ছাব্বিশ
গত পঁচিশ বছরে পশ্চিম বাংলার সামগ্রিক রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামোয়, সবাই মানুন না মানুন, অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে; জ্যোতিবাবুর ব্যক্তিত্ব তথা নেতৃত্বের মহীরুহপ্রতিম উপস্থিতি ব্যতীত তা অসম্ভব ছিল। আরও যা হতে পারতো তা কেন পুরোপুরি হলো না, আমার কাছে তার দু’টি ব্যাখ্যা আছে, উভয় ব্যাখ্যার সঙ্গেই অথচ জ্যোতিবাবুর অভিজ্ঞতাসঞ্জাত বিবেচনা জড়ানো। লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ বইটি জ্যোতিবাবু আদ্যোপান্ত পড়েছেন, মার্কসীয় ধ্রুপদী সাহিত্যের আরণ্যক ভিড়ের মধ্যে এই গ্রন্থখানার কথাই তিনি বহুবার উল্লেখ করেছেন। অথচ যা ঈষৎ হেঁয়ালি, রাজপুরুষদের স্বভাবচরিত্র বিচারে লেনিনের মন্তব্য অনেকটা পাশ কাটিয়ে জ্যোতিবাবু এ ব্যাপারে খাঁটি বৃটিশ ধাঁচের উদারনৈতিক। আমলাদের আলাদা কোনও পছন্দ বা প্রবণতার কথা আমল দিতে বরাবরই তাঁর ঈষৎ অনীহা; মন্ত্রীরা যে-নির্দেশ দেবেন, রাজপুরুষ সম্প্রদায় তা পুত্তলিকাবৎ মেনে নিয়ে পালন করবেন, এটাই যেন তাঁর ধ্রুব বিশ্বাস, এখনও তিনি সম্ভবত সেই বিশ্বাসে অটল আছেন। তাই ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে অভূতপূর্ব জনসমর্থন সত্ত্বেও প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে মাথা ঘামাতে তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল না; আমরা-যা-বলবো-ওরা-তাই-শুনবে গোছের মানসিকতায় তিনি অবিচল।
দ্বিতীয় কারণ আর-একটু জটিল; কেউ যদি বলেন তা আমার মানসকল্পিত, তর্কে নামবো না। হয়তো জ্যোতিবাবু মনে-মনে ভেবেছিলেন, দুই যুক্তফ্রন্টের সময়কালে হরেকৃষ্ণ কোঙার গ্রামাঞ্চলে ভূমিবিন্যাস পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটু যেন বেশি দ্রুত এগিয়ে গিয়েছিলেন, যার পরিণাম সর্ব অর্থে দলের পক্ষে শুভফলপ্রসূ হয়নি। যাঁরা ভূমিচ্যুত হলেন তাঁরা ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ মুখর হয়ে উঠলো, এমনকি যাঁরা মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির দিকে সহানুভূতি-আপ্লুত হয়ে এগোচ্ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও কেউ-কেউ সাময়িকভাবে পিছিয়ে গেলেন, সব মিলিয়ে মহাকরণে সর্বাত্মক আধিপত্য স্থাপনের ক্ষেত্রে দলকে প্রায় দশ বছর আরও অপেক্ষা করতে হলো। দ্বিতীয়বার সেরকম ভুল করতে জ্যোতিবাবু, আমার ধারণা, রাজি ছিলেন না, তাঁর প্রতিজ্ঞা চুলচেরা বিচার করে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়া, হঠকারিতায় ভীরু দ্বার ভেঙে দেওয়ার দঙ্গলে তিনি নেই। প্রশাসনে শ্লথতা আছে তো কী আর করা যাবে, আপাতত তা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই: উপর মহলের আমলাদের মন থেকে বামফ্রন্ট সম্বন্ধে সন্দেহ-দ্বিধা সর্বাগ্রে দূর করতে হবে। এই সতর্কতা জ্যোতিবাবু অনেক ক্ষেত্রেই আকারে-ইঙ্গিতে ব্যক্ত করছিলেন সেই সময়।
এমন নয় যে সমস্যার আকীর্ণতা সম্পর্কে তিনি আদৌ ভিন্ন মত পোষণ করতেন, বরঞ্চ তাঁর বিশ্লেষণক্ষমতা ও দূরদর্শিতাবোধ অন্য অনেককে ছাড়িয়ে। সাতাত্তর সালে বামফ্রন্ট সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের পূর্ববর্তী দীর্ঘ পনেরো বছর জুড়ে পশ্চিম বাংলায় বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আদৌ কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। ঊনসত্তর সালে, দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের স্বল্পকালীন ঋতুতে, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কাতর আবেদন পাঠানো হয়েছিল প্রধান মন্ত্রী তথা যোজনা কমিশনের সভানেত্রীর কাছে। ইন্দিরা গান্ধি অল্প কথায় জবাব দিয়েছিলেন, পশ্চিম বাংলার চিন্তার কারণ নেই, রাজ্যে বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দিলে, দেশের অন্যত্র-উৎপাদিত বিদ্যুৎ থেকে তা পূরণ করা হবে। প্রতিশ্রুতিই সার: বছরের পর বছর, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কলকাতায়, মফঃস্বলে, নিকষ অন্ধকারের রাজত্ব। সাতাত্তর সালে সরকারে প্রবেশের পর প্রথম কয়েক মাস, জ্যোতিবাবু হয়তো কোনও সভা করতে হুগলি বা হাওড়া বা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় গিয়েছিলেন, সন্ধ্যা একটু গাঢ় হলে ফেরার পথে মাঝে-মাঝে খানিকক্ষণের জন্য আমাদের ফ্ল্যাটে বসে যেতেন, সখেদে, চিন্তায় আকুল হয়ে বলতেন: ‘কুড়ি-পঁচিশ মাইল এলাম, পুরোটা অন্ধকার।’ ওরই কাছাকাছি সময়ে এক অপরাহ্নে দিল্লির হাওয়াই আড্ডার সুসজ্জিত অপেক্ষাকক্ষে দু’জনে বসে আছি, কলকাতার বিমান ধরবো, হঠাৎ তিনি মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন: ‘এই যে বিরাট আরামের মধ্যে এই ঘরে আমরা দু’জন ডুবে আছি, ভাবুন তো একবার, কল্পনা করুন আপনি বামফ্রন্টের মন্ত্রী নন, কংগ্রেসের মন্ত্রী; তাহলে রাজ্যে কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, লক্ষ-লক্ষ বেকার, এত বিদ্যুৎসংকট, এত দারিদ্র-বুভুক্ষা, এ সমস্ত কোনও কিছু নিয়েই আপনাকে চিন্তা করতে হতো না’।
বিদ্যুৎসংকট নিয়ে অত ভাবিত ছিলেন বলেই জ্যোতিবাবু সংশ্লিষ্ট দফতরটি নিজের হাতে রাখা সাব্যস্ত করেছিলেন, তেমন পরামর্শ বোধহয় ওঁর আশেপাশে স্থিত শুভানুধ্যায়ীদের দেওয়া। সিদ্ধান্তটি মনে হয় যথার্থ ছিল না। মুখ্যমন্ত্রীর হাজার রকম দায়িত্ব, কাতারে- কাতারে মানুষজন আসছেন, তাঁদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, প্রশাসনের সার্বিক দায়ভার, আইনশৃঙ্খলা ও পুলিশি ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান, তার উপর দলের অন্যতম প্রধান নেতা হিশেবে আরও অগণিত কর্তব্য; এই অবস্থায় বিদ্যুৎ দফতরের বাড়তি চাপ ঠিক বাঞ্ছনীয় ছিল না। অনেক বছর ধরে রাজ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার প্রসার অবরুদ্ধ, কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন ও রাজ্য বিদ্যুৎ বোর্ডের মধ্যে সুষ্ঠু বোঝাপড়া স্থাপনের প্রশ্ন, মফঃস্বল ও গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎপ্রবাহ বিস্তারের অগুনতি সমস্যা, বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য অর্থ বরাদ্দ যথাযথ হলো কিনা সেদিকে নজর রাখা, বিদ্যুৎশিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিককুলের প্রত্যাশা পূরণের সমস্যা: কোনও-কিছুই হেলাফেলা করবার ব্যাপার নয়, মুখ্যমন্ত্রীকে সে সমস্ত কিছুর সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণের আবদার জানানো অসমীচীন। একটু দেরিতে হলেও জ্যোতিবাবু সম্ভবত তা বুঝতে পেরেছিলেন। বিরাশি সালে ফের নির্বাচনে জিতে যখন নতুন বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হলো, বিদ্যুৎ দফতরের দায়িত্ব আলাদা করে পাখি—প্রবীর—সেনগুপ্তকে দেওয়া হলো। পাখি সেনগুপ্ত এখন প্রয়াত, তাঁর নাম অনেকেরই ভুলে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু যে ক’বছর পাখি বিদ্যুৎ দফতরের দায়িত্বে ছিলেন, প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন, গোঁড়া কমিউনিস্টের মতো আগাপাশতলা গোঁয়ার, অধ্যবসায় ও দৃঢ়চিত্ততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি—এবং পরে শঙ্কর সেন—বিদ্যুৎ উৎপাদনে চমকপ্রদ উন্নতি ঘটিয়েছিলেন, সেই হেতুই পশ্চিম বাংলায় সামগ্রিক বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভারতবর্ষের প্রায় অন্য যে কোনও অঞ্চলের চেয়ে এখন ঢের, ঢের ভাল।
সাতাত্তর সালে প্রত্যাবর্তন করি। ভোট অন অ্যাকাউন্টের পর বছরের পাকা বাজেট তৈরির দিকে মনঃসংযোগ করতে হলো। বিভাগীয় সচিবদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বললাম, মন্ত্রীদের সঙ্গেও। তখনও বিদেশী ভাষায় যাকে বলা হয় মধুচন্দ্রিমা মুহূর্ত, তার যবনিকা পড়েনি, কোনওদিক থেকেই বরাদ্দ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তেমন অসুবিধা দেখা দিল না। দিল্লি গিয়ে যোজনা কমিশনের সঙ্গে ঝুলোঝুলি করে রাজ্যের বার্ষিক পরিকল্পনার আয়তনও অনেকটা বাড়িয়ে নিয়ে এলাম। বৃত্তিতে আমার সতীর্থ, যদিও বয়সে অনেকটা বড়ো, অধ্যাপক লাকড়াওয়ালা কমিশনের কার্যকরী সভাপতি, অন্য অনেকেই চেনা-জানা, একজন অর্থনীতিবিদকে পশ্চিম বাংলায় অর্থ বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সবাই বেশ খুশি, ঝড়ঝাপ্টার মরশুম তখনও অনাগত।
বরাদ্দ বাড়ালেই তো হয় না, প্রধান কাজ সরকারের উপার্জন বাড়ানো। স্বাধীনতার পর থেকেই রাজ্যে ঢিলেঢালা প্রশাসন, গা-ছাড়া ভাব। প্রথম বার, যখন দিল্লিতে পরিকল্পনা-বরাদ্দ নিয়ে বৈঠক করতে যাই, কলকাতায় দফতরের এক উপসচিব, মনে করলেন খুশি করবার মতো রসিকতা করছেন, বললেন: ‘স্যার, দিল্লি থেকে পরিকল্পনা-বরাদ্দ দয়া করে বেশি বাড়িয়ে আনবেন না, বরাদ্দ বাড়লেই আমাদের বেশি খাটতে হবে’। আমাদের যুদ্ধ তো এ ধরনের মানসিকতা-সংস্কৃতি-আচরণের বিরুদ্ধে। সংবিধানের নিগড়ে বাঁধা আমরা, বাজার থেকে যত টাকা ঋণপত্র ছেড়ে কেন্দ্রীয় সরকার সংগ্রহ করে, তার এক-দশমাংশও তিরিশটি রাজ্য মিলিয়ে পায় না। আবগারি বাদ দিয়ে অন্য সবরকম উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে অন্তঃশুল্ক আরোপের অধিকার কেন্দ্রের এক্তিয়ারে। আয়করের নিয়মকলা নিরূপণ করে কেন্দ্র; অন্তঃশুল্ক ও আয়কর থেকে সংগৃহীত রাজস্বের একটি অংশ যদিও রাজ্যগুলির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়, কী হারে কর বসবে তা স্থির করে নতুন দিল্লির সরকার। কোম্পানির উপর কর, আমদানি ও রপ্তানির উপর কর, দুই-ই কেন্দ্রের আওতাভুক্ত। রাজ্যগুলির সাংবিধানিক অধিকার প্রধানত ক্রয়-বিক্রয়ের উপর কর বসানোয়, সেই সঙ্গে আমোদপ্রমোদের উপর কর, এমনধারা আরও অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ একটি-দু’টি করপ্রয়োগের দায়িত্ব। যদিও তাদের কৃষি কর বসানোর অধিকার আছে, বৃটিশ শাসনের নির্দয় শোষণের অধ্যায় স্মরণ করে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে একেবারে গোড়া থেকেই কৃষিভূমির উপর রাজস্ব অনেকটাই হ্রাস করে দেওয়া হয়েছিল, সেই ধারা অব্যাহত।
কোনওদিনই অপ্রিয়ভাজন হতে আমার অসুবিধা নেই, প্রথম থেকেই রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির কর্তব্যে একাগ্রচিত্ত হলাম। প্রথমে বেছে নিলাম বিক্রয় করের চৌহদ্দি; সেই সঙ্গে দিশি-বিদেশী মদ ও গাঁজার উপরও বাড়তি রাজস্ব চাপানো হলো। কৃষি করের সমস্যাটি রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর; জমিদার-জোতদারদের উপরই শুধু চাপ পড়বে, ছোটো চাষী-ভাগচাষীদের উপর পীড়ন কম হবে কিম্বা আদৌ হবে না, এরকম ব্যবস্থা গ্রহণ তত সহজ নয়, হাজার-হাজার গ্রাম থেকে এই রাজস্ব সংগ্রহে নানা কার্যকরী সমস্যাও থাকে। এসব সমস্যা নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছে ইকবাল গুলাটি, তাকে আমন্ত্রণ করে কলকাতায় নিয়ে এলাম, প্রমোদ দাশগুপ্ত ও জ্যোতিবাবুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলাম, গুলাটি তার মতো করে কৃ্ষিকরও ভূমিরাজস্বের সংগ্রহসম্ভাবনা ও প্রশাসনগত খুঁটিনাটি তাদের বুঝিয়ে বললো। যে ক’বছর অর্থমন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলাম, বার্ষিক বাজেটের আগে বুদ্ধিপরামর্শের জন্য ইকবাল গুলাটিকে ডেকে পাঠাতাম, ওটা প্রায় রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই প্রসঙ্গে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি এম জি কুট্টি-কেও। কুট্টি আই এ এস অফিসার, যদিও তথাকথিত সিনিয়ারিটিতে একটু পিছিয়ে ছিলেন, তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও পরিশ্রমক্ষমতা সম্বন্ধে নিঃসংশয় হয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁকে অর্থসচিব পদে নিয়োগ করা হলো। সাতাত্তর সাল থেকে ছিয়াশি সাল, মোটামুটি এই দীর্ঘ সময়, শেষ দিকটা বাদ দিয়ে, কুট্টি অর্থবিভাগের প্রশাসনিক দায়িত্বে থেকে আমাকে সাহায্য করেছেন। মন্ত্রীকে যথাযথ সম্মান দিতে তাঁর দিক থেকে কোনও ক্রটি ছিল না, তা সত্ত্বেও আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ক্রমে-ক্রমে বন্ধুত্বের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল, তাঁর অকালপ্রয়াণে মর্মস্তুদ আঘাত পেয়েছিলাম। আমার মেয়াদের শেষ দেড় বছর-দুই বছর যিনি অর্থসচিব ছিলেন, প্রদ্যোৎ সরকার, স্থিতধী মানুষ, তাঁর কাছ থেকেও অঢেল সাহায্য পেয়েছি।
এক ধরনের বোঝাপড়ার মতো হয়ে গিয়েছিল জ্যোতিবাবুর সঙ্গে। অর্থমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রককে কেউই বিশেষ পছন্দ করেন না, পৃথিবীর ইতিহাসে জনপ্রিয় অর্থমন্ত্রী বিরল জীব। যে-কোনও দেশেই অর্থমন্ত্রী সাধারণত কয়েক বছরের বেশি টেকেন না, আমাদের দেশেও তার তেমন ব্যতিক্রম ঘটেনি। জ্যোতিবাবুকে বললাম, অর্থমন্ত্রীকে গালমন্দ দিলে ক্ষতি নেই, মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে অবশ্য অন্য কথা; অন্যায় বা অযৌক্তিক উপরোধ-অনুরোধ এলে আমি প্রত্যাখ্যান করবো, পরে বৃহত্তর স্বার্থে তাদের একটি-দু’টি যদি মঞ্জুর করতে হয়, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তা করবেন। অন্য একটি কথাও এই সুযোগে যোগ করা কর্তব্য মনে করছি। রাইটার্স বিল্ডিঙে ঢোকার কয়েকদিনের মধ্যেই জ্যোতিবাবু আমাকে কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমার নাম করে চেনা-জানা, কিংবা সম্পূর্ণ অচেনা যে-কেউই যদি আপনার কাছে কোনও দরবার করেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই আবদার বাতিল করে দেবেন।’
মহাকরণে মনঃসংযোগ সহকারে কাজ করার অসুবিধা দেখা দিল অন্য দিক থেকে। উদাহরণ-সহ বোঝাচ্ছি। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে বাজেটের কোনও জটিল সমস্যা নিয়ে নিভৃতে হয়তো কথা বলছি, এমন সময় ঝড়ের মতো দরজা ঠেলে জনৈক মন্ত্রীর প্রবেশ, তিনি এক শরিক দলের, বাজারে কোনওদিনই তাঁর ঠিক সুনাম নেই, তাঁর দলেও নেই, কিন্তু অনেক বছর ধরে জ্যোতিবাবুর কাছে প্রশ্রয় পেয়ে এসেছেন, জনশ্রুতি, মন্ত্রীর পদ অপব্যবহার করে তিনি প্রচুর টাকা তুলছেন, খানিকটা ভাগ নিজের দলকে দিচ্ছেন, দলও তাই তেমন অখুশি নয়। মন্ত্রীপ্রবর ঢুকলেন, সঙ্গে খেলার জগতের এক চাঁই, সর্বযুগের সর্বোত্তম ফুটবল খেলোয়াড় নাকি কলকাতায় আসছেন, তাঁকে কী-কী রাজকীয় সম্বর্ধনা দেওয়া যায় তা নিয়ে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় ইচ্ছুক, বাজেটের জটিল সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গোপন প্রশ্নাবলী শিকেয় তোলা থাক। কে জানে, আমার এ ধরনের অসন্তোষ-অভিযোগই সম্ভবত বাড়াবাড়ি। রাজনীতির প্রাঙ্গণে যাঁরা দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন, লঘু ও গুরুর মধ্যে মিহিন পার্থক্য টানতে তাঁদের নানা ব্যবহারিক অসুবিধা; আমার কাছে যা দৃষ্টিকটু, তাঁদের কাছে তা স্বাভাবিক। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বৈঠকে বসেও দেখেছি, আধঘণ্টা আলোচনা হয়েছে কি হয়নি, হঠাৎ বিভিন্ন দিক থেকে শোর উঠলো: ‘চা কোথায়, মিষ্টি কোথায়!’ শুধু শরিক দলের ওই মন্ত্রীকে একা বাণবিদ্ধ করে লাভ নেই, ব্যাধিটি প্রায় সর্বব্যাপী। তবে ওই ভদ্রলোক সম্বন্ধে এটুকু অন্তত বলা চলে, তিনি ছিলেন ঊর্ধ্বহিতাহিত, ন্যায় ও অন্যায়, ভালো ও মন্দ, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ টানতে পারতেন না। একেবারে হালে আরও একজন-দু’জন মন্ত্রীকে দেখেছি, বাম ফ্রন্টের প্রধান দলের মধ্যেও দেখেছি, যাঁরাও এই বিভক্তিকরণে সম্পূর্ণ অপারগ।
ফ্রন্ট সরকারের প্রথম পর্বে অপর এক অভিজ্ঞতার কথাও বলি। কোনও বিষয়ে মন্ত্রীদের মধ্যে আলোচনা চলছে, মুখ্যমন্ত্রীও উপস্থিত, খেলার মাঠে বা অন্য কোথাও ভি আই পি ব্লকের কথা উঠলো, সবিনয়ে বললাম, আমাদের সরকার বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী, সাম্যবাদে বিশ্বাসী, ভি আই পি-নামা এই কলোনিয়াল বস্তুটি এবার তুলে দেওয়া যাক, জনসাধারণ তা পছন্দ করবেন, আদর্শের প্রতি আমাদের আস্থাশীলতারও আমরা প্রমাণ দাখিল করতে পারবো। যেন মৌচাকে ঢিল পড়লো, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী আমার আহাম্মকির নিন্দায় মুখর হলেন। সবচেয়ে উচ্চ বজ্রনিনাদ এক শরিক দলের মন্ত্রীর, বাজারে তখন তাঁর ঘোর বিপ্লবী—প্রায়-নকশাল— বলে পরিচিতি। আমার নটে গাছটি মুড়োলো, ভি আই পি-উপাসনা গত পঁচিশ বছরে তো বহুগুণ প্রসারিততরই হয়েছে।
সমান খারাপ লাগতো মন্ত্রীদের আলো জ্বালিয়ে, ভেঁপু বাজিয়ে, রক্ষী-পরিবৃত হয়ে গাড়িতে পরিভ্রমণ। যে ক’বছর মহাকরণে ছিলাম, দায়ে না পড়লে গাড়ির চালককে কোনওদিনই আলো জ্বালাতে বা ভেঁপু বাজাতে দিইনি, আর রক্ষী তো আমার কোনওকালেই ছিল না; একমাত্র ‘সঞ্চয়িতা’ পর্বে— যে-কাহিনীতে পরে আসছি— প্রমোদবাবু গাড়িতে রক্ষী নেওয়ার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তবে সেই নির্দেশ ছ’মাসের বেশি পালন করিনি, ততদিনে ওই বিশেষ উপদ্রবটিও থিতিয়ে এসেছিল।
একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে নিয়মের কড়াকড়ি বুঝতে পারি, অন্য মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে আলো বা ভেঁপুর প্রয়োজন আদৌ আছে বলে এখনও মনে হয় না। হিশেব করে দেখেছি, কলকাতার রাস্তায় পাঁচ মাইল অতিক্রম করতে গেলে আলো বা ভেঁপুর প্রয়োগ না করলে বড়ো জোর পাঁচ মিনিট বাড়তি সময় লাগে গন্তব্যস্থলে পৌঁছুতে, সেটা এমন কিছু গুরুতর ক্ষতি নয়, পাঁচ মিনিট আগে বেরোলেই তো হয়। সম্প্রতি এক মন্ত্রীর কথা শুনতে পাই, তিনি প্রাতঃভ্রমণে বেরান, সামনে দুই কনস্টেবল, পিছনে আরও দুই। যা আরও মারাত্মক কথা, মন্ত্রী মশাই বেড়ানোর ফাঁকে-ফাঁকে মাঝে-মাঝে থেমে গিয়ে একটু ডন-বৈঠক করেন, তখন নাকি ওই চার কনস্টেবলও তাঁকে অনুসরণ করে ডন-বৈঠকে ব্যাপৃত হন। ওয়াজেদ আলি সাহেব সাধে কি আর লিখেছিলেন, অনাদি অনন্ত ভারতবর্ষ, ঐতিহ্যের উপসংহার নেই।
এখন অবশ্য ধুয়ো উঠেছে মন্ত্রীরা সন্ত্রাসের শিকার হতে পারেন, অতএব সুরক্ষা চাই। আমার সারা অন্তঃকরণ জুড়ে আপত্তি: যদি জনগণের মন্ত্রী বলে নিজেদের দাবি করি, প্রহরার ঘেরাটোপ সম্পর্কে বিতৃষ্ণার ভাব পোষণ করাই তো স্বাভাবিক; যদি তার অন্যথা ঘটে, তা হলে বৃথাই জনগণের সঙ্গে মাছের মতো মিশে যাওয়ার অঙ্গীকার। তবে, ধরেই নিচ্ছি, আমার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন না।
ওই কয় বছর জ্যোতিবাবুকে খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম বলে একটি-দু’টি অন্য প্রসঙ্গও উত্থাপন করতে চাইছি। জননেতা হিশেবে তাঁর এন্তার বক্তৃতা বহুদিন ধরে শুনেছি, কাটা-কাটা অর্ধসমাপ্ত বাক্য, শ্লেষের ফুলঝুড়ি, অন্যকে হাসান, নিজে কখনও হাসেন না, অথচ সব মিলিয়ে পুরো ভাষণে যুক্তির গ্রন্থন আবিষ্কারান্তে তৃপ্ত হতেই হয়। মহাকরণের অলিন্দে ওঁর বলার আদল একটু অন্যরকম, তা সে বাংলাতেই হোক বা ইংরেজিতে। শ্লেষ-বিদ্রূপের লেশমাত্র নেই, যে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে তার নির্যাসটুকু স্বচ্ছন্দ বাক্যবন্ধে তুলে আনছেন, তাঁর এই অনায়াসসাচ্ছল্য প্রতিবার মস্ত বিস্ময়জনক বলে ঠেকতো। আলোচ্য বিষয় নিয়ে হয়তো তাঁর কোনও পূর্বচর্চা নেই, কিছুই যায় আসে না তাতে। অর্থনীতি-সংক্রান্ত বিষয় হোক, কিম্বা সেচের প্রসঙ্গ, জল নিকাশের বা রাস্তা তৈরির ব্যাপার, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে সমস্যার গভীরে চলে যেতে পারেন, যা আমার কাছে অন্তত বারবার প্রমাণ করতো, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের বাইরে বিশেষ বিষয়াশ্রিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলন তেমন জরুরি নয়, অন্তত ফলিত রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে, কেন্দ্রে এবং অন্যান্য রাজ্যে, বিভিন্ন দলের অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে, জ্যোতিবাবুর তুল্য বুদ্ধির প্রাখর্য কারও মধ্যেই তেমন লক্ষ্য করিনি; ব্যতিক্রম, অনেকে হয়তো শুনে একটু অবাক হবেন, মধ্য-পর্যায়ের ইন্দিরা গান্ধি ও জগজীবন রাম, মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে রাজস্থানের মোহনলাল সুখাড়িয়া।
অনেক বিষয়ে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে মতে মিলতো, অনেক বিষয়ে মিলতোও না। ওঁর প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা-প্রদর্শনে আমার দিক থেকে কোনওদিন ব্যত্যয় ঘটেনি, তা হলেও যখন মতদ্বৈধতা প্রকাশ করা প্রয়োজন মনে হয়েছে, করেছি, তর্ক করেছি, ফাইলে কড়া নোটও পাঠিয়েছি কখনও-কখনও। কিন্তু যে-ক্ষেত্রে, যে-কারণেই হোক, বিশদ আলোচনায় তিনি অনাগ্রহী, খানিক দূর গিয়ে আর এগোনো সম্ভব হতো না। তথাচ বলি, আমার চেয়ে বয়সে তেরো-চোদ্দ বছরের বড়ো, তবু ব্যক্তি হিশেবে আমাকে সম্ভ্রম জানাতে কদাপি তাঁর বিন্দুতম ক্রটি ঘটেনি। একটি বিশেষ ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির দুস্তর ব্যবধানের জন্য ছিয়াশি সালের জানুয়ারি মাসে মহাকরণ ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে থাকা যখন মনস্থ করলাম, তারপরও কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধানিবেদনে বিচ্যুতি ঘটেনি, একদিনের জন্যও না।
তার মানে এই নয় যে জ্যোতিবাবু আমাকে ছেড়ে কথা কইতেন। একদিনের কথা মনে পড়ে: দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক, কী একটা সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য আমাকে ডাকা হয়েছে, জ্যোতিবাবর এক মত, আমার সম্পূর্ণ ভিন্ন, অন্য যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা প্রায় সবাই নির্বাক শ্রোতা, ঘণ্টাখানেক ধরে তর্ক চলছে, আমি নাছোড়বান্দা, সকলেই উসখুস, হঠাৎ জ্যোতিবাবু অতি নাটকীয় ভঙ্গিতে আমার দিকে ফিরে অভিবাদনের ছলে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে তীক্ষ্ণ উচ্চারণে বললেন: ‘আমি আপনার কাছে অনেক অনেক ক্ষমা চাইছি, ভুলে গিয়েছিলম যে আপনি বুদ্ধিজীবী, আমরা সাধারণ মানুষ যা তিরিশ সেকেন্ডে বুঝতে পারি, আপনার মতো ইনটেলেকচুয়ালদের সেটা বুঝতে দেড়ঘণ্টা পেরিয়ে যায়।’ এতটুকু বিরক্ত না হয়ে আমি হেসে ফেলি।
ফের পিছিয়ে যাই। সাতাত্তর সালের বাজেট পেশ করা হলো, সম্ভবত এই প্রথম ইংরেজি ও বাংলাতে বাজেটের ভাষ্য মন্ত্রী স্বয়ং রচনা করলেন। তখনও আমরা স্বপ্নের ভেলায় ভেসে বেড়াচ্ছি, অনেক উদ্যোগের কথা বলছি, অনেক অঙ্গীকারের কথা, বিশেষ করে গ্রামীণ পরিকল্পনা নিয়ে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পুরোপুরি পাল্টে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্যবর্তিতায় ত্রিস্তর পরিকাঠামো সক্রিয় করা নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে, তার কিছু ইঙ্গিত বাজেট ভাষণে ছিল, ক্রয়-বিক্রয় করের পুনর্বিন্যাস করে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহের কথাও বলা হয়েছিল।
বাজেটের একটি প্রস্তাব নিয়ে কলকাতার চলচ্চিত্র পরিচালকদের এক মহল আমার উপর বিশেষ কুপিত হয়েছিলেন: টিকিটের হার, শাদা-কালো ছবির ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য, রঙিন ছবির ক্ষেত্রে তা থেকে অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমার যুক্তি ছিল শাদা-কালো ছবি প্রধানত মফঃস্বলে-গ্রামাঞ্চলে প্রদর্শিত হয়, সেখানে প্রমোদ করের বোঝা বাড়ানো অনুচিত, কিন্তু শহরের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষ হলিউডের বা মুম্বাই-মাদ্রাজের নর্তন-কুর্তনসংপৃক্ত রঙিন ছবি দেখছেন, তাঁদের উপর কেন একটু বেশি ভার চাপানো চলবে না। যে-পরিচালকরা আপত্তি করছিলেন, তাঁদের আশঙ্কা, তাঁরা সদ্য-সদ্য রঙিন ছবি তৈরির কাজে হাত লাগিয়েছেন, টিকিটের দাম চড়া হলে লোকেরা দেখতে আসবে না। সেই যুক্তি মানতে পারিনি, তবে তাঁদের মান ভাঙাবার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে রঙিন ফিল্ম কলকাতাতেই যাতে দ্রুত পরিস্ফুটন সম্ভব হয়, সেই উদ্দেশ্যে একটি অত্যাধুনিক রাসায়নিক কারখানা সরকারি ব্যয়ে প্রস্তুত করে দেওয়া হবে। এই ঝামেলার সময় দল এবং চলচ্চিত্রকলাকুশলী কর্মীদের কাছ থেকে প্রচুর সাহায্য পেয়েছিলাম।
বাজেটের ব্যাপারে অন্য একটি সমস্যাও মাঝে-মাঝে দেখা দিত। বাজেট পেশের আগে কর আরোপের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা অবশ্যপালনীয়, সুতরাং অর্থমন্ত্রী হিশেবে আমার যা-যা বলার, অথবা পরামর্শ ও উপদেশ নেওয়ার, জ্যোতিবাবুকেই শুধু বলতাম, তাঁর কাছ থেকেই নিতাম। বিভাগীয় মন্ত্রীরা একটু ব্যথিত হতেন হয়তো, কিন্তু উপায় ছিল না। ১৯৭৮-৭৯ সালের বাজেটে বেকার ভাতা চালু করা হলো, গোটা ভারতবর্ষে সেই প্রথম, মাসিক অঙ্কের পরিমাণ অতি সামান্য, কিন্তু কর্মসংস্থানহীনদের প্রতি সমাজের যে দায়িত্ব তা স্বীকৃতি পেলো। আমার মনে উচ্চাশা ছিল ওই ভাতার বিনিময়ে বেকার যুবক-যুবতীরা কোনও সরকার-অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্পে যোগ দেবেন, সপ্তাহে দু’দিন বা মাসে আট দিন অন্যান্য বিভাগীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে এ-ব্যাপারে আগে থেকে আলোচনা করতে পারলে নিশ্চয়ই প্রকল্পটির সুষ্ঠুতর রূপ দেওয়া সম্ভব হতো, কিন্তু আমাকে কথা বলতে হয়েছিল তাঁদের সঙ্গে ধোঁয়াটে ভাষায়, আমার সন্দেহ তাতে তাঁরাও খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, আমারও পরিতৃপ্তির অভাব ঘটেছিল।
আরও কিছু সমস্যা-অস্বাচ্ছন্দ্যের প্রসঙ্গে আসি। মন্ত্রিসভায়, বিশেষ করে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে যাঁরা মনোনীত হয়েছিলেন, তাঁরা পূর্ববর্তী গোটা জীবনই কাটিয়েছেন কৃষক বা শ্রমিক আন্দোলনে, বছরের পর বছর ধরে জেলে অতিবাহিত করেছেন, কিংবা পুলিশের তাড়া খেয়ে ফিরেছেন, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা। অনেকেরই মহাকরণে ঢুকে ধাতস্থ হতে সময় লেগেছিল। তাঁদের এই আড়ষ্টতাবোধের কারণেই মনে হয় মহাকরণের কাজকর্ম তাঁদের তেমন আকৃষ্ট করেনি, বেশ কয়েকজন আস্তে-আস্তে তাই উঁচু মহলের রাজপুরুষদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন, অথবা অধস্তন সরকারি কর্মচারীদের একজন-দু’জন, যাঁরা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে কাছাকাছি, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছুতেন। দু’দিক থেকেই সংকট দেখা দিল: উপরতলার আমলাদের কথা বেশি শুনলে কর্মচারী সমিতির বন্ধুরা অসন্তুষ্ট হতেন, আর শেষোক্তদের অভিমতে সায় দিয়ে ফাইলে সই করলে উঁচুতলার আমলারা চটতেন। অনেকের ক্ষেত্রে তাই এমন হয়েছে রাজনৈতিক নেতা হিশেবে চমৎকার, শ্রমিক বা কৃষক নেতা রূপে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন, কিন্তু মন্ত্রী হিশেবে সামান্য অসফল।
জ্যোতিবাবুর সঙ্গে এসব বিষয়ে বিশদ করে আলোচনায় অসুবিধা ছিল। তিনি হয়তো শুনতেন, তবে বিস্তৃত আলোচনায় যেতে চাইতেন না, তার কারণ বুঝতে পারি, যাঁদের সম্বন্ধে আমি খুব সাবধানে ঘুরিয়ে উক্তি করছি, তাঁরা রাজনীতির বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। বরঞ্চ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে গিয়ে প্রমোদবাবুর সঙ্গে অনেক বেশি খোলামেলা আলোচনার সুযোগ থাকতো। প্রমোদবাবু কোনওদিন মহাকরণের চৌহদ্দিতে পা রাখেননি, অথচ প্রশাসনিক সমস্যাগুলি চট করে ধরতে পারতেন; ঠোঁট-কাটা মানুষ, যে কোনও মন্ত্রীকে ডেকে তাঁর বিভাগের কাজকর্ম নিয়ে সমালোচনামুখর হতে দ্বিধা বোধ করতেন না, প্রয়োজন মনে করলে আমাকেও ঝাড়তেন। একমাত্র জ্যোতিবাবুর সঙ্গে কিছু-কিছু ব্যাপারে খোলাখুলি কথা বলতে প্রমোদবাবুরও, আমার সন্দেহ, সামান্য জড়তা ছিল, মনে প্রশ্ন থাকলেও কোনও তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি ছাড়া রাজ্য প্রশাসনের খুঁটিনাটি নিয়ে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলতেন না, দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করতেন। মুখ্যমন্ত্রীর মূল্যবান সময় আমার বিবেচনায় নানা অকাজে ব্যয়িত হচ্ছে, তিনি যে-কোনও সুবিধাবাদী মানুষের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আজেবাজে জায়গায় যাচ্ছেন, অথচ প্রায়ই অনেক জরুরি ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করার সময় আমরা পাচ্ছি না: এ সমস্ত সমস্যায় ভাবিত হয়ে একবার প্রমোদবাবুকে একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কী করে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে আরও কিছু শৃঙ্খলা প্রবর্তন করা যায়; কোনও এক বিশেষ শরিকি মন্ত্রীর অত্যাচার থেকে জ্যোতিবাবুকে কী করে পরিত্রাণ দেওয়া যায়; কী করে উন্নয়নের কাজে জোয়ার আনা সম্ভব; কোন-কোন প্রকরণের সাহায্যে অন্তর্বিভাগীয় সংযোগ নিবিড়তর করা চলে। প্রমোদবাবু আমার সঙ্গে দ্বিমত হলেন না, কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবার জন্য উল্টে আমাকেই অনুরোধ করলেন, ইঙ্গিতটি ধরে ফেলে আমিও পিছিয়ে এলাম। স্নেহাংশু আচার্য প্রমোদবাবু ও জ্যোতিবাবুর সমান কাছাকাছি ছিলেন, জ্যোতিবাবুর কাছে কোনও স্পর্শকাতর ব্যাপারে কথা পাড়তে হলে প্রমোদবাবু কখনও-কখনও স্নেহাংশুবাবুকে দূত হিশেবে ব্যবহার করতেন; অন্তত সেরকমই আমার অনুমান।
অবিভক্ত পার্টিতে জ্যোতিবাবু স্বয়ং বেশ কয়েক বছর রাজ্য সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু পার্টি বিভক্ত হওয়ার পর দলের আয়তন ও সাংগঠনিক চরিত্র অনেক পাল্টেছে, জেলায়-জেলায় নতুন কর্মীরা এসেছেন, দলের গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। যে কারণেই হোক, জ্যোতিবাবুর সঙ্গে দলের অন্যান্য নেতা ও কর্মীদের বরাবরই যথেষ্ট সামাজিক দূরত্ব, যা প্রমোদবাবুর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। প্রমোদবাবু হাজার-হাজার দলের কর্মীদের আক্ষরিক অর্থেই চিনতেন, প্রত্যন্ত জেলার অখ্যাত গ্রামের সাধারণ স্তরের কর্মীদেরও, তাঁদের ব্যক্তিগত তথা সাংসারিক সমস্যার খবরাখবর রাখতেন, মুখগুলি চিনতেন, নামগুলি জানতেন। জ্যোতিবাবুর এ ব্যাপারে অদক্ষতা পার্টির মধ্যে কারও কাছে অজানা নয়, পুরনো দিনের কমরেডদের সঙ্গে চমৎকার আদান-প্রদান, অথচ নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাঁর অপরিচিত। একদিন বিধানসভায় তাঁর পাশে বসে আছি, কক্ষের অন্য প্রান্ত থেকে একজন সদস্য বিতর্কে যোগ দিয়ে বক্তব্য রাখছেন, হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে জ্যোতিবাবুর প্রশ্ন: ‘যিনি বক্তৃতা দিচ্ছেন, তিনি কোন দলের?’ কুণ্ঠায় জড়োসডো হয়ে জানাতে হলো, যিনি বলছেন তিনি তাঁরই দলের বিধায়ক, তাঁর কমরেড।
বিস্ময় বোধ করতাম অন্য একটি তথ্য আবিষ্কার করে। খুব গুছোননা মানুষ জ্যোতিবাবু, গ্রামে-শহরে সভাসমিতিই তোক কিংবা বিধানসভার অভ্যন্তরে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণই হোক, প্রতিটি বক্তৃতার জন্য তিনি এক-দুই-তিন করে বক্তব্য বিষয়ের ক্রমানুক্রমিক সাংকেতিক সারসংক্ষেপ লিপিবদ্ধ করে নিতেন, যাতে কোনও জরুরি কথা বলবার সময় ভুলে না যান। একদিন লক্ষ্য করলাম, কয়েক মিনিট বাদে যে-বক্তৃতা দিতে উঠবেন, তার প্রধান বিষয়গুলির সংক্ষিপ্ত উল্লেখ এক টুকরো কাগজে লিখছেন, ধরে-ধরে ইংরেজি ভাষায়। আমি একটু অবাক হয়ে তাকানোয় সবিনয়ে হেসে বললেন: ‘কী করবো বলুন, আমার শিক্ষা-দীক্ষা তো আপনাদের মতো সম্পূর্ণ নয়’। বিস্ময়ের ঘোর তবু কাটলো না; একটুও না থেমে শাণিত বাংলায় প্রহরের পর প্রহর বলে যাচ্ছেন, অথচ তা ইংরেজি নোট দেখে।
আরও যা উল্লেখনীয়, বাইরে থেকে জ্যোতিবাবুকে গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে থাকতে দেখা যায়, কিন্তু যাঁদের সঙ্গে সামান্যতম আন্তরিকতা, তাঁদের সঙ্গে গল্প করতে, হালকা প্রসঙ্গ নিয়ে সোচ্চার হতে, তিনি প্রচুর আরাম বরাবরই পেতেন, এখনও পান। প্রত্যেকটি মানুষকে, সে মানুষের বাইরের আভরণ-আচ্ছাদন-আচরণ যাই-ই হোক না কেন, তিনি সম্মান দিতে জানেন, কেউই বলতে পারবেন না জ্যোতিবাবুর কাছ থেকে, কোনও বিরল মুহূর্তেও, অসৌজন্য পেয়েছেন। এটা শুধু বাঙালি ভদ্রতার ব্যাপার নয়, যে-কোনও মানুষের প্রতি পর্যাপ্ত সম্ভ্রম জানানোর প্রবৃত্তি তাঁর মজ্জাগত। সাংবাদিকদের কৃপায় কথাটা ভীষণ ছড়িয়েছে যে জ্যোতিবাবু একমাত্র শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই খানাপিনা করতে পছন্দ করেন। এর চেয়ে অনৃতভাষণ কিছু হতে পারে না, যাঁরা এধরনের কথাবার্তা বলেন, জ্যোতিবাবুর সামগ্রিক জীবনপ্রবাহের কোনও ধারণাই তাঁদের নেই। জ্যোতিবাবু সব ধরনের খাবার পছন্দ করেন, বিলিতি খানা থেকে শুরু করে শাদামাটা বাঙালি খাদ্য, এমনকি দরিদ্রতম শ্রমিক বা কৃষক পরিবারের জীর্ণ কুটিরে গিয়ে ডাল-নুন-কাঁচালঙ্কা-মাখা আকাঁড়া ভাতও। যেখানেই খেতে বসেছেন, প্রচুর তৃপ্তির সঙ্গে খেয়েছেন, কোনওরকম দ্বিরুক্তি বা আপত্তি না জানিয়ে। এখন তো আর সেটা সম্ভব নয়, কিন্তু বছর পনেরো আগেও দেখেছি, বিয়ে বা অন্নপ্রাশনের পঙ্ক্তিভোজনে বসে তিনি পরম তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছেন।
প্রমোদবাবুর সঙ্গে তাঁর চরিত্রগত তফাত অবশ্য বরাবরই ছিল। জ্যোতিবাবু স্বভাবঅন্তর্মুখী, বাইরে আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ হ্রস্ব, সম্ভবত একটি বিশেষ পারিবারিক গণ্ডিতে বড় হওয়ার ফল। অন্য পক্ষে প্রমোদবাবু ধাপে-ধাপে পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্বে পৌঁছেছিলেন, সাধারণ বাঙালি ঘরের সন্তান, কিশোর বয়স থেকেই স্বদেশীতে মজে যাওয়া, প্রথম জীবনে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে কাটিয়েছেন, সাংসারিক বন্ধন গোড়া থেকেই প্রায় ছিন্ন, পার্টির কমিউনে বছরের পর বছর দিনযাপন, পার্টিই তাঁর সংসার, বিভিন্ন স্তরে পার্টি কর্মীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের নিবিড়তা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো, তবে তার অনুসরণ সম্ভব নয়। জ্যোতিবাবু সচ্ছল পরিবারের সন্তান, ছেলেবেলায় লোরেটোয়—হ্যাঁ এক বছরের জন্য লোরেটোয়—ও সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়েছেন, পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে, সেখান থেকে বিলেত চলে গেছেন, ব্যারিস্টারি পড়ার পাশাপাশি হ্যারি পলিট ও রজনী পালমা দত্তের কাছ থেকে সাম্যবাদে দীক্ষা, তবে মনের পলিমাটি, জ্যোতিবাবু অন্তত বলেন, কলকাতাতেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাঁর এক জ্যেঠামশাই এতই ইংরেজভক্ত ছিলেন যে বিদেশী প্রভুরা তাঁকে সামান্য মুনসেফ পদ থেকে উন্নত করে খোদ হাইকোর্টের বিচারকের আসনে বসিয়ে দিয়েছিলেন। বোমা-পিস্তল-ছোঁড়া যুবকদের বিচারের জন্য ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছিল তিরিশের দশকের মধ্য-সময়ে, তিনি সেই ট্রাইবুনালের দায়িত্বে। যুবকদের আস্তানা থেকে বাজেয়াপ্ত-করা নানা সাম্যবাদী আদর্শ-ঠাসা বই জ্যেঠামশাই বাড়িতে নিয়ে আসতেন। লুকিয়ে-চুরিয়ে সেগুলি পড়েই নাকি, জ্যোতিবাবু সামান্য গর্বের সঙ্গে দাবি করতেন, তিনি কমিউনিস্ট হয়ে যান মনের দিক থেকে, যা প্রকটতর রূপ পায় বিলেতে।
মহাকরণ ও বামফ্রন্ট-সংক্রান্ত অন্য বিষয়াদিতে প্রবেশ করবার আগে একজনের কথা বিশেষ করে অবশ্যই বলতে হয়, তিনি সত্যব্রত সেন। কৈশোর থেকেই প্রমোদ দাশগুপ্তের খুব ঘনিষ্ঠ সত্যব্রতবাবু, ধ্যানধারণায় অতিশয় গোঁড়া, সুতরাং ষাটের দশকে পার্টি যখন ভাগ হলো, তখন থেকে তিনি অবধারিতভাবেই সি পি আই এম-এ। পার্টির কেন্দ্রীয় দফতর সে সময় কলকাতায়, পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘পিপলস ডেমোক্রাসি’ কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হতো, অন্যান্য দায়িত্ব পালনের সঙ্গে-সঙ্গে সত্যব্রতবাবু ‘পিপলস ডেমোক্রাসি’-র সম্পাদকীয় বিভাগে লেখালেখির কাজ করতেন। রঞ্জন চৌধুরী ছদ্মনামে অনেক তাত্ত্বিক রচনার লেখক তিনি; সুধাংশু দাশগুপ্তের সম্পাদনায় ‘দেশহিতৈষী’, পার্টির বাংলা সাপ্তাহিক, তার সঙ্গেও যুক্ত। সাতাত্তর সালে নির্বাচনের সন্নিকট মুহূর্তে পার্টির সদর দফতর নতুন দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলো, সত্যব্রতবাবু দিল্লি চলে গেলেন। অর্থ ও উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রমোদবাবুর কাছে আরজি জানালাম, যে করেই হোক সত্যব্রতবাবুকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনতে হবে, তাঁকে সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা পদ গ্রহণে রাজি করাতে হবে। প্রমোদবাবু আবদার মানলেন, সত্যব্রতবাবু ফিরে এলেন, দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, কিন্তু মাত্র এক টাকা মাইনেতে। পরবর্তী বছরগুলি আমাদের বড়া আনন্দের সময় ছিল, পরিশ্রম করার আনন্দ, যৌথ উদ্যমে, কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করা যে অর্থনীতিই রাজনীতি, রাজনীতিই অর্থনীতি। এখানে আরও একজনের কথা উল্লেখ না করলে কৃতঘ্নতা হবে। আমার নির্বাচনী যুদ্ধে অন্যতম প্রধান সেনাপতি ছিলেন মলয় চট্টোপাধ্যায়: একদা ছাত্রনেতা, পরে ব্যাংক কর্মচারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ, প্রচুর সামাজিক গুণাবলীতে ভূষিত। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের কয়েকদিন বাদে অতি-সুদর্শন, বছর তিরিশের এক যুবককে নিয়ে রাইটার্স বিল্ডিঙে আমার ঘরে ঢুকে মলয়ের উক্তি: ‘ছেলেটিকে দেখুন, আপনার আপ্ত সহায়করূপে কাজ করবে।’ পাঁচ মিনিট কথা বলেই বুঝলাম, যুবকটি যেমন বুদ্ধিমান, তেমনই ঠাণ্ডা মাথার, আমার মতো সর্বদা-মাথা-গরম-করতে-থাকা মানুষের যথোপযুক্ত দাওয়াই, নাম সুজিত পোদ্দার। সুজিত গত পঁচিশ বছর সুখে-দুঃখে-হরিষে-বিষাদে আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে আছে। ঘরের মানুষ হয়ে গেছে সে, তার স্ত্রী-সন্তানরাও আমার এবং আমার স্ত্রীর আত্মীয়তম।
সত্যব্রত সেনের সঙ্গে আলোচনান্তে রাজ্য যোজনা পরিষদকে ঢেলে সাজাবার ব্যবস্থা হলো। এই পরিষদের ঐতিহ্যগত মন্ত্রীসংকুলতা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হলো আমাদের। প্রথা-অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রী পরিষদের সভাপতি, পরিকল্পনা মন্ত্রী সহ-সভাপতি, সেই সঙ্গে একগাদা অন্যান্য মন্ত্রীও সদস্য হিশেবে শোভাবর্ধন করতেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই, তাঁদের দিয়ে কাজের কাজ কিছুই হবার নয়, তাঁরা বকবকম করেই দায়মুক্ত। পশ্চিম বাংলার এত-এত সমস্যা, যে সব নিয়ে রাজ্য যোজনা পরিষদের তত্ত্বাবধানে প্রচুর চিন্তাসমৃদ্ধ গবেষণা জরুরি, যার ভিত্তিতে প্রকল্পরচনা প্রয়োজন, অনেক গভীরে যাওয়া প্রয়োজন, মন্ত্রী-ভারি যোজনা পরিষদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। সুতরাং ‘কেজো বিশেষজ্ঞদের আহ্বান জানিয়ে পরিষদের সদস্য করা হলো, তাঁদের উপর রাজ্য যোজনার সামগ্রিক দায়িত্ব, মুখ্যমন্ত্রী সভাপতি রইলেন পরিষদের গুরুত্ব বোঝাবার জন্য; অন্য মন্ত্রীরা, পরিকল্পনা মন্ত্রীসুদ্ধু, সবাই বাদ। বেশ কিছু মন্ত্রীর মুখ ভার, একটি বাহারি পালক যেন তাঁদের মাথার মুকুট থেকে খসিয়ে নেওয়া হলো। এবংবিধ আত্মগরিমাবোধজড়িত সমস্যা বহু ক্ষেত্রেই প্রচুর ক্ষতি করেছে। বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলিতে মন্ত্রীরা সভাপতি হিশেবে ছড়ি ঘোরাতে ভালোবাসেন, আসল কাজ তাতে কিছু হয় না: তাঁরা উপদেশ-পরামর্শ অবশ্যই দেবেন, বিভাগীয় মন্ত্রী হিশেবে তাঁদের সেই ভূমিকা থাকবেই, কিন্তু সংস্থার দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনার জন্য যে অভিজ্ঞতা ও পারদর্শিতা দরকার, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা তাঁদের নেই। তা সত্ত্বেও মন্ত্রীরা যদি সভাপতিরূপে বিরাজ করতে চান, তাতে ক্ষতি বই লাভ নেই, ছোটো-বড়ো ভ্ৰষ্টাচারের আশঙ্কাও বাড়ে। ইত্যাকার ব্যাপারে সতীর্থ মন্ত্রীদের প্রাণপণে বোঝাবার চেষ্টা করেছি; অসফল হয়ে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছি।