, বিশাল পরিধিকে সে বেছে নিয়েছে। তার সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুযোগ করবার অধিকার কারও নেই, কিন্তু আমাদের বিষাদসিন্ধু তো তবু উথলে উঠবেই।

নিঃসঙ্কোচে একটি পার্শ্বমন্তব্য যোগ করছি। দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে অমর্তর গবেষণা, যা তাকে নিত্যনতুন শিরোপা জুগিয়েছে ও জোগাচ্ছে, আমাকে বরঞ্চ ঈষৎ বিষণ্ণই করেছে। শ্রেণীবিভাজনের সমস্যা এড়িয়ে দারিদ্র্যের আকরিক বিশ্লেষণ করা চলে বলে আমি মনে করি না। ‘উদারনৈতিক’ স্বাধীনতা, তার বিবেচনায়, সৃষ্টির সমস্ত সমস্যার নিরসনসূচক; আমি তো বলবো, পৃথিবীর অনেক সর্বনাশী ঘটনা-সংঘটনার জন্য দায়ী এক ধরনের সমাজবিকার, যাকে কেউ-কেউ স্বাধীনতা ভেবে নিয়ে হ্লাদিত বোধ করেন।

প্রীতি-স্নিগ্ধতার বিনিময়ে অনুরূপ স্নাত হয়েছি সুখময়-ললিতার সান্নিধ্য থেকেও। সুখময়ের পাণ্ডিত্যের ব্যাপ্তি যেমন বিশাল, ওর সারল্যও সমান অতুলনীয়। শিশুর অপাপবিদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে সে পৃথিবীকে দেখেছে, দেশের সমস্যাবলীর সমাধান খুঁজেছে, প্রথম থেকেই ধনবিজ্ঞানের সূত্রগুলির জটিলতম রহস্য তার অনায়াসআয়ত্ত। সর্বগুণসম্পন্ন চৌখস অর্থনীতিবিদ হিশেবে হয়তো কোনওদিনই তাকে মনে করিনি; জরুরি অবস্থার সময় তার ইন্দিরা গান্ধির প্রতি অনুরাগ মন খারাপ করে দিয়েছিল। তাতে কিছু ইতরবিশেষ হবার নয়; সুখময় সুখময়ই, ধনবিজ্ঞান-দর্শন-ইতিহাস-ন্যায়শাস্ত্র-গণিতে তার স্বচ্ছন্দ প্রব্রজ্যা মুগ্ধ না-করে পারতো না। আমার কল্পনায় একটি স্থিরচিত্র ভাস্বর হয়ে আছে: সুখময় কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিভৃত করে সমারূঢ়, জ্ঞানান্বেষীরা আসছেন-যাচ্ছেন, সুখময়ের কথা শুনছেন, সুখময়ের কথন থেকে জ্ঞানসমৃদ্ধ হচ্ছেন, চতুর্দিকে মন্ত্রের মতো মুগ্ধতা বিরাজ করছে, দিনের পর দিন জুড়ে। অথচ তাকে অনুরোধ-উপরোধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে যোজনা কমিশনে বসিয়ে দেওয়া হলো। বিবেকভারাতুর সুখময়, যে-কর্তব্য তার পক্ষে অযথা কালহেলন, তাতে নিবিষ্ট হয়ে রইলো জীবনের শেষ দশ-বারো বছর। কে জানে, যদি এই পর্বের অবর্ণনীয় পরিশ্রম থেকে সে মুক্ত থাকতে পারতো, সম্ভবত আরও ঢের দিন তার জীবনায়ু প্রলম্বিত হতো, পৃথিবী ও দেশ তার কাছ থেকে প্রভূত আরও জ্ঞানের উপচার আহরণের সুযোগ পেতো। আচরিক অত্যাচারের শিকার হলো সে, ললিতা, আমরা সবাই। মৃত্যুর পর মানবাত্মার কী গতি হয়, আদৌ কোনও গতি হয় কিনা, জানা নেই, সুতরাং যে-সুখময় আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, স্রেফ তার স্মৃতি নিয়েই আমাদের এখন কাটাতে হবে। এই নিছক স্মৃতিসর্বস্বতার নির্মমতা ললিতা কেমন করে একা বয়ে বেড়াচ্ছে ভেবে অবাক হতে হয়: চিরকালই সুখময় একান্ত ললিতানির্ভর, ললিতা সুখময়নির্ভর। বন্ধুবান্ধবের ভালোবাসা তাকে ঘিরে রেখেছে, তবু, স্বীকার করতেই হয়, ললিতাকে এখন ভীষণ একাকী নিরালম্ব মনে হয়, প্রতিভাময়ী দুহিতা মৌরীর সতত-সান্নিধ্যও যার অবসান ঘটাতে পারে না। সেই সঙ্গে সুখময়ের শিশুসারল্যের স্মৃতি নিরন্তর তাড়া করে ফেরে। অসম্ভব খাদ্যবিলাসী ছিল সুখময়। যা মস্ত কৌতূহলোদ্দীপক, খাওয়ার পোশাকি পর্যায়ক্রম সারা হয়ে গেলেই তার আসল খাওয়া শুরু; শুক্তো-শাক-ডাল-সবজি-চচ্চড়ি-মাছ-মাংস-চাটনির খাদ্যবৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া মাত্র সুখময়ের যথার্থ খাওয়ার পালা: একটু ফের ডাল, একটু ফের ভাজা, একটু ফের শুক্তো, একটু ফের মাছ, একটু ফের মাংস, কিংবা, খেয়াল চাপলে, আর একবার চচ্চড়িতে ফিরে যাওয়া। পৃথিবীর মানুষ সুখময়কে জানতো পণ্ডিত হিশেবে, আমাদের কাছে সে ভালোবাসার প্রগাঢ় আশ্রয়স্থল, যে-আশ্রয় কর্কশ হাতে কেউ কেড়ে নিয়ে গেছে।

খুবই কাছের মানুষ ছিল আর এক অর্থনীতিবিদ, তিরুবনন্তপুরমের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যক্ষ টি এন কৃষ্ণন, ষাটের দশকে কলকাতায় আমাদের সহকর্মী, অন্তত পঁয়তিরিশ বছর ধরে ঘনিষ্ঠ শুভানুধ্যায়ী, সে-ও কিছুদিন হলো প্রয়াত, তার গণিতে-পারদর্শিনী মৃদুস্বভাবা স্ত্রী রাধা তারও কয়েক বছর আগে। তাদের একমাত্র কন্যা সুনীতা প্রধানত প্রবাসিনী, ক্কচিৎ-কদাচিৎ যখন দেখা হয়, আবেগে জড়িয়ে ধরে অতীতলেহন করি।

অর্ধশতাব্দী আগে আড্ডা ও বৃত্তির বৃত্তে যাঁরা নিত্যসহচর ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে পৃথিবী থেকে নিষ্ক্রান্ত, অবশিষ্ট কয়েকজন বিভিন্ন স্থানে মহাসমুদ্রে বিচ্ছিন্ন নির্জন দ্বীপের মতো টিকে আছি; সুভাষ ধর ও নীলাঞ্জনা নিউ ইয়র্কে, দু’জনেই অসুস্থ, তা ছাড়া পারিবারিক দুর্বিপাকে বিধ্বস্ত; মোহিত হায়দরাবাদে কিন্তু বনজা নেই, পুণেতে হোনাভার কিন্তু চন্দ্রা প্রয়াত, বাঙ্গালোরে কৃষ্ণস্বামী ও মধুরা, তিরুবনন্তপুরমে রাজ, তাঁর স্ত্রী সরসম্মা বিগত, একই শহরে ইকবাল গুলাটিও কয়েক মাস আগে প্রয়াত, লীলা একা; অঞ্জু ও হিতেন ভায়া দিল্লিতে, তাদের ছেলেমেয়েরা পৃথিবীতে বিচ্ছুরিত: রুক্মিনী দিল্লিতে, ইংরেজিতে কাব্যচর্চা নিয়ে সদ্য ব্যস্ত, দেবকী সুদূর বার্কলেতে বিজ্ঞানসাধিকা, পুত্র অমিত, রিও ডি জেনিরোয় ব্রাজিলীয় সংসার সামলাচ্ছে। উমা ও শাম্বমূর্তিও দিল্লিতে, কৃষ্ণজী ও নীলাম্মা হায়দরাবাদে। আমাদের স্নেহসুধায় সিক্ত করে অর্ধ শতাব্দী আগে দিল্লির আড্ডায় নায়কত্বে বিরাজ করতেন যিনি, বলবন্ত নাগেশ দাতর, তিনিও বছর দুই হলো বিগত। প্রয়াত আমার সুহৃদ সত্যব্রত সেনও। স্নেহাংশু আচার্য যোলো বছর আগে চলে গেছেন, মাত্র কয়েকদিন আগে চলে গেছেন সুপ্রিয়া আচার্য।

যাঁর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ অব্যাহত ছিল, অরুণ ঘোষ, একবিংশ শতাব্দী শুরু হতে না হতে পৃথিবী থেকে অপসৃত। তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে গাঢ় অবসন্নতায় ঢেকে দেওয়া আর এক মৃত্যুসংবাদ। সম্পূর্ণ অন্য বৃত্তের বন্ধু, লোকনাথ ভট্টাচার্য, বৈঠক করতে প্যারিস থেকে কায়রো এসেছিল, সেখানে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। বহুবিদ্যাবতী পরমবিচক্ষণা পত্নী, ফ্রাঁস, ও কন্যা ঈশা লোকনাথকে গভীর মমতায় ঘিরে রাখতো, তবু বুক-ভরা অভিমান নিয়ে সে চলে গেল। তার গল্প-উপন্যাসের প্রতীক বাঙালি পাঠকের কাছে অবোধ্য, তার কবিতা ফরাশি ভাষায় অনূদিত হয়ে ইওরোপ জুড়ে উচ্ছ্বসিত বাহবা কুড়িয়েছে, কিন্তু স্বদেশে সে কবি ও লেখক হিশেবে অবজ্ঞাত। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে সে কয়েক দিনের জন্য কলকাতা ঘুরে গিয়েছিল, তার সত্তা জুড়ে এক ভীতিপ্রদ অন্যমনস্ক ঔদাস্য, অভিমানের সেই জীনতা নিয়েই লোকনাথ বিদায় নিল। আর এই মুহূর্তে খবর এলো কৈশোরকাল-থেকে আমাকে-মমতায়-জড়ানো বান্ধবী, শান্তি দিঘে, প্রায় হাসতে-হাসতে আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।

বন্ধদের সংখ্যা ক্ষীয়মাণ। প্রতিদিন সকালে চা-পান করার মুহূর্তে চট করে ভেবে পাই না, দূরভাষে কোন সুহৃদের কুশল অনুসন্ধান করবো, তাঁরা তো বেশির ভাগ নিষ্ক্রান্ত। হঠাৎ করে এসে কয়েক ঘণ্টার জন্য ভরসা ও আনন্দ দান করে যাওয়ার মতো মানুষজনও প্রায় শূন্য। কনিষ্ঠরা অনেকেই ব্যস্ত, নানা দায় মিটিয়ে বৃদ্ধদের নিত্য খোঁজ-খবর নেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে নির্মল-রুমার সৌজন্য অমলিন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মালিনী ও মিহির ভট্টাচার্যেরও। কখনও-কখনও আসেন পুরনো বন্ধু মুরারি সাহা, শিবকিঙ্কর মিত্র। যাঁরাই আসেন, তাঁদের প্রস্থানের মুহূর্তে করুণ হেসে বলি: আবার আসিও তুমি, আসিবার ইচ্ছা যদি হয়।

এবার যে-দম্পতির কথা বলবো, তারা কলকাতায় স্থিত নয়, নতুন দিল্লির বাসিন্দা, আগেই এদের সামান্য উল্লেখ করেছি, দু’জনেই অর্থনীতিবিদ, উভয়েই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গত তিরিশ বছর ধরে জড়িত, প্রভাত ও উৎসা পট্টনায়ক। প্রভাত উৎকলসন্তান, উৎসা বঙ্গললনা। প্রভাতের বাবা ওড়িশায় কমিউনিস্ট পার্টির জন্মলগ্ন থেকে দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অতি শৈশবে প্রভাতের বেশ কিছু সময় কেটেছে পার্টির কমিউনে। ধনবিজ্ঞানে ক্ষুরধার, দিল্লি স্কুল ও অক্সফোর্ডের বিখ্যাত ছাত্র, কেমব্রিজে কিছুদিন পড়িয়েছে, সত্তরের দশকের গোড়া থেকে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক। প্রভাতের পড়ানোয় পাণ্ডিত্যের সঙ্গে প্রাঞ্জলতার স্বাক্ষর, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ত মুগ্ধ করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বাইরেও যেখানে যখন বলার ডাক পায়, প্রাঞ্জলতম ভাষায় দুরূহতম তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে বলে। সে যদি অর্থনীতির সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে নিজেকে বদ্ধ করে রাখতো, আমার সঙ্গে তার সৌহার্দ্যের সম্ভাবনা হয়তো থাকতো না। কিন্তু না, অর্থনীতির ঘোরপ্যাঁচ যে জীবনসংঘাতের প্রতিবিম্ব, প্রভাত সে বিষয়ে আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত। গত দশ-বারো বছরে পৃথিবীর চেহারা বদলে গেছে, বদলে গেছে দেশ-বিদেশের রাজনীতির আদল, সমাজে আদর্শের অবমুখিতার ঢল, প্রভাত তার আদর্শে-বিশ্বাসে স্থিত থেকে সমস্ত উটকো প্রবণতার বিরুদ্ধে বিরামহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, পাশে পেয়েছে উৎসাকে। উৎসাও অতি প্রতিভাবতী অর্থনীতিবিদ, বরাবর প্রভাতের সহপাঠিনী, তাদের জীবনচর্যাও খাঁজে-খাঁজে মিলে গেছে। দু’জনের মধ্যে চরিত্রগত তফাত আছে। প্রভাতের সৌজন্যের তুলনা নেই, পরম রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিপক্ষের সঙ্গেও তার ব্যবহার বিনম্র মধুর; নিজের জীবনদর্শনে অবিচল, কিন্তু ঋতুতে-অঋতুতে সে কারও সঙ্গেই সরব জেহাদে নামে না। অন্য পক্ষে উৎসা সোজাসাপ্‌টা কথা বলতে পছন্দ করে, যাকে ভেকধারী বলে উৎসার মনে হয়, সেই ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে ভেকধারী বলে অভিহিত করতে তার বিবেকে বাধে না। প্রভাত যেখানে খানিকটা ভাবুক, উৎসা সেখানে ভীষণরকম কেজো; দু’জনে পরস্পরের নিখুঁত পরিপূরক। বামপন্থী চর্চার পীঠস্থান রূপে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় যে আজ সর্বখ্যাত, তার অনেকটা কৃতিত্বই এই দম্পতির আদর্শনিষ্ঠা ও উদ্দীপনাসঞ্চারের প্রতিভার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

নিবিড় ভালোবাসায় ঘিরে রেখেছে এরা দু’জন। পণ্ডিত ও পণ্ডিতম্মন্যদের মহলে আমার সুনাম নেই, মারকুটে-ঝগড়াটে বলে বাজারে প্রসিদ্ধি, অন্য কোনও জ্ঞানপীঠস্থান থেকে আমার তেমন ডাক পড়ে না, উৎসা-প্রভাত অথচ আমাকে বেশ কয়েক বার তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে; ওখানে ছেলেমেয়েদের কাছে বক্তৃতা দিয়ে, সতীর্থদের সঙ্গে অহোরাত্র আলোচনা করে, প্রচুর আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করেছি।

অমিত ভাদুড়ীর কথাও না বলে পারছি না। অমিত ললিতার অনুজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্দান্ত ভালো ছাত্র, কেমব্রিজে গিয়ে খ্যাতি কুড়িয়েছে, কিছুদিন দিল্লি স্কুলে পড়াবার পর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেকে চালান করেছিল। ধনবিজ্ঞানে ওরও প্রতিভার দীপ্তি দেশে-বিদেশে বিকীর্ণ। ললিতা-অমিতদের বাবা আদিনাথ ভাদুড়ী কমিউনিস্ট পার্টির উষামুহূর্তের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলেন, আদর্শবাদী মানুষ, ছেলেমেয়েদের মধ্যেও সেই আদর্শের প্রতিফলন। দেশবন্ধু পার্ক-সংলগ্ন আদিনাথবাবর বাড়িতে একদা প্রচুর আড্ডা দিয়েছি, গৃহস্বামীর ঔদার্যে অচিরে বয়সের ভেদাভেদ ঘুচে যেত। ললিতারা ভাইবোনরা সবাই, তাদের বাবা-মা, আগন্তুক আমরা, খাবার টেবিল ঘিরে বসে প্রহরের পর প্রহর পৃথিবীর সমস্যা, সমাজের সমস্যা, জীবনের সমস্যা নিয়ে অজস্র কথাবার্তা বলেছি, পারস্পরিক অনুরাগের বন্যায় ভেসে গেছি। কোনও বিশেষ পর্যায়ে যে বিন্দুতে অবস্থান, জীবনের এমনই নিয়ম, তাকে আমরা প্রতিনিয়ত অতিক্রম করি, জ্ঞানের পরিধি বাড়ে, একেক জনের একেক রকম করে বাড়ে, অভিজ্ঞতার গতিপথও আলাদা হয়ে যায়। পারস্পরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধার অনুভব যদিও বজায় থাকে, আমরা তা হলেও আস্তে-আস্তে একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যাই। বাইরে থেকে ঠিক বোঝা যায় না, কিন্তু অমিত আমাদের অনেকের চেয়ে, আমার ধারণা, বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ঢের বেশি গোঁড়া। অধ্যাপনার সূত্রে তাকে মাঝে-মাঝে পূর্ব ইওরোপে সময় কাটাতে হয়েছে, ষাটের দশক থেকে ওই ভূখণ্ডে সাম্যবাদী আদর্শের প্রয়োগে যে নীতিবিচ্যুতি প্রকট হচ্ছিল, সে তার প্রত্যক্ষদর্শী। ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায়, বামপন্থী আন্দোলনের যে ধরনধারণ, তা-ও তার আদৌ পছন্দ না। অমিতের অত্যন্ত সৎ ব্যক্তিত্ব, আমার রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে তার মতামতের আড়াআড়ি সে গোপন করে না, সম্ভবত সেই কারণেই ইদানীং তার সান্নিধ্য একটু কম পাই।

অথচ, অমিত ও মধুর কাছ থেকে যে-স্নেহ ও আদর পেয়েছি, তা অবিস্মরণীয়। বহুবার দিল্লিতে ও বিদেশে তাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছি, তাদের পরিচর্যায় আপ্লুত হয়েছি। মধু এই মুহূর্তে পর্তুগালে আমাদের রাষ্ট্রদূত, অন্যান্য অনেক ভাষার সঙ্গে চমৎকার বাংলা বলে, হিন্দিতে গল্প-নাটক লিখে যশোমতী হয়েছে, শাস্ত্রীয় সংগীতেও অপূর্ব কণ্ঠলাবণ্য। চোদ্দো বছর আগে ফ্রাঙ্কফুর্টে যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, মধু ভিয়েনা থেকে ছুটে এসে পরিচর্যার সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল, তার বিবরণ আগেই দিয়েছি।

তা হলেও দেশকে টেনে-হিঁচড়ে যেদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সমাজকে যে-গভীর গড্ডালিকায় ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, তাতে শেষ পর্যন্ত তো না মেনে উপায় নেই, গ্রন্থাগারের অন্ধকারে শান্তি নেই, ব্যক্তিকেন্দ্রিক মন-দেওয়া-নেওয়ায় কোনও স্বস্তির প্রস্থান নেই, জীবনের নিয়ামক রাজনীতি, সেই রাজনীতির আবর্তে দ্বন্দ্বের যন্ত্রণায় নিপীড়িত হওয়া থেকে কারওরই অব্যাহতি নেই। অমিতের জীবনদর্শন থেকে ঈষৎ দূরে সরে এসেছি, প্রভাত-উৎসাদের সারণিতে আমার অবস্থান, যদিও অমিতের চারিত্র্যদার্ঢ্যের প্রতি শ্রদ্ধা আদৌ নির্বাপিত হয়নি।

তবে আমার তো এখনও কিছু অধ্যায় পেরনো বাকি আছে। তিরানব্বুই সালের প্রারম্ভ, শিক্ষা কমিশনের পর্ব চুকেছে। ই পি ডাব্লিউ-তে লেখা চালিয়ে যাচ্ছি, কলকাতায় যার পাঠক কম, ভারতবর্ষের অন্যত্র প্রচুর। কলকাতায়ও একটি-দু’টি কাগজে নিয়মিত লিখি, তবে তাদের সম্পাদকীয় আদর্শের সঙ্গে আমার মতামতের বিপরীত-মেরু সম্পর্ক, লিখে তেমন আরাম পাই না। বামপন্থী মহলেও স্বাভাবিক কারণে আমাকে নিয়ে ঈষৎ দ্বিধাবিজড়িত ভাবনা-অনুভাবনা। কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না; সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাস করি, অথচ সাম্যবাদী সংগঠনের নিয়মকলা মেনে চলবো না, তা তো হতে পারে না। অহংবোধকে পুরোপুরি বিসর্জন দিতে না পারলে ভালো কমিউনিস্ট হওয়া সম্ভব নয়, অচিরেই তা বুঝতে পেরেছিলাম, নিজের চারিত্রিক অবস্থান সম্পর্কে কোনও কালেই আমার মনে কোনও বিভ্রান্তি ছিল না। দলের অনুশাসনের মধ্যে আমার পক্ষে থাকা দুষ্কর, এটা বুঝতে পেরেই ছিয়াশি সালে সরে এসেছিলাম। সমস্যাটি পার্টির নয়, পুরোপুরি আমার। দলের মিত্র হয়েই ওই সময় থেকে আমার সময় যাপন। অতিকিশোর বয়সে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর এক গল্পে দুই ব্যক্তির মাঠে চেয়ার পেতে বসার এক বর্ণনা পেয়েছিলাম: ‘পাশাপাশি নয়, মুখখামুখিও নয়, সে এক অদ্ভুত নৈকট্য’। দলের সঙ্গে আমার বর্তমান সম্পর্ক অনেকটা সেরকম।

হয়তো শিক্ষা কমিশনের জন্য অত পরিশ্রম করেছি, তার পুরস্কারহেতু, হয়তো একানব্বুই সালের বিধানসভা নির্বাচনে স্বেচ্ছায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সঙ্গে টক্কর দিয়েছি বলে সান্ত্বনা পুরস্কার, কিংবা হয়তো সংসদে আমাকে দিয়ে কিছু দায়িত্ব পালন করিয়ে নেওয়ার অভিপ্রায়ে, একানব্বুই সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ দল থেকে আমাকে রাজ্যসভায় প্রার্থী হতে অনুরোধ জানানো হলো; তেমন না ভেবে রাজি হয়ে গেলাম, যদিও দিল্লিতে বাসা বাঁধবার চিন্তায় তেমন উৎসাহবোধ করছিলাম না। ওই সময়ে শেয়ার বাজারের কেলেঙ্কারি এবং তার নায়কদের সঙ্গে বিদেশী ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির রমরমা সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর জল ঘোলা হচ্ছিল। পার্টি থেকে হয়তো এটাও ভাবা হয়েছিল, অর্থমন্ত্রকের নাড়ি-নক্ষত্র যেহেতু আমার অনেকটা জানা, রাজ্যসভায় ঢুকে সোরগোল তুলতে পারবো। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের খামখেয়ালে রাজসভার নির্বাচন তিন-চার মাস পিছিয়ে গেল, দিল্লি পৌঁছুতে অগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ। ততদিনে শেয়ার কেলেঙ্কারি নিয়ে সংসদীয় তদন্ত কমিটির কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে, আমার আর তার সদস্য হওয়া হয়নি। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে সংসদের দুই সভায় জোর বিতর্ক, রাজ্যসভায় দলের তরফ থেকে আমাকে বলতে বলা হলো। নতুন সদস্য হয়েছি, আসন নির্দিষ্ট হয়েছে পিছনের দিকের সরিতে। ইন্দ্রকুমার গুজরাল-জয়পাল রেড্ডিরা ধরে নিয়ে গিয়ে সম্মুখতম সারণিতে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। মিনিট চল্লিশেক ধরে বলেছিলাম, শুরু করেছিলাম এই মন্তব্য দিয়ে যে আমারও জন্ম কংগ্রেসি পরিবারে, তাই কংগ্রেসের দুরাচার-আকীর্ণ অবস্থা দেখে ঘৃণাবোধের সঙ্গে মনস্তাপও আমার কম নয়। সম্ভবত এই প্রারম্ভিক উক্তির জন্যই কংগ্রেস বেঞ্চি থেকে একটি-দু’টি তির্যক মন্তব্য ছাড়া তেমন বাধা এলো না, বক্তৃতান্তে চারদিক থেকে আসন চাপড়ে তারিফ ধ্বনিও শোনা গেল। আরও যা মনে পড়ে, যেদিন রাজ্যসভায় শপথ নিলাম, সেদিনই কলকাতায় উৎপল দত্তের মৃত্যু, বিষণ্ণ বিকেলে খবরটা পেলাম। উৎপলের মতো প্রতিভাধর মানুষ বিংশ শতাব্দীতে বাংলায় তথা গোটা উপমহাদেশে খুব কমই জন্মগ্রহণ করেছেন; তার শূন্যস্থান সহজে পূর্ণ হবে না। বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইদানীংকার ধুকতে-থাকা অবস্থা আমার অভিমতকে সমর্থন করবে। কুমার রায়ের মতো ধীশক্তি-ও তিতিক্ষা-যুক্ত কেউ-কেউ এখনো শরীর পাত করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, নতুন-নতুন তরুণ প্রতিভারও উদয় যে হচ্ছে না তা নয়। তা হলেও সব মিলিয়ে মনে হয় গোধুলি লগনে মেঘে ঢেকেছে তারা।

এক ধরনের চিন্তাহীনতা থেকে সংসদে প্রবেশ করতে রাজি হয়েছিলাম, পস্তাতে দেরি হলো না। প্রথমেই ধাক্কা খেলাম সাংসদদের আচার-আচরণ দেখে। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ভারতীয় সংসদের মাহাত্ম্য সম্পর্কে অনেক রোমান্টিক অভিমত বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যক্ত করেছেন। নব্বুই দশকের সংসদ তাঁর সেই স্বপ্নলোকের পৃথিবী থেকে অনেক দূরে। যুক্তিসিদ্ধ আলোচনার ঋতু বহুদিন গত, সংসদের এ এক সম্পূর্ণ অন্য চেহারা। স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক দশক সংসদে প্রধান ব্যবহৃত ভাষা ছিল ইংরেজি, অবস্থা আগাপাশতলা পাল্টে গেছে। সদস্যরা প্রধানত হিন্দি ভাষা ব্যবহার করেন; অধিকাংশ সদস্য শুধু ইংরেজি বলতে নয়, বুঝতেও সমান অপটু। শ্রেণীগত ও বর্ণগত কিছু পরিবর্তনও চোখে পড়বার মতো৷ তথাকথিত অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ শ্রেণী ও বর্ণ থেকে সংসদে এখন যাঁরা আসছেন, স্বভাবে দেশজ, অতি প্রাকৃত তাঁদের চলন-বলন। একদিক থেকে বিচার করলে এটা চমৎকার ঘটনা: দেশের আসল মানুষগুলি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করেছেন। কিন্তু যা মনে হয় বাস্তবে ঠিক তা নয়। যদি ইংরেজি বা হিন্দি না-জানা কেউ থাকেন সংসদে, রুদ্ধবাক্‌ হয়ে থাকা ছাড়া গতি নেই তাঁর, বিশেষ করে যদি দরিদ্রতম শ্রেণীর তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন। ভাষাগত বিভাজন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিভাজনের গণ্ডি পেরিয়ে; হিন্দি না-জানা সদস্যদের তাই মস্ত অসুবিধা। সংবিধানের শর্ত যথার্থ মান্য করা হলে দেশের সব ক’টি স্বীকৃত ভাষার যে-কোনও একটিতে সদস্যদের বলবার এবং সঙ্গে-সঙ্গে তা অন্যান্য ভাষায় অনুবাদের প্রযৌক্তিক কৌশল প্রবর্তনের ব্যবস্থা করা জরুরি ছিল। তা করা হয়নি, হিন্দি বা ইংরেজির বাইরে অন্য কোনও ভাষায় বলতে গেলে আগে থেকে সংসদ দফতরে জানাতে হয়, যে-ভাষায় বলতে সংসদসদস্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তার জন্য অনুবাদনবিশের ব্যবস্থা করা হয়, তিনি বা তাঁরা ধীরে-সুস্থে ভাষণের ইংরেজি ও হিন্দি বয়ান কয়েকদিন বাদে জমা দেন। প্রতিটি স্বীকৃত ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সংসদ-সদস্যই বিপদে পড়েন; তাঁরা, যে কারণেই হোক, হিন্দি বা ইংরেজিতে তেমন রপ্ত নন, অথচ অনুবাদের ফেরে পড়তে অনিচ্ছুক, তাই বাধ্য হয়ে অপটু হিন্দিতে কিংবা অপটু ইংরেজিতে বক্তব্য পেশ করেন। তাঁরা কী বলছেন তা থেকে অন্য সদস্যদের শ্রবণ সরে গিয়ে তাঁদের বচনের ব্যাকরণ-ভাষাগত ত্রুটির দিকে নিবদ্ধ হয়, অনেক সময় হাসির খোরাক জোগায় পর্যন্ত। এরকম হওয়া কখনওই উচিত ছিল না, কিন্তু এই সমস্যা নিয়ে কারও তেমন গা নেই, এমনকি ভাষা-অভিমানী আঞ্চলিক দলগুলিরও নেই। আমার কাছে কিছুদিনের মধ্যেই প্রতীয়মান হলো, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়-বাবাসাহেব আম্বেডকর-আম্মু স্বামীনাথনদের দিন শেষ, ইংরেজিতে চমৎকার বক্তৃতা দিলেও কল্কে পাওয়ার সম্ভাবনা কম, ভোজপুরি বা ছত্তিশগড়ি হিন্দিরই আসল কদর।

সমস্যা আসলে আরও জটিল, সদস্যদের চরিত্র পরিবর্তন ঘটিত। দেশের রাজনীতি থেকে নৈতিকতা অন্তগত, ভ্রষ্টাচার, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, এমনকি খুন-খারাপিও আর মোটেই নিন্দনীয় আচরণ নয়। তিনশো দুই ধারায় যদি দশটা-বিশটা মামলাও ঝুলতে থাকে, কোনও চিন্তা নেই, মামলার ফয়সালা হতে দুই যুগ অতিক্রান্ত হবে, ইতিমধ্যে সবাই-ই সমান সম্মাননীয় সদস্য। ‘অগ্রগামী অধঃপাত’ কথাটি একদা প্রচুর ব্যবহৃত হতো, ভারতীয় রাজনীতিবিদদের হালের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করতে গেলে ওই শব্দদ্বয়ই মনে ভিড় করে। পশ্চিম বাংলায় রাজনীতির চারিত্রিক নিম্নগামিতা শুরু হয় সত্তর দশকের সূচনা থেকে। রাজ্যে বর্ধমান বামপন্থী প্রভাব রুখতে ইন্দিরা গান্ধির চেলা-চামুণ্ডারা মার্কস-বর্ণিত লুম্পেনদের রাজনীতির মঞ্চে প্রধান ভূমিকায় নামিয়ে দিলেন। সব দলেই, কোনও দলে বেশি কোথাও কম, কিছু গুণ্ডাশ্রেণীর মানুষ নেতাদের হুকুম তামিল করবার জন্য থাকতো। তবে এতদিন তারা আড়ালে ছিল। সত্তরের দশকে যুগান্ত, তারা পাদপ্রদীপের সামনে চলে এলো। তারা সমাজের সমস্ত ক্লেদ নিজেদের মধ্যে জড়ো করেছে, কথায়-কথায় তারা মাথা ভাঙে, খুন-খারাপি করে, খিস্তি-খেউড় ছাড়া বাক্যবন্ধ রচনা করতে পারে না। অথচ তারাই, দেশের মহান নেতৃত্ব বলে দিলেন, জাতীয় যুব সম্প্রদায়ের আদর্শ, অন্তত আদর্শ হওয়া উচিত। অপকৃষ্টকে অনুসরণ করার তাগিদ আমাদের মিশ্র সমাজব্যবস্থায় অপ্রতিরোধ্য ব্যাধি। সত্তর দশকে প্রোথিত সেই বিষবৃক্ষ এখন প্রায় সর্বত্র শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে৷ এই ব্যাপারে আমার প্রথম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো সাতাত্তরের নির্বাচনের পর বিধানসভায় প্রতিপক্ষ দলের কয়েকজন সভ্যকে দেখে, তাদের ভাষা-সহবৎ-আচরণ কর্কশ, কদর্য। ছেলে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী, বাজেট আলোচনা চলছে, আমার মা, তখনই তিনি আশি ছুঁই-ছুঁই, একদিন শখ করে বিধান সভায় আলোচনা শুনতে এলেন। সভায় অঙ্গভঙ্গি-নৰ্তনকুর্দন-কুবাক্যবর্ষণের সমাহারে তিনি স্তম্ভিতা, পরদিন ফোনে আমাকে অনুযোগ জ্ঞাপন করলেন: ‘কাদের সঙ্গে মিশিস?’

সংসদে ঢুকে অভিজ্ঞানের পরিধি বিস্তৃততর হলো। সংস্কৃতিশূন্যতার, রুচিহীনতার জয়জয়কার। আর্যাবর্তের পাঁচ হাজার বছরের সঞ্চিত কর্দমের নমুনা যেন প্রদর্শিত হচ্ছে সংসদভবনে, বেশভূষা থেকে শুরু করে কথায়-বার্তায় এক ধরনের নিশ্চিন্ত উদ্ধতি, এই কর্দমাক্ত জীবরাই যেন সৃষ্টির নিয়ামক, তারা যা বলবে-করবে তা-ই সবাইকে মেনে নিতে হবে। যারা উত্তম, তারা ভয়ে-সংকোচে কোণঠাসা। সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একদা লিখেছিলেন, ‘সামান্যাদের সোহাগ খরিদ করে চিরন্তনীর অভাব মেটাতে হবে’; সে যে কী ভয়ংকর ভাগ্যপরিণাম, জাতীয় সংসদে তা আপাতত দৃষ্টান্তিত।

এই কীচক সম্প্রদায়ই সারা দেশে এখন মন্ত্রী-কোটাল হচ্ছে, আর একবার বলি, অগ্রগামী অধঃপাত। বছর কুড়ি আগে, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় তখনও বেঁচে, একটি গল্প শুনিয়েছিলেন। দিল্লি থেকে হায়দরাবাদ-বাঙ্গালোরগামী বিমানে হায়দরাবাদ যাচ্ছেন, বিমানে নিজের জন্য নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করেছেন, বিমান ছাড়বার সময় হয়ে গেছে, এঞ্জিন চালু হয়েছে, শেষ মুহূর্তে শাদা সেফারি স্যুট-পরা একটি কদর্য চেহারার লোক ধপ করে পাশের খালি আসনটিতে এসে বসলো, বসেই চোখ বুজলো, সঙ্গে-সঙ্গে জেট এঞ্জিনের সঙ্গে পাল্লা-দেওয়া নাসিকাগর্জনসহ অঘোর ঘুম। বিমান আকাশে উড়লো, মিনিট পনেরো সময় কাটলো, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় দেখলেন, তাঁর আসনের আশে-পাশে কয়েকজন ঘোরাফেরা করছে, উসখুশ উসখুশ। এদের মধ্যে একজনের তাঁকে উদ্দেশ্য করে বিনীত প্রশ্ন: ‘ম্যাডাম, ওই ওদিকে একটি খুব ভালো আসন খালি আছে, আপনি ওই আসনটিতে গিয়ে দয়া করে উপবেশন করবেন কি?’ কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় অবাক, ‘আমার জন্য এই আসন নির্ধারিত হয়েছে, আমি অন্যত্র উঠে যাবো কেন?’ আমতা-আমতা জবাব: ‘না, মানে, আমরা অনারেবল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তাই আপনাকে অনুরোধ করছিলাম।’ ‘মুখ্যমন্ত্রী, কোন্ মুখ্যমন্ত্রী, কোথায়?’ ‘ওই যে, আপনার পাশে যিনি বসে আছেন, তিনি’। তাই নাকি, উনি কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী?’ কমলাদেবী জানলেন, পাশে নিদ্রামগ্ন ব্যক্তিটি তাঁর নিজের রাজ্য কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি ধৈর্য ধরে জড়ো-হওয়া মানুষগুলিকে বললেন, ‘কিন্তু উনি তো এখন ঘুমুচ্ছেন। উনি যখন জাগবেন, আপনাদের কথা ওঁকে বলবো, এখন দয়া করে আর এখানে ভিড় করবেন না।’ অসন্তুষ্ট, মনস্কামনা অচরিতার্থ, মুখ্যমন্ত্রীদর্শনপ্রার্থীদের সাময়িক রণে ভঙ্গ দেওয়া। খানিক বাদে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী আড়মোড়া ভাঙলেন, এদিক-ওদিক তাকালেন, সৌজন্যের অভাব নেই, কমলাদেবীকে আলতো করে নমস্কার। কমলা দেবী তাঁকে জানালেন, কতিপয় ভদ্রলোক তাঁদের অনারেবল চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক, সেই উদ্দেশ্যে তাঁকে, কমলাদেবীকে, আসনটি খালি করে দিতে বলেছিলেন, যদি মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে আলাপ করতে চান, তিনি উঠে অন্য আসনে যেতে সম্মত আছেন। বিশ্বের বিরক্তি মুখে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী: ‘না, না, ম্যাডাম, আপনি বসে থাকুন। ওই লক্ষ্মীছাড়া লোকগুলি আমাকে বড়ো জ্বালায়, ওদের সঙ্গে বাক্যালাপের আমার একেবারে ইচ্ছা নেই’। একটুক্ষণ নীরবতা, হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রীর বিনীত প্রশ্ন: ‘ম্যাডাম, আপনার শুভ নাম কি জানতে পারি?’ কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায় নাম বললেন, মুখ্যমন্ত্রীর কোনও ভাব-বিকার নেই। এবার দ্রুত পরের প্রশ্ন: ‘ম্যাডাম, আপনার স্বামীর শুভ নাম কি জানতে পারি?’ কমলা দেবী অস্পষ্ট একটি জবাব দিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তবু বেপরোয়া ; ‘ম্যাডাম, আপনার স্বামী কী কাজ করেন? ক’টি ছেলেমেয়ে আপনার?’ মহিলার ধূসরতর, অস্পষ্টতর উত্তর, মুখ্যমন্ত্রী একটু দমে গিয়ে অবশেষে নীরব, কমলাদেবী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তবে সমাপ্তির পরও সমাপ্তি থাকে। হায়দরাবাদে বিমান থেমেছে, কমলা দেবী অবরোহণের জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন, সৌজন্যের প্রতিমূর্তি মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে, কর্ণাটকের বিখ্যাততমা দুহিতাকে, বিদায় সম্ভাষণ জানালেন, ‘ম্যাডাম, আপনি অবশ্যই একবার কর্ণাটকে আসবেন, কর্ণাটক অতি চমৎকার রাজ্য’।

আজি যে রজনী যায় ফিরাইবো তায় কেমনে। অথচ, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আগে, কর্ণাটকেরই মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন রামকৃষ্ণ হেগড়ে ও বীরেন্দ্র পাটিলের মতো শালীন ব্যক্তিবর্গ। হেগড়ের কথা ইতিমধ্যেই নানা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি। বীরেন্দ্র পাটিল ষাটের দশকে রাজ্যের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী, আশির দশকে ইন্দিরা গান্ধির পুনরাগমনের ঋতুতে কেন্দ্রে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হয়েছিলেন। সদ্য ঘোষণা করা হয়েছে, ত্রিভুবননারায়ণ সিংহকে পশ্চিম বাংলার রাজ্যপালের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। সেই সপ্তাহে কী কাজে দিল্লিতে বীরেন্দ্র পাটিলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি, আমাকে বললেন, ‘দয়া করে আমার একটু উপকার করবেন? অত্যন্ত অনুগৃহীত বোধ করবো যদি কলকাতায় ফিরে গিয়ে ত্রিভুবননারায়ণজীকে জানান, ভদ্রমহিলা তাঁর সঙ্গে যে-আচরণ করলেন তাতে আমি মর্মাহত।’ আমি কথাটি বাইরে ফাঁস করে দিলে ভদ্রমহিলা অবধারিত পাটিলের চাকরি খেতেন, কিন্তু যা বলা উচিত বলে মনে হয়েছে, তা বলতে পাটিল ভয় পাননি।

হতাশার মুহূর্তে খানিকটা রঙ্গ করে কাকে যেন একবার বলেছিলাম, সংসদে আমার বাঁ দিকে যারা উপবিষ্ট, তারা প্রায় প্রত্যেকেই একটি-দু’টি করে খুন করেছে, আর ডান দিকে যারা, তারা অসাধু উপায়ে অন্তত একশো-দু’শো কোটি টাকা কামিয়েছে। কে জানে, এই যে বিলাপটি এখানে লিপিবদ্ধ করছি, সেই অপরাধেই কোনও মাননীয় সদস্য হয়তো সংসদের কাঠগড়ায় আমাকে ডেকে পাঠাবেন। লোকসভা ও রাজ্যসভা দু’জায়গাতেই এই চারিত্রিক রূপান্তর। রাজ্যসভার ক্ষেত্রে আরও কিছু বাড়তি সমস্যা ইদানীং দেখা দিয়েছে। সাধারণ্যে ধারণা ছিল, অপেক্ষাকৃত প্রবীণ ব্যক্তিরাই রাজ্যসভার সদস্য হবেন; নিয়মাবলীতেও নির্দিষ্ট, রাজ্যসভায় সদস্য হতে গেলে ন্যূনতম বয়স, লোকসভার ক্ষেত্রে যা, তার চেয়ে বেশি হওয়া আবশ্যক। হালে সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার ঘটছে। রাজ্যসভার সাংসদদের গড় বয়স এখন লোকসভাভুক্ত সাংসদদের গড় বয়সের চেয়ে কম। উঠতি ছাত্র ও যুব নেতারাও, রাজ্য বিধানসভায় নিজ দলের ভোট ভারি থাকার জন্য, সহজেই রাজ্যসভায় নির্বাচিত হচ্ছেন, যেমন হচ্ছেন উঠতি শিল্পপতিনন্দন বা ধনী কৃষককুলের অল্পবয়স্ক সন্তান, কিংবা সফল ঠিকেদার বা দালাল বা, বলেই ফেলি, সর্ব-অর্থে সমাজবিরোধী। এঁদের মধ্যে অনেকে হয়তো নির্বাচক-মণ্ডলীর আস্থা অর্জন করতে অসমর্থ, দু’-তিনবার লোকসভার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে হেরেছেন, এবার বিধানসভায় পার্টির ভোটাধিক্যের জোরে রাজ্যসভায় আসীন। যে-ভাবনা-চিন্তার ধার-ভার রাজ্যসভার সদস্যদের কাছে শাদামাটাভাবে আশা পোষণ করা যায়, তাঁদের দিয়ে তা পূরণ হবার প্রশ্ন নেই। মানছি, জ্যোর্তিময় বসুর মতো চৌখস বহু সামাজিক গুণাবলীমণ্ডিত মানুষের পক্ষে এই পরিবেশেও তুই-তোকারি করে আসর জমানো অসম্ভব হতো না; সেই প্রতিভা তো সবাইর বর্তায় না।

অন্য এক সমস্যার ব্যঞ্জনা গভীরতর। সংবিধান ও তৎসম্পর্কিত আইনে অনুশাসন, একমাত্র রাজ্যের স্থায়ী অধিবাসীরাই রাজ্য থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হতে পারবেন। এই নিদানের নিহিতার্থ মোটেই অস্বচ্ছ নয়। সংবিধান-রচয়িতারা ভেবেছিলেন রাজ্যসভায় প্রধানত রাজ্যগুলির বিশেষ-বিশেষ সমস্যার উপর অধিকতর আলোকপাত করা হবে, বিশ্লেষণযুক্ত আলোচনার পর সমাধানের সূত্র খোঁজা হবে। বামপন্থীদের বাইরে অন্য কোনও রাজনৈতিক দলই এই স্পষ্ট নির্দেশ মানেনি। শেয়ালকে ভাঙা বেড়া প্রথম দেখিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধি, তাঁর প্রায়-স্বৈরাচারিণী পর্বে: অনুগত বাঙালি বিদূষককে গুজরাট থেকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছেন, অনুরূপ কোনও পেটোয়া পঞ্জাবতনয়কে অসম থেকে রাজ্যসভায় হাজির করেছেন, নয়তো কেরল রাজ্যের এক বশংবদ ব্যক্তিকে রাজস্থান থেকে। ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে, স্থায়ী বসবাস প্রমাণের যে-নির্দেশনামা তা এড়িয়ে, পছন্দের মানুষদের রাজ্যসভায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মহাজ্ঞানী-মহাজন অনুসৃত, সেই পথের পথিক হতে ভালোভাবে শিখেছে দেশের অন্য দলগুলিও। জনতা দল কর্ণাটকের মানুষকে ওড়িশা থেকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে, ভারতীয় জনতা পার্টি কলকাতায় তিন পুরুষ ধরে বসবাসকারী নাগরিককে রাজ্যসভায় আসীন করেছে উত্তর প্রদেশ থেকে। ফের বলছি, একমাত্র ব্যতিক্রম বামপন্থী দলগুলি।

ফলে যা হবার তাই-ই হয়েছে। রাজ্যগুলির আর্থিক-সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ নানা সমস্যা নিয়ে রাজ্যসভায় বিস্তারিত হবার খুব কম সুযোগই এখন সদস্যদের ভাগ্যে ঘটে, হামেশা দেখা যায় মাননীয় সাংসদ যে-রাজ্য থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, তার প্রধান ভাষা পর্যন্ত জানেন না তিনি, ওখানকার সমস্যাদি সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট কেন, ভাসা-ভাসা কোনও ধ্যান-ধারণাও নেই, কী আলোচনা করবেন তা হলে? রাজ্যসভা গঠনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যই তাই ব্যর্থ হতে বসেছে। বিপরীত মতাবলম্বীও অবশ্য অনেকে আছেন; তাঁরা বলবেন জাতীয় সংহতির স্বার্থেই অন্য রাজ্যবাসী, ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষজনকে প্রত্যেক রাজ্য থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচন প্রয়োজন। বেশ তো, তাঁদের কথা যদি মেনে নিতে হয়, অনুগ্রহপূর্বক সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট আইনগুলি পাল্‌টানো হচ্ছে না কেন?

তবে মূল সমস্যা সভ্যদের চারিত্রিক ও সাংস্কৃতিক মান-সংশ্লিষ্ট। যদি দাগী অপরাধীদের দিয়ে সংসদের উভয় কক্ষের শোভা বর্ধন করা হয়, তা হলে সংসদের মান উঁচু থাকবে, বিজ্ঞ ব্যক্তিরা মিহিন সুসংস্কৃত ভাষায় বক্তৃতা দেবেন, বিষয় নির্বাচনে চিন্তার গাম্ভীর্য প্রদর্শন করবেন, এ সবই দুরন্ত দুরাশা। উভয় সভাই এখন হট্টমেলায় পরিণত, নীতি-নিয়মের তোয়াক্কা হ্রস্বমান, দেশের-সমাজের প্রধান সমস্যাগুলি অনাদরে অবহেলিত, অন্য দিকে তুচ্ছ কিন্তু চমকপ্রদ ঘটনা বা গুজব নিয়ে অন্তহীন শোরগোল-চেঁচামেচি, কখনও-কখনও প্রায় আস্তিন গুটিয়ে মারামারি। এই রুচিনিম্নগামিতা সংক্রামক: সদস্যরা আলতু-ফালতু কথা বলছেন, ঠুনকো বিষয়ে প্রহরের পর প্রহর জুড়ে বিস্তারিত হচ্ছেন, হচ্ছেন এমন ভাষায় যা বেশির ভাগ সদস্যের মালুম হচ্ছে না, তাঁরা স্বভাবতই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন। এরকম পরিস্থিতিতে গলাবাজিরই প্রধান দাপট: যিনি যত চেঁচাতে পারবেন, তত বেশি তিনি সভা-পরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। সভার অধিকাংশ সময় এই শ্রেণীর সদস্যদের দখলে অবলীলাক্রমে চলে যায়, স্বাভাবিক কারণেই তাঁদের অভব্যতা-অভদ্রতার নেশাও চড়ে। তাঁরা গলা উঁচু করে যা বলছেন, তাই-ই প্রাধান্য পাচ্ছে, বেতারে-টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে, খবরের কাগজে প্রত্যহ সংবাদচুড়ামণি তাঁরা। শৃগাল-কুকুরসম চিৎকার-শীৎকারের সময়সীমা সকাল এগারোটা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত। এগারোটা থেকে বারোটা এক ঘণ্টা জুড়ে মৌখিক প্রশ্নোত্তর পর্ব, বারোটা থেকে পরবর্তী ঘণ্টা দেড়েক ‘মুক্ত প্রহর,’ অথবা দৃষ্টি আকর্ষণী আলোচনা। এই আড়াই ঘণ্টা কালপরিসর মাননীয় হুল্লোড়বাজদের সুবর্ণ মুহূর্ত। তাঁরা চেঁচাচ্ছেন, বেয়াদপি করছেন, প্রতিপক্ষকে সভার বাইরে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করছেন, আপত্তিজনক প্রায়-অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করে সংবাদপত্রাদির খিদের খোরাক মেটাচ্ছেন। একজন-দু’জন সদস্য প্রশ্ন করবার কিংবা আলোচনায় যোগ দেওয়ার পূর্বক্ষণে ঘাড় ফিরিয়ে প্রেস গ্যালারির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, আশ্বস্ত হতে চান তাঁদের পছন্দের সাংবাদিকটি উপস্থিত আছেন কিনা, শেষোক্ত জনকে চোখে না পড়লে মাননীয় সদস্য ফের আসন পরিগ্রহ করেন, কারণ স্পষ্ট।

মেঘনাদ সাহা, ফিরোজ গান্ধি, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, কে টি শাহদের সংসদ থেকে বহুদূর চলে এসেছি আমরা। ভাষার সৌকর্যপ্রদর্শনের ঋতু অবসিত, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার। বাগ্‌বৈদগ্ধ্যের বিনিময়-প্রতিবিনিময়ও ক্রমশ নির্বাপিত। চতুর আক্রমণ প্রতি-আক্রমণে, অথচ সুভদ্র বাক্যব্যবহারে, পরস্পরকে বিদ্ধ করবার শৌখিনতাও আর কল্পনা করা সম্ভব নয়। এখন রীতি দাঁড়িয়ে গেছে প্রতিদিন অধিবেশনের প্রথম আড়াই ঘণ্টা, অর্থাৎ প্রশ্নোত্তরের সময়, মুক্ত প্রহরে অথবা দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব আলোচনার কালে, সদস্যরা যথেষ্ট পরিমাণে উপস্থিত। প্রেস গ্যালারিতেও তখন অধিকাংশ দিনই উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু মধ্যাহ্ণ বিরতির পর, দুপুর আড়াইটে-তিনটে নাগাদ, সভা যখন ফের বসে, প্রায়-শূন্য অধিবেশন কক্ষ, সমপরিমাণ শূন্য প্রেস গ্যালারি। হয়তো কোনও আইন প্রণয়ন করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা, কিংবা দেশের অর্থনীতি নিয়ে, গ্রামোন্নয়নের সমস্যা অথবা নারী নির্যাতন সমস্যা নিয়ে। যাঁরা বলবেন তাঁরা থাকেন, একজন-দু’জন মন্ত্রী থাকেন, দয়াপরবশ হয়ে আরও দু’একজন থাকেন, কারণ তাঁরা সৌজন্যে বিশ্বাস করেন। বিরস দিন, বিরল কাজ, প্রবল বিদ্রোহে অধিকাংশ সদস্য হয় নিজ-নিজ আবাসে দিবানিদ্রায় মগ্ন, কিংবা সংসদভবনের কেন্দ্রীয় হলে বসে তাঁদের নরক গুলজার। বিকেলের দিকে বেশ কিছু তন্নিষ্ঠমনা সাংসদ সুন্দর সুচিন্তিত বক্তব্য পেশ করেন দেশের প্রধান সমস্যাদি নিয়ে; সেসব বক্তব্য ধারাবিবরণীতে নিঃসাড় লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে, সংবাদপত্রে কোনও প্রতিবেদন জায়গা পায় না, বেতার-দূরদর্শনেও না। ইংরেজিতে বক্তৃতা দিলে তো পরিস্থিতি শশাচনীয়তর, সব মিলিয়ে বড়ো জোর কুড়ি-পঁচিশজন বসে থাকেন, যিনি বলছেন তাঁর দলভুক্ত কেউ-কেউ, অন্য দলের মুষ্টিমেয় কয়েকজন অবশ্য মন্ত্রীর বক্তৃতা থাকলে সংখ্যা একটু ভারি হয়, আর যদি ভোটাভুটির ব্যাপার থাকে, তা হলে ঘণ্টা বাজে, এখান-ওখান থেকে পালিয়ে-বেড়াননা সদস্যরা জড়ো হন, ভোটপর্ব সমাধা হওয়া মাত্র তাঁদের শনৈঃ পুনঃপ্রস্থান, ভারতীয় গণতন্ত্র যে দীর্ঘজীবী হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *